নিরালায় ভালোবাসি-২৫,২৬
কলমে : তুহিনা পাকিরা
২৫ .
আজকের দিনটা অন্যরকম। তার কারণ একটাই, আজ হোলি অর্থাৎ রঙের উৎসব। রাস্তায় সকল বাচ্চারা অতপ্রেতে লুকিয়ে রয়েছে। যেই কাউকে তারাহুরো করে যেতে দেখছে তাকেই রঙে ভরিয়ে দিচ্ছে। আর আম জনতার আজকের দিনটা প্রতিবারই আফসোসেই কাটে। প্রতিবারই যতই তারা আগে থাকতে প্রয়োজনীয় জিনিস কিনে রাখুক না কেনো দেখা যাবে সেই হোলির দিন সেই কিছু না কিছু আনতে দোকানে ছুটতে হয়। আর যারা বাড়িতে লুকিয়ে থাকে আজকের দিনে, তাদের ব্যবস্থা হয় অন্যরকম। দেখা যাবে তুমি নিশ্চিন্তে রান্নাঘরে মাংসটা জমপেশ করে কষছো। সেই মুহূর্তে তোমারই পাড়ার তোমরাই পাশের বাড়ির কাকিমা এসে তোমাকে রঙে ডুবিয়ে তোমাকে সঙ্গে করে অপর বাড়িতে হানা দেবে। এইতো কিছুক্ষণ আগেই নীচ থেকে ইচ্ছের মা, জেঠিমার চিৎকারের শব্দ আসছিল। তার কারণ পাশের বাড়ির সব জেঠিমা, কাকিমা মিলে তাদের রঙ মাখাতে এসেছে। তৃপ্তি নতুন বউ, তাকেও কেউ ছাড়েনি। সবাই মিলে বগল ডাবা করে পাশের বাড়িতে গিয়েছে। এই একদিক দিয়ে ইচ্ছে আছে বেশ ভালো। গত পাঁচদিন ধরে জ্বরে পুড়ে বিছানাতেই ওর স্থান এখন। সেই দিন বাড়িতে ফেরার পর থেকেই মেয়ের ধুম জ্বর। একেই তো ভয় পেয়েছিল, তার উপর যতদিন কলেজ গিয়েছে রোজ একটা না একটা আইসক্রিম খেয়ে সর্দি বাড়িয়েছে। নীরব যখন ইচ্ছের শরীর খারাপ দেখলো ভীষন রেগে গিয়েছিল। প্রচণ্ড বকা খেতে গিয়েও ইচ্ছে বেঁচে গিয়েছে ধীরের জন্যে। বাড়ির কাউকেই নীরবের প্ল্যানের সম্পর্কে ধীর বলেনি। তাই সবাই এটাই জানে যে, নীরব ইচ্ছের সাথে থাকতে চায় না বলেই ওকে সুবীরের কাছে পাঠিয়ে দিয়েছিল। ব্যাস কেউ আর নীরবকে সাপোর্ট করছে না। উল্টে ইচ্ছের কাছে যেতেও দিচ্ছে না। বিশেষ করে নীরবের মা তো ইচ্ছের কাছেই রয়ে গেছে। যাতে তার ছেলে এখানে না আসতে পারে। তবে নীরব মা কে লুকিয়ে বেশ কয়েকবার ইচ্ছেকে দেখতে গিয়েছিল। কিন্তু ইচ্ছে তো জ্বরের মধ্যেও রাগ দেখিয়ে নীরবের দিকে ফিরেও তাকায়নি। এমনকি নীরব ওর হাত ধরেছিল বলে সেইদিন কেউ ওকে ঔষধ খাওয়াতে অবধি পারেনি। পড়ে নীরব আর আসবে না বলে তবে ইচ্ছের কাছ থেকে গেছে। আর আসেনি।
