#নিরবতায়_হৃদয়_কোনে,০৪,০৫
#জিন্নাত_চৌধুরী_হাবিবা
#পর্ব_০৪
ভাদ্রের দুপুর, আকাশে শুভ্র পেঁজা তুলোর মতো মেঘ। সূর্যের কিরণ স্বর্ণপ্রভার মতো ঝিকমিক করছে। ভাদ্র মাস যদিও শরৎ এর শুরু, কিন্তু এর বেশির ভাগ সময়টায়ই বর্ষাকালের মতো যায়।
পথেঘাটে চোখ রাখতে রাখতেই দূরে দেখা মিললো নির্ভীকের। রৌদ্র তাপে চোখজোড়া ক্ষীণ করে চেয়ে আছে।
এই সময়টাতে রিশাতকে পড়াতো মিতালী। আজ থেকে নির্ভীকের ছাত্রকে পড়াবে।
নির্ভীক বলল,
-“মেয়েটিকে কিন্তু ইংরেজি পড়াতে হবে।”
মিতালী অবাক হয়ে বলল,”ছাত্রী! আমি ভাবলাম ছাত্র হবে হয়তো। আর ইংরেজি তো তুই ভালো পারিস।”
নির্ভীক বিরক্তিবোধ করলো। বলল,
-“নবম-দশমের ইংরেজি তুই পড়াতে পারবিনা? তোর তো সেকেন্ড চয়েস ইংরেজি ছিলো। তুই পারবি বলেই তো আশায় ছিলি ফাস্ট চয়েস ম্যাথ না আসলে ইংরেজি নিয়ে পড়বি।”
মিতালী হেসে বলল,
-“হয়েছে আর বিরক্ত হতে হবেনা। আর আমি এটাও জানি তুই ইচ্ছে করেই টিউশনটি ছেড়ে দিচ্ছিস।”
নির্ভীক বলল,”বেতন পেলে আমাকে ট্রিট দিতে ভুলবিনা।”
মিতালী কপট রাগের ভান করে বলল,”কিসের ট্রিট? তুই যে আমার কাছ থেকে দশ টাকা, বিশ টাকা নিতি। সেগুলো আগে ফেরত দে।”
ভাবলেশহীন ভাবে নির্ভীক বলল,”আমি তোর কাছ থেকে টাকা নিয়েছিলাম নাকি? কিজানি মনে পড়ছেনা।”
নির্ভীকের বাহুতে থাপ্পড় বসালো মিতালী। হাসলো দুজনেই।
তাকে সঙ্গে নিয়ে ছাত্রীর মায়ের সাথে পরিচয় করিয়ে দিলো নির্ভীক। দশমে পড়ুয়া ছাত্রী।
পড়াতে গিয়ে বুঝতে পারলো মেয়েটি মুখ ভার করে বসে আছে। মিতালী কিছু জিজ্ঞেস করলোনা। মেয়েটি থমথমে গলায় বলল,”ম্যাম, স্যার আমাকে কেন পড়াবেনা?”
মিতালী বলল,”নির্ভীক এখন পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছে। তাই পড়াতে পারবেনা।”
মেয়েটি চুপচাপ রইলো। কিয়দংশ সময় অতিবাহিত হতেই রিতু বলল,”ম্যাম, আপনার কাছে স্যারের নাম্বার আছে?”
