নিস্তব্ধ বিচরণ,পর্ব-২১

0
2179

নিস্তব্ধ বিচরণ,পর্ব-২১
তানজিলা

মিটিং রুমের একদিকে ঠকঠক আওয়াজে বিরক্ত হয়ে ক্রোধ দৃষ্টি রেহানের দিকে নিক্ষেপ করে রিয়াদ। প্রায়ই রেহানের এই বদঅভ্যেসে সবাই বিরক্ত। রেহান তার বাবার রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করেই বারবার ফোনের দিকে তাকাচ্ছে। চাহনি জুড়ে যেন কোন কিছুর অপেক্ষা। একপ্রকার বিরক্ত হয়েই রিয়াদ এক গাদা ফাইল টেবিলে বেশ আওয়াজ করে রাখতেই থেমে যায় রেহান।
-“ছোট বাচ্চা নও তুমি! বয়স ত্রিশের কাছাকছি হতে চললো তাও এই বদঅভ্যেস আর গেলো না!”

রেহান কিছু না বলে চুপচাপ সোজা হয়ে বসলো। অফিস টাইম অনেক আগেই শেষ। শুধুমাত্র রেহানকে রিয়াদ বসিয়ে রেখেছে কোন জরুরি কাজে। এক দুইবার ইনায়াকে ফোন করলো কিন্তু কিছুক্ষণ বেজেই ফোন কেটে যাচ্ছে প্রত্যেকবার। মনটা কেমন অদ্ভুত রকম অশান্ত হয়ে আছে। ঘড়িতে সময় রাত নয়টা। রেহানের অস্থিরতা দেখে রিয়াদের বিরক্তির পরিমাণ যেন আরও বেড়ে যাচ্ছে। যা ইচ্ছে তাই করবে! বাবা মায়ের মতামতের কোন মুল্যই যেন নেই ওর কাছে! ইনায়া মেয়েটাকেও সুবিধার মনে হয় না! ছেলের এই অধঃপতন আর মানতে পারছে না রিয়াদ!

রেহান কেবিনের থাই গ্লাস থেকে নিচে তাকিয়ে লক্ষ্য করলো ইনায়া নিচে দাঁড়িয়ে একজনের সাথে কথা বলছে। আর যেই লোকের সাথে কথা বলছে সে কিছুটা কাচুমাচু হয়ে আছে। রেহান ভ্রু কুঁচকে আছে। ইনায়া এখানে কী করছে! এই মেয়েকে একা বাহিরে যেতে নিষেধ করেছিলো রেহান!
রেহানকে ক্ষুব্ধ হয়ে ইনায়ার দিকে আসতে দেখেই লোকটা দৌড়ে পালালো। তবে ইনায়ার তাতে কোন হেলদোল নেই। ক্ষুব্ধ চোখের বিপরীতে নির্লিপ্ত চাহনি ছুড়ে মারে ও।
-“কী করছো এখানে তাও এতো রাত করে? বারণ করেছিলাম না আমি?লোকটা কে?”
ইনায়া রেহানের ক্রোধমিশ্রিত চিৎকার কন্ঠে করা প্রশ্নের কোন জবাব দিলো না। শুধু এক দৃষ্টিতে রেহানকে পর্যবেক্ষণ করছে। অনুভুতিহীন চেহারার মাঝে কোন কিছুই খুঁজে পাচ্ছে না রেহান। রেহানের চিৎকার সংযুক্ত আচরণে আশেপাশের কিছু মানুষ তাকিয়ে ছিল ওদের দিকে। কোনমতে নিজেকে সামলে ইনায়ার হাত ধরে পার্কিং প্লেসে নিয়ে গেল রেহান।

