নিরালায় ভালোবাসি-২১,২২

0
1011

নিরালায় ভালোবাসি-২১,২২
কলমে : তুহিনা পাকিরা
২১ .

বিকেলের দিকে বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিল ইচ্ছে। হিসেব মতো এই বাড়িতে ওর আজ শেষ দিন। ফিরে যেতে হবে নিজের ঠিকানায়। হ্যাঁ সত্যিই তো এটা কি ওর নিজের ঠিকানা নাকি! আজ সুবীর বেঁচে আছে বলে ওকে নিতে এসেছে কিন্তু যদি সুবীরের আসার কোনো সুযোগ না থাকতো, তবে কি হতো! নীরব একদিন ঠিকই ওর থেকে মুক্তির উপায় খুঁজতো। এইটাই বোধহয় বেস্ট। কোনো কিছু করতে হলো না। ইচ্ছে নিজেই নিজের কাছে প্রতিজ্ঞা বদ্ধ হলো, আর যাই হোক নীরবের কাছে ফেরা যাবে না। এই যাওয়াকেই ও শেষ যাওয়া হিসেবে জানতে চায়। আর কোনো দিন এখানে না। জীবন যদি আগের ছন্দে চলতে চায় তাই সই। নামি দামি কোনো কিছু তো দূর এক মুঠো ভালোবাসাও ওর চাই না। ওর জীবনের চাওয়া তো কেবল মাথার উপরের একটু ছাদ। তাতেই সারাটা জীবন ও চালিয়ে নেবে। অবশ্য ইচ্ছের ইচ্ছে জীবনটা এই মুহূর্তে স্তব্ধ হয়ে গেলে মন্দ হয় না। সবার দৃষ্টির আড়ালে গেলে খুব বেশি ক্ষতি হবে নাকি!

– ” এই ইচ্ছে তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে নে। সুবীর তো এক্ষুনি চলে আসবে। ”

নীরব হন্তদন্ত হয়ে বারান্দায় এসে ইচ্ছের দিকে তাকালো।
” ও বাবা , ইচ্ছে তো দেখি সম্পূর্ণ তৈরি। যাক ভালো করেছিস। ”

ইচ্ছে বাইরের দিকে দৃষ্টি দিলো। নীরব এসে ওর পাশে দাঁড়ালো। ইচ্ছের দৃষ্টি দূরের আকাশে দিকেই হয়তো তাকিয়ে রয়েছে। কিন্তু নীরবের মনে হচ্ছে চোখের ভাষা আজ অন্য। ইরা আজ বড্ড শান্ত। একদম চুপ। আচ্ছা পাখিদের কী মন কথা বলে! অবশ্যই বলে। ওরাও তো তাই নিজের মন মর্জি চলে। কাওকে ওদের তোয়াক্কা করতে হয় না। ওরা চাইলেই পারে দূর আকাশে ডানা মেলে উড়ে যেতে। ইচ্ছের খুব শখ ও ডানা মেলে ওই আকাশে উড়ে যাবে। যেই আকাশে নেই কোনো কষ্ট, না আছে বিধিনিষেধে বাঁধা শক্ত লোহার শিকলখানা। মানব জীবনের এই শিকলে আবদ্ধ হয়ে আর যেনো ইচ্ছে চায় না থাকতে। নাম যখন ইচ্ছেই রাখার ছিল, সৃষ্টিকর্তা তবে কেনো ডানা দিলো না, ইচ্ছেডানা।

আনমনেই ইরার খাঁচায় হাত রাখলো ইচ্ছে। খাঁচাটা নরে উঠলো। ইরাও ডানা ঝাপটালো। দূরের আকাশ যেনো ইরাকে আঁচল পেতে ডাকছে। ইচ্ছে ভাবনায় পড়লো, ও কী তবে ইরাকে আটকে রেখেছে এই লোহার খাঁচায়। ইচ্ছের মতো ওর ও তো তবে দম বন্ধ হয়ে আসে। সেও নিশ্চয় উড়তে চায় ডানা মেলে, ভাসতে চায় শরৎ কিংবা বসন্তের নীলাকাশে।