কথাটি বলে মিতালীর সরল দৃষ্টি নজরে পড়তেই মেয়েটি আপনাআপনি ভড়কে গেলো। নিজেকে নিয়ে আর কোনো সাফাই দিলোনা। মাথা নিচু করে নিলো।
মিতালী মৃদু হেসে বলল,”এখন তোমার পড়ার সময়, অন্যসব ভাবার সময় পরেও পাবে।”
রিতু মেয়েটি বুদ্ধিমতী। তাইতো চট করেই ধরে ফেললো ম্যাম তাকে কিসের ইঙ্গিত দিয়েছে। আপাতত ম্যামকে না ঘাটানোই উচিত হবে।
রিতুকে পড়িয়ে সোজা রিশাতদের বাসায় গেলো। রিশাতের মা ফোনে বলেছেন আজ এসে যেনো বেতন নিয়ে যায়। তিনি পুরো বেতনটাই হাতে দিলেন। হাসিমুখে বললেন,”ওর বাবার বদলি না হলে এত ঝামেলা হতোনা। রিশাত ও এখন নতুন শিক্ষকের সাথে মানিয়ে চলতে চলতে অনেকটা সময় চলে যাবে।”
মিতালী ও বিনিময়ে এক টুকরো হাসি ফেরত দিলো। বলল,”ভালো থাকবেন আন্টি।”
শেষ বিকেলের টিউশন শেষে বেরিয়ে দেখলো সন্ধ্যা নামি নামি অবস্থা। বাড়ি যেতে যেতে আরও অন্ধকার নামবে। পথেঘাটে লোকজন নেই। গা ছমছমে রাস্তা। হুট করেই মাথায় টোকা পড়লো। পেছন থেকে নির্ভীক বলল,
-“এমন ভ্যাবলার মতো দাঁড়িয়ে আছিস কেন? চল তোকে বাড়িতে দিয়ে আসি। আমিতো তোর বিনেপয়সার বডিগার্ড।”
ভয় কমলো, বুকের দুরুদুরু কম্পন স্বাভাবিক গতি নিলো। প্রতিদিন এ সময়ে নির্ভীক তাকে সঙ্গ দেয়। আজ স্টুডেন্টের বাসা থেকে বেরিয়ে তাকে দেখতে না পেয়ে খানিক ভয় আর সাথে মন খারাপ হলো। ভেবেছিলো বখাটেদের খপ্পরে পড়বে।
মিতালীকে বাড়িতে পৌঁছে দিতে গিয়ে আর নিজের ফেরা হলোনা।
বাড়ির সম্মুখে লোকজনের সামনে প্রশ্নবিদ্ধ হতে হলো তাকে। চেয়ারম্যান চাচা এখনো উপস্থিত হননি। বাড়ির উঠানে দাঁড়ানো কয়েকজন লোকের মধ্যে একজন বলে উঠলো,
-“দিনে দুপুরে তোমরা কি শুরু করলা এগুলা?”
নির্ভীক অবাক হলেও মিতালী অবাক হলোনা। তার চোয়াল শক্ত, চোখের দৃষ্টি স্বচ্ছ- দৃঢ়। বুঝতে পারলো মাহবুবের বিকেলে দেওয়া ইঙ্গিত। নির্ভীক কিছু না বুঝতে পেরে বলল,
-“কী করেছি আমরা?”
কাউকে কিছু বলতে দিলোনা মিতালী। শুধু বলল,
-“আপনারা – আমরা, সবাই এই গ্রামের মানুষ। আমাদের দুজনকে আপনারা ভালোভাবেই চেনেন। বলতে গেলে আপনাদের হাতের উপরই বড় হয়েছি। আমি বুঝতে পেরেছি আপনাদের ইঙ্গিত। আর এসবের পেছনে কে রয়েছে সেটাও জানি। আমাদের দুজনের বন্ধুত্ব একদিনের নয়। ছোটবেলা থেকেই একসাথে পড়াশোনা করেছি – চলেছি। কোনোদিন কোন আপত্তিকর কিছু দেখেছেন আমাদের দুজনের মাঝে?”
সমস্বরে কয়েকজন বলল,”না।”
নির্ভীকের কাছে ব্যাপারটি স্পষ্ট হলো। ততক্ষণে চেয়ারম্যান চাচা ও এসে পড়েছেন। নির্ভীক ক্ষু*ব্ধ হলো।
মাহবুবের দিকে চেয়ে বলল,
-“আপনি কিন্তু খুব বেড়ে যাচ্ছেন। এমন চলতে থাকলে খা*রা*প কিছু হয়ে যাবে বলে দিলাম।”
মাহবুব দ্বিগুণ ক্ষে*পে উঠে বলল,
-“বাদাইম্মার ঘরের বাদাইম্মা।নিজের নাই বাড়িঘর, মামুর বাড়িত বইসা রঙ্গলীলা দেখাস। আমরা ধরলেই দো*ষ।”
তরতর করে রাগের মাত্রা বাড়লো। চোখজোড়া বন্ধ করে রাগ নিবারণের চেষ্টা করে সবাইকে উদ্দেশ্য করে বলল,
-“উনাকে থামতে বলুন। আমি কিন্তু মে*রে বসবো।”
চেয়ারম্যানের কথা শোনা গেলো।
-“কী হচ্ছে এখানে? নির্ভীক এখানে কী করছিস?”
মাহবুব লাফিয়ে উঠলো যেনো। বলল,
-“আপনের ভাইগ্নাকে সামলান চাচা। রাজা করে রাজ্যের বিচার, রাজার ঘরে অবিচার। আপনের ভাইগ্না আর মিতালী যে ঘেঁ*ষা*ঘেঁ*ষি করে এটা দেখেন না? এসব করতে হইলে মিতালীরে এই বাড়ি ছাড়তে হইবো। আমি এমন নোং*রামি বরদাস্ত করুমনা।”
চেয়ারম্যান চাচা শান্ত হয়েই জিজ্ঞেস করলেন,
-“কী করেছে ওরা?”
