নীরবতা পর্ব_৪০ (অন্তিম পর্ব)

1
3720

নীরবতা পর্ব_৪০ (অন্তিম পর্ব)
#নাইমা_জাহান_রিতু

সূর্যোদয়ের সাথেসাথে নতুন দিনের সূচনা হয়। শুরু হয় মানুষের জনজীবন প্রকিয়া। নতুন শিশু জন্ম নেয় আবার অনেকেই বিদায় নেয় মমতাময়ী পৃথিবীর বুক ছেড়ে। জন্ম মৃত্যু যে জীবনেরই অংশ! জন্ম যার হয়েছে মরতে তো তাকে হবেই। তাই বলে কী থেমে থাকে জীবন? থাকে না। ধরাবাঁধা নিয়ম ভেঙে জীবন তার নিজস্ব গতিতে এগিয়ে চলে। যে গতিতে চলে এসেছে মেসবাহ জীবন। দেখতে দেখতে চোখের পলকেই আরও ছয়টি মাস হারিয়ে গেছে তার জীবন থেকে অকস্মাৎ যেভাবে সে হারিয়েছিল তার বোনকে। তবে অন্য আরও দশটি দিনের চেয়ে তার আজকের দিনের সূচনা হয়েছে ভিন্নভাবে। সকাল সকাল উঠে ব্যথায় ছটফট করা উল্লাসীকে দেখে অস্থির হয়েছে, প্রিয়জন হারানোর ভয়ে ডেকেছে উপরওয়ালাকে।

আজও নতুন একটি শিশু জন্মাবে। রহস্যময় এই পৃথিবীতে নিজের পদার্পণের জন্য যে উতলা হয়ে উঠেছে। মায়ের পেট থেকে বেরিয়ে নতুন জগতে নিজের রঙ ছড়ানোর জন্য চঞ্চল হয়ে উঠেছে। তবে মা যে তার এই আগমনী বার্তা সহ্য করতে পারছেনা। ব্যথায় অস্থির হয়ে কাকুতি মিনতি করছে ব্যথা কমিয়ে দেবার। বুঝতে পারছেনা সে তার শিশুর রুপটি। কেনো শুধুশুধু মা’কে কষ্ট দিচ্ছে সে? ব্যথায় কোঁকড়ানো মুখ নিয়ে হাসপাতালের বেডে শুয়ে আর্তনাদ ধ্বনি করে উঠলো উল্লাসী। মুন্নি সরকারের হাত চেপে ধরে বললো,
-“ভাবি আমার কি সময় হয়ে এসেছে?”
-“হ্যাঁ..”
-“আমার খারাপ লাগছে ভাবি। কষ্ট হচ্ছে। আমি কি মরে যাচ্ছি ভাবি?”
-“বাজে বকিস কেন? মরা কি খুব সহজ? শুধু তুই একাই এই দুনিয়ায় বাচ্চা জন্ম দিচ্ছিস? আর কেউ দিচ্ছে না?”
জবাব দিল না উল্লাসী। পেট আঁকড়ে ধরে আবারও চিৎকার করে উঠলো সে। এত কষ্ট কেনো মা হওয়ায়? কেনো..!