ডানা ঝাপটিয়ে উড়ে গেলো ইরা। নিজের দুই বন্ধুর দিকে ফিরেও না তাকিয়ে সে উড়ে গেলো দূর আকাশে। মুক্ত বিহঙ্গে আজ বড়োই চঞ্চল সে। থামেনি কোনো গাছের ডাল কী ইলেকট্রিক পোস্টের তারের উপর। আজ কেবল ওড়ার দিন, স্বাধীনতার দিন।

শূন্য খাঁচায় কেবল ইরার দুই তিনটি পালক। খাঁচা পড়ে রইলো শূন্য। এই শূন্য খাঁচা কী কেউ কোনো দিন পূরণ করতে পারবে! পারবে না। আর পারলেও ইচ্ছে থাকবে না। ইচ্ছের স্মৃতির পাতায় ইরাই থাকবে। ওর আপন কেউ। যাকে ইচ্ছে এতদিন শিকলে আবদ্ধ রেখেছিল। কিন্তু ইরা, সে তো ইচ্ছেকে ভালোবাসার শিকলে আবদ্ধ করেছিল। আজ সবের সমাপ্তি করেই না হয় ইচ্ছে চলে যাবে। বুকটা কেমন যেনো ভার হয়ে গেলো ইচ্ছের। আর কোনদিনই ইরার সাথে বোধহয় ইচ্ছের দেখা হবে না। সূচনাটা যেখান থেকে শুরু হয়েছিল সেইখানেই সমাপ্তি ঘটাই মঙ্গলের। নাহলে আরেকবার ‘ অপয়া’ শব্দটা ইচ্ছে নিজের ঝুলিতে ভর্তি করবে।

নীরবের একদম পছন্দ হলো না ইরার চলে যাওয়া। ও নিজেই তো ইরার মায়ায় পড়ে গেছে। আর মায়া তো সহজে কাটানো যায় না। ইচ্ছে যে ইরার খাঁচাটা খুলে দেবে তার ধারণা নীরবের ছিল না। কেনো করলো কে জানে? মুখটা বেজার করে পাশে তাকালো নীরব, না ইচ্ছে নেই চলে গেছে। ” ইচ্ছের বাচ্চা তুই ইরাকে ছেড়ে দিলি কোন দুঃখে। উফফ,” বিড়বিড় করে কথা বলতে বলতে নীরব ঘরে গেলো। ইচ্ছে তখন আলমারি থেকে নিজের জামা কাপড় বের করছিল। কিন্তু তার আগেই নীরব ওকে সরিয়ে আলমারির দরজা আটকে দিলো। ইচ্ছে ভ্রু কুঁচকে তাকালো নীরবের দিকে। বোকা বোকা হেসে নীরব বললো, ” আসলে আমি খুব শখ করে এই গুলো বউয়ের জন্যে কিনেছিলাম। সেই পড়বে।”

চুপ করে সরে গেল ইচ্ছে।এক মুহূর্তেই জন্যে মনে হয়েছিল নীরব ওকে আটকাবে। বলবে, তুই কোথাও যাবি না ইচ্ছে। কিন্তু না সবটা ভাবনাতেই রয়ে গেলো। কলিং বেলের শব্দে নীরব ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো। আর ইচ্ছে, সে চুপ করে নিজের নিয়তির খেলায় নিজেকে প্রস্তুত করতে লাগলো। জীবন ওকে আজ আরেকবার হারিয়ে দিতে বসেছে। আর হলোও তাই, সুবীর ওকে বাড়ি থেকে বের করে নিয়ে গেলো অন্ধ এক কুঠুরিতে। আর নিশ্চল হয়ে ইচ্ছেও পিছু নিলো তার। কই নীরব তো আটকালো না। ভালোবাসে না তাই! নাকি শব্দহীন মানুষটার প্রয়োজন আর সকলের মতো ওরও নেই।

