নিভৃতে_যতনে Part_41,42

0
2217

নিভৃতে_যতনে
Part_41,42
Writer_Asfiya_Islam_Jannat
Part_41

বিষন্নতার চাদর মুড়ি দিয়ে আকাশে ভিড় করেছে ধসূর রাঙ্গা মেঘ। দমকা হাওয়ার প্রকট, সেই সাথে মৃদু পরিমাণে মেঘের গর্জন। ধুলোবালিতে মাখোমাখো পরিবেশ। কালবৈশাখী ঝড়ের পূর্বভাস। আমি দুই কাপ কফি হাতে নিয়ে ঘরে ঢুকতে না ঢুকতে ক্ষণেই বিষন্নতা প্রগাঢ়তা কমাতে ঝুম করে নেমে পড়লো এক পশলা বৃষ্টি। আমি একপলক জানালা দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে রোয়েনের দিকে এক কাপ কফি এগিয়ে দেই। অতঃপর চেয়ার টেনে জানালার ধারে বসে পড়ি আমি। একমনে তাকিয়ে থাকি বৃষ্টির পানে। ভাবতে থাকি পুরোনো স্মৃতির কথা। এক বছর পূর্বে এমনই এক অনাকাঙ্ক্ষিত বর্ষণের দিনের জানা হয়েছিল আপন মানুষটি মনের কথা। অনুভব করেছিলাম তাঁর উষ্ণ ছোঁয়া। নিভৃতে গড়া সম্পর্কটি নিভৃতেই পূর্ণতা পেয়েছিল ক্ষণেই। আর সেটার সাক্ষী ছিল এই বৃষ্টির কণাগুলো। অবশ্য এমন ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অজস্র অনুভূতি, স্মৃতির সাক্ষীই এই বৃষ্টি কণাগুলো। হঠাৎই ঠোঁটের কোনে ফুটে উঠে এক চিলতে হাসি। আমি বৃষ্টি হতে নিজের দৃষ্টি সরিয়ে নিয়ে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকাই রোয়েনের দিকে। রোয়েন আমার দিকেই তাকিয়ে ছিল যার দরুন চারটি চোখ এক বিন্দুতে এসে মিলিত হয়। চোখের ভাষা আদান-প্রদান হতে থাকে নীরবেই। তাঁর অদ্ভুত মায়াযুক্ত চোখের পানে দৃষ্টি স্থির রাখাটা দায় হয়ে আসতেই দৃষ্টি নত করে ফেলি আমি। আলতো হাতে কানের পিঠে গুঁজে নেই অবাদ্ধ চুলগুলো। এই চোখের গভীরে যে আমার সর্বনাশ। আমি দৃষ্টি নত রেখেই ছোট ছোট চুমুক বসাতে থাকি কফির কাপে। হঠাৎ রোয়েন বলে উঠেন,

— সামনে কি করবে ঠিক করেছ কিছু?

আমি একপলক রোয়েনের দিকে তাকিয়ে বলি,

— উঁহু।

অতঃপর কিছুক্ষণ চুপ থেকে ভিতরে কথাগুলো খানিকটা গুছিয়ে নিলাম আমি। নরম সুরে বলি,

— এখনো কোন সিদ্ধান্ত নেই নি আমি। কিন্তু ভাবছি এখন নিয়ে নিব।

আমার কথার মাঝে রোয়েন ফোড়ন দিয়ে বলেন,

— সেমিস্টার গ্যাপ দিবে তাই তো?

আমি স্মিত হেসে বলি,

— হু! আর এক সেমিস্টার গ্যাপ দিলে কিছু হবে না। পরে সেমিস্টার কমপ্লিট করে নিব নে।

রোয়েন কিছু না বলে শুধু আমার পানে তাকিয়ে থাকেন। অতি মলিন তাঁর চাহনি। আমি পুনরায় একপলক তাঁর দিকে তাকিয়ে থেকে দৃষ্টিতে সরিয়ে নেই৷ তাঁর চোখে চোখ রাখার দুঃসাহসিকতা আমার নেই। এখন তো একদমই নেই। কেন না, এই দৃষ্টি যে আজকাল ব্যর্থতায় ভরা। তার দৃষ্টি স্পষ্ট বলে উঠছে, টাকার সামনে হেরে গিয়েছেন তিনি। অনিশ্চিত হয়ে উঠেছে তাঁর জীবনযাত্রার মান। যার দরুন আজ সে জোড় গলায় আমায় বলতেও পারছেন না, “তোমার সেমিস্টার গ্যাপ দেওয়ার কোন প্রয়োজন নেই। আমি ব্যবস্থা করে নিব।” মানুষটাকে আগে কখনো এতটা মলিন চাহনিতে দেখিনি। সর্বদা শক্ত-পোক্ত আর নির্মল-শীতল চাহনিতেই দেখেছি। অথচ আজ পরিস্থিতির থাবার নিচে পরে বদলে গেছে সবটাই। আমি গোপনে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে তাকে সামাল দেওয়ার জন্য বলে উঠি,

— আগে না-হয় সংসার গুছাই তারপর না-হয় ক্যারিয়ারটা গোছাবো। আর আপনি তো সর্বদা আছেনই আমার পাশে। আমাকে সাপোর্ট করতে৷ কি আছেন না পাশে?

