#নিষিদ্ধ_বরণ,২১,২২
#রোকসানা_রাহমান
পর্ব (২১)
নিহিতা কথার মাঝেই নিজের গাল বাড়িয়ে বলল,
” চাইলে চড়ও মারতে পারেন। আমি কিছু মনে করব না। ”
মাহদী অগ্নি ঝরা দৃষ্টিতে তাকাল। দুটো তপ্ত নিশ্বাস ছেড়ে হাত মুষ্টিবদ্ধ করে ক্রোধ সংযত করছে। দৃষ্টি সরিয়ে বিদ্রুপ করে বলল,
” আমার ভাবতেই কষ্ট হচ্ছে তুমি নায়রার বোন! ”
নিহিতা অপমান বোধ করল না। খুশি হয়েছে এমনভাবে তাকাল। মৃদু হেসে বলল,
” আমারও ভাবতে কষ্ট হয়, আপনি আপুর স্বামী। ”
একটু থেমে আবার বলল,
” কষ্টটা একটু বেশিই হয়। অসহ্য রকমের। আপনি কি বুঝতে পারেন? ”
মাহদী উত্তর দিল না। নিহিতার মুখের উপর দরজা লাগিয়ে দিল। সে সময় মন দৌড়ে এলো কোথাও থেকে। নিহিতার কাছে দাঁড়িয়ে বলল,
” খালামনি, তুমি আবার আম্মু সেজেছ? ”
নিহিতা মনের সামনে হাঁটু গেড়ে বসল। গাল টেনে মিষ্টি করে বলল,
” হ্যাঁ। ”
” কেন? ”
” আমার আম্মু সাজতে ভালো লাগে। ”
মন একটু চুপ থেকে বলল,
” আমার যে খালামনি সাজে বেশি ভালো লাগে? ”
” কেন? ”
” খালামনি সাজলে বাবা খুশি হয় তাই। ”
নিহিতা একটু অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল,
” বাবা বলেছে? ”
” না। ”
” তাহলে জানলে কিভাবে? ”
মন সতর্ক দৃষ্টিতে এদিক-ওদিক তাকিয়ে ফিসফিসে বলল,
” তুমি যেদিন আম্মু সাজ সেদিন বাবার চোখ লাল হয়ে থাকে। আমি ভয়ে কাছে যাই না। একা একা ঘুমাই। ”
” তাই? ”
মন মাথা উপরনিচ নাড়ালে নিহিতা বলল,
” আর বাবা? তিনি ঘুমান না? ”
মন উত্তর দেওয়ার সুযোগ পেল না। আসমা রহমানের গলা পাওয়া গেল,
” নিহিতা, মাহদী এসেছে? ”
আসমা রহমানের হাতে বাদামী রঙের কাগজ মোড়ানো একটি প্যাকেট। নিহিতার হাতে প্যাকেটটি দিয়ে আগের প্রশ্নটি আবার করলেন,
” মাহদী এসে পড়েছে? ”
” হ্যাঁ। ”
আসমা রহমান বোরকা খুলছিলেন। মেয়ের কাছ থেকে উত্তর পেয়েই গলার স্বর বদলে গেল,
” তাহলে তুই এখানে কী করছিস? ”
মায়ের প্রশ্নে নিহিতা চমকে তাকাল। চোখেমুখে ভয়! আসমা রহমান খানিকটা ধমকের সুরেই বললেন,
” রুমে যা, আমি না ডাকলে বাইরে বের হবি না। ”
নিহিতা মনকে ছেড়ে চুপচাপ পাশের রুমে ঢুকে গেল। আসমা রহমানের দৃষ্টিতে সন্দেহ। তিনি বিশ্বাসই করতে পারছেন না তার সচেতন মেয়েটা জামাকাপড় ছাড়াই এত দূর বেড়াতে চলে এসেছে! মেয়েদের যে প্রতি মাসের একটি বিশেষ দিন মনে রাখতে হয় সেটাও ভুলে গিয়েছে।
_________________
মন বালিশে শুয়ে বাবার জন্য অপেক্ষা করছিল। আসছে না দেখে উঠে পড়ে। বাবার কাছে এসে দাঁড়ালে মাহদী বলল,
” মন, দেখ তো আশেপাশে কোথাও তোর মায়ের কিছু আছে নাকি। ”
বাবার আদেশ পেয়েই মন পুরো রুমে তল্লাশি চালিয়ে একটা রাবার ব্যাণ্ড পেল। বিজয়ী কণ্ঠে বলল,
