নিভৃতে_যতনে
Part_37,38
Writer_Asfiya_Islam_Jannat
Part_37
নিশিরাতের মায়ায় জড়িয়ে পড়েছে সকলে। চারদিকে পিনপতন নীরবতা। আঁধার প্রগাঢ় হওয়ার সাথে সাথেই তলিয়ে যাচ্ছে সকলে ঘুমের রাজ্যে৷ শৈত্যপ্রবাহ হওয়ায় নিশাচর পাখি ডাক শোনা যাচ্ছে প্রখরভাবে। আমি গায়ে মোলায়েম কম্বল জড়িয়ে আয়েস করে ঘুমিয়ে আছি। ঠিক এমন সময় নাকে সিগারেটের কড়া গন্ধ এসে বারি খেতেই ঘুম ছুটে যায় আমার। ক্ষণেই সিগারেটের গন্ধ তীব্রতর হয়ে আসে আমার নিকট। আমি গন্ধটা সহ্য করতে না পেরে উঠে বসি। পাশে তাকাতেই দেখি রোয়েনে নেই। মুহূর্তেই ভ্রু কুঁচকে আসে আমার। অন্ধকারের মধ্যেই বৃথা চেষ্টা করলাম তাঁকে খোঁজার। বাথরুমে লাইট অফ বলে বুঝতে পারলাম উনি সেখানে নেই। এত রাতে তিনি গেলেন কোথায়? পুনরায় সিগারেটের গন্ধ নাকে এসে বারি খেতেই আমি বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে। গন্ধটা বারান্দা থেকে আসছে বলে এগিয়ে যাই সেইদিকেই। বারান্দার সামনে আসতেই রোয়েনকে নজরে পড়ে। সেই সাথে দৃষ্টি আটকে যায় উনার হাতে থাকা জলন্ত সিগারেটের দিকে। ক্ষণেই আমি থমকে যাই, অবিশ্বাস্য চাহনিতে তাকিয়ে থাকি সেদিকে। এই দেড় বছরের সংসারে আমি কখনো তাকে সিগারেট খেতে দেখিনি। এমনকি সিগারেটের ধারের কাছেও যেতে দেখিনি। অথচ আজ তিনি অনায়াসে জলন্ত সিগারেট ঠোঁটের মাঝে চেপে বাতাসে দগ্ধ ধোঁয়া ওড়াচ্ছেন। কিভাবে সম্ভব এইটা? সব চোখের সামনে হওয়া সত্ত্বেও কেন যেন আমার বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করছে না। আমি বেশ কিছুক্ষন থম মেরে দাঁড়িয়ে থেকে তাঁর দিকে এগিয়ে যাই। তাঁর কাছেই আসতে সিগারেটের গন্ধে আমার দম বন্ধ হয়ে আসে। গন্ধের তীব্রতা সহ্য করতে না পেরে কেশে উঠি আমি। কাশির আওয়াজ শুনে ক্ষণেই রোয়েন ঘাড় ঘুরিয়ে আমার পানে সচকিত দৃষ্টিতে তাকায়। আমি বেশ কিছুটা সময় লেগে যায় নিজেকে সামলাতে। নিজেকে সামলে আমি রোয়েনের দিকে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকাই। তাঁর মুখভঙ্গি আমার নিকট এতটা পরিষ্কার না-হলেও অনুমান করতে পারছি তিনি কিছুটা হলেও অপ্রস্তুত হয়ে পড়েছেন। হয়তো এইসময় আমাকে আশা করেন নি বলে। বেশ কিছুটা সময় নিরব থাকার পর রোয়েন গম্ভীর কন্ঠে বলে উঠেন,
— ঘুমাও নি?
আমি বেশ কিছুটা দূরত্ব বুজিয়ে রেখে স্বগতোক্তি কন্ঠে জিজ্ঞেস করি,
— আপনি সিগারেট খান?
তিনি কিছুক্ষণ আমার পানে তাকিয়ে থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নেন। অতঃপর গমগমে গলায় বলে উঠেন,
— কেন খেতে পারি না?