রোয়েন আমার কথা শুনে দীর্ঘনিশ্বাস ফেলেন। তা দেখে আমি আশ্বস্ত দিয়ে বলি,

— ইনশাআল্লাহ সব ঠিক হয়ে যাবে। চেষ্টা তো দুইজনই করছি, কারো না কারো তো চেষ্টা সফল হবেই।

রোয়েন তপ্ত নিশ্বাস ছেড়ে বলেন,

— হু।

আমি প্রসস্থ এক হাসি হেসে কফির কাপটা টেবিলের উপর রেখে এগিয়ে যাই রোয়েনের দিকে। তাঁর একটি বাহু টেনে বলি,

— ছাদে চলুন, বৃষ্টিতে ভিজবো।

তিনি ভ্রু কুটি কুঞ্চিত করে বলেন,

— কি করতে?

আমি দাঁত কেলিয়ে বলি,

— উষ্টা খেতে। এখন চলুন তো।

তিনি একরাশ বিরক্তি নিয়ে বলেন,

— তো একা গিয়ে খাও না। আমায় কেন টানছো?

— আপনি আমার জামাই তাই।

কথাটা বলেই তাঁর হাত ধরে টানতে শুরু করলাম। আগাত তাঁকে উঠতে হলো। একরকম বাধ্য হয়েই পা বাড়ালেন আমার সাথে ছাদের উদ্দেশ্যে। ছাদে আসতেই আমি তাঁকে টেনে দাঁড় করাই বৃষ্টি মাঝে। মিষ্টি হাসি হেসে বলি,

— হাজারো দুঃখের মাঝে বিন্দু বিন্দু সুখ খুজে পাহাড় সম সুখ উপভোগ করার চেষ্টা করতে হয়।নাহলে একসময় জীবন বিষাক্ত হয়ে উঠে।

রোয়েন কিছুক্ষণ আমার পানে তাকিয়ে থেকে নির্লিপ্ত কন্ঠে বলে উঠেন,

— তুমি কি জানো, তুমি আমার ভাবনার চাইতেও বেশী শক্ত?

আমি কিছু না বলে মৃদু হাসি। তাঁর থেকে কয়েক কদম পিছিয়ে গিয়ে দুই হাত ছড়িয়ে দেই দুইপাশে। চোখ দুইটি বন্ধ করে উপভোগ করতে থাকি বৃষ্টির একেকটা শীতল শিহরণ৷ প্রাণভরে কাঁচামাটির গন্ধ নিঃশ্বাসে ভরতে থাকি। কিছুক্ষণের জন্য জীবনের সকলের গ্লানি,কষ্ট ভাসিয়ে দেই বৃষ্টির স্রোতে।

____________________

আমি মুসকার আর মাহিরকে পড়াচ্ছি এমন সময় জাবিন আন্টি ট্রেতে করে কিছু ফল আর শরবত নিয়ে আসলেন। টেবিলের একপাশে সেগুলো রাখতে রাখতে বলে উঠেন,

— ভালো আছো তুমি?

আমি সৌজন্যমূলক হাসি হেসে বলি,

— জ্বী আলহামদুলিল্লাহ আন্টি। আপনার শরীর ভালো আছে?

— এইতো। তা তোমার সাথে কিছু কথা ছিল আমার।

কথাটা শোনা মাত্র হাসির মাত্রাটা কমে আসে।ক্ষণেই বুকটা ধক করে উঠে। ভীতি ঢুকে যায় মনে, ‘টিউশন হাতছাড়া হয়ে যাবে না-তো?’ আমি কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বলে উঠি,

— জ্বী আন্টি বলুন।

— তুমি কয়েকদিন আর কিছু টিউশনির খোঁজ করছিলে না?

— করছিলাম তো।

— তো আমার কাছে একটা প্রস্তাব ছিল তোমার জন্য।

আমি ভ্রু কুটি কুঞ্চিত করে বলি,

— কি প্রস্তাব?

