নিয়তি,পার্ট ২,৩

0
947

নিয়তি,পার্ট ২,৩
লুৎফুন্নাহার_আজমীন
পার্ট২

যে কয়েকদিন সালাম সাহেব হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন সে কয়েকদিন প্রায়ই ছেলেটার সাথে হৃদির দেখা হতো।ছেলেটা যে চে হৃদির সাথে কথা বলতে আসতো।হৃদিও ভদ্রতার খাতিরে ছেলেটার সাথে কথা বলতো।বিষয়টা বিলকিস বেগম খেয়াল করেন।তিনি হৃদিকে ডেকে বলেন,,

-বাইরের ছেলের সাথে এত কথা কিসের তোর?
-মামী আমি তো আর যে চে উনার সাথে কথা বলতে যাই নাই।উনিই আসছেন আমার সাথে যে চে কথা বলতে।তো ভদ্রতার খাতিরে…
-বলতে হবে না ভদ্রতার খাতিরে কথা।এরপর যদি দেখি তো তোর একদিন কী আমার একদিন।

হৃদির কথা শেষ হওয়ার আগেই ধমকের সুরে হৃদিকে কথা গুলো বলেন বিলকিস বেগম।বিলকিস বেগম প্রায়ই হৃদির সাথে কর্কশ গলায় কথা বলেন।তবে আজ যেন কর্কশতার মাত্রাটা বেড়ে গিয়েছিলো।তাই মামীর কথা শুরুর সাথে সাথে হৃদি কেঁপে ওঠে।প্রায় বিশ দিন হাসপাতালে অবস্থানের পর সালাম সাহেবকে বাসায় নেওয়া হয়।ছেলেটাও সেদিন হৃদিকে অনুসরণ করে হৃদির মামার বাসা চিনে যায়।রিসিপশনের মেয়েটার কাছ থেকে হৃদির মামার বাসার টেলিফোন নাম্বার নেয়।প্রথম দিন ফোন দিতেই সিঁথি কল রিসিভ করে।

-আসসালামু আলাইকুম। কে বলছেন?কাকে চাই?
-ওয়ালাইকুম আস সালাম।আমি হৃদির বন্ধু বলছি।হৃদিকে ফোনটা কী দেওয়া যাবে?আসলে আমি ওর নাম্বার হারিয়ে ফেলেছি।
-হৃদি তো বাসায় নেই।বাহিরে গেছে।খুব আর্জেন্ট?
-জ্বী।
-তাহলে আপনি ওর নাম্বার নিয়ে নিন।

ছেলেটা সিঁথির কাছ থেকে হৃদির ফোন নাম্বার নেয়।আর তৎক্ষনাৎ হৃদিকে ফোন দেয়।হৃদি তখন রাস্তায় ছিলো।প্রায় ৩-৪বার কল দেওয়ার পরে হৃদি কল রিসিভ করে।

-জ্বী আসসালামু আলাইকুম। কে বলছেন?
-ওয়ালাইকুম আস সালাম।হৃদি না?
-জ্বী কিন্তু আপনি কে?আর আমার নামই বা জানলেন কিভাবে?
-আমি আলভি।মনে আছে?হসপিটালের আলভি
-ওহ আচ্ছা।কেমন আছেন ভাইয়া? আর আমার নাম্বার পেলেন কোথায়।
-তুমি ভাইয়া বলার আগ পর্যন্ত ভালো ছিলাম।কিন্তু এখন নেই।
-ওমা কী হলো?
-ভাইয়া ডাকটা পুরো কলিজায় লাগে বুঝলা?কষ্ট লাগে খুব
-ওহ আচ্ছা।তাহলে আমি আপনাকে কী বলে ডাকবো?
-নাম ধরেই ডাকতে পারো।প্রবলেম নাই।
-আচ্ছা আলভি।এখন আমি রাখি।রাস্তায় আছি তো!
-আচ্ছা।তাহলে রাতে কথা হবে।
-জ্বী আল্লাহ হাফেজ।

