#নিষিধ_বরণ,পর্ব (২)
#রোকসানা_রাহমান
ক্লাস রুমে ঢুকে খানিকটা অবাকই হলো নিহিতা। রঙিন কাগজ,বেলুন, জরি ও সুগন্ধ ভরা ফুলে সাজানো চারপাশটা মুগ্ধ করার মতো। তার চোখে মুগ্ধতা ধরা দিয়েও কোথায় যেন হারিয়ে গেল। বিরক্ত ভর করল কপালের গাঢ় ভাজে! দূরে এক কোণে টেবিলের উপর রাখা কেকটার দিকে চেয়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। বিড়বিড় করে, ‘ আল্লাহ, তুমি এদের সুবুদ্ধি দেও। তোমার পথে টেনে নেও।’ তারপরে ধীর পায়ে হেঁটে যায় বন্ধুদের নিকট।
নিহিতা এবার অনার্স দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী। ইংলিশ নিয়ে পড়ছে। ভালো ছাত্রী ও শেখার প্রতি প্রবল ঝোঁক থাকায় নিয়মিত ক্লাসে উপস্থিত থাকে সে। তবে আজ উপস্থিত থাকার কোনো ইচ্ছে ছিল না। কেননা, আজ কোনো গুরুত্বপূর্ণ ক্লাস নেই। ক্লাসের পুরো সময়টা ব্যয় হবে অন্য কাজে। আজ ইংলিশ বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক দিয়া ম্যামের জন্মদিন। সেই উপলক্ষেই ছাত্র-ছাত্রীদের পক্ষ থেকে এই আয়োজন। কেক কাটা থেকে শুরু করে নাচ-গানে গিয়ে শেষ হবে। যার কোনো কিছুতেই আগ্রহ নেই নিহিতার বরঞ্চ বিষাদ আর বিরক্তে ঝিম ধরে আছে মন ও শরীর।
তিন জন মেয়ে ও দুই জন ছেলের একটি দলের কাছে এসে থামল নিহিতা। গোল বৈঠকে বসেছে তারা। সকলের চোখে-মুখে চাপা উত্তেজনা। প্রবল কৌতূহলে ঠোঁট দুটো কেঁপে থেমে যাচ্ছে আকস্মিক। অঙ্গভঙ্গিতে চঞ্চলতায় ভরপুর। ভয়াবহ কিছু করে ফেলার আগ মুহূর্ত! নিহিতা সকলের মনোযোগ ভেঙে বলে উঠল,
” আসসালামু আলাইকুম। ”
সালামের উত্তরে কয়েক জোড়া বিরক্ত চাহনি উপহার পেল। একজন তো বলেই বসল,
” তুই সবসময় আমাদের আনন্দ মাটি করে দিস, নিহি! ”
নিহিতা অপ্রতিভ হয়ে পড়ল। মন খারাপ করে বলল,
” এবার কী করলাম? ”
গোল বৈঠক ভেঙে দিয়ে কলম উঁচিয়ে সুমি বলল,
” কথা ছিল আজ আমরা মেয়েরা হালকা নীল শাড়ি পরব। ছেলেরা গাঢ় নীল পাঞ্জাবি। কিন্তু তুই? সেই বোরকা পরে চলে এলি? আমাদের অনুরোধের কোনো মূল্যই দিলি না? তুই কি আমাদের আদৌ বন্ধু ভাবিস? ”
নিহিতা কী বলবে খুঁজে পেল না। অসহায় বোধ করছে। সে জানত এমন একটা প্রশ্নের সম্মুখীন হতেই হবে। তবুও কেন উত্তরটা গুছিয়ে নিতে পারল না? বন্ধুদের অভিযোগটা ফেলে দেওয়ার মতো নয়। এই একটা অনুরোধ রাখতে গিয়ে বার বার ব্যর্থ সে। কী করে বুঝাবে তার পক্ষে বোরকা ছাড়া বাইরে বের হওয়া অসম্ভব!
