নীরবতা পর্ব_১৯_২০
#নাইমা_জাহান_রিতু
পুরো রাত পেটের ব্যথায় ছটফট করে ভোরের দিকে ঘুমিয়েছে উল্লাসী। তাই আর সকালে ঘুম থেকে উঠে তাকে ডাকলো না মেসবাহ। নাস্তা করে তৈরি হয়ে বেরিয়ে পড়লো হাসপাতালের উদ্দেশ্যে। মেয়েটিকে এভাবে একা ফেলে যেতে কোনোভাবেই মন টানছে না তার। বুকের ভেতরটায় অস্থির লাগছে। তবুও তাকে যেতেই হবে। বাইরে থেকে দরজা লক করে মেসবাহ এগুলো মুন্নি সরকারের ফ্ল্যাটের দিকে। আপাতত উনি ছাড়া দ্বিতীয় কোনো উপায়ন্তর নেই। তাছাড়া মহিলা এমনিতে খারাপও নয়। তবে তার অতিরিক্ত বকবকের কারণে একদমই সহ্য হয়না তাকে মেসবাহর।
-“কী খবর? এত সকাল সকাল আমাকে কী মনে করে মনে পড়লো?”
সৌজন্য সূচক মৃদু হেসে ফ্ল্যাটের চাবি মুন্নি সরকারের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে মেসবাহ বললো,
-“এটা রাখুন। খানিকক্ষণ পর পর গিয়ে উল্লাসীকে একটু দেখে আসবেন।”
-“কেনো? উল্লাসীর কিছু হয়েছে?”
-“ওই আরকি.. একটু অসুস্থ।”
-“বলো কী! কী হলো আবার ওর? গিয়ে দেখে আসি!”
মুন্নি সরকার ফ্ল্যাটের দিকে এগুতেই তাকে থামিয়ে দিল মেসবাহ। বললো,
-“এখন ও ঘুমোচ্ছে। কিছুক্ষণ ঘুমোক। আপনি একটুপর গিয়ে ওকে একটু খাইয়ে দিয়ে আসবেন। আমি টেবিলে ব্রেড রেডি করেই রেখে এসেছি। আর আমিও একটু ফ্রি হলে চলে আসবো। আপনি প্লিজ ওকে একটু দেখবেন।”
-“আরে! এভাবে আবার বলতে হবে নাকি! অবশ্যই আমি দেখবো। তুমি যাও।”
স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে লিফটের দিকে পা বাড়ালো মেসবাহ। অদ্ভুত এক অনুভূতি হচ্ছে তার উল্লাসীকে ফেলে যেতে। যেনো পুরো জীবনের জন্য হারিয়ে ফেলছে সে উল্লাসীকে। না চাইতেও অজ্ঞাত এক মায়াজালে সে নিজেকে জড়িয়ে ফেলছে উল্লাসীর সঙ্গে। তাকে নিয়ে ভাবছে। তার কষ্ট উপলব্ধি করতে পারছে। এসব কি মায়া? নাকি অন্যকিছু?
কলেজের গেটে এমাদের দেখা না পেয়ে মন অসম্ভব খারাপ হয়ে এল অনার। কাঁধের ব্যাগ চৈতালির কাছে দিয়ে তাকে ভেতরে পাঠিয়ে সে পায়চারী শুরু করলো রাস্তা ধরে। দু’মাস হলো এমাদের সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়েছে সে। এই কলেজেরই ইংরেজি বিষয়ের শিক্ষক নুরুল ইসলামের বড় ছেলে এমাদ। পড়াশোনায় খুব একটি মনোযোগী না হলেও বাবার ইচ্ছেতে ঢাকার একটি প্রাইভেট ভার্সিটিতে অধ্যয়নরত রয়েছে সে। তবে মাসের ৭ দিন ঢাকায় কাটালেও বাদবাকি দিনগুলো গ্রামে শুয়ে-বসে কাটায় এমাদ। এভাবেও বুঝি পড়াশোনা হয়? ভেবে পায় না অনা। অবশ্য তার নিজেরই যেখানে পড়াশোনায় মন বসে না সেখানে এমাদের কী করে বসবে? দু’জনে কি দু’পথের যাত্রী? মোটেও নয়। দুজনেই তারা একই পথে গমনকারী…
-“সরি.. সরি। দেরি হয়ে গেল!”
এমাদের ক্লান্তিমাখা মুখ দেখে মৃদু হাসলো অনা। আদুরে গলায় বললো,
-“ঘুম থেকে উঠতে দেরি হওয়ায় এভাবে দৌড়ে আসতে হবে? আজ না এলে কী এমন হতো?”
-“তুমি যে অপেক্ষা করতে!”