কেবিনে ঢুকলো মেসবাহ। চোখমুখ তার আতংকে নীল হয়ে রয়েছে। নতুন শিশু আসছে পৃথিবীতে। তবে তার আগমনে বুকের ভেতরটায় ভয় হচ্ছে। অজানা এক শঙ্কা গ্রাস করে ফেলছে নতুন প্রাণের আগমনী খুশি। তবে তার আগমনের প্রস্তুতি সম্পূর্ণ করা প্রয়োজন। যেনো কখনোই উল্লাসী ধরতে না পারে বাবা হিসেবে তার ব্যর্থতাগুলো..
-“আপনি বারবার কোথায় যান আমাকে ফেলে?”
উল্লাসীর কাঁপা গলার স্বর কানে আসতেই তার পাশে বসলো মেসবাহ। হাতের মুঠোয় তার হাত শক্ত করে চেপে ধরে বললো,
-“আর যাবো না। এই তো বসলাম।”
-“আমার কষ্ট হচ্ছে খুব।”
-“এখনি ঠিক হয়ে যাবে।”
-“যদি ঠিক না হয়? আমি যদি মারা যাই?”
কোমল স্বরে মেসবাহ জবাব দিল,
-“কিচ্ছু হবেনা।”
-“হবে.. আমার মনে হচ্ছে আমিও মায়ের মতো মারা যাবো। আপনি আমার বাবুটাকে দেখবেন তো?”
-“কিচ্ছু হবেনা ওসব। তুমি ভালো কিছু ভাবো। আমাদের বাবুর নাম ঠিক করেছিলে না? কী নাম যেনো ঠিক করেছিলে?”
-“ছেলে বাবু হলে উচ্ছ্বাস আর মেয়ে বাবু হলে মৈত্রী। আপনি কিন্তু আমায় কথা দিয়েছেন আপনি সুহার মতো আমার বাবুকে কষ্ট পেতে দেবেন না। আমার বাবুটাকে সবসময় আদর করবেন। আপনার কাজে বিরক্ত করলেও বকবেন না। একা রুমে কখনোই রাখবেন না।”
ধরা গলায় মেসবাহ বললো,
-“চুপ.. একদম চুপ।”
থামলো না উল্লাসী। ব্যাকুল সুরে সে বলতে লাগলো তার মনের ভেতরের জমানো কথাগুলো।
-“আপনি যদি আমার যায়গায় কাওকে আনতেই চান তাহলে আমার বাবুটাকে নানাজানের কাছে দিয়ে আসবেন। আমি জানি উনি সুহার মতো আমার বাবুটাকেও ভালোবাসবে।”
-“আর একবার এসমস্ত কথা বলবা তো আমি উঠে চলে যাবো।”
-“না আপনি যাবেন না। আপনি আমার পেটে হাত রাখুন। দেখুন আমার বাবুটা কীভাবে নড়ছে। শুনুন.. ওকে কিন্তু বকবেন না কখনোই। কখনোই বলবেন না তুই কেনো এত কষ্ট দিয়ে তোর মাকে মেরে ফেললি!”

