নিষিদ্ধ_বরণ,৭,৮

0
949

#নিষিদ্ধ_বরণ,৭,৮
#রোকসানা_রাহমান
পর্ব (৭)

” ইনি কে, নিহিতা? ”

নিহিতা উত্তর দেওয়ার আগেই কেউ একজন বলল,
” নিহিতার স্বামী। ”

মুহূর্তে হতচকিত তিনটি মানুষ। চোখে রাজ্য মাপের বিস্ময়, সংশয়। নিহিতার অবিশ্বাস্য চোখ জোড়া আটকাল সুমির দিকে। সে আগের চেয়েও দ্রুত গতিতে ছুটে এলো তাদের নিকট। নিহিতার পাশে দাঁড়িয়ে হালকা হাসল। সহাস্যে তাকাল আহাদের দিকে। আহাদের চোখে-মুখে স্পষ্ট সন্দেহ। মাহদীর দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি ফেলে বলল,
” নিহিতা, তুমি বিবাহিত? ”

এবারও উত্তর দিল সুমি,
” হ্যাঁ। আপনি জানতেন না, আহাদ ভাই? ”

আহাদ সন্দিগ্ধ কণ্ঠে বলল,
” না। ”

সুমি আগ্রহ নিয়ে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল তার আগেই আহাদ বলল,
” বিয়ে কবে হলো? আমার বিশ্বাস হচ্ছে না। নিহিতা, চালাকি করছ না তো? ”

নিহিতা ভীত চোখে তাকাল। পর মুহূর্তে দৃষ্টি সরিয়ে নিল সুমির দিকে। কী উত্তর দিবে বুঝতে পারছে না। সুমি ব্যাপারটা আঁচ করে কৌশলে ফিসফিসে বলল,
” শুধু এক বার বল বিয়ে হয়ে গেছে। উনি বিশ্বাস করে নিবেন। ”

নিহিতার অসহায় চোখ দুটো জ্বলে উঠল। মুখের ভাব কঠিন হয়ে আসল। সুমি ভয় পেয়ে যায়। বুঝতে পারে এত বড় মিথ্যা কথা নিহিতা বলবে না। জীবন চলে গেলেও না। বড়-ছোট কী কোনো ধরনের মিথ্যাই সহ্য করতে পারে না নিহিতা। সুমি মেকি হাসল। আহাদকে কিছু বলার জন্য উদ্যত হলে সে চট করে বলল,
” তুমি চুপ। আমি নিহিতার মুখ থেকে শুনতে চাই। ”

নিহিতার দিকে আরেকপা এগিয়ে জিজ্ঞেস করল,
” নিহিতা, তুমি বিবাহিত? ”

নিহিতা চোখ নামিয়ে ফেলল। এক কদম পিছিয়ে গেল। আহাদ পূর্বের প্রশ্নটাই আরও এক বার করল। নিহিতা তখনও চুপ। সুমি দুজনের দিকে ঘন ঘন চোখ ফেলে আশ্রয় নিল মাহদীর কাছে। আচমকা তার কাছ ঘেষে এসে কানে কানে বলল,
” আমার বান্ধুবীকে বাঁচান, প্লিজ। ”

মাহদী সুমির দিকে তাকাল। তার উপস্থিতিতে এত কিছু ঘটে যাচ্ছে অথচ সে নির্বাক। সুমি অনুরোধের সুরে বলল,
” এক মুহূর্তের জন্য স্বীকার করে নিন নিহিতা আপনার স্ত্রী। তাহলে মেয়েটা বেঁচে যাবে। সাহায্য করুন! ”

মাহদীর ভ্রুর মাঝে ভাঁজ পড়ল। সরু চোখে চেয়ে আছে সুমির দিকে। পুরো ব্যাপারটা এখনও তার মাথায় ঢুকেনি। শুরু থেকেই বুঝার চেষ্টা করছিল। পারছিল না। এতক্ষণে উপলব্ধি করল, নিহিতা সত্যিই বিপদে!