” এটা আছে। ”
মাহদী রাবার ব্যাণ্ড হাতে নিয়ে দেখল ধূলো লেগে আছে। পরনের টি-শার্টের বুকের কাছটায় ময়লা মুছে কাঠের বক্সটাতে রাখল। তালাবদ্ধ করে আলমারিতে রেখে বলল,
” ঘুমাবি চল, সকালে আমার সাথে উঠবি। ”
মন বিছানায় উঠতে উঠতে মনে করিয়ে দিল,
” আমি তো রোজ তোমার সাথেই উঠি, বাবা। ”
মাহদীর মনে পড়েছে এমন ভাব করে বলল,
” হ্যাঁ। কিন্তু অন্য সময় নিজ ইচ্ছেয় উঠিস, কাল আমার ইচ্ছেতে উঠবি। ”
মন মাথা নেড়ে বুঝাল সে উঠবে। তারপর বাবার বুকে ঘাপটি মেরে চোখ বন্ধ করে নিল।
পরের দিন সকালে মনের হাতে কিছু জিনিসপত্র দিয়ে বলল,
” আজ তোর যা যা দরকার হবে সব এখানে আছে। এগুল নানির কাছে রেখে আয়। ”
মন নানির রুমের দিকে দৌড় দিলে মাহদী নিজের রুমের দরজায় তালা দিল। চাবি নিয়ে শাশুড়ির রুমের বাইরে দাঁড়িয়ে নরম স্বরে ডাকল,
” আম্মা? ”
আসমা রহমান বেরিয়ে আসলে তার হাতে চাবি দিয়ে বলল,
” ঐ রুমে আপনি ছাড়া আর কাউকে ঢুকতে দিবেন না। ”
______________
দুপুরে খেতে আসার পূর্বে নামাজ পড়ে নেয় মাহদী। মসজিদ থেকে বের হয়ে টুপি খোলা হয়নি। সেভাবেই বাসার কলিংবেল বাজিয়ে বাইরে অপেক্ষা করছিল। দরজা খোলার শব্দে সামনে তাকাতে বিস্মিত কণ্ঠে বলল,
” আব্বু! ”
ছেলের কণ্ঠে আব্বু ডাকটা যেন আতাউল করিমের হৃদয়ে গিয়ে বিঁধল। এক সুখকর ব্যথা অনুভূত হতে চোখের কোণে জল জমতে শুরু করে। গড়িয়ে পড়ার আগেই মাহদীকে বুকে জড়িয়ে নিয়ে বললেন,
” বাবাদের কি মুখে বলতে হয় মাফ করে দিয়েছি? ”
মাহদী নীরব থাকলে আতাউল করিম পুনরায় বললেন,
” আমি শুধু দেখতে চেয়েছিলাম তোর পরিবর্তনটা কয়েক দিনের নাকি সারাজীবনের। সেজন্য সেদিন ফিরিয়ে দিয়েছিলাম। ”
এবার মাহদী কথা বলল,
” কী মনে হচ্ছে? পরিবর্তনটা কয়েক দিনের নাকি সারাজীবনের? ”
আতাউল করিম মাহদীকে ছেড়ে দাঁড়ালেন। কিছুক্ষণ মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে বললেন,
” অনিশ্চিত উত্তরটা না-ই দিলাম। শুধু বলব, তোকে এই রূপে দেখলে বউমা খুশিতে কেঁদে ফেলত। ”
সামান্য বিরতি টেনে আবার বললেন,
” বউমার খুশির জল দেখতে পারলাম না বলে ভারি আফসোস হচ্ছে! ”
বাবার আফসোসের ফেলা ভারি নিশ্বাসটা মাহদীর বুকে ব্যথার ঝড় তুলে দিল। সেই ঝড়ে এলোমেলো হয়ে স্মৃতির ডায়রী খুলে বসল মাহদী।
তখন নায়রা আট মাসের অন্তঃসত্ত্বা। পেটের সাথে হাত, পা, মুখও অস্বাভাবিকভাবে ফুলে গেছে। বেশিক্ষণ হাঁটতে পারে না। ইচ্ছে হলেই বসতে পারে না। খাবার-দাবারে খুব অনিহা। এমন অবস্থায়ও সে চেয়ারে বসে নিয়ম করে নামাজ পড়ে, কোরআন তেলাওয়াত করে। এমনি একদিন নামাজের পর তেলাওয়াত শেষ করে উঠে দেখে মাহদী তার দিকে এক দৃষ্টিতে চেয়ে আছে। সে হালকা হেসে কোরআন শরীফে চুমু খেয়ে বলল,
