#নিরবতায়_হৃদয়_কোনে,১২,১৩
#জিন্নাত_চৌধুরী_হাবিবা
#পর্ব_১২
আবছা কুয়াশায় ঘেরা মেঠোপথ ধরে হাঁটতে গিয়ে একটা ব্যাপার জেনে মনঃক্ষুণ্ন হলো ইশরাক। আজ আর সকালে মিতালীর দেখা পাবেনা। মিতালীর আজ গুরুত্বপূর্ণ ক্লাস আছে। ক্যাম্পাসে যেতে হচ্ছে তাকে। সকাল সকাল তাজা খবর খানা মিললো মাহার কাছে।
সে সকালের টিউশনে যাচ্ছিলো। মাঝপথে ইশরাকের সাথে দেখা। মাহার খুব ভালোলাগে লোকটাকে। তার সাথে খুব ভাব হয়েছে ইদানীং। তবে মাহা চায় নিজের অনুভূতি গুলো চাপা রাখতে। অনুভূতি ব্যক্ত করলে হয়তো তাকে হ্যাংলা অথবা নীচ প্রকৃতির মেয়ে ভাববে।
ইশরাক খবর পেয়ে আর দাঁড়ালোনা। মাহাকে বিদায় জানিয়ে রওনা হলো বাড়ির পথে। অফিস যাওয়ার জন্য গাড়ি ধরতে হবে। সদর এলাকায় চাকরি নিয়েছে শুধু মিতালীকে চোখে চোখে রাখার জন্য।
★★★
নির্ভীকের আজ ভীষণ ব্যস্ত সময় কা*ট*ছে। মিতালীর আজ গুরুত্বপূর্ণ ক্লাস ছিলো। সে ক্যাম্পাসে গিয়েছে বিধায় তার ভাগের ক্লাসগুলো ও আজ নির্ভীকের নিতে হচ্ছে।
★★★
ক্যাম্পাসে আসার পর থেকেই প্রিয়াকে মনমরা হয়ে থাকতে দেখলো মিতালী। ক্লাসে ও কেমন অমনোযোগী ছিলো। তাই ক্লাস শেষ করেই ক্যাম্পাসের পেছনে তাদের আড্ডা দেওয়ার সেই জায়গায় টে*নে নিয়ে গেলো। সোজাসাপটা প্রশ্ন করলো মিতালী,
-“কী হয়েছে তোর? এমন মনমরা হয়ে আছিস কেন? তোদের কী হয় আমি বুঝিনা। গতকাল নির্ভীকের মন ভালো ছিলোনা, আজ তোর। সমস্যা কী তোদের?”
প্রিয়া চোখের জল লুকানোর চেষ্টা করেও পারলোনা।
“বাসা থেকে বিয়ে ঠিক করেছে”
বলতে বলতেই দু’ফোঁটা চোখের জল ঘাসের ওপর ভোরের শিশির বিন্দুর মতো গড়িয়ে পড়লো।
ভীষণ অবাক হলো মিতালী। জিজ্ঞাসু দৃষ্টি মেলে বলল,
-“কিন্তু কেন? তোর পরিবার তো এত তাড়াতাড়ি বিয়ের দেওয়ার কথা নয়!”
-“ভালো পাত্র পেলে তাদের আর কিছু ভাবার সময় থাকেনা।”
মিতালী বুঝলো এটাই বুঝি নির্ভীকের মন খারাপের গল্প! অথচ সে এতটুকু বোঝার চেষ্টা করলোনা গল্পটি প্রিয়া নয়, বরং সে।
-“নির্ভীক কী বলেছে?”
প্রিয়া বলল,
-“জানাইনি ও কে।”
আশ্চর্য হলো মিতালী।
-“জানাসনি মানে? তুই ভাবতে পারছিস, তোর বিয়ে হয়ে গেলে নির্ভীক কতটা কষ্ট পাবে!”
চমকে উঠলো প্রিয়া। নির্ভীক কেন কষ্ট পাবে? সে তো ভালোবাসার কথা নির্ভীককে জানায়নি।
ভ্রু’দ্বয় আপনাআপনি কুঞ্চিত হলো। অস্ফুটস্বরে আওড়ালো,
-“কী!”
