নিভৃতে_যতনে
Part_33,34
Writer_Asfiya_Islam_Jannat
Part_33
রোদের প্রখরতা বেরে চলেছে। পাখিদের গুনগুনানো ভেসে বেড়াচ্ছে বাতাসে। পরিবেশটা বেশ নিরিবিলি। আমি বারান্দার এক কোনে দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি। রোয়েনের দিকে না তাকিয়েও বুঝতে পারছি তাঁর শীতল দৃষ্টি আমাতেই নিবদ্ধ। বেশ কিছুক্ষণ পর রোয়েনের দীর্ঘ নিঃশ্বাসের শব্দ কর্ণধারে এসে বারি খায়। আমি একপলক রোয়েনের দিকে তাকাই। শ্লেষের হাসি হেসে জিজ্ঞেস করি,
— এখনো বলবেন ওই বাসায় আমার যাওয়া উচিৎ? নাসরিন বেগমের সাথে দেখা করা উচিৎ?
রোয়েন আমার দিকে নিষ্পলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলেন,
— উচিত-অনুচিত নিয়ে আমি কিছু বলছি না। কেন না, এই পুরো ব্যাপারটাই হচ্ছে কুসংস্কারে জড়িত। আমাদের তথাকথিত সমাজের বিকৃত মস্তিষ্কের পরিচয় এইটা। যার ভোগান্তির শিকার তোমার মত হাজারো সিয়াশা। এই বিষয় নিয়ে বললেও যা, না বললেও তা। নাথিং উইল বি চেঞ্জড। আমি শুধু এতটুকু বলতে চাই, যার শুরু তোমার জানা তার শেষ কেনই বা অজানা থাকবে?
আমি রোয়েনের দিকে প্রশ্নবোধক চাহনি নিক্ষেপ করে জিজ্ঞেস করি,
— মানে?
— একটা গল্প বা উপন্যাস যখন আমরা পড়ি তখন তার শুরুটা কেমন তা নিয়ে আমাদের কৌতূহল থাকে না।কৌতুহল থাকে উপন্যাসের শেষটা সার্থক কি’না। সার্থকতা উপলব্ধি নিজের মধ্যে ধারণ করার জন্য’ই উপন্যাসটা পড়ি! জীবনটা উপন্যাসের শেষ পাতার মতো।এইখানে,শুরুটা কেউ মূল্যায়ন করে না কিন্তু শেষ দাড়ি টা পর্যন্ত তখন গননা করে যদি তুমি স্বার্থক হও।
— আপনি কি তাহলে চাইছেন আমি ওই বাসায় যাই? মহান সেজে সব ভুলে গিয়ে মাফ করে দেই?
রোয়েন ভাবলেশহীন ভাবে বলেন,
— তোমায় আমি ক্ষমা করতে বলেনি। শুধু এতটুকু বলছি এর শেষ বোঝাপড়াটা বুঝে নাও তুমি। এরপর না-হয় সকল সমীকরণের ইতি আজই টেনে দিও।
আমি কিছু না বলে চুপ করে থাকি। তা দেখে রোয়েন আবার বলে উঠেন,
— তোমার জীবনের গতানুগতিক ধারা ঠিক কেমন হবে তা ঠিক করবে শুধু তুমি। অন্য কেউ না। যে মনোবল এতদূর এগিয়ে এসেছো তা আঁকড়ে ধরো। গল্পটা শুরু করেছিল অন্য কেউ ইতিটা না-হয় তুমি টানো।
আমি রোয়েনের কথা শুনে কিছুক্ষণ থম মেরে দাঁড়িয়ে থাকলাম। শীতল চাহনিতে পর্যবেক্ষণ থাকি রোয়েনকে। রোয়েনের বদলে এখন অন্য যে কেউ থাকলে হয়তো আমার প্রতি সে সর্বপ্রথম সহানুভূতি জানাতো। এরপর অনুগ্রহ অথবা সান্ত্বনা দিত। অথচ মানুষটা তা করলো না। এমনকি করুণার দৃষ্টিতেও দেখলো না। বরং আমার মনোবল শক্ত করে দিল। আমি যে দূর্বল হয়ে পড়ছি তা বুঝতে পেরে অপ্রকাশ্যেই বুঝিয়ে দিলো সকল পরিস্থিতিতে নিজেকে মানিয়ে নিয়ে শক্ত থাকতে হয়। সকল পরিস্থিতিতেই তিনি আমার পাশে আছে তা অন্য সকল কথার ভাঁজে বুঝিয়ে দিলেন। মানুষটা আসলেই সকলের মধ্যে অন্যান্য।
_______________________
বাসায় প্রায় শোকের আমেজ। নাসরিন বেগমের রুমে সকলের আনাগোনা। সকলের মুখে বিষন্নতা,নয়ন দু’টি অশ্রুসিক্ত। আমি চোখে-মুখে কঠোরতা বুজিয়ে রেখে দরজার পাশেই দাঁড়িয়ে আছি। আমার থেকে বেশ কিছু হাত দূরে রোয়েন দাঁড়ানো। আমার সামনের বিছানাতেই নিস্তেজ হয়ে পড়ে আছেন নাসরিন বেগম। তার চেহেরা দেখেই বুঝা যাচ্ছে তার অবস্থা বেশ করুন। যেকোনো সময় আকস্মিক দূর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে। আমাকে দরজার সামনে এসে দাঁড়াতেই সকলের দৃষ্টি আমার দিকে এসে স্থির হয়। আমার আগমন দেখে মালিহা ফুপু দ্রুত নাসরিন বেগমকে আমার উপস্থিতির কথা জানান দেন। কথাটা তার কর্ণপাত হতেই তিনি ধীরে সুস্থে চোখ খুলে তাকান। ঘাড় ঘুরিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে ইশারায় আমাকে তার কাছে ডাকেন। আমি বেশ কিছুটা সময় নিয়ে তার দিকে এগিয়ে যাই। আমাকে এগুতে দেখে মালিহা ফুপু নিজের স্থান ছেড়ে উঠে দাঁড়ান। আমি বিনাবাক্যেই সেখানে গিয়ে বসে পড়ি। অতঃপর তাচ্ছিল্যের সুরে বলি,
— আজ এই অপয়াকে কেন মনে পড়লো আপনার? শেষ সময় এসেও আমায় কথা শুনিয়ে যেতে চান বুঝি?