” কী দেখছ? ”
মাহদী বসা থেকে উঠে এসে কোরআন শরীফ নিজের কাছে নিয়ে বলল,
” তোমার কষ্ট। ”
” কষ্ট? ”
” হ্যাঁ। সেজদা দেওয়ার সময় তুমি কাঁপছিলে। কোরআন পড়ার সময় ঘন ঘন নিশ্বাস ছাড়ছিলে। এত কষ্ট করা কি জরুরি? ”
নায়রা সাথে সাথে উত্তর দিল না। ধীর পায়ে খাটে বসতে চাইলে মাহদী এসে ধরল। পাশে বসে বলল,
” তোমার কষ্ট দেখলে আমার খারাপ লাগে, নায়রা। ”
নায়রা মাহদীর কাঁধে মাথা রাখে। স্বামীর হাতটা শক্ত করে চেপে ধরে কোমল স্বরে বলল,
” যার দয়ায় পৃথিবীতে নিশ্বাস নিচ্ছি তাকে ভালোবাসতে আবার কষ্ট কিসের? আমার তো আনন্দ হয় এই ভেবে যে, এখনও তার নাম জপতে পারছি! ”
নায়রার কথায় মাহদী খুশি হলো না, দুঃখও পেল না। নীরবে নায়রার তৃপ্তিভরা হাসিখানা দেখল। মুহূর্তকাল পর বলল,
” আমাকে নামাজ পড়ার জন্য জোর কর না কেন, নায়রা? এমনও তো হতে পারে, জোর করলে আমি..”
মাহদীকে কথা শেষ করতে না দিয়েই নায়রা উত্তর দিল,
” আমি চাই না তুমি আমাকে খুশি করতে নামাজ পড়ো। ”
মাহদী চুপ হয়ে গেলে নায়রা আবার বলল,
” আমি চাই তুমি আল্লাহকে খুশি করতে তাঁর পথে আসো। তবেই না জান্নাত উপহার পাবে। ”
নায়রার কথার গাম্ভীর্য অর্থটা মাহদী ধরতে পারল না। কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল,
” আমি যদি হঠাৎ বদলে যাই, তুমি আমাকে খুব ভালোবাসবে তাই না? ”
” না। ”
নায়রার উত্তরে মাহদী অবাক হলো। আশ্চর্যান্বিত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল,
” ভালোবাসবে না? ”
” অবশ্যই বাসব। এখন যেমন বাসি তেমন। ”
মাহদী মুখ বাঁকিয়ে বলল,
” তাহলে পালটে কী লাভ! ”
নায়রা মৃদু হাসল। মাহদীর গালে হাত রেখে নিজের দিকে ঘুরিয়ে বলল,
” গুণ দেখে ভালোবাসা কম-বেশি হয় না, গুণ দেখে সম্মান আর শ্রদ্ধা কম-বেশি হয়। তুমি হঠাৎ পালটে গেলে তোমার প্রতি আমার সম্মান বাড়বে, শ্রদ্ধা বাড়বে। বাবার সামনে চোখ তুলে গর্ব নিয়ে বলতে পারব, আল্লাহর প্রতি বিশ্বাসের প্রতিদান পেয়েছি। ”
নায়রার কথাগুলো মাহদীর ভেতরটা কাঁপিয়ে দিলেও স্বভাব পাল্টাতে পারেনি। এতে যেমন নায়রার মন খারাপ হয়েছিল তেমন মাহদীরও। একদিন মাহদী মনখারাপের সুরে বলেই ফেলল,
” আমি তোমার সম্মান বাড়াতে অক্ষম। ”
নায়রা হেসে বলেছিল,
” তোমার নামের অর্থ কী জানো? ”
” কী? ”
” সৃষ্টিকর্তা দ্বারা পথপ্রদর্শিত। তোমাকে সঠিক পথে আনার দায়িত্ব স্বয়ং আল্লাহ নিয়েছেন। তুমি অধৈর্য্য হলেও আমি ধৈর্য্য হারাব না। তাঁর সময়মতো তোমাকে ঠিক পথে আনবেন। আমি তো সেই সময়ের অপেক্ষায় আছি। ”