-“ইশ! আমার প্যাঁচাটা কত ভাবে! চলো.. একটু হেটে আসি।”
-“তোমার কলেজ?”
-“কলেজের তো তোমার মতো দৌড়ানোর সাধ্যি নেই। থাকবে সে নিজের জায়গাতেই দাঁড়িয়ে।”
হাসলো এমাদ। আশেপাশে একবার চোখ বুলিয়ে অনার হাতের আঙুলের মাঝে ডুবিয়ে দিল নিজের আঙুল।
-“জানো, কাল রাতে কি স্বপ্ন দেখেছি? দেখেছি তুমি আমার ঘরে এসে আমার কাছে গামছা চাইছো। আমিও তোমায় গামছা এগিয়ে দিচ্ছি। তবে আমি তখন এইবেশে নয়.. শাড়ি পড়া অবস্থায় ছিলাম। স্বপ্নটা সুন্দর না?”
অনার প্রশ্নের জবাবে মাথা নেড়ে এমাদ বললো,
-“হ্যাঁ.. সুন্দর।”
-“বিয়ের পর কি আমি শাড়ি পড়বো?”
-“তুমি চাইলে পড়বে।”
-“তোমার কোনো চাওয়া-পাওয়া নেই?”
-“উহু.. তোমার খুশিতেই আমি খুশি।”
এমাদের হাত জোরে চেপে ধরলো অনা। সাথেসাথেই এক অদ্ভুত অনুভূতি ছেয়ে গেল তার মনজুড়ে। দু’চোখ বুজে লম্বা একটা শ্বাস ছেড়ে সে বললো,
-“আমাদের ব্যাপারে আমরা কবে সবাইকে জানাবো?”
-“আরও কিছুদিন যেতে দাও। জানিয়ে দিব।”
-“ঠিকাছে। তবে চৈতালিকে তো জানানোই যায়। প্লিজ.. ওকে জানাই? ওর কাছে আমি কিছুই লুকিয়ে রাখতে পারিনা। দম বন্ধ বন্ধ লাগে।”
পথ চলা থামিয়ে অনার মুখোমুখি দাঁড়ালো এমাদ। ছোট্ট একটি নিঃশ্বাস ফেলে শান্ত গলায় বললো,
-“গোপন প্রেমের গভীরতা বেশি… তাছাড়া কিছুদিন যেতে দাও। সময় হলে আমরা দু’জনেই একইসাথে সবাইকে জানাবো।”
ব্যাকুল স্বরে অনা বললো,
-“সময়টি কবে আসবে?”
-“খুব দ্রুত.. চলো। তোমার কলেজের দিকে এগোই।”
ঠোঁটে হালকা হাসির রেখা ফুটিয়ে সেই চিরপরিচিত রাস্তা ধরে আবারও এগুলো অনা। এমাদকে খুব বেশি ভালোবেসে ফেলেছে সে। যতটুকু ভালোবাসলে তার খুশির জন্য নিজের জীবন বিপন্ন করতেও সে দু’বার ভাববে না।
হাসপাতালের কাজের চাপ বেশি থাকায় আর বাসায় যাওয়া হয়ে উঠলো না মেসবাহর। তবে ঘন্টাখানেক পর পর মুন্নি সরকারের নাম্বারে কল করে উল্লাসীর খবরাখবর রাখছে সে। এই মেয়েকে নিয়ে চিন্তার শেষ নেই তার। একয়দিন যাবৎ তাকে বাড়িতে একা ফেলে রেখে আসার চিন্তা, আজ থেকে আবারও নতুন চিন্তার সূচনা ঘটলো। অস্থিরতা কাটাতেই দুপুরের রাউন্ড দেয়া শেষ হতেই মুন্নি সরকারের নাম্বার ডায়াল করলো মেসবাহ। অশান্ত মনে অপেক্ষা করতে লাগলো ওপাশ থেকে একটি সাড়ার।
-“মেসবাহ.. তুমি এত কেনো টেনশন করছো বলো তো? এসব তো প্রতিটি মেয়েরই হয়। স্বাভাবিক একটি ব্যাপার এটি।”
এব্যাপারে মুন্নি সরকারের সাথে কথা বলতে অস্বস্তি হলো মেসবাহর। কোনোরকমে কথা কাটিয়ে সে বললো,
-“জ্বি.. তা উল্লাসী দুপুরে খেয়েছে?”
-“না.. ওকে খাওয়াতেই এসেছি। কথা বলবে ওর সাথে? নাও বলো।”
অপরপাশ থেকে উল্লাসীর গলার স্বর কানে আসতেই অস্থির মনে স্বস্তি ফিরলো মেসবাহর। শান্ত স্বরে সে বললো,
-“গোসল হয়েছে?”