হৃদি কল কেটে দেয়।বাজারের ব্যাগটা ফুটপাত থেকে তুলে বাসার দিকে হাঁটা লাগায়।এম্নেতে বাজার ঘাট সালাম সাহেবই করেন।তিনি অসুস্থ থাকায় সাম্য বাজারঘাট করতো।কিন্তু আজ দুইদিন যাপত সাম্য বাসায় নেই।অফিসের কাজে বাইরে গেছে।তাই হৃদিকেই বাজার ঘাট করতে হচ্ছে দুইদিন যাপৎ হৃদিই বাজার করছে।বাসায় গিয়ে সিঁথির হাতে হাতে কাজ গুলো গুছিয়ে দেয়।আগে বাসায় রান্না বান্নার দায়িত্ব ছিলো বিলকিস বেগমের ওপর।এখন তিনি স্বামীর সেবায় ব্যস্ত। শ্বাশুড়ির পরে তো ছেলের বউয়ের ওপর সংসার সামলানোর দায়িত্ব আসে।সেই সিঁথি রান্নার দায়িত্বে আছে।
দুপুরের খাবার শেষে বাসন গুলো মেজে হৃদি বিছানায় গা এলিয়ে দেয়। ঘুম ঘুম পাচ্ছে খুব।আস্তে আস্তে হৃদি চোখ বুজে।হারিয়ে যায় অতল ঘুমের দেশে।

-তোরা দুজনে আমায় পাগল করে দিবি।কতক্ষণ ধরে তোদের পেছন ঘুরছি।খেয়ে নিলেই তো ঝামেলা শেষ হয়ে যায়।

হাঁপাতে হাঁপাতে কথাটা হৃদি সাম্যকে বলেন মিসেস হেনা।সাম্য আর হৃদি হাসতে হাসতে বলে,,

-হি হি হি আমাদেল ধলতে পালে না।
-তোরা খাবি না?
-নাহ খিতুলি আমাল ভাল্লাগে না ফুপ্পি।

আহ্লাদী কন্ঠে মিসেস হেনার কথার জবাব দেয় সাম্য।সাম্য তখন দশ বছরের বাচ্চা।কিন্তু বাচ্চামি স্বভাবটা তখনও সাম্যের মধ্যে ছিলো।আর সারাক্ষণ হৃদির সাথে থাকতে সেও আধো আধো কথা বলতো।হৃদি সাম্যর কথার সাথে তাল মিলিয়ে বলে,,

-সাম্যদার ভাল্লাগে না তো আমালও ভাল্লাগে না।
-ওরে দুষ্টু।দুটোকে আজ এক সাথে বেঁধে খাওয়াবো।

কথাটা বলেই মিসেস হেনা আবার দুইজনের পেছন ছুটতে লাগেন।এবং ধরেও ফেলেন।দুজনকে নিয়ে সোফায় বসান।জোর করে খাইয়ে দেন দুজনকে।খেতে খেতে হৃদি সাম্যকে বলে,,

-সাম্যদা আজকে আমাল পুতুলের সাথে তোমাল পুতুলের বিয়ে দেবে না?
-আমি পড়া গুলো শেষ করে নেই।বিকেলে দেবো বিয়ে।
-আম্মু তুমি পায়েস লান্না কলে দিয়ো।পুতুলের বিয়েতে
-আচ্ছা।এখন খান আম্মাজান।

-হৃদি!এই হৃদি ওঠ।আসরের আজান দিয়েছে।নামাজ পড়বি না?

সিঁথি হৃদিকে ধাক্কা দিছে আর ডাকছে।বিকেল হয়ে গেছে।নামাজ পড়তে হবে না!এই বাসার নিয়ম সবাইকে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়তে হবে।অনেক কিছু ছাড় দেওয়া গেলেও এই ব্যপারে ছাড় দেওয়ার কোনো প্রশ্নই আসে না।সিঁথির ডাকে হৃদি চমকে উঠে।এতক্ষণ তাহলে হৃদি স্বপ্ন দেখছিলো!

-হ..হ..হ্যা যাই সিঁথি দি।

চোখ কচলাতে ওয়াশরুমে যায় অজুর উদ্দেশ্যে।ইদানীং ছোট বেলা নিয়ে স্বপ্ন খুব বেশিই দেখছে হৃদি।কিন্তু কেন তা আল্লাহ ছাড়া আর কেউ জানেন না।কারণ আল্লাহ সর্বশক্তি মান।তিনি সব জানেন,শুনেন দেখেন।

