নিরালায় ভালোবাসি-০৫,০৬

0
1231

নিরালায় ভালোবাসি-০৫,০৬
কলমে : তুহিনা পাকিরা
৫ .

তিন সপ্তাহ বাদেই ছিল নীরবের বাইরে যাওয়ার ফ্লাইট। কবে ফিরবে ও জানে না। কয়েক মাস কী বছর ঠিক নেই। অপর দিকে অনুপ বাবু নীরবকে পুনরায় ইচ্ছেকে বিয়ের কথা জানালে নীরব আবারও অসম্মতি জানায়। সেই কথা ইচ্ছের কানে যায়। আসলে ওই দুই পরিবারের সকলের হাতে পায়ে ধরে বলেছিল, ও নীরবকে বড্ড ভালোবাসে। কিন্তু নীরবের এতটা অসম্মতি জেনে, আর এই সবে ইচ্ছের কষ্টের কথা চিন্তা করে পরিবারের সকলে ভালো সম্বন্ধকে আর না করেনি। বিয়ের জন্যে রাজি হয়ে যায়। ইচ্ছের কথা তারা হয়তো অন্য ভাবে ভেবেছিল। নীরবকে মনে করে কষ্ট না পেয়ে নতুন সম্পর্কে জুড়ে দিয়ে ওর মন থেকে নীরবকে সরিয়ে ফেলতে চেয়েছিল। এতে যাইহোক, নতুন জীবনে ইচ্ছে নীরবকে ভুলে যাবে। কিন্তু ইচ্ছের জীবনের সেই সিদ্ধান্ত ওর সারাটা জীবন কে ধ্বংস করে দিয়েছে। ছয়টা মাসের সেই সংসার কেমন ছিল তা বোধহয় ইচ্ছে নিজে বললেও তার সমাপ্তি হবে না।

ইচ্ছেকে ঘরে পাঠিয়ে নীরব রেলিঙে ভর দিয়ে আকাশের তারার ভিড়ে হারিয়ে গেলো। চোখের সামনে ভেসে উঠল কতো শত স্মৃতি। দিনটা ছিল ইচ্ছের বিয়ের দুই সপ্তাহ আগের ঘটনা।

অনুপ বাবুর থেকে নীরব পেয়েছিল ইচ্ছের বিয়ের কিছু দায়িত্ব। যা নিয়ে সে ছিল প্রচণ্ড ব্যস্ত। আর ইচ্ছে, সে করে চলেছিল নীরবকে বোঝানোর চেষ্টা। কিন্তু যতবার বুঝিয়েছে তত বারই বিফল হয়েছে। কিন্তু হাল ছাড়েনি সে। কিন্তু এইবারের চেষ্টাটা হয়তো ইচ্ছের কাছে শেষ চেষ্টাই ছিল। এর পর ইচ্ছে হয়তো চোখ তুলেও অন্তত নীরবের দিকে তাকাতো না। আর সেটাই হয়েছিল। নীরব সেইদিন ডেকোরেশনের জন্যে কাউকে ফোন করেছিল। কথা বলার মাঝেই ইচ্ছে গিয়ে নীরবের বুকে মিশে যায়। থমকে যায় নীরব, ফোনটা ও হাত থেকে নীচে পড়ে যায়। ফোনের ওপাশের ব্যাক্তি ‘হ্যালো’ বলতে বলতে ক্লান্ত হয়ে একসময় ফোনটা কেটে দেয়।

– ” আমি বিয়ে করবো না ওই লোককে। আমি তো তোমাকে ভালোবাসি, বলো। তুমি এইরকম করো না। ওই লোকটা ভালো না। খুব খারাপ, প্লিজ। ”

ইচ্ছের কথায় নীরবের ঘোর কাটে। ইচ্ছের মিথ্যে শুনে কপালের রগ ফুলে উঠে। নিজেকে ওর থেকে ছাড়াতে বেশ কষ্ট করতে হয় ওকে। ইচ্ছে এমন ভাবে ওকে আঁকরে ধরেছিল যেনো ছেড়ে দিলেই হারিয়ে যাবে। সত্যিই হয়তো তাই হয়েছিল। কিন্তু ইচ্ছের ইচ্ছা শক্তির জোরে হয়তো নীরবকে ইচ্ছে পেয়েছে। কিন্তু এখন ইচ্ছে নীরব কেনো কারোর জীবনের সঙ্গেই জড়াতে চায়নি।

