#নিষিদ্ধ_বরণ,০৩,০৪
#রোকসানা_রাহমান
পর্ব (৩)
আনন্দে আপ্লুত হয়ে নিহিতা দরজার মানুষটিকে প্রায় জড়িয়েই ধরছিল। সে সময় ভরাট পুরুষ কণ্ঠ,
” আপনি যাকে ভাবছেন, আমি সে নই। ”
নিহিতা মাঝপথে থমকে গেল। ক্ষণিকের জন্য বোধশক্তি হারাল। কাঠ শরীরে অনুভূতি ফিরে পেল বেশ কয়েক সেকেন্ড পর। ততক্ষণে দমকা হাওয়ার সাথে বৃষ্টির কণারা উড়ে এসে ভিজিয়ে দিল তার চুল, মুখমন্ডল, গলাসহ কাপড়ের সামনের বেশ কিছু অংশ। সেই অবস্থায় দরজার দিকে ছুটে পালাল। চট করে লুকিয়ে পড়ল পর্দার আড়ালে। স্বস্থির নিশ্বাস ছাড়তে গিয়ে টের পেল তার সারা শরীর কাঁপছে, বুকের ভিতরটায় ধুকপুক করছে। মানসিক অস্থিরতা তীব্র হতে সেই পুরুষ কণ্ঠটি পুনরায় বেজে উঠল,
” আপনি কি ভয় পেয়েছেন? ”
নিহিতার কাঁপা-কাঁপি ছুটন্ত ট্রেনের মতো বেড়ে গেল। সে ভেবেই পাচ্ছে না এই বৃষ্টি ঝরা রাতে একটা পুরুষ মানুষ এ বাসায় কিভাবে। সচরাচর এমন ঘটনা ঘটে না। তাদের বাড়িতে পুরুষ মানুষের যাতায়াত খুব কম। খুব প্রয়োজনে যদি কেউ এসেও থাকে নিহিতার বাবা বারান্দায় বসান। কথাবার্তা, আপ্যায়ন শেষে সেখান থেকেই বিদেয় করেন। এখন তো উনি বাসায় নেই তাহলে কেন এসেছেন? নাকি বাসায় নেই বলেই এসেছেন? ভয়ে পর্দা খামচে ধরল নিহিতা। খোলা দরজা লাগানোর সাহসটুকুও পাচ্ছে না। যেন পর্দার কাছ থেকে নড়লেই সে শেষ! একটি নোংরা ঘটনার সাক্ষী হয়ে পৃথিবী ত্যাগ করবে!
” আমি মাহদী। এরশাদ রহমানের সাথে দেখা করতে এসেছি। স্যারকে কি ডেকে দেওয়া যাবে? ”
বাবার নাম শুনতে নিহিতার ভয় খানিক কমল। গলায় জোর এনে ধীরে ধীরে বলল,
” বাবা তো বাড়িতে নেই। ”
” বাড়িতে নেই! ”
মাহদীর কণ্ঠ কেমন যেন শোনাল! নিহিতা খুব একটা খেয়াল করল না বোধ হয়। সে ডুবে আছে অন্য চিন্তায়। মনে হচ্ছে নামটা তার পরিচিত। কণ্ঠটাও! কিন্তু স্পষ্ট কিছু মনে পড়ছে না। তার ভাবনা পথে মাহদীর গলার স্বর ধ্বনিত হলো,
” তুমি নিহিতা না? ”
নিহিতা চমকে গেল। চকিত দৃষ্টি আটকাল পর্দার মোটা কাপড়ে। যেন কাপড় ভেদ করে দূরের মানুষটাকে দেখে ফেলার এক অদম্য ইচ্ছে! বেশ কিছুক্ষণ পর ছোট্ট করে উত্তর দিল,
” হ্যাঁ। ”
ওপাশ থেকে কিছু বলার আগেই নিহিতা ভীষণ কৌতূহলী হয়ে পড়ল। জিজ্ঞেস করল,
” আপনি আমাকে চিনেন? ”
মাহদী মৃদু হেসে বলল,
” চিনব না? তোমার জন্যই তো নায়রার গালে প্রথম চড় পড়েছিল। ”
নিহিতার মুখ হাঁ হয়ে গেল। বিস্ময়ে আবিষ্ট থাকল কতক্ষণ। সহসা প্রতিবাদ করে বসল,