-“হ্যাঁ..”
-“ব্যথার কী অবস্থা?”
-“একটু কম..”
-“ধীরেসুস্থে আরও কমবে। মুন্নি ভাবিকে বলো যাবার আগে যেনো পানি গরম করে বোতলে উঠিয়ে দিয়ে যায়। পন্ডিতি করে তুমি একা করো না। গরম পানি হাতে পায়ে লাগতে পারে।”
-“আচ্ছা..”
-“মুন্নি ভাবি কি ভাত নিয়ে এসেছে?”
-“হ্যাঁ..”
-“ঠিকাছে। কোনো বাহানা না দেখিয়ে খেয়ে নাও। আমি দেখি বিকেলের দিকে একবার বাসায় আসবো।”
-“আচ্ছা..”
-“কিছু খেতে ইচ্ছে করলে বলো। নিয়ে আসবো।”
-“না, কিছুই খেতে ইচ্ছে করছে না।”
-“আচ্ছা.. রাখছি।”
ইচ্ছে না থাকা সত্বেও কল কেটে চেম্বারে এল মেসবাহ। অস্থিরতা খানিকটা কমে এলেও উল্লাসীকে একটিবার দেখার জন্য মন উতলা হয়ে উঠেছে। এ কেমন বিপদে পড়লো সে! উল্লাসী ছাড়া কী কিছুই মাথায় আসেনা তার?
ভর সন্ধ্যায় ঘুমিয়ে রয়েছে উল্লাসী। দেখে মনে হচ্ছে গভীর ঘুমে তলিয়ে আছে। যাক! ভালোই হয়েছে একদিক দিয়ে। ঘুমোনোর সময়টুকুতো একটু শান্তিতে আছে। নয়তো কষ্টে আচ্ছন্ন মুখ নিয়ে চুপচাপ বিছানায় শুয়ে থাকতো উল্লাসী। দিন শেষে বাড়ি ফিরে যা দেখা মোটেও সুখকর হত না। একরাশ ক্লান্তি নিয়ে হাতের আইসক্রিমের বাটি ফ্রিজে রেখে এসে শার্ট খুললো মেসবাহ। কিছুক্ষণ বসে ঠান্ডা হয়ে পা বাড়ালো গোসলের উদ্দেশ্যে।
থালাবাটির ঝনঝন শব্দে ঘুম ভাঙলো উল্লাসীর। চারিদিকে চোখ বুলিয়ে পরিস্থিতি বোঝার চেষ্টা করলো সে। এখন সকাল নাকি রাত? কখন ঘুমিয়েছিল সে? আর কখনই বা উঠলো? বোধগম্য হলো না। সময় নিয়ে বিছানা ছেড়ে উঠে সে ধীরপায়ে এগুলো রান্নাঘরের দিকে।
-“আপনি কখন এসেছেন?”
পিছন ফিরে উল্লাসীকে দেখামাত্র হাসি ফুটলো মেসবাহর ঠোঁটে। হাতের আলু রেখে সে এগিয়ে এল উল্লাসীর কাছে। মিষ্টি স্বরে বললো,
-“অনেক্ক্ষণ.. শরীরের কী অবস্থা?”
-“ভালো। কী করছিলেন আপনি?”
-“ভাত টা উঠিয়ে দিলাম। আলুভর্তা আর ডিম ভাজি.. চলবে তো রাতে?”
মাথা নেড়ে সম্মতি জানিয়ে উল্লাসী পা বাড়ালো ড্রইংরুমের দিকে। ঘুম থেকে উঠার পর কিছুই ভালোলাগছে না তার। কোমর টেসে টেসে আসছে। শরীরে একদম শক্তি পাচ্ছে না। দু’পা প্রচন্ড চাবাচ্ছে..
-“এই উল্লাসী, আপেল খাবে? কেটে দেব?”
ডাইনিং থেকে গলা উঁচিয়ে মেসবাহ ডেকে উঠতেই নাকমুখ কুঁচকে ফেললো উল্লাসী। ক্ষীণ গলায় জবাব দিল,
-“উহু..”
-“আইসক্রিম?”
-“উহু..”