— আমার বোনের ভাসুর একটা কোচিং সেন্টার চালায়। সেখানে নতুন কিছু টিচার নিয়োগ করবে বলে আমাকে বলছিল। তখন আমি তোমার কথা বলেছিলাম। তা তুমি কি কোচিং সেন্টারে পড়াতে চাও?

আন্টির কথা শেষ হতেই প্রাণে প্রাণ ফিরে পাই আমি। প্রশান্তির এক নিঃশ্বাস নিয়ে জিহ্বা দিয়ে শুকনো ঠোঁট ভিজিয়ে নিয়ে বিনয়ী সুরে বললাম,

— আমি পরে আপনাকে জানাবো৷

— আচ্ছা সমস্যা নেই। জানিও পরে।

কথাটা বলেই তিনি চলে গেলেন। আমিও বুক ভরা আশা নিয়ে পড়াতে শুরু করলাম।

____________________

কফির কাপে ছোট ছোট চুমুক বসাচ্ছি আর আড়চোখে রোয়েনকে পর্যবেক্ষণ করে চলেছি। তিনি মনোযোগ দিয়ে ল্যাপটপ চালাচ্ছেন। আমি মনে মনে বার বার কথাগুলো গুছিয়ে নিচ্ছি। কিন্তু তাও কিভাবে কথাটা শুরু করবো তাই বুঝে উঠতে পারছি না। কেন না আমি চাইছি, টিচার হিসাবে রোয়েন নিয়োগ হোন। তিনি আপাতত কিছু একটা করুন। এইভাবে এক জায়গায় থেকে আরেক জায়গায় দৌড়াতে দৌড়াতে তো একসময় হতাশ হয়ে পড়বেন। ভেঙে পড়বেন একসময়। এর চেয়ে ভালো কিছু একটা না-হয় করুক। মন অন্য কোথাও স্থির হোক।
আমি কথা খুঁজে না পেয়ে বেশ কয়েকবার গলা ঝেড়ে উঠি। রোয়েন তা বুঝে বলে উঠেন,

— কিছু বলবে?

আমি মিনমিনে সুরে বলি,

— হু।

রোয়েন ল্যাপটপের দিকে নজর রেখেই বলেন,

— বলো।

আমি জিহ্বা দিয়ে শুকনো ঠোঁট ভিজিয়ে নেই। কোন ভূমিকা ছাড়াই বলতে শুরু করি,

— মুসকানের আম্মু তার পরিচিত একটা কোচিং সেন্টারের কথা বলছিলেন। সেখানে নাকি কিছু টিচার লাগবে। তা আমি চাচ্ছিলাম যে, আপনার কথা বলতে। ইন্টারভিউ দেওয়া বাদে তো ফ্রিই থাকেন বেশির ভাগ। আপনার কাছে যেহেতু সময় আছেই সেহেতু সময়টাকে কাজে লাগালে তো মন্দ হয়না।

তিনি নির্লিপ্ত কন্ঠে বলেন,

— এইসবের মধ্যে আমি নেই। পড়ানো বিষয়টা এখন আর আমার দ্বারা সম্ভব না।

আমি তপ্ত নিঃশ্বাস ছেড়ে বলি,

— চেষ্টা করতে সমস্যা কি?

তিনি নির্বিকার ভঙ্গিতে বলেন,

— আমার বদলে না-হয় তুমি করো।

আমি খানিকটা ভড়কে গিয়ে বলি,

— আমি?

— হুম। দুইটা স্টুডেন্ট তো একসাথে পড়াচ্ছোই। এইবার না-হয় দশ-বারোজন পড়ালে।

আমি ইতস্তত করে বলি,

— কিন্তু….