নিহিতা উত্তর না দিয়ে একটা বেঞ্চে বসল। সুমির বাম হাতে ধরে রাখা কাগজটার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল,
” কী লিখছিলি তোরা? ”
উত্তর দিল সানোয়ার,
” লাভ লেটার। ”
কথাটা বলেই নিহিতার পাশে বসল সে। নিহিতা তৎক্ষণাৎ দাঁড়িয়ে পড়ল। অবাক হয়ে বলল,
” লাভ লেটার! কার জন্যে? ”
এই উত্তরটা সুমি দিতে চাইল। তবে দেওয়া হলো না। তার পূর্বেই সানোয়ার বলল,
” তুই কি আমাকে অপমান করলি,নিহি? ”
নিহিতা চোখ বাঁকিয়ে তাকালে সানোয়ার সকলের উদ্দেশ্যে বলল,
” আমি কি অপরিষ্কার থাকি? নাকি গোসল করি না যে আমি নিহিতার পাশে বসতে পারব না? আমার গা থেকে কি গন্ধ বের হয়? ”
শেষ প্রশ্নটা নিহিতাকে করেছে সানোয়ার। নিহিতা চোখ নামিয়ে ফেলল। খানিকটা সুমির দিকে চেপে দাঁড়িয়ে দুর্বল স্বরে বলল,
” সে রকম কিছু না। আমি আসলে…”
” তুই আসলে কী? আমার সম্পর্কে তোর ধারণা কী? একদম সত্যি করে বলবি। সেই প্রথম থেকে দেখে আসছি, আমাকে তুই পাত্তা দিস না। নিজ থেকে তো কথা বলতে আসিস না। আমি বলতে গেলেও বিরক্ত দেখাস। এক প্রশ্ন দুই-তিন বার করলে উত্তর আসে। এখানের সবার নাম্বার আমার কাছে আছে কিন্তু তোরটা নেই। রাস্তায় দেখা হলে মুখ লুকিয়ে চলে যাস। সমস্যা কী তোর? আমি কি তোর সাথে নোংরা আচরণ করেছি? ”
সানোয়ার উত্তেজিত হয়ে পড়েছে। গলার স্বর আরও বেড়ে যাওয়ার পূর্বেই রাসেল কাঁধ চেপে ধরল। শান্ত করতে বলল,
” কী করছিস? এখানে ক্লাসের সকলে আছে। ম্যামও চলে আসবেন এখন। ছেড়ে দে। ”
সানোয়ার থামল না। রেগে গেল খুব। রাসেলকে বলল,
” কেন ছেড়ে দেব? ও কি শুধু আমার সাথে এমন আচরণ করে? তোর সাথেও করে। কেন? আমরা কি ওর বন্ধু না? যদি তেমন হয় তাহলে সরাসরি বলে দিক। ”
এ পর্যায়ে সুমি কথা বলল,
” তুই অযথায় রেগে যাচ্ছিস, সানু। নিহি মাদ্রাসায় পড়াশুনা করেছে তাই হয় তো…”
” ঊর্মিও তো মাদ্রাসা থেকে পড়েছে, পর্দা করছে। ওর আচরণ এমন? ওর পাশে বসলে উঠে যায়? কথা বলে না আমাদের সাথে? বন্ধু হয়ে যদি বন্ধুকে বিশ্বাস করতে না পারে তাহলে কিসের বন্ধুত্বতা? ”
একটু থেমে আবার বলল,
” ঊর্মির মন ওর মতো নোংরা না। ও জানে বন্ধুদের মধ্যে একসাথে বসা, হাত ধরা, এমনকি জড়িয়ে ধরাও স্বাভাবিক। ”
নিহিতা আর চুপ থাকতে পারল না। শান্ত কিন্তু দৃঢ় স্বরে বলল,
” সম্পর্কে বন্ধু হলেও তুই আমার চোখে একজন ছেলে। স্বামী ব্যতীত অন্য কারও স্পর্শ আমার কাছে হারাম। ”
কথাটা বলেই ক্লাস থেকে বেরিয়ে এলো নিহিতা। মন খারাপের সাথে কিছুটা রাগও হচ্ছে। এজন্যই সে আসতে চায়নি। ঊর্মির জোরাজুরিতে আসতে হলো। রাত থেকে কল করে জ্বালাচ্ছিল। বার বার বলছিল, সে না আসলে ঊর্মিও আসতে পারবে না। বাসা থেকে বের হতে দিবে না। এক রকম বাধ্য হয়েই ঊর্মির সাথে বের হয়েছিল সে। বারান্দা পেরিয়ে সিঁড়ির মুখে পৌঁছাতে হাত-তালি ও সুর করে জন্মদিনের অভিনন্দন কানে এলো নিহিতার। এক বার ঘাড় বাঁকিয়ে ক্লাসের দরজার দিকে তাকাল। সেই সময় মনে পড়ল ঊর্মির কথা। ক্লাসে তো ও কে দেখেনি। আছে কোথায়? যে অনুষ্ঠানে আসার জন্য তার হাত-পায়ে পড়ছিল সে অনুষ্ঠান যে ঊর্মিকে ছাড়াই শুরু হয়ে গেছে! নিহিতা এদিক-সেদিক দৃষ্টি ফেলে এক তলাতে নেমে আসল। খেয়াল হলো দুজন এক সাথে ভার্সিটিতে আসলেও উপরে শুধু সে গিয়েছিল। ঊর্মি উঠেনি। উপহার আনার কথা বলে কোথায় যেন দৌড়ে চলে গেল। এত ঝামেলার মধ্যে তার কথা ভুলেই গিয়েছিল নিহিতা। এবার বেশ চিন্তায় পড়ল!
