নিষিদ্ধ_ভালোবাসা পর্ব_২

1
8220

নিষিদ্ধ_ভালোবাসা
পর্ব_২
#Nowrin_Khan

৯ বছরের সম্পর্কের পর আমার প্রেমিক আদিবকে আজ কিভাবে আমার বিয়ের কার্ডটা দিবো ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না।

ক্যাফেতে সামনের চেয়ারটায় আদিব বেশ ফুরফুরে মেজাজে বসে আছে আর গুণগুণ করে গানও গাইছে।কাউকে বিয়ে করতে চেয়ে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম মন থেকে আর সেও প্রতিজ্ঞাবদ্ধ ছিল।আজ সময়ের ব্যাবধানে তার আবেগ হয়েছে শূন্য,কমেছে আমার প্রতি মায়া আর টান আর আমারও থেমে নেয় কিছু।সময়ের স্রোতে চলছে সব….আসলে কারোর জন্য জীবনের কিছুই থেমে থাকে না!ঠিক চলে যায়…হয়তো যেভাবে চালানোর পরিকল্পনা করা হয়েছিল সেভাবে চলে না আর ভালো-মন্দেরও হিসাবের মাঝে পরে না।

~আদিব এই নে আমার বিয়ের কার্ড..তোকেই প্রথম দিলাম।
~কিছুটা ভূত দেখার মতো চমকে ওঠে!বিয়ে মানে?কার বিয়ে?
~বললাম তো আমার বিয়ে।
~আমাকে তো জানালি না।কার সাথে আর কবে?
~কার্ডেই সব দেওয়া আছে।এইতো জানালাম।
~হুম।(কিছুটা উদাস আর দুঃখী মনে)

আদিবটাও না এমন অদ্ভুত।যখন আমি তার সাথে সারাজীবন পার করার আশায় তার প্রতীক্ষায় ছিলাম তখন আমায় ঠিক অগ্রাহ্য করেছিলো।ঠিক যখনই আমি ওকে ওর কাঙ্ক্ষিত মুক্তি দিতে চাইলাম তখনই ওর চোখে মুখে কষ্টের ছাপ স্পষ্ট। হয়তো, এখন আমায় প্রতারক বলে বন্ধুমহলে এই দুঃখীমুখটা নিয়ে ঘুড়ে বেড়াবে আর আমি আখ্যায়িত হবো প্রতারিকা প্রেমিকা নামে।

~আদিব শোন যাওয়ার আগে শেষ একটা কথা বলে যাচ্ছি..
~হুম্ম বল।
~পরবর্তীতে যখন বিয়ে বা প্রেম করবি একটু কষ্ট করে বাসা থেকে জেনে নিস তারা কেমন মেয়ে চায়,আর নিজের মনের সাথেও কথা বলে নিস সে কি ৯ বা ১০ বছর পর বদলে যাবে কিনা!আসি….(কান্নাজড়িত কন্ঠে)

বাসায় আসার সাথে সাথেই আদিবটা কল দিলো।নাহ ধরবো না…অনেকটা দেরী হয়ে গিয়েছে।তাছাড়া,একমাত্র মেয়ে হিসেবে আমারও বাবা-মার প্রতি কিছু দায়িত্ব তো রয়েই যায়।
২বার কলটা বেজে কেটে গেলো…
ঠিক ৫টা মিনিট পরেই নিজের জেদের কাছে অন্তরে লুকিয়ে থাকা ভালোবাসা জিতে গেলো আর কেন ফোন করছে জানার আগ্রহও দমাতে না পেরে কল দিয়ে বসলাম।
~হ্যালো ফোন দিলি যে?আমি তো সব বলেই এসেছি।তাহলে আবার এখন কেন।
~নাহ এমনিই দিলাম।সত্যিই তোর বিয়ে?
~হ্যাঁ
~আচ্ছা।ভালো থাকিস।আর মনে পরছে তোকে খু…..
এতটুকু বলতেই কলটা কেটে দিলাম।নাহ!আমি আবার মায়ায় জড়িয়ে যাচ্ছি…
মেয়েদের এই মন নিয়েই যত্তসব ঝামেলা।একবার মায়ায় জড়িয়ে গেলে আর ছাড়তে চায় না।এখন আদিব যদি আমায় ফোন না দিতো মনকে ঠিক বুঝ দিয়ে নিতাম যে,বিয়ের কার্ডটা পেয়ে আদিব খুশি হয়েছে আর মুক্তিও পেয়েছে।কিন্তু এখন?
এই আদিবটা আমায় জ্বালিয়ে মারলো!অবহেলা করে ছেড়েও যেতে চাইছে,আবার যখন মুক্তি পাচ্ছে আমায় তখন মায়ায় জড়িয়েও ফেলছে।
এক প্রবল দ্বিধায় ভুগছি আমি!এমন সময়ই বাবা এলো হাতে গয়নার ৩টি বাক্স নিয়ে:
“মা রে জানি তোর জীবনে একটা খুব খারাপ সময় গিয়েছে।তুই-ই আমাদের একমাত্র মেয়ে।তাই আমাদের বাবা-মা হিসেবে সব শখ-আহ্লাদ তোকেই ঘিরে।এই গয়না গুলো তোর মা আর আমি টাকা জমিয়ে জমিয়ে খুব শখ করে বানিয়েছিলাম।আমাদের মেয়েকে গয়নায় মুড়ে দিবো বলে।এই যে নিজ হাতে তোর বিয়ের এতো সব আয়োজন করছি,তোর ভবিষ্যৎটা নিজ হাতে গুছিয়ে নিশ্চিন্ত হতে পারছি এই জীবনে এইতো ঢের!আর কি প্রয়োজন!তাছাড়া দুলাল আমার বন্ধু,একই শহরে থাকা হতো না বলে তোদের সাথে দেখাও করানো হয়নি তাই চিনিস না,শুনেছি তার ছেলেও খুব ভালো..তুই ভালো থাকবি মা।”

