নিরাপদ_ঘর,প্রথম পর্ব

0
1174

#নিরাপদ_ঘর,প্রথম পর্ব

১.
সেদিন নবম শ্রেণির দ্বিতীয় সাময়িক পরীক্ষার কিছু নম্বরের ফলাফল হাতে পেলাম, সব বিষয়ে ভালো নম্বর পেলেও ইংরেজিতে ৩৮ নম্বর পেয়েছি!! আমার আজও মনে আছে আমার মনের অবস্থা তখন কি বা কেমন হয়েছিলো!

একে তো আমি ক্লাসের প্রথম সারির ছাত্রী, রোল ৪!
তার উপর অংক আর ইংরেজিতে আমি বরাবরই ভালো। ইংরেজি, অংক আর বিজ্ঞানটা তখনো পড়ি আমার আব্বুর কাছেই। বাংলা, সমাজ, ধর্ম এই বিষয়গুলো আম্মু পড়াতো।

আমার এটুকু জীবনে ইংরেজিতে এতো খারাপ নম্বর আমি কখনো পাইনি। ৩৮ আমি কিভাবে পেলাম নিজেও কিছু বুঝতে পারলাম না খাতাটা হাতে নিয়ে।

আমার মনে হলো আমার পা থেকে মাথা পর্যন্ত কারেন্ট খেলে গেলো। অসম্ভব ঘামছি, এক ভয়াবহ অস্হিরতা কাজ করছিলো আমার মনে। ভাবছিলাম এই নাম্বারটা বাসায় কিভাবে নিয়ে যাবো? আম্মু তো খুব মারবে আর আব্বু খুব কষ্ট পাবে, কারণটা শুরুতেই বলেছি ইংরেজিটা পড়েছি আমি সবসময়ই আমার আব্বুর কাছে!!

২.

বাসায় এসে যথারীতি সব কাজে অস্বস্তি কাজ করছিলো, খেতে পারিনি দুপুরে কিছুই। অপেক্ষায় ছিলাম আব্বু কখন বাসায় ফিরবে। এরই মধ্যে আম্মুও জানতে চাইলো আজ কোন পরীক্ষার খাতা দেখিয়েছে কিনা কোনটাতে কত পেলাম??

হয়তো আমার অস্বস্তি আর অস্হিরতা আম্মুর চোখ এড়ায়নি। আম্মু বুঝে নিয়েছিলো আমি কিছু লুকাতে চাচ্ছি।

ইংরেজি ছাড়া সব কটা বিষয়ের নাম্বার আম্মুকে বললাম, আম্মু টুকে রাখলো তাঁর ডায়রিতে। কারণ রেজাল্ট কার্ড বাসায় এলে মিলিয়ে দেখা হবে আমি সব ঠিকঠাক বলেছিলাম কিনা!

সন্ধ্যার পর আব্বু বাসায় ফিরলে নিজের বুকের ধুকধুক শব্দ আমি যেনো নিজের কানে স্পষ্ট শুনতে পেলাম। বুকের ধুকপুকানি তো নয় যেনো কেউ কোদাল চালাচ্ছে বুকের ভিতর। দুই কানে ঝিমঝিম একটা শব্দ যেনো ঝিঁঝিঁ পোকা ডাকছে বিরামহীন।

চা বানিয়ে আব্বুর সামনে রাখলাম আর আস্তে আস্তে বললাম–
– আজকে আমার ইংরেজি খাতা দেখিয়েছে স্কুলে।
আব্বুও যথারীতি জানতে চাইলেন হাসি মুখে –হুম কতো পেয়েছো?

আমি নিরুত্তর!

আমার কোন উত্তর না পেয়ে আব্বু আমার মুখের দিকে তাকালো। আমার নিঃশব্দে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকায় আব্বু যা বুঝার বুঝে নিলো।

জোরে চিৎকার করে বললো – তুমি ইংরেজিতে ফেল করেছো?? ছি! ছি! ছি!

আমি কেঁপে উঠলাম ভেতর পর্যন্ত। পাশের রুম থেকে আম্মুও এগিয়ে এলো সেই রুমে। আমি তখন নিরবে কাঁদছি আর কাঁপছি, মাথা নিচু তখনো, জোরে জোরে মাথা দু’পাশে নাড়ছি এটা বলার জন্য যে – না আমি ফেল করি নাই….না আমি ফেল করি নাই!

কিন্তু মুখ দিয়ে তখন কোন কথাই বেরুচ্ছিলো না আমার, আর গলার নিচ থেকে ভেতরটা যেনো পানির তৃষ্ণায় শুকিয়ে আসছিলো। বারবার এটাই মনে হচ্ছিলো–”এই মুখ আব্বু আম্মুকে আমি কিভাবে দেখাবো!”