– ” তুই আমাকে ভালোবাসিস এই কথাটা কেনো যেনো আমার আজ অবিশ্বাস্য মনে হচ্ছে। তুই তো জোর করে আমাকে পেতে চাইছিস। আর যার জন্যে আজ তুই সুবীরের মতো ছেলের নামে মিথ্যে বললি। তোর আগে আমাদের সবার ওর সাথে কথা হয়েছে। ও কেমন তা আমরা বুঝেছি। সরি ভুল বললাম, তুই তো ওর সঙ্গে আজ দেখা করতেই যাসনি। তুই তো তোর ওই বান্ধবীর বাড়িতে কাটিয়ে এই সবে বাড়িতে আসলি। তাও নিজের বাড়ি না, আমাদের বাড়ি। ”

নীরব কী করে ইচ্ছের মিথ্যে ধরলো ইচ্ছে জানে না। সত্যিই ইচ্ছে সুবীরের সঙ্গে দেখা করতে যাইনি। ওর এক বন্ধুর বাড়িতে বসে দুই বন্ধু মিলে এতক্ষণ ঠিক করেছে কী করে নীরবকে বোঝাবে। কিন্তু নীরব জেনে যাওয়ায় ইচ্ছে বেশ লজ্জিত হয়। এই মানুষটাকে ও কোনোদিন মিথ্যে বলেনি। নীরবকে ও জ্বালিয়েছে, বকেছে, ঝগড়া করেছে কিন্তু মিথ্যা বলেনি। আজ বলতে হলো। সেই মানুষটার জন্যেই বলতে হলো। যেনো ওকে হারিয়ে না ফেলে।

– ” সরি, আমি মিথ্যে বলতে চাইনি। আমি ওনার সঙ্গে দেখা করতে যাইনি। কিন্তু আমি তোমাকে ভালোবাসি। আর এটা শত ভাগ সত্য। ”

ইচ্ছের কথা শুনে নীরব শান্ত চোখে ওর দিকে তাকালো। ইচ্ছের চোখ দিয়ে তখন ঝরে চলেছে মুক্তোর মতো জলের বিন্দু। কিন্তু নীরবের কিছুক্ষণ আগের মতো এবারেও মনে হলো ইচ্ছে নাটক করছে। বেশ শক্ত করে ইচ্ছের হাত খানা ধরলো,

– ” চল আমি তোকে বিয়ে করবো। ”
ইচ্ছের মুখে হাসি ফুটে উঠলো। নীরব কি সত্যি বললো? এই মুহূর্তে ওর হাতে চিমটি কেটে দেখতে ইচ্ছে করছে, ঠিক শুনলো তো। নাকি স্বপ্ন দেখলো।

ইচ্ছের মুখের এক চিলতে হাসি পর্যবেক্ষণ করে নীরব বলে উঠলো, ” একটা কথা সারাজীবন মাথায় রাখিস, তুই আমাকে জোর করে নিজের করতে চাইছিস। এর পর তো আমি তোর মুখ দেখতেও চাইবো না। তুই কি সত্যিই এতটা খারাপ ইচ্ছে? ”

এক চিলতে রোদের মাঝে হঠাৎই যেমন এক পশলা বৃষ্টি এসে আকাশ মেঘলা করে দেয়, তেমনই ইচ্ছের মুখে নেমে এলো ঘোর অন্ধকার।

– ” চল ইচ্ছে সবাই কে বলি আমি তোকে বিয়ে করবো। তোকে তো বিশ্বাস হচ্ছে না। হয়তো দেখা যাবে সুবীরের সাথে বিয়ের পর দিনই না তুই ওর নামে কোনো লেম এক্সকিউজ দিয়ে ডিভোর্স চেয়ে বসিস।”

নীরবের দিকে একবার তাকিয়ে খুব সাবধানে নিজের হাতটা ছাড়িয়ে মাথা নীচু করে দাঁড়ালো ইচ্ছে। নিজেকে ওর অপরাধী মনে হলো। বহু কষ্টে নিজের শ্বাসের গতি কমিয়ে বললো, ” চিন্তা করো না আমি খুব ভালো একটা সংসার পাতবো। তোমাদের পছন্দের পাত্রের সঙ্গে। আর দেখো খুব সুখী হবো। যে তোমরাই বলবে নজর না লাগে তোদের সম্পর্কে। ”