গাড়িতে বসাতেই নিজের সিটবেল্ট নিজের থেকে লাগিয়ে নিলো ইনায়া। এতক্ষণ যে রেহান ইনায়াকে নিয়ে এই পর্যন্ত এনে গাড়িতে বসালো তাতে আলাদা কোন প্রতিক্রিয়াই দেখা গেলো না ইনায়ার মাঝে। ভয়ও নেই! ইনায়ার এই স্বাভাবিক আচরণও কেন যেন অস্বাভাবিক মনে হচ্ছে রেহানের কাছে। কারণটা এই মুহুর্তে রেহানেরও অজানা।

প্রায় পাঁচ মিনিট যাবৎ শান্ত চোখে ইনায়াকে দেখছে রেহান। এই পাঁচ মিনিটে রেহানের চাহনি বুঝতে পারলেও ইনায়ার মুখে কোন কথা নেই!
-“কাগজটা পেয়েছো?”
ইনায়ার দৃষ্টি সামনেই আটকে আছে। রেহানের ধৈর্যও ধীরে ধীরে কমে যাওয়ার পথে। একপর্যায়ে ইনায়াকে হেঁচকা টানে নিজের দিকে ফেরায় রেহান।

-“সমস্যা কী তোমার?”
ইনায়ার বাহু অনেকটা শক্ত করে ধরায় ওর মুখের প্রতিক্রিয়ায় কিছুটা পরিবর্তন আসে। কিন্তু ইনায়া নিজেকে ছাড়ানোর কোন চেষ্টাই করলো না! তীক্ষ্ণ নজরে রেহানের চোখে চোখ রাখলো ও। রেহান ইনায়ার বাহু থেকে হাত সরিয়ে ওর চোখের নিচে স্পর্শ করতেই কিঞ্চিৎ কেঁপে ওঠে ইনায়া। কিন্তু এইবারও সরে যায় নি ও!
-“তোমার চোখ কিন্তু মিথ্যে বলছে না ইনায়া!”
ইনায়ার চোখ থেকে গড়িয়ে পড়া এক ফোটা অশ্রু মুছে ধীর কন্ঠে বললো রেহান।

-“বিশ্বাস করো আমাকে?”
-“জানি না।”
ইনায়ার অস্ফুট কন্ঠের ভারে অনেক কিছুই যেন বুঝে নিলো রেহান। ঠোঁটের কোণে কৃত্রিম হাসি নিয়ে ইনায়ার কাছ থেকে সরে এসে গাড়ি স্টার্ট করলো ও। রেহান গাড়ি স্টার্ট করতেই কিছুক্ষণ জোরে জোরে নিশ্বাস ফেলে ইনায়া।
-“ভেবো না যে, আমার প্রশ্ন শেষ। রাস্তায় সিনক্রিয়েট করার কোন ইচ্ছে আমার নেই!”
-“রাস্তায় মানুষের ওপর কাদা পানি ছিটকে মারাটা সিনক্রিয়েট না! কাউকে ফলো করাটা অসভ্যতামি না!”
হুট করেই ক্রোধের তাড়নায় মুখ ফসলে কথাটা বলে দিলো ইনায়া। আর সাথে সাথেই রেহান গাড়ি রাস্তার একসাইডে ব্রেক করলো।

-“ইনায়া তোমাকে ফলো করার কোন ইচ্ছে আমার ছিলো না। আমি শুধু আমার গাড়ি নিয়ে তোমার বাড়ির সামনে যেতাম। তুমি কোথায় যাচ্ছো, কি করছো তাতে আমার কোন মাথাব্যাথা ছিলো না।”

