#নিরবতায়_হৃদয়_কোনে,০২,০৩
#জিন্নাত_চৌধুরী_হাবিবা
#পর্ব_০২
সাত সকালে নাস্তা তৈরি করে টিউশনের উদ্দেশ্য পা বাড়ালো মিতালী। এসব কাজকর্ম আগ বাড়িয়ে তাকে আর মাকেই করতে হয়। বাবা ক্ষুধা সহ্য করতে পারেননা। ভাবি এত তাড়াতাড়ি উঠবেনা, আর না নাস্তা বানানোয় হাত দেবে।
পেছন থেকে মাহবুবের গুরুগম্ভীর ডাক,
-“আজ বাড়িতে উপস্থিত থাকবি। জরুরি আলাপ আছে সবার লগে।”
মিতালী ভেবে পেলোনা ভাইয়ের তাদের সাথে কি এমন জরুরি আলাপ থাকতে পারে। মাহবুব তো তাদের গন্যই করেনা, আর না তাদের মধ্যে খেজুরে সম্পর্ক। মিতালী কৌতুহল দেখালো। এমনি এমনি কারণ ছাড়া টিউশন, ক্লাস মিস দেওয়া যায়না। বলল,
-“কী এমন জরুরি কথা, যে আমাকে বাড়িতে থাকতে হবে।”
মাহবুব তাচ্ছিল্য হেসে বলল,
-“কৈফিয়ত চাওয়া শিখা গেছস দেখতাছি।”
মিতালী কঠিন মুখে বলল,
-“আমাকে যেহেতু থাকতে হবে, তাহলে অবশ্যই কৈফিয়ত দিতে বাধ্য।”
মাহবুব তে*ড়ে এসে বলল,
-“খুব চটাং চটাং কথা শিক্ষালাইছস।”
মিতালী হাত উঁচিয়ে থামিয়ে দিলো মাহবুবকে।
-“দূরে থাকো, গায়ে হাত তো*লা*র চেষ্টা করলে নারী নির্যাতনের মা*ম*লা ঠু*কে দেবো।”
মাহবুব আগুন চোখে তাকিয়ে বলল,
-“বাড়িতে বি*চা*র বসবো, আমার পক্ষে এতগুলা বোঝা টা*না সম্ভবনা। আমি চেয়ারম্যান চাচারে খবর দিছি।”
মিতালীর মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়লো। শেষ বয়সে এসে বাবা মায়ের জন্য বিচার বসাবে? বিষণ্ণতা আকাশ ছুঁলো, চোখের কোনে জল জমা হলো। বাবা-মা এখনো কিছুই জানেনা। শুনলে কতটা কষ্ট পাবে?
মাহবুব নিজের কাজে যেতে যেতেই বলল,”এগারোটার মধ্যে বাড়িতে থাকবি।”
মিতালী থমকে যাওয়া পা জোড়া টে*নে বেরিয়ে গেলো। ছাত্রীর বাসায় গিয়ে দেখলো সে আগে থেকেই বসে আছে।
পড়ানোর মাঝে ঝুমুর বলল,”ম্যাম, আপনার কি মন খারাপ?”
মিতালী জোরপূর্বক ঠোঁটে হাসি টে*নে বলল,
-“নাহ্, তুমি পড়ায় মন দাও।”
ঝুমুর আর কথা বাড়ালোনা।
মেয়েটাকে পড়িয়ে বের হলো। রাস্তায় নির্ভীক দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিলো। মিতালীকে দেখে একগাল হেসে বলল,
-“চল, যাওয়া যাক।”
মিতালী ভনিতা ছাড়াই বলল,
-“তুই যা, আমি আজ ক্লাস করবোনা।”
নির্ভীক খেয়াল করলো মিতালীর মুখশ্রী। চিন্তিত কন্ঠে বলল,
-“শরীর খা*রা*প তোর? ক্লাস কেন করবিনা?”
মিতালী দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
-“বাড়িতে আজ কাজ আছে। আমি ঠিক আছি। তুই যা।”
ভ্রু কুঁচকে তাকালো নির্ভীক। বলল,
-“কী কাজ? তুই না বললি তোর আজকের ক্লাস ইম্পরট্যান্ট।”
মিতালী হাঁপিয়ে যাওয়া ভঙ্গিতে বলল,
-“তোর জেরা করা শেষ হলে আমি বাড়িতে যাই। কী কাজ সেটা পরে জানাবো।”
মিতালী হাঁটা ধরলো। নির্ভীক ও আর গেলোনা ভার্সিটির উদ্দেশ্যে। মিতালীর পেছনে ছুটলো। দুজনের বন্ধুত্ব সেই স্কুল জীবন থেকে। একই এলাকায় বাস। স্কুল থেকে ভার্সিটি পর্যন্ত দুজনের বন্ধুত্ব এলাকার সকলের জানা। সবাই জানে তারা দুজন খুব ভালো বন্ধু। কেউ কেউ বলে দুজনের মধ্যে গভীর প্রেমের সম্পর্ক ও আছে।
দুজনের ভার্সিটি এক হলেও ডিপার্টমেন্ট আলাদা। মিতালী ম্যাথেমেটিকস নিয়ে পড়ছে আর নির্ভীক ইংলিশ ডিপার্টমেন্ট।
পাশাপাশি হেঁটে মিতালী জিজ্ঞেস করলো,
-“যাবিনা?”