মিতালী মাথা দুলিয়ে বলল,
-“কষ্ট পাবে না? দুজন যদি দুজনকে ভালোবেসেই থাকিস, তাহলে কেন কষ্ট পাবেনা? তাছাড়া তুই একবার বাসায় নির্ভীকের কথা বলে দেখ।”
-“তুই পা*গ*ল হয়েছিস মিতা। নির্ভীক কেন আমায় ভালোবাসতে যাবে? আমার প্রতি কোনোদিন ও কে আগ্রহ দেখাতে দেখেছিস? তাছাড়া আমিও তো নিজের মনের কথা ও কে কখনো জানাইনি। সেদিন কী বলেছিলাম মনে নেই? তোকে ছাড়া কথাটি আমি কাউকে বলিনি, এমনকি নির্ভীককে ও না।”
চরম আশ্চর্য হয়ে হতবিহ্বল চাহনিতে চাইলো মিতালী। কিছু বুঝতে না পেরে বলল,
-“মানে?”
-“আমার ভালোবাসা একপাক্ষিক। নির্ভীক কিছুই জানেনা। আর এমুহূর্তে তাকে আমি জানাতেও চাইনা। আমি জানি ও আমায় কোনদিন ও চাইবেনা। শুধু শুধু কেন ছেলেটাকে বিব্রত করতে যাবো?”
এতোগুলো দিন কী ভেবে এসেছিল মিতালী। যাইহোক সত্যটা সামনে আসায় তার ভারী বুক শীতল হলো। প্রিয়ার জন্য ভীষণ খা*রা*প লাগা কাজ করলেও কেমন প্রশান্তি লাগছে ভেতরটায়। মিতালী প্রশ্ন করলো,
-“ছেলেটা তোর পছন্দ?”
-“সবার যেখানে পছন্দ, সেখানে আমার পছন্দ না হয়ে যাবে কোথায়?”
-“তারমানে বিয়েটা তুই করছিস?”
-“হুম। শীঘ্রই তারিখ পড়বে।”
মেয়েটার চেহারায় তাকাতে পারলোনা মিতালী। চোখমুখ লাল হয়ে আছে। মনে হচ্ছে এক্ষুনি কেঁ*দে ফেলবে। তাকে কাঁদতে দেওয়া উচিত। অন্তঃকরণের ভালোবাসা পুষে রেখে নিঃশেষ হওয়ার চেয়ে কেঁদে হালকা হওয়া ভালো। তাকে স্পেস দিতে এমন করুণ মুহূর্তে সান্ত্বনা না দিয়ে স্বা*র্থপরের মতো মিতালী বলল,
-“আমার তাড়া আছে, উঠছি এখন।”
মিতালী দৃষ্টি সীমানা অতিক্রম করতেই চেপে রাখা কান্না উগলে দিলো প্রিয়া। মুখচেপে কান্নার শব্দ প্রতিহত করতে চাইলো। দীঘির স্বচ্ছ, টলটলে জলে তাকিয়ে নিজেকে আরেকটু উন্মুক্ত করে দিলো সে।
-“তুই এত স্বা*র্থপর কেন মিতা? আমায় একটু সান্ত্বনা দিলিনা। তোর জন্য আমি নির্ভীককে ছে*ড়ে দিলাম, শুধু তোর জন্য। নির্ভীকের চোখে তোর জন্য উথাল-পাতাল করা মায়া আমি দেখেছি। আমার মনে কখনো তোর জন্য হিং*সে ছিলোনা। তবুও সেদিন তোকে নির্ভীকের কথা জানালাম, যেন তুই দূরে সরে যাস। শুধু একটু ভালোবাসা পাওয়ার জন্য। নয়তো আমি তোর ক্ষ*তি চাইনি। সত্যিই ক্ষ*তি চাইনি।
এত কিছু করেও আমি নির্ভীকের মন পেলামনা। আমি চাই তুই ভালো থাক। তাইতো বিয়েতে মত দিয়ে দিয়েছি। যাতে অনেক দূরে চলে যেতে পারি। তোদের মাঝখানে থেকে তোর প্রতি কখনো হিং*সা মনে পুষতে না পারি।”
অনেকটা শব্দ করেই কাঁদলো প্রিয়া। এদিকটায় তেমন কারো আনাগোনা নেই বিধায় সমস্যা হলোনা। যে ভালোবাসা হা*রা*য়, সে শুধু ভালোবাসাই হা*রা*য়না। হা*রা*য় আমি সত্তাকে, নৈঃশব্দে চু*রমা*র হয়ে যায় যতনে গড়া হৃদয়।