অটির সামনে বসে অপেক্ষা করছে লিমন। অজানা এক ভয় তাকেও আচ্ছন্ন করে রেখেছে। ডাক্তার হবার সুবাদে তার অজানা নয় অপ্রাপ্ত বয়স্ক একটি মেয়ের মা হবার সময় ঠিক কতটুকু ঝুঁকির সম্মুখীন হতে হয়। তবুও সবটা জেনেশুনে অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনাকে মেনে নিয়েই মেসবাহ সবটা সামাল দিয়েছে। উল্লাসীর ছোটবড় সকল আবদার মিটিয়েছে। ধৈর্য ধরে নিজের সবটা দিয়ে সেবা করেছে অর্ধাঙ্গিনীর অন্তঃসত্ত্বার সময়টিতে৷ মেসবাহর এই ভালোবাসা, কষ্ট যেনো বিফলে না যায়! নয়তো জীবনের অর্থকেই হারিয়ে বসবে সে। চোখবুঁজে উপরওয়ালার নিকট প্রার্থনার মাঝপথে ইভানার আসা ফোনকল ব্যাঘাত ঘটালো তাতে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে কল রিসিভ করে লিমন বললো,
-“হ্যাঁ.. বল।”
-“কী অবস্থা ওখানের? উল্লাসীর কী অবস্থা?”
-“ওটিতে নিয়ে গিয়েছে কিছুক্ষণ হলো।”
-“আর মেসবাহ?”
-“ওর সাথেই আছে। ও তো আরেক নাছোড়বান্দা। উল্লাসীকে কোনোমতেই একা ছাড়বে না সে।”
-“যাক.. ভালোই হয়েছে৷ এতে উল্লাসীও সাহস পাবে।”
-“মোটেও না.. আরও তার বিপরীত হচ্ছে। মেসবাহকে কাছে পেয়ে উল্লাসীর চিৎকার চেচামেচি আরও বেড়েছে। এদিকে ব্যথাও উঠেছে অনেক্ক্ষণ যাবৎ। কিন্তু বাচ্চা আসছে না। উয়ার্ড সিচুয়েশন!”
আৎকে উঠে ইভানা বললো,
-“তারপর? কী ব্যবস্থা নিল?”
-“ডক্টর আরও কিছুক্ষণ ওয়েট করতে চাইলো। কিন্তু মেসবাহই লাস্টে ডিসিশন দিল সিজারের। উল্লাসীর কষ্ট দেখার ক্ষমতা নেইরে মেসবাহর। একবিন্দুও নেই..”
-“ভালোবাসলে কী এভাবেই বাসা উচিৎ না? তাছাড়া কম সময় হলো উল্লাসী সহ্য করছে পেইন। বাচ্চা মানুষ আর কতই বা নেবে!”
-“হুম..”
-“আমি কোনো কাজেই মন দিতে পারছি না। তুই একটু পরপর আমায় আপডেট দিস। রাখছি..”
ইভানা কল কেটে দিতেই আরও একটি দীর্ঘশ্বাস ফেললো লিমন। কিছু নীরবতা যদি অন্যের জীবনে আনন্দের সন্ধান এনে দেয় তাহলে ক্ষতি কী? থাকুক না কিছু নীরব ভালোবাসা মনের মনিকোঠায়। ফোন পকেটে রেখে অটির দিকে তাকাতেই মেসবাহকে বেরিয়ে আসতে দেখে ভ্রু কুঁচকে ফেললো লিমন। উঠে দাঁড়িয়ে সেদিকে এগোতেই মেসবাহ বললো,
-“পারছি নারে উল্লাসীকে ওই অবস্থায় দেখতে! কী কষ্ট! পারছি না আমি একদম।”
-“তুই এদিকে আয়.. এদিকে এসে বয়।”
লিমন হাত ধরে মেসবাহকে পাশে এনে বসাতেই লম্বা একটি নিঃশ্বাস ফেললো মেসবাহ। এতক্ষণ দম বন্ধ হয়ে আসছিল তার। নিজেকে অসহায় লাগছিল। বারবার চোখের সামনে ভেসে আসছিল অনার মৃত মুখের ছবি। উল্লাসীর অন্তঃসত্ত্বার খবর যখন তারা পেয়েছিল তখন উল্লাসীর সাড়ে তিনমাসের মত চলছিল। সেসময় তার শারীরিক কিছু পরিবর্তন ঘটলেও মানসিক পরিবর্তনটা চোখে পড়ছিল না। তবে ধীরেধীরে দিন বাড়তে লাগলো। শুরু হলো উল্লাসীর মুড সুইং। এই ভালো এই খারাপ। খাবার দাবার ঠিকঠাক মতো খেত না। অল্পস্বল্প যাই খেত গন্ধ গন্ধ বলে বমি করে ভাসিয়ে দিত। জেদ করতো, মাঝরাতে উঠে এটাসেটা খাবার আবদার করতো। তবে এনিয়ে কখনোই কিছু বলেনি সে উল্লাসীকে। বিরক্ত হলেও শান্ত থেকে বিষয়গুলো সামলিয়েছে। তবে রাতে যখন উল্লাসীকে