নির্ভীক আগ্রহ দেখালোনা। বলল,
-“ভালোলাগছেনা।”
মিতালী হাসলো। দুজনে এখনও সেই আগের মতোই আছে। একজন ক্লাস মিস দিলে অপরজন ও একই কাজ করে। বাড়িতে যাওয়ার পথেই কাশেম চাচা বললেন,
-“কিরে মিতালী, কী শুনতাছি এগুলা? মাহবুব নাকি তোগো বাড়িত তোর আব্বার লাইগা বিচার বসাইবো? আমারেও যাইতে কইছে।”
মিতালীর চোয়াল মলিন দেখালো। পাশ থেকে নির্ভীক ভীষণ আশ্চর্য হয়ে বলল,
-“কিসের বিচার?”
মিতালী কিছু বলতে পারলোনা, শুধুই দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। নির্ভীকের প্রশ্নের উত্তরে কাশেম চাচা বললেন,
-“মাহবুব তোমার মামারেও খবর দিছে। গেলেই বুঝা যাইবো ক্যান বিচার সভা ডাকছে।”
এতক্ষণে নির্ভীক মিতালীর ক্লাস না করার কারণ ধরতে পারলো। দুজনের কেউই আর কথা বাড়ালোনা। যে যার বাড়িতে পৌঁছে গেলো।
★★★
ঘড়ির কাঁ*টা এগারো এর ঘরে। বাড়ির সামনে উঠান সদৃশ জায়গায় চেয়ার পাতা হয়েছে। সেখানে উপস্থিত চেয়ারম্যান চাচার সাথে নির্ভীককে ও দেখা গেলো। চেয়ারম্যান সাহেব নির্ভীকের মামা হন।
ও যখন মায়ের গর্ভে ছিলো, তখন তার বাবা ভারতের আসামে চলে গিয়ে আর ফেরেননি। আর না খোঁজ নিয়েছেন তার মায়ের। সেই থেকেই নির্ভীকের মামা তার মাকে নিয়ে এসেছেন। নির্ভীকের মা ও আর বিয়ে করেননি। ছেলেকে বুকে নিয়েই বাবার বাড়িতে পড়ে রইলেন।
মিতালী মাথায় কাপড় দিয়ে চায়ের ট্রে রেখে বাবার পাশে দাঁড়ালো।
তার বাবা মতিন সাহেবের চোখের কোনে পানি। লজ্জায় মাটির সাথে মিশে যেতে ইচ্ছে করছে।
চেয়ারম্যান সাহেব গলা খাঁকারি দিয়ে মাহবুবকে উদ্দেশ্য করে বললেন,
-“সবাইকে কোন উদ্দেশ্য নিয়ে ডেকেছো। তুমি তোমার কথা শুরু করো।”
মাহবুব বলল,
-“আপনেরা তো জানেন আমার ইনকাম কেমন। মিতালীর লাইগা কয়েকবার সমন্ধ আনার চেষ্টা করেছি। এবারে আমেরিকান পোলা নিয়া আসছি। ওয় বিয়া বইবোনা। আমি চাইছি ওরে একটা লাইন করাই দিমু। ওয় জামাই নিয়া সুখে থাকবো, আর আমি আব্বা-আম্মা আর মাহারে নিয়া আছি। কিন্তু মিতালী কি করলো?
পাত্রপক্ষের সামনেই আমাগোরে অপ*মান করলো। পাত্রপক্ষ চইলা গেলো। আপনেরাই কন, আমার পক্ষে এতজনের ভরণপোষণ, পড়নের খরচ দেওয়া সম্ভব?”