গাড়িটা যত বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে ইচ্ছের কষ্টের পরিমাণ বাড়ছে। কিন্তু চোখের বৃষ্টিরা আজ আর ওর চোখে ধরা দিতে আসছে না। এসে তারা বলছে না, ইচ্ছের চোখের কাজল নষ্ট করবো আজ। আর নীরব, সে এখন অসম্ভব পরিমাণে রেগে রয়েছে। ভীষণ পরিমাণে রেগে রয়েছে। ওর ইচ্ছে তো করছিল মেরে নাক ফাটিয়ে দিতে। কিন্তু বহু কষ্টে নিজেকে সামলেছে। কানে থাকা ব্লুটুথ এ একটি মেয়ে গেয়ে চলেছে, “রাধা কায়াসে না জ্বলে। ”

” রজত এই ছাগলকে থামতে বলো। নাহলে আমি যে কী করবো নিজেও জানে না। ব্যাটার সাহস কম নয়, আমার বউয়ের হাত ধরে আমারই চোখের সামনে দিয়ে বেরিয়ে গেলো। তাও আবার বলে কিনা, “আপনি তো ইচ্ছেকে বউ হিসেবে মানেন না। বোঝেন তো বোবা ও। ওকে আর আপনার ঘাড়ে বইয়ে কী করবেন.” বলি আমার বউ বোবা হোক আর খোঁড়াই হোক, ওর কী? ইচ্ছে শুধু মাত্র আমার। অন্য কেউ ওর গায়ে হাত দিয়ে তো দেখুক, জানে মেরে দেবো। সত্যিটা একবার পুরোটা জানি তারপর আমার হাতের মার ওই সুবীরকে খেতেই হবে। ”

ফোনের ওপাশ থেকে রজত পাশে থাকা ইপাশিকে চুপ করতে বললো। ইপশি এতক্ষণ নীরবের কথায় হেসেই যাচ্ছিল। রজতের ও অবশ্য হাসি পাচ্ছে। কিন্তু সে এখন সিরিয়াস একটা অপরেশনে রয়েছে। ও এই মুহূর্তে রয়েছে সুবীরের বাড়ির বাইরে। সাথে অবশ্য ইপশিও রয়েছে।

– ” আচ্ছা নীরব, আমি ফোন রাখছি। যেকোনো মুহূর্তে সুবীর এসে যাবে। ”

নীরব বাড়ি থেকে বেরোতেই যাচ্ছিল সেই মুহূর্তে হুড়মুড় করে বাড়িতে আসে ধীর। আর এসেই নীরবকে প্রহার করতে শুরু করে।

– ” আরে কী করছিস ধীর, ছার লাগছে তো। ”

ধীর নীরবের কলার চেপে মুখে একটা ঘুষি মারে। চিৎকার করে বলে, ” আমি তোকে বলেছিলাম আমার বোনকে নিয়ে তোর সমস্যা হলে আমাকে বলবি। কিন্তু তুই ওকে ওই সুবীরের কাছে পাঠিয়ে দিলি। ”

ঠোঁটের কোণে লেগে থাকা রক্তটা মুছতে গিয়ে আটকে উঠলো নীরব। ওই উল্টে ধীরের কলার চেপে ধরলো,
” ওই তুই আমাকে কীভাবে মারছিস। যদি আমাকে ডক্টরের কাছে যেতে হয় এর জন্যে তবে আমার চেয়ে খারাপ কেউ হবে না।”

– ” নীরব..”