আহাদ আরও এক ধাপ সামনে এগিয়ে যেতে চাইলে মাহদী দুজনের মাঝে চলে এলো। নিহিতাকে আড়াল করে বলিষ্ঠ কণ্ঠে বলল,
” ফিরে যাও, ছোট ভাই। ”

আহাদ গরম চোখে তাকালে মাহদী স্মিত হাসল। বলল,
” এবার কিন্তু বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে, ছোট ভাই। এতক্ষণ চুপ ছিলাম বলে এখনও থাকব এটা বোকামো। আমি শুধু নিহিতাকে বুঝার চেষ্টা করছিলাম। ”

আহাদের গরম চাহনি শীতল হয়ে আসল। কাতর স্বরে জিজ্ঞেস করল,
” সত্যিই নিহিতার বিয়ে হয়ে গিয়েছে? ”

এ পর্যায়ে এগিয়ে আসল সুমি। বলল,
” এখনও বিশ্বাস হচ্ছে না আপনার? বিয়ে না হলে কি নিহিতাকে এভাবে আগলে রাখতেন উনি? ”

আহাদ আহত চোখে তাকায় সুমির দিকে। নিহিতার দিকেও। চলে যাওয়ার পূর্বে মাহদীর উদ্দেশ্যে বলল,
” দোয়া করি, আপনারা সুখী হোন। ”

আহাদ চলে যেতেই হাফ ছেড়ে বাঁচল সুমি। ফোঁস করে নিশ্বাস ছাড়ে কয়েক বার। আনন্দে গলে যাওয়া কণ্ঠে ধন্যবাদ দেয় মাহদীকে। মাহদী সব কিছু উপেক্ষা করে নিহিতাকে বলল,
” এখন বাড়ি যাবে তো? ”

নিহিতা মাথা তুলল না। ঝুঁকা অবস্থায় মাথা উপরনিচ নেড়ে হ্যাঁ বুঝালে মাহদী বলল,
” চলো, তোমাকে রিকশায় তুলে দেই। ”

নিহিতা নীঃশব্দে মাহদীকে অনুসরণ করছিল। পেছন থেকে সুমি দৌড়ে এসে বলল,
” আমিও যাব। ”

নিহিতারা রিকশায় বসলে মাহদী হুড তুলে দেয়। নিহিতার ছড়িয়ে পড়া বোরকার অংশটা ভেতরে ঢুকিয়ে দেয়। রিকশাওয়ার হাতে ভাড়ার সাথে অতিরিক্ত টাকা দিয়ে বলল,
” চাচা, তাড়াহুড়ো করবেন না। ধীরে যাবেন। ”

রিকশাওয়ালা হেসে মাথা নেড়ে রিকশা ছাড়ে। নিহিতারা চোখের আড়াল হতে শিহাবের কণ্ঠ পাওয়া গেল,
” আরে, নায়রা ভাবি চলে গেল নাকি? পরিচয় করিয়ে দিবি না? ”

মাহদী তাৎক্ষণিক বলল,
” ওটা তোর ভাবি না। ”
” তাহলে? ”
” ভাবির বোন। ”

শিহাব খানিকটা উদাস হলো। সহসা বলল,
” সেই পিচ্চিটা? ”

মাহদী উত্তর দিল না। প্রসঙ্গ পাল্টে বলল,
” চল, কোথাও বসি। তোকে অনেক কিছু বলার আছে। ”

শিহাবও আর কথা বাড়াল না। বন্ধুর পাশাপাশি হাঁটা ধরে। কয়েক কদম এগুতে খেয়াল করল মাহদী মুচকি হাসছে। শিহাব অবাক হলো। কৌতূহল প্রকাশ করে সুধাল,

” হাসছিস কেন? ”

মাহদী বন্ধুর দিকে তাকাল। উত্তর দেওয়ার বদলে আবারও হেসে উঠল। শিহাব হাঁটা থামিয়ে বলল,
” কী হয়েছে বলবি? ”