কয়েকজনই মাহবুবের সাথে একমত হলেন। একজন বললেন,
-“মাহবুব তো ঠিক কথাই কইলো। মাইয়্যাটার ভালা চাইছে বইলাই সমন্ধ নিয়া আসছে।”
মতিন সাহেব উত্তেজিত হয়ে পড়লেন। মিতালী বাবাকে থামিয়ে বলল,
-“শান্ত হও আব্বা। আমি বলছি কথা।”
এরপর সবার উদ্দেশ্যে বলল,
-“আমার পড়ালেখার খরচ আমি নিজে চালাই। আব্বা অসুস্থ হয়েছে দুমাস। মাহা উপবৃত্তি পায়।
এর আগে পরীক্ষার ফি আব্বা দিতো। সামনে মাহার পড়ার চিন্তা আমার।
তাই আমাদের পড়ালেখার খরচ বহন করা কথাটি সম্পূর্ণ মি*থ্যা।
তারপর ভরণপোষণ, ছোট থেকে বড় হওয়া পর্যন্ত উনাকে কখনো দেখিনি আমাদের দুই বোনকে বা মা আর আব্বাকে একটা সুতা দিতে। আমি টিউশনি করি। নিজের পড়ার খরচের পর গত দুমাসে আব্বার ঔষধ খরচের জন্য আমি হাতের বাকি টাকা দিয়েছি। যদিও সব ঔষধ আনা সম্ভব হয়নি স্বল্প টাকায়।
এতে একটা কড়িও তিনি দেননি। শুধু বাজারটাই তিনি করছেন। এই যে আমরা তার খাই, এর জন্য বাড়ির সমস্ত কাজ আমার মাকে করতে হয়। আমিতো নিজের পড়া আর টিউশনের জন্য বাড়িতে থাকতে পারিনা।
এবার আপনারাই তার বলা কথাগুলো যাচাই করুণ। সে কি সত্যিই আমাদের সম্পূর্ণ খরচ বহন করে?”
চেয়ারম্যান চাচা মনযোগ দিয়ে শুনলেন মিতালীর সব কথা। তিনি মেয়েটাকে ভালো জানেন। তাছাড়া মতিন সাহেবও ভালো মানুষ, ছেলে সম্পর্কে ও জানেন। এর মাঝে মাহবুবের বউ খেঁকিয়ে উঠলো,
-“বাড়ির কাজ আমি করিনা, তোর মায়ে করে? বা*ন্দির বা*চ্চা মি*থ্যা বলার জায়গা পায়না।”
চেয়ারম্যান চাচা ধমক দিলেন পিয়ালীকে।
-“অস*ভ্যের মতো ব্যবহার কেন তোমার? তুমি এই এলাকার বউ, মুখ দিয়ে ময়লা বের হচ্ছে কেন? তোমাকে এখানে কিছু জিজ্ঞেস করা হয়েছে, যে তুমি কথা বলছো?”
মাহবুব অগ্নিদৃষ্টি নিক্ষেপ করলো পিয়ালীর দিকে। সে সুযোগে সুযোগে ঘাড় থেকে বো*ঝা নামাতে চাইছে। এই বে*দ্দ*প মহিলা সব ভেস্তে দিচ্ছে।
চেয়ারম্যান চাচা বললেন,
-“মাহবুব, মিতালী যা বলছে সব সত্যি?”
মাহবুব এবার খোলস ছেড়ে আসল রূপে ফিরলো।
-“আমার দ্বারা এতগুলা বোঝা টা*না সম্ভব না। মিতালী ও তো এখন রোজগার করে। আব্বা-আম্মার খাওয়া ভাগ করে দেন। আমার ঘরে পনেরো দিন, মিতালীর ঘরে পনেরো দিন।”
মিতালী হাসলো বোধহয়। সে জানতো মাহবুব এমন কিছু বলবে।
চেয়ারম্যান চাচাকে গম্ভীরমুখে দেখা গেলো। তিনি সবার সাথে আালাপ করে ভেবেচিন্তে বললেন,
-“কিন্তু মিতালীর পক্ষে এখনই এতসব কিভাবে সম্ভব? কয়েকটা টিউশনি দিয়ে এতদিক সামলাবে কিভাবে?”
মাহবুব জবাবে বলল,
-“সেইটা আমার দেখনের বিষয় না। সবাই ওর দিক চিন্তা করে, আমার দিক কেউ চিন্তা করেনা। আমারও তো ভবিষ্যত আছে।”
প্রচন্ড ক্রো*ধ আর আত্মসম্মানের দাপটে মিতালী বলে দিলো,
-“বাকি পনেরো দিন ও আমি খাওয়াতে পারবো। আব্বা আর মা আমার আর মাহার সাথেই থাকবে।”
মাহবুবের চোখ চকচক করে উঠলো।
চেয়ারম্যান চাচা বুঝলেন মেয়েটা উত্তেজনার বশে এরকম একটা কথা বলে দিলেও তার পক্ষে সবার ভার বহন করা সম্ভব নয়। তিনি কৌশলে মাহবুবকে বললেন,
-“মিতালী তার বাবা-মায়ের দায়িত্ব নিজেই নিয়ে ফেলেছে। এতে তোমার কি মতামত?”
