নিরাপদ_ঘর,দ্বিতীয় পর্ব

0
633

#নিরাপদ_ঘর,দ্বিতীয় পর্ব

১.
আমি বড় মেডামের রুমের দরজায় এসে দাঁড়ালাম। দেখলাম মেডাম দরজার দিকেই তাকিয়ে আছেন। আমাকে দেখে বললেন ” ভেতরে এসো!”

আমি গুটি গুটি পায়ে ভেতরে যাচ্ছি। বড় মেডামের রুমটা বেশ বড়। সরকারি স্কুলগুলোতে সাধারণত প্রধান শিক্ষকের রুমগুলো যেমন হয়। আর এর আগেও এক দুইবার আমি এই রুমে এসেছি, বিভিন্ন ইভেন্টে জাতীয় পর্যায়ের পুরষ্কার পেয়ে মেডাম দেখাতে। এতো কুণ্ঠা আর লজ্জা নিয়ে এভাবে এর আগে কখনো আসি নি। তাই রুমে আর কে কে আছেন প্রথমে আমি ঠিক বুঝতে পারিনি।

আমি কিছুটা ঢুকে একপাশে দাঁড়িয়ে গেলাম, দেখি আব্বু বসে আছে মেডামের সামনে একটা চেয়ারে। আর মেডামের বাম পাশের চেয়ারটিতে বসে আছেন আমাদের ইংরেজি শিক্ষক জহির স্যার। আব্বুকে এখানে দেখে আমি খুব অবাক হলাম।

বুঝলাম আব্বু আজ অফিসে না গিয়ে স্কুলে এসেছে অথবা লাঞ্চ টাইমের ছুটিতে বাসায় না গিয়ে স্কুলে এসেছে।

যার সন্তান এই স্কুলের ষষ্ঠ শ্রেণির ভর্তি পরীক্ষায় সমস্ত জেলায় প্রথম হয়ে এই স্কুলে ভর্তি হয়েছে, সেই সন্তান ইংরেজিতে ৩৮ পেলে এই বাবা কেন মেনে নেবে! আমি বুঝলাম আমার ভুলটা কোথায় অথবা আমার কোন সমস্যার জন্য আমি এতোটা খারাপ করলাম তা আমার আব্বু অবশ্যই জানবে। আর সেজন্যই আব্বু এখানে।

কিছু মুহূর্তের তীব্র নিরবতা ভঙ্গ করে বড় মেডাম গমগমে গলায় আমাকে উদ্দেশ্য করে বললেন–

“রোল ৪ তুমি দ্বিতীয় সাময়িক পরীক্ষায় ইংরেজিতে ৩৮ পেয়েছো? তোমার মতো ছাত্রীর কাছে প্রতিষ্ঠান তো এটা আশা করতে পারে না। তার উপর তোমার বাবা খাতা দেখতে চাচ্ছেন। তুমি কি খাতা দেখোনি কাল?”

আমি বললাম “মেডাম দেখেছি।”

মেডাম এবার বললেন – ” তাহলে তোমার বাবাকে বুঝিয়ে বলো কি তোমার ভুল হয়েছে। তোমার মতো নবম শ্রেণির একটা মেয়ে নিজের খাতা দেখার পর আবার কেনো গার্ডিয়ানের খাতা দেখতে হবে। আমার স্কুলে এই নিয়ম নাই। ছাত্রী খাতা দেখবে, একবার নাহলে আবার দেখবে কিন্তু গার্ডিয়ানকে খাতা দেখানো হবে না তা সে যেই হোক না কেন।” ( শেষের লাইনটা মেডাম বেশ ঝাঁঝের সাথেই বললেন। আর মেডামকেও ব্যক্তিগতভাবে আমরা ছাত্রীরা বেশ ভয় করতাম।)

আমার আব্বু বললেন শক্ত গলায় “নিশ্চয়ই কোন পদ্ধতি আছে খাতা দেখার, সেটা আমাকে বলুন মেডাম । যদি কোন ফর্ম পূরণ করতে হয়, কোন অঙ্গীকার নামায় সই করতে হয় বা কোন দরখাস্ত জমা দিতে হয়, যা যা করতে হয় আমি করবো, কিন্তু প্লিজ ওর ইংরেজি খাতা আমি আজকে দেখবই। ”

২.

