নীরবতা পর্ব_৭_৮_৯_১০
#নাইমা_জাহান_রিতু
-“তুমি শাড়ি বদলে কামিজ পরে নাও। আমি এতক্ষণ তোমার বাসায় পরার জন্য আরও কিছু কামিজ দেখছি।”
উল্লাসীকে ট্রায়াল রুম দেখিয়ে আরও কিছু সালোয়ার কামিজ তার জন্য নিল মেসবাহ। তারপর ধীরেসুস্থে এগুলো ট্রায়াল রুমের দিকে। স্টেশন থেকে সরাসরি শপিংমলে এসেছে তারা। উল্লাসী যে সাজসজ্জায় ছিল তা নিয়ে বাসায় ঢুকলেই সকলের মনে সন্দেহ ঢুকে যেত। তাই কোনো উপায় না পেয়ে সরাসরি শপিংমলে আসার সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে তাকে।
-“শুনছেন? আমার হয়েছে।”
উল্লাসীর ডাকে পেছন ফিরে তাকে একনজর দেখলো মেসবাহ। তারপর শান্ত গলায় বললো,
-“কানের দুল খোলো.. সাথে গলার হারটাও।”
কোনো প্রশ্ন না করে কাঁপা হাতে উল্লাসী স্বর্ণের হার এবং দুল খুলে বাড়িয়ে ধরলো মেসবাহর দিকে। মেসবাহ সেগুলো নিয়ে একটি শপিং ব্যাগে ঢুকিয়ে বললো,
-“হাতের বালা দুটো খোলো।”
বাঁধ সাধলো উল্লাসী। বিয়ের আগে এই বালা তার হাতে পরিয়ে দেবার সময় ছোটমা বলে দিয়েছে, বিয়ের পর হাত কখনোই খালি রাখবি না। এতে স্বামীর অকল্যাণ হয়। আর একজন আদর্শ স্ত্রী হিসেবে স্বামীর অকল্যাণ চাওয়া কোনো স্ত্রীর কাম্য নয়। একদন্ড ভেবে দু’কদম পিছিয়ে উল্লাসী বললো,
-“আপনার অকল্যাণ হবে।”
বিস্ময়ে চোখমুখ কুঁচকে মেসবাহ বললো,
-“লেইম কথা রেখে বালাজোড়া খুলে ফেলো।”
-“ছোটমা বারন করেছে। আপনার অকল্যাণ হবে।”
-“আমার কল্যাণ অকল্যাণ নিয়ে তোমার ভাবতে হবে না। তুমি আপাতত আমার কথা মতো কাজ করো।”
-“উহু..”
মেজাজ চওড়া হয়ে এল মেসবাহর। কড়া গলায় সে বললো,
-“সিনক্রিয়েট করো না। যা বলছি দ্রুত করো।”
ঢোক গিলে আরও কয়েক কদম পেছালো উল্লাসী। এই লোককে কোনোভাবেই বুঝতে পারে না সে। মাঝেমাঝে এত মনোরম ভাষায় কথা বলে আবার মাঝেমাঝে প্রচুর রাগ দেখায়। একজন মানুষের দুই রূপ কীভাবে হয়?
কথা বাড়ালো না মেসবাহ। দ্রুত পায়ে উল্লাসীর দিকে এগিয়ে এসে সজোরে চেপে ধরলো তার হাত। সময় নিয়ে বালাজোড়া খুলে তা শপিং ব্যাগে ঢুকিয়ে চারিপাশটায় চোখ বুলিয়ে নিল। লোকজনের আনাগোনা এদিকে খুব একটা না থাকলেও দু’একজনের উপস্থিতি রয়েছে। যারা সকলেই প্রশ্নবিদ্ধ চোখে তাকিয়ে রয়েছে তাদের দিকে। সেদিক থেকে নজর সরিয়ে সকলের দৃষ্টি উপেক্ষা করেই উল্লাসীর হাত ধরলো মেসবাহ। তারপর তাকে টেনে দ্রুত বের হয়ে এল শপিংমল ছেড়ে। শহরে পা ফেলতে না ফেলতেই যে মেয়েকে নিয়ে একদফা ঝামেলায় পড়তে পড়তে বেঁচে গেছে, সেই মেয়েকে নিয়েই পুরো জীবন কাটাবে কী করে সে? জবাবে বুকচিরে একটি দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল মেসবাহর। খুব দ্রুত একটি রিকশা ডেকে তাতে উঠে বসে উল্লাসীর দিকে দৃষ্টি দিতেই তার নজরে এলো মেয়েটির কান্নামাখা মুখ। নিরবে কাঁদছে সে। অঝোরে ধারায় যা টপাটপ গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে…
বাড়ির আনাচে-কানাচে তন্নতন্ন করে খুঁজেও মুবিনের দেখা না পেয়ে অনার ঘরে এল চৈতালি। হাতে থাকা একটি বাটি টেবিলে রেখে এগিয়ে এল অনার কাছে। চোখমুখ কুঁচকে বললো,
-“তুই পড়ছিস?”