মাহবুব বলল,”দুইজনের মেলামেশা আপনেরাই দেখেন। আমি এইসব মানতে পারুমনা। আমার যে মাইয়া বড় হইতাছে সেও তো মিতালীর কাছ থেইকা এসব শিখবো।”
অনেকেই মাহবুবের মতে মত দিলো “ঠিক ঠিক।”
চেয়ারম্যান সাহেব বললেন,
-“আমিতো ওদের খা*রা*প কিছু দেখিনি। তারা ছোটবেলা থেকে একসাথে পড়েছে, চলাফেরা করেছে। দুজনে খুব ভালো বন্ধু এটা সবাই জানে।
এখন বন্ধুত্বকে যদি খা*রা*প বলে ওদের শা*স্তির ব্যবস্থা করি, তাহলে গ্রামে এমন অনেককেই পাওয়া যাবে যাদের বিবাহের পরও এখনো বন্ধুত্ব আছে। তাহলে তাদেরকে কী করা উচিত? শুধু শুধু ঝা*মে*লা কেন করছো?”
সবার উদ্দেশ্যে বললেন,”যে যার কাজে যান।”
মাহবুবের টকটকে লাল চোখজোড়াই বলে দিচ্ছে সে কতটা ক্ষেপেছে। ভেবেছিলো সবাইকে একজোট করে মিতালীকে বাড়ি ছাড়া করবে। এরপর কোনোভাবে আব্বার হাত থেকে আঙ্গুলের ছাপ নিয়ে সম্পত্তি সব নিজের নামে করে নেবে।
মাহা একপাশে জড়সড় হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। নির্ভীক যাওয়ার আগে এগিয়ে গেলো মিতালীর কাছে। বলল,
-“যদি এই লোক উল্টাপাল্টা কিছু করার চেষ্টা করে, আমাকে সাথে সাথে ফোন দিবি।”
মিতালী নিরলস চেয়ে থেকে বলল,”তুই বাড়ি যা।”
রাগ হলো নির্ভীকের। একবার বললে কি হতো “আমি তোর উপর ভরসা করি, কিছু হলেই তোকে ডাকবো।”
রাগ চেপেই বাড়ি ফিরলো।
মিতালী বাবা মাকে না দেখে মাহাকে জিজ্ঞেস করলো,
-“আব্বা-মা কই?”
মাহা বলল,
-“ভাবির বাবার বাড়িতে নাকি মেহমান আসবে। তাই আব্বা আর মাকে সাথে নিয়ে গিয়েছে। আমাকেও যেতে বলেছে আমি যাইনি। কাল আসবে তারা।”
মিতালী হাসলো। আব্বা আর মাকে সরানোর মূল উদ্দেশ্য হলো তাকে ফাঁসানো। তবুও সে অবাক হলো। আব্বা পড়ে থাকলেও যে এসে ধরেনা। সে কিভাবে অচল আব্বাকে ধরে বাবার বাড়ি নিয়ে গেলো?
★★★
সকাল সকাল আব্বা আর মাকে নিয়ে পিয়ালী বাবার বাড়ি থেকে ফিরলো। চেহারায় তাকানো যাচ্ছেনা। রোজী বেগম যেতে চাইছিলেননা। গতকাল পিয়ালী কেমন যেনো বিনয়ী হয়ে গেলো। তার ব্যবহার এমন ছিলো যে রোজী বেগম না করতে পারলেননা। ভাবলেন বউয়ের বুঝি সুমতি হয়েছে। আস্তে আস্তে সংসারটা ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু তার আড়ালে কি হলো সেটা তিনি জানতেও পারলেননা। আর না মিতালী কখনো বলবে। মাহাকেও সাবধান করে দিয়েছে গতকাল সন্ধ্যার ব্যাপার নিয়ে, যেনো আব্বা আর মাকে চিন্তা না দেয়।
ঝুমুরকে পড়িয়ে নির্ভীকের কাছ থেকে টাকা নিলো। মাহার স্কুলে গিয়ে ফর্ম পূরণের টাকা দিয়ে আসলো মাহাকে।
সেখান থেকে ফিরেই ড্রীমল্যান্ড মডেল স্কুলে পৌঁছালো। প্রথমদিনের ক্লাস সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হলো। সমস্যা হলো বিকেল চারটা পর্যন্ত ক্লাস। সাড়ে তিনটা থেকে রিতুকে পড়াতে হবে। আবার ০৪ঃ৪৫ মিনিট থেকে ০৫ঃ৪৫ পর্যন্ত আরেকজনকে পড়াতে হবে। আজ আর রিতুকে পড়ালোনা। স্কুল থেকে বেরিয়ে নির্ভীককে ফোনে জানিয়ে দিলো রিতুকে পড়ানোর সময় তার হবেনা। রিতুর মাকে যেনো ম্যানেজ করে নেয়। নির্ভীক রিতুর মাকে জানালো আজ মিতালী আটকে পড়েছে। আসতে পারবেনা সে।
রাতে ঘুমাতে গিয়ে চিন্তায় পড়লো মিতালী। বোনকে চিন্তিত হতে দেখে মাহা জিজ্ঞেস করে বসলো,”কী হয়েছে তোমার?”