-“হালকা কিছু খেয়ে নাও। ততক্ষণে ভাত হোক।”
-“আচ্ছা হোক। একেবারে ভাতই খাবো।”
আর কথা বাড়ালো না মেসবাহ। এগুলো রান্নাঘরের দিকে। উল্লাসী আসার পর রান্নাঘর কী তার একরকম ভুলতেই বসেছিল সে। মেয়েটি অবুঝ হলেও যে পাক্কা রাধুনি তা মানতেই হবে! অবশ্য হবেই বা না কেনো? নিশ্চয় তার বাড়ির সকলের রান্না নিজে হাতে সামলাতে হয়েছে তাকে। সৎ মা যে কখনোই আপন মা হতে পারে না তার জ্বলজ্যান্ত উদাহরণ উল্লাসীর ছোট মা। কী করে পারলেন উনি মিথ্যে লোভ দেখিয়ে ছোট একটি মেয়েকে বিয়ের পিড়িতে বসাতে? জবাবে মেসবাহর বুকচিরে একটি দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল। ভাতের হাঁড়িতে আলু ছেড়ে ডিমের জন্য পিয়াজ, মরিচ কাটতে শুরু করলো সে।
চোখ বুজে শুয়ে থাকার পরও ঘুমের দেখা না পেয়ে উঠে বসলো উল্লাসী। ডিম লাইটের মৃদু আলোয় ঘরের পুরোটা নজরে এলেও কোথাও মেসবাহর দেখা না পেয়ে জোর গলায় ডেকে উঠলো তাকে। খাবারের পাঠ চুকেছে অনেক্ক্ষণ। এখনো কেনো ঘরে আসেননি উনি?
-“কী হয়েছে? কিছু লাগবে?”
সিগারেট হাতে ব্যালকনি থেকে ঘরে ঢুকে ক্ষীণ স্বরে বলে উঠলো মেসবাহ। জবাবে উল্লাসী বললো,
-“উহু.. আপনি কখন ঘুমোবেন?”
-“এইতো.. এখনই।”
-“তো আসুন না! একা একা ঘুম পাচ্ছে না।”
জ্বলন্ত সিগারেট এশট্রেতে ফেলে বিছানায় এল মেসবাহ। বালিসে মাথা গুঁজে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতেই ওপাশ থেকে উল্লাসী বললো,
-“আপনার কি সিগারেট খুব বেশিই পছন্দ?”
-“বলতে পারো!”
-“কেনো পছন্দ? বিশেষ কী আছে এতে?”
মাথার নিচে এক হাত রেখে ফ্যানের দিকে চেয়ে মেসবাহ জবাব দিল,
-“এতে শান্তি আছে.. ”
-“তাহলে আপনার ভেতরে যখন অশান্তি কাজ করে তখনই আপনি সিগারেট খান?”
-“উহু.. তেমন কিছু নয়।”
-“তাহলে কেমন কিছু?”
-“তুমি ঘুমোও উল্লাসী।”
হতাশ মনে চোখজোড়া বুজলো উল্লাসী। তবে হঠাৎ করে মুন্নি সরকারের বলা কথাগুলো মাথায় আসায় আবারও চোখ মেললো সে। অনুরোধের গলায় বললো,
-“একটু আদর করে দিন না!”
-“আবারও শুরু করলে?”
-“কী হয় একটু আদর করলে? হাসান ভাইও তো মুন্নি ভাবিকে আদর করে। তাহলে আপনি আমায় করেন না কেনো?”
ছোট্ট একটি নিঃশ্বাস ফেলে মেসবাহ বললো,
-“তুমি পিচ্চি বলে। বড় হও.. অনেক আদর দিব।”
-“আমি যেহেতু পিচ্চি তাহলে আমায় পিচ্চি আদরই দিন। বড় হবার পর না হয় বড় আদর দেবেন!”
-“ঘুমোও উল্লাসী..”
-“দিন না! দিন একটু। একটুই তো। দিন না!”
-“ঘুমোও..”