রোয়েন আমার দিকে তাকিয়ে বলেন,

— তুমি করলে সমস্যা বা কোথায়? সুযোগ যেহেতু আসছে সেহেতু সেটা কাজে লাগাতে শিখো।

___________________

আমি সকল ছাত্র-ছাত্রীদের পড়াচ্ছি আর বার বার জালানা দিয়ে বাইরের আবহাওয়া পর্যবেক্ষণ করছি। ঘনকালো মেঘের আবরণে ঢেকে আছে বিশাল আকাশটি। বিকেল হওয়া সত্ত্বেও চারদিকে ছড়িয়ে আছে নিকষ অন্ধকার। থেমে থেমে বইছে ঝোড়ো হাওয়া। ঝড় না নামলেও মুষলধারে বৃষ্টি ঠিকই নামবে আজ। আমি দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে পুনরায় ছাত্র-ছাত্রীদের পড়াতে মনোযোগী হলাম। এই কোচিং সেন্টারে টিচার হিসাবে নিয়োগ হয়েছি প্রায় একমাসের ছুঁইছুঁই। রোয়েন কথাতেই আমি জাবিন আন্টিকে হ্যাঁ বলেছিলাম। অতঃপর জাবিন আন্টিই আমাকে এইখানে নিয়ে এসে পরিচয় করিয়ে দেন। অবশ্য আমার নিয়োগ হওয়ার আগে রোয়েন কোচিংটির সম্পর্কে সকল তথ্য ভালো মত যাচাই বাছাই করে নিয়েছিলেন। সব ঠিক আছে নিশ্চিত হওয়ার পরই আমি নিয়োগ হয়েছিলাম এইখানে। রোয়েনও এখন একবারে বেকার বসে নেই। ফ্রিল্যান্সিং-এর দিকে জোড় দিচ্ছেন কিছুটা। যতদিন না ঠিকঠাক মনের মত একটা জব পাচ্ছেন ততোদিন ফ্রিল্যান্সিং করবে বলে জানিয়েছেন৷ এতে অবশ্য আমার আপত্তি নেই। মানুষটা একবারে খালি বসে থাকার চেয়ে কিছু একটা করুক এইটাই আমার কাম্য।

পড়ানো শেষ করে আমি অফিস-রুমে চলে যাই। কিছু পেপারের কাজ ছিল বিধায় বের হতে খানিকটা সময় লেগে যায়। কাজ শেষ হওয়া মাত্র কাঁধে ব্যাগ চেপে বেরিয়ে পড়ি আমি। সিড়ি ভেঙ্গে নামতে নামতেই ধরণীর বুকে নেমে পড়ে মুষলধারে বৃষ্টি। নিচে গেটের সামনে এসে বৃষ্টির দাপট দেখে বিরক্তি মুখ ঘুচে আসে আমার। চারদিকে চোখ বুলিয়ে দেখি রাস্তা-ঘাট একদম খালি। মানুষজন তেমন নেই বললেই চলে। ছাত্র-ছাত্রীরাও চলে গিয়েছে সব। আজ আবার এক ইন্টারভিউ আছে বিধায় রোয়েন আমায় নিতে আসতে পারবেন না বলে জানিয়েছিলেন। তাই যেতে হলে আজ একাই যেতে হবে। কিন্তু যে পরিস্থিতিতে তাতে রিকশা পাওয়া দুষ্কর ঠেকছে এখন। ব্যাগে কিছু দরকারী কাগজ না থাকলে ভিজেই যাওয়া যেত কিন্তু সেটা তো এখন সম্ভব নয়। আমি বিরক্তিতে মৃদুস্বরে বলে উঠি, ‘ধ্যাত!’

বেশ কিছুক্ষণ নিচে দাঁড়িয়ে বৃষ্টি থামার অপেক্ষা করলাম। সেই সাথে যাতায়াতের জন্য যানবাহনের সন্ধান করলাম বহুক্ষণ। কিন্তু শেষে বৃষ্টি প্রলেপ বাড়তেই হাল ছেড়ে দেই আমি। চারদিকটা একদম জনমানবশূন্য বলে আমি উপরে যাওয়ার জন্য পা বাড়াই। ঠিক তখনই পিছন থেকে ভেসে আসে কাঙ্ক্ষিত মানুষটির সুমধুর কন্ঠ।

চলবে

#নিভৃতে_যতনে
#Part_42
#Writer_Asfiya_Islam_Jannat

বৃষ্টির রিনিঝিনি শব্দের মাঝে কাঙ্ক্ষিত মানুষটির কন্ঠ প্রতিধ্বনি হতেই আমি পীলে চমকে উঠি। সচকিত দৃষ্টিতে ঘুরে দাঁড়াই। দরজার ঠিক একটু সামনে কাকভেজা অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছে রোয়েন। তাঁকে দেখামাত্র আপনা-আপনি ঠোঁটের কোনে ফুটে উঠে সরু হাসি রেখা। স্থির হয়ে দৃষ্টি। হালকা আকাশী রঙের শার্ট লেপ্টে আছে গায়ে। ভেজা চুলগুলো এলোমেলো হয়ে লেপ্টে আছে কপাল জুড়ে। চিবুকের ধার ঘেঁষে চুয়ে চুয়ে পড়ছে পানি। চোখে মুখে ছেয়ে আছে ক্লান্তির ছোঁয়া। মানুষটা দূরত্ব ঘুচে বৃষ্টিতে ম্লান করে একমাত্র আমার জন্য ভাবতেই মনের ভিতর খেলে যায় প্রশান্তির ঢেউ। আমি তাঁর দিকে কয়েক কদম এগিয়ে আসতেই জিজ্ঞেস করি,

— আপনার না ইন্টারভিউ ছিল?