ঠাস করে একখান চড় পড়লো নীরবের গালে। চড়টা মারলো রুমা দেবী।

– ” তুই ইচ্ছেকে সুবীরের কাছে পাঠিয়ে দিলি। ও না তোর স্ত্রী। কী করে পারলি! নীর না বললে তো জানতাম না। ”

গালে হাত বুলিয়ে নিরীহ ছেলের মতো মুখভঙ্গি করলো নীরব।
– ” আমি কী করবো? ইচ্ছের সাথে সুবীরের বিয়ে তো হয়েছে নাকি। ও তো মারা যায়নি। তাহলে আমাদের বিয়েটা কী বৈধ!”

আরেকটা চড় পড়লো নীরবের গালে। ধীর চিৎকার করে বললো, ” তোদের বিয়ের বৈধ সেটা তোকে বোঝাতে হবে। তোদের না রেজিস্ট্রি হয়েছিল। ”

কিছুক্ষণ থামলো ধীর। পড়ে ধরা গলায় বলল, ” অর্ধমৃত মেয়েটাকে মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে পাওয়ার পর প্রথমেই ওর সাথে সুবীরের ডিভোর্স করাই আমরা। যদিও ওদের বিয়ের কোনো বৈধতা ছিল না। সুবীরের তো স্ত্রী ছিল। এক স্ত্রী বেঁচে থাকতে পুনরায় কী সেই বিবাহ গ্রহণযোগ্য হয়! হয় না। আর সুবীরের কোনো অ্যাকসিডেন্ট হয়নি। আর না ও মারা গিয়েছিল। ইচ্ছে সুবীরকে দেখলে আরও অসুস্থ্য হয়ে যাচ্ছিল। তখন ওকে আমরা মিথ্যে বলেছিলাম। না ও ডিভোর্সের ব্যাপারে অবগত না ও সুবীরের ব্যাপারে জানত। আরে ও তো এই সবে সুস্থ্য হচ্ছে। আগে কী হয়েছে ওর মনে আছে কিনা সন্দেহ। ”

চমকে ওঠে নীরব। ও ভেবেছিল হয়তো অ্যাকসিডেন্ট এ শয়তানটা মারা যায়নি। ও ইচ্ছের ব্যাপারে পুরোটাই জেনেছে রজতের থেকে। নীর ও অবশ্য যা জানে নীরবকে বলেছিল। রজত পুলিশে কর্মরত। আর ইচ্ছের কেসটা ওই দেখেছে। কিন্তু ইচ্ছের কেসে কিছু ফাঁক রয়ে গিয়েছিল। কারণ ইচ্ছেই এই কেসে কোনো সাক্ষ্য দেইনি। আসলে দিতে পারেনি। ও সেই ঘটনার পর থেকেই একটা ট্রমায় থাকতো। বারবার ও সুবীর কিংবা ওর পরিবারকে দেখলে ভয়ে সেন্সলেস হয়ে যেত। কিন্তু সুবীরের মা নিজে সব স্বীকার করায় তার তো শাস্তি হয়েইছে। কিন্তু কেস টা সলভ হয়নি।

নীরবের ভাবনার মাঝে ইচ্ছের বাবা নীরবের হাতটা নিজের মুঠোয় নিয়ে বললো, ” তুই শুধু ইচ্ছেকে আমার কাছে এনে দে। আমি কথা দিচ্ছি ও কোনোদিন তোর কাছে আসবে না। ”

ভ্রু কুঁচকে তাকালো নীরব। কোনোদিন আসবে না মানে কী? এখন এই সবে মাথা না ঘামিয়ে নীরব বেরিয়ে গেলো। পিছু পিছু ধীর ও গেলো।

( চলবে )

নিরালায় ভালোবাসি
কলমে : তুহিনা পাকিরা
২২ .