চমকে উঠে বই বন্ধ করে উঠে বসলো অনা। আতংকে তার চোখমুখ নীল হয়ে উঠেছে। থমথমে গলায় সে বললো,
-“কী সমস্যা তোর? ঘরে নক করে ঢুকবি না?”
-“নক করে কেন ঢুকবো? তাছাড়া আমাকে দেখেই বা তুই এত ভয় পেলি কেন!”
কথার মোড় ঘোরাতে অনা বললো,
-“কোথায় ভয় পেলাম? ঠিকই তো আছি আমি। কী এনেছিস তুই ওই বাটির ভেতরে? দেখি…”
-“নারিকেলের নাড়ু…”
-“তুই জানিস না আমি নারিকেল খাই না? আচ্ছা.. এনেছিস যখন থাক। ছোটভাইয়ের খুব পছন্দ নারিকেলের নাড়ু।”
-“একদমই না.. তুই ওনাকে মোটেও দিবি না। যে ছেলে আমার নামই মনে রাখতে পারে না তাকে আর যাই হোক নিজ হাতে নারিকেলের নাড়ু বানিয়ে খাওয়াবো না আমি।”
উঠে দাঁড়ালো অনা। টেবিলের দিকে এগুতে এগুতে বললো,
-“বললেই হলো! তুই এটা আমায় দিয়েছিস। এখন আমি যাকে খুশি তাকে দেব।”
-“তুই কিন্তু বড্ড পাকামি করছিস! তা কী দেখছিলি ওই বইয়ের ভেতর? পড়ছিলি না সেটা তো নিশ্চিত।”
বলেই চৈতালি হাত বাড়ালো বইয়ের দিকে। হঠাৎ চৈতালির এমন কাজে দৌড়ে তার দিকে এগিয়ে এল অনা। বইটি একপাশে চেপে ধরে চেচিয়ে বললো,
-“অন্যের ব্যক্তিগত জিনিসে এভাবে হাত দিতে নেই। চৈতালি.. ছাড় বলছি।”
বইয়ের অপরপাশ ধরে নিজের দিকে টেনে চৈতালি বললো,
-“তোর আবার ব্যক্তিগত জিনিসও আছে? দেখি ছাড়। কি আছে এতে দেখতে দে আমায়।”
-“ভালো হবে না একদম চৈতালি।”
-“সব কিছুতেই ভালো কেনো হতে হবে?”
-“ছাড় বলছি..”
-“তুই ছাড়।”
-“উফফ.. ছাড় না!”
এক ধাক্কায় চৈতালিকে বিছানায় ফেলে বই নিয়ে দৌড়ে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়লো অনা। বুকের ভেতরটা এখনো অনবরত কেঁপে যাচ্ছে তার। চৈতালির হাত থেকে আজ নিস্তার নেই। যতক্ষণ এবাড়িতে থাকবে ততক্ষণ প্রশ্ন করতে করতে একদম জ্বালিয়ে মারবে তাকে।
রাতের খাবার কিনে ফুটপাত ধরে এগুচ্ছিল মেসবাহ। হঠাৎ ফোনে লিমনের কল আসায় তাকে সবটা খুলে বললো সে। সব শুনে লিমন ফোনের ওপাশ থেকে বললো,
-“শেষমেশ বউকে বোন? বড় অন্যায়!”
-“এসব রাখ…”
-“রাখলাম। তবে আমার মনে হচ্ছে কাজটা তুই ঠিক করিসনি।”
-“তাহলে কী করতাম আমি? তুইই বল।”
-“যেটা সত্যি সেটাই বলতি।”
-“আর আমার মানসম্মান?”
-“কিছুদিন পর যখন সবাই সবটা জানতে পারবে, তখন তোর এই মানসম্মান কোথায় যাবে সে নিয়ে ভেবেছিস? তাছাড়া তুই একা বাসায় দুঃসম্পর্কের এক বোনকে এনে তুলেছিস। এ নিয়ে সমালোচনা হবে না মনে করেছিস?”