রোয়েন নিজের চুলে হাত গলিয়ে চুল ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে বলেন,

— ক্যান্সাল হয়ে গিয়েছে।

আমি তাঁর পাশে দাঁড়িয়ে স্বগতোক্তি কন্ঠে বলি,

— এই বৃষ্টির মধ্যে আসার কি প্রয়োজন ছিল বলুন তো? পুরো ভিজে গিয়েছেন।

— ছিল বলেই এসেছি।

কথাটা বলেই তিনি আমার ওরনার শেষাংশ টেনে সামনে নিয়ে এসে চুলগুলো মুচতে শুরু করেন। মুহূর্তেই আমি ভড়কে যাই। বোকা বোকা চাহনিতে তাকিয়ে থাকি তাঁর পানে। মানুষটা শান্ত হলেও কিছুটা পাগলাটে ধরনে। এইভাবে বুঝা না গেলেও তাঁর কর্মকাণ্ড খুবই সুক্ষ্মভাবে পর্যবেক্ষণ করলেই সেটা বুঝা সম্ভব। আমি নিজেকে কিছুটা সামলে নিয়ে তাঁর হাত সরিয়ে দিয়ে নিজেই তাঁর চুলগুলো মুছে দেই। অতঃপর স্মিত হেসে বলি,

— উপরে এসে বসুন না-হয়। বৃষ্টি তো থামার কোন নাম-গন্ধ দেখছি না।

তিনি সটান হয়ে দাঁড়িয়ে বলেন,

— বৃষ্টিতে ভিজেই না-হয় যাবো।

আমি অবাক হয়ে বলি,

— মানে?

— যা বুঝলে।

কথাটা বলে তিনি আমার হাত চেপে ধরলেন। তৎক্ষনাৎ আমি মৃদু চিৎকার দিয়ে বলি,

— সম্ভব না! আমার ব্যাগে কিছু দরকারী কাগজ আছে। সেগুলো ভিজলে পরে সমস্যা হবে।

রোয়েন আমার দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে কিছু একটা ভাবেন। অতঃপর কিছু না বলে হাতটা ছেড়ে দেন। বা পাশের পকেটে হাত দিয়ে একটা পলিথিন বের করে আমার দিকে এগিয়ে বলেন,

— অন্যদের শিক্ষা দান করার সাথে সাথে কি নিজের বুদ্ধিও দান করে দিচ্ছ নাকি? ষ্টুপিড!

কথাটা শুনে আমি গাল ফুলিয়ে তাঁর দিকে তাকাই। তেতো মুখে বলি,

— আসলেই আপনি একটা খাটাশ।

রোয়েন আমার দিকে ভ্রু কুঞ্চিত দৃষ্টি নিক্ষেপ করতেই আমি ভেংচি কেটে তাঁর হাত থেকে পলিথিনটা নিয়ে নেই।