ঘরের প্রতিটা বন্ধ দরজার অপর পাশ থেকে একফোঁটা আলো আসা দূরস্থ প্রতিটা জানালা দরজা কোনোদিন খোলা হয়েছে কিনা সন্দেহ। এমনিতেই সময়টা রাত্রি নয়টা। বাইরে থেকে এই বহু পুরনো ঘরে আলো আসা অসম্ভব। এই ঘরটা ইচ্ছে জানে না। কোনোদিন দেখেও নি। অথচ এই বাড়িতে ইচ্ছে ছয় মাস থেকেছে। কিন্তু অনেক ভেবেও ইচ্ছে ধরতে পারেনি এই ঘরটা কোথায়। সুবীর যখন এই বাড়িতে নিয়ে আসে তখন তো সন্ধ্যে হয়ে গিয়েছে। কিন্তু সুবীর তখন ভুল করেও আলো জ্বালায়নি। বাড়িতে প্রবেশ করেই সুবীর ফোনের টর্চ এ সর্বপ্রথম ইচ্ছের চোখটা রুমাল দিয়ে বেঁধে দেয়। অর্থাৎ ইচ্ছের বর্তমান অবস্থান ইচ্ছে ঠিক মত জানেই না। শুধু এই টুকু ইচ্ছের মনে রয়েছে- ওকে যখন এই ঘরে আনা হয় তখন ও সিঁড়ি দিয়ে নীচে নেমেছিল। কিন্তু ও তো উপরে ওঠেনি যে সিঁড়ি দিয়ে আবার নিচে নেমে আসবে। ঠিক এই মুহূর্তে ইচ্ছের মনে হচ্ছে ও কোনো আন্ডারগ্রাউন্ডে রয়েছে। কিন্তু ইচ্ছের জানা নেই এই বাড়িতে কী কোনো আন্ডারগ্রাউন্ড রয়েছে?

পুরো অন্ধকার ঘরটায় কেবল একটা টর্চ জ্বলছে। যার পাওয়ার খুব কম। ঠিক ভাবে কিছু দেখাই যাচ্ছে না। বলতে গেলে ঘরটা অন্ধকারই। সুবীর সেই যে ইচ্ছেকে বসিয়ে বেরিয়ে গেছে এখনও আসেনি। অন্ধকার কুঠুরিতে ইচ্ছে এখন বন্দি। আগের ইচ্ছে হলে এতক্ষণে ভয়েই তার শ্বাসকষ্ট শুরু হয়ে যেত, কিন্তু এখন কার ইচ্ছের জীবনের প্রতি মায়া কম তাই ভয়ও নেই। খুব করে নীরবের মুখটা ওর চোখের সামনে ভেসে উঠছে। আর প্রতিবারই তা যেনো জোর করে ইচ্ছে সরিয়ে ফেলেছে। নিজের ভাবনাকে কন্ট্রোল করলে আখেরে লাভ ওরই হবে। এমনিতেই তো ওর লোকসানের দিকে গলা অবদি ডুবে রয়েছে। এখনই নিজেকে সামলাতে না পারলে তলিয়ে যাবার চান্সটা বেশি।

ইচ্ছের কাছে এই অন্ধকার ঘরটা কেমন যেনো আপন মনে হচ্ছে। আলো তো সবার আপন, ওর না হোক অন্ধকারই আপন হলো। যার জন্যেই হয়তো এতো অন্ধকারকে অন্ধকার মনে হচ্ছে না।

ইচ্ছে বসে থেকে থেকে ঝিমুচ্ছে। সময়টা তো অনেকই বেড়ে গিয়েছে, কম করে এগারোটা কী বারোটা! বাইরে থেকে আওয়াজ আসছে। তার মানে নিশ্চিত ঘরটা খুব নীচে না। সুবীর এসেছে, হাত খালি। অন্য কেউ হলে নির্ঘাত ভাবতো ও নিশ্চিত ইচ্ছের জন্যে খাবার এনেছে। কিন্তু আসলে তা হলোই না। সুবীরের হাত খালি। কিডন্যাপাররাও কমসে কম তার হাতে বন্দী মানুষটিকে কিছু অন্তত খেতে দেয়। আর ইচ্ছে তো ওর প্রাক্তন স্ত্রী। সুবীর ঘরের একটা ল্যাম্প জ্বালিয়ে দিল। ল্যাম্প টা দেখেই বোঝা যাচ্ছে এটা নতুন।

