#নিয়তি-২
#অলিন্দ্রিয়া_রুহি
আমি নিরবে কাঁদছি। মনটা অস্থিরতায় ভরে রয়েছে। কাউকে রক্তের বিষয়টা নিয়ে জিজ্ঞেস করিনি। অপেক্ষা করছি উনার,উনি এলেই এই প্রশ্নের জবাব দিতে বলব। আমার জানামতে, এই ঘরে উনি ছাড়া আর কেউই প্রবেশ করেনি সারাদিনে। রাত দশটার দিকে আমার শ্বাশুড়ি রুমে এলেন। আমি উল্টো পাশ ফিরে শুয়ে,উনাকে না দেখলেও উনার উপস্থিতি টের পেলাম। দ্রুত হস্তে চোখ মুছে নিলাম,এইটুকু কান্নাতেই চোখ ফুলে লাল বর্ণ ধারণ করেছে। আমার আবার কান্নার অভ্যেস নেই! আমার শ্বাশুড়ি হতভম্ব গলায় জিজ্ঞেস করলেন, ‘কীরে মা! কাঁদিস কেন? কী হইছে?’
আমি আমতা আমতা করতে লাগলাম। কী জবাব দেব? উঠে বসতে বসতে যুতসই জবাব খুঁজতে লাগলাম। পেয়েও গেলাম চট করে,বললাম, ‘বাড়ির কথা মনে পড়ছে আম্মা।’ বলেই মাথা নিচু করে রইলাম। আমার শ্বাশুড়ি পরম স্নেহে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। পাশে বসে স্নেহের গলায় শুধালেন, ‘আমারও যখন নতুন বিয়ে হয়, তোর মতো আমিও কাঁদতাম। সবার সামনে না, একা একা। এই ধর গোসল শেষে ছাদে গিয়েছি রোদ পোহাতে,ওই একলা দুপুরে মন ভরে কেঁদে নিচে নামতাম। চোখ লাল হয়ে থাকতো। কেউ জিজ্ঞেস করলে বলতাম,বেশি পানি দিয়ে গোসল করছি আজ,তাই এমন। কেউ বুঝতো না অথচ তোর শ্বশুর ঠিকই বুঝে যেতো। দু’দিনের সম্পর্ক, অথচ কী যে মায়া ছিল মানুষটার মাঝে! রাতের বেলা আমাকে বোঝাতো, বাবার মতো আগলে রাখছে সারাজীবন। মায়ের মতো চুলে তেল দেওয়া থেকে শুরু করে, খাইছি কীনা- পর্যন্ত সবকিছুর হিসেব রাখতো। সেই মানুষটাকে ছাড়া এখন একা সব সামলাতে হয়! কতকিছুর হিসেব গোলমাল হয়!’ অনুভব করলাম, শ্বাশুড়ি মা চোখ মুছছেন৷ তখন আমার চোখেও পানির জোয়ার, ভেজা পাতা পলক মেলাতে কষ্ট হচ্ছে। শ্বাশুড়ি মা নিজে ধাতস্থ হয়ে আমাকে বললেন, ‘আমার ছেলেও যেন সেভাবেই তোকে আগলে রাখে আজীবন দোয়া করি। যতই আমরা থাকি না কেন, স্বামীর উপরে এবং স্বামীর মতো আর কেউ হয় না মেয়েদের রে…’
আমার বুকে তখন উথাল-পাতাল কাঁপন, আমি কান্না চাপানোর আপ্রাণ চেষ্টা করছি। যেই মানুষটার উপর বিশ্বাস ও ভরসা রেখে অন্য মাটিতে নিজের শেকড় গাড়তে এলাম,সেই মানুষটাই আমাকে অবহেলার পাত্রী বানিয়ে ছাড়লো! এর চেয়ে কষ্টের আর কীইবা হতে পারে!