আমার এমন কথা শুনে সকলে চকিত দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকায়। আমি সে দিকে তোয়াক্কা না করে ভাবলেশহীন ভাবে বসে থাকি। নাসরিন বেগম খুব কষ্টে বলে উঠেন,
— তোর লগে বহুত অন্যায় করসি আহমি। অনেক কোষ্ট দিসি তোরে। এতদিন না বুঝবার পারলেও এহন ঠিকই বুঝবার পারসি। মরণের মুখে আইসা বুঝতে পারতাসি জীবনের অনেক বড় বোঝা ঘাড়ে চাইপ্পা আসে আমার। যার লিজ্ঞা আমি মইরাও শান্তি পামু না। পারলে আহমারে মাফ কইরা দিস।
আমি ভ্রু কুটি কুঞ্চিত করে বলি,
— ঠিক কোন বিষয়টার জন্য ক্ষমা চাইছেন আপনি আমার কাছে? আমার গায়ে অপয়া তকমা লাগিয়ে দেওয়ার জন্য? নাকি আমাকে সবসময় অপদস্ত করার জন্য? নাকি আমার গায়ে সকল কিছুর দোষ লাগানোর জন্য? নাকি আমার থেকে আমার পরিবার আলাদা করে দেওয়ার জন্য? নাকি আমার শৈশব কেড়ে নেওয়ার জন্য?
আমার কথাগুলো চারদিকে গুঞ্জিত হতেই ওসমান সাহেব খেঁকিয়ে উঠেন,
— এইসব কোন ধরেন কথা? কখন কার সামনে কথা বলতে হয় জানো না?
আমি চোখ শক্ত করে বলি,
— না, জানি না। তা সত্য বলছি বলে গায়ে লাগছে? সত্যি অবশ্য সবসময় তেঁতোই লাগে। কিছু করার নেই। সে যাই হোক, আমি তো সকলের বেডলিস্টে পড়ি তাই আমার স্বভাবও এমনই। কিন্তু আপনাদের সকলের গুডলিস্টে থাকা এই বাড়ির বড় মেয়ে কোথায়? আসেনি নাকি?
মালিহা ফুপু ফোঁস করে বলে উঠেন,
— সে আসতে পারবে না জানিয়েছে।
আমি আফসোসের সুরে ‘চ’ উচ্চারণের মত শব্দ করে উঠে বলি,
— কিয়ারার জন্য কত কি-না করলো নাসরিন বেগম। ছোট থেকে আগলে রাখলো তাকে অথচ আজ তার শেষ সময়েই সে নেই?
হঠাৎ নাসরিন বেগম ডুকরে কেঁদে উঠে বলেন,
— সবই ভাগ্যের লীলাখেলা। তাই তো এহন শেষ বয়সে আইসা ভুগতাসি আমি৷ কিন্তু দেহার মত কেউ নাই। যারে পাইল্লা বড় করলাম হেই এখন আমায় চেনে না। তুই পারলে আহমায় মাফ কইরা দিস। তোর মাফ না পাইলে যে আমি মইরাও শান্তি পাইতাম না।
আমি চোখ মুখ শক্ত করে বলি,
— মাফ করা কি এতই সহজ? দুধভাত নাকি বিষয়টা?