মিতালী বলল,”কিছুনা।”
মধ্যবিত্ত ঘরের মেয়েরা ১৫-১৬ বছর বয়সেও অনেক কিছু বুঝে যায়। তাদের মস্তিস্ক খুব প্রখর থাকে। মূলত পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতি তাদেরকে বুঝদার বানিয়ে দেয়। মাহা জেদ ধরে বলল,”আমাকে না বললে কাকে বলবে? আমি না তোমার বোন? কতমানুষ দুঃখ-সুখ বলার জন্য একটা বোনের আফসোস করে, আর তোমার বোন থেকেও বলছোনা?”
মিতালী হেসে ফেললো। পর মূহুর্তে হাসি দীর্ঘশ্বাসে রূপ নিলো। চিন্তিত স্বরে বলল,
-“সময়ের কারণে একটা টিউশন ছেড়ে দিতে হচ্ছে। অথচ বেতন ভালো।”
আপুর কথায় তারও ভীষণ মন খারাপ হলো। হুট করে তার মাথায় এক বুদ্ধি খেলে গেলো। তীব্র উৎকন্ঠা নিয়েই জিজ্ঞেস করলো,”তোমার স্টুডেন্ট কোন ক্লাসের?”
একই মুখভঙ্গিতে জবাব দিলো মিতালী। বলল,
-“ঝুমুর ক্লাস ফাইভে পড়ে, আর বাকি দুজন মাধ্যমিকের স্টুডেন্ট।”
মাহা চট করে এমন এক কথা বললো। ভারী অবাক হলো মিতালী।
মাহা বলল,” তোমার একটা টিউশন আমাকে দিয়ে দাও। আমি একটা পড়ালে অন্য দুটো তুমি পড়াবে। ঝুমুরকে আমি পড়িয়ে দেবো। সময় তুমি ম্যানেজ করে নিও।”
বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞেস করলো মিতালী,”তুই পারবি? তোর তো সামনে পরীক্ষা। এত চাপ নেওয়ার দরকার নেই। নিজের পড়াশোনায় মন দে।”
মাহা প্রচন্ড বিরক্ত হলো। চোখমুখ কুঁচকে বলল,
-“আমিতো খা*রা*প ছাত্রী না। এক-দেড়ঘন্টা টিউশনের কাজে ব্যয় করলে কিছু হবেনা। আমাকেও তো শক্ত হতে হবে। পায়ের তলার মাটি যাতে আঁকড়ে ধরতে পারি।
জানো আপু, আমি না সবসময় চেয়ে এসেছি যেনো তোমার মতো হতো পারি। খুব কঠিন নয়, তবে একটু আ*ঘা*তেই উঁড়ে যাবো তেমনও নয়।”
মিতালী ভীষন গর্ববোধ করলো মাহাকে নিয়ে। গুলুমুলু গাল দুটোতে আদুরে হাত বুলিয়ে বলল,
-“জীবনে সফল হতে হলে ঈগল হতে হয়। যে কথা না বলেও ধারালো নজরে ভড়কে দিতে পারে, পাখা ঝাপটিয়ে আকাশে উড়তে পারে।
তোতার মতো যত্রতত্র বুলি আওড়ালেই কিন্তু আকাশে ওড়া যায়না।
কুকুরের মতো আচরণকারীদের সাথে কুকুর হওয়া মানায়না। তাদের সামনে একদলা থুতুই যোগ্য জবাব।”
মাহা বলল,
-“বুঝতে পেরেছি। এজন্যই কি ভাবির গা*ল*ম*ন্দ শুনেও তুমি চুপ থাকো?”