বিছানায় এইদিক সেইদিক করতে করতে উঠে বসলো ইচ্ছে। পায়ের কাছে গায়ের চাদরটা কুণ্ডলী পাকিয়ে গিয়েছে। গা টা ইচ্ছের বড্ড ম্যাজম্যাজ করছে। মাথাও ভার হয়ে রয়েছে। গায়ে এখনও হালকা হালকা জ্বর অনুভব করছে ইচ্ছে। কিন্তু এই ভাবে শুয়ে থাকতে ওর ভালো লাগছে না। আস্তে আস্তে বিছানা থেকে নেমে বারান্দার গ্রীলে গিয়ে মাথা ঠেকালো ইচ্ছে। নীচে এখনও রঙের খেলা চলছে। প্রত্যেককে এক একটা ভূতের চেয়ে বেশি লাগছে। ছোটো ছোটো বাচ্চা গুলো কাওকে না পেয়ে নিজেরাই নিজেদের রঙ মাখিয়ে ঘুরছে। অনেকে আবার রঙের বালতিতে বেলুন ভর্তি রঙ জোগাড় করছে। ইচ্ছের ছোটবেলার কথা মনে পড়ছে। আগে কতো মজা হতো। নীরব প্রতিবার ইচ্ছের বালতির রঙ নিয়ে পালিয়ে যেত। আর ইচ্ছে কাঁদতে কাঁদতে নীরবের বাড়িতে চলে যেত, ওর মাকে বলতে। বিচার দিয়ে আসার পথে নীরবের মায়ের হাতের নাড়ু, মোয়া নিয়ে এক গাল হেসে এসে নীরবকে ভেংচি কেটে নিজের বাড়িতে চলে যেত স্নান করতে। প্রতিবারের এক রুটিন। কথা গুলো ভাবতে ভাবতেই ইচ্ছের মুখে হাসি খেলে গেলো। হুট করেই আজ কেমন ওর সাজতে ইচ্ছে করলো। কেনো করলো কে জানে। হয়তো কিছুক্ষণ আগে ফোনে শান্তিনিকেতনের ভিডিও দেখেও হতে পারে। আবার গতকাল কলেজের বসন্ত উৎসবের জন্যেও হতে পারে। কাল তো জ্বরের জন্য ও কলেজে যেতেই পারেনি। সব মেয়েরা শাড়ি পরে এসেছিল। রঙ খেলেছে একসাথে। তাছাড়া নাচ, গান ও হয়েছে।
চট করে ঘরে ছুটলো ইচ্ছে। কতকটা মাতালের মতো, টলতে টলতে। আসলে জ্বরের ঘোর ওর এখনও কাটেনি। আলমারি খুলতে হলো না। সোফাতেই একটা লাল, হলুদ শাড়ি পরে ছিল। ওই শাড়িটাই পরনের চুড়িদারের উপর জড়িয়ে পরে নিলো ইচ্ছে। কিন্তু কেমন একটা দেখতে লাগলো ওর নিজের কাছে। সদ্য জ্বর ছাড়া শরীরটা একেই তো রুগ্ন লাগছে, তার উপর মাথা দিয়ে বিন্দু বিন্দু ঘাম গড়িয়ে পড়ছে। বোধ হয় জ্বর ছাড়ছে। ইস্, চোখ গুলোও বড্ড ভিতর দিকে ঢুকে গেছে। মনটা চট করে খারাপ হয়ে গেলো ইচ্ছের। কিন্তু ড্রেসিং টেবিলে থাকা ছোটো ছোটো পুতি দেওয়া মুক্তোর মালাটা দেখে যেনো চোখ জোড়া চক চক করে উঠলো। চট করে হারটা গলায় পড়ে ফুলের ট্রে থেকে একটা হলুদ গাঁদা কানের পিছনে গুঁজে দিলো ইচ্ছে। এইবার আর নিজেকে আয়নায় দেখতে মন চাইলো না ওর। এবারও যদি খারাপ লাগে দেখতে, থাকনা কী দরকার। নিজের যদি এইভাবে সাজতে মন চায় ক্ষতি তো নেই। ইচ্ছে যদি প্রেমিক হতো তবে নিজের প্রেমিকাকে অবশ্যই বলতো, একদিন শাড়ির সাথে একটা হার পড়ে কানের পিছনে গাঁদা ফুল গুঁজে দিও। আমার খুব ভালো লাগে। কিন্তু বলা যখন হবে না। নিজের ক্ষেত্রেই শ্রেয়।
বাইরে থেকে ” পিকু” , ” পিকু” শব্দ শুনে ইচ্ছের মনটা খুশি হয়ে গেলো। ওর বারান্দায় বুঝি আজ ইরা এসেছে! কথাটা ভেবেই আবার বারান্দায় গেলো ইচ্ছে। ইরা তো আর নেই। ওকে তো ইচ্ছে নিজেই ছেড়ে দিয়েছে। ও তবে কোথা থেকে এলো।
