নিষিদ্ধ_ভালোবাসা পর্ব-(১)

0
9325

৯ বছরের সম্পর্কের পর আমার প্রেমিক আদিব আমায় আজ জানালো:
“সুপ্তি তুই আমার পরিবারের সাথে ঠিক যাবি না আর খাপ খাওয়াতেও পারবি না”

থুম ধরে বসে ছিলাম ক্যাফের চেয়ারে।মুখ দিয়ে যেন কথায় বের হতে চাইছিলো না,যেখানে আমার কথার যন্ত্রণায় আদিবের কান ঝালা-ফালা হয়ে যেতো!কি বলবো আমি!আকাশটা মনে হচ্ছিলো আমাকে ছুঁয়ে যাচ্ছে আর পৃথিবীটাও শূন্য মনে হচ্ছিলো,কোথাও কেউ নেই!একদম শূন্য – নিস্তব্ধ চারিদিক।

আমার ঘোর কেটে গেলো আবার আদিবের ডাকে:
~”কিরে কিছু বলছিস না যে?”
~”কি বলবো?”
~”আসলে দেখ তুই রান্না করতে পারিস?আর মাছ কাটতে”
~”না”
~”ঘর গুছাতে?”
~”না”
~”আমাদের পরিবারে বউদের বাইরে বের হওয়া কিন্তু নিষেধ।”
~”৯ বছর ধরে জেনে আসছিস যে আমি ঘুড়তে ভালোবাসি”
~”আমাদের পরিবারে বউদের চাকরি করাও নিষেধ ”
~”আমি ছোট থেকেই নিজের পায়ে দাড়াতে চাইতাম তুই এটাও জানিস”
~”হুম সেই জন্যই তো হবে নারে”

সেই ছোট থেকে আমার আর আদিবের সম্পর্ক।আদিবই আমায় প্রথম প্রেমের প্রস্তাব দেয়… আর আমি না করে দেই, সবার কাছে এমনকি আদিবের বাসায়ও বিচার দিয়ে কি যে লঙ্কা কান্ড করেছিলাম!!শুনেছিলাম আদিব অনেক মারও খেয়েছিলো আর এরপরেও বলে গিয়েছিলো আমায় ভালোবাসে।বাসা থেকে বেরও নাকি করে দিয়েছিলো।বাবা-মা,মামা সকলের কথার অবাধ্য হয়েছিলো,আমাকে এক দেখায় ভালোবেসে ফেলেছিলো বলে।ঘটনার ফলশ্রুতি এতটাই ভয়ংকর হয়েছিলো যে আদিব সুইসাইডও করতে গিয়েছিলো।আমি অবশ্য এসব শুনেই গলে গিয়েছিলাম।

তারপর,কথা,কথার পৃষ্ঠে কথা।বহুদিন পর দেখা,আবারও দেখা আর প্রেম।সবকিছুই যেন না চাইতেই হয়ে গিয়েছিলো আর এভাবেই কেটে গিয়েছিলো বহুদিন, তারপর বছর আর তারওপর কিছু বছর।

এখন আদিবের মা-ও আমাদের ব্যাপারটা মেনে নিয়েছে।আদিবও অনেকটা বড় হয়েছে।মায়ের সাথে আরও ফ্রী হয়েছে.. আমার সাথে তার মায়ের কথাও বলিয়ে দিল।প্রথমে আন্টি তারপর মা ডাকা শুরু করলাম।

ছোট ছোট বিষয়-ঝগড়া আর আদিবের এসে বলা সরি আর আমার সর্বকালের ঝাড়া ডায়লগ সরি বললেই সব ঠিক হয়ে যায় না এসব মিলিয়ে কেটে গেলো আরোও কিছু বছর।

আর এখন,বর্তমান কালের কিছু বছরগুলো এমন হয়েছে যে সরিটা আমিই বলি সে হয়তো হুম বলে।রাগ করে ব্লক করে সে-ই রাখে আমি হয়তো নিজে থেকেই দেখা করতে গিয়ে সব ঠিক করি।
এভাবে ঠিক থাকেও কিছুদিন কিন্তু আবার…….
আসলে আদিব খুব চরিত্রবান আর বুদ্ধিমান ছেলে।অনেক বাস্তবিকও।কিন্তু আমি যে সেই আবেগের প্রেমে পরেছিলাম তাই বিয়ের বয়সে এসে আদিবের এমন অতি বাস্তবিক কথা প্রমিকা হিসেবে মেনে নিয়ে নিজেকে যখন আদিবের বউ হিসেবে কল্পনা করছি বড্ড বেমানান লাগছে।

নাহ!!ক্যাফেতে আর বসে থাকা যাবে না কেমন অসহ্য লাগছে।
আমি কাঁদতে কাঁদতে বাসায় চলে এলাম।বাসায় ঢুকতেই আম্মু জিজ্ঞাসা করলো:
“কিরে আদিবের সাথে দেখা হলো?কবে দেখতে আসছে ওরা তাহলে?”