-“হ্যাঁ, এনিয়ে সমালোচনা হবে না। উল্লাসী বাচ্চা একটা মেয়ে। আমাকে এবং ওকে এক করে এসব নিয়ে চিন্তাভাবনা করার মত বয়স এখনো হয়নি ওর। তাছাড়া ওর ক্লাস, ওর চালচলন, কথাবার্তা দেখেও মানুষ তেমন কিছু ভেবে সেসব রটানোর সুযোগ পাবে না।”
-“সকলে তো তোর মতো করে নাও ভাবতে পারে!”
লিমনের কথা একদন্ড ভেবে চিন্তিত মুখে মেসবাহ বললো,
-“পজিটিভ ভাব। নেগেটিভ কেনো ভাবছিস?”
-“কারণ আমাদের সোসাইটি নেগেটিভের উপরই চলে। দুটো দিন শুধু যেতে দে, দেখবি তোর পাশের ফ্ল্যাটের ভুড়িওয়ালা ভাবিই ইনভেস্টিগেশন শুরু করে দিয়েছে!”
-“বাজে কথা রাখ.. আচ্ছা, আমি এখন রাখছি। কাল তাহলে দেখা হচ্ছে।”
কল কেঁটে সদর দরজার লক খুলে ফ্ল্যাটে ঢুকলো মেসবাহ। হাতে থাকা খাবারের প্যাকেট টেবিলে রেখে ডাকতে শুরু করলো উল্লাসীকে।
মেসবাহর গলার আওয়াজ শোনামাত্র ভয়ে কোঁকড়ানো শরীর নিমেষেই শীতল হয়ে উঠোলো উল্লাসীর। মেঝে থেকে উঠে দ্রুত পায়ে ডাইনিং রুমের দিকে এগিয়ে এসে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো মেসবাহর সম্মুখে।
-“খাবার খেয়ে নাও। বসো।”
মেসবাহর কথায় চেয়ার টেনে হালকা সরাতেই মেসবাহ থামালো উল্লাসীকে। নরম গলায় বললো,
-“শব্দ করে চেয়ার টানতে হয় না। নিচের ফ্লোরেও মানুষ থাকে। শব্দের কারণে তাদের সমস্যা হয়। ওয়েট, আমি দেখিয়ে দিচ্ছি তোমায়।”
মেসবাহ চেয়ার টেনে দেখিয়ে দিতেই উল্লাসী বসলো তাতে। শান্ত দৃষ্টিতে মেসবাহর দিকে তাকিয়ে বললো,
-“এই বাসাটা কয় তলার?”
-“বারো। আর আমাদের ফ্লোর আটে।”
-“অহ..”
-“হুম… আর শোনো, তুমি কখনোই ফ্ল্যাট ছেড়ে বাইরে বেরুবে না। তাছাড়া শুধুশুধু বেরুবেই বা কেনো? তোমার কী বাইরে কোনো কাজ আছে?”
মাথা নেড়ে উল্লাসী নেতিবাচক জবাব দিতেই মেসবাহ আবারও বললো,
-“আর আমি সকালে বেরিয়ে যাবার পর কেউ কলিংবেল বাজালেও দরজা খুলবে না। পাশের ফ্ল্যাটের এক ভাবি আছে। হয়তো আমি যাবার পর বা বিকেলে গল্পগুজব করতে আসতে পারে। তবে হাজার কলিংবেল বাজালেও তুমি দরজা খুলবে না। তারপর যা বলার আমি বলে ম্যানেজ করবো। ঠিকাছে?”
-“জ্বি..”
-“গুড.. নাও। খাওয়া শুরু করো।”
খাবারের কারবার চুকিয়ে উল্লাসীকে ঘর দেখিয়ে দিয়ে ড্রইং রুমে এল মেসবাহ। টেলিভিশন ছেড়ে সোফায় শরীর মেলে দিল সে। অপরদিকে খানিকক্ষণ চুপচাপ শুয়ে থাকার পর টেলিভিশনের শব্দ কানে আসতেই উঠে বসলো উল্লাসী। কয়েক দন্ড ভেবে বিছানা ছেড়ে নেমে সে ধীর পায়ে এগুলো টেলিভিশনের ঘরের দিকে। তাদের বাড়িতে টেলিভিশন না থাকলেও পাশের বাড়িতে একটি টেলিভিশন রয়েছে। ছোটমার অগোচরে প্রায়ই সুহাকে নিয়ে সেই টেলিভিশন দেখতে যেতো সে। তবে সে টেলিভিশন এত বড় নয়। এত চিকনও নয়। তার শ্বশুর বাড়িতেও যে টেলিভিশন রয়েছে সেটিও দেখতে বেশ মোটাতাজা।
-“কী ব্যপার? ঘুমোও নি?”