হঠাৎ বড় চাচী বলে উঠেন,
— মৃত্যু পথযাত্রী মানুষের আবেদন কখনো ফিরিয়ে দিতে হয় না মা। এতে গুনাহ হয়।
কথাটা শুনে আমি তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলি,
— অহ তাই নাকি? তা আল্লাহ বানানো সেরা সৃষ্টিকে অপয়া বা অলক্ষুণে বললে তাতে গুনাহ হয় না? মিথ্যে অপবাদ দিলে তাতে গুনাহ হয় না? যেখানে জন্ম-মৃত্যু এক আল্লাহর হাতে, সেখানে মৃত্যুর দোষ এক ছোট নবজাতক বাচ্চার উপর চাপালে গুনাহ হয় না?
মালিহা ফুপু এইবার বলে উঠেন,
— গুনাহ তো সবাই করে কিন্তু মাফ কতজনে করতে পারে? মাফ করা হচ্ছে বৃহৎ গুণ। আর যেখানে শয্যাশায়ী মানুষটা নিজেই নিজের ভুলে বুঝতে পেরে মাফ চাইছে সেখানে কথা বাড়ানোর মানে হয় না।
— তাহলে আমাকে এখন মহান হতে বলা হচ্ছে? সকলের করা অন্যায় ভুলে যেতে বলা হচ্ছে? আচ্ছা বেশ! আমিও মাফ করে দিব। কিন্তু এর আগে আমার এক শর্ত আছে।
বড় চাচা ভ্রু কুঁচকে বলেন,
— কি?
আমি নির্বিকার কন্ঠে বলে উঠি,
— হুম একটু দাঁড়ান বলছি। হৃদিপু! আমাকে একটা সাদা কাগজ এনে দিও তো।
হৃদিপু কৌতূহলী কন্ঠে জিজ্ঞেস করেন,
— কেন?
— আগে আনো তারপরই বুঝতে পারবা।
হৃদিপু আর পাল্টা প্রশ্ন না করে রুম থেকে বেরিয়ে যায়। ক্ষণেই একটা সাদা কাগজ নিয়ে আবার ফেরত আসে। কাগজটা আমায় হাতে দিতেই আমি সেটা নিয়ে কিছুক্ষণ স্থির হয়ে বসে থাকি। সকলের উৎসুক দৃষ্টি আমার পানে। আমি একপলক রোয়েনের দিকে ক্ষণেই হাতের কাগজটা দুমড়ে মুচড়ে ফেলি। মুহূর্তেই অসংখ্য ভাঁজের দাগ পড়ে যায় কাগজের গায়ে। আমি পুনরায় কাগজটা মেলে ধরে সকলের উদ্দেশ্যে বলি,
— এই কাগজের সকল ভাঁজের দাগ দূর করতে পারলেই আমি সকলকে ক্ষমা করে দিব।
কথাটা শোনা মাত্র সকলে হতবুদ্ধির মত আমার দিকে তাকিয়ে থাকে। হঠাৎ ওসমান সাহেব গলা খ্যাঁকিয়ে বলেন,
— মশকরা হচ্ছে? এইটা কোন ধরনের শর্ত শুনি?
আমি শীতল কন্ঠে বলি,
— শর্তের আবার প্রকারভেদ আছে নাকি? শর্ত তো শর্তই।
মাহিলা ফুপু মাঝ দিয়ে বলে উঠেন,
— এইটা অসম্ভব। কাগজের গায়ে একবার ভাঁজের দাগ পড়লে সেটা আবার ঠিক করে কিভাবে মানুষ?
— শুনেছি, কাউকে কষ্ট দেওয়ার পর ক্ষমা চাইলে নাকি সব ঠিক হয়ে যায়। তা আমি যদি এখন কাগজটা থেকে ক্ষমা চাই তাহলে কি সে তার আগের অবস্থানে ফিরে আসবে?
বড় চাচা গম্ভীর কন্ঠে জিজ্ঞেস করেন,
— কি বোঝাতে চাইছো তুমি?
আমি শ্লেষের হাসি হেসে বলি,
— সামান্য কাগজের ভাঁজের দাগই আপনারা মুছে ফেলতে পারছেন না সেখানে আমাকে বলছেন আমি এত বছরের তিলে তিলে পাওয়া কষ্ট এক নিমিশেই ভুলে যাব? এই ভাঁজের দাগগুলোর মতই হচ্ছে আমার কষ্টগুলো। আমার হৃদয়ে লাগা ক্ষতগুলো। যা একবারে চিরস্থায়ী। হয়তো ক্ষমা করা যায় কিন্তু অন্তঃস্থলে লাগা এই দাগগুলো কখনো মুছা যায় না।
আমার কথা শুনে সকলে যেন বাক্যহারা হয়ে যায়। কারো মুখে নেই কোন কথা। সকলে শুধু ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। আমি তপ্ত নিঃশ্বাস ত্যাগ করে স্বাভাবিক কন্ঠেই বলি,
— কারো দোষ দেওয়ার মত যোগ্যতা আমার নেই। কিন্তু দোষ না দিলেও আপনারা সকলেই দোষী। যেখানে আল্লাহর হুকুম ছাড়া একটা পাতাও নড়ে না সেখানে আপনারা সকলে বিভিন্ন পরিস্থিতি আর মৃত্যুর দায়ভার আমাকে দিয়েছেন। আমার যা প্রাপ্য তা থেকে আমায় বঞ্চিত করেছেন। আমি কিয়ারার সাথে কখনোই কিছু করি নি অথচ কেউ তা বিশ্বাস করেন নি। সেদিনও কিয়ারাকে আমি ধাক্কা দেই নি। তাকে আঘাত করিনি। তখন নাসরিন বেগমও জানতে আমি নির্দোষ। সে দূর থেকে দেখেছিল ঘটনাটা। কিন্তু তাও, তিনি কিছু বলেন নি বরং আমাকেই দোষী বলে আমার পরিবার থেকে আলাদা করে দিলেন। আর সকলেও আমাকে দূরে সরিয়ে দিলেন। ক্ষণেই হয়ে উঠলাম সকলের অবহেলার পাত্রী। যখন আমার সকলের দরকার ছিল কেউ ছিল না আমার পাশে। আমি কখনো কোন কিছুতে কাউকে পাইনি। যার ফলে শৈশবটা ছিল আমার বিষাদময়। আজ এতটা কঠোর আর বেপরোয়া হয়েছি আপনাদের বদালতে। আর এখন এসে সেই আমার থেকেই আশা করছেন ক্ষমা করার?