মাহদী দীর্ঘস্বাস ফেলে স্মৃতির ডায়রী বন্ধ করে আপনমনে বলল, ‘ সে সময় এসেছে, নায়রা। অথচ, তুমি নেই! ‘
__________________
নিহিতা এশারের নামাজ পড়তে বসল অস্থিরমনে। মাহদী প্রতিদিন সন্ধ্যা সাতটার সময় বাসায় আসলেও আজ আসেনি। ঘণ্টার কাঁটা সাতটা পার হতেই সে চিন্তায় পড়ে। চিন্তা দুশ্চিন্তায় পরিণত হলো রাত আটটায়। এশারের আজান শুনতে শুনতে মাহদীর নাম্বারে কল করে, রিসিভ হয় না। বেশ কয়েকবার কল করার পরও যখন ধরল না তখন মেসেজ পাঠায়। উত্তর আসেনি। এদিকে মা ওযু করার জন্য তাড়া দিয়ে নিজেও ওযু করে নেয়। জায়নামাজ বিছিয়ে যখন নিয়ত বাঁধল তখন নিহিতার মনে পড়ল হয়তো মা কিছু জানে। এখন প্রশ্ন করা যাবে না দেখে নিজেও ওযু করে জায়নামাজে বসে। ঠিক করে নামাজ শেষ হলে জিজ্ঞেস করবে।
মাহদীর ভাবনায় নিহিতা খেয়ালই করল না সে নিয়ত ভুল করেছে। চার রাকাতের জায়গায় তিন রাকাত সুন্নত পড়েছে। সালাম ফেরাতে গিয়ে ঘাড়ের পাশে না তাকিয়ে দরজার দিকে তাকাচ্ছে। জায়নামাজে মনোযোগ না রেখে কান খাড়া করে শুনছে কলিংবেল বাজছে নাকি। সুন্নত শেষে ফরযের এক রাকাতের সেজদা করতে হঠাৎ কলিংবেল বেজে উঠল। নিহিতা জায়নামাজ ফেলে শশব্যস্ত হয়ে দরজা খুলে দিল। মাহদী নিহিতার দিকে না তাকিয়ে ভেতরে ঢুকছিল। নিহিতা উদ্বিগ্নচিত্তে জিজ্ঞেস করল,
” এত দেরি করে এলেন? আমার চিন্তা হচ্ছিল। কল করেছিলাম, ধরেননি কেন? ”
নিহিতাকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে ডাইনিং পার হচ্ছিল মাহদী। কী মনে করে পাশের রুমে তাকাল। ফাঁকা জায়নামাজে দৃষ্টি পড়তে প্রশ্ন করে বসল,
” তুমি নামাজ ছেড়ে এসেছ? ”
নিহিতার চেতন ফিরল বুঝি। খোলা দরজার দিকে তাকাতে সেও জায়নামাজ দেখতে পেল। সভয়ে অস্পষ্ট স্বরে বলল,
” হ্যাঁ। ”
মাহদী অকস্মাৎ নিহিতার ডান হাতের কনুই চেপে ধরল। দ্রুতকদমে বাইরে হেঁটে চললে নিহিতা জিজ্ঞেস করল,
” কী করছেন? হাত ছাড়ুন। আম্মু দেখতে পাবে। ”
মাহদী কোনো উত্তর দেওয়ার প্রয়োজনবোধ করল না। মূল দরজা পেরিয়ে রাস্তায় নেমে আসল। খালি রিকশা ডেকে বলল,
” উঠো। ”
চলবে
#নিষিদ্ধ_বরণ
#রোকসানা_রাহমান
পর্ব (২২)
নিহিতাকে রিকশায় উঠিয়ে মাহদীও পাশে বসল। তাকে স্বাভাবিক হওয়ার সুযোগ না দিয়েই মাহদী বলল,
” সেদিন তোমাকে গল্প শোনানোর সময় তন্বীর কথা বলেছিলাম মনে আছে? ”
নিহিতা চোখ উল্টে তাকাল মাহদীর মুখটায়। শীতল চোখ জোড়ায় দৃষ্টি স্থির রাখতে পারল না। সরিয়ে বলল,
” হ্যাঁ। আপনার বন্ধু ছিল। আপনাকে বিয়ে করতে চেয়েছিল দেখে চড় মেরেছিলেন। ”
মাহদী বাঁকা হাসল। পর মুহূর্তে রাশভারী গলায় বলল,