পাশ থেকে মেসবাহর কথায় তার দিকে তাকালো উল্লাসী। হালকা মাথা নেড়ে সে বললো,
-“উহু.. ঘুম আসছে না।”
-“নতুন জায়গা তো। একটু সময় লাগবে। বসো, বসে টিভি দেখো।”
উল্লাসীকে মেঝের মাঝবরাবর বসতে দেখে উঠে বসলো মেসবাহ। শান্ত গলায় বললো,
-“উঠে সোফায় বসো।”
মেসবাহর আদেশে সোফায় বসলো উল্লাসী। অপলক দৃষ্টিতে টেলিভিশনের দিকে তাকিয়ে রইলো সে। আজ তার পাশে সুহা থাকলে সে প্রচুর খুশি হতো। কিছু বলতে না পারলেও টেলিভিশন দেখার সময় তার মুখের উজ্জ্বলতাই বলে দেয় ঠিক কতটা আনন্দিত হয় সে তা দেখে।
-“ব্যথা পেয়েছিলে চুড়ি খোলবার সময়?”
টেলিভিশনের দিক থেকে দৃষ্টি সরিয়ে মেসবাহর দিকে দিল উল্লাসী। বললো,
-“না..”
-“তাহলে কাঁদলে কেনো?”
-“জানি না..”
-“ঠিকাছে। এই নাও রিমোট। নিজের ইচ্ছেমতো চ্যানেল বদলিয়ে নাও। আমি ঘুমোতে যাচ্ছি।”
খুশি মনে রিমোট হাতে নিল উল্লাসী। তবে পরমুহূর্তেই নিজেকে একা আবিষ্কার করে আঁতকে উঠলো তার মন। দ্রুত সে এগুলো ঘরের দিকে। তবে সে ঘরে মেসবাহর উপস্তিতি না পেয়ে ভীত গলায় সে ডেকে উঠলো মেসবাহকে।
ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে মাত্রই ঘুমোনোর জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলো মেসবাহ। আচমকা পাশের রুম থেকে মেয়েলি গলায় কান্নার আওয়াজ ভেসে এল তার কানে। উল্লাসী কাঁদছে? কিন্তু কেনো? সে তো খুশিমনে বসে টেলিভিশন দেখছিল! ভ্রু কুঁচকে পাশের ঘরের দিকে এগুলো মেসবাহ।
-“কী হয়েছে উল্লাসী? কাঁদছো কেনো?”
চোখ উঁচিয়ে মেসবাহকে দেখামাত্র দৌড়ে তার দিকে এগুলো উল্লাসী। দু’হাতে শক্ত করে তাকে জড়িয়ে ধরে ফোঁপাতে শুরু করলো সে।
নির্বিকারভাবে খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পর মুখ খুললো মেসবাহ। নিজের বাহুডোর থেকে উল্লাসীকে ছাড়িয়ে সে বললো,
-“আমি কোথাও যাইনি। পাশের রুমেই ছিলাম।”
-“মিথ্যা কেনো বলছেন?”
-“মিথ্যা কেনো বলবো! আমি ওঘরে ঘুমানোর প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম।”
-“আপনি ওঘরে ঘুমোবেন?”
-“হ্যাঁ..”