বুকে আঁকড়ে ধরে ঘুমের চেষ্টা করেছে, তখন তার দেখা পায়নি। অজস্র ক্লান্তি, ভয় একসঙ্গে এসে চেপে ধরেছে তাকে। মানসিক ভাবে যন্ত্রণা দিয়েছে। ঘটনা বেশি একটা আগের নয়। উল্লাসীর যখন সাতমাস চলছিল। শারীরিক, মানসিক সবদিক থেকেই প্রচুর পরিবর্তন ঘটেছে উল্লাসীর মাঝে। রোগা স্বাস্থ্যের মেয়েটির পেট ফুলে ফেঁপে উঠছে। খাওয়াদাওয়া ঠিকঠাক ভাবে না করায় তার রোগা পাতলা শরীর আরও রোগা হয়েছে। ঠিকঠাক ঘুম না হবার কারণে চোখের নিচে কালি জমেছে। সেরাতেও ঘুম পায় না পায় না করেও রাত দু’টোর দিকে নানান ঝামেলা করে উল্লাসীকে ঘুম পাড়িয়ে নিজেও ঘুমের রাজ্যে পাড়ি জমিয়েছিল মেসবাহ। ডুব দিয়েছিল গভীর স্বপ্নের রাজ্যে। ঘন অন্ধকারময় অথচ চারপাশ থেকে আসছে আলোর ঝিলিক। বেশ বড়সড় একটি গাছের তলায় দোলনায় বসে দোল খাচ্ছে অনা। চোখেমুখে তার একরাশ অভিমান৷ কেনো সবাই তাকে হারিয়ে নীরব হয়ে পড়েছে? সে তো নিজের জগতে ভালো আছে। তাহলে তারা কেনো নেই? ও মেজোভাই, তোমরা নীরবতা ভেঙে ফেলো না! সদ্যজাত শিশুর মতো হয়ে ওঠো না সরব… আচমকা ঘুম ভেঙে গেল মেসবাহর উল্লাসীর ডাকে। চোখজোড়া প্রসস্থ করে সে উতলা মনে বললো,
-“অনা.. অনাকে দেখলাম।”
-“পাগল হয়েছেন? অনা আপাকে কিভাবে দেখবেন?”
উল্লাসীর কথায় ঘোর কাটলো মেসবাহর। উঠে বসে ঘনঘন কিছু নিঃশ্বাস ফেলে বললো,
-“উঠলে কখন তুমি?”
-“জানি না.. আমার ক্ষিধে পাচ্ছে।”
-“রাতে ঠিকমতো না খেলে এমনই হবে। তুমি বসো.. আমি ভাত নিয়ে আসি।”
-“না না.. ভাত খাবোনা। এত রাতে কেউ ভাত খায়?”
-“তাহলে কী খাবে? সেদিন রাতের মতো এখন আবার বলো না আইসক্রিম খাবো.. ঠান্ডার কারণে তোমার ওসব মানা।”
ঠোঁট বেঁকে উল্লাসী বললো,
-“আইসক্রিম বলবোও না। আমার কেক খেতে ইচ্ছে করছে।”
-“কেক? ঘরে কী আছে? থাকার কথা তো। দাঁড়াও খুঁজে দেখি।”
মেসবাহ উঠতে নিতেই তার হাত টেনে ধরলো উল্লাসী। ঠোঁটের কোণায় হাসি ফুটিয়ে বললো,
-“খুঁজতে হবে না। কেক নেই। সন্ধ্যায়ই আমি খেয়ে শেষ করে ফেলেছি।”
-“তো সেটা তখনই বলবে না? এখন এত রাতে আমি তাহলে কেক কোথায় পাবো? তিনটার উপরে বাজে।”
-“সেটা তো আমি জানিনা। আমি খাবো মানে খাবোই।”
-“তাহলে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করো। ফজরের আযানটা দিলে না হয় আমি কেকের ব্যবস্থা করছি।”
-“অসম্ভব! ততোক্ষণ আমি কী করে থাকবো। ক্ষুধা পেয়েছে বললাম না?”
-“অন্য কিছু খাও। বিস্কিট দেই? বা চকোলেট?”
-“না.. ওসবের গন্ধে আমার বমি পায়। আমার কেকই লাগবে।”
কপাল কুঁচকে তীক্ষ্ণ গলায় মেসবাহ বললো,
-“জেদ করো না উল্লাসী। এখন আমি কেক কোথায় পাবো?”
-“হ্যাঁ.. তা তো পাবেনই না! জানি তো। সব জানি। মুন্নি ভাবি আমাকে সব বলেছে। বউ প্রেগন্যান্ট হলে নাকি আর জামাইদের তাকে আর ভালোলাগেনা। মধু আছে না মধু? বউয়ের কাছে না পেয়ে তারা সেই মধু বাইরে খুঁজতে যায়।”
-“এই মুন্নি ভাবিই তোমায় পাকাচ্ছে। ছোট বাচ্চার মুখে এসব কী কথা হু? দেখি ছাড়ো এবার।”
-“কেনো? কই যাবেন?”
-“ইউটিউব ঘেটে চেষ্টা করে দেখি। বউয়ের জন্য কেক মেক করতে পারি কিনা!”

