নীরবতা পর্ব_২৯

0
2100

#নীরবতা পর্ব_২৯
#নাইমা_জাহান_রিতু

সুহাকে বেশ যত্নসহকারে খাইয়ে দিচ্ছে উল্লাসী। রোগা পাতলা শ্যাম বর্ণের মেয়ে সুহা। দু’চোখ হরিণির মতো টানাটানা, লম্বা নাক, মাথা ভর্তি কালো কোকড়ানো চুল। অসম্ভব মায়াবী চেহারার একটি মেয়ে। অথচ এই মেয়ের উপরই কিনা দিনের পর দিন বিনা কারণে অত্যাচার চলে গেছে। কিভাবে পেরেছে? শুধুমাত্র পায়ের সমস্যা এবং কথা বলতে না পারায় কেউ এতটা অবহেলিত হয়? বুকচিরে একটি দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল মেসবাহর। বিষণ্ণ মনে আবারও ভাতের থালায় হাত দিতেই পাশ থেকে সিকান্দার মির্জা বললেন,
-“দ্রুত খাও নানুভাই। আবার বাসায় ফিরতে হবে।”
-“বাসায় ফিরতে হবে মানে? আপনি সুহাকেও সাথে নিয়ে যাবেন?”
-“হ্যাঁ..”
সিকান্দার মির্জার কথার পিঠে কিছু বললো না উল্লাসী। অসহায় চোখে তাকালো মেসবাহর দিকে। উল্লাসীর চাহনিতে বুকের ভেতরটা টিপটিপ করে উঠলো মেসবাহর। অনুরোধের গলায় সে সিকান্দার মির্জার উদ্দেশ্যে বললো,
-“ও কিছুদিন থাকুক উল্লাসীর কাছে।”
-“কিন্তু কাল ওর ডক্টরের কাছে এপয়েন্টমেন্ট আছে।”
-“আমি না হয় নিয়ে যাবো..”
একদন্ড ভেবে সিকান্দার মির্জা সুহার দিকে চেয়ে বললেন,
-“নানুভাই.. তুমি এখানে থাকতে চাও?”
জবাব দিল না সুহা। আঁকড়ে ধরলো তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা উল্লাসীর কোমর। বিপরীতে ঠোঁট হালকা প্রসস্থ করে হাসলেন সিকান্দার মির্জা। মুখের উচ্ছিষ্ট খাবার গিলে বললেন,
-“রান্না কে শিখিয়েছে তোকে?”
-“ওভাবে কেউ শেখায়নি। কিভাবে যেনো হয়ে গেছে!”
-“তা তো হবেই। সারাদিন হাতা খুন্তি দিয়ে ফেলে রাখলে কী সেই মেয়ে পড়াশোনায় পাকা হবে! বদমাশ ছোকড়া একটা।’
-“কে বদমাশ ছোকড়া?”
-“তোর বাপ। যত্তসব ছোটলোকী চিন্তাভাবনা দিয়ে মাথা ভর্তি!”
নিমেষেই মুখ চুপসে গেলো উল্লাসীর। বাবাকে নিয়ে কেউ বাজে কথা বললে বুকের ভেতরটায় অদ্ভুত এক কষ্ট হয় তার। যা ক্ষণিকেই দলা পাকিয়ে বুক চেপে গলা খামচে ধরে ঝরে পড়তে চায় চোখ বেয়ে।
-“ওর পড়াশোনা নিয়ে কিছু ভাবছো?”