হ্যাঁ বারান্দায় সত্যিই ইরা এসেছে। এতক্ষণ ” পিকু” বলে ইচ্ছেকেই ডাকছিল। ইচ্ছে পরম মমতায় ইরার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতেই ইরা উড়ে গিয়ে নীরবদের বারান্দায় চলে গেল। ইচ্ছের মনটা খারাপ হয়ে গেলো। কী দরকার ইরার নীরবের বারান্দায় যাবার। কে ও? ইচ্ছে তো ওর বেশি আপন, নীরব তো কম। ওর একদম নীরবের কাছে যাওয়া উচিত হয়নি। ইরা নির্ঘাত জানে না নীরব কতো বাজে! ইচ্ছেকে তো নীরব রোজ কষ্ট দেয়। ওর সাথে দেখা করতে অবধি আসে না। একদিন না ওকে দেখে রাগে ঔষধ খায়নি সেই দিন থেকে তো ইচ্ছে নামক মেয়েটাকে ভুলে গেছে। এই সব তো জানা কথা ঘ্যাম খাচ্ছে বেশি। আজ ইচ্ছে যদি কথা বলতে পারতো তাহলে ওর ঘ্যাম খাওয়া ছুটিয়ে দিতো।
ওই অবস্থাতেই নীরব দের বাড়ি ছুটলো ইচ্ছে। ইরাকে ঐখানে কিছুতেই থাকতে দেবে না ও। নিজের কাছে রাখবে। নীরবের কাছে থাকলে নীরবের মতো হবে। দেখা যাবে ইচ্ছেকে কোনদিন ভুলে যাবে।
রাস্তার বাচ্চা গুলোর দিকে তাকাতে হয়নি। তারা ইচ্ছেকে পাগলের মতো টলতে টলতে ছুটতে দেখে ওরাও ওদের মত সরে গিয়েছে। আসলে পুরোটাই ফলস। আসল খেলা তো দোতলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকা ব্যাক্তির। যার হাতের জাদুতে সকলে সম্মানের সঙ্গে ইচ্ছেকে যাবার রাস্তা করে দিয়েছে।
উপরে গিয়ে সোজা নীরবের ঘরের দিকে ছুটেছে ইচ্ছে। না কেউ নেই। বাড়ি সম্পূর্ণ ফাঁকা বলতে গেলে। আসলে নীরবই বাড়িতে নেই। বারান্দার খাঁচার মাথার দিকে ইরা বসে বসে ” পিকু” বলে চলেছে। ইচ্ছেকে হাত বাড়িয়ে ইরাকে কোলে তুলে নিয়ে অভিমানী দৃষ্টিতে বাইরের দিকে তাকাতেই চোখ পড়লো বারান্দার গ্রীলে হেলান দেয়া নীরবের দিকে। নীরব তো ইচ্ছের দিকেই তাকিয়ে রয়েছে। আজ কি নেশা হবার দিন? তাহলে তো এই মেয়েটার নেশায় পড়ে গেছে নীরব। সদ্য জ্বর ছাড়া ঘামের বিন্দু জমা মুখটা নীরবকে বড্ড কাছে টানছে। পরনের সাদা পাঞ্জাবির পকেটে একহাত পুরে নীরব বলে উঠলো,
“বসন্তেরই উষ্ণ দুপুরে
ধুম জ্বর ছাড়া বিন্দু বিন্দু ঘর্ম মাখা শরীরে
নির্জীব তোমার যখন, একখানি হলুদ শাড়িতে
হলুদিয়া পাখি সাজতে মন চায়।
আমি তখন দূর এক বারান্দার পর্দার আড়ালে দাঁড়িয়ে
তোমার ইচ্ছেটাকে উপলব্ধি করি। ”
প্রতিটা শব্দে নীরব ইচ্ছের দিকে এগিয়ে গেলো। শেষ মুহূর্তে নীরব যখন ঠিক ইচ্ছের সামনে,, সেই মুহূর্তে ইচ্ছের মাথাটা দুই হাতে ধরে ইচ্ছের চুলের মাঝে নিজের ওষ্ঠদ্বয় স্পর্শ করলো নীরব। পুনরায় বলে উঠলো,
“ফুলের ট্রে তে থাকা কতো না ফুলের মাঝে
তুমি যখন একখানি হলুদ গাঁদাকে
তোমার কানে পরম মমতায় গুঁজে দাও।