-“দেবেন না আপনি? আমি কিন্তু উঠে মুন্নি ভাবির কাছে চলে যাবো।”
উল্লাসীর ছটফটের সাথে পেরে না উঠে দীর্ঘশ্বাস ফেলে উল্লাসীর দিকে এগুলো মেসবাহ। চোখজোড়া বুজে পরম যত্নে কপালের মাঝবরাবর আলতো করে বসিয়ে দিল তার ঠোঁটের ছোঁয়া।
(চলবে)
#নীরবতা
#নাইমা_জাহান_রিতু
#পর্ব_২০
সকাল থেকেই প্রচুর ব্যস্ততার মাঝে সময় কাটাচ্ছে উল্লাসী। অসুস্থতা কাটিয়ে উঠেছে সে দিন পাঁচেক হলো। ঠিক অসুস্থতাও নয়, উনি বলেছেন মাসিক কোনো অসুস্থতা নয়৷ তবে যেটাই হোক সেটি ভেজাল ছাড়া দ্বিতীয় কিছু মনে হয় না তার। তল পেটে ব্যথা, হাটতে অসুবিধা, কোমর টেসে আসা.. এত কিছুর মুখোমুখি হবার পরও এই প্রথমবার নিজেকে বেশ ফুরফুরে লাগছে তার। উৎফুল্ল মনে ব্যাগের সব কাপড়চোপড় বের করে একেএকে আলমারিতে গুছিয়ে রাখলো উল্লাসী। তারপর পা বাড়ালো রান্নাঘরের দিকে। দুপুরের রান্নাটা দ্রুত সেরে মুন্নি ভাবির কাছে যেতে হবে। দুজনে মিলে আজ সিনেমা দেখার কথা রয়েছে। তবে তা মোটেও জানানো যাবে না উনাকে। মুন্নি ভাবির বারণ আছে। সব কথাই নাকি স্বামীকে জানাতে নেই। তাতে স্ত্রীর গুরুত্ব তাদের কাছে কমে যায়। ভাতের চাল ধুয়ে তা চুলোয় দিল উল্লাসী। তারপর ফ্রিজ থেকে মাছের পোটলা বের করে বেসিনের দিকে এগুতেই কানে এল কলিংবেলের শব্দ। নিশ্চিত মুন্নি ভাবি ডাকতে এসেছেন তাকে। তবে রান্নাই তো হয়নি এখনো! সব ফেলে এখন কী করে যাবে সে সিনেমা দেখতে? নিরাশ মনে মাছের পোটলা ভিজিয়ে রেখে দরজার দিকে এগুলো উল্লাসী। তবে দরজা খোলার মাত্র নিমেষেই মুখের ভঙ্গির পরিবর্তন হয়ে এল তার। মুন্নি ভাবি নয়.. মৌমিরা এসেছে!
প্রতি রাতের উল্লাসীর ভিন্ন ভিন্ন আবদারগুলোকে বেশ উপভোগ করে মেসবাহ। তার বলা কথা এবং কার্যক্রমগুলো বেশ আনন্দ দেয় তাকে। মাঝেমাঝে আবদারগুলো নিয়ে কোথাও একটি ভয় কাজ করলেও তা উপেক্ষা করে উল্লাসী বোঝানোর চেষ্টা করে সে। যা কিছুসময় পেরে না উঠে পিচ্চি আদর দিতেই হয় তাকে। তাছাড়া সে নিজে যেখানে শক্ত আছে সেখানে উল্লাসীর ছোট ছোট আবদার পূরণ করাই যায়! তবে সমস্যা সেখানে নয়, সমস্যা অন্যখানে। উল্লাসীকে একা বাসায় ফেলে হাসপাতালে এসেও কাজে মন দিতে পারে না মেসবাহ। উদ্ধত মন সারাক্ষণ আনচান করে মেয়েটির জন্য। কখন রাত হবে সেই প্রহর গুনে। মেয়েটি মায়াজালে যে বেশ শক্তপোক্ত করে আঁটকে পড়েছে সে তা বুঝেও মনকে হাজারটা কারণ দেখিয়ে বুঝ দেয় মেসবাহ। কেনো যেনো বিবেক কোনোভাবেই সায় দেয় না এ কথায়…
নিউরো সাইন্স হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে ল্যাবএইডের উদ্দেশ্যে রিক্সায় উঠে মুন্নি সরকারের নাম্বারে ডায়াল করলো মেসবাহ। উল্লাসীর জন্য একটি ফোন নিতে হবে। বারবার তার খবর নিতে মুন্নি সরকারের কাছে কল করায় বড্ড সংকোচ বোধ হয়। তাছাড়া উনার নানান প্রশ্ন তো রয়েছেই! সবমিলিয়ে ফোনের ওপাশ থেকে মুন্নি সরকারের আওয়াজ শোনামাত্র অজস্র অস্বস্তি এসে চেপে ধরে তাকে।
-“হ্যালো, মেসবাহ?”
-“জ্বি, ভাবি। একটু উল্লাসীকে ডেকে দেবেন?”
-“তাকে আর কোথায় পাই আমি? তোমার ভাই বোনেরা এসেছে না? তাদের নিয়েই পড়ে আছে সে। তুমি একটু লাইনে থাকো। আমি দিচ্ছি…”
হতবাক হলো মেসবাহ। একরাশ বিস্ময় নিয়ে বললো,
-“ভাইবোন এসেছে? আমার? কারা এসেছে?”