সিকান্দার মির্জা মেসবাহর উদ্দেশ্যে প্রশ্নটি করতেই মাথা নেড়ে সম্মতি জানালো মেসবাহ। স্বচ্ছ গলায় বললো,
-“হ্যাঁ.. আপাতত কোচিং-এ ভর্তি করিয়ে দিয়েছি। তবে কিছু ঝামেলার কারণে এখনো যাওয়া হয়ে উঠেনি।”
-“গ্রেট! আই লাইক ইউ। আজ তোমার জায়গায় ওই ছোটলোক নিজের মতো কারো হাতে উল্লাসীকে তুলে দিলে সে কখনোই এসব নিয়ে ভাবতো না।”
মনের ভেতর তৃপ্তি অনুভব করলেন সিকান্দার মির্জা৷ মেয়ের করা কাজে বহুবছর যে তৃপ্তির খোঁজ পায়নি সে!
-“সংসার ধর্ম বড় ধর্ম। তাহলে বোঝো এটা কত কঠিন কাজ!”
এক গ্লাস পানি ঢকঢক করে গিলে লম্বা একটি দম ছাড়লেন সিকান্দার মির্জা। আবারও ভারী গলায় বললেন,
-“সংসার টিকিয়ে রাখতে ভালোবাসাটা আবশ্যক নয়, তবে ভালোবাসাহীন জীবন কিছুটা নুন ছাড়া তরকারির মতো। পেট ভরাচ্ছি তবে স্বাদ পাচ্ছি না। তোমার হাতের কাছে নুন থাকতেও তুমি ইচ্ছে করে স্বাদহীন খাদ্য গোগ্রাসে কেনো গিলবে? কথায় কি যুক্তি খুঁজে পাচ্ছো?”
পাশ থেকে মেসবাহ জবাব দিল,
-“হু..”
-“ভালো থাকার মূল মন্ত্রই হচ্ছে ভালোবাসা। জটিল এই সংসার জীবন তখনই সহজ হবে যখন তোমরা দুজন দুজনকে ভালোবাসবে, সম্মান করবে। একে অপরের চাহিদার গুরুত্ব দেবে, একে অপরের দোষকে বড় করে দেখবে না। মোটকথা ভালো যদি বাসোই তাহলে নিজের সবটা দিয়েই তাকে ভালোবাসবে। তার ভালোটাকে ভালোবাসবে আর খারাপটাকে বাসবে না.. তাহলে ক্রমেই সংসার জীবন জটিলতায় ভরে উঠবে।”
-“আর দুজনের এক্সপেকটেশন?”
-“এক্সপেকটেশন.. জটিল কিছু নয়। তুমি তার কাছ থেকে নুন আশা করলে, জীবন সঙ্গী হিসেবে প্রথমে তুমি তাকে এক চিমটি নুন দাও। বিনিময়ে সে তোমাকে দু’চিমটি নুন ফিরিয়ে দেবেই দেবে।”

সকাল সকাল সুহাকে নিয়ে মেসবাহ বেরিয়েছে ডাক্তার দেখানোর জন্য। তাদের সাথে অবশ্য সিকান্দার মির্জাও রয়েছেন। সুহার সঙ্গে যাবার ইচ্ছে থাকলেও মেসবাহর সামনে তা প্রকাশ করেনি উল্লাসী। এমতবস্থায় ঘরে বসে একান্তে সময় কাটাতেও বিরক্ত লাগছে। বোনের জন্য মনটা আনচান করছে। হঠাৎ করেই সিকান্দার মির্জা নামক কেউ সুহার জীবনে আলো হয়ে এসে তার পুরো জীবন পালটে দেবে, দীর্ঘদিনের প্রতিক্ষার অবসান ঘটিয়ে বোনের সঙ্গে দেখা করাবে.. তা অকল্পনীয় ছিল। অথচ আজ তাই ঘটছে! কী করবে ভেবে না পেয়ে উৎফুল্ল মনে পাশের ঘরে এসে ঘর গোছানোর কাজে মন দিল উল্লাসী। বেশ ক’রাত হলো এঘরেই ঘুমোচ্ছে মেসবাহ। প্রচন্ড গোছগাছ স্বভাবের মানুষ তিনি। অথচ ঘরের এ কী হাল করে রেখেছে! কোনো কারণে কি অস্থিরতায় আছেন উনি? যেমন অস্থিরতায় সে দিন কাটাতো তার বিয়ের পরপর… উল্লাসীর চিন্তাভাবনার গতিপথ থেমে গেল হঠাৎ ইভানার আগমনে। সদর দরজা খুলতেই আচমকা ইভানার এই আগমন বোধগম্য হলো না তার। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তার কারণ খুঁজতে উঠে পড়ে লাগতেই মুখ খুললো ইভানা৷ সময় নিয়ে সহবাস সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করে খুটিনাটি সবটা ভেঙে খুলে একসময় উল্লাসীর দু’হাত চেপে ধরে ইভানা বললো,
-“এটা নরমাল উল্লাসী… এটা হবেই। নয়তো তোমরা বুড়ো-বুড়ি হবার পর তোমাদের কে দেখবে বলোতো?”