বাবা চলে গেলো কিন্তু আমায় আবার আরেকটা মায়া আর কর্তব্যবোধে জড়িয়ে দিয়ে গেলো।বাবা-মার প্রতি মায়া আর পরিবারের প্রতি কর্তব্যবোধ।এই মূহুর্তে দাঁড়িয়ে কেন জানিনা জীবনে আর বিয়েই করতে ইচ্ছা হচ্ছে না।মনে হচ্ছে,বিয়েই কি সব!যদিও আমার ভাবনাগুলো অবাস্তব,ভিত্তিহীন।তবুও মন বলছে ভালো হতো!

এমন সময় মা এলো হাতে ফোন নিয়ে।আমাকে পাশে বসিয়ে খুব আনন্দিত নয়নে বললো:
” এই নে নীলয়ের নাম্বার। কথা বল..বিয়ের আগে একটু একে অপরকে চিনে নে।”
প্রথমে,নীলয় নামটা শুনেই কেমন ধুপ করে ওঠেছিলো বুকটা।এক মূহুর্তের জন্য আদিব শুনেছিলাম।

মাকে হতাশ করে দিয়ে বললাম: “নাম্বার লাগবে না, যা কথা বলার তোমরাই বলে নাও।”
জোড় কদমে আগাতে লাগলো বিয়ের আয়োজন।বাসায় সব আত্মীয় স্বজনরাও চলে এসেছে।এরই মাঝে আদিবের মায়ের ফোন:
~হ্যালো সুপ্তি?
~জ্বি।আসসালামু আলাইকুম।
~ওয়ালাইকুম আসসালাম।শুনলাম বিয়ে করছিস?
~হুম।তবে বিয়েটা করছি না,বাবা-আম্মুই ঠিক করে দিয়ে দিচ্ছে।তুমি কেমন আছো?প্রেসারটা নরমালে আছে তো?
~রাখ তো তোর প্রেসার।তা আমার ছেলেকে যখন বিয়েটা করবিই না প্রেমটা করতে এসেছিলি কেন?
~তুমি সবটা জানো না তাই এমন বলছো।
~জানি জানি।সব জানি।শুনলাম তোর বরটাও খুব বড়লোক।হয়তো সেটাই কারণ… ভালো থাকিস।

আদিবের মা হয়তো অভিমান করেছে।আসলে, সব মায়েরাই নিজ সন্তানের সুখ-দুঃখের কথা সবার আগে ভাবে।নিজের মায়ের কাছেই হয়তো সন্তানের বড় অপরাধও বড় নয়।সে যায় করুক সবার আগে নিজের সন্তানের সুখ-চাহিদা।

তবে,কেন জানিনা নিজেকেও অপরাধী লাগছে।আদিবটা অবহেলার পর আমাকেই আবার অপরাধী করে ছাড়লো।