এতক্ষণে পুরো ঘরটা ইচ্ছের কাছে দৃষ্টিগোচর হলো। এতক্ষণ ঘরে জানালা খোলা হয়না বলে মনে হলেও আসলে এই ঘরে কোনো জানালায় নেই। ঘরটা আসলে একটা স্টোর রুমের মতো। কিন্তু চারিদিকটা পরিপাটি করে গোছানো। সুবীর দাঁড়িয়ে রয়েছে সিঁড়ির ঠিক নীচে। সিঁড়ির মাথায় একটা দরজা, সেই দরজা দিয়ে ফ্রিজ দেখা যাচ্ছে। ইচ্ছে এক ঝটকায় বুঝে ফেললো এই ঘরের অবস্থান কোথায়! ও ছয় মাস এই বাড়িতে থেকেছে, বাড়ির সব কাজ সামলেও কখনো সিঁড়ির নীচের এই গুপ্ত ঘরের কথা জানতেই পারেনি। সিঁড়ির মাথায় ফ্রিজটা উপরের সিঁড়ির ঠিক নিচেই রয়েছে।

সুবীরের মুখের ভয়ঙ্কর এক হাসি ইচ্ছের বুক ক্ষণিকের জন্য কেঁপে উঠলো। এই হাসি মানুষকে খুন করতেও পিছপা হয় না। হয়তো আজ ইচ্ছের শেষ দিন। এতক্ষণ জীবনের প্রতি কোনো মায়া না থাকলেও হুট করেই ইচ্ছের বাঁচতে ইচ্ছে করছে। কিছুক্ষণ আগের বিষাদ হীন পৃথিবীটা ওর সবথেকে আপন মনে হচ্ছে। নিজের আপন মানুষ গুলোর প্রতি অভিমান গুলো এখনই যেনো ওর কাছে অতীব তুচ্ছ মনে হচ্ছে। এই জন্যেই কী কবিগুরু বলেছিলেন, ” মরণ এলে হঠাৎ দেখি, মরার চেয়ে বাঁচাই ভালো। ” ( কবিতা -বোঝাপড়া )

একপা একপা করে সুবীর এগিয়ে ইচ্ছের ঠিক সামনে গিয়ে বসলো। সুবীরের প্রতিটা পদধূলিতে ইচ্ছে পিছনের দেওয়ালে মিশে যেতে লাগলো। যদি সত্যিই এই দেওয়ালে মিশে যাওয়া যেত তাহলে বোধ করি ভালোই হতো।

– ” কেমন লাগছে ইচ্ছে?”

ইচ্ছের নির্বিকার চিত্তে তাকিয়ে থাকা সুবীরের যেনো আমোদ ফুর্তি বেশি হলো। প্রাণ খোলা এক হাসি হাসলো সে। যেই হাসি ইচ্ছের কাছে ভয়ের সীমা বাড়ালো।

– ” ও হো আই অ্যাম রিয়েলি ভেরি সরি ইচ্ছে। আমি তো ভুলেই গিয়েছিলাম তুমি বোবা, সরি আপনি। দেখছো তোমাকে তুমি বলবো না আপনি বলবো তাই নিয়ে সমস্যা। আপনি তে আর যেতে পারছি না তুমিই ঠিক আছে। সে যাইহোক তুমি হচ্ছো বোবা। বোবা মানে জানো তো….?