-“কেউ তোকে কটাক্ষ করলে চুপ থাকবি। যখন বিতর্কে যাবি? তখন সে আরও বলবে, আরও বলবে। তোর চেয়ে একধাপ উপরে থাকতে চাইবে। কিন্তু তুই যখন চুপ থাকবি? তখন ধীরে ধীরে তার কটাক্ষের শব্দভান্ডার ফুরিয়ে যাবে। সে আর উপরে উঠতে পারবেনা। কী বলেছিলাম আমি?
তোতা বুলি আওড়াতে পারলেও আকাশে উড়তে পারেনা।”
মাহা গভীর মনযোগে বোনের কথা শ্রবণ করলো। সে বুঝলো পৃথিবী এখনো চেনা বাকি তার।
মাহা ঘুমিয়ে পড়লো। মুঠোফোনের শব্দ পেয়ে স্ক্রিন অন করলো মিতালী। নির্ভীক পাঠিয়েছে,
“একবার শুধু কবিতা হয়ে এসে দেখো,
গোটা জীবন আবৃত্তি করবো তোমাকে।”
মিতালী ফিরতি মেসেজ পাঠালো,
-“কী এটা?”
অনেকক্ষণ পর টুংটাং শব্দ হলো। নির্ভীক লিখলো,
-“কবিতা, শিমুল মুস্তাফার লিখা।”
#চলবে…….
#নিরবতায়_হৃদয়_কোনে
#জিন্নাত_চৌধুরী_হাবিবা
#পর্ব_০৫
রিশাতের মায়ের দেওয়া টাকা দিয়ে টুকটাক বাজার করেছে মিতালী। সকালে ঝুমুরকে মাহা গিয়ে পড়িয়ে আসে। সেই সময়ে রিতু মেয়েটাকে পড়িয়ে আসে মিতালী। তার সাথে রিতুর একটা চাচাতো বোন যোগ হয়েছে। দুজনকেই একসাথে পড়িয়ে দিচ্ছে।
তারপর স্কুল, বিকেলের টিউশন শেষ করে যখন ক্লান্ত বোধ করে, তখনই একচিলতে হাসি নিয়ে নির্ভীক তার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকে। নির্জন সময়টুকু ভয় দূর করতে, তাকে সঙ্গ দিতেই নির্ভীকের আসা।
ইদানীং সে মিতালীকে ছাড়াই ক্যাম্পাসে যাচ্ছে। নিজের ক্লাসের পাশাপাশি প্রিয়ার কাছ থেকে মিতালীর জন্য নোট কালেক্ট করে দিচ্ছে। পাশাপাশি পথ ধরে এগিয়ে যাওয়া, নিরব মনে একপাক্ষীক বার্তা জমিয়ে রাখা। দোকান থেকে দুটো কেক হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে নির্ভীক। সে বুঝতে পারে মিতালী হয়তো অর্থসংকটের কারণে দুপুরে কিছু কিনে খায়না। টিউশনে কখনো নাস্তা দিলে খায়, নয়তো পানি দিয়ে গলা ভেজায়। জীর্ণশীর্ণ, ক্লান্ত, মলিন চেহারায় তার অভুক্ততার প্রমাণ।
নির্ভীক একটি কেক নিজে নিয়ে অপরটি মিতালীর দিকে বাড়িয়ে দেয়। মিতালী কিছু বলতে চাইলেই সে থামিয়ে দিয়ে বলে,
-“তোর সাথে কথা বলতে বলতে বাড়ি ফেরার পথে আমার গলা শুকিয়ে যায়, খিদে পায়। কিছু না খেলে আমি শক্তি পাইনা। প্রচন্ড কথা বলিস তুই।”
মিতালী হাসে। পাশে ভাবলেশহীন চলতে থাকা ছেলেটাকে তার বড্ড চেনা। তাইতো এখন আর কিছু বলেনা সে।
সে চায় জনম জনম ধরে এ বন্ধুত্ব টিকে থাকুক, বেঁচে থাকুক সকল বন্ধুদের প্রাণে প্রাণে।
★★★
ক্লান্ত শরীর নিয়ে রান্না করলো মিতালী। ভেবে রেখেছে এখন থেকে রাতে রান্না করে রেখে পরেরদিন সন্ধ্যা পর্যন্ত খাবে। এরপরই পরেরদিনের রান্না বসাবে। এমন না করলে বেশিদিন টিকে থাকতে পারবেনা। সকালে ভাত খেয়ে বেরোলে পুরোদিন আর পেটে খাবার পড়েনা। খিদের চোটে নাড়িভুড়ি সব বেরিয়ে আসতে চায়। রোজী বেগমের হাত-পা বাঁধা। তিনি কিছু করতে গেলেই তাদের একেবারে মেয়ের ঘাড়ে নামিয়ে দেবে।
