নিষ্কলুষচিত্ত তুমি-১

0
1879

নিষ্কলুষচিত্ত তুমি-১
লেখা : মান্নাত

“নারী হয় ধর্ষিত,
সেই নারী তুমি আমার কাছে সুভাষিত,
নারী হয় কলুষিত,
সেই নারী তুমি আমার কাছে নিষ্কলুষচিত্ত।”

বাড়ি থেকে বেশ কিছু দূরে চায়ের দোকানে দাঁড়িয়ে সিগারেটের নেশা করতে এসেছে পলক। পাশেই মসজিদ পুরান বাসস্ট্যান্ডের; এটা সিলেটের হাইওয়ের রাস্তা। চারিদিকের অন্ধকারে সিগারেটের ওঠা-নামা এক অন্যরকম তরঙ্গের সৃষ্টি করছে। চায়ের দোকান থেকে সিগারেট ধরিয়ে, এমনিই হেঁটে হেঁটে রাস্তার পাশ ধরে এগিয়ে চলতে চলতে উপরোক্ত ছন্দ কাটল, মাঝে-মাঝে ছন্দ তৈরির ঝোঁক আছে তার। লেখাপড়া পুরো শেষ না করেই একটা প্রাইভেট কোম্পানিতে চাকরি করতে হচ্ছে তাকে; বয়স আটাশ চলছে। মোটা অঙ্কের বেতন না পেলেও মা-বোন’কে খাওয়ানোর মতো বেতন ঠিকই পায়। বাবা নেই যে মাথার ওপর ছায়া দেবে, তবুও রাখার মতো ভিটে বাড়িটা রেখে গেছেন। এমন সময় হঠাৎই তার পাশ দিয়ে একটা মাইক্রোবাস চলে গেল। মনে হলো একটুর জন্য তার পায়ের ওপর গাড়ি চালিয়ে দেয়নি। চামড়ার মুখ সবারই আছে, গাড়িটাকে তো আর ধরা যাবে না, তাই মুখ দিয়ে গালি-গালাজ করল কতক্ষন। মন-মেজাজের বিক্ষিপ্ত অবস্থার কারণে বাড়ির পথে হাঁটা ধরলো। কিন্তু আকস্মিক কিছুর গোঙানির শব্দে থমকে দাঁড়ালো সে। পলক ভূত-প্রেতের কথা ছোটোবেলায় বহু শুনেছে। বড়ো হয়ে এসবে বিশ্বাস করে কুসংস্কারাচ্ছন্ন হতে চায় না। আরেকবার শব্দটা’কে সুক্ষ্মভাবে কর্ণকুহরে প্রবেশ করার ক্ষীয়মান অপেক্ষা করল। দ্বিতীয়বারের মতো সেই শব্দটা পেয়ে গেল। নির্জন, নিস্তব্ধ উপরন্তু অন্ধকারাবৃত রাতে গোঙানির মূল উৎস খোঁজার চেষ্টাতে নিজের ভেতর কেমন যেন গোয়েন্দা গোয়েন্দা ফিল পাচ্ছে। হালকা হাসল বিষয়টা ভেবে। এমন সময় আবারও সেই শব্দটা শুনতে পেল, তবে সেটা বিস্তর রাস্তার ওপাশের ঝোপঝাড় থেকে। দু-মনাভাব নিয়ে এগিয়ে রাস্তা পার হলো পলক। ঝোপঝাড়ে বস্তার মতো দেখতে মাঝারি আকারে বস্তার কাপড়ে পেঁচানো কিছু একটা চোখে পড়ল। অদ্ভুত জিনিসের প্রতি সকলের মতোই তার-ও মন কৌতুহলী হয়ে উঠল। পুরুষ মানুষ হয়েও দুরুদুরু বুকে এগিয়ে গেল সেটার কাছে। খানিক আবার পিছিয়ে এলো, থেমে গিয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে তাকিয়ে দেখল; কেউ তাকে দেখছে কি না। নাহ, রাত একটার সময় চা-সিগারেটের দোকান ছাড়া কিছু খোলা থাকার কথা না। তেমনই এখন সামনের আর দূর-দূরান্তের কয়েকটা দোকানের বাতি জ্বলতে দেখা গেল, তাও পাশ দিয়ে সাই করে গাড়ি চলাচল করছে হাতগোনা দু-একটা। বেশ কিছুটা সাহস সঞ্চয় করে এগিয়ে গিয়ে বস্তুটার ওপর হাত রাখল পলক। একি হাত কাঁপছে! বিস্মিত হলো নিজেরই এমন কৌতুকপূর্ণ অবস্থা দেখে। আসলেই বিষয়টা হাস্যরসাত্মক। নিজের পৌরুষে