সুবীরের করা প্রশ্ন ইচ্ছের মধ্যে এক রাগের সঞ্চার করলো। এতদিন অনেকে ওর কথা বলতে না পারার জন্যে ও সকলের কাছে হাস্যকর বস্তু রূপে প্রতিফলিত হয়েছে ঠিকই। কিন্তু এতদিন তার জন্যে সকলের সেই ‘ ‘বোবা ‘ ডাকটা ওর কাছে ওর কষ্টের কারণ ছিল। সকলের কাছে বঞ্চনায় ও রোজ কষ্ট পেয়েছে। কিন্তু আজ সুবীরের মুখে ‘ বোবা ‘ শব্দটা ওকে যেনো রাগী করে তুললো। কেনো? কারণটা খুব সহজ, ইচ্ছের জীবনের এই কারণটার জন্যে সুবীরই দায়ী। সুবীর তখনও ইচ্ছেকে নিয়ে হেসে চলেছে। ইচ্ছে আর থাকতে পারলো না। যা আজ পর্যন্ত কারোর সঙ্গে করার সাহস তো দূর ভাবতে অবধি পারেনি সেই কাজটাই করলো। ঠাস করে দুই খানা চড় সুবীরের গালে দিয়ে উঠে দাঁড়ালো। প্রচন্ড ক্ষোভে সুবীরের দিকে তাকিয়ে রইল। ইচ্ছের দৃষ্টিতে সুবীর ভয় পেলেও ভরকালো না। ও উল্টে ইচ্ছেকে বার কয়েক প্রচণ্ড তেজে চড় মারলো। ইচ্ছের ঠোঁটের কোণ দিয়ে তখন দরদর করে রক্তের স্রোত বইছে। সুবীর ইচ্ছের চুলের মুঠি ধরে ওর মাথাটা দেওয়ালে ঠুকে দিলো। শব্দহীন ইচ্ছের গলায় আর্তনাদটা বেরিয়ে এলো। সজোড়ে দেওয়ালে লাগানো মাথাটা সুবীর চেপে ধরেই বললো, ” তোর এতো তেজ কিসের? আমার জীবন তো ধ্বংস করেই দিয়েছিস। সব থাকতেও আজ আমার কেউ নেই। আর তার জন্যে তুই দায়ী। আর তুই শুধু আমার জীবন নষ্ট করেছিস এমন না , আমার মনে হয় যতদিন তুই পৃথিবীতে থাকবি তুই সবার জীবন নষ্ট করবি। নীরব ও মনে হয় আমার ভাবনায় ভেবেছিল। তাইতো নিজেই আমাকে ফোন করে তোকে ওর কাছ থেকে নিয়ে যেতে বললো। তুই ভাববি না এতে আমি কতটা খুশি হয়েছি। ও মনে হয় এই মুহূর্তে রিলাক্স করছে। ঘাড় থেকে বোঝা নেমেছে তো। আসলে তুই তো বোঝাই। বিয়ের আগে কতো উড়ো ফোন করে বলতাম, সুবীরকে বিয়ের জন্যে না করে দিন। ও খারাপ ছেলে। কিন্তু কোনো দিনই তো শুনিস নি। পড়ে কী করেছিলিস ওই নীরব কে ফোনটা দিয়ে আমাকে যা তা বলেছিলিস। এখন তার শাস্তি ভোগ তো করতেই হবে।”

সুবীর ইচ্ছেকে ছেড়ে দিয়ে পাশের একটা পুরোনো সোফায় বসলো। সোফাটা এতে খানিক নড়বর করে উঠলেও ভেঙে গেলো না। কিছুক্ষণ আগের রেগে যাওয়া , বাঁচতে চাওয়া মেয়েটার মস্তিষ্ক যেনো একমুহূর্তে সুবীরের হস্তগত হলো। নীরব যে নিজেই সুবীরের সাথে যোগাযোগ করেছিল এটা ইচ্ছে ভাবতে পারলো না। শেষে কিনা নীরব…..! ভালো।