দীর্ঘশ্বাস ফেলে নীরব। ইচ্ছের মুখে শোনা শেষ কটা শব্দ। আর কোনো কথা বলেনি ও। তারপরের সপ্তাহে বিয়ের পর ইচ্ছে যখন সুবীরের বাড়ি যাচ্ছিল, নীরবের দিকে একবার তাকিয়ে হাত জোর করে প্রণাম করেছিল। সেই দিনই শেষ ওদের দেখা। তারপর কাল ওদের বিয়েতে নীরব ওকে সেইদিনের পর প্রথম দেখলো। কিন্তু এই ইচ্ছে নীরবের কাছে অজানা। ইচ্ছের মাঝে কিছু একটা কমতি নীরব লক্ষ্য করেছে এই দুইদিন। শুধু কি বিয়ের জন্যে নাকি অন্য কারণ, কে জানে!

{ এতক্ষণ অতীত ছিল। এবারের বর্তমানের মাটিতে পদার্পণ করলো নীরব }

– ” বাবা তুমি তো জানো আমি ওকে কখনোই ভালোবাসিনি। ও হয়তো আমার ভাগ্যে ছিল, তাই না? তাই হয়তো ওর জীবন টা নতুন রূপে আমার সাথে জুড়ে গেছে। আমি জানি না ওকে কখনও ভালোবাসতে পারবো কিনা! তবে আমি চেষ্টা করবো ওকে ভালোবাসার। জানোতো ধীর আগের দিন অনুপ কাকুকে বলছিল, আমি নাকি ইচ্ছেকে কষ্ট দেবো। আরেকবার যেন ভেবে দেখা হয়। বাবা তুমি দেখো আমি আমার দিক থেকে খুব চেষ্টা করবো। ইচ্ছেকে খুব ভালো রাখবো। ওর কোনো কষ্ট হবে না। ওকে আমি ভালো রাখবই। এটা আমার প্রমিশ। বিয়ে যখন হয়েছে ও আমার স্ত্রী , ও আমার দায়িত্ব। তবে সব শেষে ও ভালোবাসা আমার অবশ্যই হবে। কিন্তু আমি তো ওর মায়ায় পড়তে এখনও পারিনি। জানিনা ভবিষ্যতে কি হবে। তবে যা হবে তাতে আমরা দুইজনে একসঙ্গে থাকবো, ভালো থাকবো আমরা খুব সুখী হবো দেখো।”

মনের মধ্যে জমে থাকা কথা গুলো নীরব আকাশের তারার দিকে তাকিয়ে বললো। নীরবের ছোটো থেকে বিশ্বাস ওর বাবা ওর সঙ্গে সবসময় আছে। তিনিই ওকে সঠিক পথ নির্ণয়ে সহযোগিতা করবেন। এখন এতো কথা বলতেই মনটা ওর ফ্রেশ হয়ে গেলো।
————————

নীরবের বলা মতো ঠিক জায়গায় ইচ্ছে শুয়েছে। নীরব ওর পাশে গিয়ে শুয়ে পড়ল। ইচ্ছে এতক্ষণে ঘুমে কাঁদা। ইচ্ছের গায়ে ভালো মতো কম্বলটা জড়িয়ে অপর প্রান্ত নিজের গায়ে টেনে নিলো নীরব। মুখে বিড়বিড় করে বলে উঠলো, ” জীবনে আমাকে কতো কী করতে হচ্ছে। প্রথমে তো ওর সঙ্গে বিয়ে এখন আবার একই কম্বল শেয়ার করতে হচ্ছে। তবে যাইহোক তুই আমার বউ। ”

চোখ বন্ধ করলো নীরব। হঠাৎই যেনো সৃষ্টিকর্তা ওর উদ্দেশ্যে ধ্বনিত করলো,

–” তো তোর কেমন মেয়ে পছন্দ রে নীরব?”

নীরবে হাসলো নীরব। চোখ বন্ধ করে সুন্দর এক হাসি হাসলো। সৃষ্টিকর্তার প্রশ্নে যেনো সে খুব খুশি। অবশেষে কেউ তো ওর মনের কথা জানতে চাইলো।

নী : “যে মেয়ে আয়না না দেখে সোজা টিপ পড়তে পারে।”

সৃ : এই ভাবনা কোথা থেকে মস্তিষ্কগত করলি?