উদ্বেগপূর্ণ গলায় উল্লাসী জবাব দিল,
-“দেখার মতো তো আসলেই কেউ থাকবে না!”
-“ইয়েস! ইউ গট ইট। কেউ থাকবে না। তাছাড়া তুমি আমার একটি কথার উত্তর দাও। মেসবাহ যখন তোমায় আদর করে তখন তোমার ভালোলাগে না?”
-“লাগে..”
-“কতটুকু ভালো লাগে?”
-“জানি না…”
-“তুমি জানো উল্লাসী.. হয়তো এই ভালোলাগার কোনো সীমা পরিসীমা নেই বলেই তুমি তোমার অনুভূতি গুলোকে ব্যখ্যা করতে পারছো না। তাছাড়া ঠিক এর মাধ্যমেই কিন্তু স্বামী স্ত্রীর মাঝের সম্পর্ক পরিপূর্ণতা পায়।”
একদন্ড থেমে উল্লাসীর মনের অবস্থা বোঝার চেষ্টায় ব্যর্থ হয়ে আবারও ইভানা বললো,
-“স্বামী স্ত্রীর মাঝে সেক্স কোনো বাজে কাজ নয়। আর না মেসবাহর উদ্দেশ্য এর মাধ্যমে তোমায় কষ্ট দেয়া। একটা জিনিস ভেবে দেখো। মেসবাহর যদি তোমাকে কষ্ট দেয়াই উদ্দেশ্য থাকতো তাহলে এখন ও কেনো এতটা গিলটি ফিল করতো? কেনো তোমার নীরবতায় কষ্ট পেত? কেনো তোমার থেকে দূরে দূরে থাকতো?”
-“জানি না..”
-“জানি না বললে তো হবে না। তোমার জানতে হবে। তুমি মেসবাহর স্ত্রী। তুমি এসব না বুঝলে না জানলে আর কে জানবে বলো?”
দীর্ঘশ্বাস ফেললো ইভানা। গলার স্বর খানিকটা কমিয়ে এনে আবারও বললো,
-“ব্যাথা পেয়েছো.. তবে এটা রেগুলার চালালে আর ব্যথা পাবে না। মাঝে গ্যাপ রাখলে আবারও প্রথমবারের মতোই ব্যথা পাবে। আমি একজন গাইনেকোলোজিস্ট। আমি তোমাকে ডাক্তারি ভাষায় বলো বা স্বাভাবিক মানুষের ভাষ্যে.. উভয় ভাবেই বোঝানোর চেষ্টা করেছি। এখনও যদি তুমি না বুঝে অবুঝের মতো আচরণ করে মেসবাহকে কষ্ট দাও তা কি ঠিক হবে? এতে তোমার বিবেক কী বলে উল্লাসী?”