-“তোমার বড় ভাই আর ছোট বোন।”
-“বলেন কী! আচ্ছা.. আমি আসছি।”
-“তা এসো.. তবে তোমাদের পরিবার থেকে যে উল্লাসীকে এত সহজভাবে মেনে নিয়েছে তা দেখেই আমার ভালোলাগছে।”
-“হ্যাঁ.. ওইতো। আচ্ছা, রাখছি।”
দ্রুত ফোন কেটে রিক্সা ঘোরাতে বললো মেসবাহ। আপাতত বাসায় যাওয়া তার বেশ জরুরী হয়ে পড়েছে। বড় ভাই এবং অনা যে আসবে তা তো একবারও জানায়নি তাকে! তাহলে এভাবে হুট করে আসার মানেটা কী? অস্থিরতায় চিপের কোণা দিয়ে ঘাম বেয়ে পড়তেই তা মুছলো মেসবাহ। তাদের প্রেমের বিয়ের কথাটি যে মিথ্যে তা হয়তো এখনো জানতে পারেনি মুন্নি সরকার। নয়তো ফোনে এত শান্ত ভাবে কখনোই কথা বলতো না সে। তাছাড়া বড় ভাই গম্ভীর স্বভাবের মানুষ। মুন্নি সরকারের সাথে গল্প জুড়ে দেবার মতো মানুষ তিনি নন। বাদ রইলো অনা, সে গল্প পাগল এক মেয়ে। একবার গল্পের আসর খুলে বসলে তার সকল লুকোনো কথা মুন্নি সরকারের সামনে আসতে দু’সেকেন্ডও লাগবে না সেখানে তার বাসায় পৌঁছানো তো দূরের কথা! আবারও ঘামে সিক্ত কপাল মুছলো মেসবাহ। রিক্সা চালকের উদ্দেশ্যে থমথমে গলায় বললো,
-“ভাই.. একটু তাড়াতাড়ি চালান না!”
-“এর থাইকা বেশি পারমু না! পাও দিয়া রিক্সা চালাই আমি.. এ তো আমার উইড়াজাহাজ না!”
-“ঠিকাছে.. ঠিকাছে। যেভাবে খুশি চালান।”
সারাদিনের ক্লান্তি মেটাতে গোসল সেরে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিল মেসবাহ। তারপর ধীরেসুস্থে এগুলো পাশের ঘরের দিকে। অনা মৌমির সঙ্গে খেলায় ব্যস্ত, মাজহারুল চোখবুঁজে শুয়ে রয়েছে। এরমাঝে অনাকে ডেকে তাদের বিয়ের কথা উঠানো ঠিক হবে কিনা ভেবে পেল না মেসবাহ। ঘরজুড়ে কয়েকবার পায়চারী করে সে এগুলো রান্নাঘরের দিকে। এই রাতে আর এদিকটায় আসবে না মুন্নি সরকার। তাই আপাতত ভয় নেই। রাতের খাবার পর না হয় ধীরেসুস্থে পুরো ব্যপারটা বুঝিয়ে বলা যাবে অনাকে।
-“কী করছো?”
রান্নাঘরে ঢুকে উল্লাসীকে প্রশ্ন করামাত্র পিছন ফিরলো সে। মুখ ছোট করে হতাশ গলায় বললো,
-“আমি এতবড় মাছ কখনোই কাটিনি।”
-“মাছ কোথায় পেলে?”
-“আপনার আম্মা পাঠিয়েছে।”
চোখমুখ কুঁচকে বিরক্ত গলায় মেসবাহ বললো,
-“আম্মাও না! কেটে পাঠালেই তো পারতো! দেখি কী মাছ?”
উল্লাসী সরতেই প্রায় পাঁচ কেজি ওজনের ইলিশ মাছ দেখে সেদিকে এগিয়ে গেল মেসবাহ। ভ্রু কুঁচকে বললো,
-“বাড়িতে এতগুলো কাজের মানুষ থাকতে তোমার ভরসায় এই মাছ মা কী করে পাঠায়! আর কী কী পাঠিয়েছে?”
-“মাংস আর কিছু শাকসবজি। ওগুলো অনা আপা ফ্রিজে তুলে রেখেছে।”
-“অহ.. দেখি সরো। আমি চেষ্টা করে দেখি!”
-“আপনি পারবেন?”
-“দেখি চেষ্টা করে.. তুমি শুধু আমাকে ডিরেকশন দেবে কোথায় কিভাবে কাটবো।”
মেসবাহর কথামতো সরে বসে মেসবাহকে জায়গা করে দিল উল্লাসী। উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো মেসবাহর মাছ কাটা দৃশ্যের দিকে।
-“আরে না.. ওইখানে না। এইযে.. এই মাথার কাছে কাটুন। হ্যাঁ.. আরেকটু নিচে। এইতো.. এবার ঠিকাছে।”
উল্লাসীর কথামতো মেসবাহ মাছের মাথা কাটতেই চোখমুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠলো তার। ঠোঁটের কোণায় হাসি ফুটিয়ে বললো,
-“ডিম আছে মাছে!”
