নিস্তব্ধ বিচরণ,পর্ব-২০

0
2167

নিস্তব্ধ বিচরণ,পর্ব-২০
তানজিলা

-“তোমাকে কিছু বলার সুযোগ তো পাচ্ছি না তাই এই পন্থা নিতে হলো। জানিনা এতে তুমি তোমার মনে স্বস্তি পাবে কি-না। আমার ধারণা ছিল সত্যিটা থেকে দূরে থাকাই তোমার জন্য ভালো। কিন্তু শেষপর্যন্ত তোমার জেদের কাছে হার মানলাম। সাদাফের সাথে আমার যখন পরিচয় হয় তখন আমি বেশ ছোট ছিলাম। তবে সেই বিভৎস স্মৃতি আজও মনে আছে। বাচ্চা পাচারকারী চক্রের কবলে পরেছিলাম একবার। আমার বয়সী আরও অনেকেই ছিল সেই অন্ধকার বদ্ধ জায়গায়। তাদের মধ্যে একজন ছিল সাদাফ। চোখের সামনে কত জনকে মরতে দেখেছি হিসেব নেই। আমার নিজেরও মনে হয়েছিলো আমি হয়তো ফিরতে পারবো না! হয়তো আসলেই পারি নি। বেঁচে ফিরলেও সেই ভয়ংকর অনুভূতি মস্তিষ্কে গেঁথে আছে। আমি মনে করেছিলাম সাদাফ মারা গেছে। দুই বছর আগে হঠাৎ করেই সাদাফের সাথে দেখা হয়ে যাবে কল্পনাও করিনি আমি! যদিও সাদাফ আগের থেকে অনেক বদলে গেছিলো। মানুষের মধ্যে পরিবর্তন আসে জানতাম কিন্তু এতটা…!”

হঠাৎ কেউ এক কাপ চা চোখের সামনে রাখতেই কিছুটা চমকে উঠে কাগজটা ডায়েরিতে রেখে দিল ইনায়া। জান্নাত ইনায়ার হাতে চায়ের কাপটা ধরিয়ে দিয়ে। বিছানায় বসে পড়লো। রেহানের ডায়েরি ইনায়ার হাতে দেখে জান্নাতের চোখে যে বিস্ময় ছিলো সেটা ইনায়া বেশ ভালো করেই বুঝতে পারছে। তবে এই মুহুর্তে জান্নাত নিজের কাজ নিয়ে কথা বলছে। কিন্তু ইনায়ার মনটা তো রেহানের ডায়েরিতেই পড়ে আছে। চা টাও ঠান্ডা হতে চললো। ফুল হাতা ড্রেসের সাথে গলায় ওড়না পেচিয়ে রেখেছিল ইনায়া। জামার হাতাটা একটু উঠে ছিল যেটা ইনায়া খেয়াল করেনি।
জান্নাতের দৃষ্টি অনুসরণ করতেই হাতে থাকা সুস্পষ্ট দাগগুলো ঢেকে ফেললো ইনায়া। জান্নাত মৃদু হেসে বললো,
-“আমি চেয়েছিলাম রেহান তোমাকে কথাটা বলুক।”
ইনায়া আনমনে জান্নাতের দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো,
-“আমি হয়তো সত্যি পাগল হয়ে গেছি!”
-“তোমার তাই মনে হয়?”
-“আমি জানি না! কখনও নিজেকে একজন সুস্থ স্বাভাবিক মানুষ মনে হয় আবার কখনও না!”

ইনায়া এক দৃষ্টিতে সামনে তাকিয়ে কথাগুলো বলছিলো। জান্নাতকে বেশ মনোযোগ সহকারে ওর কথা শুনতে দেখে ইনায়া খানিকটা অপ্রস্তুত হয়ে চুপ হয়ে গেল।
-“সরি আপু, আমিও না এসব বলে আপনাকে বিরক্ত করছি!”
জান্নাত এবার একটু শব্দ করেই হাসলো।
-“তোমার কথা শোনা তো আমার দায়িত্ব! আফটার অল ইউ আর মাই নিউ পেশেন্ট!”
ইনায়ার ভ্রু কুঁচকে এলো। পেশেন্ট মানে!
-“কাল থেকে তোমার ট্রিটমেন্ট শুরু হতে পারে। কোন প্রবলেম হলে ফোন করতে পারো।”
কিছুটা অবাক কন্ঠে ইনায়া বলে উঠলো,
-“আজব তো! আমি কখন থেকে আপনার পেশেন্ট?”
জান্নাত নির্লিপ্ত কণ্ঠে বললো,
-“বলতে পারো এখন থেকেই! এন্ড ট্রাস্ট মি জেদ কিন্তু আমারও কম না!”
ইনায়াকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই জান্নাত উঠে হনহন করে চলে গেল। কিছুক্ষণ পর ইনায়াও রুম থেকে বেরিয়ে জান্নাতের পিছু নিলো।

জেরিন বেগম মুখটা শুকনো করে খাটে বসে আছেন। জান্নাতকে দেখে মুখ ঘুরিয়ে বসলেন।
-“কি হলো দাদী? তোমার জন্য আজকে ছুটি নিয়ে দেখা করতে এলাম! তাও এমন করছো!”
জান্নাতের ছুটি নেয়ার বিষয়টা শুনে মুখ ঘুরিয়ে একবার জান্নাতের দিকে তাকালো জেরিন বেগম। খুশী হলেন না-কি বোঝা যাচ্ছে না। তবে জেরিনের চাহনি দেখে যা বুঝার বুঝে নিলো জান্নাত। ইনায়া চুপচাপ জেরিনের পাশে বসে দাদী নাতনির কান্ড দেখছে।
-“তোমার জন্য খিচুড়ি রান্না করে এনেছি। আর মুখ ফুলিয়ে বসে থাকতে হবে না!”
খিচুড়ির কথা শুনেই জেরিনের চোখটা চকচক করে উঠলেও পরক্ষনেই দাত কটমট করে বললো,
-“সারাদিন এখানে বসে থাকতে কার ভালো লাগে! তোরা পারলে আমাকে নিয়ে বাইরে চল। বিরক্ত হয়ে গেছি আমি!”
______________________