আচমকা লিমনের ডাকে অতীতের বেড়াজাল ছিঁড়ে বাইরে বেরিয়ে এল মেসবাহ। একরাশ হতাশা নিয়ে লিমনের দিকে চাইতেই পাশ থেকে শুনতে পেল আলাউদ্দিন শেখের আওয়াজ। শঙ্কিত গলায় সে বলছেন,
-“মেজো বৌমা কোনহানে? ঠিক আছে তো হে?”

বাস্তবতা বড়ই নির্মম। তবে অসুন্দর নয়। অনা পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে পরপারে চলে গেছে। রেখে গেছে আপনজনদের হাহাকার.. গভীর নীরবতা। তবে জীবন সৌন্দর্যে পরিপূর্ণ। দূর্বিষহ অতীত চলে যায় কিছু সুখকর ভবিষ্যৎ দেবার আশায়। একঘেয়ে জীবনের অবসান ঘটাতেই পৃথিবীতে চলে নানান সুখদুঃখের খেলা। এখেলায় কেউবা সময়ের স্রোতে হারিয়ে যায়, কেউবা নতুন করে আসে আশীর্বাদ হয়ে। আলাউদ্দিন শেখের পরিবারেও এসেছে নতুন প্রাণ। তার আগমন সকলের চোখে পানি এনে দিয়েছে। ছোট্ট এই প্রাণটার ভেতর যেনো স্বয়ং অনার বসবাস! চোখভর্তি জল নিয়ে নাতনিকে কোলে তুলে নিলেন আলাউদ্দিন শেখ। হাতপা অনবরত কাঁপছে তার। বুকের ভেতরটায় অদ্ভুত এক ভালোলাগায় ভরে উঠেছে। যেমনটা আজ থেকে বিশবছর আগে সদ্য জন্মানো অনাকে কোলে নিয়ে অনুভব হয়েছিল তার মনের ভেতরটায়। উপরওয়ালার কত সুন্দর লীলাখেলা!
-“ও দাদু.. তুমি একা কেনো আমার বোনকে কোলে নিয়ে আছো? আমাকেও দাও!”
মৌমির কথা শুনে কেঁদে ফেললো আলাউদ্দিন শেখ। বুকে আঁকড়ে ধরলো দুই নাতনিকে। চারিপাশর সকলের কোলাহল বলে দিচ্ছে তারা ঠিক কতটা খুশি। অনার মৃত্যুর পর যে ঘোর নীরবতা নেমে এসেছিল তাদের জীবনে কালের স্রোতে সদ্যজাত এই প্রাণ তা সরবে পরিবর্তন করে দিয়েছে। সত্যিই জীবন সুন্দর.. বড়ই সুন্দর!