খাওয়া শেষে বাসন গুলো মেজে ক্লান্ত শরীরটা বিছানায় এলিয়ে দেয়।কিছুক্ষণের মধ্যেই চলে যায় অতল ঘুমের দেশে।রাত ১২টা নাগাদ হৃদির ঘুম ভাঙে তাও ফোনের শব্দে।ঘুম মাখা চোখ নিয়ে ফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকায় সে।নাম্বারটা সেভ করা নেই কিন্তু পরিচিত পরিচিত লাগছে নাম্বারটা….আরেহ এটা তো আলভির নাম্বার।কিন্তু এত রাতে আলভি হঠাৎ ফোন দিলো কেন?নিশ্চয়ই কোনো দরকার আছে বা থাকতে পারে।ঘুম ঘুম চোখে ফোন রিসিভ করে ক্লান্তিকর কন্ঠে হৃদি বলে,,

-জ্বী বলুন
-ঘুমায় পড়ছিলা নাকি?
-রাত বাজে বারোটা।এই সময় ঘুমানো কী স্বাভাবিক নয়?
-অহ আচ্ছা।তাহলে ডিস্টার্ব করলাম।সরি
-না না ঠিক আছে।কী জন্যে ফোন দিয়েছিলেন সেটা বলুন
-এম্নি। কথা বলতে মন চাইলো তাই ফোন দিলাম।
-হোয়াট?এমনি?মানে কী এগ্লার?
-তোমার মিষ্টি ভয়েজ শুনতে মন চাইলো তাই ফোন দিলাম।
-মশাই রাত বিরাতে এইভাবে অন্য মেয়েকে ফোন দিলে আপনার গার্লফ্রেন্ড রাগ করবে।

কথাটা বলেই হৃদি হেসে দেয়।হৃদির হাসির আওয়াজ ফোনের ও পাশেও যায়।হৃদির হাসি শুনে আলভীও মুচকী হাসে।আর বলে,,

-ও হ্যালো মেডাম।আমার কোনো গার্লফ্রেন্ড নেই।আমি পিউর সিঙ্গেল।By the way আপনার বফ কেমন আছে?
-বফ নাই।
-কেন?
-ডোন্ট নো।আমার ঘুম পাইতেছে।
-আচ্ছা।আর ডিস্টার্ব করবো না।গুড নাইট মেডাম।

প্রতিদিন রাতেই প্রায় হৃদিকে আলভী ফোন দিতো।হৃদিও আলভীর সাথে কথা বলাটা খুব উপভোগ করতো।কোনো দিন ফোন দিতে দেরি হলে হৃদি খুব চিন্তায় পড়ে যেত।এত দিনে ছেলেটার প্রতি মায়া জন্মে গেছে হৃদির।মেয়েদের মায়া বরাবরই বেশি থাকে।তারা আঠা নষ্ট হওয়া টিপ,ভাঙা চুড়ি,জোড়া হারানো কানের দুলটাও যত্ন করে রেখে দেয়।এই জন্য তাদের মায়াবতী বলা হয়।মায়াবতীর কোনো পুরুষবাচক শব্দ নেই।(হুমায়ুন আহমেদ)
মায়া ভয়ংকর সুন্দর।এই জিনিসটা একটা মেয়ের জীবনে যেমন সুখের জোয়ার বয়ে আনে।ঠিক তেমনই দুঃখ কষ্টও বয়ে আনে।ঠিক যেমনটা হয়েছিলো বাংলার শেষ নবাব সিরাজউদ্দৌলার স্ত্রীর সাথে।তিনি প্রথমে নবাবের মায়ায় পড়েন।পরে ভালোবেসে বিয়েও করেন। কিন্তু সুখ তার কপালে বেশিদিন সয় না।দুঃখ কষ্টের ভাটা পড়ে তার জীবনে।হত্যা করা হয় বাংলার শেষ স্বাধীন নবাবকে।বেগম লুৎফান্নেছা এতটাই বাংলার শেষ নবাবের মায়ায় পড়েছিলেন যে পরবর্তী জীবন সে নবারের কবরে প্রদীপ মোমবাতি জ্বালিয়েই কাটিয়ে দিয়েছেন।

চলবে,,,

#নিয়তি
#লুৎফুন্নাহার_আজমীন(কন্ঠ)
#পার্ট৩

-আচ্ছা তুমি কী বাচ্চা পড়াও?
-আগে পড়াইতাম।এখন পড়াই না।কেন?

