নিভৃতে_যতনে
Part_27,28
Writer_Asfiya_Islam_Jannat
Part_27
রান্নাঘরে আমি আর পলি আন্টি কাজ করছি। রুমেই মা রোয়েনের সারা শরীরে স্পঞ্জ করে দিচ্ছেন। বাবা যোহরের নামাজ পড়ে টিভিতে খবর দেখছেন। বেশ কিছুক্ষণ পর মা রোয়েনকে ফ্রেশ করিয়ে রান্নাঘরে আসেন। আমাকে টেবিলে খাবার সাজিয়ে দিতে বলে তিনি হাতমুখ ধুতে চলে যান। আমিও তার কথামত চটজলদি টেবিলে খাবার সাজিয়ে নিলাম। অতঃপর মা-বাবাকে ডেকে এনে চেয়ারে বসিয়ে দিলাম। নিজে তাদের প্ল্যাটে খাবার তুলে দিয়ে, আরেকটা প্ল্যাটে রোয়েনের জন্য খাবার তুলে নিলাম। খাবারের প্ল্যাটটা নিয়ে রওনা হলাম রুমের উদ্দেশ্যে। রুমে এসে দেখি রোয়েন শুয়ে শুয়ে মোবাইল দেখছে। দৃশ্যটা দেখামাত্র মেজাজ চটে গেল আমার। কাঠ কাঠ গলায় বলে উঠলাম,
— অসুস্থ অবস্থায়ও মোবাইল ছাড়া চলে না আপনার?
আমার কথা শুনে রোয়েন চকিত দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকায়। অতঃপর ভ্রু কুঁচকে বলেন,
— তো সারাদিন রুমে শুয়ে বসে থেকে করবোটা কি? বউয়ের সাথে হা-ডু-ডু খেলবো?
কথাটা শোনামাত্র কান গরম হয়ে যায় আমার। তাঁর দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলি,
— ছিহ! কথার কি শ্রী। রুমে থেকে থেকে মাথা গিয়েছে নাকি আপনার?
সে এক রাশ বিরক্তি নিয়ে বলে,
— হ্যাঁ গিয়েছে। কত ভালো লাগে এই রুমে বন্দী হয়ে থাকতে?
কথাটার মর্ম বুঝে আমি হালকা হেসে বলি,
— তিনদিন হলো মাত্র আর তাতেই এই অবস্থা? বাকি পনেরো-বিশ দিন কিভাবে কাটাবেন?
— জানি না।
আমি আর কিছু না বলে এগিয়ে গেলাম তাঁর দিকে। বেডসাইড টেবিলে খাবারের প্ল্যাটটা রেখে রোয়েনকে ধরে উঠে বসালাম। পিঠে পিছনে বালিশ দিয়ে ভালো মত বসিয়ে দিলাম। খাবারের প্ল্যাটটা হাতে নিয়ে তাকে খায়িয়ে দিতে শুরু করলাম। কিছুটা সময় অতিক্রম হতেই রোয়েন শীতল কন্ঠে বলে উঠেন,
— এইসব করতে তোমার বিরক্তি লাগে না?
আমি উনার দিকে কৌতূহল দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলি,
— বিরক্তি কেন লাগবে?
উনি ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছেড়ে বলেন,
— আমার কিছু তো এখন তোমাকেই করতে হচ্ছে। মা মাঝে মধ্যে একটু সহযোগিতা করলেও বাকিসব তো তোমাকেই করতে হচ্ছে। রাতও জাগতে হচ্ছে। সেবা করতে হচ্ছে আমার। তাই বিরক্তি আসাটা অস্বাভাবিক কিছু না।
আমি মৃদু হেসে বলি,
— আপনজনদের জন্য কিছু করতে কখনো বিরক্তি আসে না৷
রোয়েন কিছু না বলে শীতল দৃষ্টিতে আমার মুখ পানে তাকিয়ে থাকেন। হঠাৎ আমার ফোনের রিংটোন বেজে উঠতে তিনি চোখ সরিয়ে নেন। তাঁর বা পাশেই আমার ফোনটি থাকায় বলি,
— ফোনটা একটু দেন তো।
রোয়েন ফোনটা হাতে নিয়ে বলে,
— তোমার হৃদিপু ফোন দিয়েছে।
আমি ভাত মাখতে মাখতে বলি,
— তাহলে থাক। আমি পরে কল ব্যাক করে নিব নে।
রোয়েন কিছু বলতে যাবে তার আগেই কল কেটে যায়। তাই তিনি আর কিছু না বলে ফোনটা পাশে রাখতে নেয়, ঠিক এমন সময় পুনরায় রিংটোন বেজে উঠে। তা দেখে তিনি বলেন,
— পরে কথা বলতে হবে না, এখনই বলে নাও। আমি ধরে রাখছি তুমি কথা বলো।
আমি অহেতুক কথা না বাড়িয়ে বলি,
— তাহলে রিসিভ করে স্পিকারে দেন।
রোয়েন আমার কথা মতই কলটা স্পিকারে দিয়ে আমার সামনে ধরেন। আমি ‘হ্যালো’ বলার আগেই অপরপাশ থেকে হৃদিপু বলে উঠেন,
— ওই মাইয়া এতক্ষণ লাগে ফোন ধরতে?
আমি ভেংচি কেটে বলি,
— একবার ফোন দিয়েই এই হাল? আর নিজে যে হাজারবার ফোন দিলেও তুলো না তার বেলায় কি?
— আমার বেলায় সব মাফ।
— কচু! কি জন্য ফোন দিয়েছ তা বলো। হাতে কাজ আছে আমার।
হৃদিপু অভিমানী সুরে বলে,
— বিয়ে করে মেয়ে তুই আমায় ভুলে গেলি। আমার ভালোবাসার এই প্রতিদান দিলি তুই?নাইছ!