মাহবুব বলল,
-“সে নিতে চাইলে আমার তো করনের কিছু নাই।”
চেয়ারম্যান সাহেব মনে মনে হাসলেন। পরপরই নিজের চাল চেলে দিলেন।
-“মিতালী যেহেতু বাবা-মায়ের সারাজীবনের দায়িত্ব নিয়ে ফেলেছে, তাহলে তোমাকে স্ত্রী নিয়ে বাড়ি ছাড়তে হবে। বাবা-মায়ের দায়িত্ব নিতে না পারলে সম্পত্তির কানাকড়ি ও পাবেনা।”
চমকে উঠলো মাহবুব, পিয়ালী দুজনেই। পিয়ালী বলল,
-“তাহলে আমরা থাকবো কই?”
-“কেন? বাজারে কলনি আছেনা? সেখানে থাকবেন।”
নির্ভীকের কথায় তেতে উঠলো মাহবুব, পিয়ালী। চেয়ারম্যান সাহেব ভাগ্নেকে ধমকে উঠলো,
-“তোকে কথা বলতে বলেছে কে?”
এদিকে মিতালী চোখের ইশারায় না করছে কথা বলতে। নির্ভীক রা*গে ফে*টে পড়লেও নিজেকে দমিয়ে নিলো।
মাহবুব বলল,
-“আমি তো কইছি পনেরো দিন আমি খাওয়ামু। তাহলে বাড়ি ক্যান ছাড়ুম?”
অনেক বিবেচনার পর সিদ্ধান্ত হলো মাহবুব, মিতালী দুজনেই বাবা-মাকে মাসে পনেরো দিন করে খাওয়াবে। এছাড়া কেউ আর উপায় দেখলোনা।
মিতালী উপস্থিত সবার মাঝে আরও একটি ব্যাপার খোলসা করে বলল,
-“এই লোকের তেড়ে এসে গায়ে হাত তু*ল*তে আসা স্বভাব বাদ দিতে বলবেন। নয়তো কোনদিন রান্নাঘর থেকে ব*টি নিয়ে হাতে কো*প মে*রে বসবো।”
নির্ভীক মিতালীর এমন প্রতিবাদী রূপে ভীষণ খুশি হলো। মনে মনে বাহবা দিলো মেয়েটাকে।
সব সিদ্ধান্তের পর ক্লান্ত মিতালী রান্নায় হাত বসালো। মা কেঁদেই যাচ্ছেন। এমন হলে আর আজ খেতে হবেনা। লবনের বাটি থেকে বড় পাতিল পর্যন্ত দু’ভাগ হলো।
বিকেলের মধ্যেই ঘরের মাঝখানে লম্বা বেড়া তোলার ব্যবস্থা হবে। রান্না করতে গিয়ে মিতালী ভীষণ দুশ্চিন্তায় পড়লো। দায়িত্ব তো কাঁধে এসে গিয়েছে। একটা চাকরি যেভাবেই হোক জোগাড় করতে হবে। টিউশন ও চালাতে হবে। চাকরি পাওয়া মুখের কথা নয়।
বাবা-মা আর মাহার প্রথম খাওয়া মাহবুবের ঘর থেকেই শুরু। মিতালীর ঘরে পনেরো দিন পর থেকে। চিন্তায় আর পেটে খাবার পড়লোনা। মুঠোফোনের শব্দ পেয়ে হাতে নিলো ফোন। ক্লাস সেভেন এর ছাত্র রিশাতের মায়ের ফোন।
সালাম বিনিময়ের পরই তিনি বিনীতভাবে বললেন,
-“মিতালী, রিশাতের বাবার ট্রান্সফার হয়েছে। আমরা আর এখানে থাকবোনা। কাল থেকে রিশাতকে পড়াতে হবেনা।”
মিতালী থমকে গেলো। হাতে একটা টাকাও নেই। টিউশনের পাশাপাশি চাকরি দরকার, অথচ হাত থেকে একটা টিউশন ছুটে গেলো।
ঘরে বাজার নেই, আজ কোনোভাবে রান্না চালিয়ে দিয়েছে। পাশের ঘর থেকে বাবার গুঙ্গিয়ে ওঠার শব্দ শোনা যাচ্ছে। মাথা ফাঁকা ফাঁকা লাগছে।
#চলবে………
#নিরবতায়_হৃদয়_কোনে
#জিন্নাত_চৌধুরী_হাবিবা
#পর্ব_০৩
আজও ভার্সিটি যাওয়া হলোনা মিতালীর। গতকালের পানতাভাত আর বাসি তরকারি দিয়ে সকালের নাস্তা চালিয়ে নিলো সে।
চাল আপাতত লাগবেনা। তবে বেশ কিছু বাজার লাগবে। বাবার ঔষধ নেই, শরীরের ব্যথায় সারারাত ছটফট করেছে।
রাতে আর ঘুম হয়নি মিতালীর। বাবার সাথে যে মাও ঘুমায়নি সেটা বেশ টের পেলো সে।
মাহা তৈরি হয়ে নিয়েছে মিতালীর সাথে বেরোবে বলে।
রোজী বেগম নিরলসভাবে মেয়েকে দেখে যাচ্ছেন। নির্বাক তিনি, মেয়েকে কী বলে শান্তনা দেবেন? শান্তনা দিতে না পারুক, সর্বোচ্চ সাহস জুগিয়ে যাবেন।
মিতালী মৃদু হেসে বলল,
-“কী খেয়েছো মা?”
