নিস্তব্ধ বিচরণ,পর্ব -২৪
তানজিলা
বেশ গুরুত্বপূর্ণ কেসের ফাইল ঘাটাঘাটি করছে থানার ওসি তামিম শিকদার। হুট করে ফোন বেজে ওঠায় ফোন তুলে কিছুটা ক্লান্ত স্বরে প্রশ্ন করলো,
-“মারিয়া ঘুমিয়েছে?”
-“হ্যা ঘুমিয়েছে। তোমার কী আরও লেট হবে?”
-“হুমম।”
জান্নাতকে আর কিছু বলতে না দিয়েই ফোনটা কেটে দিলো তামিম।
মারিয়ার ঘুমন্ত মুখের দিকে তাকাতেই একটা দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে এলো জান্নাতের। হাতের দাগটা অনেকখানি মিশে গেছে।
অনেক ধরণের মানুষের সাথে মিশেছে ও ইতিমধ্যে। যেই হেলথ অরগানাইজেশানে কাজ করে তা মূলত শিশু আর মহিলাদের জন্য। তাদের মুখের দিকে তাকাতেই অনেক সময় মনে হয় যেন নিজেকে দেখছে। বেশিরভাগই শিশু নির্যাতন, প্রতারণা কিংবা ডমেস্টিক ভায়োলেন্স স্বীকার। যাদের জন্য সমাজে অনেকে দেয় বিভিন্ন পরামর্শ। কেউ কেউ বলে মানিয়ে নাও, থেকে যাও, আর কোন পথ খোলা নেই আবার কেউ কেউ বলে ছেড়ে দাও এমন সংসার যেখানে তোমাকে প্রতিনিয়ত অত্যাচারিত হতে হয়! তাই আজ পর্যন্ত ওর কাছে আসা রোগীদের কখনই এর মধ্যে কোন পরামর্শ দেয়নি ও। পরামর্শ দেয়ার অধিকার যে সবার নেই!
___________________________________________
রাত অনেক হওয়ায় এতক্ষণে অনেকেই চলে গেছে নিজ নিজ বাড়ি। তবে নিহাল এখনও পুলিশ স্টেশনের বাইরে টং এর দোকানে বসে চা খাচ্ছে। আজ পুরোদিন ধকল গেছে ওর ওপর দিয়ে। চোরাকারবারি গ্যাঙের একজন সদস্যদের লাশ খুবই বিকৃত অবস্থায় পাওয়া গেছে। অনেকদিন ধরেই ওয়ান্টেড লিস্টে ছিল সাদাফ। কিন্তু বারবার হাতের নাগালের বাইরে চলে যেত পুলিশের। এখন ধরা তো পড়লোই কিন্তু লাশ হয়ে। ধারণা করা হচ্ছে যে গ্যাঙেরই কোন লোকের হাতে খুন হয়েছে হয়তো!
বেশ রাত পর্যন্ত খোলা থাকে এই চায়ের দোকানটা তবে বৃষ্টি বাদলের দিন বাদে। যদিও একদিক দিয়ে ভালোই হয়। অনেক সময় কাজের তাগিদে রাত পর্যন্ত পুলিশ স্টেশনে থাকার প্রয়োজন পড়ে যায়। মামার হাতের এক কাপ কড়া চায়ের প্রয়োজন সে রাতগুলোতে বেশিই পড়ে। চায়ে চুমুক দিতেই সামনে বসে থাকা ভদ্রলোককে দেখে ভ্রু কুঁচকে এলো নিহালের। সাদা শার্ট পরিহিত এই মানুষটাকে এর আগেও পুলিশ স্টেশনে দেখেছে নিহাল। তবে নামটা ঠিক মনে পড়ছে না। আর এই মুহুর্তে বেশ বিব্রত বোধ করছে নিহাল। কারণ সেই সামনে বসে থাকা মানবের কটাক্ষ দৃষ্টি। যার কারণ ধরতে বেশ ঝামেলায় পড়তে হচ্ছে নিহালকে। নিহালের বিব্রত মুখটা দেখে মনে হলো লোকটা বেশ মজাই পাচ্ছে। কটাক্ষ দৃষ্টির মাঝে ঠোঁটে বেশ অদ্ভুত ভঙ্গিতে ভেসে উঠলো বক্র হাসি। নিহালের মেজাজটা এবার মাথায় চড়ে বসলো। দেখে তো পাগল মনে হচ্ছে। তাও নিজের রাগ সংযত করে গলায় কাঠিন্যের ছাপ এনে বললো,
-“আপনাকে ঠিক চিনতে পারলাম না!