নিহিতা চিন্তিত বদনে পুরো ক্যাম্পাসে ঊর্মিকে খুঁজে বেড়াল। কয়েক বার কলও দিয়েছে। রিং হচ্ছে কিন্তু ধরছে না। এবার কিছুটা ভয় ঘিরে ধরল নিহিতাকে। মেয়েটা ঠিক আছে তো? সে দুশ্চিন্তাগ্রস্থ হয়ে অনার্স ভবনের ছাদের দিকে ছুটল। যদিও ছাত্র-ছাত্রীদের ছাদে উঠা নিষেধ, তবুও নিহিতা সেদিকেই ছুটল। মনটা যেন এক অদৃশ্য সংকেত পেয়েছে। বার বার মনে হচ্ছে ঊর্মি সেখানেই আছে।
ছাদে পৌঁছে ক্লান্ত দৃষ্টি এক পাশে পড়তে নিহিতার ছোটখাটো ধাক্কা লাগল অন্তরে। দূরের হালকা নীল রঙের শাড়ি পরিহিতা মেয়েটি ঊর্মির মতো দেখতে হলেও সে বিশ্বাস করতে পারছে না। তার স্পষ্ট মনে আছে ঊর্মিও তার মতো বোরকা পরে বের হয়েছিল। ভার্সিটিতে এসেছিল। তাহলে শাড়ি পরল কখন? আর সাথের ঐ ছেলেটি কে? এত ঘনিষ্ঠ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে কেন? নিষেধ থাকা সত্ত্বেও তার সাথে ছাদে কেন উঠেছে ঊর্মি? নাকি ছেলেটি জোর করে তুলে এনেছে? খারাপ কিছু করবে না তো? নিহিতা আরেকটু এগিয়ে যেতে ছেলেটির মুখ স্পষ্ট হলো। সাথে সাথে মনে পড়ল, এই ছেলেটি বেশ কয়েক মাস আগে ঊর্মিকে অনুসরণ করত। বন্ধুদের মতে ঊর্মিকে পছন্দ করত, প্রেম করতে চাইত। তখন তো ঊর্মি খুব একটা আগ্রহ দেখায়নি। তাহলে এখন এত সহজভাবে কাছ ঘেষে দাঁড়িয়ে আছে কিভাবে? তাহলে কি ঊর্মিও!
নিহিতার চিন্তা-ভাবনা থেমে গেল। তার সকল প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার জন্যই বুঝি দুজন একে-অপরের ঠোঁটে গভীর চুমু খেল। বিস্ময়ে স্তব্ধ হয়ে গেল নিহিতা। বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে এই মেয়ে তার বান্ধবী ঊর্মি। পনেরো বছরের চেনা সেই ঊর্মি! যে কিনা কোরআন তেলাওয়াতে, গজলের সুরে, হাদিস মুখস্থ করাতে, সূরা পাঠে সারাক্ষণ তার সাথে প্রতিযোগিতা করত। সব সময় চাইত নিহিতার আগে থাকতে। মাদ্রাসার বাৎসরিক প্রতিযোগিতায় সেকেন্ড হলে সে কী রাগ দেখাত! এক বার তো দুজন এক সাথে প্রথম হয়েছিল। শুধু কি প্রতিযোগিতা? আচার-ব্যবহারেও তো নিহিতার চেয়ে উত্তম ছিল। প্রথম পরিচয়ে সকলের সাথে ভাব জমিয়ে ফেলত। সব থেকে বড় কথা নিহিতার বাবা ঊর্মিকে খুব পছন্দ করেন। মেয়ের মতো ভালোবাসেন!
