নিষ্কলুষচিত্ত তুমি-৫
লেখা : মান্নাত মিম
লায়লা বেগম বেশ একটা পছন্দ করেন না নন্দিতাকে। সেজন্যে তাঁর সাথে কথা বলার সময় কেমন জানি গুটিয়ে থাকে নন্দিতা। স্বতঃস্ফূর্তভাবে লায়লা বেগমের সামনে অন্যদের সাথেও কথা বলতে দ্বিধা কাজ করে নন্দিতার মাঝে। পলক সবসময় বাড়ি না থাকলেও বিষয়টা খেয়াল করেছে ইদানীং। তাই তো আজ সায়মার বিয়ের কেনাকাটা করার জন্য খালি বাড়িতে নন্দিতাকে একা ফেলে রেখে চলে গেলেন। সায়মা যদি-ও একটু সহানুভূতি দেখিয়ে কিছু বলতে চেয়েছিল কিন্তু মা’য়ের চোখ রাঙানিতে ওই মুখের রা গিলে ফেলেছে। তাদের আবার সঙ্গ দিতে ফারজানা-ও হাজির। আজ তিনজন লেডি মিলে জমিয়ে বিয়ের মার্কেটিং করবে। সেজন্যে গতকাল রাতে পলক তার অফিসের বসের কাছ থেকে অগ্রীম বেতন এনে দিয়ে লায়লা বেগম’কে। মা’য়ের হঠাৎ এমন আচরণ তার বোধগম্য হচ্ছে না। দুপুরে লাঞ্চের ব্রেকের সময় ছুটি নিয়ে বাড়ি এসে পড়েছে পলক। মন-মানসিকতা ভালো না বলে। তবে সে জানতো না যে, সকালের দিকেই মা-বোন মার্কেট চলে যাবে বা বাড়িতে নন্দিতাকে একা রেখে যাবে। যথা নিয়মে নিজের রুমে গেল ফ্রেশ হতে, ফিরে এসে ডাইনিংয়ে গেল খাবারের জন্য। এদিকে বাড়িতে কেউ নেই বলে নন্দিতা প্রিয় জায়গা ছাদে গিয়েছিল। সেখান থেকে নেমে এসে পলক’কে খেয়াল করেনি বিধায় পেছনটা দেখে ভয় পেয়ে চিৎকার দিয়ে দিলো। পিছন ফিরে নন্দিতাকে দ্বিতীয়বার চিৎকার দেওয়ার আগেই পলক তার মুখ চেপে ধরল।
“আরেহ! আমি পলক। অযথা চিৎ…..”
বলার আগেই নন্দিতার থরথর করে কাঁপা শরীরের ভর পলকের ওপর ছেড়ে দিলো। ফ্যাসাদে পড়ল পলক। মনে মনে ভাবল, ভয়েই অজ্ঞান! অতঃপর কী আর করা পাঁজা কোলে তুলে নিয়ে চলল মেয়েটাকে তার রুমে দিয়ে আসার জন্য। বিছানায় ঝুঁকে শুইয়ে দিতে গিয়ে নজর পড়ল গলার দিকে, যেখানে বেখেয়ালে সম্ভবত ওড়না সরে গিয়েছে। গলার ফাঁকা বড়ো হওয়ায় নজরে এলো কামড়ের দাগ হালকা হলেও কাছ থেকে স্পষ্টই। শক্ত হয়ে এলো পলকের মুখটা। স্পষ্টতই দুঃখে মিশ্রিত রাগের অদ্ভুত অনুভূতি খেলা করতে লাগল তার মুখে। এতদিনেও কাছ থেকে কখনো দেখা হয়নি নন্দিতাকে। সেই সুযোগই তো ছিল না। আজ যখন কাছ থেকে দেখার সুযোগ এলো, তাই বলে সবকিছুর আগে ক্ষতস্থানটা’ই নজর কাড়ল। নন্দিতার হলদে আভা ছড়ানো মুখটা কেমন পাণ্ডুবর্ণ ধারণ করেছে। কিছুক্ষণ আগের ভয়ে হয়তো। আবদ্ধ থাকা আঁখিযুগলের পাপড়ি একে-অপরের সাথে লেপ্টে আছে। কী মায়াবী, স্নিগ্ধ দেখতে লাগছে অচেতন নন্দিতাকে! সংজ্ঞান থাকতেও মায়াবী দেখাত, কিন্তু এভাবে সম্মুখীন হয়ে দেখা যেত না। যার ফলে প্রায়শই তাকে লুকিয়ে-চুরিয়ে দেখতে হতো। কখনো ছাদের সিঁড়ি কোঠায়, তো কখনো দরজার আড়ালে। মেয়েটাকে দেখলে