সন্ধ্যায় আসার সময়ই নির্ভীক নোট তুলে দিয়েছিলো তাকে। সেগুলোতেই একবার চোখ বুলিয়ে নিচ্ছে। চর্চা না থাকলে পানির মতো স্বচ্ছ বিষয় ও পাথরের মতো কঠিন মনে হয়।
টেবিল গুছিয়ে একবার আব্বাকে দেখতে যাওয়ার ইচ্ছে পোষণ করলো। ঘরের মাঝখানে বেড়া তুলে দিলেও আব্বা-মা আর মাহা মিতালীর পাশেই থাকছেন।
মিতালী নরম হলো, অধরকোনে হাসি টে*নে বলল,
-“আব্বা কী করো? সারাদিনে একবারও তোমার খোঁজ নিতে পারিনি।”
মতিন সাহেব হাসলেন মেয়ের কথা শুনে। কাঁপা-কাঁপা স্বরে বললেন,
-“তোর কাঁন্ধে যেই দায়িত্ব উঠাইয়া দিছিরে মা। আমি কোনোদিন ভাবিনাই এমন পরিস্থিতি হইবো। আমি বোঝার মতো পইড়া থাকুম।”
মিতালী কপট রাগ দেখালো। রাগত স্বরে বলল,
-“তুমি কেন নিজেকে বোঝা মনে করো? তুমি হচ্ছো আমাদের মাথার উপর বটগাছের ছায়া। যার দোয়াতে আমাদের সফলতা আসবে।”
মতিন সাহেব মেয়েকে ইশারা করলেন ঝুঁকতে। মিতালী ঝুঁকে যেতেই তার কপালে চুম্বন করে বললেন,
-“আমি খাঁটি হীরার মালিক। আমার চাইতে ধনী আর কেডায় আছে?”
মাহা আড়াল থেকে বেরিয়ে মুখ ভার করলো। মিথ্যে রাগ দেখিয়ে ন্যাকা কান্না জুড়ে দিলো। বলল,
-“সব আদর তোমাদের মেয়ের জন্য। আমাকে ড্রেনে পেয়েছো তো কী হয়েছে? একটু আদর করে দিলে কি টাকা খসে যাবে?”
মাহার কান্ডে সবাই হাসলো। মতিন সাহেব দুই মেয়েকেই দুহাতে জড়িয়ে বললেন,
-“তোরা দুইডাই আমার হীরা।”
★★★
সকালে বের হওয়ার সময় মাহবুবের মেয়ে মাহবুবাকে চোখে পড়লো। দূর থেকে পিটপিট করে ফুফিকে দেখে গেলো। মিতালী আশেপাশে তাকিয়ে হাত বাড়িয়ে ইশারা করলো। মাহবুবা এলোনা। সেও আশেপাশে তাকালো। মাকে নজরে পড়তেই ঘরে ঢুকে গেলো।
দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো মিতালী। মেয়েটা আগে তার কাছে আসলেও ঝা*মে*লা হওয়ার পর থেকে আসছেনা। হয়তো কড়া সুরে না করে দিয়েছে। কথা না শুনলে মেয়েটাকে তুলে আছাড় মা*র*তে ও দ্বিধা করবেনা মাহবুব।
বৃহস্পতিবার হওয়ায় আধা বেলা স্কুল করেই বাড়ি ফিরলো মিতালী। আগামীদিন শরীরটাকে বিশ্রাম দিতে পারবে ভেবেই একটু শান্তি লাগছে। সপ্তাহের ছয়টি দিন জুড়েই দৌঁড়ঝাপের উপর থাকতে হয়।
★★★
সন্ধ্যার পূর্ব মুহূর্তে বাড়ি থেকে বেরোতে নিলেই নির্ভীকের মা পথ আগলে দাঁড়ান।
-“কই যাস?”
নির্ভীক স্বাভাবিক প্রশ্ন ধরেই উত্তর দিলো,
-“একটু সামনের দিকেই যাচ্ছি। আবার ঘুরে চলে আসবো।”
মা বললেন,
-“মিতালীর লগে দেহা করতে যাস, তাইতো? সেদিন ও এ নিয়া ঝা*মে*লা বাঁধাইলি। কী দরকার আছে ওর লগে কথা কওনের?”