” আমার জন্য কেন হবে? আমি কি বলেছিলাম রাগি ভাইয়াটাকে সাহায্য করো? কাগজে নাম্বার লিখে দেও? তার নিজের মায়া হয়েছিল। সেই দোষেই চড় খেয়েছে। ”
মাহদীর হাসি চওড়া হলো। চোখ বুঁজে থাকল কিছুক্ষণ। রেলস্টেশনের সেই মুহূর্তটি আরও এক বার স্মৃতিচারণ করে বলল,
” তোমার কথা বলার ধরণ এখনও সেই আগের মতো আছে। ”
মুহূর্তে জমে গেল নিহিতা। কথা বলার উৎসাহ দমিয়ে নিজেকেই নিজে প্রশ্ন করল, ‘ আমি কি আগ বাড়িয়ে কথা বলছিলাম? ‘ প্রশ্নের উত্তর পায় না নিহিতা। মনে পড়ে বাড়িতে সে একা। বিদ্যুৎ নেই। বাইরে তুমুল বেগে বর্ষণ হচ্ছে। সেই সাথে মানুষটির বিস্ময়কর আগমনে পুলকিত হয়। অদ্ভূত এক আনন্দের ঝড় উঠে বুকজুড়ে। বিস্ময়াভিভূত স্বরে জানতে চাইল,
” আপনি এখানে হঠাৎ? এত রাতে? ”
” কেন? এখানে আসা বারণ নাকি? কে বারণ করল? আমার শ্বশুর মশাই? ”
নিহিতার ঠোঁটের কোণে হাসি ধরা পড়ল। তবে স্পষ্ট হওয়ার পূর্বে দ্রুত বলল,
” না, না বারণ হবে কেন? মায়ের মুখে শুনেছি..”
নিহিতার কথা শেষ হওয়ার পূর্বেই মাহদী বলল,
” আগে আসতে ইচ্ছে হয়নি। এবার হলো। ”
নিহিতা সাথে সাথে কিছু বলল না। কিছুক্ষণ পর যখন বলতে চাইল তখনই মাহদী বলল,
” তুমি কি বাসায় একা? ”
নিহিতার অস্পষ্ট হাসিটুকু মিলে গেল। ঘাড় ফিরিয়ে অন্ধকার রুমে তাকিয়ে বলল,
” হ্যাঁ। ”
” তোমার আম্মা? ”
” নানি বাড়ি। ”
মাহদী চুপ হয়ে গেল। চিন্তায় পড়ে গেল খুব। না জানিয়ে এসে কত বড় ভুল করেছে বুঝতে পারছে। তার ধারণা ছিল এখানে আসার পর অস্বস্তিকর পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে। কিন্তু এখন তো মনে হচ্ছে ভীষণ সমস্যায় পড়ে গিয়েছে! নিহিতা নিশ্চয় তাকে ভেতরে ঢুকতে বলবে না। বলার হলে এতক্ষণে বলে ফেলত। তাছাড়া বললেও তো ঢোকা অনুচিত। নায়রার মুখে শ্বশুরবাড়ি সম্পর্কে যতটুকু শুনেছে ততটুকুতে অনুমান করে ফেলেছে শ্বশুর মশাই না আসা পর্যন্ত তাকে বাইরেই থাকতে হবে। মাহদী খানিকটা আশা নিয়ে জিজ্ঞেস করল,
” শ্বশুর মশাই কখন আসবেন বলে গেছেন কিছু? ”
” আসতে আসতে সকাল হবে। ”
মাহদী হতাশ চোখে ঘুরে দাঁড়াল। হঠাৎ হঠাৎ বিদ্যুৎ ঝলকানিতে ভেজা উঠোন চোখে পড়ছে। উঠোনে পা দিতে গোড়ালি পর্যন্ত ডুবে গেল। সে অবস্থায় পেছন ঘুরে বলল,
” মন সিএনজিতে ঘুমিয়ে পড়েছে। ভেতরে কি ওর শোয়ার ব্যবস্থা করা যাবে, নিহিতা? ”
মনের কথা শুনে মাত্রাতিরিক্ত অবাক হলো নিহিতা। সে ভেবেছিল মাহদী একা এসেছে। বাবার সাথে কথা বলে চলে যাবে। সে রকম হলে তো মনকে নিয়ে আসার কথা না। মা কত বার করে বলার পরও মনকে নিয়ে এ বাসায় আসেনি। তাহলে কি কিছু দিন থাকবে?