পাশের চায়ের দোকানের বেঞ্চে বসল মাহদী। শিহাবকে বসার জন্য ইশারা করে বলল,

” নায়রার সাথে দেখা করতে এসে একটা ঝামেলা হয়ে গিয়েছিল। গণ ধোলাই খাওয়ার মতো অবস্থা। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, মার পিঠে পড়ার আগে কেউ একজন বলল, ‘আমি নায়রার স্বামী’ ব্যস! বেঁচে গেলাম। ”
” নায়রা তোর বউ হলে তুই তো তার স্বামীই হস। এতে আশ্চর্যের কী হলো? ”
” তখন আমাদের বিয়ে তো দূর পরিচয়ও হয়নি! ”

শিহাব বিস্ময় নিয়ে বলল,
” বলিস কী! বিয়ের আগেই স্বামী বানিয়ে দিয়েছে? ”
” হ্যাঁ। অবশ্য, সে ঘটনার জন্যই আজ আমি সত্যি নায়রার স্বামী। ”
” বুঝিনি। খুলে বল। ”

মাহদী কথার ফাঁকে চায়ের কথা বলেছিল। চা চলে আসতে হাতে নিয়ে বলল,
” একে তো বিশ্রী ঝামেলা বাঁধিয়ে ফেলেছিলাম তার মধ্যে শখানেক লোকের সামনে অপমান বোধও করছিলাম। এসব থেকে রেহাই পেতে ঢাকায় ফেরার জন্য বাসে উঠলাম। সিটে বসতে আমার কী যেন হলো! ”
” কী হলো? ”
” জানি না। শুধু মনে হচ্ছিল, আমি যাকে খুঁজছিলাম যার অপেক্ষায় ছিলাম তাকে ফেলে চলে যাচ্ছি। মুহূর্তে নিজেকে অসহায় লাগল। নিঃসঙ্গ চেপে ধরল। জোর করেও সিটে বসে থাকতে পারলাম না। এক পর্যায়ে চলন্ত গাড়ি থেকে নামতে বাধ্য হলাম। ফুলবাড়ির মাটি স্পর্শ করতেই নায়রার মুখটা মনে পড়ল। বুঝতে পারলাম ইনিই আমার সেই খুঁজে ফেরা অদৃশ্য টান! ”

শিহাব বেশ উৎসাহ নিয়ে জিজ্ঞেস করল,
” তারপর? ”
” তারপর আর কী? বাসায় ফোন দিয়ে জানালাম আমি বিয়ে করব। মেয়ে ঠিক হয়ে গেছে। তোমরা চলে এসো। ”
” বিয়ে হয়ে গেল? ”

মাহদী চায়ে চুমুক দিল। কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল,
” হয়েছে। কিন্তু আমি যত সহজে বলছি তত সহজে হয়নি। ”
” তাহলে কঠিন করে বল। ”
” অন্য এক দিন বলব। মনকে রেখে এসেছি। ও আবার বাবাকে ছাড়া বেশিক্ষণ থাকতে পারে না। ”

মাহদী চায়ের বিল মিটিয়ে বলল,
” মনের সাথে দেখা করবি নাকি ফিরে যাবি? ”

শিহাব উত্তর দেওয়ার প্রয়োজন বোধ করল না। মাহদীর সঙ্গে হাঁটা ধরে। রিকশায় উঠতে হঠাৎ মনে পড়ল মাহদীর হাসির কারণটায় জানা হয়নি। সে আগের প্রশ্নটা করতে মাহদী বলল,
” আজ আবারও বিয়ে ছাড়াই একজনের স্বামী হয়ে গেছি। ”

শিহাব চোখ বড় বড় করে বলল,
” কার? ”
” নিহিতার। ”

শিহাব মজার ছলে বলল,
” তাহলে কি মাহদীর সেই ‘কী জানি হলো’ ঘটনাটা আবার ঘটতে যাচ্ছে? ”

মাহদী রাগ চোখে তাকাল। শক্ত স্বরে স্পষ্ট করে বলল,
” নিহিতা নায়রার বোন। মানে, আমারও বোন। ”