সময় না নিয়েই উল্লাসী ক্ষীণ স্বরে বললো,
-“ঠিক হবে না।”
-“হুম.. জানো উল্লাসী? গতকাল যখন আমি সবটা জানতে পারলাম তখন আমার একবার মনে হয়েছিল তুমি মেসবাহর জন্য ঠিক নও। মেসবাহ তোমার চাইতে বেটার কাওকে ডিসার্ভ করে। তবে পরমুহূর্তেই যখন তোমাকে নিয়ে মেসবাহর ভেতরের ছটফটানি দেখলাম, তোমাকে নিয়ে ওর সুস্থ মস্তিষ্কের চিন্তাভাবনা দেখলাম তখন মনে হলো, মেসবাহ তোমাকে ডিসার্ভ করে কিনা জানিনা। তবে সে তার ভালোবাসার মানুষটিকে নিয়ে সুখে থাকা ডিসার্ভ করে। এন্ড ইউ নো হোয়াট হি লাভস ইউ আ লট? প্রচুর ভালোবাসে ও তোমায়.. প্রচুর।”
বুকচিরে আরও একটি দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল ইভানার। উল্লাসীর হাত শক্ত করে চেপে ধরে বললো,
-“তুমি ভাগ্যবতী উল্লাসী। সময় থাকতে তুমি মেসবাহকে নিজের ভালোবাসার বন্ধনে আবদ্ধ করে নাও। এতটুকু বলতে পারি জীবনে কখনোই কষ্টের দেখা পাবে না। সত্যি বলতে মেসবাহর মতো আমি আমার এই আঁটাশ বছরের জীবনে দ্বিতীয় কাওকে দেখিনি। হি হ্যাজ আ সফট হার্ট। এন্ড আই রেলি লাভ হিম…”
চোখের কোণা বেয়ে দু’ফোটা জল গড়িয়ে পড়তেই নিজেকে সামলে নিল ইভানা। দ্রুত চোখের পানি মুছে ঠোঁটে একরাশ হাসি ফুটিয়ে আবারও বললো,
-“এস আ ফ্রেন্ড… যাকগে তুমি আমার কথায় কিছু মনে করলে না তো?”
-“উহু..”
-“গুড গার্ল। এবার আমাকে ঝটপট তোমার হাতের এক কাপ চা খাওয়াও তো! খুব ইচ্ছে করছে খেতে।”
উল্লাসী রান্নাঘরের দিকে এগুতেই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো ইভানা। তার কাজ আপাতত শেষ। বাদবাকি টুকো না হয় উল্লাসী নিজেই করে নেবে…

-“তুমি বের হবে সবাই ঘুমোনোর পর। অর্থ্যাৎ রাত দশটার পর। আমি মতিন মামার দোকানের পাশটায় তোমার জন্য অপেক্ষা করবো।”
-“ঠিকাছে।”
-“ওখান থেকে আমরা যাবো রেলস্টেশনে। রাত বারোটার ট্রেন ধরে সরাসরি চট্টগ্রাম। ওখানে শফিক আমাদের জন্য অপেক্ষা করবে।”
ফোনের ওপাশ থেকে এমাদের কথা শুনে কপাল কুঁচকে অনা বললো,
-“শফিকটা কে?”
-“আরে আমার বন্ধু। ওর ওখানেই আমরা কিছুদিন থাকবো। তো যা বলছিলাম। আমরা চট্টগ্রামে নেমে সর্বপ্রথম যা করবো তা হলো আমাদের বিয়ের কাজটা সেরে ফেলবো। তারপর সেখান থেকে শফিকের বাড়ি যাবো।”
-“ওর বাড়িতে ওর বাবামা নেই? উনারা আমাদের থাকতে দেবে?”