হৃদিপুর কথা শুনে রোয়েনের ভ্রু কুঁচকে আসে। তা দেখে আমি হালকা হেসে বলি,
— হ্যাঁ দিলাম এই প্রতিদান। হ্যাপি!
কথা বলে আমি রোয়েনের মুখে ভাত পুরে দিলাম। হৃদিপু দীর্ঘ নিঃশ্বাস নিয়ে বলে,
— ভাইয়া কেমন আছে?
কথাটা শুনে আমি রোয়েনের দিকে তাকালাম। অতঃপর হালকা হেসে বলি,
— আপাতত ভালোই আছে। বেড রেস্টে আছে।
— আচ্ছা তাঁর খেয়াল রাখিস আর শুন চাচী কথা বলবে তোর সাথে। নে কথা বল।
আমি নির্বিকার গলায় বলি,
— দাও।
মা ফোনে আসতেই আমি সালাম দিলাম। মা সালামের উত্তর দিয়ে রোয়েনের কথা জিজ্ঞেস করতে লাগলো। অতঃপর মা উদাসীন গলায় বলেন,
— তোর বাবাকে বলেছি একবার ওই বাসায় যাওয়ার কথা। দুই-একদিনের জামাইকে দেখে যাব নে আমরা৷
আমি শীতল কন্ঠেই বলি,
— সেটা তোমাদের ইচ্ছা। আসলে আসবে নাইলে না।
— এমন করিস কেন?
আমি ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করি,
— কেমন করলাম?
মা কিছু বলতে যাবে তার আগেই নাসরিন বেগমের কন্ঠ শোনা গেল। তিনি গলা উঁচিয়ে জিজ্ঞেস করছেন,
— ওই হৃদি তোর চাচী কার লগে কথা কয়?
হৃদিপু অকপটে উত্তর দেয়,
— সিয়ার সাথে দাদি।
— কেল্লা?
— ভাইয়া এক্সিডেন্ট করেছিল তো তাই তাঁর খোঁজ নিচ্ছিল চাচী।
নাসরিন বেগম খ্যাঁক করে বলে উঠেন,
— ওই অপয়ার লিজ্ঞাই তো পোলাডার আজ এই অবস্থা। অপয়া কোনহানকার। যার জীবনে যায় হের জীবনেই শনি ডাইক্কা লইয়া আহে। আমাগো রে তো ধ্বংস করসেই এখন ওই পোলাটার জীবনটাও ধ্বংস করতাসে। বিয়া কইরা বেচারা পোলাডার জীবনটাই নষ্ট।
আমি ফোনে আছি দেখে হৃদিপু দ্রুত তাকে বলে,
— আহা দাদি চুপ করো তো। কি বলছো এইসব?
— ঠিকই তো কইতাসি। ওই অপয়াডা যেমনে আমাগো জীবন খাইসে,তেমনই ওই পোলাডারও জীবন খাইবো দেখিস। মুখপোড়া মাইয়া কোনহানকার।
মা এইবার চাপা কন্ঠে বলে উঠেন,
— আহা মা চুপ করুন। ওই সব শুনছে।
— হুনলে হুনুকজ্ঞা।
এতক্ষণ ধরে মোবাইলের অপর পাশের সকল কথাই আমি শুনছিলাম। সেই সাথে শুনছিল রোয়েনও। হয়তো অন্য সময় হলে এইসব আমার মধ্যে ভাবান্তর সৃষ্টি করতো না। গায়েই মাখতাম না কথাগুলো৷ কিন্তু আজ পরিস্থিতি ভিন্ন। আজ রোয়েন আমার সামনে বসা এবং কথাগুলো উনিও শুনেছে। কথাগুলো উনি শুনেছেন বলেই আমি লজ্জায় কুঁকড়ে যাচ্ছি। নয়ন দুইটি ক্ষণে ক্ষণে জ্বালা করে উঠছে। গলা ধরে আসছে। আমি নতজানু হয়ে আছি। সাহস হচ্ছে না মুখ তোলার। আমি কোন মতে বলে উঠি,
— মা পরে কথা বলি।
কথাটা বলেই আমি ভাত মাখা হাতে ফোনটা কেটে দেই। ফোনটা কেটে দিয়ে আমি চুপচাপ নিচের দিকে তাকিয়ে বাকি ভাতগুলো মাখিয়ে নিতে থাকি। কানে বাজছে নাসরিন বেগমের একটি কথা, ‘রোয়েনের এই অবস্থা নাকি আমার জন্য।’ হঠাৎ আমার কি হলো জানি না আমি নতজানু হয়ে রোয়েনকে জিজ্ঞেস করে বসলাম,
— আপনারও কি তাই মনে হয় আমি অপয়া? আমার জন্যই আপনার এই অবস্থা?
বেশ কিছুক্ষণ এইভাবেই নতজানু হয়ে থাকলাম উত্তরের আশায়। কিন্তু তাও কোন উত্তর না পাওয়ায় আমি মুখ তুলে তাকালাম। তাঁর নয়ন দুইটির দিকে নজর যেতেই দেখলাম তা প্রগাঢ় রক্তিম লাল। চোখে-মুখে কাঠিন্য ভাব বিদ্যমান। আমাকে তাঁর দিকে তাকাতেই উনি কাঠ কাঠ গলায় বলে,
— তোমার ভাগ্য ভালো যে আমার হাতে প্লাস্টার ঝুলছে। নাহলে আজ একটা থাপ্পড়ও মাটিতে পড়তো না।
আমি কাঁপা কাঁপা গলায় বলি,
— মানে?
রোয়েন বাজ গলায় বলেন,
— নিজেকে অপয়া বলো কোন লজিকে তুমি? মুর্খ তুমি? কেউ তোমায় অপয়া বললো আর তুমি তা মেনে নিলে? আর আমার এই অবস্থার দায়ী তুমি নিজেকে কিভাবে বলে দাবী করো? তখন ছিলে তুমি আমার সাথে?