★★★
সময় দু’টোর কাঁটায়। স্কুলে পিরিয়ড টাইম। ফোন হাতে ম্যাসেন্জারে টেক্সট পাঠালো মিতালী।
সকাল থেকে ধ*ক*ল যাওয়ায় ক্লান্ত শরীরটা নিয়ে চেয়ারে বসে ঝিমিয়ে রইলো নির্ভীক। শরীরে শক্তি কুলচ্ছে না বলে খেতে গেলোনা সে। দৈবাৎ মেসেন্জারের টুংটাং শব্দ হলো। ঝিমিয়ে থাকা চোখজোড়া সজাগ হয়ে উঠলো। স্ক্রিন অন করেই দেখতে পেলো মিতালীর কাছ থেকে বার্তা এসেছে।
প্রবল আগ্রহ নিয়ে বার্তাটি ওপেন করলো সে।
-“খেয়েছিস?”
নির্ভীকের অধরকোন প্রসারিত হলো। দ্রুত হাতে টাইপ করলো,
-“একা একা ইচ্ছে করছেনা।”
মিনিট না যেতেই ফিরতি বার্তা,
“স্কুল থেকে বের হ। আমি কাছাকাছি আছি।”
এতক্ষণের ঝিমিয়ে থাকা শরীর যেন মুহুর্তেই চাঙ্গা হয়ে উঠলো। শরীর ঝাড়া মে*রে স্কুলের গেইট পেরিয়ে সামনের দিকে এগোলো। বেশিদূর যেতে হলোনা। তার পূর্বেই মিতালীর দেখা পেলো। মেয়েটা মিষ্টি হেসে এগিয়ে আসছে। তা দেখে নির্ভীকের হৃদয় কোন ‘ছলাৎছলাৎ ‘ শব্দে ধুকপুক করে উঠলো। ভালোবাসায় যাদু আছে। নয়তো সাধারণ বিষয়কেও কেমন অসাধারণ লাগে, সারাক্ষণ মনকাননে ভালোলাগার পাখিগুলো কিচিরমিচির করে।
একসাথে খাবার শেষ করে মিতালী বাকি ক্লাসগুলো নিতে নির্ভীকের সাথেই স্কুলে ফিরলো।
স্কুল শেষে ফেরার পথেই চেয়ারম্যান চাচার সাথে দেখা হলো। সালাম জানালো মিতালী। তিনিও হাস্যজ্জ্বল মুখে জবাব দিলেন।
স্নেহভাজন কন্ঠে বললেন,
-“তোমার সাথে কিছু কথা বলবো।”
মিতালী নম্র স্বরে বলল,
-“জি চাচা বলুন।”
-“মালিহা আজকাল তোমার মিনা ভাবির কাছে পড়তে চায়না। ভেবেছি ওর জন্য ঘরোয়া শিক্ষক রাখবো। আমরা তোমার কথাই ভাবলাম। তোমার যদি সময় হয়, তাহলে মালিহাকে একটু সময় দিও।”
মিতালী ইতস্তত করে বলল,
-“আসলে আমার তো দিনের বেলায় সময় নেই চাচা।”
নির্ভীক যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো। এখন যদি মিতালী হ্যাঁ করে দিতো, তবে তার কানের নিচে দু*টো দেওয়ার ইচ্ছেটা দমিয়ে রাখতোনা সে।
চেয়ারম্যান চাচা বললেন,
-“তুমি না হয় সন্ধ্যার পর পড়িয়ে দিও। বাড়ির কারো কাছেই সে পড়বেনা। আর বাইরের কাউকে ভরসাটা ঠিক করতে পারছিনা। তুমি সময় দিলে উপকৃত হতাম। পড়ানোর পর তোমায় ইশারাক বা নির্ভীক নাহয় বাড়ি পৌঁছে দেবে।”
এতটা অনুরোধ ফেলতে পারলোনা মিতালী। হ্যাঁ করে দিলো সে। চেয়ারম্যান সাহেব কথা পাকা করে নিজ গন্তব্যে পা চালালেন। রা*গ হলো নির্ভীকের। নাকের পাটা ফুলে উঠলো তার। মিতালীর সাথে কথা না বলেই আগে আগে হাঁটলো। পেছনে পড়ে যাওয়ায় একপ্রকার দৌঁড়ে নির্ভীকের পাশ ধরলো মিতালী। হাঁফিয়ে যাওয়া গলায় বলল,
-“তুই আমায় ফেলে এমন ঘোড়ার মতো ছুটছিস কেন?”