রোজী বেগম হাসার চেষ্টা করলেন। বললেন,
-“রুটি খাইছি। তুই কী খাইয়া বাইর হবি? ঘরেতো কিছু নাই।”
মিতালী ব্যাগ কাঁধে নিয়ে বলল,
-“আমি ভাত খেয়ে নিয়েছি।”
তারপর মায়ের চোখের দিকে তাকিয়ে অনুভূতি শূন্য হয়ে বলল,
-“আজও নাস্তা তুমিই বানিয়েছো তাই না?”
রোজী বেগম কাচুমাচু করে দৃষ্টি লুকাতে চেয়েও পারলেননা। একইভাবে বলে গেলেন,
-“তুই জানস তোর আব্বার তাতাড়ি নাস্তা লাগে। বইয়া থাকলে কি পেটে খাওনা যাইবো?”
বেশি কিছু বলতে পারলোনা সে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
-“আমি চললাম, বেশি চিন্তা করোনা।”
আজ আর ঝুমুরকে পড়াতে হবেনা। সে নানার বাড়িতে আছে। বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা মাহাকে সঙ্গে নিয়ে কিছুদূর যেতেই নির্ভীকের দেখা মিললো। হেসে এগিয়ে এসে বলল,
-“কেমন আছিস?”
মিতালী স্বাভাবিক ভাবেই বলল,
-“ভালো।”
-“আজ ক্লাস এটেন্ড করবি?”
নির্ভীকের প্রশ্নের জবাবে মিতালী বলল,
-“নাহ্, চাকরি খুঁজতে হবে। রিশাতের মা কাল ফোন করে বলে দিয়েছেন তারা এখান থেকে চলে যাচ্ছে। রিশাতকে পড়াতে হবেনা।”
মাহা কাচুমাচু করছে। বোনকে কিভাবে বলবে মনের কথা? আপু এত কষ্ট করছে তাদের জন্য। সে খুব ভালো করেই জানে মিতালীর হাতে এখন একপয়সাও নেই। তাহলে কিভাবে বলবে ফর্ম পূরণের কথা?
মিতালী অনেকক্ষণ ধরেই মাহাকে লক্ষ করে বলল,
-“কী বলতে এত দ্বিধা হচ্ছে তোর?”
মাহা তটস্থ দৃষ্টিতে তাকিয়ে গলার স্বর একেবারে খাটো করে নিলো। বলল,
-“ফর্ম পূরণের জন্য চার হাজার টাকা লাগবে।”
মিতালী নিভে আসা গলায় বলল,
-“ওহ্, আমি ভুলেই গিয়েছি তোর ফর্ম পূরণের কথা। কদিন সময় আছে?”
-“সাতদিন।”
উপরে স্বাভাবিক থাকলেও ভেতরে ভেতরে চিন্তার পাহাড় তৈরি হলো।
নির্ভীক জানে মিতালীর হাতে টাকা নেই। তাই বলল,
-“আমার কাছে টিউশনির কিছু টাকা আছে। চার হাজার মিলিয়ে দিতে পারবো। মাহার ফর্ম পূরণের টাকা আমি দিয়ে দিচ্ছি।”
মিতালী মাঝখানে নির্ভীককে থামিয়ে দিলো। বলল,
-“টাকা তো দিবি। তবে আমি এই মাসে তোর টাকাটা শোধ করতে পারবোনা।”
নির্ভীক স্বাভাবিকভাবেই বলল,
-“শোধ কেন করতে হবে? আমি কি তোর পর কেউ?”