” ভেবেছিলাম তোমার জন্য অতটুকুই যথেষ্ট। কিন্তু আমি ভুল। তোমাকে পুরোটা বলা উচিত ছিল। তাহলে হয়তো আজ আমায় তোমার পাশে রিকশায় বসতে হতো না। ”
নিহিতার দৃষ্টি ফিরে এল মাহদীর মুখে। চোখেমুখে রাজ্যের বিরক্তি, নিশ্বাসে আফসোসের ভারি ধাক্কা! নিহিতার কষ্ট হলো। মন খারাপের চাহনি ফেলে বলল,
” তন্বী আরও কিছু করেছিল? ”
মাহদী বোধ হয় নিহিতার প্রশ্নটা শুনল না কিংবা উপেক্ষা করে বলল,
” ঝামেলাটুকু সেখানেই শেষ হতে পারত, হলো না। আমার আর তন্বীর পরিবারের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কটা নষ্ট হয়ে গেল। বাবা রেগে গেলেন খুব। আম্মুকে কথা শুনাতে শুরু করলেন। ব্যাপারটা শেষ হচ্ছিল না। সময়ের সাথে সাথে বড় হচ্ছিল। এদিকে আমি ছিলাম ভীষণ আম্মু ভক্ত। বাবার এই রাগারাগিটা মেনে নিতে পারছিলাম না। বার বার মনে হচ্ছিল, আমার কোনো দোষ নেই। তন্বীর বলা পুরো বক্তব্যটাই যে মিথ্যে বাবাকে বিশ্বাস করাতে পারছিলাম না। একরাতে এটা নিয়ে বাবার সাথে আমার বেশ তর্ক চলছিল। তর্কাতর্কির এক পর্যায়ে তিনি আমাকে বেয়াদবের আখ্যা দিয়ে শরীরে আঘাত করতে লাগলেন। আমি বাঁধা দেইনি, প্রতিবাদ করিনি, চোখ তুলে তাকায়নি পর্যন্ত। আমি চুপচাপ সহ্য করলেও আম্মু পারছিল না। তিনি ছুটে এলেন আমাকে বাঁচাতে। বাবা বার বার বলছিলেন সরে যেতে। আম্মু শুনছিল না। যতটা পারছিল আমাকে আড়াল করে নিচ্ছিল। বাবা প্রচণ্ড রেগে গিয়ে আম্মুর গালে একটা চড় মেরে বসলেন। মুহূর্তে আমার মাথায় রক্ত উঠে যায়। নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়ি। আম্মুর চোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়তে না পড়তে বাবার নাক সই ঘুষি মেরে বসি। ”
এতটুকু বলে মাহদী থামল। নিহিতার দিকে তাকিয়ে বলল,
” আমার এক আঘাতে বাবাকে হসপিটালে ভর্তি হতে হয়েছিল। আমি একবারের জন্যও হাসপাতালে যাইনি, বাড়িতেও না। আম্মু প্রায় কল করে কান্নাকাটি করতেন, তবুও আমাকে বাড়িতে নিতে পারেনি। তার কয়েক বছর পর আম্মু আর আব্বুকে একসাথে দেখেছিলাম তোমাদের বাড়িতে। আমি শুধু আম্মুকে ফোন করে বলেছিলাম বিয়ে করব। ব্যস! তারা ছেলের বউকে নিতে ছুটে এলেন। যদিও সেদিন বউমাকে নিতে পারেনি। তোমার বাবা বিয়েতে অমত করেছিল। এসব তো তুমি জানোই। যেটা জানো না সেটা বলি। নায়রাকে নিয়ে কিন্তু আমি বাবার বাড়িতে উঠিনি। আমার বাড়িতে উঠেছিলাম। আম্মু আমাকে বোঝানোর চেষ্টা করছিল অনেক। যখন দেখল কাজ হচ্ছে না তখন নায়রাকে বলতে শুরু করল। সে তো একটুতেই গলে গেল! শ্বশুরবাড়ি যাওয়ার বায়না ধরা শুরু করল। তার যাতে মন খারাপ না হয় সেজন্য বলেছিলাম, আমি যাব না। তুমি