নী : একটা কবিতায় এই লাইনটা আমার খুব ভালো লেগেছিল। সেই থেকেই আমার এটা প্রিয় লাইন। আর কখন যেনো প্রিয় মানুষের মধ্যে এই ব্যাক্তিত্ব আমি কামনা করি কে জানে। তবে সবার সব ইচ্ছে তো পুরন হয় না। তবে আমার ইচ্ছে পূরণ না হলেও ইচ্ছেকে পেয়েছি।

সৃ : আমি তোর জন্যে ভালো কিছুই রেখেছি। তোর জীবনসঙ্গী হয়তো তোর মনের মতোই।

নী : ধুর।

সৃষ্টিকর্তা চুপ করে গেছে। চোখ খোলে নীরব। কিছু ভুলে গিয়েছিল। আলো জ্বললে ওর ঘুম হয় না। হঠাৎই চোখ খুলে তাকাতেই চোখে আলো পড়তে চোখ জ্বালা করলো ওর। ইচ্ছে বিছানার শেষ প্রান্তে শুয়ে রয়েছে। নীরব হাত বাড়িয়ে একদম ওর পাশে টেনে আনলো। ইচ্ছেও পুতুলের মতো নীরবের গা ঘেঁসে শুয়ে রইলো। নীরব ক্রমাগত হাই তুলছে। চোখ খুলে চাইতে পারছে না ঠিক মতো। তবুও হাত বাড়িয়ে পাশের টেবিলের ড্রয়ার খুলে মায়ের দেওয়া বালা জোড়া বের করলো। অপর হাতে বিছানার পাশের আলোর সুইচ টা বন্ধ করে পুনরায় শুয়ে পড়ল। ঘুম চোখে ইচ্ছের দুই হাতে বালা জোড়া পরিয়ে যেনো শান্তি পেলো ও। মুখে হাসি নিয়ে চোখ বুজলো। বিড়বিড় করে বললো,

– ” আমার দেওয়া গিফট পড়ে দেবো। তৈরি করতে দিয়েছি। হলেই পাবি। শুভ রাত্রি।”

( চলবে)

নিরালায় ভালোবাসি
কলমে : তুহিনা পাকিরা
৬ .

তৃপ্তি দেবী সিঁড়ি দিয়ে একটু হলেই স্লিপ খেয়ে পড়তে গিয়েও বেঁচে গেলেন। এই সাত সকালে সিঁড়ি মোছা হয়েছে দেখে তিনি যেনো চমকে গেলেন। এখন কম করে সাড়ে পাঁচটা বাজবে। এই শীতের ভোরে কেউ এতো সকালে ঘুম থেকে উঠেছে কিনা সন্দেহ। সেখানে কিনা কেউ ঘর মুছেছে! নীরবের বিয়ে উপলক্ষ্যে এই বাড়িতে এসেছেন তিনি। কয়েকদিন হলো ডায়বেটিস ধরা পড়ছে। তাই তিনি প্রতিদিন সকালে একটু হাঁটতে বেরোন। এখানে এসেও তার ব্যতিক্রম নেই।

– ” বৌদি তাড়াতাড়ি এসো, কী হয়েছে দেখে যাও।”

রুমা দেবী ঘর থেকেই বেরোচ্ছিলেন চাবি হাতে। গেটের তালাটা না খুলে দিলে তার ননদ বাইরে বেরোতে পারবে না। হঠাৎই তৃপ্তি দেবীর চিৎকারে তিনি প্রায় ছুট লাগলেন। ভাবলেন কোনো বিপদ হয়েছে নাকি। অপর দিকে চিৎকার শুনে নীরব ও তাথৈও ঘর থেকে ছুটে বেরিয়ে এলো।

– ” কী হলো রে তৃপ্তি, চিৎকার করছিস কেনো? কিছু হয়েছে?”

উপরের রেলিঙে রুমা দেবী কে দেখে তৃপ্তি দেবী বললেন,” সাবধানে নীচে নেমে এসো বৌদি।”

– ” আরে কি হয়েছে, সাবধানে কেনো?”
সিঁড়িতে পা দিতেই রুমা দেবীর পা ঠাণ্ডায় ছ্যাঁক করে উঠলো। আশা এই বাড়িতে কাজ করে প্রায় পাঁচ বছর। সে তো এত সকালে কাজ করতে ঘুম থেকে ওঠে কিনা সন্দেহ। আশার আগে রুমা দেবী যখন একা বাড়ির সব কাজ করতো তখনও এমন কাজ করেনি। তবে আজ কে করলো? পরক্ষনেই কিছু একটা ভেবে ছুটে নীচে নেমে গেলেন তিনি।