-“তাই তো দেখছি…”
-“আস্তেধীরে বের করুন।”
-“তা করছি.. একটা কাজ করো তো।”
-“কী কাজ?”
-“গলার এপাশটা চুলকে দাও। উফ! অসহ্য লাগছে..”
মেসবাহর গলায় হাত রেখে উল্লাসী বললো,
-“এখানে?”
-“হু..”
-“দিচ্ছি.. আপনি এত ঘামেন কেনো? এটুকুতেই ঘেমে টেমে একাকার হয়ে পড়েছেন! দাঁড়ান.. মুছে দেই।”
উল্লাসী এক হাতে পরণের ওড়না তুলে মেসবাহর কপালের ঘাম মুছে দিতেই তার ঠোঁটে ফুটলো মিষ্টি হাসির ঝলক। সুখী সে.. প্রচুর সুখী। এর চেয়ে বেশি সুখী হওয়া আর কোনোভাবেই সম্ভব নয় তার পক্ষে।
ডাইনিং থেকে মেসবাহ এবং উল্লাসীকে দেখে বুকচিরে একটি দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল মাজহারুলের। ধীর পায়ে আবারও সে ফিরে এল ঘরে। তার এবং জ্যোতির বিবাহিত জীবনটাও হয়তো এমন হতে পারতো। তবে হয়নি। আর না কখনোই হবে। বাড়ির বড় বউ হবার কারণে যখন সংসারের সকল কাজ নিজে হাতে একা সামলেছে জ্যোতি তখন সে একমুহূর্তের জন্যও এগিয়ে গিয়ে সাহায্য করেনি তাকে। না তার ছোটছোট চাওয়া-পাওয়া পূরণ করতে সক্ষম হয়েছে। কিছু সময় ইচ্ছে করলেও বাবার কারণে করা হয়ে উঠেনি, কিছু সময় নিজের ইচ্ছে করেনি। শুধু জানপ্রাণ দিয়ে ভালোবাসলেই একটি সম্পর্ক টিকিয়ে রাখা সম্ভব নয়। তাতে যেমন সম্মান দরকার ঠিক ততটাই দরকার একে অপরকে বোঝা। তার মনে অপরপক্ষকে নিয়ে চলা ক্ষোভকে খুঁজে বের করা। যা খুঁজে পেলেও একজন আত্মমর্যাদাহীন মানুষ হিসেবে তা মুছে দেয়ার ক্ষমতা তার ছিল না…
গাড়ি থেকে নেমে রাশেদ রহমানকে বিদায় জানিয়ে একটি রেস্টুরেন্টের ভেতর ঢুকলো জ্যোতি। সানগ্লাস খুলে অনুসন্ধানী চোখে চারপাশে নজর বুলাতেই দেখতে পেল মাজহারুলকে। বয়স তিনকের মতো একটি মেয়েকে নিয়ে জড়োসড়ো হয়ে বসে রয়েছে সে। এই মেয়েই কি মৌমি? তার মেয়ে?
-“কেমন আছো?”
দূর থেকে জ্যোতিকে দেখেই নিজেকে শক্ত করে নিয়েছিল মাজহারুল। তবে ধীরেধীরে জ্যোতির কাছে আসামাত্র বুকের ভেতরটা টিপটিপ করে উঠলো তার। বড্ড বদলে গেছে জ্যোতি। এই জ্যোতির সাথে কোনো অংশেই মিল নেই আগের সেই অভিমানী জ্যোতির…
-“বললে না কেমন আছো?”
-“আছি একরকম.. তুমি বসো।”
-“হ্যাঁ.. বসছি।”
মাজহারুলের মুখোমুখি বসলো জ্যোতি। হাতে থাকা ব্যাগ এবং ফোন একপাশে নামিয়ে রেখে বললো,
-“কিছু অর্ডার করেছো?”
-“হ্যাঁ.. মৌমির জন্য আইসক্রিম।”
-“তোমার জন্য কিছু করোনি?”
-“না.. আমি বাইরের খাবার খাই না।”
-“তুমি একদমই বদলাও নি.. ঠিক সেই আগের মতোই রয়ে গেছো!”