নির্ভীক তে*ড়ে তার দিকে এগোতে গিয়েও দমে গেল। দাঁতে দাঁত চেঁ*পে বলল,
-“সারাদিন গাধারখাটুনি খে*টে ও রাতে আমাদের বাড়িতে কেন তোকে যেতে হবে? না করে দিতে পারলিনা?”
মিতালী আমতা আমতা করে বলল,
-“চাচা এত করে বলল। উনার দ্বারা আমি অনেকবার উপকৃত হয়েছি। এতটাও অকৃতজ্ঞ আমি নই। তাছাড়া দু’টো পয়সা বেশি পেলে আমারই লাভ।”
ফোঁস করে শ্বাস ছাড়লো নির্ভীক। মেয়েটার সাথে কথা বলে খুব একটা লাভ নেই মনে করে আর কথা বাড়ালোনা নির্ভীক। তবে তার আরও একটা দায়িত্ব আজ থেকে যোগ হলো। চেষ্টা করতে হবে যাতে মিতালীকে বাড়ি পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব ইশরাকের নয়, তার হয়।
★★★
গোছানো পড়ার টেবিল। হাতের কাছে কয়েকটা বই-খাতা নিয়ে গোলগাল চেহারা আর মরম রূপে বসে আছে মালিহা। মিতালীকে দেখেই মিষ্টি হাসলো।
মিতালীও হাসলো। প্রথম ধাপেই পড়ায় গেলোনা। মালিহার সাথে ছোট বাচ্চা হলো। গল্প ছন্দে কিছুটা সময় কা*টা*লো। প্রথমেই বাচ্চাদের পড়াতে গেলে এরা পড়াতে মনযোগ দিতে চায়না। অনীহা প্রকাশ করে। মে*রে*ধ*রে কিছু শেখানো যায়না। বরং আরো বেঁকে বসে। একটু গল্প করার বা পড়ার শেষে খেলার লো*ভ দেখালে এরা দ্রুত পড়াটা শেষ করতে চায়। মনযোগ ধরে রাখার চেষ্টা করে।
পড়ানোর একপর্যায়ে মিতালীর ষষ্ঠ ইন্দ্রীয় জানান দিলো তাকে কেউ গভীর চোখে পর্যবেক্ষণ করছে। লোকটি যাতে দৃষ্টি এদিকসেদিক করে পার পেয়ে যেতে না পারে সেজন্য নড়াচড়া করলোনা সে। হুট করেই চোখ তুলে তাকালো লোকটির দিকে।
আচমকা মিতালী এভাবে তাকিয়ে যাবে বুঝতে পারেনি ইশরাক। দ্রুত দৃষ্টি স্বাভাবিক করে হাসলো সে। এগিয়ে এসে মালিহার কাঁধে হাত রাখলো।
-“বলোতো আম্মু কেমন লাগছে মিসকে? পড়তে ভালোলাগছে?”
মিতালী দৃষ্টি সরিয়ে নিলো। অস্বস্তি হলো তার। এমন বিব্রতকর পরিস্থিতিতে কেউ না পড়ুক। ইদানীং ইশরাক ভাই তার দিকে অন্যরকম দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে। যেটা মোটেও স্বাভাবিক লাগছে না মিতালীর। মনে হচ্ছে কিছু বলতে চায়। আচ্ছা সে কি সরাসরি প্রশ্ন করবে? যে আপনি আমায় কিছু বলতে চান? কিন্তু তাকে কী -বা বলার থাকতে পারে?