” নিহিতা? ”
মাহদীর ডাকে অতি দ্রুত গলায় বলল,
” হ্যাঁ, ভেতরে নিয়ে আসুন। ”
মাহদীর খানিকটা চিন্তা দূর হলো। ভেজা পানিতে ঝপঝপ শব্দ তুলে গাড়ির কাছে চলে গেল। ঘুমন্ত ছেলেকে কোলে জড়িয়ে দরজার সামনে এসে দাঁড়াল সে। অনুমতি চাওয়ার পূর্বেই নিহিতা বলল,
” এখানে রেখে যান। আমি আমার রুমে শুয়িয়ে দিব। ”
মাহদী স্যু ভর্তি পানি নিয়ে বসার রুমে ঢুকল। হাঁটার তালে তালে জুতোর মধ্য থেকে পানি ছিটকে পড়ছে লাল কার্পেটে। মোমের আলোতে এসব দেখার উপায় আছে কি? নিহিতা টেবিলের উপর মোম রেখে নিজেকে আগাগোড়ায় ঢেকে দূরে এক কোণে দাঁড়িয়ে আছে।
মনকে সোফায় বসিয়ে রেখে কপালে হালকা চুমু খেল মাহদী। ফিরে যাওয়ার জন্য দরজার দিকে পা ফেললে নিহিতা জিজ্ঞেস করল,
” আপনি কোথায় ঘুমাবেন? ”
” দেখি রাতটা সিএনজিতে কাটানো যায় নাকি! ”
মনকে নিজের বিছানায় শুয়িয়ে দিয়ে নিহিতাও শুয়ে পড়ল। মোমের আলো নিভিয়ে দিয়ে চোখ বন্ধ করে আপনমনে বিড়বিড় করল, ‘ আমার একটুও ভয় করছে না। ‘
________________
এরশাদ রহমান সারারাত জেগে বাসায় ফিরছিলেন ক্লান্তভঙ্গিতে। মাথাটা ঝিম ধরে আছে। চোখ দুটোতে যন্ত্রণা হচ্ছে। ভেবেছিলেন হাত-মুখ ধুয়ে নাস্তা সেরে একটু ঘুমিয়ে নিবেন। তা আর হলো কোথায়? বাসার গেইটের একটু দূরে রিক্সা থেমে গেল। রিক্সাওয়ালাকে কিছু জিজ্ঞেস করার দরকার পড়ল না। সামনে বাচ্চা-কাচ্চার জটলা দেখে কিছুটা বিরক্ত হলেন। ভাবনায়ও পড়লেন। তার বাড়ির সামনে এমন ভিড় হওয়ার কারণ কী? মনে প্রশ্ন পড়ার সাথে সাথে একটি সিএনজির দেখা মিলল। ভারি আশ্চর্য হয়ে সামনে ছুটে গেলেন। বাচ্চাদের সরিয়ে সিএনজির ভেতরে চোখ রাখতে দৃষ্টি আটকে গেল মাহদীর উপর। সে বসে বসে ঘুমাচ্ছে। এই ঘুমন্ত মুখটির দিকে চেয়ে থাকতে থাকতে সেই দিনটির কথা মনে পড়ল। যেদিন মাহদীর সাথে প্রথম দেখা হয়েছিল।