ফোনের এপাশ থেকে আলভীর কথার জবাব দেওয়ার সাথে পালটা প্রশ্ন করে হৃদি।ফোনের ওপাশ থেকে আলভী জবাবে বলে,,

-আমার ছোট ভাই টা ক্লাস টু তে উঠলো।ওর জন্য প্রাইভেট টিউটোর খুজছিলাম।পড়াবে আমার ছোট ভাইটাকে?
-দেখি।আমি মামার সাথে কথা বলে তোমায় জানাবো নি।
-আচ্ছা।কয়টা বাজে খেয়াল আছে মেডাম?

ফোনের ওপাশ থেকে আলভীর বলা কথা শুনে হৃদি ঘড়ির দিকে তাকায়।দেখে দেড়টা বাজে।এত রাত হয়ে গেছে হৃদি বুঝতেই পারেনি।আলভীর সাথে কথা বললে সময় কেমন যেন তাড়াতাড়ি বয়ে যায়।

-কী হলো মেডাম?বললেন না তো কয়টা বাজে।

ফোনের ওপাশ থেকে হৃদির দিকে প্রশ্ন ছুড়ে মারে আলভী।লজ্জা মাখা কন্ঠে হৃদির আলভীর প্রশ্নের উত্তর দেয়।

-ইয়ে মানে…দেড়টা।
-ঘুমাবেন না?
-ঘুম আসছে না।
-ঘুমায় পড়ো।আবার সকালে উঠেই তো তোমাকে রাজ্যের কাজ করতে হয়।কখনো খারাপ লাগে না?
-খারাপ লাগবে কেন?নিজের ঘরে কাজ করতে কার খারাপ লাগে!
-নিজের ঘর?তুমি না তোমার মামাবাড়ি থাকো।
-মামা কী আপন না?মা মারা যাওয়ার পর বাবার আদর থেকে বঞ্চিত হই।তখন তো মামাই আমায় কাছে টেনে নিয়েছে।সাম্যদার থেকে মামা আমায় কোনো অংশে কম দেখে না।
-কিন্তু তোমার মামি?

আলভীর কথা শুনে হৃদি দীর্ঘশ্বাস ফেলে।হাসি মাখা কন্ঠে বলে,,

-মামি তো আমায় আরও বেশি ভালোবাসে।তাই তো বকা ঝকা করেন।অনেক রাত হয়েছে।আল্লাহ হাফেজ
-হুম আল্লাহ হাফেজ।

হৃদি ফোন কেটে দেয়।স্টাডি টেবিলের পাশে চার্জিং পয়েন্ট।ফোন চার্জে দিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ে।দীর্ঘশ্বাস ফেলে হৃদি।সে জানে মামির কাছে হৃদি বোঝা।কিন্তু ঘরের কথা কী আর বাইরের মানুষকে বলা যায়?লোকে ছি ছি করবে।ছোট বেলায় হৃদি বেশ পেট পাতলা স্বভাবের ছিলো।কোনো কথাই গোপন রাখতে পারতো না।তাই হৃদির মা হৃদিকে বলতেন,,

-আমাদের কাছে বলছিস বল। কিন্তু বাইরের মানুষের কাছে ঘরের কথা কখনো বলবি না।লোকে ছি ছি করবে আর সুযোগ পেলে কটু কথা বলবে।

সময় আর পরিস্থিতি কত কিছুই বদলে দেয়।৪-৫বছর আগের সেই হৃদি এখন বদলে গেছে।কিছু হলেই বাড়ি মাথায় করতো যে মেয়ে আজ চুপচাপ থাকতে শিখে গেছে।গোপন রাখতে শিখে গেছে হাজারো কথা।যে মেয়ে গোসল করে বাথরুমে কাপড় ফেলে আসতো অন্য কেউ তার কাপড় ধুবে বলে সেই মেয়ে আজ ৪-৫জনের কাপড় দিব্যি ধুয়ে দিচ্ছে।হাত নষ্ট হয়ে যাবে বলে যে মেয়ে বাসন মাজতো না আজ সেই মেয়ে তিনবেলার এটোঁ বাসন ধুচ্ছে।কেউ নিজের জিনিসের দিকে তাকালে যে মেয়ে তাকে সহ্য করতে পেতো না।আজ সেই মেয়ে হাসি মুখে প্রিয় জিনিসটাকে অন্যের হাতে তুলে দিয়েছে।মেয়েদের জীবনটা ঠিক এই রকমই।সেক্রেইফাইজ আর মানিয়ে নিয়েই চলে যায়।দুটো চোখের একটি দিয়ে নিজের পরিবার আপনজনের সুখ দেখে।আর অন্য চোখ দিয়ে ভালোবাসার মানুষটার।নিজের দিকে তাকানোর সময় সুযোগ কোনোটাই নেই তার।কেন যেন ইদানীং রাত হলে হৃদির মায়ের কথা খুব মনে পড়ে।আজকেও মনে পড়ছে।হৃদি দীর্ঘশ্বাস ফেলে। চোখের কার্ণিশ থেকে জল গাল গড়িয়ে বালিশে পড়ে।