ইচ্ছে মন দিয়ে রান্না ঘরটা মুছে কাল রাতের এঁটো বাসন গুলো মাজছিল। কিন্তু হুট করেই তৃপ্তি দেবীর চিৎকারে হাত থেকে কাঁচের প্লেটটা পরে ভেঙে যায়। প্রচন্ড ভয়ে বেসিনের গায়ে জড়ো সড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে আছে সে।

– ” এই তুই কি করছিস? এতো সকালে এইসব কে করে?”

রুমা দেবীর কথায় আরও জড়ো হয়ে যায় ইচ্ছে। ভয়ে হাত গুলো বারবার চেপে ধরছে। রুমা দেবী জোর করে ইচ্ছের হাত ধরে বাইরে নিয়ে এলো।

– ” কী করছিস তুই এইসব? তোকে কে বলেছে এই সব কাজ করতে। এই বাড়িতে এতো কাজ নেই যে তোকে এই ভোর বেলা ঘরের কাজে হাত লাগাতে হবে। তাছাড়া এই কাজের জন্যে রুমকি আছে। যা ঘরে যা। হাতের কী অবস্থা। ঠাণ্ডায় যেনো জমে গেছে। যা ঘরে যা। তাথৈ ওকে ঘরে দিয়ে আয় যা। ”

নীরব এতক্ষণ হাঁ করে ইচ্ছের দিকে তাকিয়ে ছিল। কী হলো সব মাথার উপর দিয়ে গেলো। এই মেয়ে এতো কী করে সংসারী হলো কে জানে। ইচ্ছে চলে যেতে তৃপ্তি দেবী বললেন, ” ইচ্ছের মতো বৌমা পেয়ে তো তুমি ধন্য হয়ে গেলে বৌদি।”

রুমা দেবী বাইরের দরজার তালা খুলতে খুলতে বললো, ” এবার থেকে তুই চিৎকার কম করিস, একটু হলেই আমি হার্ট ফেল করতাম। আর ইচ্ছেকে দেখেছিস, তোর চিৎকারে কাঁপছিল কেমন।”

– ” আমার গলার আওয়াজ এই জন্মে কমবে না। সে যাই হোক আমি বাগানে যাচ্ছি। তুমি এলে এসো।”

তৃপ্তি দেবী চলে যেতেই রুমা দেবী নীরবকে বললো,
” ও যখন উঠে এলো তখন তুই কি করছিলিস? তোকে বলেছি না ও এখনও পুরোপুরি সুস্থ না। পরের দিন থেকে এটা খেয়ালে রাখবি। এতো সকালে এই ভাবে জল ঘাটলে শরীর খারাপ করবে। এমনিতেই কয়েকদিন হলো ও হসপিটাল থেকে বাড়ি এসেছে। এই সময় ঠাণ্ডা লাগানো ওর একদম উচিত না। যা ঘরে যা, মেয়েটা একা আছে।”

নীরব মুখ ফুলিয়ে ঘরে চলে গেল। এতে ওর দোষ কোথায়? ও কী জেগে জেগে ইচ্ছেকে পাহারা দেবে নাকি। পাহারা দিত যদি জানতো ইচ্ছে এই ভাবে উঠে আসবে। কিন্তু বোঝার ব্যাপার এতো সকালে ইচ্ছে বাড়ির কাজ করলো কেনো? তবে কি কিছু ভাবতে ভুল করছে নীরব। মাথায় হাজারো চিন্তা নিয়ে নীরব ঘরে প্রবেশ করলো। ইচ্ছে তখন চুপ করে বিছানায় বসে ছিল। নীরব বিছানায় উঠে ইচ্ছের কোলে মাথা রেখে মাথাটা কম্বল দিয়ে চাপা দিয়ে দিলো। আর ইচ্ছে হাঁ করে নীরবের দিকে তাকালো। কী হলো এটা ও তো বুঝতেই পারলো না। কম্বলের ভিতর থেকে নীরব বললো, “এটা তোর শাস্তি। আমি এইভাবেই শুয়ে থাকবো। কাল থেকে তোকে যদি এই ভোরে উঠে কাজ করতে দেখি না তাহলে দেখিস তোর কী করি! ”

নীরব ভেবেছিল ইচ্ছে হয়তো ওর সাথে ঝগড়া বাঁধিয়ে দেবে। কিন্তু এখনও ইচ্ছে কে চুপ করে থাকতে দেখে নীরব কম্বল থেকে মাথা বের করে বললো, ” কাল থেকে ঘুম থেকে উঠে পড়তে বসবি। তুই মাস্টার্সে ভর্তি হয়েছিস না?”