মাথাটা মাঝে মাঝে ব্যথা করে উঠছে ইচ্ছের। একভাবে আর দাঁড়াতে পারছে না। তাই আস্তে আস্তে নিচে বসে গেলো। এই মুহূর্তে সুবীরের জন্যে ইচ্ছের খুব মায়া হলো। সত্যিই তো নিহিকে ও কতো ভালোবাসে। তাই না ইচ্ছেকে বিয়ে করতে বারণ করেছিল। এমন কি বিয়ের পর ইচ্ছের সামনেও আসেনি। চলে গিয়েছিল। ও সবসময় নিহিকে নিয়ে থাকতে চেয়েছে। তাই বোধ হয় এতটা ডেসপারেট হয়েছিল। সুবীর নিহি কে খুব খুব ভালোবাসে। ইসস, ওকেও যদি কেউ এমন ভাবে ভালো বাসতো! নীরব যদি ওকে ভালোবাসতো, তাহলে নিশ্চয় সুবীরের উড়ো ফোনকলের কথা বিশ্বাস করতো। অবিশ্বাস করে বলে যেতো না , তোকে বলেছিলাম আমি বিয়ে করবো চল। কিন্তু ছেলেটার নামে খারাপ কিছু রটাবিনা। কিন্তু তুই সেই কাজটাই করছিস। ছি, তোর লজ্জা করছে না। কাকে দিয়ে ফোন করাচ্ছিস বল?

দীর্ঘশ্বাস ফেলে ইচ্ছে। নীরব ওকে ভালোবাসে না। সুবীর ঠিকই বলেছে, নীরব এখন রিলাক্স করছে। হয়তো খুব খুব আনন্দ করছে। ইচ্ছের মুখে হাসি ফুটে উঠলো। নিজের ভাগ্যের পরিধির মাপকাঠি বেশ ভালোই।

ইচ্ছেকে হাসতে দেখে সুবীর বললো, ” কী ভাবছিস? ভাবছিস তো তোকে মেরে দেবো, ইচ্ছে আমার এখনও ভাবনা আছে তোকে মেরে ফেলবো। কিন্তু আমি তোকে মারতে চাই না। আমার স্ত্রী বলেছে, ওই সব যাকে তাকে মেরে নিজেকে কেনো ব্যস্ত করবে। ও হ্যাঁ তোকে তো বলাই হয়নি, নিহি মানে আমার স্ত্রী এখানে আসছে কিছুক্ষণের মধ্যেই। ও আসছে শাস্তি দিতে। ওর স্বামী কে তোর বিয়ে করার অপরাধে এই শাস্তি। ও খুব খুশি জানিস। প্রথম স্ত্রী থাকা সত্বেও দ্বিতীয় বিবাহ, মাকে দিয়ে তোকে টর্চার, পড়ে তোকে সেই কাঁচের মধ্যে ফেলে দেওয়া। কতো কি করলাম। কিন্তু দেখ আমার কিন্তু শাস্তিই হবে না। আহা, কী শান্তি তোকে বলে বোঝাতেই পারবো না। ”

সুবীরের কথায় ইচ্ছে কিছুই শুনলো না। চুপ করে বসে রইল। সুবীর তখন গুনগুন করেই চলেছে। সেই মুহূর্তে ইচ্ছের মনে হলো কেউ ওকে দেখছে। কিন্তু কে? সুবীর তো নয়। সুবীর তো মেঝের দিকে তাকিয়ে গুনগুন করছে। ইচ্ছের ভাবনার মাঝেই কেউ সুবীরের বসা সোফায় লাথি মেরে দিলো। এতক্ষণের নড়বড়ে সোফাটা ক্যাচক্যাচ শব্দ করে ভেঙে পড়লো। সুবীর ভাবেনি এতো তাড়াতাড়ি তার পতন হবে, তাও ইচ্ছের পায়ের সামনে। আসলে সুবীর ইচ্ছের পায়ের কাছেই পড়েছে।

( চলবে )

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here