★★

-হৃদি তো এইচএসসি দিলি এইবার তাই না?
-জ্বী মামা।

কথাটা বলে সালাম সাহেবের প্লেটে তরকারি দেয় হৃদি।সালাম সাহেব রুটির টুকরো মুখে দিয়ে বলেন,,

-তা বিয়ে সাদি করার ইচ্ছা কী এখনো আছে?না আর একটু পরে করবি।
-তোমরা যা ভালো বুঝো।তোমরা তো আমার ভালোই চাইবে।কখনো খারাপ চাইবে না।
-তোর পছন্দের কেউ আছে?

কথাটা শোনা মাত্রই হৃদি সাম্যের দিকে করুণ দৃষ্টিতে তাকায়।দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,,

-মামি কিছু লাগবে তোমার?
-নাহ।

কারও বুঝতে বাকী রইলো না যে হৃদি কথাটা এড়িয়ে গেলো।সবার খাওয়া যখন শেষের দিকে তখন হৃদি আর সিঁথি খেতে বসে।খাওয়া শেষে সালাম সাহেব উঠে যাচ্ছিলেন।তখন হৃদি তাকে বলে,,

-মামা আমি যদি একটা টিউশনি করি তো তোমাদের কী কোনো সমস্যা হবে?
-বাসায় গিয়ে পড়াবি নাকি স্টুডেন্ট বাসায় আসবে।

পানির গ্লাসটা টেবিলে রেখে হৃদিকে পাল্টা প্রশ্ন করে সাম্য।সাথে সাথে হৃদি জবাব দিয়ে দেয়,,

-বাসায় গিয়ে ভাইয়া।
-বাসা কই?
-তা তো জিজ্ঞাস করি নি।
-আচ্ছা আমায় জানাস।

কথাটা বলেই সাম্য অফিস ব্যাগ কাঁধে নিয়ে অফিসের উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। সালাম সাহেব উঠে ঘরে যান।পেছন পেছন তার সহধর্মিণীও যান।

সিএনজিতে আনমনে বসে আছে সাম্য।শহুরে যান্ত্রিক জীবনের কলহল তার কান স্পর্শ করেনি।সেদিনই সাম্যের ফুপি পুতুলটাকে সাম্যের কোলে দিলো।দেখতে দেখতে পুতুলটা বড়ও হয়ে গেলো।হয়ে গেলো কৈশরের প্রেম।পরিস্থি পুতুলকে সাম্যের থেকে দূরে সরিয়ে নেয়।যাকে নিয়ে সাম্যের পুরো জীবন কাটানোর কথা ছিলো সে একদিন অন্যকারও হয়ে যাবে।ভাবতেই সাম্যের ভেতরটা মোচড় দিয়ে ওঠে।

রাত তখন প্রায় সাড়ে এগারোটা। সাম্য ছাদে দাঁড়িয়ে নিজ মনে সিগারেট টেনে যাচ্ছে।হৃদি জানে যে এই সময় সাম্য সিগারেট টানে।তাই সে ছাদে আসে।সিঁথির সাথে বিয়ের কথা জানানো হয়েছিলো সাম্যকে।সে সোজা না করে দেয়।তা নিয়েই নিজেদের মধ্যে আলোচনা করছিলেন বিলকিস বেগম আর সালাম সাহেব।এবং তা হৃদি আড়াল থেকে শুনতে পায়।সবার মতো সেও চেষ্টা করে সাম্যকে রাজী করানোর।হৃদি ডাক দিলে সাম্য পেছন ফিরে তাকায়।হৃদিকে দেখে সাম্যের মলিন মুখে হাসি ফুটে।সিগারেটটা প্রায় শেষের দিকেই।সিগারেটের ফিল্টারটা ছুড়ে ফেলে মেঝেতে।ছাদের রেলিংয়ের সাথে ধাক্কা লেগে অনাদরে রেলিংয়ের সাথে হেলান দিয়ে পড়ে থাকে সিগারেটের জলন্ত ফিল্টার।
সাম্য হৃদির কাছে গিয়ে বলে,,