মিতালী খানিক হেসে বলল,
-“পর কেউ একথা আমি বলেছি? তুই আমার কাছের মানুষ। টাকাতো তোকে ফেরত দিতে হবে। তুই তো আর লাখ টাকা ইনকাম করছিসনা। টিউশনি করে হাত খরচ চালাচ্ছিস।”
নির্ভীক বলল,
-“এগুলো হাত খরচের বাইরে জমানো টাকা।”
মিতালী বলল,”তবুও, আমি তোর টাকা ফেরত দেবো।”
নির্ভীক দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,”আচ্ছা।”
পর মূহুর্তে আড়ালে নিঃশব্দে হাসলো। প্রবল আত্মসম্মানবোধ মেয়েটার মাঝে। হাঁটার মাঝে পাশে থাকা মেয়েটির দিকে নিমেষহীন তাকিয়ে মনে মনে আওড়ালো,
এখানে একসময় বিকেল পলাতক হবে
সন্ধ্যার বাড়বে বয়স-আমি তবু একজন
বসে থাকবো অনন্ত রাত্রির দিকে মুখ ফিরিয়ে
তুমি শুধু একবার বলো-“ভালোবাসা তোমাতে আছে”
—রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্।
মাহার স্কুল আসতেই সে গেইট দিয়ে প্রবেশ করলো।
পাশাপাশি পা চালিয়ে দুজন সামনে এগোলো। মিতালী জানে নির্ভীক আজও ক্লাস করবেনা। মিতালীকে ছাড়া সে ক্যাম্পাসে পা রাখবেনা। হাঁটতে হাঁটতেই নিজের সিদ্ধান্তের কথা জানালো,
-“ড্রীমল্যান্ড মডেল স্কুলে যাবো। দেখি তারা শিক্ষক নেয় কি-না?”
দুজনে চললো কিন্ডারগার্টেনের উদ্দেশ্যে।
কথা হলো তাদের সাথে। দশদিন তারা মিতালীর ক্লাস দেখবে। এরপর সিদ্ধান্ত জানাবে তাকে শিক্ষক হিসেবে গ্রহন করবে কিনা?
মিতালী রাজি হয়ে গেলো। আপাতত এছাড়া সে উপায় দেখছেনা। সেখান থেকে বেরিয়ে অজানা গন্তব্যে হাঁটলো দুজন।
ঘন বর্ষার মতো আকাশে স্নিগ্ধ, কোমল একটুকরো মেঘ উঁকি দিলো। সূর্য ঢেকে গেলো আড়ালে। সাদা-কালো মেঘের আড়ালে লুকোচুরি খেলে হেসে উঠলো যেনো। একটু পরই নামবে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি। আকাশের গতিবিধি লক্ষ করে নির্ভীক সুধালো,
-“বাড়ি যাবিনা? তাড়াতাড়ি চল, একটুপর বোধহয় বৃষ্টি নামবে।”
নির্ভীকের কথা শেষ না হতেই ইলশেগুঁড়ি নামলো। পা থামিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লো মিতালী। নির্ভীক মাথায় ছাউনির মতো হাত দিয়ে পেছন ফিরে বলল,
-“দাঁড়িয়ে পড়লি কেন? চল।”
মিতালী এখনো দাঁড়িয়ে আছে ভাবলেশহীন। হাত চেপে ধরে একটু দূরে সামনের ছাউনির নিচে ছুটে গেলো নির্ভীক। মিতালী বিরক্ত হয়ে বলল,
-“নিয়ে আসলি কেন? দেখছিসনা কি সুন্দর বৃষ্টি হচ্ছে।”
কপট রাগ দেখিয়ে নির্ভীক বলল,
-“এমন বৃষ্টিতে ভিজলে যে জ্বর নামবে সেটা জানিস না?”
-“একরাত জ্বর হয়েও যদি ক্ষণিকের আনন্দ মেলে, তবে আমি সয়ে নেবো।”
বর্তমান পরিস্থিতি মনে করিয়ে দিতে নির্ভীক বলল,
-“অসুখ করলে তোর পরিবার দেখবে কে?”
বৃষ্টিতে পা বাড়াতে গিয়েও থমকে দাঁড়ালো মিতালী। এখন যে আর অসুস্থ হওয়া চলবেনা। এখন ছোটার সময়, টাকার পেছনে ছুটতে হবে। জীবনে মায়া আর টাকা দুটোই লাগে।
ঝিরিঝিরি বৃষ্টি থেমে গেলো। কিছুদূর গিয়ে নির্ভীক বলল,”ঝালমুড়ি খাবি? চল কতদিন খাইনা। সেই স্কুলের মতো আমেজটা কতবছর ধরে খুঁজে পাচ্ছি না।”
মিতালী স্বায় জানালো। বলল,”চল”।
ঝাল খাওয়াতে দুজনেই পটু। নির্ভীক ঝালমুড়িওয়ালা মামাকে বলল,
-“মামা ভালো করে ঝাল দিয়ে দুটো ঝালমুড়ি দিনতো।”
মামা একগাল হেসে নিজের কাজ শুরু করলেন।
কাগজে মোড়ানো দুটো ঝালমুড়ি হাতে নিয়ে রাস্তার পাশ ধরলো তারা। নির্ভীকের খাওয়া শেষ হতেই আড়চোখে মিতালীর খাওয়া পরোখ করলো। হুট করেই মিতালীর কাগজের প্যাকেটে হাত ঢুকিয়ে দিলো। এক খাবলা মুড়ি নিয়ে মুখে চালান করলো।
কি হয়েছে বুঝতে পেরে মিতালী কপট রাগ দেখালো। আমতা আমতা করে নির্ভীক বলল,”আমারটা শেষ।”
নির্ভীকের কাচুমাচু মুখে ভঙ্গি দেখে হেসে ফেললো মিতালী। নিজের অবশিষ্ট ঝালমুড়ি সরিয়ে বলল,”আর দেবোনা।”
স্নিগ্ধ, মোহময়ী ঠোঁটের হাসি অপলক চেয়ে চেয়ে দেখলো নির্ভীক। সে কি একটু দুর্বল এই হাসির উপর, নাকি অনেকখানি?
