নিস্তব্ধ বিচরণ,পর্ব -৭
তানজিলা
৭ মাস আগে
_____________
কাঠফাটা রোদের মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকার চেয়ে অসহ্যকর কিছু হতে পারে বলে এই মুহুর্তে ইনায়ার মনে হচ্ছে না। তার ওপর হাতে থাকা আইসক্রিমের সর্বনাশ হয়ে আছে। গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। রোদের প্রকপটাও আজ বেশি! কাঁধে ঝুলানো ব্যাগটা মাথার উপর তুলে ধরলো ইনায়া। ফিহা আর মাদিহা গল্প করতে ওর সামনে এসে দাঁড়াতেই সমস্ত রাগ ওদের উপর ঝাড়ার তীব্র ইচ্ছা জেগে ওঠে ইনায়ার মনে।
-“এত তাড়াতাড়ি আসার কী দরকার ছিল? আর একটু হলেই হয়তো আমি কুলফির মতো গলে এখানে পড়ে থাকতাম! কত বড় সুযোগটা কী মিস হয়ে গেল না!”
ইনায়ার কথা শুনে দুইজন নিজেদের কথা থামিয়ে ইনায়ার দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকালো। প্রত্যেকবার সবচেয়ে দেরিতে ইনায়াই আসে। হয় ঘুম নাহলে ভুলে যাওয়ার মতো বদঅভ্যেসে জর্জরিত ইনায়া এই দেরি করা নিয়ে কেউ কিছু বললেও সেটাকে পাত্তা দেয় না। একটু দেরি হতেই পারে! যেহেতু এটা জ্যামের শহর! আর আজকে নিজে আগে এসেছে দেখে ওদের ঝাড়ছে! ইনায়ারই স্টাইলে ওরা ইনায়াকে ইগনোর করে পাশ কাটিয়ে চলে গেল। ইনায়া ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেল। ওর কথা কি কারও কানে যায়নি!
কিছুক্ষণ পর নিজেই দাঁত বের করে হাসতে শুরু করলো। ইনায়াকে হঠাৎ এভাবে হাসতে দেখে ফিহা আর মাদিহার কেউই অবাক হলো না। এতে নতুন কিছু নেই। হুট করে কোন মজার কথা চিন্তা করতে করতে হাসতে শুরু করে ইনায়া। যেই সেই হাসি না, মানুষের চোখে পড়ার মতো হাসি! প্রায়ই ক্লাসে এই বদঅভ্যেসের জন্য বিপদে পড়ে ও!
-“আরে শোন না! হঠাৎ আজকে…!”
ইনায়া নিজের হাসির ঝুলি খুলে ওদের সাথে চলছে। হঠাৎ মাদিহাকে দেখে মনে হলো কি যেন নিয়ে বেশ চিন্তিত। একটু পর পর সামনে কি যেন দেখছে।
-“ইনায়া দেখ তো তোর দিকে কিভাবে যেন তাকিয়ে আছে!”
মাদিহার কথা শুনে ইনায়া ভ্রু কুঁচকে সেদিকে তাকালো। কিন্তু তেমন কিছুই দেখলো না। মাদিহা বললো,
-“তুই পেছনে ফিরতেই চলে গেল!”
-“হয়তো ওর উপর ক্রাস খেয়েছে। এসব কথা রাখ। আজকে আমার দ্রুত বাড়ি যেতে হবে!বাড়িতে মেহমান আসার কথা!”
ফিহায় কথায় ওরা সেদিন আর ওদিকে দাঁড়ালো না। বাসায় আসার পথে ইনায়া একাই ছিল। ফিহা আর মাদিহার বাড়ি উল্টো পথে। বাড়ির কাছাকাছি চলে আসতেই একটা বাচ্চা ছেলে এসে ইনায়ার হাতে একটা চিরকুট ধরিয়ে দিয়ে ইনায়াকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই দৌড়ে কোথায় যেন চলে গেল! ইনায়া চিরকুটটা খুলে দেখতেই ওর বুকটা মোচর দিয়ে উঠলো। একবার আশেপাশে চোখ বুলালো ইনায়া। সবাই নিজ নিজ কাজে ব্যাস্ত। রাস্তার একপাশে টংয়ের দোকানে কিছু লোক আড্ডা দিচ্ছে আর চা খাচ্ছে। বাচ্চারা একপাশে খেলছে। এরকম চিরকুট ওকে কে পাঠাবে! লাল মার্কারের তীব্র গন্ধ আসছে চিরকুটটা থেকে। হুমকি দিচ্ছে কেউ ওকে!