_____________________

জৈষ্ঠ্যমাসের তপ্ত রৌদ্রময় দুপুরে গাছে গাছে ফুটে উঠেছে অগ্নিঝরা ন্যায় কৃষ্ণচূড়া। মৃদু বাতাসের দোলানীতে দোল খাচ্ছে ফুলের পাপড়িগুলো। কয়েকটা আবার ঝরে পড়ছে মসৃণ মাটির বুকে। নীলাভ আকাশের বুকে বিরাজমান করেছে শুভ্র রঙ্গের মুগ্ধতা। সেই সাথে আমার মন জুড়েও। শুভ্র রঙ্গের মুগ্ধতা নয় প্রণয়ের মুগ্ধতা। এই মুগ্ধতার উৎপত্তির কারণ হচ্ছে আজকের দিনটা। আজ রোয়েন আর আমার দ্বিতীয় বিবাহবার্ষিকী৷ আগেরবারের আমি দিনটা ভুলে গেলেও এইবার আমি দিনটা ভুলিনি। মনে রেখেছি। সেই সাথে বাসায় বিশেষ কিছু করার উদ্যোগও নিয়েছি। কিন্তু এইবার রোয়েনের দিনটা মনে আছে কি-না জানি না। কেন না, কোন বিশেষ প্রতিক্রিয়া পরিলক্ষিত হয়নি তাঁর মাঝে। বাকি দিনকার মতই তিনি একদম স্বাভাবিক ছিলেন। তার উপর আজ তিনটে-চারটে ইন্টারভিউ আছে বলে সকালেই বেরিয়ে পড়েছিলেন তিনি। তাই বেশি কথাও হয়নি। অবশ্য আজ তিনি সারাদিন বাইরে থাকবে বলে আমার জন্য ভালোই হয়েছে। নিজের কাজগুলো নিরদ্বিধায় সম্পন্ন করতে পারবো আমি। টাকা-পয়সার সমস্যা এখন তেমন একটা না-হলেও ঘটা করে কিছু করার ইচ্ছে নেই আমার। মানুষটা সবকিছু সাদামাটা পছন্দ করে বলে সেভাবেই সবটা করবো বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছি।
রোয়েনের সকল পছন্দের খাবারই আজ নিজ হাতে রান্না করেছি আমি। সেই সাথে রোয়েনের রেড ভেলভেট কেক প্রিয় বলে সেটাও এখন বানানোর প্রস্তুতি নিচ্ছি। কেক-এর মিক্সটা চুলায় বসিয়ে দিয়ে আমি ফ্রেশ হতে চলে যাই। ফ্রেশ হয়ে এসে কেকটা নামিয়ে ফেলি আমি। অতঃপর ক্রিম চিজ ফ্রস্টিং দিয়ে সাজিয়ে নিয়ে ফ্রিজে রেখে দেই।
রোয়েনের আসার আগে আমি একটু পরিপাটি হয়ে নিলাম। সব রুম আরেকবার গুছিয়ে নিলাম। সব কাজ শেষে আমি ক্ষান্ত হলাম। সোফায় গা একটু হেলিয়ে বসে চোখ বন্ধ করে থাকলাম। অপেক্ষা প্রহর গুনতে থামলাম তাঁর আসার।
সন্ধ্যা গড়িয়ে পড়তেই রোয়েনের আগমন হলো। সজাগ ছিলাম বিধায় দরজার বেল চাপতেই আমি দৌড়ে দরজা খুলে দিলাম। ক্ষণেই ভেসে উঠে তাঁর ক্লান্তিমাখা চেহেরা। আমি স্মিত হেসে দরজার পাশ থেকে সরে দাঁড়াতেই তিনি ঘরে প্রবেশ করেন। এদিক-সেদিক না তাকিয়ে সোজা রুমে চলে গেলেন। আমি আগে থেকেই বিছানায় তাঁর কাপড় রেখে দিয়েছিলাম বলে তিনি সেটা নিয়ে ফ্রেশ হতে চলে গেলেন। ফ্রেশ হয়ে আসতেই আমি তাঁর দিকে এক গ্লাস লেবুর শরবত এগিয়ে দিলাম। তিনি একপলক আমার দিকে তাকিয়ে গ্লাসটা হাতে নিয়ে নিলেন। অতঃপর অর্ধেকটা খেয়ে আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলেন,

— খাও!

আমি কিছুক্ষণ গ্লাসটার দিকে তাকিয়ে থেকে প্রশান্তির নিশ্বাস ফেলি। এইটা তাঁর নিত্যদিনের অভ্যাস। তাঁকে একগ্লাস শরবত দিলে তিনি অর্ধেকটা খেয়ে আমাকে বাকি অর্ধেকটা দিয়ে দিবেন। অবশ্য এইটা শুধু শরবতের বেলায় তা কিন্তু নয়। তাঁর সবকিছুতেই যে আমার একাংশ ভাগ বরাদ্দ আছে তা তিনি অপ্রকাশিত ভাবেই বেশ বুঝিয়ে দেন আমায়। আমি গ্লাসটা হাতে নিয়ে বলি,

— প্রতিবার নিজের ভাগের অর্ধেকটা আমায় না দিলে হয় না?

রোয়েন আমার দিকে তাকিয়ে বলেন,

— আমার সবকিছুর অর্ধাংশের অধিকারপ্রাপ্ত সে। তাঁকে যে কিছু থেকে বঞ্চিত করার দুঃসাহস আমার নেই।

আমি কিছুটা না বলে প্রসস্থ এক হাসি উপহার দেই তাঁকে। অতঃপর শরবতটুকু খেয়ে সাইড টেবিলে গ্লাসটা রেখে কাবার্ডের সামনে চলে যাই। আমার সাইডের কাবার্ডটা খুলে কাপড়ের ভাঁজ থেকে একটা টাই-এর বক্স বের করি। সেই সাথে রোয়েনের পছন্দের একটা পারফিউমের বক্সও। তাঁকে দেখে যতটুকু অনুমান করলাম তিনি আজকের দিনটার কথা ভুলে গিয়েছেন। এত ব্যস্ততা আর চিন্তার মাঝে ভুলে যাওয়াটা অস্বাভাবিক কিছু না। তাই নিয়ে আমার কোন আক্ষেপ নেই। আগের বার তিনি আমায় ভড়কে দিয়েছিলেন এইবার না-হয় আমি দেব।
তাঁর দিকে একবার সতর্ক দৃষ্টিতে তাকাতাম। তিনি আধশোয়া হয়ে চোখ দুইটি বন্ধ করে শুয়ে আছেন। তা দেখে আমি বক্স দু’টি কাপড়ের উপরে রেখেই চট জলদি ফ্রিজ থেকে কেকটা নিয়ে আসি৷ অতঃপর রোয়েনের দিকে এগিয়ে যাই কেকটা নিয়ে। তাঁর পাশে গিয়ে বসে মৃদুস্বরে বলি,

— শুভ বিবাহবার্ষিকী!