কথাটা বলেই রিকশা থামাল মাহদী। শিহাবকে জোর পূর্বক নামিয়ে দিয়ে বলল,
” এক সময় নায়রা আমার রাগকে ভয় পেত। এখন আমি আমার রাগকে ভয় পাই। মনের সাথে দেখা করতে অন্য দিন আসিস। ”

__________
” ঐ ছেলেটার কাছে আহাদ তো কিছুই না। তার কথা বলার ধরণ দেখেছিস? শান্ত অথচ দৃঢ়! ”

সুমির কার কথা বলছে বুঝতে না পেরে নিহিতা বলল,
” কোন ছেলে? ”
” কোন ছেলে আবার? তোর স্বামীর অভিনয় করল যে সে। ”
” ওহ। ”

নিহিতার ‘ওহ’ শব্দটাকে উড়িয়ে দিয়ে সুমি বলতে শুরু করল,
” কী সুন্দর অভিনয় করল। আহাদের কাছ থেকে তোকে বাঁচিয়ে নিল। আবার রিকশায় তুলে দিয়ে রিকশাওয়ালাকে কেমন সাবধান করল খেয়াল করেছিস? রিকশার হুডটাও তো তুলে দিল। নিহিতা, তুই শুধু ভাব একটু অভিনয় করতে বলেছি বলেই এতটা যদি সত্যি স্বামী হত তাহলে কেমন হত? আমার তো ঐ মেয়ের উপর হিংসে হচ্ছে। ”
” কোন মেয়ে? ”
” যে মেয়ে এই ছেলেটাকে স্বামী হিসেবে পাবে। ”

নিহিতা এবার বিরক্ত হলো। খানিকটা বিরক্ত ঝেরেই বলল,
” কী তখন থেকে ছেলে ছেলে করছিস? উনার নাম মাহদী। ”

সুমি আশ্চর্য হয়ে বলল,
” তার নাম তুই কী করে জানলি? চিনিস নাকি? ”

নিহিতা সুমির দিক থেকে চোখ সরিয়ে নিল। অন্য দিকে তাকিয়ে বলল,
” হ্যাঁ। উনি নায়রা আপুর স্বামী। ”

সুমি বিস্মিত হলো। পর মুহূর্তে বিদ্রুপ করে বলল,
” নায়রা আপুর স্বামী মানে তোর দুলাভাই। সরাসরি বললেই হয়, ‘উনি আমার দুলাভাই।’ তা না করে একবার নাম ধরে বলছিস আরেক বার নায়রা আপুর স্বামী বলছিস। কেন? ”
” কী কেন? ”
” সহজ পরিচয়কে কঠিন পরিচয় কেন বানাচ্ছিস? মানছি এখনকার দিনে বোনের স্বামীকে দুলাভাই ডাকা চলটা উঠে যাচ্ছে। তাই বলে ওভাবে পরিচয় দিবি? মাহদী ভাইও তো বলতে পারতি। ”
” খেয়াল করিনি। ”
” খেয়াল করিসনি। নাকি অন্য কিছু? ”

সুমির সন্দেহমাখা প্রশ্নে খানিকটা ঘাবড়ে গেল নিহিতা। শুকনো গলায় জিজ্ঞেস করল,
” অন্য কিছু বলতে? ”

সুমি সরাসরি বলল,

” বোনের স্বামীকে নিজের স্বামী বানানোর মতলব। ”

নিহিতা নাক-মুখ কুঁচকে ফেলল। পরক্ষণে দৃঢ় স্বরে বলল,
” এমন কুৎসিত চিন্তা-ভাবনা যেন আমার শত্রুর মনেও না আসে। ”

চলবে

#নিষিদ্ধ_বরণ
#রোকসানা_রাহমান

পর্ব (৮)

” নায়রার রুমটাও এভাবে গুছিয়ে দিতেন। তাই না, বাবা? ”

মাহদীর কণ্ঠ স্বরে এরশাদ রহমান পেছনে তাকালেন। তার হাতে বিছানার চাদর। মন একটু দূরে কাঠের চেয়ারে বসে নানার কার্যকলাপ দেখছিল। বাবাকে দেখেই ছুটে এলো। তার চোখে-মুখে দারুন উচ্ছ্বাস!