আম্মু-বাবা কেউই আদিবকে শুরুতে মেনে নেয়নি।নিজের কতো বিয়ের ঘর যে ভেঙেছি আদিবের জন্য তার হিসাব নেই। অনেক কষ্টে খাওয়া-দাওয়া বন্ধ করে,রাগ দেখিয়ে দরজা বন্ধ রেখে তবেই বাবা-মাকে রাজি করেছিলাম।আদিবের বেতন ১০ হাজার,পরিবারের অবস্থাও তেমন ভালো না এসব নিয়ে আমার কখনও কোনো মাথা ব্যাথা না থাকলেও বাবা-মার এতে ছিল ঘোর আপত্তি।কিন্ত আমার জেদের কাছে এই আপত্তি বশ্যতা শিকার করলো।

আম্মুকে কিছু না বলে আমার রুমে চলে এসেছি।দরজা বন্ধ করে বেসিংএ গিয়ে চোখে-মুখে পানি দিয়ে এবার আয়নায় নিজেই নিজেকে বেশ কিছুক্ষণ দেখে আমার আমিকে আয়নার প্রতিবিম্বে আবিষ্কার করে নিজেই নিজের সাথে কথা বলার চেষ্টা করলাম:

“তুই কতো বোকা রে সুপ্তি!যখন ছেলেটা প্রেম করতে এসেছিলো কেন তুই স্টেম্পে তার লিখিত দলিল নিলি না?কেন তখন সেই দলিলে তাকে দিয়ে স্বাক্ষর করিয়ে এটা লিখে রাখলি না যে, তুই তার এবং তার পরিবারের যোগ্য কিনা!কেন তুই বুঝলি না,কোনো মানুষের যখন তার খুব ভালো লাগার মানুষটির ব্যাপারে জানা শেষ হয়ে যায় তখন তার প্রতি আগ্রহ কমে যায়।মানুষ মাত্রই পরিবর্তনশীল আর গিরগিটির মতো রঙ বদলায়।যার জন্য আদিব তার পরিবারের বিরুদ্ধে গিয়েছিলো,পরিবারের কথা অমান্য করেছিল আর আজ সে-ই পরিবারের দোহায় দিয়ে তোকে ছেড়ে যাচ্ছে।”

আম্মুর ডাকে আবারোও ঘোর কাটলো আর তার হাজারো প্রশ্নের ভিড়ে আর এটা লুকাতে পারলাম না যে আদিব আমায় বিয়ে করতে চায়না।কথাটা শুনা মাত্রই আম্মুর অপমানজনক কথায় যেন আমার বুকের ভেতরের ক্ষততে লবণ আর মরিচ ঢালার স্বাদ পাচ্ছিলাম।
বাবাও আমার সাথে কথা বলা বন্ধ করে দিল।অপরদিকে,আমি ভাবছিলাম আদিবের মাকে সব বলবো বা আদিবের হাত-পা ধরে ওকে বিয়ে করতে রাজী করাবো। কিন্তু মন তা করতে চাইলেও বিবেকের কাছে বাঁধা পরছিলাম বারবার।
আসলে,অনেক বছরের সম্পর্ক তো তাই সম্পর্কের চেয়ে সময়ের বাঁধনে বাঁধা পরে গিয়েছিলাম বেশি।কথা বলাটা যেন অভ্যাস হয়ে গিয়েছিলো।অভ্যাসের ফলশ্রুতিতে আদিব আর আমি একে অপরের খোঁজ নিতাম… কেমন আছি এই অবদিই কিন্তু আদিব তখনও বিয়ে করতে নারাজ। আমিও জোড়াজুড়ি বা তাকে প্রতারক বলে আখ্যাও দেয়নি।কারণ,আমি জানতাম আদিবের যা মন চায় তাই করে, আর আদিব ভুল কিছু কখনও করতেই পারে না।আসলে, বিশ্বাস করাটা সময়ের সাথে কখন যে রক্তে মিশে গিয়েছে বুঝিনি।আর আমরা মেয়েরাও বড্ড অদ্ভুত কাউকে ভালোবেসে ফেললে তার প্রতি আসক্ত হয়ে যায়।

এভাবে চলতে চলতে সত্যি সত্যিই বিয়েটা ঠিক হয়ে গেলো বাবার বন্ধুর ছেলের সাথে। আর এবার না করারোও মুখ নেয়! আমার আত্মহত্যা করার মতোও সাহস নেয় ।দেখতে এসেই আংটি পরিয়ে চলে গেলো।ঠিক করেছি বিয়ের কার্ডটা আগে আদিবকেই দিব…
আজ মনটা শক্ত করে আবার আদিবকে ক্যাফেতে আসতে বললাম……

সম্পর্কের নতুনত্বে আদিব নিজ থেকেই আগে এসে আমার জন্য অপেক্ষা করতো,তার নাকি আমার জন্য ঘন্টার পর ঘন্টা অপেক্ষা করতে ভালো লাগতো।আর এতে নাকি আমাকে অনুভবও করে বেশি আর ভালোবাসাও বাড়ে।গত ১ বছর যাবত অবশ্য আমিই তার জন্য অপেক্ষা করি ঘন্টার পর ঘন্টা আর সে ব্যস্ততায় দেরি করে ফেলে।
অথচ,আমিই নাকি ছিলাম তার পৃথিবী।আম্মুর ফোন চুরি করে সারারাত কথা বলার দিনগুলো কবে যে হারিয়ে গেলো চোখের পলকে টেরই পেলাম না।কত শখ ছিলো ওর, আমার নিজের ফোন হবে…আর ওকে আমার সাথে আম্মুর ফোন দিয়ে লুকিয়ে লুকিয়ে কথা বলতে হবে না।আজ দামি ফোন তো হলো ঠিকই কিন্তু কথা বলার মানুষটি কই…
এসব ভাবতে ভাবতেই আর ভাবনার ঘোর কাটিয়ে আদিব এসে আমার সামনের চেয়ারে ধপাস করে বসে পরলো……
চলবে…
নিষিদ্ধ_ভালোবাসা
পর্ব-(১)
নওরীন খান।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here