নিষিদ্ধ_ভালোবাসা পর্ব_৩

0
5184

নিষিদ্ধ_ভালোবাসা
পর্ব_৩
#Nowrin_খান

ফুলসজ্জার রাতেই আমার নতুন বরকে আমার প্রেমিকের কথা বলে দিয়েছিলাম।সাথে এটাও বললাম, এই মুহুর্তে আমাকে তার স্ত্রীর ভূমিকা পালন করা সম্ভব না।
কয়েক মাসের প্রেমিক হলে তাও একটা কথা ছিল,৯ বছরের সম্পর্ক ছিল আমাদের!

নীলয় মানে আমার বর আমাকে ছেড়ে দিবে নাকি আমার অতীত মেনে নিবে এসব কিছুই কথাগুলো বলার আগে মাথায় কাজ করছিলো না বা আসেও নি।মাথায় তখন শুধু একটাই কথা ছিল যে,কিভাবে তাকে সব গুছিয়ে বলবো,কিভাবে শুরু করবো।তবে,কথাগুলো বলার পর নীলয়ের নিস্তব্ধতার এই মুহুর্তে আমার ভবিষ্যত নিয়ে ভাবছি আর মনে মনে দৃঢ়তা আনছি যাতে বের করে দিলেও অনুনয়-বিনয় করতে না হয়, আবার বাবা-মায়ের উপরেও বোঝা না হতে হয়!
আমার ভাবনা আর নীলয়ের নিস্তব্ধতার পাঠ শেষ করে নীলয় শুধু একটা কথাই বলে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো:
“ঘুমিয়ে পরো”
আমার মনে হাজারো প্রশ্নের ভিড় এসে জড়ো হলো।নীলয় কেন আমার ৯ বছরের সম্পর্কের কথা আর সেটা ভাঙ্গনেরও কারণ জেনে কিছুই বললো না!নীলয় কি কাল আমায় বের করে দিবে!
এসব ভাবতে ভাবতেই কখন যে ঘুমিয়ে গেলাম বুঝেই ওঠতে পারলাম না আর সকালে ঘুম ভাঙলো ননদের ডাকে।ওঠার সাথে সাথেই ননদের প্রশ্নের মুখে পরলাম:
“একি ভাবি ভাইয়া অন্য ঘরে ঘুমাচ্ছে যে?”
কিছুই বললাম না কিছুটা এড়িয়েই ওয়াশরুমে ঢুকে ফ্রেশ হয়ে বের হতেই খেলাম আরেকটা ধাক্কা!
বিয়ে বাড়িতে মানে বরের বাড়িতে যতোজন আত্মীয় এসেছিল সকলেই আমার ঘরে এসে জড়ো হয়েছে আর নীলয় কেন ঘরে ছিল না তার গুঞ্জন।
এতো মহা বিপদ!আজ আবার বউভাতে বাবা-মাও আসবে তারা এসে এসব শুনলে বড্ড কষ্ট পাবে।হঠাৎ নীলয় ঘরে ঢুকে পরিস্থিতি তার পেট খারাপের কথা বলে ভালো ভাবেই ঠান্ডা করে দিলো।আসলে নীলয়ের পরিবারেরও তো মান-সম্মানের ব্যাপার আছে!
এই যাত্রাই রক্ষা!
এরই মাঝে নীলয় আমার সাথে খুব দরকার ছাড়া একটা কথাও বলে না আর পরিস্থিতি এড়াতে ওর ঘরেই খাটে আমাকে থাকতে দিয়ে সে থাকে নিচে।যদিও ওইদিকে আমার কোন মাথা ব্যাথাই নেই।