এরশাদ রহমান চোখ ফিরিয়ে বিছানায় চাদর পাতায় ব্যস্ত হলেন। বালিশে নতুন কভার লাগিয়ে বললেন,
” ঘরটা অনেক দিন বন্ধ ছিল। তাই পরিষ্কার করে দিলাম। ”

মাহদী ছেলেকে কোলে তুলে নিল। ভেতরে ঢুকে বলল,
” নায়রার প্রশংসার সবটা জুড়েই আপনি থাকতেন। মাঝে মাঝে কিন্তু আমার খুব হিংসে হতো, রাগ হতো। আপনি সাজার চেষ্টা করতাম। এক দিন নায়রার খুব জ্বর হলো। ডাক্তার দেখালাম। ওষুধ খাওয়ালাম। লাভ হলো না। শরীরের তাপমাত্রা কমার বদলে বেড়ে গেল। বিছানা ছেড়ে দাঁড়ানোর মতো শক্তি নেই। সেই অবস্থায় সে ঘর ঝাড়ু দেওয়ার জন্য ঝাড়ু খুঁজছে। আমার তো খুব রাগ হলো। খানিকটা বকাঝকা করে নিজেই ঝাড়ু হাতে নিলাম। তাকে দেখিয়ে ঘর ঝাড় দিলাম, বাসন ধুলাম, ভাত করলাম, ডিম ভাজলাম। সব শেষে যখন তার সামনে গিয়ে বসলাম। সে হেসে ফেলল। যে মেয়ে জ্বরে ভুগে চোখের পাতা ফেলতেও কষ্ট পাচ্ছে সে মেয়ে আমাকে দেখে হাসছে আর বলছে, ‘ তুমি চাইলেই কি আমার বাবার মতো হতে পারবে? তাহলে তো আমি বিছানায় পড়ে থাকতাম না। তিনি আমার কপাল ছুঁয়ে দিলেই জ্বর হারিয়ে যেত! ‘ বাবা, আপনি কি বুঝতে পারছেন সে সময়টা আমি কত দুঃখ পেয়েছিলাম? ”

এরশাদ রহমান কিছু বললেন না। নীঃশব্দে দরজার দিকে এগুলেন। হঠাৎ কী হলো মাহদীর কাছে এসে দাঁড়ালেন। তার মুখে নরম চাহনি ফেলে কাঁধে হাত রাখলেন। বিগলিত কণ্ঠে বললেন,
” আমার কাছে প্রথম বারের মতো কিছু চেয়েছিল নায়রা। সেটা তুমি। দিয়েছিলামও। কিন্তু কেন জানি মন থেকে মেনে নিতে পারলাম না। খুশি হতে পারলাম না। অথচ প্রার্থনায় সারাক্ষণ চাইতাম মেয়েটা ভালো থাকুক, সুখে থাকুক। ”
” তাহলে কেন এক বারের জন্য কথা বলেননি আমার সাথে? কেন এক বারের জন্য দেখতে যাননি তাকে? নায়রা যে খুব করে চাইত তার নিজের হাতে সাজানো সংসারে আপনি এক বার আসুন। তার হাতে বানানো চা খেতে খেতে ভুল সংশোধন করে দিন অথবা প্রশংসায় ভরিয়ে দিন। ”

এরশাদ রহমান সাথে সাথে কিছু বলতে পারলেন না। তার কণ্ঠ স্বর ভার হয়ে আসছে। চোখের চাহনি ঝাপসা হচ্ছে। মুহূর্তকাল শেষে কিছু একটা বলতে চাইলেন তখনই অন্য কারও কণ্ঠ স্বর,