ছেলেটি ঠোঁট ছেড়ে ঊর্মির গলায় মুখ ডুবাতে নিহিতা চোখ বন্ধ করে ফেলল। হাতে-পায়ে এক রকম কাঁপা-কাঁপি নিয়েই নিচে নেমে আসল।
” তুই বাইরে কী করছিস? ভেতরে যাবি না? ”
ঊর্মির আকস্মিক আগমনে খানিকটা ছিটকে উঠল নিহিতা। সে ক্লাসের বাইরে বারান্দার রেলিং ঘেষে দাঁড়িয়েছিল। ঊর্মির মুখের দিকে শান্ত চোখে থেকে বলল,
” তোকে খুব সুন্দর লাগছে। ”
ঊর্মি লাজুক হাসল। চোখে-মুখে আনন্দের বন্যা! ঊর্মি সহাস্যে ঘুরে দাঁড়িয়ে বলল,
” ব্লাউজের হুকটা খুলে গেছে। লাগিয়ে দে তো। আমি পারছি না। ”
নিহিতা হুক লাগাতে লাগাতে বলল,
” দূর গা থেকে মাহফিলের জন্য বাবার ডাক এসেছিল। সকালেই বেরিয়ে গেছেন। যাওয়ার আগে বলে গেছেন, রাতে তোকে নিয়ে ঘুমাতে। ”
” কেন? খালাম্মা আসেনি এখনও? ”
” না। নানির শরীরটা আগের চেয়েও বেশি খারাপ। বলল, হসপিটালে ভর্তি করতে হবে। ”
ঊর্মি সাথে সাথে উত্তর দিল না। কিছুক্ষণ থেকে সহসা বলল,
” আচ্ছা, বিকেলে চলে আসব। আংকেলকে বলিস, আব্বুকে ফোন দিয়ে বলে দিতে। ”
” আচ্ছা। ”
________________
বিকেলের আকাশটা খুব একটা ভালো দেখাচ্ছে না। কালো মেঘেরা ঘুরে বেড়াচ্ছে। হাওয়াও বয়ছে খুব। বৃষ্টি হবে নাকি? ঊর্মি তো এখনও এলো না? এদিকে আবার বৃষ্টির হাওয়া বয়লেই বিদ্যুৎ চলে যায়। মেয়েটা আসবে তো?
নিহিতা খোলা জানালা দিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে এসবই ভেবে যাচ্ছে। সে চিন্তা কমাতে মাকে কল দিল। কথা শেষ হতে দরজার দিকে তাকাল। না কেউ দরজায় খটখট করেনি!
মাগরিবের আযান পড়তে নামাজে দাঁড়াল নিহিতা। মোনাজাত শেষ করে জায়নামাজ তুলে রেখে আবারও দরজার দিকে তাকাল। মুহূর্তে অস্থির হয়ে পড়ল সে। ভয় ঝেঁকে বসল মনজুরে। ঊর্মি কি সত্যি আসবে না? তাহলে কি রাতটুকু একাই কাটাতে হবে? নিহিতা ভেতরে ভেতরে শিউরে উঠল। একা এক রুমে ঘুমালেও ফাঁকা বাসায় রাত কাটানো হয়নি কখনও। যদিও ভয় পাওয়ার তেমন কিছু নেই। এই গাঁয়ের সকলে তার বাবাকে খুব সম্মান করে, শ্রদ্ধা করে। আশেপাশের গ্রামের মানুষরাও নাম শুনলেই সালাম দেয়।
জানালা দিয়ে বৃষ্টির ছাট আসতে তাড়াহুড়োয় পাল্লা লাগাতে শুরু করে নিহিতা। সেই সময় কড়া নাড়ার শব্দ। নিহিতা ভয়ে কেঁপে ওঠে। ঊর্মি এসেছে জেনেও জিজ্ঞেস করে,
“কে? ”
” আমি। দরজা খোল তাড়াতাড়ি। ”
নিহিতা দৌড়ে দরজা খুলে দেয়। কিছু বুঝার আগেই ঊর্মি একটা ছেলেকে নিয়ে হুড়-মুড়ে ঢুকে পড়ে। ভেতর থেকে ছিটকানি তুলে দিয়ে বলল,
” তোয়ালে নিয়ে আয়। ইমন একদম ভিজে গেছে। সর্দি বসে যাবে। ”