মৃদু হেসে চায়ে চুমুক দিলো লোকটা। শান্ত কন্ঠে বললো,
-“এখানে চা খেতে আসা প্রত্যেককেই আপনি চেনেন বুঝি!”
কিছুটা থতমত খেয়ে বসলো নিহাল। তবে চেহারায় ফেলে ওঠা কাঠিন্য ভাবটা বজায় রেখেই ও বললো,
-“আপনার পাশে বসে থাকা লোকটিকেও আমি চিনি না। কিন্তু তাকে তো আমি কোন প্রশ্ন করিনি। এখানে উপস্থিত সবার মধ্য থেকে শুধু আপনাকেই এই প্রশ্নটা আমি এমনি এমনি তো করিনি। বিষয়টা আপনি নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন জনাব!”
-“স্নিগ্ধ।”
-“জি?”
-“আমার নাম স্নিগ্ধ। স্নিগ্ধ মাহমুদ।”
-“আমি নিহাল আহমেদ…!”
-“আমি জানি!”
খালি কাপটা দোকানে রেখেই নিহালের চোখে চোখ রেখে স্নিগ্ধ নিজের ব্যাগ থেকে কিছু কাগজপত্র বের করে পুলিশ স্টেশনের দিকে যেতে শুরু করলো।
তামিম নক না করেই রুমে ঢুকে পড়ায় বেশ বিরক্ত হয়েই সেদিকে তাকালো তামিম। নিহালও স্নিগ্ধর পিছু পিছু এসে পড়লো,
-“স্যার আমি বারণ করা সত্ত্বেও লোকটা…”
তামিমের তীক্ষ্ণ চাহনি নজরে পড়তেই চুপ হয়ে গেল নিহাল। মনে মনে হালকা ফুঁসছে। সিনিয়র দেখে মুখের ওপর কিছু বলে না। ওর জানামতে তামিম লোকটা প্রচন্ড ঘাড়ত্যাড়া আর মেয়েবাজ! আর নিহালের ওপর পারলে কাজের অর্ধেক চাপ ছেড়ে দিয়ে ফালতু ফোনালাপেই ব্যাস্ত থাকবে! তবে সাদাফের কেসটার ব্যাপারে নিহালকে কোন হস্তক্ষেপ করতে দেয় নি তামিম। নিজেই সামলাচ্ছে! নিহাল কিছু বললেই ছ্যাত করে উঠে। নিজের মুখ বন্ধ করেই রুম থেকে বেরিয়ে গেলো নিহাল।
স্নিগ্ধ সেদিকে পাত্তা না দিয়ে টেবিলে কিছু কাগজপত্র আর একটা পেনড্রাইভ রেখে চেয়ারে বেশ আরাম ভঙ্গিতে বসলো।
-” অন্ধ স্বজনপ্রীতির মোহে নিজের জীবনটা অন্ধকারের দিকে নিশ্চয়ই ঠেলতে চাইবেন না আপনি! এইগুলো শুধু কপি, মেইন প্রমানগুলো এখনও আমার হাতে আছে। আর সেগুলো দিয়ে আমি ঠিক কী কী করতে পারি তা নিশ্চয়ই আপনাকে ভেঙে বলতে হবে না!”
___________________________________________
ফোনে কথা বলার আওয়াজে ঘুম ভেঙে গেল ইয়াসমিনের। রিয়াদের কন্ঠে লেগে আছে রাগের রেশ। ইয়াসমিনকে বসতে দেখেই কল কেটে সাইডে রাখলো ও।
-“ইনায়া মেয়েটা বড্ড বাড় বেড়েছে!”
দাঁতে দাঁত চেপে বললো রিয়াদ।
-“এতো টেনশন করার কিছু নেই! আর ওকে তো আমি পুরো কথাটা বলিনি!”
-“আমাকে শেখাতে এসো না ইয়াসমিন! বাপের মতো পাখা গজিয়েছে!”
রিয়াদের শেষের কথাটায় কেন যেন খটকা লাগলো ইয়াসমিনের। কিন্তু কিছু বলার সাহস পাচ্ছে না। নিজেই ভেতরে নিজের জন্য এক অদ্ভুত তাচ্ছিল্য খুঁজে পাচ্ছে ও। এতোদিনে মুখ খোলার সাহস হয়নি এখন আর কী হবে! শুধু শুধু নিজের ছেলেমেয়েদের ওপর রাগ ঝাড়তে পারে ও আর কিছুই না! হঠাৎ করেই রেহানের রুম থেকে ভাঙচুরের আওয়াজ শুনে কিছুটা হকচকিয়ে গেলো রিয়াদ সাথে ইয়াসমিনও!
চলবে…