ইচ্ছে একবার মাথা নাড়িয়ে চোখ সরিয়ে নিলো নীরবের থেকে। প্রথম কোনো ছেলের এতোটা সংস্পর্শে এসে বেশ অসস্তি হচ্ছে ওর। এটা ঠিক যে আগে ও একবার নীরবকে জড়িয়ে ধরেছিল। কিন্তু সেটা ছিল হারিয়ে ফেলার দুঃখে, কষ্টে। সেইদিন তো ও চেয়েছিল নীরব যেনো ওর কষ্টটা অনুভব করে। যদিও বা সেই দিন তো তা হয়নি। কিন্তু আজ অনুভূতি গুলো যেনো নতুন করে জীবন্ত হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু ইচ্ছে তো তা চায় না।

——————————–

বিকেলের দিকে নীরব ইচ্ছেকে নিয়ে বাড়ির পাশের পার্কে নিয়ে যায়। ইচ্ছেকে সবসময় মন মরা করে বসে থাকতে দেখতে নীরবের এতটুকু ইচ্ছে করছে না। কই ইচ্ছে আগে তো এমন ছিল না। আগে সবসময় হাসি মজা করতো। কিন্তু এখন ইচ্ছেটা কেমন যেনো পাল্টে গেছে। এই যে নীরব সেই এসে থেকে ওর দিকে তাকিয়ে রয়েছে এতে ওর কোনো অনুভূতি তো দূর কোনো অসস্তি ও হচ্ছে না। এসে থেকেই তাকিয়ে রয়েছে এক দিকে। সেখানে দল মিলে সকলে হেসে চলেছে। কিন্তু বিস্ময়কর ব্যাপার ইচ্ছে তা দেখেও হাসছে না। নীরবের তো এখন মনে হচ্ছে ওর আবার পাগলের সাথে বিয়ে হলো না তো। কিন্তু ইচ্ছে পাগল না সম্পূর্ণ স্বাভাবিক। তবে কোথাও গিয়ে অনুভূতিটা হয়তো মরে গেছে।

নীরব কতকটা গম্ভীর গলায় বলল, ” শোন ইচ্ছে এখন থেকে তুই যেহেতু আমার বউ তোর সব থেকে প্রধান কর্তব্য হলো একটু কম বকা। মানে তোকে এই রকম চুপ করে থাকতে বলছিনা। ধর আমি পাঁচটা কথা বললাম, তাহলে তুই অবশ্যই চারটা কথা বলবি। আমি তো বুঝতেই পারছি না তুই এত চুপ কেনো?”

নীরব কোনো উত্তরই পেলো না। তাই পুনরায় বললো, ” বুঝেছি। তোকে আমি ফিরিয়ে দিয়েছিলাম বলে তুই আমার উপর রাগ করেছিস, তাইতো। আচ্ছা যা, আমি খুব দুঃখিত। কিন্তু দেখ আমরা কিন্তু এক সুতোয় বাঁধা পড়েছি। এইটাই হয়তো হওয়ার ছিল। বিষয়টা হয়তো তুই মানতে পারিস নি। আমিও পারিনি। কিন্তু আমি মানছি না এমন না। একটু তো সময় লাগবেই তাই না।”

নীরবের কথায় ইচ্ছে ড্যাবড্যাব করে ওর দিকে তাকিয়ে রইল। কী বলবে খুঁজে পেলো না ঠিক। ধীর এসেছিল রুমা দেবীর থেকে জেনে যে ইচ্ছে আর নীরব এই পার্কে এসেছে। এখানে এসে ও দেখে নীরব কিছু বলছে। শেষের কথা টুকুই ও কেবল শোনে।

– ” যদি কখনো মানতে না পারিস তাহলে কাউকে জানাস আর না জানাস আমাকে জানাস। আমি আমার বোনকে তোর কাছে রাখবো না।তোর দয়াতে ও ওখানে থাকবে না। ”