কথাটা বলেই তিনি পুনরায় জলন্ত সিগারেট ঠোঁটের মাঝে চেপে ধরলেন। সাথে সাথে আমার বুকটা দুমড়ে মুচড়ে যায়। কোন এক অদৃশ্য কারণেই আমার বেশ খারাপ লাগতে শুরু করলো। কারণটা ঠিক আমার নিকট স্পষ্ট নয়। আমি কোনমতে নিজেকে সামলে বলি,
— আগে তো খেতেন না।
উনি অকপটে স্বীকার করলেন,
— এখন খাই।
— কিন্তু কেন? কি এমন কারণ যে আপনার এই বাজে জিনিসকে ছুঁতে হলো?
রোয়েন একপলক আমার দিকে তাকিয়ে বলেন,
— ইচ্ছে হয়েছে তাই ছুঁয়েছি। আবার ইচ্ছে ফুরিয়ে গেলে ছুঁড়ে ফেলবো। নট এ বিগ ডিল।
আমি তীক্ষ্ণ স্বরে বলে উঠি,
— আপনি এখনই ফেলবেন এইটা৷ এমন বাজে জিনিস খাওয়ার মানে হয়না। এখনই ফেলুন বলছি।
উনি রুদ্ধদ্বার কন্ঠে বলে উঠেন,
— সেটা আমার ইচ্ছা আর আমি কি করবো না করবো তা বলার তুমি কে?
আমি বিস্ময়ের সুরে বলি,
— আমি কে মানে? আমি আপনার স্ত্রী।
— তো তাই বলে কি এখন তোমার সব কথা শুনতে হবে?
আমি নরম স্বরে জিজ্ঞেস করি,
— আপনি ঠিক আছেন তো? এমন উদ্ভট আচরণ কেন করছেন?
রোয়েন বিশুদ্ধ হাওয়ায় নিকোটিনের বিষাক্ত ধোঁয়া উড়িয়ে দিয়ে বলেন,
— আ’ম ফাইন।
— কিন্তু..
রোয়েন আমার কথার মাঝে ফোড়ন দিয়ে গম্ভীর কন্ঠে বলেন,
— এই নিয়ে আমি কথা বাড়াতে চাই না। যাও গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ো৷
আমি অস্ফুটস্বরে বলি,
— এমন…
রোয়েন আবারও আমায় বলতে না দিয়ে কিছুটা রাগ মিশ্রিত কন্ঠে বলে উঠেন,
— বলছি না ঘুমাতে যেতে তোমায়? একা থাকতে চাচ্ছি আমি। একা থাকতে দাও আমায়।
রোয়েন এই কথার পৃষ্ঠে আর কথা বলার ক্ষমতা থাকলো না আমার। বাক্যহারা হয়ে গেলাম যেন। নয়ন দু’টি হয়ে উঠলো সিক্ত। আমি আর কিছু না বলে নিঃশব্দে চলে আসি রুমে। ক্ষণেই গা এলিয়ে দেই বিছানায়। চোখের পাতা দুইটি বন্ধ করতেই চোখের কার্নিশ বেয়ে গড়িয়ে পড়লো অশ্রুকণা। রোয়েনের এমন ব্যবহার আমি কোনভাবেই মেনে নিতে পারছি না। বেশ কষ্ট হচ্ছে আমার। গলাটা বার বার ধরে আসছে। নিজেকে বার বার বুঝ দিচ্ছি, তাঁর এমন আচরণের পিছনে নিশ্চয়ই কোন কারণ আছে। তিনি এইভাবেই একরোখা মানুষ। নিজের সমস্যার ব্যাপারে কখনো মুখ ফুটে বলতে পারেন না। এইবারও হতে পারছেন না যার দরুন তিক্ত হয়ে এমন রুদ্ধ আচরণ করছে।
নিজেকে এতটা বুঝ দেওয়ার পরও শেষে এসে সব ছন্নছাড়া হয়েই যাচ্ছে। পারছি না মানতে আমার প্রতি মানুষটা এমন আচরণ। না চাইতেও ক্ষণে ক্ষণে দেখা দিচ্ছে অশ্রুজল। কিছুক্ষণের মাঝে আমি নিজেকে সামলে নিয়ে হাতের উল্টোপিঠ দিয়ে নিজের অশ্রুসিক্ত নয়ন দুটি মুছে নেই। অন্যপাশে কাত হয়ে গায়ে কম্বল জড়িয়ে চুপচাপ শুয়ে থাকি। নীরবে অপেক্ষা করতে থাকি রোয়েনের ভিতরে আসার। অপেক্ষার প্রহর গুনতে গুনতে যে কখন ঘুমিয়ে পড়ি তা বুঝে উঠতে পারলাম না।