আমি কিছু না বলে চুপ করে বসে থাকি। তা দেখে রোয়েন বলে উঠেন,
— স্পিক আপ ডেমিট।
আমি তাও কিছু না বলে নতজানু হয়ে যাই। দুই দিকে না সূচক মাথা নাড়াই। তা দেখে উনি কিছুক্ষণ হাঁসফাঁস করে নিজেকে কিছুটা শান্ত করে বলেন,
— আমাদের সাথে কখন কি হবে না হবে তার নির্ধারণ কারী আল্লাহ। মানুষ না। আমাদের ভাগ্যও আল্লাহই লিখেন। যা হয় সব আল্লাহর মর্জিতে। তো সেই হিসাবে আমার সাথে যা হয়েছে তা আল্লাহর ইচ্ছায়৷ এই এক্সিডেন্ট আমার ভাগ্যে ছিল তাই হয়েছে৷ এতে তোমার অবদান কোথায়? বুদ্ধি খাটাও।
— হুম।
— অন্যের কথাকে গুরুত্ব দেওয়ার চেয়ে নির্বোধ থাকাও শ্রেয়। ইচ্ছে তো করছে ঠাডিয়ে দেই কয়েক। তোমাকে তিনি এমন কথা কেন বলেছে তা জানার বিন্দু মাত্র ইচ্ছে নেই কিন্তু এমন ফালতু কথা কানে নিতে কে বলেছে তোমায়?
আমি মাথা উঁচু করে বলি,
— কথাগুলো কখনোই আমলে নেই না। আজও তাই। শুনতে শুনতে সয়ে গিয়েছে এইসব। কিন্তু কেন জানি না আজ আপনাকে কথাটা জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করলো তাই করলাম।
রোয়েন কিছুক্ষণ আমার দিকে নীরব দৃষ্টিতে তাকিয়ে অতি শীতল কন্ঠে বলেন,
— তাঁর কাঁটাযুক্ত বাগানে নিভৃতে ফোটে উঠা পবিত্র ফুল তুমি। যার গায়ে না আছে কোন দাগ, না আছে কোন কলঙ্ক। আছে শুধু প্রগাঢ় স্নিগ্ধতা আর পবিত্রতা।
এইটুকু বলে রোয়েন চুপ থাকে। অতঃপর বলে,
— তাঁর জীবনে আর্শীবাদ তুমি, অভিশাপ নও।
কথাটা বলেই রোয়েন দেয়ালের সাথে মাথা ঠেকিয়ে চোখ বন্ধ করে ফেলে। আর আমি মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকি তার দিকে। মনের মাঝে থাকা কালো মেঘের কুন্ডলীকে চিরে খিলে উঠে এক চিলতে রোদ। ঠোঁটের কোনে ফুটে উঠে মিষ্টি হাসি। আনমনে বলে উঠি, “এই মানুষটার তীরেই আমার আসল নীড়।”
______________________
দেখতেই দেখতে মাস খানিক চলে গেল। সেই সাথে বদলে গেল জীবনের ধারাও। রোয়েন সম্পূর্ণভাবে ঠিক হয়ে গিয়েছেন আরও বিশ-পঁচিশ দিন আগেই। আর অফিসে জয়েন দিয়েছিল পা ঠিক হতেই। বাবা-মাও চলে গিয়েছেন গ্রামের বাড়িতে। এইদিকে আমারও ভার্সিটিতে ক্লাস শুরু হয়ে গিয়েছে। নতুন কিছু বন্ধুও জুটেছে৷ এর মধ্যে পুরোনো বন্ধু হলো সুরাইয়া। কচিং-এ তো একসাথে ছিলামই এখন ভার্সিটিতেও একসাথে। আমার জন্য ভালোই হয়েছে যাতায়াতের সঙ্গী আর ভালো বন্ধু হিসাবেও পেয়েছি তাকে। সেই সাথে আদিব, ইফতি, স্নেহা, নূর এদের সাথেও বেশ ভালো বন্ধুত সম্পর্ক গড়ে উঠেছে আমার। যেমন সবকিছুতেই কিছুটা পরিবর্তন এসেছে তেমনই রোয়েনের প্রতি আমার অনুভূতিগুলোর মধ্যেও পরিবর্তন হয়েছে। আগে তাঁর জন্য আমার অনুভূতি ছিল আবছা কিন্তু এখন তা প্রগাঢ় হয়ে এসেছে। তাঁর জন্য আমার এই প্রগাঢ় অনুভূতির নাম জানা নেই আমার। এইটা তাঁর প্রতি আমার মোহ নাকি ভালোলাগা নাকি ভালোবাসা আমার জানা নেই। শুধু জানি, উনি আমার পাশে থাকলে আমার আর কিছুই চাই না। আমার জন্য তাঁর মনোভাব কি তা এখনো অস্পষ্ট আমার কাছে। অবশ্য যেখানে আমার অনুভূতিগুলাই আমার কাছে অস্পষ্ট সেখানে রোয়েনের অনুভূতি কি করে বুঝি আমি? দুইজনের সম্পর্ক এখন কেমন ভাসমান৷ না আছে সম্পর্কটা বন্ধুত্বের মাঝে আর না আছে সেটা বিবাহ দাম্পত্যের মাঝে। কোন এক জায়গায় সেটা আটকে আছে কিন্তু সেটা কোথায় তা হয়তো দুইজনের কারোই জানা নেই। কিন্তু মজার বিষয় হলো দিন যাচ্ছে ঠিকই আপন নিয়মে।