কথাগুলো শুনে কারো মুখে রা নেই। সকলেই নিশ্চুপ। তা দেখে আমি তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলি,
— কিয়ারা আর আমি দুইজনই ছিলাম এই বাড়ির মেয়ে। অথচ আমাদের বৈষম্য করা হতো। কিয়ারা ভুল করেও সব পেয়েছে আর আমি ভুল না করেও কিছু পাইনি। কিন্তু এর জন্য কিয়ারাকে আমি ঈর্ষা করি না। কিন্তু ও আমার সাথে যা করেছে তার জন্য আমি ওকে ঘৃণা করি। প্রচন্ড ঘৃণা করি।
নাসরিন বেগম আবার ডুকরে কেঁদে উঠে ক্ষমাপ্রার্থী হন। বাসার সকলেই কম বেশি এক বলতে থাকে। দুই-একজনের সুরে অনুতাপের রেশ। আমি চোখ শক্ত করে সেগুলো শুনতে থাকি। অতঃপর কাঠ কাঠ গলায় বলি,
— কাউকে কখনো ক্ষমা করতে পারবো কি-না জানি না।।বলবও না চেষ্টা করবো। তাই এই নিয়ে আমায় আর কিছু বলবেন না। আপাতত এই বাড়ির সাথে আমি আর কোন সম্পর্ক রাখতে চাই না। এই বাসায় আজ আমার শেষ আসা। আশা করি, এরপর থেকে কেউ আমার সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করবেন না বা ক্ষমা চাওয়ার অযুহাত খুঁজবেন না। এখন আসি!
কথাটা বলে আমি উঠে দাঁড়াই। একপলক মা আর হৃদিপুর দিকে তাকিয়ে বলি,
— চিন্তা নেই তোমাদের দুইজনের সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করবো না। ভালো থেক।
এই বলে আমি রোয়েনের সাথে বেরিয়ে আসলাম। সিড়ি ভেঙে যখন নিচে নেমে এসে দাঁড়াই। চোখ প্রচন্ড জ্বালা করছে আমার। বার বার আমি হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে চোখ কচলাচ্ছি। তা দেখে রোয়েন শীতল কন্ঠে বলে উঠেন,
— সবসময় কান্না দূর্বলতার পরিচয় বহন করে না। কিছু কান্না হয় একান্ত নিজের, যা জীবনের পথচলায় সাহায্য করে। তাই মাঝে মধ্যে নিজের জন্য হলেও কাঁদা উচিৎ।
ক্ষণেই আমার নয়ন দুইটির বাঁধ ভেঙে গড়িয়ে পড়ে অজস্র অশ্রুমালা। আমি কিছু না ভেবে রোয়েনকে জড়িয়ে ধরে ডুকরে কেঁদে উঠে। রোয়েনও সপ্তপর্ণে আমায় আগলে নেন। আমার মাথার পিছে হাত গলিয়ে দেন। আজ আমি কেন কাঁদছি জানি না। শুধু জানি বড্ড হালকা লাগছে আজ আমার। ভারি মনটা এতদিন পর ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। যার ফলে আজ নিজেকে ধরে রাখা দুষ্কর আমার জন্য। বেশ কিছুক্ষণ পর শীতল কন্ঠে বলেন,
— আমি আছি তো।
কথাটা কর্ণধারে এসে বারি খেতেই আমি স্থির হয়ে যাই। অশ্রুর গতানুগতিক ধারা কমে আসে। হঠাৎই মনের মাঝে খেলে যায় প্রশান্তি উতলা ঢেউ। কথার ভাঁজে লুকিয়ে থাকা নির্ভরতা হ্রাস করে দিল আমায় ক্ষণেই। মনে হতে থাকলো, এই স্বার্থপর দুনিয়াতে আমার আপন বলে কেউ একজন আছে। যে কি-না একান্ত আমার। যার তীরেই কি-না আমার নির্ভরযোগ্য স্থান। এই মানুষটি আমার পাশে থাকলে যে আমার আর কিচ্ছু চাই না। কিচ্ছু না!