______________________
নিকষ কালো আধার ভেদ করে সূর্যি উঁকি দিয়েছে পৃথিবীর বুক চিরে।সোনালি রৌদ্দুরের আভা গাছের পাতায় পাতায় নুইয়ে পড়ছে আদর মাখা পরাশে। সদ্য ঘুম ভাঙা পাখির কলতান মুখরিত হচ্ছে ব্যস্ত শহরের গাড়ির হর্ণের সাথে।শুভ্র প্রহরের রেশ আকাশের কোল জুড়ে লুটোপুটি খাচ্ছে। এক ফালি রোদের ঝলকানি চোখে এসে বিঁধতেই আমার ঘুম হালকা হয়ে আসে। ঘুম চোখেই একটু নড়েচড়ে উঠতে নিলেই বুঝতে পারি আমি কারো উষ্ণ আলিঙ্গনে আবদ্ধ। আমি একটু ঘাড় কাত করে পাশে তাকাতেই রোয়েনের ঘুমন্ত মুখখানি ভেসে উঠে। মুহূর্তেই ঠোঁটের কোনে ভেসে উঠে সরু হাসির রেখা। মনের মাঝে ছেঁয়ে যায় একরাশ মুগ্ধতা। প্রতিদিন সকালেই তার আলিঙ্গনে নিজেকে আবিষ্কার করা যেন এখন নিত্যদিনের ব্যাপার। কিন্তু তাও প্রত্যেকবারই এক আলাদা ভালোলাগা কাজ করে। বেশ কিছুক্ষণ এইভাবেই পেরুতেই হঠাৎ আমার কালকের কথাটা মস্তিষ্কে টনক নাড়ে। মুহূর্তেই ঠোঁটের কোনে ফুটে উঠা হাসিটা মিইয়ে যায়৷ চোখ মুখে ছেঁয়ে যায় এক রাশ অভিমান। আমি নিজেকে রোয়েনের আলিঙ্গন থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে উঠে বসি। নীরবে দীর্ঘশ্বাস ফেলে চলে যাই ফ্রেশ হতে।
নাস্তার টেবিলে বসে রুটি আর ভাজি চিবুচ্ছি আর আড়চোখে দেখছি রোয়েনকে। তিনি এক হাতে কফির কাপটা আর অন্য হাতে মুঠোফোন। খুব মনোযোগ দিয়ে কি যেন দেখছেন মুঠোফোনে। আমি কোন রকম শব্দ না করে নাস্তা করতে থাকি। রোয়েন কফিটা শেষ করেই উঠে পড়েন। আমি তা দেখে চট জলদি জিজ্ঞেস করি,
— নাস্তা করবেন না?
রোয়েন আমার কথায় স্থির হয়ে দাঁড়ান। নির্লিপ্ত গলায় বলে উঠেন,
— না।
— নাস্তাটা করে নিন। নাহলে পড়ে শরীর খারাপ করবে।
তিনি তিক্ত কন্ঠে বলে উঠেন,
— সেটা আমি বুঝে নিব।
কথাটা বলেই তিনি রুমে চলে যান আর আমি ঠোঁট কামড়ে মাথা নিচু করে বসে থাকি। কেন যেন, এই রোয়েনকে আমার বড্ড অচেনা লাগছে। মানতে পারছি না তাঁর এমন খাপছাড়া ব্যবহার। ধীরে ধীরে ভারী হতে থাকলো অভিমানে পাল্লা। আমি কোনেমতে নিজের সামলে নাস্তাটা সেড়ে উঠে পড়ি। ভার্সিটি যাব বলে রেডি হওয়ার জন্য রুমের দিকে এগিয়ে যাই। রুমে আসতেই পুনরায় সেই দগ্ধ পোড়া গন্ধ নাকে এসে বারি খায়। আমি বারান্দায় উঁকি দিতেই দেখি রোয়েন সেখানে এবং হাতে তাঁর সেই অনাকাঙ্ক্ষিত জিনিস। সিগারেট। আমি হতাশাজনক নিঃশ্বাস নিয়ে ওয়াশরুমে চলে যাই। ফ্রেশ হয়ে এসে দেখি রোয়েন ল্যাপটপ নিয়ে বসেছেন। আমি একপলক তাঁর দিকে তাকিয়ে ঘড়ির দিকে তাকালাম। রোয়েনের তো অফিসের সময় হয়ে গিয়েছে তাহলে উনি অফিসের জন্য রেডি হচ্ছেন না কেন? তিনি কি আজ অফিস যাবেন না? তিনি তো কখনো অফিস কামাই দেন না। কাজের প্রতি তিনি প্রচুর সিরিয়াস। আচ্ছা তাঁর আবার শরীর খারাপ করেনি তো? নাকি অন্য কোন সমস্যা? নিজের কৌতূহল দমিয়ে রাখতে না পেরে আমি জিজ্ঞেস করে উঠি,
— আপনি আজ অফিস যাবেন না? সময় চলে যাচ্ছে তো।
রোয়েন ল্যাপটপের দিকে তাকিয়ে থেকে বলেন,
— আজ যাব না।
আমি তাঁর দিকে এগিয়ে এসে বলি,
— আপনার শরীর খারাপ করছে? কোন সমস্যা? বললেন না তো কিছু।
রোয়েন গম্ভীর কন্ঠে বলেন,
— তেমন কিছুই না।
আমি প্রশ্নবোধক কন্ঠে জিজ্ঞেস করি,
— তাহলে?