বৃহস্পতিবার হওয়ায় আজ আমার হাফ ডে ছিল। যার ফলে আজ আমার দুপুরের মধ্যেই বাসায় অবস্থান করার সৌভাগ্য হলো। নাহলে তো সন্ধ্যার আগে বাসায় আসাটাই দুষ্কর। দুপুরের খাবার খেয়ে রুমে আসতেই দেখি বিছানার এক কোনে রোয়েন কাপড় পড়ে আছে। সেগুলো দেখে আমি কাপড়গুলো ভাঁজ করে নিলাম। অতঃপর রোয়েনের কাবার্ড খুলে কাপড়গুলো রাখতেই দেখি কাবার্ডের কাপড়গুলো আজ এলোমেলো। সচরাচর রোয়েনের কাবার্ড এলোমেলো থাকে না৷ সবসময় পরিপাটি থাকে৷ তাই আজ এমন অবস্থা দেখে বেশ ভড়কেই গেলাম আমি। কিন্তু ক্ষণেই নিজেকে সামলে গুছিয়ে দিতে থাকলাম কাবার্ডটা। গুছানোর এক পর্যায়ে হাতে ডায়েরি মত কিছু একটা পড়ে। আমি সেটা হাতে নিয়ে বুঝতে পারলাম অতি যতনে কালো মলাটে পুরানো থাকা জিনিসটি আসলেই একটি ডায়েরি। যেহেতু রোয়েনের সাইড থেকে ডাইরিটা পাওয়া সেহেতু নিসন্দেহে এইটা তাঁরই। কিন্তু রোয়েন ডায়েরি লিখে জেনে বেশ কৌতূহল হলো আমার। ইচ্ছে হলো খুলে ডায়েরিটা পড়ার। কিন্তু ভদ্রতার জন্য সেই ইচ্ছাটাকে সাই দিলাম না। কারো পারসোনাল জিনিস নিয়ে এত আগ্রহ দেখানো ঠিক না। তাই ডায়েরিটা নিজ জায়গায় রেখে দিতে নিলাম কিন্তু তার আগেই সেটা হাত থেকে ফঁসকে নিচে পড়ে যায়। মেঝেতে পড়ে মাঝের কিছু বদ্ধ পৃষ্ঠা উন্মুক্ত হয়ে আসে আমার সামনে। আমি সেটা উঠাতে গিয়ে না চাইতেও চোখ পড়ে যায় কিছু লাইনের উপর। যা দেখা মাত্র আমি স্তব্ধ হয়ে যাই।
“হয়তো তুমি আমার ভাগ্যে নেই। হয়তো বা তুমি আমার ধরা-ছোয়ার বাহিরে। হয়তো তুমি সেই অমূল্য রত্ন যাকে নিয়ে ভাবাও আমার জন্য বিলাসিতা। কিন্তু আসলেই কি তাই? হয়তো তাই।
— আমি ভেবে নিলাম
তুমি সেই লাল গোলাপ
যাকে নিরন্তর পাহাড়া দেয় এক কাটার বাগান।”
চলবে
#নিভৃতে_যতনে
#Part_28
#Writer_Asfiya_Islam_Jannat
ডায়েরির সাদা পাতার উপর গোটা অক্ষরে লিখা চরণগুলো চোখের দৃষ্টিতে পড়তেই বুকটা মোচড় দিয়ে উঠে। স্থির হয়ে আসে দৃষ্টি। সেই সাথে মনের মাঝে জাগে কৌতূহল। প্রবল ইচ্ছা জাগে জানার,” এই চরণগুলো আসলে কার জন্য লিখা? এতটা আবেগ আর বিষাদ মিশ্রিত শব্দ রোয়েন ব্যবহার করেছে কার জন্য?” নিজের মনের কৌতূহল আর ইচ্ছে দমিয়ে রাখতে না পেরে ডায়েরিটা হাতে তুলে নেই। সামনের দিক থেকে কয়েকটা পৃষ্ঠা উল্টাতে কিছু চরণের উপর এসে দৃষ্টি স্থির হয়,
” জীবনের সারণী সাদা খাতায় ফুটিয়ে তোলা রেওমিলের ছকের মতো কিন্তু হিসেব অগোছালো। রেওয়ামিলের হিসাব তো মেলানো যায় সঠিক নির্দেশনায়! কিন্তু,জীবনের হিসেবের খাতায় সঠিক পরিচালক না হলে সব এলোমেলো ঝড়া পাতার মতো হয়”
কথাগুলো পরে আমি পরের পৃষ্ঠা উল্টালাম। পরের পৃষ্ঠায় লিখা,
” আসলেই হুমায়ুন আহমেদ ঠিক বলেছেন, এই পৃথিবীতে প্রায় সবাই, তার থেকে বিপরীত স্বভাবের মানুষের সঙ্গে প্রেমে পড়ে। উদাহরণস্বরুপ আমি।”
পরের পৃষ্ঠা উল্টাতেই চোখে পরে,
” পৃথিবীতে সবচেয়ে কঠিন সমীকরণ হচ্ছে অনুভূতির সমীকরণ। এর মারপ্যাঁচ কখনই ধরা যায় না। যেমন আমি ধরতে পারছি না।”
আমি এই তিন পৃষ্ঠা পড়ার পর পুরো ডায়েরি একবার নেড়ে চেড়ে দেখি। ডায়েরিটা নরমাল ডায়েরির মত লিখা না। যেমনটা সাধারণত সকলে লিখে তেমন লিখা না। তার চেয়ে এইটা একটু ভিন্ন। ছোট ছোট এমন অসংখ্য অনুভূতির প্রকাশ এতে লিখা আর সেইসবের মাধুর্যও খুব গভীর৷ মানুষটা যেমন স্বল্পভাষী ঠিক তেমনই তাঁর ডায়েরিটাও। আমি যেখানে পড়া থামিয়েছিলাম সেখানে ফিরে যেতেই ডোরবেল বেজে উঠে। শব্দটা কর্ণপাত হওয়া মাত্র আমি ভড়কে যাই, চোরা চোখে তাকাই ঘড়ির দিকে। সাড়ে চারটার বেশি বাজে। নিজেই ভাবতে থাকি, এই সময় কে আসলো? তৎক্ষনাৎ মনে পড়লো আজ তো বৃহস্পতিবার। উনার তো আজ হাফ ডে। নিশ্চয়ই এখন রোয়েন এসেছেন। আমি চট জলদি উঠে ডায়েরিটা আমার সাইডের কাবার্ডে লুকিয়ে রাখলাম। পলি আন্টিকে দরজা খুলতে বলে মুহূর্তেই আমি রোয়েনের কাপড়গুলো ভাঁজ করতে শুরু করি। সেই সাথে, নিজেকে শান্ত রাখারও চেষ্টা করতে থাকি। ভাব এমন যে, এই বুঝি চুরি করতে গিয়ে ধরা খাওয়ার আগ মুহূর্তে বেঁচে গিয়েছি। হৃদস্পন্দন চলছে তার সর্বোচ্চ গতিতে। কখন না জানি ফুলস্টপ মেরে বসে।
কিছু প্রহর অতিক্রম হতেই রোয়েন ক্লান্ত পায়ে রুমে প্রবেশ করে। আমি একবার তার দিকে তাকিয়ে দৃষ্টি সরিয়ে নেই। উনি বিছানার পাশে হেলমেট আর ব্যাগটা রেখে ক্লান্ত কন্ঠে বলেন,
— আমার সব কাপড়চোপড় নামালে যে?