সময় দেখে ইশারাক বলল,
-“চল তোমায় বাড়ি পৌঁছে দিয়ে আসি।”
মিতালী সায় জানালো। আশেপাশে নির্ভীক নেই। তারমানে ইশরাকের সাথেই পৌঁছাতে হবে।
★★★
বাজারের কাজ সেরে দ্রুত বাড়ি ফিরলো নির্ভীক। মিতালীকে পৌঁছে দিতে হবে। কিন্তু তা আর হলো কই? মায়ের মুখে শুনলো একটু আগেই নাকি ইশরাক মিতালীকে পৌঁছে দিতে গেলো।
গোপনে ধপ করে উঠলো নির্ভীক। বাড়ি ছেড়ে ত্রস্তব্যস্ত পায়ে বের হলো।
#চলবে……….
#নিরবতায়_হৃদয়_কোনে
#জিন্নাত_চৌধুরী_হাবিবা
#পর্ব_১৩
বেশিদূর যাওয়া হলোনা মিতালী আর ইশরাকের। কোথা থেকে নির্ভীক এসে টপকালো। নিজের নাম ধরে ডাক পড়ায় পেছন ঘুরে তাকালো মিতালী। ইশরাক চোখেমুখে বিস্ময়বিমূঢ় ভাব ফুটিয়ে বলল,
-“তুই না বাজারে গিয়েছিলি?”
নির্ভীক আগেই ইশরাকের প্রশ্নের জবাব দিলোনা। মিতালীর দিকে ক্রু*দ্ধ দৃষ্টি ফে*লে বলল,
-“বলেছিলাম না কথা আছে তোর সাথে। আমি আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করবি!”
মিতালী ভীষণ আশ্চর্য হলো। নির্ভীকের সাথে তো তার এমন কোন কথাই হয়নি। তাই বলল,
-“কিন্তু তুই তো আমায়….”
এতটুকুতেই থামতে হলো মিতালীকে। নির্ভীক বাঁধা দিয়ে বলল,
-“এখন আর এত কথা বলতে হবেনা।”
অতঃপর ইশরাকের দৃষ্টিতে দৃষ্টি মেলালো। খানিকটা ভারী সুরে বলল,
-“আমি মিতাকে পৌঁছে দিচ্ছি, তুমি বাড়ি চলে যাও। অফিস করে নিশ্চয়ই অনেক ক্লান্ত তুমি।”
ইশরাক কিয়দংশ সময় নিমেষহীন তাকিয়ে রইলো নির্ভীকের শক্ত ভাঁজে লুকিয়ে রাখা একজোড়া চঞ্চল চোখে। অতঃপর ঠোঁট বেঁকিয়ে হাসলো। যার অর্থ বা মর্ম উপলব্ধি করতে পারলোনা নির্ভীক। ইশরাক সামনে ইশারা করে বলল,
-“চল, দুজনে গিয়েই দিয়ে আসি। আর আমি ঠিক আছি, ক্লান্তি বোধ হারিয়ে সেই কবেই সতেজতা ফিরে এসেছে।”
কথাটি বলতে গিয়ে আড়চোখে মিতালীকে দেখলো।
নির্ভীক কথা বাড়ালোনা। মিতালীকে পৌঁছে দিলো দুজন।
★★★
টিমটিমে চাঁদের আলোয় যখন মিতালীকে পৌঁছে দিয়ে দু’ভাই রাস্তায় নামলো, পায়ে পা মিলিয়ে সমানতালে হেঁটে চললো, তখন ইশারাকই আগে কথা বলল,
-“মিতালীকে ভালোবাসিস?”
চমকানোর কথা থাকলেও চমকালো না নির্ভীক। এটুকু সত্য যেন সবার জানা উচিত।
-“বুঝতে পেরেও তুমি পিছু নিয়েছো?”
ইশারাক জবাব না দিয়ে পাল্টা প্রশ্ন ছুঁ*ড়*লো,
-“সে ও কি তোকে ভালোবাসে? বলেছে কখনো?”