আমরা দুইটা ভাইবোন; আমরা মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান। তখনো আমাদের বাসায় প্রাইভেট টিউটর দেয়া তো দূরের কথা বাসার বাইরে কোন ব্যাচেও আমরা পড়তাম না।
স্কুলের পড়া রোজ আব্বু আম্মু মিলে বাসায় পড়িয়ে দিতো। এভাবেই আব্বু আম্মুর কাছে পড়েই আমি ক্লাস ফাইভে আর আমার ছোট ভাই ক্লাস এইটে স্কলারশিপ পেয়েছি।

এবার আসি মূল ঘটনায়।

আমি অনেক সাহস করে অনেক কষ্টে উচ্চারণ করলাম “৩৮ পেয়েছি…!! ”

আম্মু এমনভাবে হাহাকার করে উঠলো যেনো তাদের জীবনের সব প্রাপ্তি আজ আমি তছনছ করে দিয়েছি।
বারবার আব্বু কে বলতে লাগলো ” দিনরাত এদের জন্য এতো কষ্ট করে আমরা কি পেলাম বলো? এখন মেয়ে তো নাক কাটালো, আমরা তো কাউকে মুখও দেখাতে পারবো না। আরও স্বপ্ন দেখো মেয়েকে সায়েন্স পড়াবে।”

এরপর অনেক মার খেলাম সেদিন আম্মুর হাতে। আম্মু যতোক্ষণ পারলো আমাকে মারলো!
সেদিন রাতে আব্বু বা আম্মু কেউ রাতের খাবার খেতে আমাকে ডাকতেও আসলো না।
ছোট ভাইটা রাতে আমার চোখ মুছিয়ে দিলো। ভাই বোন মিলে একসাথে রাতে ঘুমিয়ে পড়লাম।

৩.

সকালে ঘুম ভাঙলো আব্বুর ডাকে। রোজকার মতো মগ ভর্তি গরম চা বানিয়ে আব্বু আমাকে ডেকে তুললো ঘুম থেকে। চা বিস্কিট খেতে খেতে ক্লাসের পড়াগুলো দেখে দিয়ে বললো খুবই ঠান্ডা গলায়,
(যদিও আমি স্পষ্ট বুঝতে পারছিলাম কতোটা অভিমান কাজ করছিলো তখন আমার উপর।)

–” আমি হয়তো তোমাকে ঠিকঠাক পড়াতে পারছিনা। দেখি আগামী মাস থেকে তোমার জন্য একজন টিউটর রেখে দিবো। উনি বাসায় এসে তোমাকে পড়াবেন।”

আমি খুবই অনুতপ্ত হয়ে মাথা নিচু করে কথা শুনছিলাম আর কাঁদছিলাম।
আর মনে মনে বলছিলাম –” না না টিউটর দিতে হবে না আমি এখন থেকে আরও মনোযোগী হবো, ভালো করে পড়বো। আর তোমাদের লজ্জার কারণ হবো না।”

কথাগুলো মনেই তৈরি হলো আর গলা পর্যন্ত এগুলো না।

তারপর ব্যাগ গুছিয়ে সকাল ৯ টার দিকে স্কুলে যাওয়ার জন্য তৈরি হলাম, আম্মুর সাথে অভিমানে সকাল থেকে একটা কথাও বললাম না।

আম্মু গত রাতে এতো মেরেছে আমাকে মনে খুবই কষ্ট পেয়েছি আমি। মারার আগে তো একবার জানতে চাইলেও পারতো সবসময় ইংরেজিতে ৭৫/৮০ পাওয়া এই আমি ৩৮!! কেনো পেলাম। কি কারণ! আমার সত্যিই খুব অভিমান হলো আম্মুর উপর।

আম্মু তখন ভারী আর রাগী গলায় বললো – ঢং বাদ দিয়ে সোজা টেবিলে আয়, নাস্তা না খেয়ে বাসার বাইরে একটা পা দিলে খুব খারাপ হবে কিন্তু।

চুপচাপ ডায়নিং টেবিলে বসে পড়লাম আর ফুঁপিয়ে কাঁদতে শুরু করলাম। বারবার বলতে চাইলাম

–”আম্মু ইংরেজির জহির স্যারের কাছে প্রাইভেট না পড়লে স্যার বলেছেন নাম্বার দিবে না, ফেল করায় দিবেন, তাই তিনি ফেল করাতে চাচ্ছেন আমাকে।” কথাগুলো বলতে চাচ্ছিলাম কিন্তু বলতে পারছিলাম না।

.…স্কুলের জন্য বেরিয়ে পড়লাম।

তখন আমি ক্লাসে, হয়তো তৃতীয় বা চতুর্থ পিরিয়ড চলছে। স্কুলের একজন আয়া যাকে আমরা আসমা খালা বলে ডাকতাম তিনি সেসময় ক্লাসে এসে বললো

– রোল ৪, তোমাকে বড় মেডাম তার রুমে ডাকছেন।

( চলবে…..)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here