আমার মন তখন আনচান করে বলে ওঠে
তোমার মাথায় উষ্ণ এক চুম্বন এঁকে দিতে।
তোমার গলায় দোলা ওই ছোটো পুঁতির
মালাগুলোকে হিংসে হয় খুব।
একবার তোমায় কাছে পেলে
অতিতুচ্ছ ওই মালাকে এক টানে ছিঁড়ে দেবো আমি।
একটা একটা করে তোমার শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়া মালাটার অহংকারকে নিঃশেষ করবো আমি।”
ইচ্ছের গলার মালাটা সত্যিই অহংকার ত্যাগ করে ইচ্ছের শাড়ির ভাঁজ দিয়ে গড়িয়ে গড়িয়ে মেঝেতে পড়ে গেলো। নীরব পকেট থেকে লাল আবিরের প্যাকেট থেকে একমুঠো আবির নিয়ে ইচ্ছের দুই গালে লাগিয়ে দিয়ে বলে উঠলো,
“কানের পাশের ছোটো ছোটো চুল গুলো থেকে যখন ঘামের বিন্দু গুলো তোমার গাল বেয়ে ঝরে যাবে,
নির্জীব তোমার দুই গালে লাল আবিরের
পরশ ছোঁয়াতে কেঁপে উঠবে তুমি।
আমার বসন্তের রঙিন মন বলে
ভালোবাসায় জড়িয়ে ধরতে।
তোমার সদ্য জ্বর ছাড়া
উষ্ণ-ঘর্মাক্ত শরীরে মিশে যেতে মন চায়।”
– ” আমি কি তোকে জড়িয়ে ধরতে পারি?”
বারান্দার গ্রীলে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল ইচ্ছে। যেনো গ্রিলের সঙ্গে মিশে গিয়েছিল। নীরবের প্রতিটা শব্দ ওর হৃদয়ে কম্পনের সৃষ্টি করছিল। কোনো এক লজ্জার স্রোত ওকে গভীর সমুদ্রে যেনো টেনে নিয়ে গিয়েছে। নীরব কবিতা শেষে ইচ্ছের দিকে তাকিয়ে হেসে কথাটা বলতেই ইচ্ছে নীরবের বুকে মিশে যায়। ভালোবাসার মানুষটাকে আর একবার দুই হাত বাড়িয়ে আহ্বান করে। আজ তো ভালোবাসতে মানা ,,
———————–
ডাইরির পৃষ্ঠার পরের পাতাটা ওল্টানোর আগেই তাথৈ এর হাত থেকে ডায়রিটা কেড়ে নেয় ইচ্ছে।
– ” ও বৌদি, দাও না ওটা পড়ি। আর তো একটু খানি বাকি। দাও না! ”
ঘাড় নেড়ে ডাইরিটা নিয়ে ঘরে ঢোকে ইচ্ছে। যার অর্থ, আর না তাথৈ। এই টুকুই ইনাফ তুই যা পড়েছিস।
ইচ্ছের পিছনে তাথৈ ও আসে। আর এসেই এক আবদার বৌদি ডায়রিটা দাও। ইচ্ছে অবশ্য ততক্ষনে ডায়রি ড্রয়ারে পুরে চাবি দিয়ে দিয়েছে।
সময়ের দিক থেকে অনেক কিছু পরিবর্তন হয়েছে। এই যে তাথৈ এখন ইচ্ছেকে আর” ইচ্ছে দি” না বলে “বৌদি” বলছে। আরও অনেক কিছুই হয়েছে। সবার ভালোবাসা গুলো বেড়েছে। তার উপর আজ তো নীরব , ইচ্ছের বাড়ি লোক জনে সমাগম বলা যেতে পারে। কিছু একটা আছে আজ। আসলে ছিল। একটু আগেই সব শেষ হয়েছে। এই ততক্ষণ তাথৈ পুরোনো সম্পর্ক গুলো খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছিল। দেখছিল হয়তো ভালোবাসার মাপকাঠি। কিংবা ইচ্ছের ভালোবাসার জোর।
( চলবে )
নিরালায় ভালোবাসি
কলমে : তুহিনা পাকিরা
২৬ .