এমন অবস্থা কতটুকু হেয় পূর্ণ হবে ভাবল খানিকক্ষণ। ফের গোঙানি শব্দে ভাবনার অতলান্ত থেকে মনযোগ সরিয়ে নিজেকে ধাতস্থ করল; সম্মুখে থাকা অদ্ভুত জিনিসটার দিকে অগ্রসর হতে। এগিয়ে গিয়ে একহাতে পকেটে থাকা ফোনের ফ্লাশ লাইট জ্বালাল, অন্যহাতে বস্তুটাকে নিজের সামনে উন্মোচন করল। বস্তুটির উপরিভাগ অল্পসল্প খোলা থাকায়, রক্তমাখা মুখের অংশ পলকের সামনে উন্মোচিত হলো। ঘটনার প্রবল ধাক্কায় এত সুঠাম পুরুষালি দেহের পলকের হাত থেকে ফোন ছুটে মাটিতে পড়ল। বিস্ময়কর নয়নে অন্ধকারের মাঝেও মেয়েটির দিকে তাকিয়ে রইল সে।মিনিট গড়ালো খানিক। বুকটা হাঁপানোর মতো ওঠানামা করছে। নিজের সম্মুখের জিনিসটা কী বিষয়ের হতে পারে, এতটুকু বোধশক্তি আছে তার। ঈষদচ্ছ আলোতে মেয়েটি রক্তমাখা কেটে যাওয়া ঠোঁট ফাঁক করে গোঙানি ধ্বনি উচ্চারিত হতেই পলকের মনে সাহসের সঞ্চারণ হয়। ভাবে, “নারী জাতি সম্মুখে ধর্ষিত হয়ে, অথচ ভয়ে আমি হাত গুটিয়ে!” নিজেকেই নিজে ধিক্কার জানিয়ে নিচ থেকে ফোন উঠিয়ে নিয়ে আবার মেয়েটার মুখের সামনে ধরল। ভ্রু কুঁচকে এলো মেয়েটির প্রবল আলোর ঝলকানিতে। এবার মুখ থেকে আলো সরিয়ে সারা শরীরের বলতে চটের বস্তা দিয়ে ঢাকা পড়া অংশটুকু দেখতে লাগল পলক। চটের বস্তার অবস্থাও বেগতিক। রক্তে ভেজা চিটচিটে হয়ে আছে সেটা। চিন্তা হচ্ছে বেশ। মেয়েটিকে বাঁচাতে পারবে তো না কি নিজেই উলটো এই কেসে ফেঁসে জেলে যাবে। কারণ সাধারণত এসব বিষয়ে তাকেই প্রথম জিজ্ঞাসাবাদ করতে গিয়ে থানাতে টানা-হেঁচড়া করা হবে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে আবারও ওঠে দাঁড়িয়ে যায়। মন-মগজে একনাগাড়ে ধোলাই চলছে। এক মন বলছে, সাহায্য করতে। তো আরেক মস্তিষ্ক বলছে, উপকার করিয়া ফাঁসিতে ঝুলিতে চাও? তাহলে যাও। দ্বিধা-দ্বন্দের মাঝে ফোনে কল আসলো। পলকের মা লায়লা বেগম ফোনকল করেছেন। মা’য়ের সুবোধ বালক বলা চলে পলক’কে। কারণ মা তার কাছে অনন্য। মা’য়ের কাছেই শিখেছে, নারী জাতিকে সম্মানের চোখে দেখার বিষয়। এছাড়াও ভাই-বোনের কাছে বন্ধুত্ব বলতে কিংবা কঠিন পরিস্থিতিতে পড়লে সমাধানের জন্য মা’য়ের নামটা আগে আসে মনে। কিন্তু আজ যে পরিস্থিতির সে পড়েছে, সেখানে শেখা বুলিও ফিকে পড়ে যাচ্ছে। সঠিক সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারছে না। এসময়ে মা’য়ের কল’টা বেশ কাজে আসবে মনে করেই রিসিভ করে সালাম দিয়ে নিজের বর্তমান পরিস্থিতির বিষয়টা খোলে বলে পলক। বিষয়টা তখন লায়লা বেগমকে-ও ভাবায়। বেশ কিছুক্ষণ চিন্তা ভাবনা করার পরে তিনি বললেন, সেখানেই পলক’কে দাঁড়াতে তিনি আসছেন। বেশ অনেকক্ষণ পরে তিনি এলেন, তবে সাথে করে মেয়ে সায়মা’কে নিয়ে। সায়মা’কে দেখে পলক বলে ওঠে,

“আবার ওকে আনতে গেলে কেন?”