চলবে
#নিভৃতে_যতনে
#Part_34
#Writer_Asfiya_Islam_Jannat
আকাশটা আজ মেঘাচ্ছন্ন। চারদিকে ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টি হচ্ছে। ক্ষণে ক্ষণে বিকট শব্দে মেঘ ডেকে উঠছে। রাস্তার খালি জায়গায় জমতে শুরু করেছে কাঁদাপানি। আমি বারান্দায় থাকা বেতের মোড়ায় বসে একধ্যানে বৃষ্টি দেখছি। ঝোড়ো হাওয়ায় বৃষ্টির ক্ষুদ্র কণা আঁচড়ে পড়ছে চোখে-মুখে। সর্বাঙ্গে খেলে যাচ্ছে শীতল শিহরণ। কিন্তু তবুও আমার মধ্যে কোন হেলদোল নেই। অন্যমনস্ক হয়ে স্থির হয়ে বসে আছি সেখানেই৷ আজ দেড় মাস হতে চললো নাসরিন বেগম ইন্তেকাল করেছেন। এমনই এক বৃষ্টির দিনে তার মৃত্যু হয়েছি। সকলেই আমাকে ডেকেছিল নাসরিন বেগমকে শেষ দেখা দেখে যাওয়ার জন্য। কিন্তু আমি যায়নি। বলতে আমার সাহস হয়নি। কেন না, কাফনে জড়ানো মৃতদেহ আর খাটিয়া যে আমার বোধগম্য নয়। আমি এইসব সহ্য করতে পারি না, বড্ড ভয় পাই। বোডিং এ থাকতে যখন একটা মেয়ে সুইসাইড করলো আর তার লাশ কাফনে মুড়িয়ে আমাদের সামনে আনা হলো তখন সেটা দেখা মাত্র আমি আমার জ্ঞান হারিয়েছিলাম৷ আর আমার সেই জ্ঞান ফিরেছিল দুদিন পর। এরপর পুরো এক সপ্তাহে আমি ভয়ে কাবু ছিলাম। এই ঘটনা এক মা ব্যতীত কেউ জানে না। হয়তো কেউ জানবেও না আমার এইসবে ফোবিয়া আছে। তাই হয়তো আমি না যাওয়ার জন্য মানুষগুলো আমাকে এক দফা দোষ দিয়ে যাবে। অবশ্য এতে নতুন কিছুই নেই। তারা তো ছোট থেকেই আমায় দোষারোপ করেই আসছে। এখন না-হয় তাদের অভিযোগের পাল্লা ভারী হলো। কিন্তু এইসব নিয়ে তো আমার ভাবনা নয়। আমার ভাবনা গিয়ে আটকিয়েছে অন্য জায়গায়। আচ্ছা, নাসরিন বেগমকে কি সত্যি আমার ক্ষমা করে দেওয়ার দরকার ছিল? লোক দেখানো মহান হওয়াটা কি আবশ্যক ছিল? হয়তো ছিল আবার হয়তো না। আচ্ছা, লোক দেখানো ক্ষমা করলেও কি আমি আদৌ মন থেকে তাকে ক্ষমা করতে পারতাম? পারতাম না তো। কষ্টগুলো তখনও ছিল এখনো আছে। পার্থক্য শুধু এইখানে, আগে কষ্টগুলো পোড়াতো আর এখন তা পোড়া দাগে পরিনত হয়েছে৷ যা আদৌ অন্তঃস্থল থেকে মুছবে কি-না সন্দেহ। ইশশ! যদি সকল কষ্ট ভোলা যেত তাহলে জীবনটা কতটাই না সাচ্ছন্দ্য হতো। ক্ষমা নামক শব্দটা তখন চাইতে হইতো না আপনি-আপনি হৃদয়ের গহীন থেকে চলে আসতো।
আমি যখন আমার আপন ভাবনায় বিভোর ঠিক তখনই কাধে কারো উষ্ণ হাতের ছোঁয়া পাই। পিলকে চমকে উঠি আমি৷ আপন ভাবনা থেকে বেরিয়ে এসে ঘাড় ঘুরিয়ে পিছনে তাকিয়ে দেখি মা দাঁড়িয়ে আছে। চোখের চাহনি তার তীক্ষ্ণ।আমি মায়ের দিকে তাকিয়ে ছোট একটা হাসি উপহার দিতেই মা ধমকের সুরে বলে উঠেন,
— এই অসময়ের বৃষ্টিতে কেউ ভিজে? জ্বর বাঁধাবে পড়ে।