আমি কতক্ষণ দাঁড়ানো ছিলাম জানি না। রুমের লোকগুলো হয়তো ভুলেই গেছে আমি সেখানে আছি।
ইংরেজি স্যার কিছুতেই খাতা দেখাবেন না, বড় মেডাম স্যারের পক্ষেই সাফাই গাইছেন আর সব দোষ আমার। আমি গান, কবিতা, বিভিন্ন জাতীয় ইভেন্টে অংশগ্রহণ করে পড়াশোনায় অমনোযোগী হয়ে যাচ্ছি এধরনের কথাও স্যার এক ফাঁকে বললেন।

কিন্তু সব কথার জালে জড়ালেও আব্বুর এক কথা আমার খাতা না দেখে আজকে, আব্বু যাবেই না স্কুল থেকে।

বড় মেডাম স্কুলের বিভিন্ন সিনিয়র স্যার মেডামদের একে একে ডাকতে লাগলেন, উনাদের মতামতের জন্য। কারণ জহির স্যার আমার খাতা দেখাবেন, মানা করে উনার ক্লাস আছে একথা বলে উঠে চলে গেছেন এক ফাঁকে।

আমার আব্বুর খাতা দেখাতেই হবে যেভাবে হোক এই জেদের সামনে বড় মেডাম একটু নমনীয় হয়েছেন।

সিনিয়র স্যার মেডামদের সিদ্ধান্ত হলো খাতা দেখানো হবে, আব্বুকে এজন্য বড় মেডাম বরাবর একটা দরখাস্ত জমা দিতে হবে, তবে নাম্বার বাড়ানো হবে না।
এ শর্তে রাজি হলে একজন সিনিয়র স্যার ও মেডাম বললেন উনারা জহির স্যারকে বলে খাতা দেখার ব্যবস্হা করে দিবেন।

আব্বু বড় মেডাম বরাবর দরখাস্ত তখনই জমা দিলেন।
জহির স্যার খুব বিরক্ত হয়ে আমার খাতা বের করে দিলেন, কিন্তু তিনি চেয়ারে বসলেন না, বাকি খাতার বান্ডেল টেবিলে রেখে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে রইলেন। তাঁর চোখে মুখে তখন রাগ আর জেদ স্পষ্ট।

৩.

আব্বু খাতাটা উল্টেপাল্টে দেখে বললেন ” স্যার আমার মেয়ের গ্রামার ৩০টাই হয়েছে সে গ্রামারে ৩০ এ ৩০ পেয়েছে। আর বাকি ৭০ এ মাত্র ৮…?? যেই মেয়ে গ্রামারে এতো ভালো সেই মেয়েকে রচনায় দিয়েছেন ২০ এ ২, এপ্লিকেশনে দিয়েছেন ৩…? আমি তো বুঝতেই পারছিনা এতো কম নাম্বার কেনো?”

জহির স্যার বললেন – ” আপনি নিজেই মেয়েকে পড়ান! এখন কি আর আগের দিনের নিয়মে পড়ালে হবে? সব কিছুর নিয়ম পরিবর্তন হয়েছে। আপনার মেয়ের দরখাস্ত লেখার নিয়ম ভুল, ২ দিয়েছি শুধু পাশ করানোর জন্য। আর রচনা? সবাই লিখছে পপি গাইড থেকে হুবহু আর সে এসব রচনা কোনখান থেকে লিখছে? এজন্য হুবহু না লিখায় কম নাম্বার পাইছে!”