আমি নিজেকে শান্ত রেখে তাঁর দিকে তাকিয়ে বলি,
— ধোঁয়া জামাগুলো রাখতে গিয়ে দেখি সব এলোমেলো হয়ে আছে তাই ভাবলাম ভাঁজ করে দেই।
উনি নিজের গলার টাই ঢিলে করতে করতে বলেন,
— আমি পরে গুছিয়ে নিতাম নে।
তাঁর কথা শুনে আমার কি হলো জানি না, আমি অকপটে জিজ্ঞেস করে উঠি,
— আমি করলে দোষ কোথায়?
উনি আমার দিকে নির্লিপ্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলেন,
— তুমি করলে দোষ কেন হবে?
আমি মুখ ফিরিয়ে কাপড় ভাঁজ করতে করতে বলি,
— না এমনি! আমি কিছু করলে আপনার ভালো নাও লাগতে পারে।
কথাটা শুনে রোয়েন কিছুক্ষণ আমার পানে ভ্রু কুঞ্চিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। এরপর আমার বা বাহু টেনে ধরে তাঁর দিকে ঘুরিয়ে নেন আমায়। আমাকে তাঁর মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে গম্ভীর কণ্ঠে জিজ্ঞেস করেন,
— তোমার কি হয়েছে? আজ এমন রাফ বিহেভ করছো কেন?
কথাটা শুনে আমি কিছুক্ষণ নীরব থাকি। আনমনে ভাবতে থাকি, “আসলেই আমি এমন কেন করছি? কেন মন আমার আজ এত বিষাদময়? কষ্ট কেন হচ্ছে আমার? কেন রোয়েনকে দেখা মাত্র বার বার আমার ওই ডায়েরির লিখাগুলো চোখের সামনে ভাসছে? ক্ষণেই বুকের মাঝে রক্তক্ষরণ কেন হচ্ছে? রুষ্টু কেন হচ্ছি আমি? কেন? কেন?”
শত প্রশ্নগুলোর ভিড়ে একটারও সঠিক উত্তর খুঁজতে না পেরে আমি মিইয়ে যাই। বাহানা দিয়ে দেই,
— মুড সুইং হচ্ছে। কখন কিরকম বিহেভ করছি বুঝতে পারছি না।
রোয়েন চিন্তিত কন্ঠে বলেন,
— বেশি খারাপ লাগছে?
আমি অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে বলি,
— না।
রোয়েন আমার বাহু ছেড়ে দিয়ে স্বাভাবিক কন্ঠে বলেন,
— ইউ নিড এ রিফ্রেশমেন্ট। সন্ধ্যায় রেডি থেক।
কথাটা বলেই তিনি বারান্দা থেকে টাওয়ালটা নিয়ে চলে যান ফ্রেশ হতে আর তাকিয়ে থাকি তাঁর পানে। মানুষটা প্রকাশ্যে নাহলেও নিভৃতে ঠিকই বুঝিয়ে দেয় আমার প্রতি তাঁর যত্নগুলো। চিন্তাগুলো৷ এরপরও কি তাঁর উপর রুষ্টু থাকা যায়? কেন জানি না, এই মানুষটার উপর এক আলাদা অধিকারবোধ কাজ করে। আমি সবকিছুর ভাগ দিতে রাজি কিন্তু এই মানুষটার ভাগ আমি কাউকে দিতে রাজি না। তাই বলে কি, ডায়েরির পাতায় অন্য এক নারীকে নিয়ে লিখা কাব্যিক কথাগুলো পড়ে আমার ঈর্ষা হচ্ছে? তাঁকে হারানোর ভীতি কাজ করছে আমার মাঝে? কিন্তু তাঁর প্রতি আমার মনোভাব কি? ভালোলাগা নাকি ভালোবাসা?