ভাবলেশহীন গলায় লায়লা বেগম বললেন,

“একা রাখলেও কি ও জানবে না?”

মা’য়ের যুক্তির কাছে সবসময়ই হেরে যেতে হয় তাদের, এবারও তাই হলো। জীবনের বহু ধাপ পেরিয়েই বলতে গেলে সেই সমূহের মাঝে স্বামী বিহীন পথ দু’টো সন্তান নিয়ে একা পাড়ি দিয়েছেন তিনি। লায়লা বেগম এগিয়ে গিয়ে মেয়েটার পাশে উবুড় হয়ে নাকের ডগায় আঙুল নিয়ে বেঁচে আছে কি না যাচাই করতে দেখে পলক বলে ওঠে,

“বেঁচে আছে। নাহলে তখন গোঙানির শব্দ শোনলাম কি করে?”

বিরক্তিকর দৃষ্টি নিক্ষেপ করলেন ঘাড় ঘুরিয়ে পলকের দিকে। অতঃপর মেয়েটা বেঁচে আছে দেখে পলক’কে বললেন, গাড়ি ডাকতে। তখন পলক হতাশা নিয়ে বলল,

“মা, গাড়ি যদি ডাকতে পারতাম তাহলে আমি-ই মেয়েটাকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে পারতাম। তোমাকে কেন বিষয়টা জানালাম?”

“তোর হাতের লাইট আগে বন্ধ কর। কারো চোখে পড়লে বিষয়টা অন্যদিকে গড়াবে। আর গাড়ি ডাকতে সমস্যা কী? যা বললাম তা কর।”

এদিকে লায়লা বেগমের পাশে থাকা সায়মা এগিয়ে এসে তার মা’য়ের একহাত জড়িয়ে ধরল। সেটা দেখে তিনি বলে ওঠেন,

“কাঁপছিস কেন?”

তখন ফোনের লাইটের আলোতে মেয়েটার রক্তমাখা বীভৎস চেহারা দেখে সায়মার অবস্থা করুণ। জীবনে এ-ই প্রথম ধর্ষিতা দেখছে। কাঁপানো গলায় কোনোরকমে সায়মা বলল,

“তুমি কীভাবে এত শক্ত হয়ে আছ? আমার তো দেখেই বমি পাচ্ছে ভয়ের সাথে।”

এসময়ে গাড়ি পাওয়া বেশ মুশকিল, পেলেও যেতে চাইবে না আর এসব দেখলে গালির খিস্তি শুরু করে দিবে গাড়িচালক। তাও বেশ দূর থেকে এগিয়ে গিয়ে সিএনজি পেল পলক। দাম চওড়া চেয়েছে। লায়লা বেগম এসব বিষয়ে অবগত। এছাড়াও জানেন যে, মেয়েটার রক্তাক্ত অবস্থা দেখে আরো আগে রাজি হবে না, যত টাকা ভাড়া দেয়া হোক না কেন। তাই সাথে করে বিছানার চাদর এনেছেন সেটা জড়িয়ে দিয়ে মেয়েটার মুখ ঢেকে নিলেন অল্প খোলা রেখে। অন্ধকার অভিশপ্ত রাত্রিতে চাঁদ যেন আজ নিজের জ্যোৎস্না ছড়াতেও চায় না। উপরন্তু সিএনজির লাইট নিভানো থাকায় বিষয়টা ঢাকা পড়ে গেল। সিএনজিওয়ালা-ও সেদিকে খেয়াল করল না বেশি একটা। মা-মেয়ে দু’জন দু’পাশে বসে, অজ্ঞানরত অজানা মেয়েটিকে বাঁচানোর উদ্দেশ্য হাসপাতালের দিকে ছুটলেন। সরকারি হাসপাতালে না নিয়ে পাশ কাটিয়ে নিজের পরিচিত ক্লিনিকে নিয়ে যেতে লাগলেন। এরমধ্যে কর্তব্যরত তাঁর পরিচিত ডাক্তার’কে ফোন লাগালেন,

“কে আফরোজ বলছিস?”