মিতালীর কথায় চমক কাটলো তার। মিতালী বলল,
-“এমন চেয়ে থাকলে আমার ভীষণ পেট খারাপ করবে।”
নির্ভীক চমকালো। মিতালী কি বুঝতে পারলো কিছু?
পরিস্থিতিকে অনুকূলে আনতে বোধহয় মুহুর্তেই ঝুম বৃষ্টি নামলো, রোদ-বৃষ্টি। উত্তপ্ত সূর্যের উপস্থিতিতে আকাশের জলধারা প্রকৃতির এক চমৎকার দৃশ্য। এবার আর তাড়া দেখালোনা নির্ভীক। মুহুর্তেই দুজন কাকভেজা হয়ে গেলো। একে অপরের দিকে তাকিয়ে হাসলো, অতঃপর নির্জন দুপুরে জনমানবহীন রাস্তায় জুতা হাতে ছুটলো দুজন। সেই স্কুল জীবনে ফিরে গেলো। জীবন সংগ্রাম সারাজীবনের। মাঝেমাঝে ছোটছোট বিষয়ে একটু সুখ খুঁজে নিতে হয়।
মিনিট বিশেক স্থায়ী হয়ে বৃষ্টি ছন্দ থেমে গেলো। আকাশের দোনোমোনো অবস্থা দেখে মিতালী বলল,”আকাশের ও কি মুড সুইং হয়?”
নির্ভীক নিচের ঠোঁট বের করে ঘাড় উঁচিয়ে বোঝালো,”কিজানি বাবা।”
মিতালীকে বাড়ির রাস্তায় এগিয়ে নিজেও পথ ধরলো বাড়ি যাওয়ার। ঘরে প্রবেশের পরই কেমন থমথমে ভাব দেখা গেলো। মাহাকে বাড়িতে দেখে মিতালী জিজ্ঞেস করে বসলো,
-“তোকে না স্কুলে দিয়ে এলাম?”
মাহা থমথমে ভাব ধরে রেখেই বলল,
-“একটু খা*রা*প লাগছিলো। তাই ফিরে এলাম।”
মিতালী চিন্তিত হলো। বলল,
-“তোর কি কোন কারনে মন খারাপ?”
কথা বললোনা মাহা। মিতালী আর ঘাটালোনা। গোসল নিয়ে রান্নার জোগাড়ে নামলো। রান্না করা ভাত আর আলুর তরকারি দেখে বেশ অবাক হলো।
মাকে গিয়ে বলল,
-“রান্না তুমি করেছো?”