তাথৈ অবশেষে ইচ্ছের কাছে হেরে গেছে। পরনের ভারী শাড়িটায় যেনো এবার শ্বাস আটকে যাবে ইচ্ছের। ভ্যাপসা গরমে একেই তো সে ঘেমে নেয়ে চান। তাথৈ বোধ হয় ইচ্ছের ভারী নিশ্বাসের শব্দ শুনলো। আসলে ওর নিজেরই ইচ্ছেকে দেখে কষ্ট হচ্ছে। পাশের টেবিল থেকে এক গ্লাস জল ইচ্ছের হাতে দিয়ে বললো,
– ” তুমি শাড়িটা চেঞ্জ করে নাও বৌদি। তোমার তো কষ্ট হচ্ছে। এক কাজ করি ওই হালকা হালকা শাড়িটা এনে দিই! ”
বিছানায় রাখা হালকা সবুজ শাড়িটা আনতে বললে ইচ্ছে ইশারায় মাথা নেড়ে না বলে। যার অর্থ সে এই ভাবেই থাকতে চায়। আর বারে বারে জানালার বাইরে তাকাতে থাকে। প্রথমে জোর করলেও পড়ে ইচ্ছের বাড়ির উঠোন থেকে ভেসে আসা নীরবের গলা শুনে যা বোঝার বুঝে যায় তাথৈ। এটা হচ্ছে ভালোবাসার একটা পার্ট ও বলা যেতে পারে। সেকেন্ড ইয়ারে পরা কোনো মেয়ের পক্ষে এটা বোঝা সামান্য ব্যাপার। ছোটো থেকে উপন্যাস পড়ে পড়ে প্রেমের প্রতিটা ধাপই তাথৈ হস্তগত করেছে। শুধু নিজেই এখনও কারোর প্রেমে পড়েনি। যতবারই প্রেমে পড়েছে প্রকৃতির প্রেমে পড়েছে। প্রতিটা ঋতুর প্রেমে পড়েছে, ফুলের প্রেমে পড়েছে, মেলার ভিড়ের প্রেমেও ও পড়েছে। কেবল সেই প্রেমস্পদার তার জীবনে আজও আসেনি। আসলে বললে ঠিক প্রেম হয়না। প্রেমিক আমি খুঁজছি! এটা নিতান্তই একটা কথার কথা। এর সাথে প্রেম কিংবা ভালোবাসার সম্বন্ধ বহু দূর। প্রেম, ভালোবাসা খুঁজতে হয় না বা কাউকে খুঁজে দিতেও হয় না। ওটা আচমকাই হয়।
ফ্যানের স্প্রিড বাড়িয়ে তাথৈ বেরিয়ে যায়। উদ্দেশ্য ইচ্ছের বাড়ির উঠোনে যেখানে সকলে রয়েছে সেখানে যাওয়া। সকলে বলতে কেবল ছেলেরা। আজ নীরবের বাড়িতে ছেলেদের অ্যালাউ নেই। তাদের আতিথেয়তা ইচ্ছেদের বাড়িতেই হয়েছে। যদিও বা অনুষ্ঠান এতক্ষণে মিটে গেছে। এখন সকলে দুপুরের খাবার খেতে গিয়েছে।