ঊর্মি এসেছে দেখে ওড়না নিতেও ভুলে গেছিল নিহিতা। ছেলের নামটা কানে বাজতে তার সম্বিৎ ফিরে। দ্রুত ওড়না দিয়ে মুখসহ পুরো শরীর ঢেকে উল্টো ঘুরে বলল,
” এসব কী ঊর্মি? ছেলে মানুষ নিয়ে বাসায় ঢুকেছিস কেন? বাবা পছন্দ করে না জানিস না? তার মধ্যে উনি তো বাসায়ও নেই। কেউ দেখলে কী হবে? ”
” কেউ দেখেনি। সেজন্যই তো রাত করে এলাম। শোন, আজ ও এখানে থাকবে। ”
নিহিতা হাওয়াবেগে পেছন ঘুরল। বিস্ফারিত চোখে বলল,
” থাকবে মানে? ”
” থাকবে মানে, থাকবে। আর শোন, ওর জন্য আলাদা রুমে ব্যবস্থা করতে হবে না। তোর পাশের রুমে আমরা দুজন শুব। ”
ঊর্মির এহেন আচরণে নিহিতা যারপরনাই বিস্মিত হলো। পর মুহূর্তে হতাশ হলো! প্রিম মানুষটির এমন আমূল পরিবর্তন কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না। কতক্ষণ বিমূঢ় থেকে বলল,
” তোরা কি বিয়ে করেছিস? ”
” ধূর! বিয়ে করতে যাব কেন? ”
” তাহলে? ”
” আমরা প্রেম করছি। ”
এ পর্যায়ে রেগে গেল নিহিতা। রাগ সংযত রেখে বলল,
” যেখানে কোনো পুরুষের দিকে এক বারের জায়গায় দুই বার তাকাতে নিষেধ করেছেন। সেখানে তুই রাত কাটাতে চাচ্ছিস? ঊর্মি এর শাস্তি কতটা ভয়ংকর হতে পারে তুই কি আন্দাজ করতে পারছিস? ”
ঊর্মি মুখ বাঁকিয়ে বলল,
” এখন আমার মাথা নষ্ট করিস না তো। তাছাড়া আমরা সামনে বিয়ে করব। ”
নিহিতা ইমনের দিকে এক ঝলক তাকিয়ে বলল,
” যে ছেলে বিয়ের আগেই তোর দামি সম্পত্তি ভোগ করার জন্য উঠে পড়েছে সে ছেলে তোকে বিয়ে করবে? আমার তো মনে হচ্ছে না। ”
ঊর্মি কঠিন চোখে তাকাল। দৃঢ় স্বরে বলল,
” তোর মনে হওয়া দিয়ে আমার কী কাজ? আমি জানি করবে। ”
” তাহলে বল এখনই করতে। ”
” এখন? ”
ঊর্মির কণ্ঠ থেকে বিস্ময় ঝরে পড়ছে। নিহিতা বলল,
” হ্যাঁ। এখন। তোরা দুজনেই বিয়ের উপযুক্ত। কোনো সমস্যা হবে না। আমি মৌলবী কাকাকে ফোন দিয়ে ডাকছি। উনি সব ব্যবস্থা করে দিবেন। কথা দিচ্ছি, তোরা না চাইলে এ বিয়ের কথা কেউ জানবে না। ”
ঊর্মি কিছু বলার আগেই ইমন ক্ষেপে গেল। কাষ্ঠ স্বরে বলল,
” আমি জানতাম ঝামেলা হবে। সেজন্যই বলেছিলাম দূরে কোথাও ঘুরতে যাই। কেউ বিরক্ত করতে আসত না। ঝামেলাও হত না। ”
নিহিতা এবার ছেলেটির দিকে তাকাল। শ্লেষিত কণ্ঠে বলল,
” আপনি দেখছি বেশ অভিজ্ঞ সম্পন্ন! ”
ইমন কটমটে চোখে তাকাল। দাঁতে দাঁত পিষে ঊর্মির উদ্দেশ্যে বলল,
” বান্ধবীকে দিয়ে অপমান করাতে এনেছ তাই না? শান্তি? এবার আনন্দ করো। খবরদার আমাকে কল দিবে না। তোমার সাথে সব ধরনের যোগাযোগ বন্ধ। ”