এরশাদ সাহেব গ্রামের মসজিদে ইমামতি করেন। নামাজ শেষে ধর্মীয় বিশ্বাসের বেশ গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে আলোচনা করেন নিয়মিত। মাঝে মাঝে বাড়ি বাড়ি গিয়ে নামাজের দাওয়াতও দেন। তার মার্জিত আচার-আচরণ, ধর্মের প্রতি নিখাদ বিশ্বাস, ধর্মীয় আলোচনার মাধ্যমে মানুষের মনে জায়গা করে নিয়েছেন বহু আগে। তার প্রতি সকলের শ্রদ্ধা, বিশ্বাস, সম্মান দিনকে দিন বেড়েই যাচ্ছিল। প্রশংসা ছড়িয়ে পড়ছিল আশেপাশের গ্রামে। এমন করেই গ্রামের মাহফিলগুলোর একটি স্থায়ী আসন তার নামে হয়ে গেল। সেই সুখ্যাতিতে নিজ জেলা ছেড়ে অন্য জেলাতেও ডাক পড়ত হঠাৎ হঠাৎ। তেমনই এক দাওয়াত রক্ষা করতে দূরের একটি জেলায় গিয়েছিলেন। মাহফিল শেষে যখন বাড়ি ফিরছিলেন তখনই আরেকটি দাওয়াত আসে ঢাকা থেকে। ফিরিয়ে দেওয়া সম্ভব হয়নি বলে ট্রেনে করে যাচ্ছিলেন। মাঝপথে ফুলবাড়ি স্টেশন পড়বে শুনে তার স্ত্রী মেয়েদের দিয়ে বাড়ি থেকে খাবার পাঠিয়েছিলেন। ট্রেন স্টেশনে থামলে মেয়েরা খাবার দিয়ে যায়। খাবার খেয়ে যখন একটু ঝিমুচ্ছিলেন তখন,
” সিগারেট? ”
মুখোমুখি সিটে বসা তারুণ্য কণ্ঠের ছেলেটির দিকে বিস্ময় চোখে তাকালেন এরশাদ রহমান। বাবার বয়সী একজনকে সিগারেট খাওয়ার প্রস্তাব দিচ্ছে এক ছোকরা! ভাবা যায়! আধুনিকতায় পৃথিবীর এত অধঃপতন? এরশাদ রহমান বিড়বিড় করে কিছু পড়ে বললেন,
” না, বাবা। আমি খাই না। ”
ছেলেটি ভ্রু কুঁচকে বিরক্ত প্রকাশ করল। সিগারেট নিজের ঠোঁটে পুড়ে পকেট হাতরাতে শুরু করল। সিগারেট ধরানোর মতো কিছু না পেয়ে বলল,
” আপনার কাছে দেশলাই হবে? ”
এরশাদ রহমান সহজ মনে পাঞ্জাবির পকেট থেকে একটা গ্যাস লাইট বের করে বললেন,
” দেশলাই নেই, বাবা। এটা আছে। ”
ছেলেটি বিনা বাক্যে গ্যাস লাইট নিয়ে সিগারেট ধরাল। জায়গায় বসে ধুমপান করাতে এরশাদ সাহেবের সমস্যা হচ্ছিল। এক বার বলতে চেয়েও থেমে গেলেন। ছেলেটার দিকে দু-এক বার তাকিয়ে চোখ বন্ধ করে নিতে সে বলল,
” সিগারেট খান না গ্যাস-লাইট নিয়ে ঘুরেন। ব্যাপার কি বলুন তো? আমার সামনে খেতে লজ্জা করছে দেখে মিথ্যে বলছেন? ”
এরশাদ রহমান বেশ রেগে গেলেন। প্রকাশ করলেন না। চুপচাপ থমথমে মুখে বসে থাকলে ছেলেটি আবার বলল,
” এখনকার দিনে বড়-ছোট এসবের কেউ ধার ধারে না,বুঝলেন? বাপ-ছেলের মধ্যেও সিগারেট শেয়ার চলে। ”