-“I AM WATCHING YOU!”
হঠাৎ ইনায়ার চোখ পড়লো রাস্তার একপাশে দাঁড়িয়ে থাকা গাড়িটার দিকে। কালো রঙের গাড়ি।
-“আপু এভাবে কী দেখছো?”
ইনায়ার সবচেয়ে ছোট কাজিন আরিফা ওর কাছে আসতেই ইনায়া দ্রুত চিরকুটটা লুকিয়ে ফেললো। একবার চারপাশে চোখ বুলিয়েই ঘরে ঢুকে পড়লো ইনায়া।
ইনায়ার চাচা মাত্র ঘরে এসে ঢুকলো। চেহারায় চিন্তার ছাপ। ইনায়া আর আরিফাকে দেখে যেন জোর করে মুখে হাসি এনে ওদের সাথে কথা বলছে। ইনায়া তো ওর চাচার চোখের মণি। বাসায় আসতেই আরিফার সাথে সাথে ইনায়ার জন্যও কিছু না কিছু নিয়ে আসেই। ওর চাচার মুখে লেগে থাকা চিন্তার ছাপ ইনায়ার দৃষ্টিগোচর হয়নি। চেয়েছিল চাচার সাথে কথা বলবে কিন্তু এখন সেটায় মন সায় দিল না।
গত দুইদিন যাবৎ একই গাড়ি বাড়ির সামনে দেখছে ইনায়া। কেন যেন মনের মধ্যে খুঁতখুঁত রয়েই গেছে। হয়তো সেদিনের ঘটনাটার জন্য। ভিষণ ভয় পেয়েছিল ইনায়া। ওর বাবারও কোন খবর নেই কয়েকদিন যাবৎ। একবার ভ্রু কুঁচকে কালো রঙের গাড়িটার দিকে তাকালো ইনায়া। ভেতরের কিছুই বাইরে থেকে দেখা যাচ্ছে না।
ধীরে ধীরে গাড়িটার দিকে এগিয়ে গেল ইনায়া। কয়েকবার গাড়ির জানালার কাঁচে নক করলো। কিন্তু ভেতর থেকে কোন সাড়াশব্দই নেই। মনের মধ্যে থাকা সন্দেহ তিলে তিলে ক্রমশ গাড়ো হচ্ছে। এবার জানালার খুব কাছে এগিয়ে যায় ইনায়া। গাড়ির ভেতরে কি আছে সেটা জানার প্রচেষ্টায়। আচমকাই কেউ একজন গাড়ির ভেতর থেকেই জানালার কাঁচে বারি দিতেই কিছুটা দূরে সরে যায় ইনায়া। সাথে সাথেই গাড়িটা ইনায়ার চোখের সামনে থেকে চলে গেল। ঘটনার আকস্মিকতার ছাপ লেগে আছে ইনায়ার চোখে মুখে। কিছুক্ষণ পর একবার গাড়িটা যেদিক দিয়ে গেল সেদিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালো ইনায়া। এতো সহজে হাল ছেড়ে দেয়ার পাত্রি ও না।
পরের দিনও গাড়িটাকে একই স্থানে দেখতে পেল ইনায়া। প্রতিবেশিদের একবার জিজ্ঞেস করেছিল ও।কেউ গাড়িটার ব্যাপারে কিছু জানে না। একটা গাড়ি নিয়ে এতো ইনভেস্টিগেট করার কারণে কাল ওর চাচীর ঝাড়িও খেয়ে বসে আছে। একবার মনেই হলো কেউ কি কোন মজা করছে ওর সাথে! চিরকুটটার ব্যাপারে কাউকেই বলেনি ও। বাসার সবাইকে এমনিও ইদানিং বেশ টেনশনে থাকতে দেখে ওর বিবেকে নাড়া দিয়ে উঠলো। যদি আসলেও কেউ মজা করে থাকে তাহলে তো শুধু শুধু সবার সময় নষ্ট হতে পারে। সেটা ইনায়া একদমই চায় না।
তবে এই গাড়ির ব্যপারটাকেও হালকা ভাবে নিচ্ছে না ও। গাড়িটা এখানে কয়েক ঘন্টা দাঁড়িয়ে থেকে চলে যায়। কিন্তু এই কয়েকঘন্টা গাড়ি থেকে কেউই বের হয় না।
ব্যাগ থেকে গাড়ো লাল রঙের লিপস্টিক বের করলো ইনায়া। গাড়ির জানালায় বেশ বড় করে কিছু একটা লিখলো। যদিও এক সময় এসে লেখাটা একটু ছোট হয়ে গেল।
-“কার ওপর নজর রাখছেন আপনি?”