নির্ভীক হুট করেই থেমে গেলো। নিভে গেলো তার গম্ভীর ভাব, চোখজোড়া নিভু নিভু হয়ে আসলো।
ইশরাক তা দেখে হাসলো। বলল,
-“তোর মতো তুই চেষ্টা করে যা। আমি তোকে বাঁধা দেবোনা। দেখি এই ল*ড়া*ই*য়ে কার জয় হয়।”
এরপর দুদিকেই নিরবতা চললো। কেউ কোনো কথা বললোনা। মূলত নির্ভীক কথা বাড়াতে চাইলোনা। দু’ভাইয়ের মাঝে ঝা*মে*লা বাঁধিয়ে পরিবারে অ*শা*ন্তি বাড়াতে চাইছেনা সে।
★★★
দুদিন পরের ঘটনা। ভোরের আবছা আলো কে*টে গিয়ে সূর্যের আগমন। ঘাসের উপর হালকা শিশির বিন্দু রৌদ্রজ্জ্বল ছোঁযায় ঝলমল করে উঠছে। ফজরের নামায পড়ে কিছুক্ষণ তসবিহ জপছিলেন রোজী বেগম। বেশিক্ষণ বসলেন না, দুটো মেয়েই একটুপর বেরিয়ে পড়বে। তাদের নাস্তার ব্যবস্থায় উঠে পড়লেন।
মিতালী বাড়ি থেকে বের হওয়ার পূর্বে বাবাকে দেখতে গেলো। শরীর পূর্বের তুলনায় আরো দুর্বল হয়ে গিয়েছে। গতমাসে একহাজার টাকার ঔষধ এনে দিয়েছিলো মাত্র দশদিনের। তখন খানিকটা সুস্থ বোধ করলেও এখন পূর্বের তুলনায় একটু বেশিই অসুস্থ। বাবা চোখ খুললেন না। রোধ হয়ে আসা হাত-পা গুলো নিজে নিজে নাড়ানোর চেষ্টা করছেন। বলা যায় ব্যায়াম, যাতে একেবারেই অবস না হয়ে যান। তাহলে যে তাকে নড়াচড়া করতে স্ত্রী আর মেয়েদের কষ্ট হয়ে যাবে। মিতালী বাবাকে দেখে নিঃশব্দে প্রস্থান করলো। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ভাবলো ‘তার যদি কাড়াকাড়ি টাকা থাকতো তবে, আব্বাকে সে কোনো ভালো ডাক্তার দেখাতে পারতো।’
প্রতিটি নিন্মবিত্ত আর মধ্যবিত্তের একটাই দীর্ঘশ্বাস। আর সেটা হচ্ছে টাকা।
★★★
আজও মিতালীর গতিপথে রিকশা এসে থামলো। সে উঠলোনা রিকশায়। আজ কিছু কড়া কথা বলার পালা। এভাবে রোজ রোজ লোকসমাজে তাকে হে*ন*স্তা করার জবাব নেবে সে। পাশে মাহা ও ছিলো। মিতালী তার হাত ধরে সামনে এগোলো। ইশরাক রিকশা থেকে নেমে সে ও ওদের পেছন পেছন আসলো।
জনাকীর্ণহীর্ণ সরু রাস্তার পাশ ঘেঁষে হাঁটতে গিয়েও পা জোড়া থামিয়ে নিলো মিতালী। আশেপাশে লোকসমাগম নেই। এটাই কথা বলার মোক্ষম সুযোগ। মিতালীকে থেমে যেতে দেখে ইশরাক বলল,
-“রিকশায় উঠলেনা যে?”