-শুনলাম সিঁথির সাথে মা বাবা আমার বিয়ে ঠিক করেছে।তুই কিছু জানিস?
-হু জানি।এও জানি তুমি বলেছো সিঁথিদিকে তোমার দ্বারা বিয়ে করা সম্ভব নয়।
-ভুল কিছু বলেছি?আমার পুতুল থাকতে আমার অন্য কাওকে চাই না।
-অবশ্যই।সব কিছু সম্ভব না সাম্যদা।তুমি জানো আমি আশ্রিতা।
-আশ্রিতা তো কী হইছে!তোকে আমি বিয়ে করে পার্মানেন্টলি এই বাড়ির সদস্য বানাবো।

হৃদির গালে হাত দিয়ে একরাশ আশা ভরা কন্ঠে কথাটা সাম্য বলে।হৃদি এক ঝটকায় সাম্যের হাত সরিয়ে দেয়।হৃদির এমন আচরণের জন্য সাম্য মোটেও প্রস্তুত ছিলো না।সে অবাক দৃষ্টিতে সাম্যের দিকে তাকিয়ে থাকে।করুণ কন্ঠে বলে,,

-হৃদি!তোর কী কিছু হয়েছে?এমন করছিস কেন তুই?
-কী হবে কিছু না।
-তাহলে এমন করছিস কেন?তুই কী আমায় আর ভালোবাসিস না?
-সব ভালোবাসা পুর্ণতা পায় না সাম্যদা।অন্যের খুশীর জন্য কখনো কখনো নিজেদের সেক্রিফাইজ করতে হয়।
-কী বলতে চাইছিস তুই?
-সিঁথিদিকে এই বাড়িতে বউ করে নিয়ে এসো।

হৃদির মুখে এমন কথা শুনে সাম্যের মাথায় রক্ত চড়ে যায়।রাগে ওর চোখ রক্তিম বর্ণ ধারণ করে।

-পাগল হইছিস?কী বলতেছিস এগুলা?ওর মতো মেয়েকে আমি বিয়ে করবো?নেশাখোর ছেলের সাথে সম্পর্ক। দুই তিন বার বাসা থেকে বেরিয়ে গেছে।
-জানো সাম্যদা মেয়েরা না অনেক সরল হয়!হতে পারে ছেলেটা সিঁথিদিকে ফুসলিয়ে বের করে নিয়ে গিয়েছিলো।অন্তত আমার খুশীর জন্য সিঁথিদিকে বিয়ে করো।

কথাটা বলে হৃদি দীর্ঘশ্বাস ফেলে। সাম্য সিগারেটে আগুন ধরিয়ে এক টান দেয়।দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,,

-আমি ওকে বিয়ে করলে তুই খুশী হবি?
-কেন নয়?অবশ্যই খুশী হবো।
-কিভাবে?
-মামা মামি খুশী হবে।
-আর তুই? আমি?
-সব সময় নিজেদের কথা ভাবলে হবে?কবি বলেছেন ভোগে নয় ত্যাগেই প্রকৃত সুখ।

হৃদির কথা শুনে সাম্য ফিক করে হেসে দেয়।এই মেয়েটার বাচ্চামি স্বভাব হুট করেই চলে আসে।তাও সিরিয়াস মোমেন্টে!তখন বা হেসে থাকা।যায় না।হৃদি চলে যাচ্ছিলো।ঠিক সেই সময় সাম্য হৃদিকে পেছন থেকে ডাকে।হৃদিও পেছন ফিরে তাকায়।সাম্য মুচকী হেসে বলে,,

-বেশ তাই হবে।আমি সিঁথিকেই বিয়ে করবো।কিন্তু একটা আবদার রাখবি?
-কী?
-কাছে আয়।

হৃদি সাম্যের কাছে যায়।সাম্য হৃদির কপাকে এঁকে দেয় তাদের ভালোবাসার শেষ চিহ্ন।হৃদিও চোখ বন্ধ করে তা পরম আয়েশে গ্রহন করে।

চলবে,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here