মনে অদ্ভুত প্রশান্তি ছেয়ে যেত, যার অর্থ পলকের নিজের-ও জানা নেই। তার মন কেন যেন বারবার নন্দিতার দিকে টানে, অদ্ভুত অদৃশ্য এক টান অনুভব করে সে মেয়েটার প্রতি। একসময় যাকে কি না দু’চোখেও সহ্য করতে পারত না বলে; মা’কে বলেছিল বাড়িতে নন্দিতাকে না নিতে। অথচ ফারজানাকে বন্ধু হিসেবেই ভাবতে ভালো লাগে। এরচেয়ে বেশিকিছু কখনো সে ভাবেইনি। মা’য়ের মুখে উজ্জ্বলতা দেখেছিল, ফারজানাকে ছেলের বউ হিসেবে দেখার জন্য। তাই বিয়েতে মত দেওয়া। কিন্তু বিবাহ বন্ধনের জন্য যে টান-টা প্রয়োজন, সেটা সে পাচ্ছে না। উপরন্তু মনের মধ্যে এতদিন যে হাঁসফাঁস অনুভূতি হচ্ছিল, সেটা নন্দিতাকে দেখে কমে গেল। তাহলে কী নন্দিতাকে সে……. ভাবার জন্য সময় পেল না। ভূত দেখার মতো চক্ষুযুগল বড়ো বড়ো করে তাকিয়ে আছে নন্দিতা, তারউপর ঝুঁকে থাকা পলক’কে দেখে। চিৎকার কি দিতে যাবে, এমন সময় ফের পলক তার মুখ চেপে ধরে বলল,
“আমাকে দেখে কি রেপিস্ট মনে হয়?”
এই এক শব্দই যথেষ্ট ছিল নন্দিতার মুখ নিঃসৃত হওয়া কথা গণ্ডদেশে আঁটকে দিতে। নন্দিতার নড়াচড়া না দেখে বুঝলে সে স্থবির হয়ে গেছে। তাই মুখ থেকে হাত সরিয়ে সোজা হয়ে পাশে বসে বলল,
“আমার পরিচয় দিতে হবে না। আমাকে চিনেনই তো না?”
মুখ থেকে পলকের হাত সরানো মাত্রই ওঠে গিয়ে দেয়ালের সাথে সেঁটে বসে অবনত মাথা নাড়ায়, যার অর্থ তাকে চেনে নন্দিতা। তবুও মুখে কোনো জবাব দিলো তো না-ই, উলটো মুখায়বে পলক’কে ভয় পাওয়ার আতংক দৃশ্যমান হয়ে আছে। সেটা দেখে কেন জানি মনের গভীর থেকে বেদনাদায়ক দীর্ঘশ্বাস মুখ হতে নির্গত হলো পলকের। ফের বলে উঠল,
“তা আমাকে চিনেন যে, সেটা কী হিসেবে? পরোপকারী নাকি রেপিস্ট?”
কথাটা কর্ণগোচর হওয়া মাত্রই অশ্রু চোখে জ্বলজ্বল হয়ে জানান দিচ্ছে যে, কথাটা নন্দিতাকে-ও পীড়া দিচ্ছে। ঝট করে মাথা উঁচু করে পলকের পানে এই প্রথম বেশখানিকটা সময় নিয়ে তাকিয়ে দেখে। নাহ, ওই মুখে তো কোনো রেপিস্টের তকমা লাগানো না। উলটো সে তো জানে পলক কীভাবে তাকে পেয়ে ক্লিনিকে নিয়ে গিয়ে, তার জীবন বাঁচিয়েছে। সেদিন অজ্ঞান হয়েছিল বলে কিছু জানেনি, তবে ফারজানার সাথে কথায় কথায় গল্পের মাঝে সেদিনের পর থেকে জ্ঞান আসার পরের সবকিছুই জ্ঞাত হয়। আর কখনো তো পলক তার সামনে এসেও তাকে বিব্রতবোধ করায়নি। যখন থেকে পলক জানতে পেরেছে, কোনো পুরুষ মানুষ দেখলেই নন্দিতার ধর্ষণ হওয়ার স্মৃতি মনে স্মরণ হয়ে চিৎকার, চ্যাঁচামেচি করে কষ্ট পায়। তাই তো দূরে থেকেই শুধু পলক তাকে একপলক দেখে। সেটা অবশ্য নন্দিতার জানা নেই। কিন্তু আজ খালি বাড়িতে কোনো পুরুষ মানুষের অবয়ব দেখে ভয়ে চিৎকার দিয়ে ওঠে৷ কথাটা বলার জন্য মুখ খুলবে তার আগেই পলক বলে ওঠে,