মাকে কিছু বলতে না দিয়ে মাহা জবাব দিলো। বলল,
-“ভাবি মাকে কথা শুনিয়েছে। তাদের ঘরে খেয়ে কেন তোমার জন্য রান্না করেছে? ও ঘরে খেতে হলে তোমার একফোঁটা কাজ ও আমরা কেউ করতে পারবোনা।”
মিতালী চোখ বুঁজে নিলো। মনে মনে প্রার্থনা করলো “আল্লাহ আমাকে বড় একটা চাকরি পাইয়ে দাও। যাতে এই তিনটে মানুষকে কারো কথা শুনতে নাহয়। তাদের সব দায়িত্ব যেনো আমি নিতে পারি।”
মুখে মাকে বলল,
-“আমি এসে রান্না করে নিতাম মা। তুমি অযথাই আমার জন্য চিন্তা কর। বাবার সাথে সাথে নিজের শরীরের দিকেও একটু খেয়াল রেখো।”
রোজী বেগমের চোখ ভর্তি জল টলমল করছে। কান্না রোধ করার চেষ্টায় নেমে পড়ে বললেন,”অভাগা যেদিকে যায়, সাগর শুকিয়ে যায়।
দেখসনা, তোর আব্বা ঘরে ঢুকতে ঢুকতেই কেমন কইরা সব ধ্বস নামতাছে তোর উপর। আমাদের দায়িত্ব, মাহার আর তোর নিজের পড়ার খরচ। হাতে নেই একপয়সা, ঘরে নেই বাজার, রাত হইলেই তোর আব্বা ব্যথায় কাতরায়। তার নাই ওষুধ।”
মিতালী বলল,
-“ধৈর্য ধরো মা। একদিন সব ঠিক হয়ে যাবে।”
মাকে সামাল দিয়ে বাবাকে একবার দেখে আসলো মিতালী। নিজের বাকি কাজ সেরে কিছুক্ষণ ভাবলো। কাল নির্ভীকের কাছ থেকে টাকা নিয়ে মাহার ফর্ম পূরণ করে আসবে। বিকেল নাগাদ একটা টিউশনি আছে। হঠাৎ নির্ভীকের ফোন। সে বলল,
-“মিতা আমার না এতগুলো টিউশনি করতে ভালোলাগছেনা। একটা স্টুডেন্ট ছেড়ে দিয়েছি। এখন স্টুডেন্ট এর মা বলেছে একজন ভালো শিক্ষক খুঁজে দিতে, নয়তো আমাকেই পড়াতে হবে। বুঝতেই পারছিস পড়ার ফাঁকে এত চাপ আমার সহ্য হয়না। আমি আন্টিকে তোর কথা বলে দিয়েছি। তুই এক্ষুণি বেরিয়ে পড়। তোকে তাদের বাসা চিনিয়ে দিয়ে আসবো আমি।”
পুরোদমে কথা শেষ করে তবেই ক্ষান্ত হলো নির্ভীক। মিতালী ভ্রু কুঁচকে জহুরি কন্ঠে বলল,
-“টিউশন করতে তোর এত সমস্যা কিরে? মনে হচ্ছে অনেকগুলো টিউশন একসাথে চালাচ্ছিস?”
নির্ভীক বোঝ দেওয়ার মতো বলল,
-“আমি এখন পুরোদমে পড়ায় মন দিতে চাই। সেজন্যই টিউশন ছেড়ে দিচ্ছি। কথা না বলে বেরিয়ে পড়।”
খট করে লাইন কে*টে দিলো নির্ভীক। মিতালী হাসলো। নির্ভীক তার কথা ভেবেই টিউশন ছেড়েছে। পড়ালেখা একটা অজুহাত মাত্র। সে এমনিতেও ভালো ছাত্র। পড়ার নিদিষ্ট সময়টুকু কাউকে দেয়না। এমন ভালো বন্ধু কজনের কপালে আছে? মিতালী ভাবে নির্ভীককে যে মেয়ে জীবনসঙ্গী রূপে পাবে সে নিঃসন্দেহে সৌভাগ্যবতীদের একজন।
কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে বেরোলো মিতালী। মাহবুবের মুখোমুখি পড়তেই পাশ কাটিয়ে যেতে নিলো। পা থামিয়ে দাঁড়ালো মাহবুব। পেছন থেকেই বলল,
-“বিয়া করার কী দরকার? যদি বিয়ার আগেই রংঢং করা যায়। হাত-ধরাধরি, কদিন পর দেখুম চুমু ও খাইতাছস। এই বাড়িত থাইকা এসব চলবোনা। শীঘ্রই আমি চেয়ারম্যান চাচার কানে কথা তুলুম। যাতে ভাইগ্না সামলায়।”
মিতালীর মাথায় যেনো বড়সড় বাজ পড়লো। নির্ভীক তার ছোটবেলার বন্ধু। এটা সবাই জানে। কিন্তু বন্ধুত্বকে যে মাহবুব নোং*রা চোখে দেখবে কে জানতো? মিতালী কু*কু*রে*র সাথে কুকুর হলোনা। শুধু একদলা থুতু ফেললো। নিজ গন্তব্যের উদ্দেশ্য বেরিয়ে পড়তেই পিয়ালী আর মাহবুব চোখে চোখে ইশারা করলো।
মাহবুব এগিয়ে যেতেই পিয়ালী বলল,”বুইড়া-বুড়ি দুইটারে ভুলিয়ে ভালিয়ে কাল আমাদের বাড়িতে নিয়ে যাবো। এর ভিতরে তুমি যা করার করো।”
মাহবুবের ঠোঁটের কোনের কুটিল হাসিই বলে দিচ্ছে কেমন পরিকল্পনা আঁটতে চলেছে তারা। বড়সড় কোনো বিপর্যয় আসতে চলেছে মিতালীর ওপর। যা তাকে বি*ধ্ব*স্ত, ছিন্নভিন্ন করে দেবে।
#চলবে………