আব্বু খুব অবাক হয়ে বললো “পপি গাইড থেকে হুবহু রচনা শিখতে আমি আমার মেয়েকে মানা করেছি। আমি বেশকিছু গ্রামার বই ঘেটে ওকে নোট করে পড়াই।”

স্যার বললেন – “এভাবে আমার কথামতো না লিখলে আমি নাম্বার দিবো না।”

আব্বু বললো – “ঠিক আছে স্যার আমি খাতা দেখলাম আপনাকে ধন্যবাদ, পরে আপনার সাথে বাইরে একদিন কথা বলবো।”

একথা বলে আব্বু স্কুল থেকে চলে আসলো।

৪.

এরপর থেকে বাসায় এক গুমোট পরিবেশে আমি অপরাধীর মতো দিন কাটাচ্ছিলাম। সেদিনের পর আব্বু আমাকে তেমন কিছুই আর বলেনি, কিন্তু একটু এদিক সেদিক হলেই আম্মু খুবই বকাঝকা করতো। তাই সবসময়ই একটা মন খারাপ, অপরাধী মানসিকতা নিয়ে আমার দিন কাটছিলো।

পরের সপ্তাহে শুক্রবার ঘটলো এক ঘটনা।

জহির স্যার আমাদের স্কুলে নতুন এসেছিলেন শহরের অন্য একটা স্কুল থেকেই। আর তিনি নাকি আমাদের পাড়াতেই থাকতেন।

আব্বুর সাথে সেদিন জুম্মার নামাজে স্যারের দেখা হয়ে যায় আমাদের পাড়ার মসজিদে। আব্বু স্যারকে সালাম দিলে স্যার এগিয়ে এসে কুশল বিনিময় করার পর আমার কথা তোলেন।

তিনি আব্বুকে বলেন আমাকে তাঁর কাছে প্রাইভেট পড়ার জন্য তার বাসায় পাঠাতে। আমাদের ক্লাসের অনেকেই নাকি উনার কাছে পড়ে এবারের দ্বিতীয় সাময়িক পরীক্ষায় বেশ ভালো নম্বর পেয়ে মেধাতালিকায় অনেকটাই এগিয়ে গেছে। আমিও যদি পড়ি তাহলে উনি আমার দিকে আলাদা নজর রাখবেন, আলাদাভাবে আমাকে গাইড করবেন।

যাক অবশেষে আমার বাবা মা যেভাবেই জানুক না কেন আসল ঘটনাটা জানতে পারলো। যেটা আমি গত এক সপ্তাহ ধরেই বলতে চাচ্ছিলাম, কিন্তু কোনভাবেই তাদের বলতে পারছিলাম না।

আমার ঘর থেকে আব্বুর সব কথা শুনে আমি আব্বু আম্মুর রুমে গেলাম। আব্বুকে বললাম ” স্যার স্কুলেও আমাকে বলেছেন যেন উনার কাছে পড়তে যাই, কিন্তু ভয়ে আমি কথাটা তোমাদের বলতে পারছিলাম না।”

আব্বু তখন বললো – ” মা কোন সমস্যা নাই, আমি তো বিষয়টা জানি, তোমার অন্যান্য স্যারদের সাথেও আমার পরিচয় আছে। দেখি উনাদের সাথে কথা বলে কি করা যায়। তবে তোমাকে আমি জহির স্যারের কাছে পড়াবো না, আমি স্কুলের ভালো ফলাফল চাই না আমি চাই বোর্ড পরীক্ষায় তুমি চমৎকার একটা রেজাল্ট করে সবাইকে দেখিয়ে দিবে।”

আব্বুর আশ্বাস পেয়ে সেদিনের পর থেকে আমার গুমোট দিনগুলো যেনো কিছুটা খোলা বাতাসের স্বাদ পেলো।

তারপরও একটা চিন্তা আমার ছোট্ট মাথায় ঘুরছিলো,
স্যারের কাছে প্রাইভেট না পড়লে তো এতো কম নাম্বার পেয়ে আমার রোল পিছিয়ে যাবে, আমি কি পারবো সামনের পরিস্থিতির সাথে নিজেকে খাপ খাওয়াতে?

সেদিনের সেই ছোট্ট মাথায় অনেক বড় চাপ অনুভব করছিলাম সেদিন।

(চলবে………)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here