আমাকে ডিনার করার জন্য বললেও আমি রাজী হলাম না। আমার শ্বাশুড়ি মা হাত ধরে টেনে নিয়ে গেলেন। টেবিলে আমার দেবর লাবিব বসে রয়েছেন, তিনি গ্রোগাসে গিলছেন দেখলাম, আমার হঠাৎই হাসি পেয়ে গেল। ব্যাপারটা আমার দেবর খেয়াল করে এক চোখ টিপলেন, আমি ঘাবড়ে গেলাম। হতবিহ্বল চোখে চাইলাম, এবার লাবিবের ঠোঁটে দুষ্টু হাসি। আমারও হাসি পেয়ে গেল। দেবর হিসেবে এইটুকু মজা করার অনুমতি তাকে দেওয়াই যায়। ঠিক তখনই খেয়াল করলাম, আমার স্বামী মহাশয় মেইন দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছেন। শ্বাশুড়ি মা তাকে দেখে বললেন, ‘চলে আসছিস? আয় বস। তোর জন্য বউমাও না খেয়ে আছে।’
শুনলাম উনি গম্ভীর কণ্ঠস্বরে উত্তর দিলেন, ‘তা তো দেখতেই পারছি।’ এই বলেই উনি ঘরে চলে গেলেন। আমি দোটানায় পড়লাম। আমার কী উনার পিছুপিছু যাওয়া উচিত,নাকী খেতে বসা উচিত? দ্বিধাদ্বন্দে ভুগছিলাম যখন, তখন শ্বাশুড়ি মা-ই সাহায্য করলেন। আমাকে খেতে বসিয়ে দিলেন। উনি ফ্রেশ হয়ে আসবেন- এমনটা বলার পর আমিও অল্প একটু খেয়ে নিলাম। আমার খাওয়া শেষেও উনি আসছেন না দেখে আমাকে ঘরে পাঠালেন আম্মা।
এসে দেখি, উনি বিছানায় আধশোয়া অবস্থায় মোবাইল টিপছেন। আমার ছায়া যেই না রুমে পড়ল,উনার কপালে ভাঁজ সৃষ্টি হলো কতগুলো। ব্যাপারটা আমার নজর এড়ালো না। মন খারাপের একটা স্ফুলিঙ্গ ভেতর থেকে বের হতে চাইলো,আমি পুরোপুরি ইগনোর করলাম সেটাকে। কথায় কথায় মন খারাপ করলে চলবে না,বাঙালি নারীদের চলেও না। সংসার করতে গেলে মান-অভিমান বিসর্জন দিয়ে তবেই সংসার করতে হয়। উনি উনার মতো ফোনে ব্যস্ত, আমার দিকে ফিরেও তাকাচ্ছেন না। আমিই তাই আগ বাড়িয়ে মৃদু কণ্ঠে বললাম, ‘খাবেন না?’
উনি উত্তর দিলেন না। আমার গলায় কষ্টের দলা পাঁকিয়ে উঠল। হজম করার চেষ্টা করেও করতে পারছি না। জীবনে কেউ এরকম পরিস্থিতির শিকার হয়েছে কীনা জানি না! বিয়ের দ্বিতীয় দিন একটা স্বপ্নের দিনের ন্যায় থাকে সবার জন্যে.. এই সময়ে প্রেম হয়, ভালোবাসা হয়। একজন অপরজনের সাথে একটু কথা বলার জন্য ছটফট করবে,একজন অপরজনের উপর অধিকার খাটাবে,মেহমানদের ভীড়ে কিছুটা সময় কাটানোর আপ্রাণ চেষ্টা করবে- এভাবেই না দু’জনের প্রতি দু’জনের টান বাড়বে! অথচ আমার সাথে কী কাহিনীটাই না ঘটছে! কী অদ্ভুত!
আমি আবারও বলার চেষ্টা করলাম, ‘খাবেন না?’
অথচ গলা দিয়ে কোলা ব্যাঙের ঘরঘর শব্দ ছাড়া আর কিছুই বেরোলো না। তেতো অনুভূতিতে মন বিষাক্ত, আমার রোদ ঝলমলে আকাশে কোথা থেকে এই কালো মেঘের আবির্ভাব ঘটলো,জানি না। ফিরে চলে যেতে চাইলাম, হঠাৎ মনে পড়ল রক্তের কথাটা। এক মিনিট সময় নিয়ে নিজেকে সাহস জোগালাম। অনেকটা গাঢ় কণ্ঠেই প্রশ্ন করে বসলাম এবার, ‘চাদরে ওটা কীসের রক্ত?’
উনি এবার ভূত দেখার ন্যায় চমকে উঠলেন। ফোন ফেলে দিয়ে চাদর টানাটানি শুরু করলেন। মুখ দিয়ে প্রশ্ন করে চলেছেন, ‘কই রক্ত? কোথায়?’
আমি বললাম, ‘বালিশের পেছনে,দেখুন। আমি গোঁজ করে রেখেছি যাতে কেউ না দেখে।’
‘কেউ দেখেনি তো?’
‘নাহ, শুধু আমিই।’
‘যাক..’ উনি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন। কিন্তু আমি স্বস্তি পেলাম না। পুনরায় জবাবের প্রত্যাশায় প্রশ্ন করলাম, ‘বললেন না তো,কার রক্ত এগুলো? আপনাকে তো জখম দেখাচ্ছে না, তবে? আর এখানে এলো কী করে?’