মিতালীর চোয়াল খানা শক্ত হয়ে আসলো। মরম রূপ ভাটা পড়লো কঠিন খোলসের আড়ালে। শান্ত রূপে কঠিন হলো সে। দৃঢ় কন্ঠে বলল,
-“কেন রোজ রোজ আমি ভাড়া ছাড়া রিকশায় উঠবো? যখন আমার মনে হবে আমার কাছে পর্যাপ্ত টাকা আছে, আমি রিকশায় চড়ে যেতে পারবো। তখন আমি নিজ থেকেই উঠবো।”
ইশরাক ডান ভ্রু খানিক কুঁচকে নিলো। রাশভারি গলায় শুধালো,
-“তোমার ভাড়া দেওয়ার প্রয়োজন তো পড়ছেনা।”
এতক্ষণ যাবত ঠান্ডা মস্তিস্কে বাক্যালাপ চললেও এ পর্যায়ে তেতে উঠলো মিতালী। খানিক জোরালো কন্ঠে বলল,
-“আমরা আত্মসম্মান চিনি। আর নিজেদের আত্মসম্মান আছে বলেও মনে করি। এতটুকু জ্ঞান আমাদের আছে যে, কে আমাদের কতটা পছন্দ করে। আমরা ও তাকে ঠিক ততটাই সম্মান দিতে জানি। শুধু শুধু তাকে বিরক্ত করিনা।”
কথার তীরটা যে সরাসরি ইশরাককেই ইশারা করলো সেটা সে হয়তো কিছুটা আঁচ করতে পেরেছে। তাই নিঃসংকোচ প্রশ্ন ছুঁড়লো,
-“কাউকে পছন্দ করা কি অপরাধ?”
মিতালী কাঠকাঠ গলায় জবাব দিলো,
-“পছন্দ করা অপরাধ নয়, কিন্তু তার অপছন্দীয় কাজগুলো করা অপরাধ।
আশাকরি আমাদের পিছু পিছু আপনাকে আর দেখতে পাবোনা।”
কথাটি বলেই মাহার হাত চেপে পা বাড়ালো মিতালী। চোখের কোন জলে চিকচিক করছে মাহার। সে এতটুকু আজ নিশ্চিত হলো যে ইশরাক ভাই আপুকে পছন্দ করে। এজন্যই বুঝি এতদিন তার সাথে ভাব জমিয়েছে? ছলেবলে কৌশলে কিভাবে আপুর কথা জিজ্ঞেস করতো, তা ও মনে পড়ে গেলো। সে চোখের জল গড়াতে দিলেনা, তার পূর্বেই স্কার্ফের কোনা দিয়ে সন্তর্পণে মুছে নিলো চোখের কোন।
ইশরাক হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। কী হলো ঠিক বুঝলোনা। মিতালী কি কোনোভাবে বিয়ের পূর্বের দুজনের সন্ধিটাকে ভ’য় পাচ্ছে? তবে সে যথাযথ ব্যবস্থা নেবে।
★★★
আজ মালিহাকে পড়াতে এসেই মিতালী চেয়ারম্যান চাচার খোঁজ করলো। তিনি বাড়ি ছিলেন না বিধায় মালিহাকে পড়িয়ে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলো। নির্ভীক ও এসে পড়লো মিতালীকে পৌঁছে দিতে। চেয়ারম্যান সাহেব স্ত্রীর কাছে জরুরি তলব শুনে মিতালীর মুখোমুখি বসলেন।
-“বলো মিতালী, কী বলতে চাও?”
শ্বাস নিয়ে স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করলো মিতালী। সরল গলায় বলল,
-“আব্বা আমায় নিয়ে দু*শ্চি*ন্তা*য় থাকেন। সন্ধ্যার পর কখনো বাড়ির বাইরে থাকিনি তো। তাছাড়া সকালে বেরিয়ে সন্ধ্যা ছুঁইছুঁই সময়ে বাড়ি ফিরি। তারপরই এখানে আসতে হয়। আমি পরিবারকে সময় দিতে পারিনা। আব্বা – মা চাইছেন না আমি সন্ধ্যার পর কোথাও পড়াই। ক্ষ*মা করবেন আমায়। আপনারা আমার বি*প*দে অনেক সহযোগিতা করেছেন, কিন্তু বাবা – মায়ের অবাধ্য হয়ে আমি মালিহাকে পড়াতে পারছিনা।”
নির্ভীকের মনে লাড্ডু ফোটে। এতদিনে মেয়েটা একটা সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তার ইচ্ছে হলো একবার মিতালীকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরতে। বুকের বাঁ পাশে চেপে ধরে বলতে ইচ্ছে করলো ‘শুনতে পাচ্ছিস? তোর সিদ্ধান্তে খুশি হয়ে আমার বুকের লাব ডাব বেড়ে গিয়েছে’।
চেয়ারম্যান সাহেবের চোয়ালে আঁধার নামলো। তিনি বেশ অসন্তুষ্ট গলায় বললেন,
-“সে কি কথা মিতালী? এতটা অনুনয় করে বললাম তোমায়, তাছাড়া মালিহাকে ও দেখছি তোমার সাথে বেশ মিলেমিশে পড়াশোনা করছে। এখন তুমি এ কথা বললে কি চলে?”