ওপাশ থেকে জবাব এলো,

“নাহ আমি ফারজানা বলছি।”

“ওহ্। তোমার আম্মু নেই? আমি তোমার লায়লা আন্টি বলছি।”

“আন্টি আজকে আম্মুর ডিউটি নেই। আমার ডিউটি পড়েছে।”

“তাহলে থাকো ওখানে, আমি আসছি। পারলে একটা বেড রেডি করে রাখো।”

“আচ্ছা, আসেন।”
_______

ডাক্তার ফারজানার মুখে হাত। মেডিকেল হিস্টোরিতে এই প্রথম এত ভয়াবহ অবস্থার স্বাক্ষী হলো। যদিওবা সে এখানে নতুন হিসেবে, তবুও মেডিকেল আসা যাওয়া হতো তো ডাক্তারি পড়ার জন্য।

“আন্টি কীভাবে কী?”

কথাটা বলে পলকের দিকে একঝলক তাকালো।

“পরে বলব। মেয়েটাকে সুস্থ করো আগে।”

ইতস্ততভাবে ফারজানা তখন বলল,

“ইয়ে মানে আন্টি বিষয়টা পুলিশ’কে জানাতে হবে যে।”

বিস্মিত কণ্ঠে লায়লা বেগম বলে ওঠেন,

“ফারজানা, তুমি বলতে পারলে কথাটা!”

তাড়াতাড়ি লায়লা বেগমের হাত ধরে অনুশোচনা কণ্ঠে ফারজানা বলল,

“আমাকে ভুল বুঝো না আন্টি। জানোই তো বিষয়টা কতো ক্রিটিকাল।”

“সবার আগে মেয়েটার বাঁচার বিষয়। সেটাকে গুরুত্ব দেও। আশা করি আমার কথাটা রাখবে।”

চোখের ইশারায় আশ্বস্ত করে মেয়েটার চিকিৎসা করতে চলে গেল। ফারজানার চলে যাওয়ার দিকে পলক তাকিয়ে লায়লা বেগম’কে বলল,

“এতক্ষণ লাগল যে?”

দীর্ঘশ্বাস ফেলে লায়লা বেগম বললেন,

“পুলিশের কাছে বিষয়টা আগে জানাতে চেয়েছিল।”

“সেটাও দেখার বিষয়। এখন না হলে পরেও তো বলতে হবে। আপাতত আসো বসি গিয়ে।”

ক্লিনিকের করিডোরের বেঞ্চিতে বসে আছে লায়লা বেগম ছেলে-মেয়ে’কে নিয়ে। লায়লা বেগমের কাঁধে মাথা রাখা সায়মার।

“আমাকে তখন জিজ্ঞেস করেছিলে না, আমি কীভাবে এত শক্ত, কঠোর হয়ে আছি?”

সায়মা এবার সোজা হয়ে বসে মাথা নেড়ে সায় দিলো। লায়লা বেগম সামনের সাদা রং করা দেয়ালে তাকিয়ে বলতে লাগলেন,

“এই যে দেখছ না, নতুন রং করা সাদা দেয়াল। এখন এটা সময়ের কাছে চাপা পড়ে আস্তে আস্তে রং বদলাতে শুরু করবে৷ এখন ঠুনকো, হাতুড়ির অল্প আঘাতে ভেঙে গুঁড়িয়ে যাবে। কিন্তু বছরখানেক পড়ে মজবুত হয়ে উঠবে নিজের ভেতর থাকা ইটগুলো। এমনিভাবে মানুষ জীবনের প্রতিটি ধাপে সময়-অসময়ের পরিস্থিতির চাপে পড়ে নিজেকে শক্ত করে গড়ে তোলে। বুঝেছো?”

সায়মা আবারও তার মা’য়ের কাঁধে মাথা রেখে বলল,

“আম্মু, ইউ আর দ্যা বেস্ট।”

এরইমধ্যে একজন নার্স দৌড়ে এলো। পলক এগিয়ে গিয়ে উদ্বিগ্ন কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল,

“কী ব্যাপার?”