ঘুরে এসো। নায়রা রাজি হলো। আমার আম্মু এসে তাকে নিয়ে গেল। সেখান থেকে ঘুরে এসেই সে শ্বশুরের সাফাই গায়তে শুরু করল। সুযোগ পেলেই আমাকে বলত, আমি ভুল করেছি। ক্ষমা চেয়ে সম্পর্ক ঠিক করা উচিত। তার কথায় আমার মন নরম হওয়ার বদলে আরও পাষাণ হয়ে গেল। কড়া করে বলে দিলাম, ঐ বাড়িতে যাওয়া নিষেধ। তার কণ্ঠে যেন আর কখনও বাবার কথা না শুনি। নায়রা আমার আদেশটা খুব হালকাভাবে নিল। জানত, আমার কাছে অনুমতি চাইলে পাবে না৷ তাই ঐ বাড়ি যাচ্ছে এমন একটা মেসেজ দিয়ে চলে যেত।
আমি কেন জানি নায়রাকে বকতে পারতাম না, রাগ দেখাতে পারতাম না। এদিকে শ্বশুরবাড়ি গিয়ে শ্বশুরের যত্ন-আত্তি করাটাও আমার সহ্য হচ্ছিল না। তবুও রাগটা চেপে যাচ্ছিলাম। নায়রার প্রেগন্যান্সির বয়স যখন সাতে পড়ল তখন খুব সুন্দর করে বলেছিলাম, ‘ তুমি শুধু শুধু এসব করছ। আমি কখনই তার কাছে ক্ষমা চাইব না, ঐ বাড়িতেও যাব না। এ অবস্থায় তোমাকে একা ছাড়তে পারব না। তাই আমার ফোনে কোনো মেসেজ দিয়ে লুকিয়ে বাড়ির বাইরে যাওয়া চলবে না। না মানে না। ‘ নায়রা আমার কথাকে পাত্তায় দিচ্ছিল না তাই শাসিয়ে বলেছিলাম ঐ বাড়িতে গেলে আমার বাসায় ঢুকতে দেব না। আমার এই শাসানির প্রভাব থাকল কয়েক দিন পর্যন্ত। একদিন হঠাৎ ফোনে মেসেজ আসে বাবা নাকি খুব অসুস্থ দেখতে যাচ্ছে। আসার সময় যেন তাকে নিয়ে আসি। আমার এত রাগ হলো যে নায়রাকে আনতে গেলাম না। সে আমার অপেক্ষা করতে করতে বাসায় আসল মাঝরাতে। রাগে তখন আমার শরীর কাঁপছে। কিছু একটা না করে ফেলি সে ভয়ে তাকে রুমে রেখে বাইরে চলে এলাম। ভেবেছিলাম রাতটা বাইরে কাটিয়ে তাকে শিক্ষা দেব।
কয়েক মিনিট পরেই নায়রার কল আসে আমার ফোনে। আমি রিসিভ করার বদলে ফোন বন্ধ করে পকেটে রেখে দেই। নিজের জেদ ধরে রাখতে বাকি রাতটুকু রাস্তায় কাটিয়ে বাসায় ফিরলাম ভোরবেলা। কলিংবেল চাপলে দরজা খোলার বদলে ভেতর থেকে অনবরত দরজায় বাড়ি দেওয়ার শব্দে লক্ষ্য করলাম সিটকানি বাইরে থেকে লাগানো। রাগের মাথায় হয়তো আমিই লাগিয়েছিলাম। সিটকানি খুলে দরজা মেলতে দেখি মালিকা খালা একটা বাচ্চা কোলে দাঁড়িয়ে আছে। চোখমুখের অবস্থা ভয়ংকর! আমাকে দেখেই চিৎকার করে বলল, ‘ ম্যাডাম রে জলদি হাসপাতালে লইয়া যান। ‘ আমি ছুটে ভেতরে ঢুকতেই ভয়ে জমে গেলাম। নায়রা হাত-পা ছেড়ে দিয়ে চোখ বন্ধ করে আছে। মেঝেতে রক্তর মাখামাখি। ”
মাহদী থেমে প্রলম্বিত নিশ্বাস টানল। নিহিতা আতঙ্কিত চোখ দুটোতে চেয়ে বলল,