আমি একপলক নিজের দিকে তাকিয়ে বাইরে তাকালাম। মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছে। যার দরুন বৃষ্টি ঝাপটা দৃঢ় হওয়ায় আমি ভিজে একাকার। নিজের ভাবনায় এতটাই বিভোর ছিলাম যে বুঝতেই পারিনি কখন এতটা ভিজে গেলাম। আমি মায়ের দিকে তাকিয়ে অপরাধী সুরে বলি,
— বুঝতে পারিনি।
মা গলার সুর নরম করে বলেন,
— যাও তারাতাড়ি ফ্রেশ হয়ে নাও। ঠান্ডা লেগে যাবে নাহলে৷
আমিও তার কথায় সম্মতি জানি চলে যাই ফ্রেশ হতে। ফ্রেশ হয়ে এসে বুঝতে পারি শীত আমায় কাবু করতে শুরু করেছে। হয়তো রাতে ধুমিয়ে জ্বরও আসতে পারে। আমি বিছানায় বসে তোয়ালে দিয়ে চুলগুলো মুছতে থাকি৷ এমন সময় মা এক কাপ রঙ চা নিয়ে হাজির হন। আমার হাতে চায়ের পেয়ালাটা ধরিয়ে দিয়ে তোয়ালেটা নিজে নিয়ে নেন। অতঃপর আমার পিছনে বসে বলেন,
— দাও আমি মুছে দিচ্ছি।
আমি কিছু না বলে তার দিকে পিঠ করে বসি আর ছোট ছোট চমুক বসাতে থাকি চায়ের পেয়ালাটিতে৷ ক্ষণেই অন্যমনস্ক হয়ে পড়ি আমি৷ বেশ কিছুটা সময় পর মা বলে উঠলেন,
— মন খারাপ কেন?
কথাটা শুনে আমি কিছুটা ভড়কে যাই। স্বতঃস্ফূর্ত স্বরে বলি,
— কোথায় মা?
— আবার মিথ্যে বলছো? তোমাকে পেটে ধরিনি বলে যে তুমি আমার সন্তান না তা তো নয়। মায়েরা সন্তানের সব এইভাবেই বুঝে যায়। এখন বলো মন খারাপ কেন?
আমি অস্ফুটস্বরে বলি,
— ইয়ে মানে, নাসরিন বেগমের কথা ভাবছিলাম। আমার কি তাকে ক্ষমা করে দেওয়া উচিৎ ছিল?
মা দীর্ঘ নিঃশ্বাস নিয়ে বলেন,
— আমি তোমার পক্ষে বা বিপক্ষে কথা বলছি না। শুধু এতটুকুই বলছি, অন্তর থেকে যদি ক্ষমা না করতে পারো তাহলে মুখে বলা সেই ক্ষমার মূল্য নেই৷ হয়তো মানুষটা অনুশোচনা থেকে পাবে কিন্তু কর্ম থেকে মুক্তি পাবে না।
কথাটা শুনে আমি চুপ হয়ে থাকি। মা কিছুটা সময় নিরব থেকে বলেন,
— তোমার প্রতি খালাম্মার অনিহা আমি নিজেই দেখেছি। তার অকথ্য ভাষাও শুনেছি। তাই বলতে পারি তিনি যা করেছেন তা ভুল। কিন্তু তোমার পরিবারও যে তোমার সাথে এমন করবে তা বুঝিনি। বিয়ের সময়টাও বুঝিনি যে তোমার প্রতি পরিবারের এত অনিহা।
আমি কিছুটা অবাক হয়ে বলি,
— আপনি দেখেছেন মানে?
মা স্মিত হেসে বলেন,
— ভুলে গেলে নাকি আমি আগে তোমার পাশের ফ্ল্যাটেই থাকতাম। হয়তো আমরা তোমার স্মৃতিতে নেই কিন্তু আমাদের স্মৃতিতে তোমার সেই ছোট মুখটা এখনো ভাসে।
কথাটা শুনে আমি মিইয়ে যাই৷ আসলেই আমার বিষয়টা মনে ছিল না। এত কথার ভিরে ওই কথাটা মাথা থেকে প্রায় বেরিয়েই গিয়েছিল। হঠাৎ টনক নাড়তেই আমি মাকে জিজ্ঞেস করি,
— একটা কথা জিজ্ঞেস করি?
— হুম করো।
আমি অস্ফুটস্বরে বলি,
— না মানে এই বিয়েই বা কিভাবে ঠিক হলো?