ঊর্মি ইমনকে আটকাতে চাইলেও লাভ হলো না। দরজা মেলে ব্যাঘ্র চালে বেরিয়ে গেল।
প্রেমিককে আটকাতে ব্যর্থ হয়ে রাগে ফেটে পড়ল ঊর্মি। পর মুহূর্তে কেঁদে দিল। ভেজা কণ্ঠে বলল,
” তুই আমার কত বড় ক্ষতি করেছিস ভাবতেও পারছিস না, নিহি। ”
নিহিতা দরজায় ছিটকানি তুলে মুখ থেকে ওড়না সরিয়ে বলল,
” ক্ষতি নয়, উপকার করেছি। ”
ঊর্মি অশ্রুসিক্ত নয়নে তেড়ে আসল নিহিতার দিকে। ভেজা চোখে রক্তিম আভা ছড়িয়ে পড়েছে। রূঢ় স্বরে বলল,
” এটা উপকার? প্রেম করতে গেলে এসব একটু-আধটু হয়েই থাকে। তুই কাউকে ভালোবাসিস না তাই বুঝতে পারছিস না।
”
” আমার বোঝার প্রয়োজনও নেই। যে ভালোবাসায় নিজের স্বরূপ ভুলে নোংরা ও কুৎসিত সত্তাকে ধারণ করতে হয় সে ভালোবাসার সাথে দেখা হওয়ার পূর্বে আমার মৃত্যু হোক। ”
ঊর্মি সাথে সাথে কিছু বলল না। নিহিতা আচমকা ফোন তুলে নিয়ে বলল,
” আমি ভেবেছিলাম ঐ ছেলেটা তোকে জোর করছে। এখন তো মনে হচ্ছে ঐ ছেলের কোনো দোষ নেই। সব দোষ তোর। তোর উপরে সয়তান ভর করেছে। সয়তান কিভাবে তাড়াতে হয় আমার জানা আছে। ”
কথাটা বলতে বলতে ফোন কানে নিয়েছিল নিহিতা। ওপাশ থেকে রিসিভ হতে বলল,
” আসসালামু আলাইকুম, আংকেল। ”
ঊর্মি তীরবেগে ছুটে আসল। নিহিতার থেকে ফোন ছিনিয়ে কল কেটে বলল,
” বাবাকে কল দিয়েছিস কেন? ”
” তোর কু-কীর্তি জানাতে। ”
” তুই কিন্তু বেশি বাড়াবাড়ি করছিস। বাবাকে তুই চিনিস না? একদম মেরে ফেলবে আমায়। ”
নিহিতা ঊর্মির কাঁধে এক হাত রাখল। নরম স্বরে বলল,
” যে কাজ বাবা-মায়ের ভয়ে লুকিয়ে করতে হয় সে কাজ কখনই ভালো হতে পারে না। কেননা, আমাদের ভালো-মন্দ সম্পর্কে নিখুঁত অনুমান একমাত্র পিতা-মাতারাই করতে পারেন। ”
নিহিতার উপদেশ ঊর্মির পছন্দ হলো না। আগের ঘটনার জের ধরে বলল,
” তোর সাথে আমার কোনো সম্পর্ক নেই। ”
ঊর্মি বাসা থেকে বের হয়ে যাওয়ার সাথে সাথে বিদ্যুৎ চলে গেল। বাইরের ঝড়ো হাওয়ায় পর্দা উড়ছে। নিহিতার মধ্যে ভয়েরা বাসা বাঁধার পূর্বেই ভেতর থেকে দরজা লাগিয়ে দিল। অন্ধকারে হাতরে ফোনের আলো জ্বালাল। সারা রাত অন্ধকারে কিভাবে কাটাবে ভাবতেই বুকে কাঁটার মতো কিছু বিঁধল। গা ছমছম করা অনুভূতি নিয়ে বাবার নাম্বার ডায়াল করল। ওপাশ থেকে রিসিভ হওয়ার পূর্বেই দরজায় ঠকঠক শব্দ হলো। নিহিতার ভেতরে আনন্দের দোল খেয়ে গেল। ছুটে দরজা খুলেই বলল,
” আমি জানতাম তুই আমাকে একা ছেড়ে যাবি না। ”
আনন্দে আপ্লুত হয়ে নিহিতা দরজার মানুষটিকে প্রায় জড়িয়েই ধরছিল। সে সময় ভরাট পুরুষ কণ্ঠ,
” আপনি যাকে ভাবছেন, আমি সে নই। ”
চলবে