” সবাই জানে মনকে জন্ম দেওয়ার সময় নায়রা হাসপাতালে মারা গিয়েছে। কথাটা পুরোপুরি সত্য নয়। মনকে জন্ম দেওয়ার সময় নায়রা মারা গিয়েছে সত্যি কিন্তু হাসপাতালে নয়, আমার বাসায়। আমি রাগ করে বেরিয়ে গিয়েছিলাম বলেই তার প্রসব বেদনার সময় সামনে ছিলাম না। রাগে হিতাহিতজ্ঞান হারিয়ে বাইরে থেকে সিকটানি লাগিয়েছিলাম বলেই মালিকা খালা পাশে থেকেও তাকে হাসপাতালে নিতে পারেনি। নিজের সিদ্ধান্তকে সঠিক ভেবে ফোন বন্ধ করে ছিলাম বলেই তার শেষ নিশ্বাসটুকুর শব্দও পাইনি। ”
মাহদীর গলা ধরে এলো। যন্ত্রণায় ছটফট করছে। নিজেকে সামলাতে অনেকটা সময় নিয়ে বলল,
” তুমি প্রথম দিন যখন নায়রার সম্পর্কে প্রশ্ন করেছিলে সেদিন আমি ভয় পেয়েছিলাম। সে ভয়েই তোমাদের বাড়ি ছাড়তে চেয়েছিলাম। অথচ আজ দেখ, নিঃসংকোচে সব সত্য বললাম। কেন জানো? কারণ তুমি তোমার পথ ভুলে গেছ। তোমাকে সঠিক পথে ফিরিয়ে দেওয়ার জন্যই সম্পূর্ণ সত্য বলা। এই সত্য থেকে আমার সম্পর্কে দুটো ধারণা পাবে। এক. আমার এক ভালোবাসা ব্যথা পেলে আমি অন্য ভালোবাসাকে ব্যথা দিতে দ্বিধাবোধ করি না। দুই. আমার রাগের কাছে ভালোবাসা হেরে যায়।
নিহিতা, আমি জানি মনকে তুমি ধাক্কা দিয়ে ফেলেছ। তবুও চুপ করেছিলাম। কারণ, নায়রাকে হারানোর পর মনে মনে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম আমি আর কখনও রাগ করব না। রাগে পড়ে ভুল সিদ্ধান্ত নিব না। হাসপাতাল থেকে এখানে চলে আসার সিদ্ধান্ত হঠাৎ করে নিইনি। অনেক ভেবেচিন্তে নিয়েছিলাম। ভেবেছিলাম আমি দূরে চলে আসলে তুমি নিজের ভুল বুঝতে পারবে। কিন্তু তুমি তো একের পর এক ভুল করেই চলেছ! ”
মাহদীর মুখের ভাব বদলে যাচ্ছে। ক্রোধান্বিত দৃষ্টি রেখে বলল,
” আমি চাইলেই তোমার বাবা-মায়ের কাছে নালিশ করতে পারি, করছি না। কারণ, আমার জন্যই তারা এক মেয়ের কাছ থেকে আঘাত পেয়েছিলেন। সেই আমার জন্যই আরেক মেয়ের কাছ থেকে আঘাত পান সেটা আমি চাই না। যদিও এবার সমস্যাটা তুমি সৃষ্টি করছ আমি নই তবুও জামাই-শ্বশুরের সম্পর্ক নষ্ট হবেই। কিছু শাস্তি অন্যায় না করেও পায়। তুমি কি আমাকে সে শাস্তি দিতে চাচ্ছ? ”
এই এতক্ষণ পর নিহিতার চোখের পলক পড়ল। কিছু একটা বলার জন্য ঠোঁট কেঁপে উঠতে মাহদী বলল,
” আমার প্রতিজ্ঞা যদি ভেঙে যায় ভুলে যাব তুমি নায়রার বোন। ”
মাহদীর শাসানির মধ্যে রিকশা থেমে গেল। কাঠ স্বরে বলল,
” নামো। ”
নিহিতা হালকা কেঁপে উঠল। চারপাশে চোখ পড়তে বিস্ময় ধরা পড়ল অক্ষিকোটরে। বিড়বিড় করল, ‘ আমরা এখনও বাড়ির সামনেই? ‘
মাহদী আবার ধমকে উঠল,
” নামতে বলেছি। ”
নিহিতা নামল। গেটের ভেতর ঢুকতে ঢুকতে বলল,
” আপনি যদি ভেবে থাকেন আমি ভয় পেয়েছি তাহলে ভুল। ”
মাহদী কপাল কুঁচকে নিলে নিহিতা মৃদু হেসে বলল,
” আপনাকে ভালোবেসে আমি মরতেও রাজি। ”