-“মা তুমি এসব বাদ দাও তো। ওই মাহবুবের কাজই হলো মানুষের পেছনে লাগা।”
-“তবুও বাপ, আমি এত ঝা*মে*লা চাইনা। তোর বাপরে ছাইড়া তোরে বুকে নিয়া পইড়া রইছি। কিছু একটা হইলে আমি আর বাঁচুমনারে আব্বা।”
কথা বলতে বলতে মুখে আঁচল চেপে কেঁদে ফেললেন নির্ভীকের মা।
নির্ভীকে মাকে আলতো হাতে জড়িয়ে ধরলো। হেসে বলল,
-“তুমি আমাকে নিয়ে এত চিন্তা কেন করো, বলোতো? কিছু হবেনা আমার, সবসময় তোমার দোয়া আমার উপর থাকছে তো।”
মাকে বুঝ দিয়ে মিতালীকে আনতে বেরিয়ে পড়লো।
দেখা পেতেই নির্ভীক বলল,
-“কাল তো ছুটি। আজ একটু ধীরে হাঁট। কতদিন হলো দুজনের একসাথে অনেকক্ষণ খুব একটা গল্প করা হয়না।
মিতালী হাঁটার গতি কমালো। ধীর পায়ে এগোতে থাকলো। হঠাৎ নির্ভীক প্রশ্ন করলো,
-“মিতা, তোর কেমন ছেলে পছন্দ?”
মিতালী ভ্রু কুঁচকে বলল,”হঠাৎ এই প্রশ্ন?”
নির্ভীক বলল,
-“এমনিতেই জিজ্ঞেস করলাম। কখনো জানা হয়নি তো তাই।”
মিতালী কিছুকক্ষণ ভাবলো। অতঃপর বলল,
-“সাদামাটা, একটু অগোছালো, একটু দায়িত্বশীল।
সে প্রেম নিয়ে নয়, সুখ নিয়ে আসুক। আমি বারবার তার প্রেমে পড়বো। সুখ মানে টাকা নয়, তার বক্ষস্থল যেনো আমার শান্তির স্থান হয়। যেমন আমার বাবা কাড়িকাড়ি টাকা না কামিয়েও আমাদের সুখে রেখেছেন।”
নির্ভীক অনিমেষ চেয়ে রইলো। তাকে দেখার তৃষ্ণা এজীবনে না ফুরাক। তাকে না পাওয়ার খাতায় রাখলেও ভালোবাসার অন্ত না থাকুক।
যদি কখনো সময় আসে তাকে জানাবার, ফিরিয়ে দেওয়া ভাঙা মন নিয়েও আজীবন ভালোবাসবে নির্ভীক। তার অপলক দৃষ্টি নজর কাড়তেই মিতালী ভ্রু উঁচিয়ে শুধালো,”কী?”
নির্ভীক দুপাশে হালকা মাথা দুলিয়ে হেসে ফেললো। বলল, “একটা কবিতা বলি?”
_”কবিতা শোনাই যায়। তুই কিন্তু আগে এমন ছিলিনা। এই বছর দেড়েক হবে কবিতা নিয়ে বেশ ঘাটাঘাটি করছিস।”
আনমনে বলল নির্ভীক,”তার প্রেমে পড়ার পর আমি কবিতার প্রেমে পড়ে যাই। আমার হৃদয়স্থলের সকল অনুভূতি যে একেকটা কবিতার অংশবিশেষ।”
মিতালীর মন খা*রা*প হলো। নিজেকে ঠিক রেখে বলল,
-“বাহ্! তুই প্রেমে পড়েছিস, বছর কেটেছে। অথচ আমি জানলাম আজ?”
মিতালীর কথায় চমক কাটলো নির্ভীকের। লুকোচুরি ভঙ্গিতে বলল,”আরে কবিতা পড়তে পড়তে কথায় একটা টা*ন চলে এসেছে। সেরকম কিছুনা।
আমি তোকে কবিতা শোনাই।”
মিতালীকে কিছু বলার সুযোগ দিলোনা নির্ভীক।
“মেঘের মতো ভার হয়ে রয় বুক,
মেঘের মতন থমথমে কী ব্যথা!
মেঘতো তবু বৃষ্টি হয়ে ঝরে,
আমার কেবল জমছে ব্যাকুলতা।”
—সাদাত হোসাইন।
মিতালী মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনে যায়। ভেবে ভেবে মরিয়া হয়ে ওঠে নির্ভীকের কিসের এত ব্যাকুলতা?