বউভাত,নীলয়ের বাড়ির আত্মীয়দের আপ্যায়ন,নতুন বউয়ের কর্তব্য,শ্বাশুড়ির থেকে রান্না শিখা,ননদের চাহিদা মিটানো আর তার সাথে আড্ডায় ব্যস্ত আমি আমার ৯ বছরের অভ্যাস কাটিয়ে ওঠতে চলেছি।অভ্যাসটা ছিল আদিবের সাথে কথা বলা।যার সাথে কথা বলা ছাড়া একটা দিনও থাকতে পারতাম না,যার সাথে ৫ ঘন্টা কথা না হলেই গাল ফুলিয়ে দিতাম আর মাঝে মাঝে আমায় ভুলে গিয়েছে,সে বদলে গিয়েছে ভেবে ফুপিয়ে কাঁদতাম।এই মূহুর্তে এসে এটা আবিষ্কার করলাম যে,
“ব্যস্ততা মানুষকে সব ভুলিয়ে রাখতে পারে”
তবে হ্যাঁ, যখন সংসারের এসব ঝামেলা থেকে কিছুটা একা থাকি,যখন সন্ধ্যার পর ছাদে কিছুটা সময় কাটাই বা নির্ঘুম কোন রাত কাটে,হঠাৎ যখন খুব ভোরে ঘুম ভেঙে যায় খুব মনে পরে তখন আদিবের আমাকে আর আমার আদিবকে দেওয়া কথাগুলো।কতো বিকাল একসাথে হাতে-হাত রেখে ভবিষ্যত সংসারের পরিকল্পনা করে কাটিয়েছি!আমাদের সন্তানের নাম ঠিক করেছি!এসব ভাবলেই গাল বেয়ে ২ ফোটা জল পরে যায়।ঠিক তখনই মনটা আবার আদিবের সাথে কথা বলতে উথাল-পাতাল করে,ফোনটা হাতেও নেই কিন্তু ফোন আর দেওয়া হয় না।নাম্বারটা এখনও চোখ বন্ধ করে ডায়াল করতে পারি!

এখন সময়টা কাটছে মিষ্টির প্যাকেট হাতে নিয়ে আত্মীয়দের বাড়ি ঘুরতে ঘুরতে।নিজেদের মাঝে মিল থাকুক বা না থাকুক প্রকৃতির রীতি এড়ানোর সাহস আমাদের নেই,পরিবার আর সমাজ নামক শিকলে আমরা বাঁধা।
এখন আদিবকে আরেকটু ভুলে গিয়েছি,দেখা যাচ্ছে আগে প্রতিদিন একবার করে কথা বলার শখ জাগলেও এই আত্মীয়দের ভীড়ে আর ঘুরতে ঘুরতে নিজের ক্লান্ত শরীরে নিজেকে নিয়েই ভাবার সময় পাইনা।
আত্মীয়দের বাড়িতে ঘুরার পাঠ চুকিয়ে এখন নাকি নীলয়ের বন্ধুরা আসবে তার বউকে দেখতে।নীলয়ের পরিবারের সবাই গিয়েছে গ্রামে তাই সব রান্নাবান্না থেকে শুরু করে সব দায়িত্ব এলো আমার ঘাড়ে।নীলয় টুকটাক যা-ই কথা বলে বা অর্ডার করে কিছুই ঠিক মানুষের সাথে কথা বলার মতো না।অনেকটা রাগী আর ধমকের সুরে,দায় সারা কথা-বার্তা।শুরুতে এসব আমার গায়ে না লাগলেও আর এটাই চেয়েছিলাম ভাবলেও কয়েকদিন ধরে আমার বেশ রাগ আর খারাপও লাগছে।মনের একদিক বলছে এমনই তো কথা ছিল আবার অন্যদিক বলছে একসাথে এতোদিন থাকছি একটু ভালো করে কথা বললেও তো পারে,বাড়ির বুয়ার সাথেও তো আমার থেকে ভালো আচরণ করে!
নীলয়ের কথা যখন আমার মনে আঘাত করে ঠিক তখনই আদিবটার কথা মনে পরে:
“ইসস আদিব কখনই পারতো না এভাবে কথা বলতে,নীলয়ের জায়গায় আদিব থাকলে খুব ভালোও থাকতাম!”
মনে রয় আফসোস আর চোখে জল।

আসলে,মানুষের সন্তুষ্টির বরই অভাব।আর,কোনো মানুষ কাছে না থাকলেই তার শুধু ভালো দিকই মনে পরে।মন থেকে মুছে যায়,আদিবের করা আচরণ।এখন যদি আদিব এই আচরণ গুলো করতো বা আদিবের সাথে বিয়ে হতো আমার আফসোস তখনও থাকতো।মনকে সন্তুষ্ট করা খুবই কষ্টসাধ্য ব্যাপার।