“রক্ত লাগবে।”

“আপনাদের এখানে নেই।”

“আছে তবে আরো দু’তিন ব্যাগের মতো লাগবে। ততোটা এখানে মজুদ নেই।”

অতঃপর পলকের হাতে কাগজ দিয়ে আবার বলল,

“ফারজানা ম্যাম এই ঠিকানা থেকে গিয়ে রক্ত আনতে বলেছেন।”

বলে চলে গেলে পলক-ও তার মা’কে বিষয়টা জানিয়ে রক্ত আনতে চলে গেল। অনেক সময় গড়িয়ে গেল। ফজরের নামায লায়লা বেগম’কে হাসপাতালে আদায় করতে হলো। যথাসময়ে অটি থেকে ফারজানা ও তার সাথের এক সঙ্গী ডাক্তার বের হলেন। সেদিকে আর গেলেন না লায়লা বেগম। কারণ মাত্রই বের হলো দু’জন। কিছুক্ষণ পরেই ডাক পড়ল তাঁর। ফারজানার চেম্বারে গিয়ে চেয়ার টেনে বসলেন তিনি। ফারজানা ওয়াশরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে নিজের চেয়ারে বসতে বসতে লায়লা বেগম’কে জিজ্ঞেস করল,

“আন্টি কিছু খেয়েছেন?”

“নাহ, এখনো খাইনি। এমনিতেও গলা দিয়ে কিছু নামবে না টেনশনে।”

ইতস্তত করে ক্ষীণ আওয়াজে জিজ্ঞেস করল,

“বাকিরা?”

“সায়মার আজ দরকারি এসাইনমেন্ট আছে ভার্সিটিতে জমা দিতে হবে আবার পলকের অফিস আছে। তাই দু’জনকে পাঠিয়ে দিয়েছি বাড়িতে। বাইরে থেকে কিছু কিনে নিয়ে খেয়ে নেবে ওরা। তুমি এবার মেয়েটার খবর বলো।”

ছোট্ট নিশ্বাস ফেলে ফারজানা কথাগুলো গুছিয়ে নিয়ে বলা শুরু করল,

“মেয়েটাকে তো দেখেছেনই কী করুণ অবস্থা! বাঁচার আশা ছিল ক্ষীণ। তবুও ভাগ্যের নির্মম পরিহাসের কারণে হয়তো বেঁচে গেল কিন্তু মৃত অবস্থায়।”

আৎকে ওঠা বিস্ময়কর স্বরে লায়লা বেগম বললেন,

“কী বলছ! বেঁচে আছে না?”

“হুম, বেঁচে তো আছে। তবে মরণ দশার মতো। মাথার পিছনে আঘাত পেয়েছে প্রচণ্ড। সেলাই পড়েছে সেখানে সাতটা। স্মৃতিশক্তি না হারালেই রক্ষে। এছাড়াও তো সারা শরীরের অবস্থা আমি মেয়ে হয়ে দেখেও ভয়ে শেষ।”

“আমাকে সায়মা রাস্তাতে তার ভয়ের কথাও বলেছিল, যেখানে মেয়েটাকে পেয়েছি।”

অতঃপর মেয়েটাকে খোঁজে পাওয়ার বিস্তারিত ঘটনা খোলে বললেন তিনি, যেমনটা পলক তাঁকে বলেছিল।

“সবই তো শুনলে এখন বলো, আমি কীভাবে আগে মেয়েটাকে সুস্থ না করিয়ে পুলিশের কাছে বিষয়টা বলি? বুঝতেই তো পারছ। ছেলের মা, নিজে জানি নিজের অংশ কেমন। কিন্তু অন্যরা তো সেটা মেনে নেবে না। পুলিশ প্রথম পলক’কেই সন্দেহ করবে।”

“জি আন্টি, আপনি ঠিক বলেছেন। বুঝতে পেরেছি আপনার পরিস্থিতিটা। তবে এখন আমার সাথে বাকি ডাক্তাররা-ও বিষয়টা অবগত। কতক্ষণ আর বিষয়টাকে ধামাচাপা রাখা যাবে? পুলিশকে তো জানাতে হবেই।”

“আপাতত মেয়েটাকে সুস্থ হতে দেও না। কারণ তাকে-ও তো সুস্থ হতে হবে, নাহলে কীভাবে জানবে তার সাথে ঘটা ঘটনা?”