কথাটা বলে দাঁত বের করে হাসল ছেলেটি। এরশাদ রহমান সেই হাসির দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালেন। জিজ্ঞেস করতে চাইলেন, ‘ তুমিও কি তোমার বাবার সাথে সিগারেট খাও? ‘ করা হলো না। তার আগেই যোহরের আযান পড়ল। ছেলেটির দিকে নরম চোখে চেয়ে বললেন,
” চলো এক সাথে নামাজ পড়ি। ”
ছেলেটি ভ্রু বাঁকিয়ে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে বলল,
” আমি নামাজ পড়ি না। ”
” কেন? তুমি মুসলিম না? ”
ছেলেটি সাথে সাথে উত্তর দিল না। সিগারেটে শেষ টান দিয়ে বাইরে ফেলে বলল,
” না। ”
” তুমি হিন্দু? ”
এরশাদ রহমানের কন্ঠে বিস্ময়ের ঢল! তিনি কিছুতেই বিশ্বাস করতে চাচ্ছেন না ছেলেটি হিন্দু। তাই আবারও প্রশ্ন করলেন,
” তুমি আসলেই হিন্দু? ”
” না। ”
” তাহলে? ”
” দুনিয়াতে কি মুসলমান, হিন্দু ছাড়া আর কোনো ধর্ম নেই? ”
এরশাদ রহমান কিছু একটা বলতে চাইলেন। ছেলেটি বাঁধা দিয়ে বলল,
” আমি এখন ঘুমাব। ”
ছেলেটি সত্যি সত্যি চোখ বন্ধ করে সিটে হেলান দিল। তার মুখের দিকে কতক্ষণ চেয়ে থেকে অনুরোধের সুরে বললেন,
” পাঁচ মিনিট পরে ঘুমালে হয় না, বাবা? ”
” কেন? ”
” আমি একটু নামাজটা আদায় করে নিতাম। ”
” করুন। তাতে আমার কী? নামাজের সাথে আমার ঘুমের কী সম্পর্ক? ”
” তুমি আমার সামনে থাকলে সিজদাহ দিব কিভাবে? ”
ছেলেটি সিট থেকে পিঠ আলগা করল। বিরক্ত গলায় বলল,
” কেন? আমি কি আপনার মাথা ধরে রাখব? ”
এরশাদ রহমান বুঝাতে চাইলেন কোনো মানুষকে সামনে রেখে সিজদাহ্ দিতে নেই। তার আগেই ছেলেটি উঠে দাঁড়াল। আরেকটি সিগারেট মুখে ঢুকিয়ে বলল,
” তখন গ্যাস লাইট দিয়ে উপকার করেছেন তাই আপনাকে পাঁচ মিনিট সময় দিয়ে শোধ দিলাম। মাহদী উপকার ফেরত দেওয়ার সুযোগ পেলে কখনও মিস করে না! ”
একটা বাচ্চার ধাক্কাতে এরশাদ সাহেবের দৃষ্টি নড়ল। মাহদীর দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে চলে যাচ্ছিল তখন,
” আসসালামু আলাইকুম, বাবা। ”
এরশাদ রহমান থমকালেন। পেছন ঘুরে তাকালে মাহদী সিএনজি থেকে নামতে নামতে বলল,
” বাসার মেহমানকে রাস্তায় ফেলে চলে যাচ্ছেন? ”
চলবে
#নিষিদ্ধ_বরণ
#রোকসানা_রাহমান
পর্ব (৪)
” বাসার মেহমানকে রাস্তায় ফেলে চলে যাচ্ছেন? ”