-“তাহলে আমিও ওঘরে ঘুমোবো। একা আমি এঘরে থাকবো না।”
-“ভয়ের কিছু নেই উল্লাসী। ঘর থাকতে তুমি শুধুশুধু নিচে শোবে কেনো? তুমি এঘরেই থাকবে।”
-“তাহলে আপনিও এঘরেই থাকবেন।”
উল্লাসীর শরীরের থরথরিয়ে কাঁপুনিই বলে দিচ্ছে ঠিক কতটা ভয় পেয়েছে সে। তবে তাই বলে তার অদ্ভুত চাওয়া তো মেনে নেয়া যায় না! একদন্ড ভেবে গলা খানিকটা গম্ভীর করে মেসবাহ বললো,
-“আমি আমার ঘরেই থাকবো। এবং তুমি এঘরে থাকবে। এনিয়ে আর কোনো কথা শুনতে চাইছি না।”
মেঝেতে বসে পড়লো উল্লাসী। কাঁপা হাতে মেসবাহর দু’পা আঁকড়ে ধরে সে বললো,
-“আমি একা কখনোই থাকিনি। নতুন এই বাসায় একা এঘরে থাকলে আজ রাতেই আমি মরে যাবো। ওঘরে থাকিনা একটু! আমি নীরবে নিচে শুয়ে থাকবো। সুহার কসম…”
(চলবে)
#নীরবতা
#নাইমা_জাহান_রিতু
#পর্ব_৮
ঘড়ির কাটায় রাত ১টা। চারিদিকে বিরাজ করছে সুনসান নীরবতা। মেঘে আচ্ছন্ন আকাশে চাঁদের কণাটা আবছা হয়ে উঠেছে। সেদিকে তাকিয়েই আরেকটি সিগারেট ধরালো মেসবাহ। বাড়িতে যাবার কারণে বেশ কিছুদিন যাবৎ সিগারেটের স্বাদ নিতে পারেনি সে। বাবার সামনে সিগারেট হাতে দাঁড়ানোর সাহস তার নেই। দীর্ঘশ্বাস ফেলে সিগারেট টেনে নাক মুখ দিয়ে ধোঁয়া ছেড়ে নির্ঘুম রাতের নিস্তব্ধতা কাটিয়ে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো মেসবাহ। পায়চারী করতে শুরু করলো ব্যালকনিজুড়ে।
আজ কঠিন একটি সত্যর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে সে হাপিয়ে উঠেছে। আটাশ বছরের এই জীবনকে অনর্থক ঝামেলা লাগছে। অস্থির লাগছে বাচ্চা একটি মেয়ের পাশাপাশি চলে… চিন্তার জগতে বিচরণ করতে করতেই চোখজোড়া লেগে এসেছিল মেসবাহর। তবে পাশ থেকে আসা মেয়েলী স্বরের কাকুতিতে ঘুম ভেঙে গেল তার। ঝটপট চেয়ার ছেড়ে উঠে ঘরে ঢুকতেই ড্রিমলাইটের ঝাপসা আলোয় তার নজরে এল উল্লাসীর নিষ্পাপ মুখ। গুটিসুটি মেরে মেঝেতে শুয়ে ছটফটিয়ে যাচ্ছে সে। মেয়েটির অসহায়ত্বর কাছে হেরে আজ তাকে নিজের ঘরে থাকার অনুমতি দিয়েছে মেসবাহ। যদিওবা ঘর ফাঁকা পরে থাকতে মেয়েটিকে নিচে শোয়ানোর বিন্দুমাত্র ইচ্ছে তার ছিল না। তবে ব্যাকুল স্বরে উল্লাসীর আকুতি মিনতি বুকের ভেতরটায় কাঁটার মতো বিঁধছিল তার। তাই কোনো উপায় না পেয়ে নিজের ঘরে নিচে বিছানা করে শোবার যোগাড়যন্ত্র করে দিয়েছে সে। কিন্তু হঠাৎ উল্লাসী এভাবে ছটফট করছে কেন? ধীর গলায় উল্লাসীকে কয়েকবার ডাকলো মেসবাহ। তবে অপরপাশ থেকে তেমন সাড়া না পেয়ে তার কপালে হাত রাখলো সে। যা ভেবেছিল সেটিই। মেয়েটির গা গরম হয়ে উঠেছে। তাকে কোথাও খুঁজে না পেয়ে হয়তো খুব বেশিই ভয় পেয়ে গিয়েছিল উল্লাসী। যার ফলে গা কাঁপুনি দিয়ে জ্বর বাধিয়ে ফেলেছে সে।
জ্বর মেপে দেখে ঔষধ সহ এক গ্লাস পানি এনে সাইড টেবিলে রাখলো মেসবাহ। তারপর এসে আবারও উল্লাসীর পাশে বসে তাকে কয়েকবার জোর গলায় ডাকতেই বিস্ময়ে চোখমুখ কুঁচকে উঠে বসলো উল্লাসী। কিছুসময়ের জ্বরেই ফর্সা মুখ তার লাল টকটকে হবার উপক্রম হয়েছে। চোখ দুটিও রক্তের কুন্ডলী পাঁকিয়ে রক্তলাল বর্ণ ধারণ করেছে। ভয়ংকর সেই চোখের দিকে একনজর তাকিয়ে চোখ সরিয়ে নিল মেসবাহ। নরম গলায় বললো,
-“শীত করছে?”