” তুমিও তো কথা বলতে আসোনি। নায়রা নিশ্চয় এটাও চাইত তুমি এ বাড়ি আসো। তার বাবার সাথে মনোমালিন্য ভেঙে পাশাপাশি বসে চা খাও? ”

মাহদীর চকিত দৃষ্টি পড়ল দরজার দিকে। নায়রার মা আসমা রহমান দাঁড়িয়ে আছেন৷ হাতে ট্রে। তাতে চা ও বিস্কুট সাজানো।

স্বামীর জরুরি কল পেয়ে হাসপাতাল থেকে ফিরতে বাধ্য হয়েছিলেন আসমা বেগম। এসেই সাংসারিক কাজ শেষে সন্ধ্যার নাস্তা সাজিয়ে আনলেন। স্বামী ও মেয়ের জামাইয়ের সামনে নাস্তা রেখে স্বামীর উদ্দেশ্যে বললেন,

” আপনারা দুজনেই আমার নায়রাকে সর্বোচ্চ ভালোবেসেছেন। কিন্তু তাকে সুখী করতে পারেননি। তার শেষ ইচ্ছেটা পূরণ করতে পারেননি। শেষ হাসিটা উপহার দিতে পারেননি। ”

কথাটা বলেই শাড়ির আঁচল চেপে ধরলেন মুখে। চোখের পানি গালে গড়িয়ে পড়ার পূর্বেই সেখান থেকে প্রস্থান করলেন।

________________

বিশ্ববিদ্যালয়ে যাবে না ভেবেও পরের দিন ঠিক হাজির হলো নিহিতা। গেইট ছেড়ে মাঠ পার হতে পারল না। তার আগেই সুমি সামনে এসে দাঁড়াল। তার পিছু পিছু এসে দাঁড়াল সানোয়ার আর সেতু। নিহিতা সকলের দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালে নাদিম বলল,
” আজ ক্লাস করতে হবে না। ”
” কেন? ”
” সারপ্রাইজ পার্টির আয়োজন করা হবে তাই। অনেক কিছু প্ল্যান করার কাছে। ”
” সারপ্রাইজ পার্টি? কিসের? ”

এবার কথা বলল সুমি,
” কাল সানোয়ারের জন্ম দিন। নিহিতা, আমার জন্ম দিনে তোকে পাইনি। এবার কিন্তু থাকতেই হবে। তোর কোনো কথা শুনব না। ”

নিহিতা কিছু একটা বলতে চাইল তার আগেই সেতু বলল,
” মুখ বন্ধ। চুপচাপ আমাদের সাথে চল। ”

নিহিতার ক্লাস করা হলো না। সুমি, সেতু জোর করে তাকে নিয়ে ক্যাম্পাস থেকে বেরিয়ে গেল। প্রায় ঘন্টাখানেক পর মার্কেট থেকে বের হয়ে নিহিতা মুখ খুলল,
” তোরা কিন্তু অযথায় জোর করছিস। আমি এসবে থাকতে পারব না। আমার বাবা এগুলো পছন্দ করেন না। আমিও না। ”
” আংকেলকে বলতে যাচ্ছে কে? ”

নিহিতা কিছুটা অবাক হয়ে বলল,
” বাবাকে বলব না? ”
” জন্মদিনের কথা বলবি না। অন্য কিছু বলিস। ”

সুমি কিছুক্ষণ ভেবে বলল,
” ঊর্মির মতো তুইও বলবি আমার বাসায় আসবি। রাতে থাকবি। ”

ঊর্মির কথা শুনে নিহিতার চোখ-মুখে লাবণ্য ছড়াল। দুই দিন ধরে মেয়েটার সাথে যোগাযোগ নেই। এই সুযোগে দেখা তো হবে! নিহিতা খানিকটা উৎসাহ নিয়ে জিজ্ঞেস করল,
” ঊর্মি? ও আসবে? ”
” তো আসবে না? ও কি তোর মতো? ”

