নিস্তব্ধ বিচরণ,পর্ব -১৯

0
2129

নিস্তব্ধ বিচরণ,পর্ব -১৯
তানজিলা

ফ্লোরে ভাঙা অবস্থায় পড়ে আছে রেহানের ফোন। যদিও সেটা নিয়ে মাথা ব্যাথা নেই রেহানের। স্থির হয়ে বিধ্বস্ত অবস্থায় বসে থাকা ইনায়ার পাশে বসলো ও। ইনায়ার অশ্রুশিক্ত নয়ন ভাঙা ফোনটার দিকেই অটল।
-“আপনার মতো এতো সম্মানিত ব্যাক্তির আমার ওপর এতো দয়া দেখানোর কারণ জানতে পারি?”
রেহান ইনায়ার হাত ধরতে গেলে ছিটকে সরে যায় ইনায়া। রেহান বারান্দায় যাওয়ার কিছুক্ষণ পরই ইনায়া রেহানের ফোন চেক করতে হাতে নেয়। মেসেজ বক্সে আননোন নাম্বার থেকে আসা বেশ কিছু মেসেজ দেখে যেগুলো দুপুরে সেন্ড করা হয়েছে। তারমধ্যে একটা ভিডিও দেখে স্তব্ধ হয়ে যায় ও। ভয়ংকর দুঃস্বপ্নের মতো মনে হচ্ছে সব। সাথে সাথে ফোনটা ছুড়ে মারে ইনায়া। দেয়ালে বারি খেয়ে ছিটকে পড়ে সে ফোন।

-“আপনি যদি আসল খুনিকে ধরিয়ে না দেন তাহলে এই ভিডিও সাদাফ ভাইরাল করবে তাই তো!”
নির্লিপ্ত কণ্ঠে বললো ইনায়া। হয়তো কোথাও জমে আছে চাপা ক্ষোভ।

-“বিশ্বাস করো, আমি এসবের কিছুই চাই নি! আমি তোমার কোন ক্ষতি করতে চাইনি। আমি যদি জানতাম ঐ সাদাফ এমন করবে তাহলে কখনোই জেল থেকে বের হতে ওকে সাহায্য করতাম না! আমি শুধু সত্যিটা জানতে চেয়েছিলাম তোমার বাবার কাছ থেকে। পিঠপিছে সাদাফ এতটা নীচ হয়ে উঠবে কল্পনাও করিনি!”
রেহানের একনাগাড়ে বলা কথাগুলো শুনে কিছু বললো না ইনায়া। কেন যেন অসাড় মনে হচ্ছে নিজেকে। কোন অনুভূতি হৃদয়ে কাজ করছে না। না ভয়, না আতঙ্ক আর না কষ্ট। ভাবলেশহীন চোখে উঠে বালিশে মাথা রাখতেই মাথাটা কেমন ঝিমিয়ে এলো।যেন আধার এসে জায়গা করে নিল চোখের আলোয়।

সকালে বেশ স্বাভাবিক ব্যাবহার করছে ইনায়া। রেহান বেশ দুশ্চিন্তা নিয়েই ড্রইংরুমে বসে ছিল। ইনায়ার সাথে কথা বলার চেষ্টা করেও লাভ হলো না। ও এমন ভান করছে যেন রাতে কিছুই হয়নি। রিয়াদ খান সেই কখন বেরিয়েছে। ইয়াসমিন রেহানের সামনে কফির কাপটা রাখতেই ধীর কন্ঠে মা বলে ডেকে ওঠে রেহান। ইয়াসমিন কিছুসময়ের জন্য থেমে গেলেও রেহানের দিকে তাকালো না।
-“শুধু দাদীর কথা ভেবে এখানে কয়েকদিন আছি। চিন্তা করো না, কোন খুনি সারাজীবন এই বাড়িতে থাকতে আসে নি!”

-“কফি ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে!”
কম্পিত গলায় কথাটা বলেই রেহানের চোখের সামনে থেকে সরে আসলো ইয়াসমিন। পেছনে ফেলে গেল অশ্রুশিক্ত চোখে ঘৃণার পাত্রে পরিণত হওয়া ছেলেকে। নিজেকে দোষ দেয়া ছাড়া হয়তো কিছুই করার নেই তার। ছোটবেলায় ছেলেটাকে একা ছেড়ে দেয়া অনেক বড় ভুল ছিল ওর। বোর্ডিং স্কুলে যাওয়ার পর থেকে রেহানের রাগের পরিমাণ আরও ভয়ংকর হতে শুরু করে। রেহানের করা সব ভুল অপরাধ কাজে টাকা দিয়ে সবার মুখ বন্ধ করতো রিয়াদ। একদম কড়া শাসন থেকে শাসন করাই ছেড়ে দেয় সে। শাস্তি হিসেবে শুধু দূরে রাখে ওর পরিবার থেকে। রিয়াদের মুখের ওপর কিছু বলতে পারেনি। কিন্তু ইয়াসমিন তো বুঝতো ঐসময় রেহানের ওর বাবা মায়ের সান্নিধ্যের কতটা প্রয়োজন ছিল। সঠিক শাসনের প্রয়োজন ছিলো।
এখন আফসোস করে কী হবে! রেহান হয়তো মনে করে ইয়াসমিন ওর থেকে ঘৃণার তাড়নায় দূরে থাকে। কিন্তু এই মুহুর্তে অপরাধবোধের পাল্লাটাই যে বেশি!