-“করছে..”
-“বিছানায় উঠে শোও।”
-“তাহলে আপনি কোথায় শোবেন?”
সে কথার জবাব না দিয়ে হাত ধরে উল্লাসীকে উঠালো মেসবাহ। তারপর তার দিকে ঔষধ এবং পানির গ্লাস বাড়িয়ে দিয়ে বললো,
-“খেয়ে নাও…”
-“আপনি এঘর ছেড়ে কোথাও যাবেন না তো?”
-“না..”
-“সত্যিই?”
-“হ্যাঁ..”
-“কসম কাটুন।”
-“কাটলাম..”
-“এভাবে না। ভালো করে কাটুন।”
ছোট্ট একটি নিঃশ্বাস ফেলে মেসবাহ ক্ষীণ স্বরে বললো,
-“তুমি শুয়ে পড়ো উল্লাসী।”
-“আচ্ছা.. তবে আপনি কিন্তু এঘরে আমাকে একা ফেলে কোথাও যাবেন না।”
-“ঠিকাছে, যাবো না।”
কাথা গায়ে চাপিয়ে উল্লাসী শুয়ে পড়তেই চেয়ার টেনে স্টাডি টেবিলে এসে বসলো মেসবাহ। তারপর চার্লস ডিকেন্সের ডেভিড কপারফিল্ড বইটি খুলে তাতে মনোযোগ দিল।
শরীরের উষ্ণতা কাটিয়ে বিছানা ছেড়ে উঠে চারিপাশে চোখ বুলালো উল্লাসী। তবে ঘরে কোথাও মেসবাহর দেখা না পেয়ে ধীর পায়ে সে এগুলো পাশের ঘরের দিকে। ঘুমন্ত মেসবাহকে এক পলক দেখে আবারও সে ফিরে এল ঘরে। ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে খানিক্ষন শহুরে সকালের সৌন্দর্য উপভোগ করলো। বেশ ফুরফুরে লাগছে এখন তার শরীরটা। কিছুক্ষণ আগের ম্যাজমেজে ভাবটাও কেটে গেছে। লম্বা কিছু দম ছেড়ে ঘরে ফিরে গতকাল বিকেলের কেনা কিছু সালোয়ার কামিজের মাঝে একটি উঠিয়ে সে এগুলো গোসলের জন্য।
পাউরুটিতে জেলী মাখিয়ে দুটো প্লেটে রাখলো মেসবাহ। তারপর উল্লাসীর দিকে তাকিয়ে বললো,
-“এখন কী একটু ভালো লাগছে?”
মাথা নেড়ে সম্মতি জানালো উল্লাসী। সেদিকে তাকিয়ে মেসবাহ বললো,
-“এত সকালে গোসল করেছো কেনো?”
-“বিয়ের পর সকালে গোসল করতে হয় বলে।”
উল্লাসীর এমন উত্তরে ধাক্কা খেলেও নিজেকে সামলে নিল মেসবাহ। চোখেমুখে একরাশ অস্বস্তি ফুটিয়ে বললো,
-“আর করবে না। এসবের কোনো দরকার নেই।”
-“কিন্তু আপনার আম্মা যে বলে দিয়েছেন! প্রতি সকালে গোসল করে নাপাক শরীরকে পাক পবিত্র করতে।”
-“আম্মা বলে দিয়েছেন তো গ্রামে গেলে এসব করবা। এখানে যতদিন আছো প্রতি সকালে গোছলের কোনো দরকার নেই।”
আবারও মাথা নেড়ে সম্মতি জানিয়ে পাউরুটিতে হাত দিল উল্লাসী। অধীর আগ্রহে মেসবাহকে দেখে তাকে অনুসরণ করে পাউরুটিতে কামড় বসালো সে।
-“আপনি কাল আমাকে একা ঘরে রেখে পাশের ঘরে এসে ঘুমিয়েছিলেন.. তাই না?”
প্লেট থেকে নজর সরিয়ে উল্লাসীর দিকে দিল মেসবাহ। ঠান্ডা গলায় বললো,
-“উহু.. সারা রাতই ওঘরে ছিলাম। ভোরের দিকে এসে এঘরে শুয়েছি।”
-“অহ..”
-“সব ভয় তো তোমার রাতে। দিনে তো কোনো ভয় নেই। নাকি আছে?”