নিহিতা সুমির প্রশ্ন এড়িয়ে জিজ্ঞেস করল,
” এখন কোথায় আছে? দেখতে পাচ্ছি না যে? ”
” সানোয়ারকে নিয়ে কোথাও একটা গেছে। ও আমাদের সাথে থাকলে তো সারপ্রাইজ মাটি হয়ে যাবে। ”

নিহিতা চুপ হয়ে গেল। ঊর্মির সাথে দেখা করার জন্য মন যেমন ছটফট করছে তেমন ধর্মীয় শিক্ষা বোধও জেগে উঠছে।

” তুই কি এখনই নাদিমের সাথে যাবি নাকি সন্ধ্যার দিকে আসবি? ”

সুমির প্রশ্নের পিঠে প্রশ্ন করল নিহিতা,
” নাদিমের সাথে যাব কেন? ”
” ওর বাসা চিনতে। তুই তো নাদিমের বাসা চিনিস না। ”
” ওর বাসা চিনে কী হবে? ”

সুমি বিরক্ত হয়ে বলল,
” বার্থ ডে পার্টি ওদের বাসায় হবে তাই। ”

মুহূর্তে নিহিতার দুর্বল মন সবল হয়ে উঠল। সব কিছু ভুলে শক্ত স্বরে বলল,
” অসম্ভব! তোর বাসায় হলে একটা কথা ছিল। নাদিমের বাসায় হলে কিভাবে যাব? শুনেছি ও এখানে চাচার সাথে থাকে। তার মধ্যে চাচি জীবিত নেই। ”
” তোর চাচিকে দিয়ে কী কাজ? ”
” আমার কোনো কাজ নেই। যে বাসায় মহিলা মানুষ নেই। সে বাসায় যাওয়াই উচিত না। আর তুই বলছিস রাতে ওখানে থাকতে। তোদের কি মাথা নষ্ট হয়ে গেছে? ”

পাশ থেকে সেতু বলল,
” মহিলা নেই দেখেই নাদিমের বাসা ঠিক করা হয়েছে। মহিলারা থাকলে অনেক ঝামেলা। কোনো কিছু ঠিক মতো করা যায় না। সারাক্ষণ নজরে রাখে আর শাসায়! ”
” আমাদের ভালোর জন্যই করেন। একজন মেয়েই জানেন অন্য মেয়ের বিপদ সীমা সম্পর্কে। ”

সেতু মুখ বাঁকাল। নাদিম বিরক্তে অন্য দিকে চলে গেল। সুমি ধৈর্য্য ধরে কঠিন সুরে বলল,
” আর একটা কথাও না। তুই এখনই আংকেলকে কল দিয়ে বল আজ বাড়ি ফিরছিস না। আমার সাথে থাকবি। ”

নিহিতাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে সুমি নিজেই কল ঢুকিয়ে বলল,
” তোর বলতে হবে না। আমি-ই বলছি। ”

নিহিতা দ্রুত ফোন কেড়ে নিল। বেশ কিছুক্ষণ কথা কাটাকাটির পর নিহিতা বলল,
” আচ্ছা, ঠিক আছে। আমি বাবাকে বলব তিনি যদি অনুমতি দেন আসব। কিন্তু হ্যাঁ, মিথ্যে নয় সত্য বলে। আমি চাই তোদেরকে খুশি করতে কিন্তু আল্লাহকে অখুশি করে নয়। পাপ করে নয়। ”

_________________

মাহদীর কথামতো পরের দিনই শিহাব মনের সাথে দেখা করতে এলো। অনেক কথাবার্তা শেষে বলল,

” সবই বললি কিন্তু নায়রা ভাবি কেন বাবার নাম্বার দিয়েছিল সেটা বললি না। ”

কথাটা সহজ মনে বলে ভয় পেয়ে গেল শিহাব। বন্ধুর চোখ-মুখের ভাব পালটে গেছে। কাঠিন্য চেহেরার দিকে তাকিয়ে শুকনো ঢোক গিলল। একটু দূরে সরে বলল,
” বলতে হবে না। কিছু বলতে হবে না। আমি আজ উঠি। ”