মা হালকা হেসে বলেন,
— প্রতিবেশী হওয়া সুবাদে তোমাদের সাথে আমাদের ভালো সম্পর্ক ছিল জানোই তো। কিন্তু আমরা ওই এলাকা থেকে চলে আসার পর তোমাদের সাথে যোগাযোগ ছিন্ন হয়ে যায়। তারপর অনেক বছর যোগাযোগ ছিল না। কিন্তু তিন বছর আগে ইদের এই সময় একদিন রাস্তায় তোমার শ্বশুরের সাথে তোমার বাবার দেখা হয়। পূর্বপরিচিত আর তারা ভালো বন্ধু হওয়া সুবাদে তোমার বাবা তাকে জোড় করে বাসায় নিয়ে যায়। আর সেখানেই তোমার শ্বশুর তোমাকে দেখে৷ তোমার সাথে বোধহয় কথাও হয়েছিল। তখনই নাকি তোমায় তার মনে ধরে যায় আর তিনি তৎক্ষনাৎ রোয়েনের জন্য তোমার বিয়ের কথা বলেন। তোমার বাবাও নাকি এক কথায় রাজি হয়ে যান। কিন্তু সামনে তোমার এইচএসসি পরীক্ষা ছিল বলে বিষয়টা তখন এতটা আগায় নি। অতঃপর বাসায় এনে তোমার সম্পর্কে আমাদের জানান। তিনি যে বিয়ে পাকা করে এসেছেন তাও জানান৷ তোমাকে আগে থেকে চিনি বলে আমারও কোন সমস্যা ছিল। অতঃপর কথা ঠিক হয় যে, এইচএসসির পর তোমার আর রোয়েনের বিয়ে হবে। আর এইখানেই কথা পাকাপাকি হয়ে যায়। অবশেষে তোমার এইচএসসি শেষে বাসায় আসতেই তোমার আর রোয়েনের বিয়ের তোরজোড় শুরু হয়। অবশ্য আমাদের সকলের আগে থেকেই সকল ধরনের প্রস্তুতি ছিলই। তাই সবকিছু তাড়াতাড়িই সেড়ে ফেলতে পারি আমরা৷
আমি অন্যমনস্ক হয়ে জিজ্ঞেস করে বসি,
— কিন্তু উনি কি এই বিয়েতে রাজি ছিল?
কথাটা বলা মাত্র অস্বস্তিতে পড়ে যাই। যত যাই হোক শ্বাশুড়িকে তো আর প্রশ্ন করা যায় না। মা স্মিত হেসে বলেন,
— সেটা না-হয় রোয়েনকেই জিজ্ঞেস কোরো।
মনে আরও কয়েকটা প্রশ্নক থাকা সত্ত্বেও আমি আর কথা বাড়ালাম না। চুপ হয়ে গেলাম। মাও অন্য বিষয় নিয়ে কথা বলতে শুরু করলেন। অতঃপর আমিও তার সাথে তাল মিলালাম৷
________________________
হেমন্তের মাঝামাঝি সময়। নীলাভ আকাশে আজ সোলানি রোদ্দুরের প্রখরতা খানিকটা কম এখন। চারদিকে টোনাটুনির কিচিরমিচির কলরব। হাওয়ায় ভাসে সদ্য ফোটা ফুলের সুবাস। ঢাকা ভার্সিটির হাক্কিম চত্তরে পিছনের দিকটায় বসে আড্ডা দিচ্ছে বন্ধুমহলের সকলের। অফ পিরিয়ড হওয়া সুবাদে আড্ডা জমেছে দারুণ। সবুজে রাঙ্গা গাছগাছালির নিচে সকলের হাতেই এককাপ চা আর মুখে হাজারটা কথা। আর কি লাগে আড্ডা জমাতে? আমি মন দিয়ে সকলের কথা শুনছি আর হাতে থাকা চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছি। হঠাৎ ইফতি বলে উঠে,
— এই আদিব আর নূরের বাচ্চা গেল কই? আড্ডার মাঝ থেকে উঠে ওই যে গেল তো গেল এক্কেরে মি. ইন্ডিয়া হয়ে গেল।
স্নেহা নিজের নখ দেখতে দেখতে বলে,
— দেখ কোন গাছের তলায় বসে আবার প্রেম করছে।
সুরাইয়া মুখ লটকিয়ে বলে,
— জীবনে করলামটা কি? আজ একটা প্রেমও করতে পারলাম না অথচ ওই দুই হারামির প্রেম জমে ক্ষীর। বলি এই জীবন রেখে লাভ কি?
আমি রসিকতা করে বলি,
— আসলেই লাভ কি? মরে যা তুই। মরতে বেশি কিছু করতে হবে না, জাস্ট বুড়িগঙ্গার পানিতে গিয়ে একবার ডুব দিবি। ব্যাস! মরণ পাঁচশ পার্সেন্ট নিশ্চিত তোর। বাঁচার কোন চান্স নেই।
কথাটা শোনা মাত্র সকলে হু হু করে হেসে উঠে আর সুরাইয়া ফুসে উঠে বলে,
— তুই বন্ধু নামে কলঙ্ক।
আমি কিছু বলতে যাব তার আগেই আমার ফোন বেজে উঠে। আমি ফোন হাতে নিয়ে দেখি রোয়েন। আমি আর এক মুহূর্ত অপচয় না করে ফোন রিসিভ করলাম৷
— হ্যালো!
— তোমার আজকে হাফ ডে না?
— হুম কেনো?