-“থাকবে না কেনো! অবশ্যই আছে। শফিকের বাবামা অনেক ফ্রি মাইন্ডের। ও সবটাই বলে রেখে তাদের।”
-“অহ.. তাহলে তো হলোই।”
-“হ্যাঁ.. তুমি ঠিক সময়মত বেরুবে কিন্তু।”
বিব্রত গলায় অনা বললো,
-“ঠিকাছে। তা বেরুবো। কিন্তু আমরা আজ না পালিয়ে দুদিন সময় কেনো নিচ্ছি? কাল আবারও আমাকে ছেলের বোন দেখতে আসবে। যা ভাবলেই আমার অস্বস্তি হচ্ছে। এভাবে কারো সামনে গিয়ে সঙ সেজে আমার বসে থাকতে মোটেও ভালো লাগেনা।”
-“বললেই তো হয়না, অনা। একটা গোছগাছ আছে। তা কাল আবারও কেন দেখতে আসবে? ছেলে তো একবার এসে দেখেই গেছে! ছেলের পছন্দ হয়েছে। ব্যস! কাহিনী খতম। এখানে আবার ছেলের চৌদ্দগুষ্টির দেখার কী আছে? ওই হাঁদারাম কি নিজে বিয়ে করবে নাকি চৌদ্দগুষ্টিরে দিয়ে বিয়ে করাবে?”
ফিক করে হেসে ফেললো অনা। চোখে মুখে একরাশ স্বস্তি ফুটিয়ে বললো,
-“কার যেনো বুকের ভেতরটা জ্বলে পুড়ে ছাড়খাড় হয়ে যাচ্ছে! ইশ.. পোড়া পোড়া গন্ধ পাচ্ছি।”
-“হাসবে না শুধুশুধু। তোমার হাঁদারাম হবু জামাইকে একবার সামনে পাই! মেরে চৌদ্দগুষ্টির নাম না ভুলিয়ে দিয়েছি তো আমার নাম এমাদ নয়!”
-“কচু! আচ্ছা এখন রাখছি। আম্মা ডাকছে। যাই খেয়ে আসি। তুমি খেয়ে নিও।”
-“যাও.. আমার আর দুপুরের খাওয়া! মাত্রই সকালের নাস্তা করলাম। আচ্ছা তুমি যাও।”
কল কেটে ফোন নির্দিষ্ট স্থানে লুকিয়ে রেখে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এল অনা। দ্রুত খেয়েই একবার চৈতালির বাড়িতে যেতে হবে। চৈতালির লাল টকটকে একটি ব্লাউজ আছে। যা তার সবুজ শাড়ির সাথে বেশ খাটবে!

সুহাকে বাসায় রেখে মেসবাহর হাসপাতালে আসতে আসতে সকাল পেরিয়ে দুপুর হয়ে এল। ক্লান্তিকর অবস্থায় চেম্বারে ঢুকেই চেয়ারে নিজের শরীর এলিয়ে দিল মেসবাহ। দু’চোখ বুজে ফেললো কিছু দীর্ঘশ্বাস। বাসা থেকে উল্লাসীর হাতের দুমুঠো ভাত খেয়েই সে দ্রুত বেরিয়ে পড়েছিল হাসপাতালের উদ্দেশ্যে। যা গাড়ির ঝাঁকুনির তোপে পড়ে সবটাই হজম হয়ে পেটের ভেতরটা আবারও ক্ষুধার জানান দিচ্ছে। মোটের উপর অস্থির লাগছে। চারিপাশের মানুষের কোলাহল কানে এসে বিঁধছে তীরের মতো।
-“স্যার.. ওয়ার্ড নাম্বার তিনের নয় নাম্বার বেডের প্রেশেন্ট হঠাৎ করেই মাথার ব্যথায় চিৎকার চেচামেচি করছে। একটু আসবেন?”
নার্সের কথা শুনে চোখ মেলে তাকালো মেসবাহ। তীক্ষ্ণ গলায় বললো,
-“এখন তো তোফায়েল সাহেবের ভিজিটিং আওয়ার। তাছাড়া কেসটাও উনার আন্ডারে। এখানে আমার কাজ কী?”
-“কিন্তু স্যার তোফায়েল স্যার যে বললো উনি আপনার আন্ডারে!”