মাহদীর অকস্মাৎ প্রশ্নে এরশাদ রহমান থমকালেন। ঘাড় বাঁকিয়ে একবারটি চাইলেনও কিন্তু মুখে কিছু বললেন না। নীরব চালে বাসার গেইটের সম্মুখে এসে ভ্রু কুঁচকালেন। পাশে না তাকিয়ে বুঝতে পারলেন মাহদী তার পাশাপাশি হাঁটছে। গম্ভীর মুখে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলেন। মুহূর্তকাল পর ভেতরে ঢোকার জন্য পা ফেললে মাহদী বলল,
” নায়রা সবসময় বলতো তার বাবা কারও উপর রাগ করলেও কথা বলা বন্ধ করেন না৷ অথচ আপনি আমার সাথে ছয় বছর ধরে কথা বলছেন না। তাহলে কি নায়রার ধারণা মিথ্যা? ”
এরশাদ রহমান আবারও থামলেন। এবার ফিরে তাকালেন মাহদীর দিকে। মাহদী একপা ভেতরে এগিয়ে বলল,
” আমি হয়তো আপনার মতো করে নায়রাকে ভালোবাসতে পারিনি। কিন্তু আমার মতো বেসেছি। হৃদয় উজার করে! তার বিশ্বাস ছিল, আমি আপনার সাথে কথা বলতে চাইলে আপনি মুখ ফিরিয়ে নিবেন না। ”
মাহদী হাঁটতে হাঁটতে এরশাদ রহমানের নিকট এসে দাঁড়াল। মাথাটা কিঞ্চিৎ ঝুকিয়ে বিনয়ী গলায় বলল,
” আমি চাই না নায়রার বিশ্বাস মিথ্যা হোক। আপনার সম্পর্কে তার ধারণা ভুল হোক। বাবা, আমি এখানে ক্ষমা চাইতে আসিনি। সম্পর্কটা দৃঢ় করতে এসেছি। ”
এরশাদ রহমানের তাকানো ভঙ্গি বদলাল না। মুখের ভাব পাল্টাল না। পূর্বের মতোই মাহদীর দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলেন। মাহদীকে পেছনে ফেলে উঠোন পেরোলেন। দরজার নিকট পৌঁছাতে একটা বাচ্চা তার কোমর জড়িয়ে ধরল। উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বলল,
” নানাজান! ”
নরম তুলতুলে স্পর্শে এরশাদ রহমানের গম্ভীর ভাব ছুটে গেল। মনের নিষ্পাপ, নির্মল, পবিত্র মুখখানা দেখেই চোখ দুটো আনন্দে প্রজ্জ্বলিত হলো। নিমিষেই দূর হয়ে গেল তনু-মনের সকল ক্লান্তি। মনকে কোলে তুলে নিয়ে সুধালেন,
” আমার নানাভাই কেমন আছে? ”
মন নানার গলা জড়িয়ে বলল,
” খুব ভালো। ”
কথাটা বলেই একগাল হাসল মন। চোখে-মুখে তার দারুন উচ্ছ্বাস। যেন দীর্ঘ দিন পর পাখি তার নীড়ে ফিরেছে! এরশাদ রহমানের ঠোঁটের হাসি স্পষ্ট হলো। মুগ্ধ চোখে দেখছেন নাতিকে। এই নবীন চোখ, নাক, ঠোঁটে গড়া বদনখানির আড়ালে কার ছায়া খুঁজে বেড়াচ্ছেন? অস্থির চিত্তে কার মুখটা বার বার ভেসে উঠছে? কার জন্য চোখ দুটোতে জল চিকচিক করছে?