গভীর নিঃশ্বাস ফেলে মৌমির দিকে তাকালো মাজহারুল। হুট করে ঢাকায় আসার একমাত্র কারণ তার এই মেয়েটি। পরশু রাতে তার মৃত্যুর স্বপ্নটি দেখার পর কোনোভাবেই শান্তি পাচ্ছিলো না সে। নিঃশ্বাস ফেলতে কষ্ট হচ্ছিলো। দম বন্ধ বন্ধ লাগছিলো। কেনো যেনো মনে হচ্ছিলো মৃত্যুর আগে একবার হলেও মৌমিকে দেখিয়ে আনা উচিৎ তার মাকে। মা কী তা বোঝে না সে.. তবে সকলের মা আছে তার নেই তা খুব করে বুঝতে পারে। বাস্তবতা বড়ই নির্মম! তবু্ও সেই নির্মমতা দেখেই কাটিয়ে দিতে হয় বছরের পর বছর।
-“আম্মা.. ওদিকে তাকাও। তোমার আম্মু.. আম্মুকে দেখো।”
মাজহারুলের হাতের ইশারায় মৌমি তার দিকে চাইতেই বুকের ভেতরটায় হু হু করে উঠলো জ্যোতির। ঠোঁটজোড়া চেপে পাশ থেকে সানগ্লাস তুলে আবারও চোখে পড়ে নিল সে।
-“এটা আম্মু হলে ওটা কে?”
মৌমির প্রশ্নে কপাল কুঁচকে মাজহারুল বললো,
-“কোনটা?”
-“মেজবাবার বউ.. তুমি তো বলেছিলে ওই আমার আম্মু।”
-“ওটাও আম্মু। তবে এটা আসল আম্মু।”
পাশ থেকে হালকা কেশে গলা ঠিক করলো জ্যোতি। তারপর স্বাভাবিক গলায় বললো,
-“মেসবাহ বিয়ে করেছে?”
ভারী গলায় মাজহারুল বললো,
-“হ্যাঁ.. তুমি কী মৌমিকে একবার কোলে নেবে?”
-“অবশ্যই..”
মাজহারুল মৌমিকে কোলে দেয়ামাত্র তাকে বুকে চেপে ধরলো জ্যোতি। ঠোঁট চেপে খানিকটা সময় চুপচাপ বসে থাকার পর আর নিজেকে সামলাতে না পেরে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো সে। অতীতের পিছুটানকে বুকে চেপে আর পারছে না সে নিজেকে শক্ত রাখতে।
-“তুমি কাঁদছো কেনো আসল আম্মু?”
মৌমির কথায় কোনো জবাব দিল না জ্যোতি। দু’হাতের আঁজলে তার মুখ তুলে চুমুতে ভরিয়ে দিল তাকে। মৌমি নিজেও জ্যোতির বুকে গিয়ে তার ছোট্ট দুটি হাত দিয়ে আঁকড়ে ধরলো তাকে। ঠোঁটে তার ভুবনভুলানো হাসি ফুটিয়ে বললো,
-“আসল আম্মু.. তুমিও কী ওই আম্মুর মত অন্য কারো ছিলে এতদিন? কেনো ছিলে? আমার কথা কি একবারও মনে পড়তো না তোমার?”
মৌমির একথারও জবাব দিল না জ্যোতি।চোখের সানগ্লাস খুলে সে অশ্রুসিক্ত নয়নে মেয়ের দিকে তাকিয়ে থেমে থেমে বলতে শুরু করলো,
-“আমাকে মাফ করে দিস মা। আমাকে মাফ করে দিস। আমি জানি তোর ভেতর বুঝ এলে তুই আমাকে ঘৃণা করবি.. কিন্তু আমার কিছু করার ছিল না। আমি অনেক চেষ্টা করেছি। কিন্তু তোর মুখের দিকে তাকিয়েও আমি ওসব সহ্য করতে পারিনি।”
জ্যোতির কথা বোধগম্য হলো না মৌমির। তবে তার ছোট্ট দুই হাত দিয়ে সে মুছে দিল মায়ের চোখের পানি। তার গালে ঠোঁট ছুঁয়ে দিয়ে বললো,
-“কাঁদে না আসল আম্মু। ও বাবা.. আসল আম্মুকে একটা আইসক্রিম কিনে দাও না! আসল আম্মু কাঁদছে..”
আরও দৃঢ়ভাবে মৌমিকে নিজের বুকে আঁকড়ে ধরলো জ্যোতি। ঠিক একারণেই ওবাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে আসার পর দ্বিতীয়বার আর মৌমিকেও দেখতে যাবার সাহস করে উঠতে পারেনি সে। সে জানতো, সবকিছুর মায়া ছেড়ে ওবাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে আসলেও নিজের পেটের সন্তানের মায়া কাটানো সম্ভব নয়…
-“মা, আমি তোকেও আমার সাথে আনতে চেয়েছিলামরে। কিন্তু তোর দাদু আনতে দেয়নি। আমাকে মাফ করে দিস মা। বড় হবার পর আমাকে ঘৃণা করিস না।”
(চলবে)