______________________
সেদিনের পর ডায়েরিটা পড়ার সুযোগ আমার আর হলো না। বিভিন্ন ব্যস্ততা আর সময়ের স্বল্পতার ফলে ডায়েরিটা ধরাই হয়নি। সারাদিন আমার পার হয় ভার্সিটির প্রাঙ্গণে আর সন্ধ্যায় বাসায় পৌঁছাতে না পৌঁছাতে রোয়েনও এসে হাজির হয়। ভার্সিটি নিয়ে যে ডায়েরিটা পড়বো তারও উপায় নেই৷ সবসময় বন্ধুমহলের মাঝেই থাকতে হয় আমায়। তাদের চোখ ফাঁকি দিয়ে ডায়েরিটা পড়া অসম্ভব৷
চৈত্রের শেষ ভাগ। শৈত্য প্রবাহ এখনো বিরাজমান। উত্তরা বাতাসের রাজত্ব এখনো চলছে। সেই সাথে আগমন হতে চলেছে বৈশাখের। ঢাকা ভার্সিটির প্রাঙ্গণ সজ্জিত হতে চলেছে ফুলে ফুলে। সেই নিয়ে সকলের কতই না উচ্ছাস। বৈশাখকে শুভেচ্ছা জানানোর জন্য ভার্সিটিতে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আয়োজন করা হয়েছে। তা নিয়েই আলোচনায় মত্ত সবাই। টিচারও কাজ ভাগ করে দিচ্ছে সকলের মাঝে। এইসব আয়োজনের মাঝে আজ আমাদের সকালের ক্লাসটা বাদে বাকি ক্লাসগুলো স্থগিত হয়ে যায়। যেহেতু ভার্সিটিতে আমার আর কোন কাজ নেই সেহেতু আমি আর ভার্সিটিতে না থেকে চলে আসি বাসায়। বাসায় এসে ফ্রেশ হয়ে নিয়ে বসি ডায়েরিটা। যেখান থেকে পড়া ছেড়েছিলাম শুরুও করলাম সেখান থেকেই।
“ভালোলাগা আর ভালোবাসা হচ্ছে পৃথক সত্তা। এদের ব্যখ্যা আর সমীকরণও আলাদা। কিন্তু তাও আমি দুইটার মধ্যে পার্থক্য খুঁজে বের করতে পারছি না। দুইটাকেই গুলিয়ে ফেলছি। আদৌ সে আমার ভালোলাগা নাকি ভালোবাসা?”
উপর পৃষ্ঠা উল্টাতে দেখি,
“পৃথিবীতে অনেক ধরনের অত্যাচার আছে। কিন্তু এর মধ্যে প্রেমের অত্যাচার হচ্ছে ভয়ানক অত্যাচার। এ অত্যাচারের বিরুদ্ধে কখনও কিছু বলা যায় না আবার সহ্যও করা যায় না।”
আমি একের পর এক পৃষ্ঠা উল্টিয়ে দেখতে থাকি সবগুলো। হঠাৎ এক জায়গায় এসে দৃষ্টি স্থির হয় আমার।
“প্রেম-ভালোবাসা হচ্ছে মরীচিকার মত। যখনই সেটা আগলে ধরে মানুষ বাঁচতে চায় তখনই তা নিমিষেই মিইয়ে গিয়ে চরম বাস্তবতা দেখিয়ে যায়।”
এরপরের পৃষ্ঠায় লিখা,
” পৃথিবীতে বোঝাপড়া, রুজি- রোজগার, জীবনযাত্রার মান আর শরীরের চাহিদার সামনে প্রেম-ভালোবাসা অতি ঠুনকো।”
এরপরই আসে সেই কাঙ্ক্ষিত চরণটি,
” হয়তো তুমি আমার ভাগ্যে নেই। হয়তো বা তুমি আমার ধরা-ছোয়ার বাহিরে। হয়তো তুমি সেই অমূল্য রত্ন যাকে নিয়ে ভাবাও আমার জন্য বিলাসিতা। কিন্তু আসলেই কি তাই? হয়তো তাই।
— আমি ভেবে নিলাম
তুমি সেই লাল গোলাপ
যাকে নিরন্তর পাহাড়া দেয় এক কাটার বাগান।”
আমি এই কথাগুলো দ্বিতীয়বার পড়ার পর কিছুক্ষণ স্থির হয়ে থাকি। ভিতরে ভিতরে বেশ কষ্ট পাচ্ছি আমি। শ্বাস আটকে আসছে। কান্নাগুলো দোলা পাকিয়ে আসছে কণ্ঠনালীর মাঝে। আমার আগে রোয়েনের জীবনে একজন ছিল তা আমার অজানা নয়। রোয়েন তো আমায় নিজ থেকেই বলেছিল তাঁর জীবনে একজন ছিল। যে তাঁকে ছ্যাঁকা দিয়ে চলে গিয়েছে। কিন্তু তখন সেটা শুনে এতটা কষ্ট হয়নি যতটা না আজ সেই অনাকাঙ্ক্ষিত মানুষটিকে নিয়ে লিখা রোয়েনের মনোভাবগুলো পড়ে হচ্ছে। বার বার বিষিয়ে যাচ্ছি আমি। আমি সাহস করে পরের পাতা উল্টালাম। তাতে লিখা,
” জীবনে দুই-একটা ভুল সম্পর্কে জড়ানো উচিৎ, পৃথিবীর কঠোর বাস্তবতা বুঝার জন্য।”
পরের পাতায় লিখা,
“আজ বছর খানিক পর বুঝতে পারলাম তোমার প্রতি আমার অনুভূতিগুলো। বুঝতে পারলাম আমাদের সম্পর্কটা। তোমার আমার মধ্যে যা ছিল তা নিছক প্রেমের সম্পর্ক। ভালোবাসার না৷ ভালোবাসার সম্পর্ক হলে হয়তো আমি দিব্যি চলতে পারতাম না।”
সর্বশেষ পাতায় লিখা,
” ভালোবাসা,ভালোলাগা আর আবেগের মধ্যে পার্থক্য বুঝানোর জন্য ধন্যবাদ তাকে।”