কচ্ছপের গতিতে ইচ্ছে ড্রেসিং টেবিলের আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। পরনে লাল একটা বেনারসী শাড়ির মতো শাড়ি। আসলে ইচ্ছে খুব বেশি শাড়ির নাম জানে না। শাড়িটা ভীষন ভারী, কাঞ্জিভরম হতেও পারে। এছাড়াও বোধহয় হাজারটা গয়না পরিয়ে রেখেছে ওকে। নীরবের ঠাকুরদার আমলের ভারী ভারী গলার হার থেকে শুরু করে কোমর বন্ধনী পর্যন্ত ইচ্ছেকে পড়তে হয়েছে। আজ সকালে এই গহনা গুলো রুমা দেবী ওর হাতে দিয়ে বলেছে, এইবার তোর জীবনে আরেক ধাপ এর প্রমোশন হচ্ছে। এই গুলো এই বাড়ির ঐতিহ্য। চরম অর্থ সংকটেও এই গহনায় কখনো আমি হাত দিইনি। এবার দায়িত্ত্ব তোর। আগলে রাখিস।”
কিন্তু ইচ্ছে এই গহনা গুলো আদৌ নিজের কাছে রাখবে না। বিয়ের আগে নিজের যাবতীয় খুঁচ খাছ যা গহনা ছিল তা থাকতো ওর মায়ের কাছে। তবে বিয়ের পর সেইগুলো নিজের দায়িত্বে কোনো কালেই ইচ্ছে রাখেনি। এই বাড়িতেও তো ওর এক মা আছে তার কাছেই ইচ্ছে নিজের গহনা রাখে। এইগুলো আবার রুমা দেবীর কাছেই যাবে। আসলে মাথার উপর দায়িত্ব থাকলে তা আমরা সব সময় পালন করি। কিন্তু মাথার মধ্যে একবার যদি ধন সম্পত্তির চিন্তা ঢুকে যায় তবে সারাক্ষণ একটা চিন্তা খেয়ে চলে তোমার মস্তিস্ক কে। আর ইচ্ছে এটাই মানে।
ইচ্ছে আজ খোঁপায় জুঁই ফুলের মালা দিয়েছিল। যেগুলোর ছোটো ছোটো পাঁপড়ি গুলো ঝরে শাড়ির আঁচলের ভাঁজে ভাঁজে জড়ো হয়েছে। ইচ্ছে গলার বড়ো হারটা একহাতে ধরে আঁচলের ফুলের পাঁপড়ি গুলো সরিয়ে দিলো। পড়ে নিজের পেটে পরম মমতায় হাত দিয়ে আপন মনে হাসতে লাগলো। স্বপ্নের দেশে এক রূপকথার ঘর সাজাতে লাগলো। হুট করেই পিছন থেকে এক বলিষ্ঠ হাত ইচ্ছের কোমর জড়িয়ে পেট স্পর্শ করলো। নীরব জানা সত্ত্বেও আচমকা স্পর্শে কেঁপে উঠলো ইচ্ছে। পড়ে হুশ ফিরতে নীরবের হাত স্পর্শ করে ড্রেসিং টেবিলের আয়নায় তাকালো ইচ্ছে। নীরব ও ওর দিকেই আয়নার মধ্য দিয়ে তাকিয়ে রয়েছে। দুইজনের চোখে চোখ পড়লে লজ্জা পেলো ইচ্ছে। হুট করেই চোখটা বন্ধ করে নিলো। নীরব তখনও ইচ্ছের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। কিন্তু ইচ্ছের লজ্জা মাখা দুটি আঁখি তখনও বন্ধ। দুষ্টু হেসে নীরব পিছন দিক থেকে ইচ্ছের কানে ফিসফিস করে বলল,
—-” লজ্জার পরিমাণ এতো বেশি যে ইচ্ছের গালটা ফট করে ফেঁটে যেতে পারে। এটা দেখে ইচ্ছের দাদা আমি নামক অধমকে মেরে নাক ফাটিয়ে দিতেও পারে। তবে সেইসব তো অতীত, এখন আবার ইচ্ছেই মেরে এই অধমের নাক ফাটিয়ে দেয়। যুগ পাল্টেছে বস।”