মাহদী শিহাবের শার্ট টেনে ধরল। জোর করে বিছানায় বসিয়ে বলল,
” আমার বউ তোর ভাবি। ভাবি মানে ভাবি। শুধু ভাবি বলবি। ফের যেন নাম ধরে বলতে শুনি না। ”

শিহাব আড়ষ্টভঙ্গিতে মাথা এক পাশে কাত করল। সে ভেবেছিল অন্য কিছু। এখন বুঝল ভাবির আগে নাম উচ্চারণ করার জন্য রেগে গেছে।

এবার শিহাবের প্রশ্নের উত্তর দিল মাহদী,
” সে দিন তাড়াহুড়োয় টিকেট ছাড়াই ট্রেনে উঠেছিলাম। ভেবেছিলাম টিটিকে টাকা দিয়ে সামলে নিব। তার আর প্রয়োজন হলো না। টিটি টিকেট চাইতেই নায়রার বাবা আমারটা সহ তার টিকেট দেখাল। ”
” নায়রার বাবার কাছে তোর টিকেট গেল কী করে? ”
” আমার টিকেট না। ঐ সিটের টিকেট। যদিও তখন অনেক অবাক হয়েছিলাম। পরে নায়রার কাছ থেকে শুনেছি ওর বাবা নাকি সব সময় দুই সিটের টিকেট কাটে। ”
” কেন?”
” নিজের সুবিধার জন্য। উনি কখনও নামাজ কাযা করেন না। গাড়িতে থাকা অবস্থায়ও পড়েন। নামাজ পড়ার সময় যাতে কোনো সমস্যা না হয় সেজন্য। এ ছাড়া আরও অনেক কারণ থাকতে পারে। সে দিন নায়রার বাবাও ঢাকার দিকে যাচ্ছিলেন। আর নায়রা জানত তার বাবার কাছে দুটো টিকেট আছে। সেজন্যই হয়তো সাহায্য করতে চেয়েছিল। ”

শিহাব প্রথমে ভালো মতো বুঝতে পারল না। পরক্ষণে সব কিছু নিজের মতো গুছিয়ে নিল।

____________

ঘরের আলো নিভে যাওয়ার পরও বার বার মোবাইলে আলো জ্বেলে সময় দেখছেন এরশাদ রহমান। বারোটা পার হতে নিহিতার নাম্বারে কল দিলেন।

দুপুরে খাওয়ার সময় নিহিতা জন্ম দিনে যাওয়ার অনুমতি চেয়েছিল। তিনি যাওয়ার অনুমতি দিলেও থাকার অনুমতি দেননি। বলেছিলেন তাদের আনন্দ-উল্লাস কমে আসলে যেন বাবাকে কল দেয়। যত রাতই হোক তিনি গিয়ে নিয়ে আসবেন।

প্রথম বার কল হয়ে কেটে গেলে আবার কল দিলেন এরশাদ রহমান। দ্বিতীয় বারে ফোন বন্ধ আসতে তার ভেতরটা কেমন করে উঠল! যেন কোনো মাংসাশী প্রাণী তার কলিজাটা কামড়ে ধরে আছে। তিনি তাৎক্ষণিক পাঞ্জাবি পরে বাইরে বের হলেন। স্ত্রীর পিছু ডাকের তোয়াক্কা করলেন না। বারান্দা পার হয়ে উঠোনে পা পড়তে মাহদী ডেকে উঠল,
” বাবা? ”

এরশাদ রহমান চমকে উঠলেন। কিছুটা ভয়ও পেলেন বোধ হয়। উত্তর দেওয়ার পূর্বে মাহদী নিকটে এসে দাঁড়াল। জিজ্ঞেস করল,
” এত রাতে কোথায় যাচ্ছেন? ”

এরশাদ রহমান তখনও নিজেকে ধাতস্থ করতে পারেননি। আরও কিছুক্ষণ সময় পর দুর্বল স্বরে বললেন,
” নিহিতাকে আনতে। ”

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here