এরপর আর কিছু লিখা নেই। পুরো ডায়েরিটা পড়ে আমি নীরব। কেন জানি মানতে পারছি না বিষয়টা। ডায়েরির প্রত্যেকটা কথা যে তিনি তাঁর প্রাক্তনকে উদ্দেশ্য করে লিখেছেন তাতে কোন সন্দেহ নেই আমার। কিন্তু মনের মাঝে একটা প্রশ্ন থেকেই গেল, “সেই মানুষটি রোয়েনের ভালোবাসা ছিল নাকি আবেগ ছিল?” ডায়েরির কোথাও স্পষ্ট লিখা নেই তাঁর প্রতি রোয়েনের ঠিক অনুভূতিটা কি ছিল। লিখা পড়ে তো মনে হচ্ছে সেটা উনার আবেগ ছিল। কিন্তু আদৌ কি তাই? হঠাৎ টনক নাড়ে, “উনার জীবনের প্রথম নারী আমি নই। তাঁর কোন কিছুতেই আমি প্রথম না।” কথাটা ভাবা মাত্র আমি দুমড়ে মুচড়ে যায়। বিষিয়ে যাওয়া মন নিয়ে রোয়েনের কাবার্ডে কাপড়ের ভাঁজে সপ্তপর্ণে রেখে দেই ডায়েরিটা। অতঃপর পলি আন্টিকে বলে হাটা দেই ছাদে যাওয়ার উদ্দেশ্যে।
________________________
চৈত্র মাসে সাধারণত বৃষ্টি হয় না। কিন্তু কেন যেন আজ প্রকৃতি তার বিধানের উল্টো নিয়মে চলছে। আকাশটা আজ বিষন্নতায় ঘেরা। কালো ঘন মেঘের হাতছানি। ঝোড়ো হাওয়া বইছে। দূর আকাশে মেঘরা মৃদুস্বরে ডেকে উঠছে। হয়তো ক্ষণের মাঝেই ঝুম বৃষ্টি নামবে। সেই বিকেল থেকেই আমি ছাদে। বিষন্ন চোখে দেখছি পরিবেশটা। বৃষ্টি নামবে যেনেও আমি নামছি না ছাদটি থেকে, স্থির দাঁড়িয়ে আছি। কিছুই যে ভালো লাগছে না আমার। বেশ কিছুক্ষণ এইভাবেই থাকার পর আমার বাহুতে টান অনুভব করি। আমি পিছে ঘুরে তাকাতেই দেখি রোয়েন। উনি আমার দিকে রুদ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। আমি পিছনে ঘুরে দাঁড়ানো মাত্র তিনি গম্ভীর কন্ঠে বলেন,
— এই সময় ছাদে কি করছো তুমি? দেখছো না আকাশ খারাপ করছে? তাও নিচে নামছো না কেন?
আমি বেশ কিছুক্ষণ রোয়েনের দিকে তাকিয়ে থেকে শীতল কন্ঠে জিজ্ঞেস করি,
— আজ আমায় একটা প্রশ্নের উত্তর দিবেন? উত্তরটা না জানা পর্যন্ত আমি শান্ত হতে পারছি না। দম বন্ধ হয়ে আসছে আমার।
রোয়েন আমার দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বলেন,
— কি জানতো চাও তুমি?
আমি অকপটে জিজ্ঞেস করি,
— আপনার প্রাক্তন কি আপনার আবেগ ছিল নাকি ভালোবাসা?
— হঠাৎ এই প্রশ্ন কেন?
— জানতে চাই আমি এই প্রশ্নের উত্তর।
রোয়েন কিছুক্ষণ চুপ থেকে শীতল কন্ঠে বলেন,
— আবেগ ছিল।
— আর আমি?
রোয়েন ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করে বলে,
— মানে?
আমি নির্লিপ্ত কন্ঠে জিজ্ঞেস করি,
— আমি আপনার কি? আমার জন্য আপনার অনুভূতি কি?
— তোমার আজ কি হয়েছে? এইসব প্রশ্ন কেন করছো?
আমি আমার বাহু থেকে রোয়েন হাত সরিয়ে বলি,
— কারণ আজ আমি এই প্রশ্নের উত্তর জানতে চাই। জানতে চাই আমি আপনার কি হই? আপনার জীবনে আমার জায়গায়টা আসলে কি?
রোয়েন কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলে,
— নিচে চলো।
— কেন? উত্তর নেই আপনার কাছে? সে তো আপনার জীবনে প্রথম নারী ছিল। কিন্তু আমি?
রোয়েন আমার দিকে তাকিয়ে বলে,
— আমার প্রাক্তন আমার অতীত যার বর্তমানে কোনে অস্তিত্ব নেই আর না কখনো থাকবে। কিন্তু হঠাৎ তুমি অতীত কেন টানছো? আর এইসব প্রশ্নই বা কেন করছো?
আমি মুখ ঘুরিয়ে বলি,
— জানি না কেন করছি। কিন্তু আজ আমার সকল প্রশ্নের উত্তর চাই এই চাই।
রোয়েন আমার সামনে এগিয়ে এসে বলেন,
— আমার প্রাক্তন আমার অতীত আর তুমি আমার বর্তমান ও ভবিষ্যৎ। সে আমার জীবনে প্রথম নারী হলেও আমার জীবনের শেষ নারী কিন্তু তুমিই। অর্ধাঙ্গিনী তুমি আমার। তোমার সাথে তো ওর কোন তুলনা হয় না আর কখনো হবেও না।
— কিন্তু তাও যে আমার মানতে কষ্ট হচ্ছে এইসব। কেন কষ্ট হচ্ছে জানি না শুধু জানি প্রচন্ড কষ্ট হচ্ছে।
হঠাৎ আকাশে বাজ পড়ে শুরু হয় মুষলধারের বৃষ্টি। বৃষ্টির বড় বড় কণা সর্বাঙ্গে ছড়িয়ে যেতেই ভড়কে যাই দুইজনেই। দুইজনের মধ্যে বেশ দূরত্ব না থাকায় বৃষ্টির এই ধারার মাঝেও দুইজনেই চেয়ে থাকি নির্লিপ্ত দৃষ্টিতে একে উপরের দিকে। বেশ কিছুক্ষণ সময় অতিক্রম হতেই রোয়েন আরেকটু এগিয়ে এসে আমার চর্বিযুক্ত গালের হাত গলিয়ে দিয়ে আমার চোখে চোখ রেখে বলেন,
— ভালোবাসো আমায়?
কথাটা কর্ণপাত হওয়া মাত্র ভড়কে যাই আমি। শরীরের মধ্যে বয়ে শীতল এক শিহরণ। আমি নিজের দৃষ্টি নামিয়ে বলি,
— জানি না।
উনি নির্লিপ্ত কন্ঠে উত্তর দেন,
— যে প্রশ্নের উত্তর তুমি নিজেই জানো না সেই প্রশ্নের উত্তর তুমি আমার কাছে আশা করছো? স্ট্রেঞ্জ!