ইচ্ছে ফট করে চোখ খোলে। প্রেগন্যান্সির দরুন নাহয় কয়েকবার নীরবের নাকে ঘুষি মেরে দিয়েছিল। তাও ঘুমের ঘোরে। তাই বলে এইভাবে বলতে হবে। হালকা হালকা রাগে মুখ ফুলিয়ে ফেললো ইচ্ছে। নীরবের কাছে এই রাগ ফুস মন্তর টাইপ। এই আছে, এই হাওয়া। পিছন দিক দিয়ে ইচ্ছের গালে নীরব নিজের ঠোঁট স্পর্শ করতেই ইচ্ছে আবারও লজ্জা পায়। এইবার সামনে ফিরে নীরবের বুকে মুখ লুকায়। নীরব ও হেসে দেয়।
জীবন থেকে অনেকটা সময় অতিবাহিত হয়েছে। সেই সাথে নীরব ইচ্ছের ভালোবাসাটা বেড়েছে। আজ ইচ্ছের সাঁধ ছিল নয় মাসের। ইচ্ছে মা হতে চলেছে। নতুন একটা সম্পর্কের প্রমোশন হয়েছে তার।
ইচ্ছেকে জড়িয়ে থাকা অবস্থায় নীরব বললো, ” খাবার সব খেয়েছিস? না হাঁ করে খালি গিলেছিস? ”
বোকা বোকা হাসলো ইচ্ছে। যা নীরবের দৃষ্টিগোচর হয়েছে বলে মনে হয় না। নীরবের পাঞ্জাবির বোতাম গুলো নিয়ে খেলতে খেলতে ইচ্ছে কেবল বাম দিক থেকে ডানদিকে গভীর ভাবে মাথা কাত করে দেখালো, যে ও সব খেয়েছে এইবার ইচ্ছে ঠিক কতটা খেয়েছে তা তো নীচে গেলেই নীরব জানবে। যদিও বা নীরবের আন্দাজ মতে কেবল চাটনিই ইচ্ছে মুখে তুলবে।
– ” আচ্ছা চল ফ্রেশ হয়ে নে। আমার তোকে দেখা হয়ে গেছে। তোকে ভালোই লাগছে তবে তুই বেশি মুটি হয়ে গেছিস? ”
কথাটা নীরব ইয়ার্কির ছলে বললেও ইচ্ছে কুটুস করে নীরবের হাতে খামচি কাটলো।
– ” আচ্ছা বাবা সরি। তুই মুটি না। হয়েছে। আমি মোটা, চলবে? ”
ইচ্ছে একগাল হেসে সম্মতি দিলো। নীরব প্রথমে মুখটা ব্যাজার করে হেসে উঠলো। ইচ্ছের গালটা টেনে দিয়ে ওকে বিছানায় বসিয়ে গহনা গুলো খুলে দিলো। পড়ে ইচ্ছে ফ্রেশ হতে ওকে শুইয়ে দিয়ে মাথায় হাত বোলাতে লাগলো। পড়ে ইচ্ছে ঘুমিয়ে গেলে নীরব বাইরে চলে গেলো। যাবার আগে তাথৈ কেও রেখে গেছে। তাথৈ ও এসে ইচ্ছের পাশে সাবধানে দূরত্ব রেখে শুয়ে পড়েছে। এখনও বাড়িতে অনেক লোক জন আছে। সবার খাওয়া হয়নি। তাথৈ আগেই খেয়ে নিয়েছে ইচ্ছের সাথে থাকবে বলে। বলা তো যায় না কখন কী প্রয়োজন পড়ে।
( চলবে )