__________
নিহিতার পেছন পেছন আসমা রহমানও রুমের ভেতর ঢুকলেন। দরজা লাগিয়ে জিজ্ঞেস করলেন,
” কোথায় গিয়েছিলি? ”
নিহিতা ভয়ে আমতা আমতা শুরু করলে আসমা রহমান নিকটে এসে দাঁড়ান। নিহিতাকে নামাজ ছেড়ে উঠে যেতে দেখে তিনি সালাম ফিরিয়ে বাইরে এসেছিলেন। বসার রুমে কাউকে না পেয়ে মূল দরজার দিকে এগিয়ে যান। খোলা দরজার সামনে দাঁড়িয়ে বাইরে চোখ রাখতেই দেখেন মাহদী নিহিতাকে টেনে সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামছে। তারপর থেকে বসার রুমে বসে মেয়ে আসার অপেক্ষা করছিলেন।
নিহিতা ভেবেছিল মিথ্যে বলবে। পর মুহূর্তে সিদ্ধান্ত পাল্টে ফেলে বলল,
” আমি মাহদীকে ভালোবাসি, আম্মু। ”
আসমা রহমান মেয়ের গালে সশব্দে চড় মেরে বললেন,
” মাহদী নয় ভাইয়া। ফের যদি এই নামটা উচ্চারণ করতে শুনেছি তাহলে চড়িয়ে দাঁত ফেলে দিব। আমরা তোকে এই শিক্ষা দিয়েছি? ”
আসমা রহমান একটু চুপ থেকে বললেন,
” আমার অনেক দিন থেকেই সন্দেহ হচ্ছিল, পাত্তা দিইনি। নিজেকে ভুলিয়ে রেখেছিলাম এই বলে যে, আমার মেয়ে অমন হতেই পারে না। কিন্তু এখন? ছি! ”
আসমা রহমান নাক-মুখ কুঁচকে নিলেন।
________
মাহদী বাসায় ঢুকতে ঢুকতে ভাবছিল এরশাদ রহমানের সাথে কথা বলবে। নিহিতাকে সামলানো তার পক্ষে অসম্ভব হয়ে পড়েছে। সে উদ্দেশ্যেই শ্বশুরকে খুঁজতে তার রুমে যায়। তিনি ফোনে কথা বলতে বলতে মাহদীকে ইশারায় বসতে বলেন। কয়েক সেকেন্ড পেরুতেই বুঝতে পারে ফোনের ওপাশে আহাদ কথা বলছে। তাদের ফোনালাপ দীর্ঘ হয়। কথা শেষ করে মাহদীর নিকট বসেই এরশাদ রহমান বললেন,
” অফিস থেকে এক সপ্তাহের ছুটি চেয়ে রেখ। ”
” কেন, বাবা? ”
” কেন আবার? নিহিতার বিয়ের দায়িত্ব নিতে। ”
এরশাদ রহমান একটু থেমে বললেন,
” আমার তো আর ছেলে নেই। মেয়ের জামাই আছে। এখন তুমিই আমার জামাই, তুমিই আমার ছেলে। ”
এরশাদ রহমানের স্নেহের বুলিতে মাহদী খুশি হওয়ার বদলে দুঃখ পেল। মন খারাপের কণ্ঠে বলল,
” এই দায়িত্ব আমি নিতে পারব না, বাবা। ”
” কেন? ”
মাহদী কী উত্তর দিবে খুঁজে না পেয়ে বলল,
” অফিস থেকে ছুটি দিবে না। ”
এরশাদ রহমান কিছু একটা বলতে চাইলেন তার আগেই আসমা রহমানের কণ্ঠস্বর ভেসে এল,
” ও যখন চাচ্ছে না তখন জোর করো না। আমরা দুজনেই সব সামলে নেব। ”
এরশাদ রহমান অপ্রসন্ন মুখ বানিয়ে বলল,
” এসব কী বলছ? নিহিতার বিয়েতে মাহদী আসবে না? ”
” আসবে না কেন? যখন ছুটি পাবে তখন আসবে। ”
স্বামীকে চুপ করিয়ে দিয়ে মাহদীর কাঁধে হাত রাখলেন আসমা রহমান। কোমল স্বরে বললেন,
” আমি জানি, তোমার আসতে অসুবিধা হবে। তবুও বলছি, তোমার সুবিধামতো এসো। তুমি আসলে নায়রার স্থানটা পূর্ণ থাকে। ”
চলবে