-“আমি দুঃখিত চাচা। কিন্তু এ ছাড়া আমার উপায় নেই।”
মিতালীকে বাঁচাতে নির্ভীক বলল,
-“মালিহা কে না হয় আমিই পড়াবো এখন থেকে।”
চেয়ারম্যান সাহেব বললেন,
-“এতদিন পড়াতে পারিসনি, এখন পারবি? ও পড়বে তোর কাছে?”
অতঃপর মিতালীর উদ্দেশ্য বলল,
-“তোমার রাতে পড়াতে সমস্যা তো? তাহলে দিনে পড়িয়ে দিও।”
মিতালী ইতস্ততভাবে কিছু বলতে চাইছে, কিন্তু পারছেনা। অনবরত দু’হাত কচলে চলেছে।
সেটা লক্ষ করে চেয়ারম্যান সাহেব তীক্ষ্ণ চাহনি ফে*লে বললেন,
-“দিনের বেলা ও সমস্যা?”
মিতালী লজ্জায় আর জবাব দিতে পারলোনা। তার তো সকাল থেকেই সময় নেই। সামনেই বছর শেষে সবার পরীক্ষা আসছে। কোন স্টুডেন্টের মা – বাবাই শিক্ষক ছাড়তে চাইবেন না। আর না সে দিনে মালিহাকে পড়াতে পারবে।
মিতালীকে নতমস্তকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে চেয়ারম্যান সাহেব বিরস মুখে জবাব দিলেন,
-“আচ্ছা বেশ।”
মিতালী সালাম জানিয়ে বেরিয়ে পড়লো। মালিহাকে পড়াতে তার ভালোই লাগে। তাকে পড়ানো বাদ দিয়েছে বাধ্য হয়ে। তার একমাত্র কারণ ইশরাক। তার চোখের দৃষ্টি খুব ভালো কিছু বলছেনা। এভাবে তার দিকে গভীর দৃষ্টি ফেলা কারো নজরে পড়ে গেলেই সর্ন*নাশ। সবাই হয়তো তার দোষই চোখে দেখবে। গ্রামাঞ্চলে মেয়েদের দো*ষই ধরা হয় বেশিরভাগ সময়। কেউ ইশরাকের দো*ষ দেবেনা। সবাই মিতালীর চরিত্রে আঙ্গুল তুলবে। সবার মুখেমুখে রটে যাবে ‘টাকার লো*ভে চেয়ারম্যানের ছেলেকে হাত করেছে।’
কেননা মিতালীদের অবস্থা খুব একটা ভালো নয়। হাজার দু’য়েক টাকার জন্য আত্মসম্মানে সে দা*গ লাগতে দেবেনা।
নির্ভীক পেছন থেকে প্রফুল্লচিত্তে শুধালো,
-“চল আইসক্রিম খাই।”
মিতালী বাঁধ সাধলো।
-“এখন ঠান্ডার প্রকোপ ধীরে ধীরে বাড়ছে। আইসক্রিম খাবোনা।”
নির্ভীক বাঁধা মানলোনা। তাকে দাঁড় করিয়ে দুটো আইসক্রিম নিয়ে এলো দোকান থেকে।
★★★
রাতে বাবার সাথে আলাদা ঘরে বসলো ইশরাক। কিছু সময় থম ধরে পড়ে রইলো। এরপরই ঠাস করে বলে দিলো,
-“আমি মিতালীকে বিয়ে করতে চাই।”
চেয়ারম্যান সাহেব বিস্ফোরিত চোখে তাকালেন।
#চলবে…….