রোয়েন আমার এত কাছে থাকায় আমার এখন প্রায় শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থা। ভিতরটা ক্ষণেই এলোমেলো হয়ে আসলো। যে প্রশ্নের উত্তর গুলো জানার জন্য এতক্ষণ অস্থির হয়ে ছিলাম তা নিমিষেই চলে গিয়েছে। আমি কোনমতে বলে উঠে,
— আমি নিচে যাব।
উনি নরম সুরে বলে,
— উত্তর না নিয়েই চলে যেতে চাচ্ছো?
আমি দৃষ্টি তুলে জিজ্ঞেস করি,
— তাহলে দেন উত্তর। আমি আপনার কি?
উনি নমনীয় গলায় বলেন,
— আবেগ আর ভালোলাগার উর্ধ্বে তুমি। আমার সকল অনুভূতির শিরোনাম তুমি। আমার জীবনের শেষ পরিনতি তুমি।
আমি তাঁর চোখের দিকে তাকিয়ে বলি,
— উত্তরটা কিন্তু এখনো ঘোলাটে।
রোয়েন কিছু না বলে আমার দৃষ্টিতে নিজের দৃষ্টি নিবদ্ধ করে নেয়। পানির বিন্দু বিন্দু কণা তাঁর মুখশ্রী ছুঁয়ে দিয়ে গড়িয়ে পড়ছে আমার মুখমন্ডলের উপর। ছুঁয়ে দিচ্ছে আমার চর্বিযুক্ত গাল,ঠোঁটযুগল। বেশ কিছু সময় পেরুতেই আমি দৃষ্টি নত করে নেই। হঠাৎ রোয়েন আমার মুখ উঁচু করে সপ্তপর্ণে নিজের ভেজা অধরযুগলের মাঝে আমার অধরযুগল নিবদ্ধ করে ফেলেন। ঘটনাক্রমেই বুঝতেই সারা শরীরে আমার শিহরণ বয়ে যায়। অবাকে আমি কিংকর্তব্যবিমুঢ়। নড়তে পর্যন্ত ভুলে যাই আমি। ঘোরের ভিতর চলে যাই আমি।
বেশ কিছুক্ষণ পর রোয়েন একটু সরে আসতে আমি ঘোর থেকে বেড়িয়ে আসি। ছিটকে সরে দাঁড়াই তাঁর কাছ থেকে। লজ্জায় নতজানু হয়ে আছি আমি। গাল দুইটির মাঝে ফুটে উঠেছে রক্তিম লালাভ আভা। আমি কিছু না বলে তাঁর পাশ কাটিয়ে আসতে নিলে উনি আমার হাত চেপে ধরে বলে,
— কি পেয়েছ তোমার স্পষ্ট উত্তর?
আমি বুঝতে পেরেছি তাঁর উত্তর কিন্তু লজ্জায় আর সংশয়ের ফলে গলায় দিয়ে আমার একটা শব্দও বের হচ্ছে না। আমি কোন মতে তাঁর থেকে হাত ছাড়িয়ে নিয়ে এক দৌড়ে সিড়ি বেয়ে নেমে আসি নিচে। আমার হৃদস্পন্দন যেন তার সর্বোচ্চ গতিতে চলছে। চারদিকে যে সেই ধ্বনি কম্পিত হচ্ছে.. ধুকধুক..ধুকধুক। সকলেই হতো শুনতে পাচ্ছে সে ধ্বনি। কি লজ্জা! কি লজ্জা! এইদিকে শীতের মৌসুমে বৃষ্টি ভিজে এখন শীতে আমি কাত। থরথর করে কাঁপছি আমি। টলমল পায়ে এসে পৌঁছাই দরজার সামনে। দরজার হ্যান্ডেল ঘুরাতেই বুঝতে পারি দরজা ভিতর দিয়ে বন্ধ। আমি চঞ্চল ভঙ্গিতে চাপতে থাকি ডোরবেলের সুইচ। কিন্তু কেউ এসে দরজা খুলে না। হঠাৎ পিছন থেকে রোয়েন বলে উঠেন,
— বাসায় কেউ নেই। দরজার চাবি আমার কাছে।
রোয়েনের কন্ঠ কর্ণপাত হতেই আমি স্থির হয়ে যাই। তৎক্ষনাৎ দূরে সরে দাঁড়াই। গুটিয়ে নেই নিজেকে। বুঝতে দেরি নেই রোয়েন আসা মাত্র পলি আন্টি বেরিয়ে গিয়েছেন। রোয়েন আর কিছু না বলে দরজা খুলে দেন। উনি ভিতরে যেতেই আমিও চলে ভিতরে। মাথা নত করে ধীর পায়ে এগিয়ে যেতে নেই রুমের দিকে। হঠাৎ নিজের ডান বাহুতে দ্বিতীয় বারের মত টান অনুভব করি। আমি পিছনে না ঘুরে কাঁপা-কাঁপা কন্ঠে বলি,
— কিছু কি বলবেন?
উনি আমার একটু কাছে এসে বলেন,
— তুমি নামক অসুখে আজ আমি আক্রান্ত। গুরুতরভাবে আক্রান্ত। এই অসুখ ছাড়াতে যে এখন আমার তোমাকে প্রয়োজন। তুমি কি দায়িত্ব নিবে আমার অসুখ নিরাময় করার? নিবারিত কি হবে আমার মাঝে?
অতঃপর কিছুক্ষণ চুপ থেকে তিনি বলেন,
— আজ নিজের সীমা লঙ্ঘন করতে চাই আমি। তোমাতে রাঙ্গাতে চাই এই আমিটাতে। তুমি কি অনুমতি দিবে আমায় সকল সীমা লঙ্ঘন করার?
চলবে