ফেসবুকে ঢুকে দেখলাম অনেকেই ম্যাসেজও করেছে।বেশিরভাগ ম্যাসেজই আমাকে আর আদিবকে নিয়ে করা।বেশির ভাগ ম্যাসেজগুলো এমন যে:
~”এতো বছরের সম্পর্কের পর তুই কিভাবে পারছিস বিয়ে করতে?”
~”আপু আদিবদা কে এভাবে কষ্ট দিতে পারছো তুমি?”
~”শুনলাম বর নাকি খুব ধনী তা আদিবকে কি এই কারণেই ছেড়েছেন নাকি ম্যাডাম?”
এই হলো আমার ইনবক্সের অবস্থা।হয়তো গ্রুপে গ্রুপে আমায় নিয়ে সমালোচনার ঝড়ও বয়ছে।আসলে,আদিবের আমার প্রতি করা অন্যায় আর অবহেলাগুলো ছিল লোকচক্ষুর অন্তরালে।তাই তা কারোর চোখে পরেনি বলে কেউ সেইদিক থেকে বিচার করছে না।সেইসব শুধু আমার মনেই কষ্টের ছাপ ফেলে গিয়েছে সকলের অগোচরে।কিন্তু আমার বিয়েটা স্পষ্ট তাই সবাই এইদিক থেকে অর্থাৎ বলা যেতে পারে একদিক থেকে বিচারে মত্ত।
আমরা মানুষেরা বড্ড অদ্ভুত।যা দেখি তাই বলি,ঘটনার পৃষ্ঠের ঘটনা দেখার চেষ্টা করিনা।

আজ রাত পার হলেই আমার গায়ে হলুদ।কাল বিয়ে…
আদিবের দেওয়া সমস্ত উপহার গুলো বের করেছি।এগুলো আমি সারাজীবন বয়ে নিয়ে বেড়াতে পারবো না।আমার বুকের উপর বোঝা হয়ে থাকবে আর কাঁটার মতো বিঁধবে।অশ্রুসিক্ত নয়নে উপহারগুলো শেষবার দেখছি…..
কতো মায়া,আবেগ,অনুভুতি, স্মৃতি জড়িয়ে আছে এগুলোয়।আমি কখনোও আদিবের দেওয়া উপহার গুলো ব্যবহার করতাম না।স্মৃতিচিহ্ন হিসাবে রেখে দিতাম।এসব কাল এক বান্ধবীর কাছে দিয়ে যাবো।আদিবকে ফেরত দিতে।

যতই জিনিসগুলো দেখছি ততই মায়া বাড়ছে।আচ্ছা আমি পালিয়ে যাই আদিবের সাথে?ছিঃ ছিঃ কি ভাবছি এসব!মা-বাবার সমাজে মুখ থাকবে না তাহলে।মন সকল বোঝার উর্ধ্বে তাই হয়তো মানতে চাইছে না আর মানাতেও পারছি না।তাছাড়া,আদিবও মানবে না।এমনটা ভাবতে ভাবতেই বিয়ের দিন চলে এলো….আমার পালিয়ে যাওয়ার ইচ্ছা, পরিকল্পনা মাটি করে দিয়ে আজ আমার বিয়ে।হঠাৎ আমার পাশে বসা বান্ধবীর ফোনে আদিবের নাম্বার থেকে কল।ফোনটা ধরার সময় পাওয়ার আগেই কাজী সাহেব এসে হাজির।

আমি আর আমার মাঝে ছিলাম না,মন বলেও কিছু অনুভব করছিলাম না,অঝোরে কেঁদেই যাচ্ছিলাম আর এরই মাঝে বিয়ে হয়ে গেল।

আমার চেনা শহর আর মানুষগুলোকে ছেড়ে চলে এলাম ভিন্ন এক শহরে।

ফুলসজ্জার খাটে বউ সেজে বসে আছি।আদিবকে নিয়ে কল্পনা করা এই দিনে আজ দিনটা ঠিক থাকলেও বদলে গিয়েছে মানুষ।
তবে,আমার কাউকে ঠকানোর অধিকারও নেয়।তাছাড়া যে আমায় বিয়ে করেছে তারও অধিকার আছে আমার অতীত সম্পর্কে জানার।আজই সব বলে দিতে হবে….
ঘড়িতে বাজে রাত ১২ টা।এসময় নীলয় ঘরে প্রবেশ করলো।আমি ঘরেই পায়চারি করছিলাম আর ভাবছিলাম নীলয়কে সব কিভাবে বলবো আর শুরুটাইবা কিভাবে করবো!কিভাবে বুঝাবো যে,আমার ওকে এই মুহুর্তে স্বামী হিসাবে মেনে নেওয়া সম্ভব না।আমারও তো মন আছে, আমি তো আর নিজের মনের উপর জোর খাটাতে পারি না।

নতুন বউয়ের এমন চিন্তিত মুখে পায়চারি দেখে নীলয় খুব অবাক হলো মনে হলো।তাকে আরোও অবাক করে দিয়ে বললাম,
“আমার আপনার সাথে কিছু কথা আছে”
চলবে…..
(১ম পর্বের লিংক কমেন্টে দেওয়া আছে)

1 COMMENT

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here