রেহান অফিসে যেতেই ইয়াসমিনকে ধরে বসলো ইনায়া।
-“মা, একটা কথা ছিল!”
বেশ সতর্ক কন্ঠে বললো ইনায়া।
-“কি হয়েছে?”
চায়ে চুমুক দিয়েই ইনায়ার দিকে তাকালো ইয়াসমিন। ইনায়ার মুখটা সকাল থেকেই শুকনো মনে হচ্ছে। কিছু বলবে বলবে ভেবে আর বলা হয়নি।
-“আপনার কেন নিজের ছেলেকে খুনি মনে হয়?”
বিস্ময় প্রকাশ পায় ইয়াসমিনের চেহারায়। মুখটাও যেন কেমন শুকিয়ে গেল।
-“মা বলেছিলো তুমি এ ব্যাপারে কিছুই জানো না।”
-“জানতাম না! এখন জানতে চাই!”
-“কি বলবো আমি! রিয়াদ একজন সাক্ষীকে টাকা অফার করেছিলো সেটা আমার দৃষ্টিগোচর হয়নি। সবটা না জেনেই ভুল ধারণা পুষেছিলাম আমি! রেহানের বাবা মনে করেছিলো রেহানই হয়তো খুনটা করেছে তাই টাকা অফার করেছিলো। সেই লোক টাকাটা নেয়নি। আমিই পুরোটা বিষয় না জেনে ওভার রিয়েক্ট করে ফেলেছিলাম। ভেবেছিলাম এবারও হয়তো রেহানের কোন অপরাধ ঢাকতে চায় রিয়াদ। আর ততক্ষণে রেহান আমার থেকে অনেকটা দূরে চলে গেছে। বাড়ি ছেড়ে চলে গেছে ছেলেটা অভিমান করে। লজ্জায় ওর দিকে তাকাতে পারি না আমি!”

-“আপনি আপনার ছেলেকে বলেননি কেন আমার বাবা মিথ্যা সাক্ষ্য দিতে কোন টাকা নেয়নি!”
ইনায়ার দিকে অবাক চোখে তাকায় ইয়াসমিন।
-“তোমার বাবা?”
ইয়াসমিন হঠাৎ এভাবে চমকে ওঠায় ইনায়া কিছুটা নড়েচড়ে বসে। ইয়াসমিন আরও কিছু বলতে যাবে তার আগেই মারিয়া এসে ইয়াসমিনের কোলে চড়ে বসলো।
-“আমরা এই বিষয়ে পরে কথা বলবো!”
ধীর কন্ঠে বললো ইয়াসমিন। ইনায়াও মারিয়ার সামনে কিছু বললো না। তবে ইয়াসমিনের প্রতিক্রিয়ায় যতটুকু বুঝেছে সেই সাক্ষী যে ইনায়ার বাবা ছিল সেটা হয়তো ইয়াসমিন জানতো না।

জান্নাত এসেই ইনায়াকে টেনে রেহানের ঘরে নিয়ে গিয়ে বসালো।

-“প্রচন্ড কৌতুহলী মেয়ে তুমি!”

-“শুধুমাত্র কৌতুহলে আমি এসব করছি! আমার মৃত বাবার সম্পর্কে কিছুই জানার অধিকার কি আমার নেই!কেউ আমার বাবার বিরুদ্ধে মিথ্যা অপবাদ দিলে আমি নিশ্চয়ই চুপচাপ বসে থাকবো না। এই সব কিছুতে আমিও জড়িত।”

-“কখনও কখনও কিছু সমস্যার সমাধান আমাদের চোখের সামনেই থাকে। আমরাই বুঝতে পারি না!”

-” কি বলতে চান আপনি?”

-“ভুল বুঝাবুঝির সমাধান ঠান্ডা মাথায় আলোচনা করে খুব সহজেই করা যায়। কিন্তু সেখানেই পিছিয়ে যাই আমরা। মানুষের চোখও ধোঁকা দিতে পারে । আমরা অনেক সময় সেটা মানতে পারি না। আর না তিল তিল করে পুষে থাকা দূরত্ব, ধোঁকা, ভুল মানসিকতাকে এতো সহজে ছাড়তে পারি!এই বাড়িতে তাই হচ্ছে। হয়তো তোমার মনেও!”

-“কী করবো কিছুই বুঝতে পারছি না আমি!”
জান্নাত মলিন হেসে বললো,
-” হুট করে কারো সম্পর্কে কোন ধারণা এনে বসো না। মানব মন বড়ই বিচিত্র। কার মনে কি আছে সেটা সৃষ্টিকর্তাই ভালো জানেন।”

জান্নাত চলে যাওয়ার পরও অনেকক্ষণ গভীর চিন্তায় মগ্ন ছিল ইনায়া। সাদাফ ওর এতো বড় ক্ষতি করে নিশ্চিন্তে ঘুমোবে সেটা ইনায়া মেনে নেবে না!
হঠাৎ করেই ড্রেসিং টেবিলের ওপর একটা ডায়েরি লক্ষ্য করলো ইনায়া। রেহান তো নিজের পারসোনাল ডায়েরি যেখানে সেখানে ফেলে রাখে না। ইনায়া উঠে ডায়েরিটা হাতে নিতেই একটা ভাজ করা কাগজ নিচে পড়লো।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here