হাঁটতে হাঁটতে বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছাতেই বিদায় জানালো সে।
নির্ভীক দাঁড়িয়ে থাকে। যতক্ষণ না দৃষ্টি সীমানার বাইরে ছুটে যায় কল্পনা বিলাসিনী রমণী।
বহুবছর একসাথে কাটানোর পর একটু একটু মায়া, একটু খানি মুগ্ধতা, বছর দেড়েক আগে হুট করেই প্রেমে পড়া। অথচ সে প্রেম জানেনা।
প্রেম ক্ষণে ছিলোনা কোনো সাজ, ছিলোনা কোনো হৃদয় থমকে দেওয়া শাড়ির আঁচল।
সাদামাটা কামিজে স্বেদজলে আচ্ছাদিত রমণী কেমন হৃদয় কেড়ে নিলো।
প্রেম জাগলো এক অপরিপক্ক পুরুষ হৃদয়ে। সেদিন প্রথম প্রেম জানলো সে। ভালোবাসা ধীরে ধীরে হৃদয়ে ছড়ালো।
★★★
কাঁচা বাজার কিছুই নেই ঘরে। আজ হাঁড়িতে কি চড়বে ভাবতে ভাবতে বুদ্ধি পেলো। শুকনো মরিচের যা দাম, বয়ামে চার-পাঁচটা শুকনো মরিচ পেলো। সাথে একটা রসুন আর পেঁয়াজের সংমিশ্রণে করে নিলো মরিচ ভর্তা। ঘরম ভাতের সাথে এই মরিচ ভর্তা অমৃতের স্বাদ যেন।
রোজী বেগম নিজের ভাগের একটুখানি তারকারি মেয়ের জন্য লুকিয়ে আনতে গেলেন। পাত থেকে সরিয়ে উঠে আসার সময় পিয়ালী পথরোধ করে দাঁড়ালো।
বাটির তরকারি টুকু কেঁড়ে নিয়ে বলল,
-“খেতে না পারলে দিয়ে দেবেন। তবুও আমার ঘরের খাবার কোনো কুকুর , বিড়ালকে দেবেননা।”
রোজী বেগম চুম মে*রে গেলেন। এদিক ওদিক দৃষ্টি লুকাবার চেষ্টা মাত্র।
পিয়ালীর কথাখানায় বেশ জোর ছিলো বিধায় ঘরের অপর প্রান্তে থেকে মিতালীও কিছুটা শুনতে পেলো। কিন্তু ব্যাপারটা বুঝতে পারলোনা। বাবা-মাকে কিছু বলেছে কি-না দেখতে সেদিকে গেলো।
নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে জিজ্ঞেস করলো,”কী হয়েছে এখানে?”
পিয়ালীর একেকটা কথা সুঁচের মতো বিঁধলো মনে। সে বলল,
-“বাবা-মার পুরো দায়িত্ব নিতে চেয়েছিস। তাহলে এখন না খেতে পেরে আমার ঘরের তরকারি কেন লাগবে? ল*জ্জা লাগেনা? খেতে না পারলে মানুষের বাড়িতে কাজ করে খা।”
এবার মায়ের উপর রা*গ হলো মিতালীর। সে তো বলেনি তার তরকারি লাগবে। কেন শুধু শুধু এতগুলো কথা শুনবে? মা আর আব্বার সাথে যখন কেউ উঁচু গলায় কথা বলে, তখন তার খুব খা*রা*প লাগে। মায়ের চোখে চোখ রাখলো মিতালী। ঠান্ডা গলায় বলল,
-“আমার তো তরকারি লাগবে না মা। নিজের যতটুকু সামর্থ্য ততটুকুতে আমি তুষ্ট থাকতে পারি। আর কোনোদিন তুমি এমন করবেনা।”
রোজী বেগম টলটলে জলভরা চোখে তাকালেন। মতিন সাহেব ও চুপ হয়ে আছেন।
মিতালী ফিরে এসে মরিচ ভর্তা দিয়েই ভাত খেয়ে নিলো। লাল লাল ভাতের দলা মুখে পুড়ছে আর চোখ মুছতেছে। কারো কাছে ছোট হওয়ার চেয়ে ভিটার মাটি কামড়ে ম*রে যাওয়া ভালো। এই দুনিয়ায় যারা আত্মসম্মান বিসর্জন দিতে পারে, তারাই বোধহয় ভালো থাকে।
#চলবে………