উনার মসৃণ কপাল আবারও ভাঁজ বিশিষ্ট হলো। আমিও শক্ত হওয়ার চেষ্টা করছি। উত্তর আমার জানতেই হবে। উনি হঠাৎ রূঢ়ভাবে বললেন, ‘সে তোমার না জানলেও চলবে।’
‘এটা আমার ঘর,এখানে কোথায় কী হচ্ছে- তা আমি জানবো না?’ ফট করে মুখ দিয়ে জোরালো গলার প্রতিবাদ বেরিয়ে এলো। দেখলাম উনার ঠোঁট জুড়ে তাচ্ছিল্যের হাসি।
‘এটা তোমার ঘর? একদিনেই ঘর তোমার নামে হয়ে গেল? মা লিখে দিয়েছে নাকী?’
আমি জবাব দিতে পারলাম না। চোখ ভরে উঠলো আবারও। অভিমান হলো এবার,কড়া অভিমান। ঠিক করলাম, আগামীকাল বাবার বাড়ি যাওয়ার পর আর কোনোদিনই ফিরে আসবো না। উনার এই অহংকার নিয়ে উনিই থাকুক। সংসার আর ভালোবাসার কোনো দরকার নেই আমার!
আমি বেরিয়ে গেলাম। যাওয়ার আগে লক্ষ্য করলাম,উনি বেশ চিন্তিত ভঙ্গিতে কাউকে ফোন লাগাচ্ছেন।
আমার বেডরুমের পাশেই আরেকটি ঘর, সেখানে থম ধরে বসে রইলাম। এই ঘরেই গতকাল আমার স্বামী থেকেছে। এই বিছানায়ই ঘুমিয়েছে নিশ্চয়ই। বুকের ভেতর একরাশ অভিমান, তবুও কীসের টানে যেন, খুব অসহায়ের ন্যায় আমি বিছানায় হাত বোলালাম। যাকে একবারও ছুঁয়ে দেখার কপাল আমার হয়নি,তার জন্য মন কেন কাঁদে বুঝি না! এর চেয়ে আগেই তো ভালো ছিলাম। এত জ্বালা যন্ত্রণা আর চিন্তা- কিছুই ছিল না! বাবার ঘরে অতিরিক্ত আদর পাওয়ার জন্যেই কী আমার সাথে এমনটা হচ্ছে? স্বামীর আদর কী কপালে নেই তবে? চোখ বেয়ে টপাটপ পানি পড়তে লাগল। আমি মোছার চেষ্টা করলাম না। সব কষ্ট মুছে দিলেই চলে যায় না। এগারোটার কাছাকাছি ঘড়ির কাঁটা, ঘরে কেউ ঢুকেছে- অনুভব করতে পেরে আমি গুটিয়ে গেলাম। দ্রুত চোখ মুছে পেছন ফিরে দেখলাম, আমার দেবর লাবিব দাঁড়িয়ে। আমাকে দেখেই উনি বললেন, ‘ভাবী আপনি!’
আমি বিষম খেলাম। কী বলব! কী অযুহাত দেখাবো! চোরা চোখে চেয়ে রইলাম। লাবিব বললেন, ‘ভাইয়া তো ওই রুমে।’
‘আমি বিছানা গুছাতে এসেছিলাম।’ ঝটপট উত্তর দিলাম। লাবিব হেসে দিলেন, ‘আপনাকে এত কষ্ট করতে হবে না ভাবী। এই ঘরে কেউই থাকে না। এটা গেস্ট রুম।’
‘ওহ! এখানে শুধু গেস্টরা এলে তবেই থাকে?’
‘হ্যাঁ, এছাড়া সারা মাসই আম্মু দরজা তালা দিয়ে রাখে। আজকে সব মেহমান চলে গেল। দেখবেন কালকেই এই দরজায় তালা মেরে দিবে আম্মু। আমার ইয়ারফোন এই রুমে রেখে গেছে অধরা,সেটা নিতে এলাম।’
‘ওহ! গতকাল রাতেও কী এই ঘরে গেস্টরা ছিল?’
‘হুম। অধরা,বড় আপু,উনার ছেলে- এরাই ছিল। কেন ভাবী?’
আমি মাথা নাড়িয়ে বললাম, ‘এমনিই,কিছু না।’
আমি বেরিয়ে গেলাম। মাথায় জট লাগলো, তাহলে উনার শেরওয়ানি কেন বারান্দায় ছিল!? আর উনি যদি এই ঘরে না থেকে থাকেন, তবে কোথায় থেকেছেন রাতে? কিছুই বোধগম্য হচ্ছে না। সবকিছু রহস্য এবং ধোঁয়াশা!
(চলবে)