— বললাম তো কিছুই না। আর আমাকে নিয়ে এত ভাবতে হবে না, তুমি ভার্সিটির জন্য রেডি হও। দেরি হয়ে যাচ্ছে তোমার৷
কথাটা কর্ণপাত হওয়া মাত্র আমি স্থির হয়ে যাই। ব্যথিত নয়নে তাকিয়ে থাকি তাঁর পানে। মনে মনে প্রশ্ন করে উঠি, ” আপনাকে নিয়ে চিন্তা করবো না তো কার জন্য চিন্তা করবো? আমার আপন বলতে আছে কে আর? যদি কোন সমস্যা থাকে তাহলে আমাকে কি তা বলা যায়না?
কেন করছেন এমন ব্যবহার আমার সাথে? কেন?” কিন্তু মুখ ফুটে আর কিছু বলা হলো না আমার। আরও ভারী হয়ে আসলো অভিমানের পাল্লা। কিছুক্ষণ রোয়েনের পানে তাকিয়ে থেকে আমি নীরবে রেডি হয়ে বেরিয়ে আসলাম বাসা থেকে।
চলবে
#নিভৃতে_যতনে
#Part_38
#Writer_Asfiya_Islam_Jannat
বারান্দার এক কোনে দাঁড়িয়ে শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি হলুদ রাঙ্গা আকাশের পানে। বিষিয়ে আছে মনটি। নয়ন দুইটিতে বিষন্নতার ছাপ স্পষ্ট। না চাইতেও রোয়েনের ব্যবহারগুলো বার বার ভাবাচ্ছে আমায়। ভার্সিটি থেকে আসার পর ঘরের কোথাও রোয়েনের দেখা মিলে নি। পলি আন্টিকে তাঁর কথা জিজ্ঞেস করতেই জানা গেল, তিনি নাকি অফিসে গিয়েছেন। কথাটা শোনামাত্র খানিকটা সময়ের জন্য কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে গিয়েছিলাম। কোন ভাবেই হিসাব মিলাতে পারছিলাম না। কেন না, সকালে আমি যখন জিজ্ঞেস করেছিলাম, অফিস যাবেন কি-না তখন তিনি অকপটে নাকচ করে দিয়েছিলেন। তার মানে কি উনি আমায় মিথ্যে বলেছিলেন? কিন্তু কেন? প্রশ্নটা মাথা চাড়া দিয়ে উঠতেই হতাশামূলক নিঃশ্বাস বেরিয়ে এলো বুক চিরে। অভিমানে সিক্ত হয়ে আসে নয়ন দুইটি। হঠাৎ করেই রোয়েনের মধ্যে আসা পরিবর্তনগুলো মেনে নিতে পারছিনা। তাঁর ব্যবহারগুলো বেশ পোড়াচ্ছে আমায়। সেই সাথে ভাবাচ্ছেও। দুইদিন আগেও তিনি স্বাভাবিক ছিলেন। আমাকে নিয়ে ঘুরেও এসেছিলেন। আমার প্রতি তাঁর ব্যবহারগুলো ছিল অতি স্নিগ্ধ। কিন্তু হুট করে তাঁর কি হয়ে গেলো কে জানে? এত জলদি এতটা পরিবর্তন, আদৌ কি সম্ভব?