রাত অনেক হয়েছে। হাসপাতালে মৈত্রীকে গ্রাম থেকে দেখতে আসা সকলে মেসবাহর বাসায় চলে গিয়েছে। উল্লাসীর পাশে জ্যোতির থাকবার ইচ্ছে থাকলেও মৌমির যন্ত্রণায় তা পেরে না উঠে সেও গেছে সকলের সাথে। শুধু হাসপাতালে রয়ে গেছে মুন্নি সরকার এবং মেসবাহ। রাতের আলোবাতাস খেতে মুন্নি সরকার কেবিন ছেড়ে বেরিয়ে যেতেই মেসবাহ এসে বসেছে উল্লাসীর কাছে। এনেস্থিসিয়ার ঘোর ধীরেধীরে কাটছে উল্লাসীর। বাবুকে বারবার দেখতে চাইছে। তার কথামতো বাবুকে মুখের সামনে ধরলেই তার পুরো মুখে চুমু খাচ্ছে। মাঝেমাঝে কোমড়ের ব্যথার নড়েচড়ে উঠার চেষ্টা করছে। তার ব্যথাভর্তি কোমল মুখে আলতো করে ঠোঁট ছুঁয়ে দিল মেসবাহ। নীচু গলায় বললো,
-“খুব কষ্ট হচ্ছে?”
-“উহু..”
-“বাবুকে কোলে নিতে ইচ্ছে করছে?”
-“হু..”
-“কালই নিতে পারবে ইনশাআল্লাহ।”
-“বাবুকে দেখবো।”
-“একটু আগেই তো দেখলে!”
-“আবারও দেখবো..”
উল্লাসীর কথায় মৈত্রীকে কোলে তুললো মেসবাহ। অন্যরকম এক ভালোলাগা অনুভব হচ্ছে তার বুকের ভেতরটায়। সদ্যোজাত এই প্রাণের দিকে চাইতেই বুকের ভেতরটায় তৃপ্তি অনুভব করছে। নতুন উদ্যমে আবারও জীবনকে উপভোগ করতে ইচ্ছে করছে। দীর্ঘদিনের শোক, মানসিক যন্ত্রণা অবশেষে বোধহয় কাটিয়ে উঠতে পেরেছে সে! আনন্দ লাগছে তার.. উৎফুল্লতায় ছেয়ে যাচ্ছে মনের ভেতরটা। স্বস্তির কিছু নিঃশ্বাস ফেলে উল্লাসীর দিকে মৈত্রীকে বাড়িয়ে ধরলো মেসবাহ। প্রফুল্লচিত্তে খানিকক্ষণ মা-মেয়ের ভালোবাসার গভীরতা দেখার পর ঠোঁটজোড়া দুজনের মাথায় ঠেকিয়ে ফিসফিসিয়ে বললো,
-“কলিজা বের হয়ে গিয়েছিল আমার। বলেছিলাম বাচ্চা হবার সাথেসাথেই তোমার মতো বিচ্ছুপনা শিখে যাবে.. কিন্তু মেয়ে তো আমার আরও এক ডিগ্রি উপরে! আসার আগেই তার বিচ্ছুপনা দেখিয়ে আমার জান পুরো বের করে দিয়েছিল…”
-“একটু জান বেরুলে কিছুই হয়না..”
হেসে উঠলো মেসবাহ। উল্লাসীর দিকে খানিকটা ঝুকে একহাতে তার কপালের চুলগুলো সরিয়ে দিতেই পাশ থেকে এল মুন্নি সরকারের আওয়াজ।
-“ভুল সময় এসে পড়লাম মনে হচ্ছে…”
-“আরে না না.. আসুন।”
-“উহু.. দাও। তোমার দুঃসম্পর্কের বাচ্চাটাকে আমায় দিয়ে দাও। আমি আরেকবার চক্কর কেটে আসি.. ততক্ষণে না হয় তোমার দুঃসম্পর্কের বউকে নিয়ে তুমি আরেকটু ভালোবাসাবাসি সেরে ফেলো।”
খলখল করে হেসে উঠে মুন্নি সরকার মৈত্রীকে কোলে চাপিয়ে বেরিয়ে যেতেই ঠোঁট চেপে হাসলো মেসবাহ। এই সেই উল্লাসী.. যাকে একসময় মেনে নিতে কষ্ট হলেও আজ একদন্ডের জন্য উল্লাসীহীন নিজেকে ভাবতে পারেনা সে। এই বুঝি ভালোবাসা? কারণ যাকে মনপ্রাণ দিয়ে ভালোবাসা যায় তাকে একমুহূর্তের জন্যও চোখের আড়াল করা যায়না। সেও পারবেনা উল্লাসীকে চোখের আড়াল করতে। পারবেনা উল্লাসীকে ছাড়া দু’পা হাটতে। শিশির ভেজা সকালে, রৌদ্রোজ্জ্বল দুপুরে, ঘন আঁধারময় রাতেও উল্লাসীর হাতে হাত রেখে পায়ে পায়ে তাল মিলিয়ে চলবে সে বাকিটা পথ।

(সমাপ্ত)

1 COMMENT

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here