নীরব এই মুহূর্তে ধীরকে এইখানে দেখে একটু চমকে যায়। এখন তো ওর অফিসে যাবার কথা। সরাসরি তাই জিজ্ঞেসই করে বসে।

– ” অফিস যাসনি শালা?”
– ” মুখের ভাষা ঠিক কর নীরব।”
– -” যা বাবা, ভুল কী বললাম। তুই তো আমার শালাই। তুই আর নীর যেহেতু ইচ্ছেই ভাই সেই হেতু আমার শালা। তো এবার বল অফিস যাসনি?”
– ” না, ছুটি নিয়েছিলাম। কাল থেকে যাবো। ”
– ” ওহ।”
নীরব এতক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিল। হঠাৎই বসতে গেলেই ধীর বললো, ” আইসক্রিম নিয়ে আয় তো নীরব।”

নীরব খুশি হলো। ওর মনে হলো এই যেনো ধীর ওর উপর সহজ হলো। নাহলে একটু আগেও পর্যন্ত কেমন করে যেনো কথা বলছিল।

– ” কোন ফ্লেবার?”
– ” যা ইচ্ছে।”
নীরব ইচ্ছের দিকে তাকিয়ে বললো, ” চল ইচ্ছে।”

– ” ও কেনো যাবে। আমি কি ওকে বলেছি। তোকে
বলেছি যে, নীরব আইসক্রিম নিয়ে আয়।”
– ” তুইই তো বললি, যা ইচ্ছে।”

ধীরের এই মুহূর্তে নীরবকে লাথি মারতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু মনের ইচ্ছে মনে রেখে বললো, ” তোকে যা ইচ্ছে আইসক্রিম আনতে বলেছি।”

– ” ও। বুঝতে পারি নি। এই জন্যেই ছোটো বেলায় বলেছিলাম তোর বোনের নাম ‘ ইচ্ছে ‘ রাখিস না। কিন্তু সেই ‘ইচ্ছেই ‘রাখলি। দেখলি কী হলো।”

ধীর রেগে নীরবের দিকে তাকালে নীরব ছুটে রাস্তার ওপারে আইসক্রিম ভ্যানের দিকে এগিয়ে গেল। ধীর গিয়ে ইচ্ছের পাশে বসতেই ইচ্ছে মলিন হাসলো।

– ” কী রে ওখানে সব ঠিক তো? নীরব তোকে কিছু উল্টো পাল্টা বলেনি তো? ”

ইচ্ছে মাথা নেড়ে না করলো। দাদার কাঁধে পরম শান্তিতে মাথাটা এলিয়ে দিল। ধীরের মনের ভয়টা ইচ্ছে বুঝতে পারলো। এই ভয়টা ওর ও ছিল। কিন্তু ভয়টা যেনো হুট করেই কেটে গেল। সব যেনো ম্যাজিক হলো। কেনো হলো। শুধুই কি ইচ্ছেকে ওরা চেনে!

– ” শোন বোন, যদি তোর ওখানে কোনো অসুবিধা হয় আমাকে কিন্তু জানাবি। মনে থাকবে?”

কিন্তু ইচ্ছে সেই সব শুনলো কিনা কে জানে। ও তো তাকিয়ে রয়েছে রাস্তার ওপারে নীরবের দিকে। নীরব বেচারা বোস কাকুর কুকুরকে দেখে এপারে আসতে পারছে না ভয়ে। হাত দেখিয়ে কুকুরটাকে খালি হুশ হুশ করছে। ইচ্ছের হাসি পেলো। মৃদু হাসি, যা ধীরের চোখের আড়াল হলো না। এতদিন পর হয়তো ইচ্ছেকে ও জোর করে না হেসে প্রাণবন্ত ভাবে হাসতে দেখলো। ওর বেশ ভালোই লাগলো। অপর দিক থেকে নীরব চিৎকার করে বললো, ” ওই ধীর এইদিকে আয়, এই ভলুকে সরা। নির্ঘাত এর জন্যে আমাকে চোদ্দোটা ইনজেকশন নিতে হবে। ”

ধীরকে যেতে হলো না। তার আগেই যার কুকুর সে ওখান থেকে ভলুকে নিয়ে গেলো। ধীরের হঠাৎ বোধোদয় হলো এই ছেলেটা এখনও কুকুরকে ভয় পায়। এমনকি ইনজেকশন নিতেও এর জ্বর। তাহলে ওর বোনকে কী করে ও সামলাবে।

( চলবে )

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here