কিছুটা প্রহর অতিবাহিত হতেই চারদিকে ভেসে উঠে এক মধুর ধ্বনি। মাগরিবের আযান দিচ্ছে। আযানের কলধ্বনি কর্ণধারে এসে বারি খেতেই নিজের স্তম্ভিত ফিরে পাই আমি। ক্ষণেই মাথায় কাপড় টেনে রুমে চলে যাই। ওযু করে নামাজ আদায় করে নেই। অতঃপর কিছুক্ষণ বিশ্রাম করে নিজের এসাইনমেন্টগুলো নিয়ে বসে পড়ি।
রাত নয়টা প্রায় ছুঁই ছুঁই। এখনো রোয়েনের আসার নাম গন্ধ নেই। আমি মুঠোফোনটা হাতে নিয়ে বার বার পায়চারী করছি। মনে মাঝে কু ডাকছে। উনি তো সহজে এত দেরি করেন না। তাহলে আজ কেন? বেশ কয়েকবার ফোন মিলিয়েছি রোয়েনের নাম্বারে। রিং হচ্ছে ঠিকই কিন্তু কেউ ফোনটা তুলছে না। এতক্ষণ চিন্তা হলেও এখন ভয় হচ্ছে প্রচুর। কাউকে যে বলবো সে উপায়ও নেই। কেন না এতে অন্যরাও চিন্তায় পড়ে যাবে। তার উপর এখন পাশেও কেউ নাই। রোয়েনের দেরি হচ্ছে বলে পলি আন্টি চলে গিয়েছেন ঘন্টাখানিক আগেই। যার দরুন সব এখন নিজেকেই বইতে হইছে। সময় যত গড়াচ্ছে ততই চিন্তা আর ভয় মাথা চাড়া দিয়ে উঠছে। বারংবার চোখের সামনে ভেসে উঠছে রোয়েনের এক্সিডেন্ট করা সেই রাতের কথা। যার ফলে কোনভাবেই ক্ষান্ত হতে পারছি না। ক্ষণেই ঠান্ডা হয়ে আসছে হাত-পা। নিজেকে বড্ড অগোছালো লাগছে৷
অবশেষে আমার অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে রাত দশটায় রোয়েন এসে হাজির হোন। দরজা খুলে তাকে দেখামাত্র সকল অভিমান ভুলে জড়িয়ে ধরে তাকে। কম্পিত কন্ঠে বলে উঠি,
— আপনি ঠিক আছেন তো? কিছু হয়নি তো আপনার? এত দেরি কেন করলেন আপনি? ফোন কেন ধরেন নি আমার? আমি কত ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম জানেন?
রোয়েন ম্লান হেসে এক হাত আমার পিঠে গলিয়ে দিয়ে বলেন,
— আমি ঠিক আছি। এত হাইপার হওয়ার কিছু নেই।
কথাটা শোনা যেন আমার জানে জান আসে। প্রশান্তির নিঃশ্বাস ত্যাগ করে নয়ন দুইটির পাতা বুজে ফেলি। হাত-পা কাঁপছে মৃদু পরিমাণ। বেশ কিছুক্ষণ এইভাবে অতিবাহিত হতেই আমি তাঁর থেকে সরে এসে দাঁড়াই। নির্লিপ্ত দৃষ্টিতে তাকাই তাঁর মুখপানে। ক্লান্তি ভরা মুখখানিতে ম্লান হাসি। আমি মিনমিনে গলায় বলি,
— এত দেরি কেন করলেন আপনি? ফোনও তুললেন না যে?
রোয়েন ভিতরে ঢুকতে ঢুকতে গলার টাই কিছুটা ঢিলে করে নেন। নির্লিপ্ত কন্ঠে বললেন,
— কাজ ছিল।
— একটা বার ফোন করে তো জানাতে পারতেন। ভয়ে ছিলাম আমি।
— মনে ছিল না।
কথাটা বলে তিনি রুমে চলে যান ফ্রেশ হতে আর আমি সেদিকে তাকিয়ে তপ্ত নিঃশ্বাস ত্যাগ করি। রোয়েন ফ্রেশ হয়ে আসতে আসতে আমি খাবার গরম করে ফেলি৷ খাবারগুলো টেবিলে সাজিয়ে চলে যাই রোয়েনকে ডাকতে। দরজা কাছে আসতেই দেখতে পাই রোয়েন আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুলগুলো মুছছে। আমি কোনরকম ভনিতা না করে বলি,
— খাবার গরম করেছি, খেতে আসুন।
— খাব না।
— কেন?