রাগী কন্ঠে একনাগাড়ে কথাগুলো বলে ওঠে রেহান। ইনায়া আর কিছু বললো না। এমনিও এই বিষয়ে এই মুহুর্তে রেহানের সাথে কোন কথা বলার ইচ্ছা ইনায়ার নেই। ইনায়ার শান্ত মুখ দেখে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে গাড়ি থেকে বেড়িয়ে গেল রেহান। সারাদিন ধরে বৃষ্টি পড়েছে আজ। রাস্তাও কর্দমাক্ত। এইদিকে নেই কোন মানুষের আনাগোনা। রেহান ইনায়ার দিকে এসে গাড়ির দরজা খুলে ওকেও বাইরে নিয়ে এলো। ইনায়া ভ্রু কুঁচকে আশপাশটা দেখছে। শুনশান ভয়ংকর পরিবেশ। ইনায়া এইবার একটু বেঁকে বসলো। রেহানের থেকে হাত ছাড়াতে চেষ্টা করলো কিন্তু কোন লাভ হলো না। কয়েক পা সামনে যেতেই একটা লেকের সামনে এসে থামলো রেহান। দুইজনই ভিজে একাকার। ল্যাম্পপোস্টের আলোটাও বেশ ক্ষীণ। জনমানবহীন লেকের একপাশে রেহান বসলো আর পাশে ইনায়াকে বসালো।

-“কোথায় গিয়েছিলে আজকে? তোমার না পা মচকে গেছে?”
ইনায়ার হাতটা এখনও শক্ত করে চেপে ধরে আছে রেহান। পরিবেশটাও যেন বেশ ঠান্ডা। থরথর করে কাঁপছে ইনায়া।
-“পা এতোটাও মচকায়নি যে হাঁটতে পারবো না!”
কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বললো ইনায়া। তবে তা ভয়ে নাকি ঠান্ডায় সেটা ঠিক বুঝে উঠতে পারলো না রেহান।
-“এখানে কেন আমরা?” আশেপাশে একবার চোখ বুলিয়ে জিজ্ঞেস করে ইনায়া।
রেহান মৃদু হেসে বললো,
-“আমি সতর্ক করেছিলাম তোমাকে! করিনি!”
ধীর কন্ঠে লেগে আছে হুমকির আভাস। ইনায়ার মনে লুকিয়ে থাকা ভয়টা আরও বাড়ছে। রেহান সেটা বুঝতে পেরেই সশব্দে হাসতে শুরু করলো।
-“আমাকে ভয় পাও তুমি! কিন্তু রাত করে একা বাহিরে পা রাখতে ভয় করে না তোমার! তোমার যাতে কোন অসুবিধা না হয় তার জন্য নিজেকে তোমার থেকে দূরে দূরে রেখেছি আমি! আর তুমি রাত করে একা বাহিরে বেড়িয়ে গেলে!
ধীর কন্ঠটা যেন ক্রমাগত চিৎকারে পরিণত হচ্ছে। ইনায়ার গাল চেপে ওর মুখটা নিজের খুব কাছে নিয়ে এলো রেহান।
-“আমি এতোটাও নরম মানুষ না ইনায়া যতটা আমি তোমার সামনে থাকার চেষ্টা করি! আমার ধৈর্য নিয়ে খেলতে যেও না। আমি এমন কিছুই করতে চাই না যা নিয়ে আমাকে পরে রিগ্রেট করতে হয়!”

______________________________________

বৃষ্টিতে ভিজে হলেও ভীর করে দাঁড়িয়ে আছে একদল মানুষ। কৌতুহল, আতঙ্ক অথবা ভয় একেকজনের মুখে একেক ধরণের অনুভুতি। চিপা গলির একপাশ সম্পূর্ণ আটকে দিয়েছে পুলিশ যাতে কোন জনসাধারণ সেখানে প্রবেশ করতে না পারে।

নিহাল আহমেদ নতুন জয়েন করেছে পুলিশ ডিপার্টমেন্টে। সেরকম কাজে এখন পর্যন্ত জড়াতে হয়নি। আজ প্রথম কোন খুনের কেসের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে ওকে! লাশ দেখেই কিছুদূর এগিয়ে গরগর করে বমি করতে শুরু করলো নিহাল। এমন বিভৎস লাশ ও এর আগে কখনও দেখেনি!
লাশ ময়নাতদন্তের জন্য পাঠানো হয়েছে। বৃষ্টির পানি জমে গেছে কিছু কিছু জায়গায়। আর তাতে মিশ্রিত হয়ে আছে লাল রক্তের বন্যা!

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here