“সেটা তো ঠিক বলছেন। আচ্ছা দেখি মাম্মামের সাথে বিযয়টা নিয়ে আলাপ করে। এখন আপনি আমার সাথে সকালের নাস্তা করে নিবেন।”

“আরে নাহ।”

লায়লা বেগমের কথা উপেক্ষা করে আকুতিভরা কণ্ঠে ফারজানা বলল,

“প্লিজ আন্টি, আমি কোনো বারণ শুনব না।”

অগত্যা লায়লা বেগম’কে সকালের নাস্তা করতে হলো। মাঝেমাঝে সময় করে পলক খবর নিলো তার মা’য়ের। ক্রিটিকাল অবস্থা দেখে আবার জ্ঞান ফেরার আটচল্লিশ ঘন্টা সময় দেওয়া হয়েছে। সেজন্য অটিতে এখনো রাখানো মেয়েটাকে। ফারজানা চলে গেছে সকালের সিফট হয়ে আফরোজা বেগম আসেন, তবে যাওয়ার সময় তার মা’কে কিছু বলে গেছে। তিনি সকল রিপোর্ট দেখে বলেন,

“ছয়-সাতজন মিলে কাজটা করেছে।”

নিশ্বাস ভারী হয়ে এলো লায়লা বেগমের কথাটা শুনে। চোখ টলটলে অবস্থায় শুধু বললেন,

“কোন মা’র সন্তানটারে? আমারই কলিজা ছিঁড়ে যাচ্ছে। আর তার মা কেমন অবস্থায় আছে আল্লাহ ভালো জানে।”

“আরো বাকি। বয়স বেশি না বিশ-একুশ হবে হয়তো। জরায়ু ফেলে দিতে হয়েছে। বুঝতেই পারছিস কেন?”

এবার বাঁধভাঙার মতো অশ্রু গড়াতে লাগল লায়গা বেগমের। আফরোজা বেগম ডাক্তার হয়েও তাঁর চোখ থেকেও অংশ ঝরছে। কোনো কথাই বলতে পারছেন না লায়লা বেগম। তবুও কোনোরকমে ভাঙা গলায় বললেন,

“ফারজানা দেখি জানাল না বিষয়টা?”

চশমা খোলে ডাক্তার আফরোজা বেগম টিসু দিয়ে চোখ মুছে নিয়ে বললেন,

“আমাকে বলেছে তোকে জানাতে। শোন এখন কী করব? তুই না কি বলেছিস পুলিশ কমপ্লেন এখন করতে না?”

“হুম, মেয়েটা কীভাবে সহ্য করল এতকিছু। আপাতত সুস্থ হোক তারপর নাহয় বাকিটা।”

“আচ্ছা, দেখি কতটুকু করতে পারি। থাকবি না কি বাড়ি যাবি?”

“বাড়ি যেতে হবে। জ্ঞান ফিরতে তো সময় লাগবে। সায়মা আবার দুপুরে আসবে, পলক-ও না কি ছুটি নিয়েছে আজ। গিয়ে দুপুরের খাবার খেয়ে আসব ভাবছি।”

“সেটাই ঠিক হবে। আমরা আছি এখানে, দেখে রাখব মেয়েটাকে।”

নানান কথাবার্তায় আর দুশ্চিন্তায় লায়লা বেগম ভুলে গেলেন বাড়ি ফেরার কথা পলক’কে জানাতে। এদিকে পলক সোজা বাড়ি না গিয়ে হাসপাতালে এসে পড়ল তাঁকে সাথে নিয়ে যেতে। প্রথমেই এসে অটির সামনে তাকিয়ে লায়লা বেগম’কে খোঁজল পলক। কিন্তু পেল না, তাই একটু অটির ওপরের গ্লাস ভেদ করে ভেতরে তাকাল; হয়তো ভেতরে থাকতে পারে লায়লা বেগম। নাহ, সেখানে নেই। তবে সেখানে শুভ্র সাদা বেডে শুয়ে আছে এক নারীমূর্তি। নাকে নল দেওয়া, মাথায় ব্যান্ডেজ। বুক পর্যন্ত চাদর থাকায় বাকিটা দেখা গেল না। প্রথম দেখায় মুখ রক্ত রঞ্জিত ছিল। কিন্তু এখন হলদে আভা ছড়ানো মুখে গোল গোল কামড়ের দাগ স্পষ্ট।

চলবে…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here