নিস্তব্ধ বিচরণ,পর্ব-১৪
তানজিলা
চেয়ারে পায়ের ওপর পা তুলে আরামে বসে হাত দিয়ে টেবিলে ক্রমাগত টকটক আওয়াজ করছে রেহান আর বেশ মনোযোগ সহকারে টেবিলের ওপাশে বসে থাকা ব্যাক্তির গতিবিধি লক্ষ্য করছে। এই লোকের মধ্যে কোন রাগ নেই বললেই চলে। এর আগে যে সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে গিয়েছিলো খুব অল্পেই ধৈর্যহারা হয়ে ডা. মাহফুজ আরমানকে ওর জন্য রিকোমেন্ড করে, অর্থাৎ যে ভদ্রলোক এখন ওর সামনে বসে আছে।
-“রাগ হচ্ছে না-কি কৌতুহল?”
বেশ সাবলীল কন্ঠে প্রশ্ন করে মাহফুজ। রেহান কিছু না বলে কক্ষটা বেশ শান্ত চোখে পর্যবেক্ষণ করতে থাকে।
-“রুমের ডেকোরেশন হালকা চেঞ্জ করা হয়েছে। আগেরটা বেশ বোরিং মনে হচ্ছিলো!”
রেহান এবারও কিছু বললো না শুধু ঘনঘন নিশ্বাস নিতে শুরু করলো। এটা রেহান তখনই করে যখন ওর প্রচন্ড রাগ চড়ে ওঠে।
-“আমি যতই নিজেকে সামলে রাখার চেষ্টা করি…সি ডাসেন্ট লিসেন টু মি!”
বিড়বিড় করে বললো রেহান।
-” আপনি কোথায় কারও কথা শোনেন! খুবই অনিয়মিত হয়ে গেছেন আপনি!”
-“ব্যাস্ত ছিলাম।”
এই বলে আবারও হাত দিয়ে টেবিলে ঠকঠক আওয়াজ করতে লাগলো রেহান।
মাহফুজ রেহানের দিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,
-“এই সপ্তাহে মোট কয়বার সিগারেট খেয়েছেন?”
-“কাউন্ট করিনি।”
-“আপনাকে দেখে মনে হচ্ছে আপনার অবস্থার বেশ ইমপ্রুভমেন্ট হয়েছে! ইউ আর লুকিং বেটার দ্যান বিফোর!”
মাহফুজের হাস্যোজ্জ্বল ফেস দেখে কপাল কুঁচকে এলো রেহানের।
-“আই ওয়াজ ব্যড!”
-“প্রথম দুই সপ্তাহে আপনি আমার কেবিনের যে অবস্থা করেছিলেন! থাক সেসব কথা!
-“আমি কি এতই খারাপ? ও আমাকে শুধু ভয় পায়!”
রেহানের কন্ঠের তেজ অনেকটাই ধীর হয়ে এলো।
-“ভালোবাসেন তাকে?”
হুট করে এই প্রশ্ন কানে এতেই রেহান কিছুটা নড়েচড়ে বসলো। মাহফুজ বললো,
-“এই প্রশ্নের উত্তর আমাকে দেয়ার দরকার নেই। নিজেকে নিজেই প্রশ্ন করতে পারেন।”
-“আই জাস্ট ডোন্ট ওয়ান্ট টু হার্ট হার!”
এবারও রেহানের বিড়বিড় করা কথা মাহফুজের কানে এগোয়নি। কিন্তু এবার এ নিয়ে আর কথা বাড়ালো না।
_______________________________
ইনায়া ওর চাচাকে বেশ কয়েকবার ওর বাবা হাবিবের ব্যাপারে জিজ্ঞেস করেছে। কিন্তু লাভ হয়নি। সে এ ব্যাপারে ইনায়ার জড়াতে স্পষ্ট না করে দিয়েছে। দুপুর থেকে ওর চাচীর পাশ ঘেঁষে বসে আছে ইনায়া। কিন্তু এবারও সরাসরি কিছু জিজ্ঞেস করার ইচ্ছে ওর নেই। কথায় কথায় হাবিবের কাজের ব্যাপারে জানতে চাইছে ইনায়া। ভাবতেও অবাক লাগছে একসময় অভিমানে জর্জরিত হয়ে কিছুই জানতে চাইতো না ও। ইনায়ার মা মারা যাওয়ার পরই ওর সামনেও তেমন একটা আসতো না হাবিব। ইনায়ার চাচী হয়তো আন্দাজ করতে পেরেছে কিছু একটা।
-“তোমার একটা বান্ধবী ছিল না ফিহা, ওর বড় বোনও একই অফিসে চাকরি করে। কয়েক মাস হলো। ওকে জিজ্ঞেস করতে পারো। আমি তেমন কিছুই জানি না!”