-“যত্তসব বোগাস কথাবার্তা! ছেলেটি গতকাল রিকশা থেকে পড়ে গিয়ে মাথায় আঘাত পেয়েছিল। যার শুরু থেকে সবটাই উনি হ্যান্ডেল করেছেন।”
-“তাহলে এখন কী করবো স্যার?”
চোখেমুখে বিরক্তি প্রকাশ করে উঁচু স্বরে মেসবাহ বললো,
-“সেটাও আমি তোমায় শিখিয়ে দিব? তাহলে তুমি আছো এখানে কী কাজে? গেট লস্ট। আমি এখন কোথাও যেতে পারবো না।”
মেসবাহর এমন ব্যবহারে অবাক হলো রিমঝিম। তার দেখা সবচেয়ে শীতল মেজাজের ডাক্তারের মাঝে মেসবাহ একজন। যার কাজ সর্ব পরিস্থিতিতে ঠোঁটের হাসি ধরে রাখা। সকলের সাথে সুস্থসুন্দর ভাবে পেশ হওয়া। অথচ আজ কী এমন হলো যে সাধারণ একটি ব্যাপারে এতটা চড়াও হলেন তিনি? নিরাশ মনে রিমঝিম চেম্বার ছেড়ে বেরুতেই আগমন ঘটলো লিমনের। চেয়ার টেনে মেসবাহর মুখোমুখি বসে সে কপাল কুঁচকে বললো,
-“কী হয়েছে? এভাবে বেচারির উপর চিৎকার করছিলি কেন?”
-“শালার সব জায়গায় পলিসি! রাস্কেল একটা।”
-“মাথা ঠান্ডা কর। তাছাড়া যার উপর রেগে আছিস তার উপর না ঝেড়ে এদের চৌদ্দগুষ্টি উদ্ধার কেনো করছিস?”
-“আমি কারো উপরই রেগে নেই।”
-“বুঝি রে পাগলা বুঝি। খাইনা আমি সুজি।”
-“তুই সুজিই খাস।”
চোখ টিপলো লিমন। দুষ্ট হাসির রেখা ঠোঁটে ফুটিয়ে বললো,
-“শুধু সুজি? আমি যা খাই তার বর্ণনা দিতে গেলে রাত পেরিয়ে সকাল হয়ে পড়বে।”
বিরক্ত মুখে মেসবাহ বললো,
-“কেউ শুনতে চেয়েছে?”
-“চেতস কেন শালা? শোন এই পরিস্থিতি আমিও পেরিয়ে এসেছি। পাগলা তোমার যে এখন ধ্যান জ্ঞান সবটাই উল্লাসীর শরীরের দিকে তা অস্বীকার করে কাপুরষ হতে চাও?”
-“চুপ কর তো। বাজে বকিস না।”
আরাম করে চেয়ারে বসলো লিমন। টেবিল থেকে একটি কলম উঠিয়ে তা ঘোরাতে ঘোরাতে বললো,
-“বিরিয়ানি চিনিস বিরিয়ানি? কেউ যদি এই বিরিয়ানি আগে না খেয়ে থাকে, তাহলে তার পক্ষে বিরিয়ানির স্বাদ জানা সম্ভব নয়। তখন তার নাকে হাজারো বিরিয়ানির গন্ধ আসলেও তা গলাধঃকরণের ইচ্ছা জাগবে না। তবে কেউ যদি মামা একবার জীবনে বিরিয়ানির স্বাদ জেনে যায়, তখন তারে আর ঠেকায় কে? বিরিয়ানি আশেপাশে থাকলে তার আরও স্বাদ নিতে মন ছটফট করে। এমন কী বিরিয়ানি আশেপাশে না থাকলে এরা অর্ডার করে হলেও তা গলাধঃকরণ করেই ছাড়ে। কিছু বুঝলা মাম্মা?”

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here