মারিয়াকে নিয়ে ব্যাস্ত থাকায় ইনায়ার সাথে কোন কথা বলতে না পারলেও ইয়াসমিনের মুখে লেগে আছে দুশ্চিন্তার ছাপ। শীতল হাওয়ায় মুখোরিত পরিবেশ। কিছুক্ষণ আগেই নেমেছিল ঝুম বৃষ্টি। এখনও গুড়িগুড়ি বৃষ্টি পড়ছে। নিজের অশান্ত মন নিয়ে ইনায়া নিজের ঘরে এসে কাগজটা খুলে আবারও পড়তে শুরু করলো।

-“আনিসা খাতুন হত্যাকান্ডের আগে আমার সাথে তার তুমুল কথা-কাটাকাটি হয়। এক পর্যায়ে আমাকে চড় মেরে বসায় নিজেকে সেদিন কন্ট্রোল করতে পারিনি। সবার সামনে তাকে থ্রেট দিয়ে বসি। যদিও কোন কিছুই আমি ঠান্ডা মাথায় বলিনি। পরবর্তীতে বাবা তাকে চাকরি থেকে বের করতে চাইলেও আমিই তা করতে দেয় নি। তারপর দিন বিকেলে সাদাফ আমার সাথে দেখা করতে আসে। আমরা করিডোরে একা ছিলাম। সাদাফের ফোনে কল আসায় ও কিছুদূর চলে যায়। কিছুক্ষণ পর চিৎকারের আওয়াজ শুনে আমি দৌড়ে ছুটে যাই সেখানে। সেদিকে যেতেই দেখি সাদাফ আমার পিছু পিছু আসছে। তোমার বাবা আনিসা খাতুনের রক্তাক্ত শরীর দেখে চিৎকার করে উঠেছিলেন। শ্বাসপ্রশ্বাস চলছিল না। হসপিটালে পৌঁছতেই ডাক্তার তাকে মৃত ঘোষণা করে। তোমার বাবার মাথায় কি চলছিলো আমি জানি না। যেখানে সবাই আমাকে সন্দেহ করছিলো তোমার বাবা হুট করে পুলিশের কাছে সাদাফের নাম বলে বসে। যদিও পুলিশ ইনভেস্টিগেশনের সময় আমি বলেছিলাম সাদাফ আমার সাথে করিডোরে ছিলো। কিন্তু ওই কিছুসময়ের জন্য আমার চোখের আড়ালে গেছিলো সেই জোরেই সাদাফকে ছাড়া হলো না।

সাদাফ গ্রেফতার হওয়ার পর আমার সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করে। যদিও সেটা সফল হয়নি। আমার মনেও ছিল দ্বিধা। সাদাফের ক্রিমিনাল রেকর্ড ছিল বেশ ভয়ংকর। এর আগেও মার্ডার কেসে ফেঁসেছিলো। শুধুমাত্র প্রমানের অভাবে ছাড়া পেয়েছে। এইবার কেউ সাক্ষ্য দেওয়ার সাহস দেখিয়েছে তাই এই সুযোগে আরও অনেকেই সাদাফের বিরুদ্ধে অভিযোগ করতে থাকে।

তোমার বাবা চাকরি ছাড়তেই আমার মা হুট করে আমাকে দোষারোপ করতে শুরু করলো। সে নাকি জানে আমি খুন করেছি আর তা ঢাকতে তোমার বাবাকে টাকা দিয়েছি। কিভাবে কি হলো কিছুই বুঝতে পারলাম না। আমার সন্দেহের কাটা গিয়ে পড়ে তোমার বাবার ওপর। এবার মনে প্রচন্ড ক্ষোভ নিয়ে তোমার বাবাকে খুঁজতে শুরু করলাম। তোমার বাড়ির সামনে এই আশায় যেতাম যদি অন্তত তোমার সাথে দেখা করতে আসে তোমার বাবা! কিন্তু তা হয়নি। সাদাফ জেল পালিয়ে আমার কাছ থেকে টাকা নিয়ে কোথায় যেন চলে গেল। যদিও ও কোথায় যেতে পারে সে নিয়ে কিছুটা ধারণা আমার ছিল। হঠাৎ করে খবর পেলাম তোমার কিডন্যাপিং এর কথা। প্রথমে ভেবেছিলাম তুমি হয়তো তোমার বাবার কাছে আছো। তোমাকে খুঁজতে শুরু করলাম এইবার। সেইমুহুর্তে সাদাফ যে এমনটা করতে পারে মাথায় আসে নি। সেদিন সাদাফকে খুঁজতে যেয়েই তোমাকে ঐ ঘরে পাই আমি। তোমার তো জ্ঞানও ছিলো না। ভিষণ ঘৃণা হচ্ছিলো নিজের ওপর সেদিন। এই সাদাফকে সাহায্য করতে চেয়েছিলাম আমি! সাদাফ এখনও পলাতক। আনিসা খাতুনের খুন না করলেও আরও অনেক অপরাধের বোঝ জমা আছে ওর ঘাড়ে! হয়তো ওর প্রতি অন্ধ বিশ্বাস করার ফল পাচ্ছি আমি!

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here