-“জানি না..”
-“জানতে হবে। আর তোমাকে তা জানাতেই আমি এখন কিছুক্ষণের জন্য বের হবো।”
বুকটা ছ্যাত করে উঠলো উল্লাসীর। ঢোক গিলে সে বললো,
-“কোথায় যাবেন?”
-“এক বন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে। বেশিক্ষণ না এই ধরো এক’দু ঘন্টার মাঝেই ফিরবো। কোনো ভয় নেই। নিজের ইচ্ছেমতো তুমি এটুকু সময় কাটাও।”
চোখমুখ ছোট হয়ে এল উল্লাসীর। ব্যথিত গলায় সে বললো,
-“আচ্ছা…”
চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বেসিনের দিকে এগুতে এগুতে মেসবাহ বললো,
-“দুপুরের রান্নাটা কী তুমিই করবে? নাকি আমি আসার পথে খাবার নিয়ে আসবো?”
-“আমিই করবো..”
-“ঠিকাছে। তবে আমি আসার পর তুমি রান্না শুরু করবে। নয়তো আবার হাত পা পুড়িয়ে বসবে!”
লিমনে সঙ্গে দেখা করে বাসায় ফিরতে ফিরতে বেশ দেরি হলো মেসবাহর। উল্লাসীর জন্য বেশ চিন্তা হচ্ছে তার। মেয়েটি আবার ভয়টয় পেল না তো? সকল ভাবনা একপাশে রেখে কয়েকবার কলিংবেল টিপলো মেসবাহ। তবে ওপাশ থেকে উল্লাসীর সাড়া না পেয়ে চাবি দিয়ে দরজা খুলে ভেতরে প্রবেশ করলো সে। হাতে থাকা ফলভর্তি পলিথিন ব্যাগ ডাইনিং টেবিলে রেখে উল্লাসীর নাম নিতে নিতে সে এগুলো ঘরের দিকে।
মেসবাহর জন্য অপেক্ষা করতে করতে ঘুমের দেশে পাড়ি জমিয়ে ছিল উল্লাসী। তবে বেশি একটা সময় টিকতে পারলো না সে ঘুমের সেই রাজ্যে। বেশ ঠান্ডা কিছুর উপস্থিতি কপালে অনুভব করতেই ঘুমভাবটা কেঁটে গেল তার। আতংকে হুড়মুড়িয়ে উঠে বসে কয়েক কদম পিছিয়ে গেল উল্লাসী। তবে পরমুহূর্তেই মেসবাহকে দেখামাত্র আত্মায় পানি ফিরে এল তার। বুকে থুতু দিয়ে সে বললো,
-“না, জ্বর নেই।”
-“ভয় পেয়েছো?”
-“হুম…”
চিন্তিত মনে শার্টের বোতাম খুলতে খুলতে মেসবাহ বললো,
-“আমি হসপিটালে যাওয়া শুরু করলে তুমি কিভাবে সময় কাটাবে তা ভাবাচ্ছে আমাকে। এজন্যই তোমায় আনতে চাইনি। আব্বা যে কোনো প্রতিটা জিনিসে জোরাজুরি করে!”
কি বলবে ভেবে পেল না উল্লাসী। নীরবে খানিক সময় সেভাবেই কাটানোর পর বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়াতেই পাশ থেকে মেসবাহ বললো,
-“তুমি কিচেনে যাও। আমি জামাকাপড় ছেড়ে আসছি।”
চুলো জ্বালিয়ে উল্লাসীকে একেএকে সব দেখিয়ে দিল মেসবাহ। তারপর বাড়ি থেকে আনা গরুর মাংস ফ্রিজ থেকে বের করে তা পানিতে ভিজিয়ে বললো,
-“বরফ ছাড়লে ভালোভাবে ধুয়ে তারপর রাঁধবে।”
-“আপনি রান্না জানেন?”
-“তেমন জানি না.. তবে চলে। ভাত, ডিম ভাজি, আলু ভর্তা এসব আর কি!”
-“আর মাছ মাংস?”