— ক্লাস শেষে একা যাবে না। আমি নিতে আসবো।
কথাটা শোনামাত্র ভিতরে একরাশ মুগ্ধতা ছেয়ে গেল। আমি ঠোঁটের কোনে মিষ্টি হাসি ঝুলিয়ে বলি,
— আচ্ছা।
— সাবধানে থাকবে।
কথাটা বলেই তিনি ফোন রেখে দিলেন। আমি ঠোঁটের কোনে মিষ্টি হাসি বিদ্যমান রেখেই চোখ তুলে তাকাতেই ইফতি ভ্রু নাচিয়ে বলে উঠে,
— আহা কি প্রেম! তোদের প্রেম দেখে আমি আপ্লূত দোস্ত। তা আমি কিন্তু মামা ডাক শুনার জন্য চাতক পাখির মত বসে আছি দোস্ত।
আমি কিছুক্ষণ ইফতির দিকে তাকিয়ে দাঁত কেলিয়ে বলে উঠি,
— মামা!মামা! আমার প্রিয় ইফতি মামা। আরও মামা ডাক শুনার ইচ্ছা থাকলে বল? আমি একশ বার বলে দিচ্ছি। প্যারা মামা জাস্ট চিল।
আমার কথা শেষ হওয়া মাত্র সকলে উচ্চস্বরে উঠে। আমিও তাল মিলিয়ে তাদের সঙ্গে হেসে উঠি।
____________________
ক্লাস শেষে গেটের বাহিরে এসে দাঁড়ালাম। আমি চারদিকে চোখ বুলিয়ে আমার মানুষটিকে খুঁজছি এমন সময় একটা পিচ্চি এসে আমার সামনে হাজির হয়। আমার কামিজের শেষ অংশ ধরে টান দিতেই আমি চকিত দৃষ্টিতে তার দিকে তাকাই। কৌতূহলী কন্ঠে জিজ্ঞেস করি,
— কি চাই?
মেয়েটা কিছু না বলে আমার দিকে একটা চিঠি এগিয়ে দেয়। তারপর মিষ্টি সুরে বলে,
— আফনারে ওই ভাইয়াডা এইটা দিতে কইসে। লোন!
আমি চিঠিটা হাতে নিয়ে ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করি,
— কোন ভাইয়া?
কথাটা বলতে বলতেই পিচ্চিটা দৌড় দিয়ে চলে যায় আর ক্ষণেই সকলের মাঝে হারিয়ে যায়। আমি পিছন থেকে বেশ কয়েকবার ডাকা সত্ত্বেও সে সাড়া দিল না। আমি ভ্রু কুঁচকে রেখেই চিঠিটা উল্টেপাল্টে দেখলাম। কোন নাম-টাম কিছু লিখা নেই। আমি এক ঝাঁক কৌতূহল নিয়ে যেই না চিঠি খুলতে যাব তার আগেই কেউ সেটা ছো মেরে হাত থেকে নিয়ে যায়। আমি এক রাশ বিরক্তি নিয়ে চোখ তুলে “কে রে” বলতে গিয়ে থেমে গেলাম। চুপসে গেলাম মুহূর্তেই। সামনেই রোয়েন ভ্রু কুঁচকে দাঁড়িয়ে আছেন। আমার দিকে একপলক তাকিয়ে উনি চিঠিটা খুলতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। মুহূর্তেই চিঠিটা খুলে পড়তে শুরু করেন। আমি একটু উঁকি-ঝুঁকি দেখার চেষ্টা করলাম আসলে চিঠিতে কি লিখা। উপরে ‘প্রেয়সী’ সম্মোধন আর কিছু আবেগময় লাইন চোখে পড়তেই আমার আর বুঝতে নেই এইটা নির্ঘাত কোন প্রেমপত্র। কথাটা বোধগম্য হতেই আমার গলা শুকিয়ে আসে৷ জীবনে প্রথমবার কোন প্রেমপত্র পেলাম আর তাও কি-না পড়ার আগেই নিজের বরের হাতেই ধরা হলো? হায় খোদা! এমন ভাগ্য বুঝি লাখে আমারই হয়? এখন না জানি রোয়েন কি করে। ক্ষণেই রোয়েনের চেহেরায় পরিবর্তন দেখতে পেয়ে আমার গলা শুকিয়ে আসে। আমি কিছু বলতে তার আগেই রোয়েন চিঠি ভাঁজ করে নিজের পকেটে রেখে গম্ভীর কন্ঠে বলেন,
— চলো!
কথাটা বলে উনি সামনের দিকে এগিয়ে যান। আর এইদিকে তাঁর এমন কন্ঠ শুনে আমার শরীরে কাঁপন ধরে যায়। মনে মনে ভাবতে থাকি, “এইটাই বুঝি ঘূর্ণিঝড় আসার আগের পূর্বাভাস?” আমি যখন কথাটা ভাবছি তখনই রোয়েন থেমে পিছে ঘাড় ঘুরে আবার বলে উঠেন,
— কি হলো চলো।
আমি কোনমতে মাথা দুলিয়ে রোয়েনের পিছু পিছু যেতে শুরু করি। না জানি আজ ভাগ্যে কি আছে।
চলবে