ফিহার সাথে ইনায়ার দেখা হয়না অনেকদিন। ফোনে হয়তো কথা হয়েছিলো কিন্তু খুব কম। ফিহার বড় বোনের নাম প্রত্যাশা। ফিহার বাড়িও বেশ কাছে। আজ একবার ফিহার সাথে দেখা করবে বলে মনস্থির করলো ও।
আরিফা সেই কখন থেকে ছাদে বসে আছে। মেজাজটা বড্ড খারাপ। ইনায়া হুট করে পাশে এসে বসতেই আরিফা লাফ দিয়ে উঠে গেল।
-“তোর কি হয়েছে রে? আমাকে দেখে বারবার পালিয়ে যাস কেন?”
আরিফা মুখটা শুকনো করে আঁড়চোখে একবার দেখলো ইনায়াকে।
-“তুমি মারবে না তো আমাকে?”
ইনায়া একটু কষ্ট পেলেও সেটা চেহারায় ফুটে উঠলো না। মুখটা স্বাভাবিক রেখেই আরিফাকে শক্ত গলায় বললো,
-“কেন মারবো? আচ্ছা সত্যি করে বলতো তুই আমার লুকিয়ে রাখা চকলেটগুলো খাসনি তো?”
শুকনো একটা ঢোক গিলে ভীত চোখে ইনায়ার দিকে তাকালো আরিফা। সাথে সাথেই ফিক করে হেসে দিল ইনায়া। আরিফা হা করে তাকিয়ে আছে ইনায়ার দিকে। যেন অনেক দিন পর ওর আগের ইনায়া আপুকে খুঁজে পেয়েছে। ইনায়াকে জড়িতে ধরলো ও।
-“কি হচ্ছে এখানে?”
রেহানের কন্ঠ কানে এতেই ইনায়ার মুখ থেকে হাসিটা উবে গেল। আরিফা একবার রেহানকে দেখেই বললো,
-“আমার আপুকে ছাড়া একটা দিনও থাকতে পারলেন না?”
এতটুকু পিচ্চির মুখ থেকে এমন পাকা পাকা কথা শুনে রেহান নিজেও থতমত খেয়ে গেল। আরিফা বয়সে মারিয়ার চেয়ে বড় হলেও ওদেরও মধ্যে বেশ মিল খুঁজে পাচ্ছে রেহান। আজকালকার জেনারেশনের অবস্থা!
রেহান আরিফার হাতে একটা চকলেট ধরিয়ে দিতেই আরিফা দৌড়ে নিচে চলে গেল।
ইনায়া এখনও ছাদে রাখা দোলনায় বসে আছে। রেহান খানিকটা বিরক্ত নিয়েই ইনায়ার পাশে বসলো। ইনায়ার অনুপস্থিতিতে ঘরটায় টিকতে পারছিলো না ও। নিশ্চুপ ভীত মুখটা দেখার জন্য আকুল হয়ে উঠছিল মন।
কিন্তু এখানে এসে এতো মনোমুগ্ধকর হাসি দেখবে কল্পনাও করেনি রেহান।মেয়েটা হাসে না কেন ওর সামনে!
এখনও নিস্তব্ধতায় কাটছে সময়। কেউ কোন কথা বলছে না। রেহান একটু পর পর আঁড়চোখে দেখছে ইনায়াকে। ডা. মাহফুজের করা প্রশ্ন মাথায় চড়ে বসেছে। সত্যি কি প্রেমে পড়েছে ও! শব্দটা নতুন না হলেও অনুভূতিটা ভিষণ নতুন মনে হচ্ছে ওর কাছে!
চলবে…