” নানাজান, আমাকে দেখে তুমি খুশি হওনি? ”
এরশাদ রহমানের গলা ধরে এসেছে প্রায়। বার কয়েক ঢোক গিলে স্বাভাবিক গলায় বললেন,
” খুশি হব না কেন? খুব খুশি। মনে হচ্ছে আকাশ থেকে চাঁদটা টুপ করে আমার হাতে পড়েছে। ”
” তাহলে তোমার চোখে পানি কেন? ”
এরশাদ রহমান চোখের পানি লুকাতে চাইলেন। হিতে বিপরীত হলো। চোখের কোল দুটো বর্ষার নদীর মতো থৈ থৈ করে উঠল। নদীর পানি কিনার ছাপিয়ে গড়িয়ে পড়ার আগেই কণ্ঠ ছাড়লেন,
” নিহিতা? মা নিহিতা? ”
নিহিতা সকালের নাস্তা বানাচ্ছিল। বাবার গলা পেয়ে রুটি ফেলে ছুটে এলো। আশে-পাশে খেয়াল না করে দরজা ছেড়ে বাইরে এসে দাঁড়িয়ে বলল,
” বাবা, আপনি কখন এলেন? দাঁড়ান আমি পা ধোয়ার পানি নিয়ে আসছি। ”
নিহিতা ব্যস্ত চালেই ভেতরে ফিরে গেল। মিনিটের মধ্যে পানি নিয়ে হাজির হলো। বাবার পায়ে পানি ঢালতে গিয়ে চোখ পড়ল বাবার পেছনে। সাথে সাথে লজ্জায় কুঁকড়ে গেল। অবশ শরীরে বিড়বিড় করল, ‘ আমি এতক্ষণ এই মানুষটার সামনে দৌড়াদৌড়ি করছি? এই খোলামেলা পোশাকে? ‘ নিহিতা পানি রেখে ভেতরে চলে গেল। পর্দার আড়ালে লুকিয়ে বলল,
” বাবা, উনার সাথে কি আপনার আলাপ হয়েছে? ”
এরশাদ রহমান মেয়ের দিকে তাকালেন। পর পরই মাহদীর দিকে। তারপর পা ধোয়ায় মনোযোগ দিলেন। পানির মগ হাতে নেওয়ার জন্য ঝুঁকতে মন কোল থেকে নেমে পড়ল। পানির মগের ভেতর হাত ডুবিয়ে দিল। এক হাতে পানি ফেলছে অন্য হাতে পা ডলে দিচ্ছে। তার এই কাণ্ডে বিস্ময়ে স্তব্ধ এরশাদ রহমান। মুহূর্তে মনের জায়গায় একটা বাচ্চা মেয়েকে কল্পনা করে ফেললেন। যে হাসতে হাসতে পা ধুয়ে দিচ্ছে আর বলছে,
” আমার বাবার পা আয়নার মতো ঝকঝকে। দেখ আমার মুখ দেখা যাচ্ছে! ”
এরশাদ রহমান এতক্ষণে উপলব্ধি করল, নায়রার মতো মনও তাকে তুমি তুমি করে বলে। তার পরিবারের একমাত্র নায়রায় তাকে ‘তুমি’ সম্বোধন করত।
” নানাজান, হয়েছে? ”
মনের কণ্ঠে এরশাদ রহমানের সম্বিৎ পড়ল। নাতির কপালে চুমু খেয়ে বললেন,
” হয়েছে তো। একদম আয়নার মতো চকচকে করছে। ”
মন হাসল। সেই হাসিতে গড়িয়ে পড়ল আকাশ মাপের খুশি সমুদ্র মাপের আনন্দ। এরশাদ রহমান মনের গাল ছুঁয়ে দিলেন। চুলে হাত বুলিয়ে দিলেন। আগের মতো কোলে তুলে মেয়ের উদ্দেশ্যে বললেন,
” দক্ষিণ ঘরের চাবিটা নিয়ে আয়৷ ”
নিহিতা চাবি এনে দিল। এরশাদ রহমান নাতিকে কোলে নিয়ে মাহদীর সন্নিকটে এলো। চাবিখানা তার হাতে দিয়ে বলল,
” জামা-কাপড় পাল্টে গোসল করে নেও। আমি নাস্তা পাঠিয়ে দিচ্ছি। ”
কথাটা বলেই এরশাদ রহমান বড় ঘরের মূল দরজার ভেতর হারিয়ে গেলেন।