ক্ষণেই রোয়েন চোখ খুলে সচকিত দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকায়। আমি হাসিমুখে তাঁর দিকে কেকটা এগিয়ে দেই৷ তিনি কিছুক্ষণ সেই দিকে তাকিয়ে থেকে হালকা হেসে বলেন,

— শুভ বিবাহবার্ষিকী!

তাঁকে ভড়কে দিতে পেরেছি কি-না জানি না কিন্তু তাঁর ঠোঁটের কোনে ফুটে হাসিটা যেন আমার সবচেয়ে প্রাপ্তি। আমি চোখের ইশারায় করলাম কেকটা কাটতে। তিনি আমার হাত থেকে কেকটা নিয়ে বিছানার উপর রাখেন। অতঃপর ছুড়িটা নিজ হাতে নিয়ে আমার হাতটাও টেনে নেন তাঁর হাতের মাঝে। নিঃশব্দে কেটে ফেলেন কেকটি। কেকের প্রথম পিসটা আমার মুখের সামনে ধরতেই আমি সেটা খেয়ে নেই। তাঁকেও খায়িয়ে দেই কিছুটা। কেক খাওয়া শেষে কাবার্ড থেকে সেই বক্স দু’টো বের করে রোয়েনের সামনে এগিয়ে দেই। তিনি আলতো হাতে সেটা গ্রহণ করেন। আমি তাঁর পাশে বসতেই তিনি আমার হাতটি টেনে নিয়ে তাঁর সামনে ধরেন। অতঃপর নিজের বা পকেট থেকে একটা বেলীফুলের মালা বের করে খুবই সপ্তপর্ণে সেটা আমার হাতে পড়িয়ে দেন। বিস্ময়ে আমার ঠোঁট দুইটি আপনা-আপনি নিজেদের মধ্যে দূরত্ব সৃষ্টি করে নেয়৷ আমি নিষ্পলক দৃষ্টিতে যখন আমার হাতের পানে চেয়ে আছি ঠিক তখনই রোয়েন বিছানা থেকে নেমে পড়েন। নিচে হাটু গেড়ে বসে আমার পা টেনে ধরতেই ভড়কে যাই আমি। দ্রুত নিজের পা সরিয়ে নিয়ে অস্ফুটস্বরে বলে উঠি,

— এইসব কি করছেন আপনি? পায়ে হাত দিচ্ছেন কেন?

রোয়েন বিরক্তিতে ভ্রু কুটি কুঞ্চিত করে বলেন,

— পা কেটে ফেলার জন্য। কোন সমস্যা?

আমি তাঁর কথার পিঠে কিছু বলতে যাব তার আগেই তিনি তাঁর হাতের তর্জনীটা আমার ঠোঁটের মাঝে চেপে ধরে বলেন,

— হুসসস! কোন কথা না।

আমি ফ্যালফ্যাল দৃষ্টিতে তাঁর দিকে তাকাতেই তিনি হাতটা সরিয়ে নেন। পুনরায় পকেটে হাত গলিয়ে দিয়ে এক জোড়া পায়েল বের করেন। পায়েলটা ঠিক কিসের তৈরি তা আমার জানা নেই। কিন্তু বর্ণনা দিতে হলে বলবো, সোনালী রঙ্গের প্রলেপের উপর সাদা পাথরের সরু কাজ। তার নিচে ঝুলছে লম্বাটে পাতার আকৃতির মত, এদের মাঝে কিঞ্চিৎ দূরত্ব। পায়েলটা দেখতে সাধারণের হলেও এ যেন হাজারের মধ্যে অনান্য। রোয়েন খুবই সপ্তপর্ণে আমার পাটা তাঁর হাটুর উপর রেখে পায়েলটি পড়িয়ে দিতে থাকেন আর আমি শুধু ফ্যালফ্যাল দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকি তাঁর পানে। চোখের মনিতে কিঞ্চিৎ বিস্ময়তা বিরাজমান। তার মানে মানুষটা আজকের দিনের কথাটা ভুলে নি? তাঁর মনে ছিল। আর সেই আমাকে ভড়কে দেওয়ার জন্য এইসব করে বসে আছে? অথচ আমি কি-না ধরতেই পারিনি। আমি তাঁকে আর কি ভড়কে দিব তিনি তো নিজেই আমাকে ভড়কে দিয়েছেন। আসলেই মানুষটাকে বাহিরে ভাব-ভঙ্গি দেখে তাঁর অন্তরের কথাটা বুঝা বড় দায়।
দুই পায়ে পায়েল পড়ানো শেষে তিনি মাথা তুলে জিজ্ঞেস করলেন,