“থাক, কিছু বলতে হবে না। আমি জানি আপনি ভয়ে এমনটা করেছেন। আপনার ভয় পাওয়াটা স্বাভাবিক। তবুও আপনাকে কিছু কথা বলতে চাই।”
বলে থেমে একনজর তাকাল নন্দিতার দিকে, দেখতে পেল নীলাভ অক্ষিযুগল তার দিকেই নিক্ষেপ করা। চোখ সরিয়ে নিলো, এই চোখে তাকালে সে শুধু নেশাক্ত হয়ে নিজের সর্বনাশ দেখতে পায়। অতঃপর সে বলা শুরু করল,
“একজন মেয়ের কাছে সবচেয়ে সম্মানের জিনিস হলো তার সম্ভ্রম এবং গুরুত্বপূর্ণ জিনিসও। সেখানে যখন সেই অংশটুকু তার সম্মতি ব্যতিত ছিনিয়ে নেওয়া হয়, পরপুরুষের খোরাক হতে হয়; তখন মনে হয় মেয়েটার জীবনের সুখ, আনন্দ, স্বাচ্ছদ্য কেড়ে নেওয়া হয়েছে। বেঁচে থাকার কোনো তাগিদ তার মধ্যে দেখা যায় না। জানি, আমি-ও পরপুরুষ অন্যদের থেকে আলাদা নই। তবে নারী জাতিকে আমি সম্মানের চোখে দেখি, আপনাকে প্রথম যে অবস্থায় দেখেছিলাম সত্যি হতভম্ব হয়ে গিয়েছিলাম কয়েক পলের জন্য। আপনার জায়গায় নিজের মা-বোন’কে দেখলে কেমন হতো, সেই জ্ঞানটুকু নিজের মধ্যে ধারণ করে রেখেই সাহায্য করেছিলাম। শারীরিক দিক দিয়ে তো সুস্থবোধ করছেন। তবে মানসিক ঝক্কি এখনো সামলে ওঠতে পারেননি। আপনাকে সাইক্রিয়াটিস্ট দেখানো হলে, আপনি নাকি তাদের-কে সবকিছু খোলে বলেন না? তাদের সাথে কো-ওপারেট করেন না। যার কারণে এখনো আপনি মানসিক দিক দিয়ে দূর্বল।”
এবার সরাসরি তাকিয়ে শেষ কথাগুলো বলল পলক। আর নন্দিতা নিম্নমুখী হয়ে বাক্যহারা হয়ে আছে। আসলেই সে সবকিছু সামলিয়ে ওঠতে পারছে না। কারো সাথে খোলামেলা নিজের ভেতরে জ্বলন্ত তুষেরআগুন সম্পর্কে কাউকে জানাতে পারছে না। একা একাই সে জ্বলতে ধর্ষণের স্মৃতির অনলে। স্বাভাবিকই কতদিন পলক’রা তাকে সাহায্য করে, তার খরচের ভার বহন করবে? যা-ও করেছে তাতেই বহু ঋণী নন্দিতা তাদের কাছে। অন্যসব হলে মরে থাকার জন্য ফেলে যেত। এই প্রথম মুখ খুলল,
“আমাকে আর দু’টো দিন সময় দিন। আমি আপনাদের খরচাপাতি পরিশোধ করে চলে যাব।”
নন্দিতার বলা মিহি, চিকন, মিষ্টি স্বরের কথা শুনেও পলকের এবার রাগ হলো। মেয়েটাকে বোঝায় কী, আর মেয়েটা বুঝে কী? হতচ্ছাড়া ঘাড়ত্যাড়া মেয়ে। মেজাজ ফুটন্ত পানির মতো হয়ে উঠল নন্দিতার কথা শুনে। কিন্তু হাইপার হওয়া চলবে না, মেয়েটা যে বয়স অনুযায়ী অবুঝ সেদিকে লক্ষ রেখে পলক বলল,
“তা কীভাবে পরিশোধ করবেন শুনি?”
বুকের ওপর হাত দু’টো ভাজ করে প্রশ্ন করল পলক। আর প্রশ্নেই কপোকাত মেয়েটা। আসলেই তো পরিশোধ করবে কীভাবে? নিজের থাকার জায়গায়ই তো পাবে না, হয়তো মানুষের দ্বারে দ্বারে ফিরবে, নয়তো রাস্তায় রাস্তায় মানুষ নামের কিছু কুকুরের খাদ্যে পরিণত হবে। মেয়ে হয়ে জন্মালে নিয়তিও পরিহাস করে পক্ষান্তরে।
_______
চলবে…