— খিদে নেই।
আমি কিছুটা রুদ্ধ কন্ঠে জিজ্ঞেস করি,
— খিদে নেই বলতে? আপনি কি বাইরে থেকে খেয়ে এসেছেন?
রোয়েন এইবার তিক্ত কন্ঠে বলে উঠেন,
— এখন কি সব কিছুর কৈফিয়ত তোমাকে দিতে হবে?
কথাটা শ্রবণ হওয়া মাত্র আমি স্তব্ধ হয়ে যাই। অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকি রোয়েনের পানে। এক রাশ অভিমান এসে ভর করে মনের মাঝে। ভারী হয়ে এর পাল্লা। রোয়েনকে কিছুটা সময় পর্যবেক্ষণ করে নিঃশব্দে বেরিয়ে আসি রুম থেকে। ডাইনিং এ এসে একটা প্লেটে খাবার সাজিয়ে ফেলি। খাবারটা মূলত রোয়েনের জন্য। মানুষটা রাতে না খেয়ে একদমই ঘুমাতে পারেনা। আমি তাঁর শুকনো মুখটা দেখেই বুঝেছি তিনি কিছু খায়নি। কিন্তু তাও সিউর হওয়ার জন্য জিজ্ঞেস করেছিলাম তাকে। কথাটা ভাবামাত্র বুক চিরে দীর্ঘ নিঃশ্বাস বেরিয়ে এলো।
তাঁর সাথে যতই অভিমান করি না কেন, তাঁকে তো হেলায় ফেলে দিতে পারিনা। দিন শেষে তাঁকে দেখে রাখার দায়িত্ব আমারই।
খাবার নিয়ে আমি এগিয়ে যাই রুমে। রুমে আসতেই দেখি রোয়েন মাথায় এক হাত রেখে শুয়ে আছেন। আমি নিঃশব্দে এগিয়ে যাই তাঁর দিকে। বেড সাইড টেবিলে প্লেটটা রেখে তাঁর বাহুতে হালকা টান দেই। তিনি সচকিত দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকাতেই আমি আমি কাঠ কাঠ গলায় বলে উঠি,
— খেয়ে নিন।
তিনি গম্ভীর কন্ঠে বলেন,
— বললাম তো খাব না।
— খেতে বলেছি খাবেন। এত কথা কেন বলেন? উঠুন বলছি।
এইভাবে বেশ কিছুক্ষণ তর্ক বিতর্কের পর রোয়েন বিরক্তিতে ‘চ’ উচ্চারণ করার মত শব্দ করে উঠে বসে। আমি আর কিছু না বলে প্লেট হাতে তুলে নেই। খুব সপ্তপর্ণে তাঁর মুখে তুলে খাবারটুকু। রোয়েন কিছুক্ষণ আমার মুখপানে তাকিয়ে থেকে বিনাবাক্যে খাবারটুকু খেয়ে নেন।
রোয়েনকে খায়িয়ে দিয়ে নিজেও খেয়ে নেই কিছুটা। অতঃপর সব গুছিয়ে রুমে আসতেই তৃতীয় বারের মত সেই দগ্ধ পোড়া গন্ধটি নাকে এসে বারি খায়। ক্ষণেই মেজাজ খারাপ হয়ে যায় আমার। আমি উনার সামনে গিয়ে তিক্ত কন্ঠে বলে উঠি,
— আবার এইসব ছাইপাঁশ খাচ্ছেন? এখনই ফেলুন ওইটা বলছি।
তিনি কঠোর সুরে বলেন,
— রুমে যাও।
— আগে ফেলুন ওইটা বলছি।
— আমার বিষয়ে হস্তক্ষেপ করতে বলি নি তোমায়।
আমি তেঁতে উঠে বলি,
— আপনি বললেই হলো?