_________________
নাস্তা শেষে একটু বাইরে বের হলো মাহদী। মন তার নানার সাথে কোথাও একটা গিয়েছে বিধায় সে একাই বেরিয়েছে। মাটি রাস্তা পার হয়ে ইটে রাস্তায় পা রাখতে একটা রিক্সা দাঁড় করাল। কী ভেবে রিক্সায় উঠে বসল। রিক্সাওয়ালা জিজ্ঞেস করল,
” কোনটে যাবেন, ভাই? ”
” ফুলবাড়ি সরকারি কলেজ। ”
রিক্সার ছুটে চলা রাস্তার ধারে গাছপালায় ভরা। সজনে গাছের নরম হাওয়াই মাহদীর চুল উড়ছে। হৃদয়ে মৃদু দোলা দিচ্ছে। উদাসীন চোখ জোড়া কোথাও হারিয়ে যাচ্ছে,
“এক্সকিউজ মি ম্যাম। ”
মাহদীর ডাকে বোর্ডে হিসাব কষায় ব্যস্ত মাঝ বয়সী শিক্ষিকা বিরক্ত চোখে তাকালেন। মাহদী মনোযোগ পেয়ে বলল,
” নায়রাকে কিছু সময়ের জন্য ছাড়া যাবে? ”
ফিন্যান্সের শিক্ষিকা বোর্ড থেকে মার্কার সরিয়ে নিলেন। মাহদীর দিকে ঘুরে দাঁড়ালেন। ভ্রু কুঁচকে আগাগোড়া পর্যবেক্ষণ করে বললেন,
” কেন? ”
” জরুরি কথা আছে। ”
” কী কথা? ”
এ পর্যায়ে মাহদীর মেজাজ নষ্ট হলো। ভদ্র চাহনি হারিয়ে গেল। বিনয়ী ভাব ছুটে গেল। অনুমতির পরোয়া না করে ক্লাসের মধ্যে ঢুকে পড়ল। দ্রুত চোখ বুলিয়ে নিল পুরো ক্লাসে। নায়রাকে পেল একদম সামনে থেকে দ্বিতীয় বেঞ্চে। কাঙ্ক্ষিত মানুষটিকে পেয়ে ঠোঁটের কোণে খুশির টান পড়ল। নায়রার কাছে ছুটে গিয়ে বলল,
” বাইরে এসো কথা আছে৷ ”
নায়রা ভয়ে পাশে সরে বসল। ভীত চাহনি আঁকল ম্যামের দিকে। মাহদী সে চাহনি উপেক্ষা করে আচমকা নায়রার হাত ধরে ফেলল। ক্লাস থেকে বের করে নিয়ে আসল জোর করে। পেছনে গম্ভীর মুখের শিক্ষিকার চেঁচামেচি কানেই তুলল না।
নায়রাকে টেনে নিয়ে এসে দাঁড়াল মাঠের ঠিক মাঝে। ক্লাস চলছিল বিধায় তখন পুরো মাঠ ফাঁকা। নায়রার হাত ছেড়ে সবুজ ঘাসে বসে পড়ল মাহদী। নায়রাকে টেনে বসিয়ে বলল,
” কাল রাতে তোমার বাবাকে কল দিয়েছিলাম। ”
নায়রা ভয়ে শক্ত হয়ে গেল। হাত-পা অবশ হয়ে যাওয়া অবস্থা! রক্ত শূন্য চোখে তাকালে মাহদী বলল,
” তোমার বাবার ব্যবহার অত্যন্ত খারাপ। প্রথমে সুন্দর করে কথা বললেও পরবর্তীতে যখন তোমাকে চাইলাম সঙ্গে সঙ্গে কল কেটে দিলেন। কাজটা কি ঠিক করেছে, নায়রা? তার দুর্ব্যবহারের কারণে আমাকে ঢাকা থেকে এখানে ছুটে আসতে হলো। ঘাম ঝরিয়ে, টাকা দিয়ে তোমার কলেজের নাম জানতে হয়েছে। ভাগ্যিস গ্রামের লোক তোমাকে চিনত! ”
মাহদী একটু থামল। নায়রার চোখ দুটোতে চেয়ে আচমকা বলল,
” তুমি কিন্তু আমার হাতে চড় খাওয়া প্রথম মেয়ে নও। তুমি কত নাম্বারে আছ নিশ্চিত বলতে পারছি না। তবে দশের পরে একটা হবে। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হলো এই প্রথম কোনো মেয়েকে চড় দেওয়ার পর আমার দুঃখ হচ্ছে, খারাপ লাগছে। মনের ভেতর অশান্তি লাগছে। কেন বলো তো? ”
চলবে