এই গাড়ির ভেতরে থাকা মানুষটাই যদি ওর কাছে চিরকুট পাঠিয়ে থাকে তাহলে সে ঠিকই বুঝে নিবে। আর যদি অন্য কেউ হয় তাহলে অন্তত রাগেও বের হতে পারে। ভুল হলে সরি বলে নিবে। কিন্তু এতো ভয়ে ভয়ে থাকতে পারছে না ও। সবসময় মনে হচ্ছে ওর দিকে কেউ নজর রাখছে। সেদিনের পর থেকে জানালা বারান্দা সব বন্ধ করে ঘুমাতে যায় ও!
ইনায়ার ধারণাকে ভুল প্রমান করে এবারও গাড়িটা চলে গেল। এবার তো ইনায়ার অনেকটা নিশ্চিত, কিছু তো ঘাপলা আছে! এতো দামী গাড়িতে লিপস্টিক দিয়ে লেখার পরও গাড়ি থেকে কেউ বের হলো না!
ইনায়ার চোখ যতদূর যায় তার থেকে অনেকখানি দূরে এসে থামলো গাড়িটা। গাড়ি থেকে বেরিয়ে এলো অতি রাগান্বিত এক যুবক। রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে পুরো মুখটাই যেন লালবর্ণ ধারণ করেছে। একবার মনোযোগ সহকারে গাড়ির কাঁচে লাল রঙে আবৃত লেখাগুলো খেয়াল করলো রেহান। যথেষ্ট চেষ্টা করছে নিজের রাগ নিয়ন্ত্রণ করার। দুনিয়াতে এই কাজটাই যেন রেহানের কাছে সবচেয়ে কঠিন মনে হয়। তার উপর নিজের প্রিয় কোন বস্তুর উপর যখন কেউ এভাবে টর্চার চালায় তখন যেন চোখে শুধু ক্রোধ জ্বলে ওঠে ওর। চোখমুখ কুঁচকে লেখাগুলোর দিকে নজর দিয়ে বিড়বিড় করে বলে উঠলো,
-“এতো বিশ্রি হাতের লেখাও কারো হতে পারে!”
কিছু একটা চিন্তা করে লেখাগুলো না মুছেই আবারও ইউটার্ন মারলো রেহান। ইনায়াকে রাস্তার একপাশে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বাঁকা হেসে গাড়ির স্পিড কিছুটা বাড়িয়ে দিল। রাতে বৃষ্টি হওয়ায় রাস্তায় এখনো কাঁদা পানি জমে আছে। ইনায়ার খুব কাছ থেকে যেতেই একগাদা কাঁদাপানি ইনায়ার শরীরে ছিটকে পড়লো!
গাড়িটাকে আবারও ইনায়ার দিকে আসতে দেখে প্রথমে অবাক হলেও পরে নিজের অবস্থার দিকে লক্ষ্য করতেই রাগে কটমট করে গাড়িটার দিকে তাকালো ইনায়া। কিছুটা সামনে এসে গাড়িটাও আবার থেমে গেল। আশেপাশের সবাই ইনায়াকে দেখে হাসছে বিশেষ করে বাচ্চারা। ইনায়া দ্রুত পা চালিয়ে গাড়িটার দিকে এগোতে গেলেই আগের মতো এবারও গাড়িটা চলে গেল!
ইনায়াকে রাগে কটমট করে ভ্রু কুঁচকে এভাবে তাকাতে দেখে আনমনেই হেসে উঠলো রেহান। পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নিল। মেয়েটার মধ্যে বাচ্চামী স্বভাবটা বিদ্যমান। এর সাথে তাল মিলিয়ে নিজের সময় নষ্ট করার কোন মানেই হয় না। অনেক জরুরি কাজ বাকি আছে ওর!
চলবে…