যাইহোক,বুয়াকে সাথে নিয়ে নীলয়ের বন্ধুদের জন্য নানাধরণের খাবার রান্না করলাম।রান্নার ব্যস্ততায় আদিবের জন্য আফসোস আর নীলয়ের জন্য রাগ কিছুই অনুভবে আর আসলো না।আগেই বলেছিলাম:
“ব্যস্ততা মানুষকে সব ভুলিয়ে রাখতে পারে”
খাওয়া শেষে নীলয়ের বান্ধবীদের সাথে ছাদে বসে আড্ডা মারছিলাম।কথায় কথায় নীলয়ের ২ জনের সাথে সম্পর্কের কথা ওঠে এলো।একজনের সাথে ব্রেক-আপের পর তাকে ভুলতে আরেকটি মেয়ের সাথে কথা বলতে বলতে বন্ধুত্ব থেকে সম্পর্কে জড়িয়ে গিয়েছিলো নীলয়।কিন্তু মেয়েটির নাকি বিয়ে হয়ে গিয়েছিলো!তখন নীলয়ের চাকরীও ছিলো না!মেয়েটি নাকি বাবা-মায়ের আর পরিবারের দোহায় দিয়ে নীলয়ের থেকে বিদায় নিয়েছিলো।নীলয়ের সেই বান্ধবীটি হাসতে হাসতে বললো:
~”জানো পরে কি হয়েছিলো?আমি ওই মেয়েকে ম্যাসেজ দিয়েছিলাম তার বিয়ের দিন”
~”কি ম্যাসেজ?”
~”বাবা-মায়ের কথার বিরুদ্ধে যাবি না তাইলে করলা ভাজি করলে খাছ না কে ছেরি?”
আপুর কথা শুনে খুব হাসি না পেলেও আপু যে ময়মনসিংহের সেটা খুব ভালো করেই বুঝতে পারলাম।
রাতে নিজে নিজেই ভাবছি:
“নীলয় নিজে ২টা সম্পর্কে ছিল তাহলে আমার সম্পর্কের কথা শুনে সে এমন রাগ কেন দেখাচ্ছে।সে কিছু বললেও সরাসরি বলা হয়ে যেত কিন্তু একই বাসায় থেকেও শত্রুর মতো আচরণ কেন করছে?”

এই ছেলেগুলোও না অদ্ভুত।নিজের সব ভুল বা দোষ দোষ না কিন্তু প্রেমিকা বা বউয়ের দোষ আর দোষ থাকে না মহা-অন্যায় হয়ে যায়।তারা শুধু অন্যদেরই বিচার করবে নিজেদের দৃষ্টিকোণ থেকে কিন্তু নিজেদের গুলো নিয়ে ভাববে না।

এরই মাঝে নীলয়ের বাড়ির সকলেই ফিরে এলো এক মহা প্রস্তাব নিয়ে।আমাকে আর নীলয়কে হানিমুনে পাঠাবে!কক্সবাজারের সব আয়োজনও করে ফেলেছে।না করারো মুখ নেয় আর না করলেই সন্দেহ করে হাজারো প্রশ্ন করবে।বাধ্য হয়েই প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম আর মনে মনে ভাবছিলাম:
“ইসস বান্ধবীদের সাথে গেলে কত্তো মজা হতো!সারাজীবন তাদের সাথে এই জায়গায় ট্যুর দেওয়ার প্ল্যানই করে গিয়েছি,বাস্তবায়ন আর হয়নি”
হঠাৎ করে মনে পরলো, বেশ কয়েকদিন পরেই মনে পরলো আদিবের কথা!আমাদের অনেক শখ ছিলো ১ মাসই হানিমুনে খুব ঘুরে-বেড়াবো!
হঠাৎ করেই এসব ভাবতে মানে আদিবের কথা ভাবতেই এমন অপরাধ-বোধ জাগছে কেনো!তবে কি আমার মন নিজেকে এই বাড়ির মানে নীলয়ের বউ ভাবতে শুরু করেছে!
ভাবনার ঘোর কাটিয়ে ব্যাগ গুছানোয় মন দিলাম আর ঠিক করে নিলাম হানিমুন-টানিমুন কিচ্ছু না নিজে নিজেই ঘুরতে তো পারবো!
বিয়ের ঝামেলায় আর আদিবের বিরোহে মনটা কেমন দুমড়ে গিয়েছে!সমুদ্রের কাছে গিয়ে সব ভুলে হালকা হয়ে আসি!
পরেরদিন,রাতে বেরিয়ে পরলাম কক্সবাজারের উদ্দেশ্যে আর সকালে হোটেলে উঠলাম।

আমার বর রিসিপশনে গিয়ে সব ফরমালিটিস সারছে আর আমি ওয়েট করছি।হুট করে আমার সামনে দিয়ে আদিব রিসিপশনের এদিকে হেঁটে গেলো! না চাইতেও ওঠে তার পিছু পিছু যাচ্ছি।সে রুম বুকিং দিচ্ছে আর তার পাশেই দাঁড়িয়ে আছে একটি মেয়ে……
চলবে…..
(আগের পর্বের লিংক কমেন্ট বক্সে দেওয়া থাকবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here