রোয়েন এইবার তেজী গলায় বলে উঠেন,
— বলছি না এইসব বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করতে? একবারে বুঝো না কথাটা? রুমে যাও বলছি।
মুহূর্তেই নয়ন দুইটি সিক্ত হয়ে আসলো। আমি চোখের পানি লুকাতে দ্রুত সেই জায়গা থেকে সরে আসি৷ রুমের লাইট অফ করে বিছানায় গা এলিয়ে দেই। চোখের কার্নিশ বেয়ে গড়িয়ে পড়ে কয়েক ফোটা নোনাজল। জলন্ত সিগারেট হয়তো রোয়েনের হাতে কিন্তু তার দহনে পুড়ছি আমি। কেন করছে এমন উনি? আমি তো আর তাঁর খারাপ চাইছি না, তাহলে? এতটা কঠোরতা কেন? পরের মত আচরণ কেন করছেন তিনি? শুনেছি, সম্পর্কের বয়স যত বাড়ে ততোই অনিহা আর অনুগ্রহ স্থান পায়। একটা গ্যাপ চলে আসে৷ আমাদের বেলাও কি তাই হচ্ছে? নাকি অন্য কিছু? আপাতত প্রশ্নগুলো ছুঁড়ে ফেলে অভিমান জিনিসটাকে আঁকড়ে ধরি আমি। অভিমানের বসেই সিদ্ধান্ত নেই, তিনি যেহেতু চাইছেন আমায় দূরে সরিয়ে রাখতে তাহলে তাই হোক। বলবো না আমি আর কোন কথা। হঠাৎ রোয়েনের পায়ের আওয়াজ পেতেই আমি নিজের চোখের জলটুকু মুছে নেই৷ চুপটি মেরে শুয়ে থাকি৷ ক্ষণেই রোয়েন আমার পাশে এসে শুয়ে পড়েন। দুইজনের মাঝে তখন পিনপতন নীরবতা। হঠাৎ রোয়েন আমার কোমড় পেঁচিয়ে নিজের উষ্ণ আলিঙ্গনে জড়িয়ে নেন। মুহূর্তেই আমি ভড়কে যাই। ঘটনাক্রমে বুঝতে একটু সময় লাগে আমার। আমি এতে অভ্যস্ত হলেও আজ অপ্রস্তুত হয়ে পড়ি। তাই প্রথমে একটু হাঁসফাঁস করলেও পরবর্তীতে স্থির হয়ে যাই। সিগারেটের মৃদু গন্ধ আসছে। এতে গা গুলিয়ে আসলেও আমি চুপটি মেরে শুয়ে থাকি। হঠাৎ রোয়েন বলে উঠেন,
— সিয়াশা!
নিজের নামটা তাঁর মুখে উচ্চারিত হওয়া মাত্র বুকটা মুচড়ে উঠে আমার। মনে হলো, কন্ঠটা যেন কেমন শোনালো। তাঁর এই ডাক শুনে বুকের মাঝে বয়ে যেতে শুরু করে এক ঝড়। এই ডাক যে উপেক্ষা করার ক্ষমতা আল্লাহ আমাকে দেননি। না চাইতেও আমি ছোট করে বলে উঠি,
— হু!
— একটা কঠিন প্রশ্নের উত্তর চাই তোমার থেকে। দিবে কি?
আমি নিচু স্বরে বলি,
— করুন।
রোয়েন তপ্ত নিঃশ্বাস ত্যাগ করে বলেন,
— আমার সাথে থাকতে গিয়ে যদি কোনদিন চরম বাস্তবতার স্বীকার হও তখন তুমি কি করবে? এই সংসার ছেড়ে চলে যাবে নাকি থেকে যাবে?
আমি চকিত দৃষ্টিতে তাঁর দিকে তাকাই। হঠাৎ এমন প্রশ্ন করার মানে কি খুঁজে বের করার চেষ্টা করি। কেমন বাস্তবতা? আর তাঁর কেন মনে হচ্ছে আমি সেই বাস্তবতার মুখোমুখি হলে সংসার ছেড়ে চলেও যেতে পারি? এত এত প্রশ্নের ভিড়ে সবকিছুই যেন এখন গোলক ধাঁধা লাগছে। যার আগামাথা কিছুই বুঝে উঠতে পারছি না আমি। বেশ কিছুক্ষণ চুপ থেকে আমি নিরপেক্ষভাবে উত্তর দেই,
— সেটা পরিস্থিতির উপর নির্ভর করে। সকল পরিস্থিতি যেমন এক না, তেমনই এর প্রতিকারও এক না। পরিস্থিতি বুঝেই সিদ্ধান্ত নিতে হয়।
আমার কথার পৃষ্ঠে কোন কথা বললেন না। শুধু কয়েকটা দীর্ঘনিশ্বাস বেরিয়ে তার বুক চিরে। যার কলধ্বনি ছিল আমার নিকট অতি স্পষ্ট।
চলবে