— দেখো তো পছন্দ হয়েছি কি-না।

আমি ধরা গলাই বলি,

— অনেক! ভীষণ সুন্দর পায়েল দু’টো।

তিনি কিঞ্চিৎ হেসে বলেন,

— তোমার দেওয়া টাই-টা আমাকেও মানাবে দারুণ।

কথাটা কর্ণপাত হতেই আমি কিঞ্চিৎ হাসি৷ মিইয়ে যাওয়া স্বরে বলি,

— আজকের দিনটার কথা আপনার তাহলে মনে ছিল?

রোয়েন সটান হয়ে এক হাত চুলের মধ্যে গলিয়ে চুলগুলো সামনে থেকে পিছনের দিকে ঠেলে দিয়ে বলেন,

— ভুলেছিলাম কখন যে মনে রাখবো।

কথাটা কর্ণধার হতেই ঠোঁটের কোনে ফুটে উঠে দীর্ঘ হাসি। মানুষ প্রকাশ্যে কিছু না বললেও স্বল্প কথার ভাঁজে আর কাজের মাধ্যমে অপ্রকাশিত কথাগুলো ঠিকই বুঝিয়ে দেন।

__________________

খাওয়া-দাওয়া শেষে রোয়েন আমায় নিয়ে বেরিয়ে পড়েন ফাঁকা রাস্তায়। দিনটা একসাথে কাটাতে না পারলেও রাতটা ঠিকই হয়ে উঠে একান্ত আমাদের। আমি রোয়েনের পেট জড়িয়ে ধরে মাথা এলিয়ে দিয়েছি তাঁর পিঠে। চুপটি মেরে বসে থেকে অনুভব করছি রাতের নির্জীব ঢাকা শহর। বায়ুতে নেই এখন কোন বিষাক্ততা। আছে শুধু শুদ্ধতা। দীর্ঘ পথ পারি দিয়ে বাইক উঠে পড়ে পুরান ঢাকার পোস্তোকলা ব্রিজের উপর দিয়ে। আরও বেশ কিছুটা পথ অতিক্রম করতেই একটি কাঙ্ক্ষিত জায়গায় এসে বিশ্রাম নেয় বাইকটি। রোয়েন বাইকটা সাইডে পার্ক করতেই আমি নেমে পড়ি। ব্রিজের ধার ঘেঁষে দাঁড়াতেই চোখে পড়ে সচ্ছ পানির ধারা। চাঁদের স্নিগ্ধ আলোয় জ্বলজ্বল করছে প্রত্যেকটি ঢেউ। যতদূর চোখ যায় ততোদূর নজরে পড়ে পিঁপড়ের ন্যায় বিল্ডিং আর বিল্ডিং। একটা সাথে যেন একটা ঠাসা। বেশ সংখ্যক জানালার ফাঁক দিয়ে দিয়ে বাইরে গড়িয়ে পড়ছে এলিডি লাইটের আলো৷ হিম-শীতল বায়ু সর্বাঙ্গে ছড়িয়ে যেতেই গা কাটা দিয়ে উঠে আমার। রোয়েন আমার পাশে এসে দাঁড়াতেই আমি উষ্ণতার লোভে তাঁর নিকট ঘেঁষে দাঁড়াই। তিনি একপলক আমার দিকে তাকিয়ে আমার পিছন দিয়ে হাত গলিয়ে আগলে নেন আমায়। ক্ষণেই আমি তাঁর বুকে মাথা এলিয়ে দেই। চোখ দুটি বন্ধ করে অনুভব করতে থাকি মানুষটির উপস্থিতি। সময় খারাপ হোক আর ভালো মানুষটা আমার পাশে থাকলে যে আমার আর কিছু চাই না। অনায়াসে কাটিয়ে দিতে পারি এমন শত কোটি প্রহর। কথায় আছে না, “ভালবাসা থাকার জন্য বিলাসিতার প্রয়োজন নেই, ভালবাসার মানুষটির সঙ্গই যথেষ্ট।”

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here