-“তেমন একটা খাই না। কখনো খেতে ইচ্ছে হলে বাইরে থেকে আনিয়ে নেই।”
বলেই রান্নাঘর ছেড়ে বেরিয়ে ডাইনিংয়ে এসে চেয়ারে বসলো মেসবাহ। মেয়েটিকে একা রেখে পুরোটা দিন হাসপাতালে কি করে কাটাবে সে, যেখানে ঘন্টা তিনেকের জন্য তাকে ফেলে বাইরে গেলেই মেয়েটি ভয়ে দিশেহারা হয়ে পড়ে! অবশ্য গ্রামের বাচ্চা একটি মেয়ের পক্ষে অচেনা এক জায়গায় এসে একা একটি ফ্ল্যাটে সময় কাটানো বেশ কঠিনও। তাহলে এখন কী উপায়? মেয়েটির জন্য কী এখন চাকরি বাদ দিয়ে ঘরে বসতে হবে তার! হঠাৎ দরজায় বেজে উঠা কলিংবেলের শব্দে চিন্তায় ছেদ পড়লো মেসবাহর। উদাস মনে সেদিকে এগিয়ে গিয়ে দরজা খুলতেই তার সামনে ভেসে উঠলো লিমনের ভাষ্যমতে ভুড়িওয়ালা ভাবির ছবি।
-“ভালো আছো?”
-“জ্বি, আছি। আপনি ভালো আছেন?”
-“আমি তো সবসময়ই ভালো থাকি। শুনলাম তুমি নাকি গ্রাম থেকে কাজের মেয়ে এনেছো।”
চোয়াল শক্ত হয়ে এল মেসবাহর। গম্ভীরমুখে সে বললো,
-“বোন.. দুঃসম্পর্কের বোন। কাজের মেয়ে নয়।”
-“অহ.. তাই বলো! তা কোথায় তোমার সেই বোন? ডাকো তো ওকে। একটু দেখা সাক্ষাৎ করে যাই। ভাই, তোমরা তো পুরুষেরা যে যার যার কাজে বেরিয়ে যাও! আর বাড়িতে বসে পঁচে পঁচে মরতে হয় আমাদের। কথা বলার মত পাশে একজন থাকলে বেশ লাগে!”
বলেই হনহনিয়ে ভেতরে ঢুকে পড়লেন মুন্নি সরকার। ঘটনার আকস্মিকতায় হকচকিয়ে গিয়ে তার পিছু নিল মেসবাহ। ডাইনিং প্লেসে যেতেই তাকে থামিয়ে বললো,
-“ভাবি আপনি এখানে বসুন। আমি ওকে ডেকে আনছি। আপনি কেনো শুধুশুধু এত গরমের ভেতর আগুনের কাছে যাবেন! আপনি বসুন…”
তারপর দ্রুত পায়ে মেসবাহ এগুলো রান্নাঘরের দিকে। এই মহিলাকে একদম পছন্দ নয় তার। অবশ্য শুধু এই মহিলা নয়, আগবাড়িয়ে খাতির জমাতে আসা সকল ব্যক্তিই চক্ষুশূল তার।
-“যা বলেছি বুঝেছো তো?”
-“হুম..”
-“তাহলে বলো উনার সামনে আমাকে কী ডাকবে?”
-“ভাই..”
-“গ্রেট। আর হ্যাঁ, বেশি কথা বলবে না। রান্নার বাহানা দেখিয়ে দ্রুত চলে আসবে।”
-“আচ্ছা।”
-“চল এবার।”
সব শিখিয়ে পড়িয়ে উল্লাসীকে নিয়ে ডাইনিংয়ে এসে চেয়ারে বসলো মেসবাহ। ঠোঁটের কোণায় মৃদু হাসি ফুটিয়ে বললো,
-“ওই উল্লাসী।”
-“উল্লাসী? সুন্দর নাম তো। কীসে পড়ো তুমি?”
মুন্নি সরকারের প্রশ্নে হাত কচলাতে কচলাতে উল্লাসী জবাব দিল,
-“ক্লাস এইট।”
-“বেশ ছোট। অবশ্য ছোট মেয়েকে এনেই ভালো করেছো মেসবাহ। আরও ছোট মেয়ে হলে ভালো হত। আজকালকার মানুষের যা মনোভাব! তারা ভাইয়ের সঙ্গেও বোনকে জড়াতে দুবার ভাবে না!”
গলা শুকিয়ে এল মেসবাহ। কোনোমতে ঠোঁটের কোণায় হালকা হাসির রেখা ফুটিয়ে মুন্নি সরকারের কথায় সম্মতি জানালো সে। অপরদিকে মুন্নি সরকার উল্লাসীর উদ্দেশ্যে বলেই যাচ্ছে,
-“আমি কিন্তু ফ্রি হলেই গল্প করতে চলে আসবো তোমার সাথে। তুমি তো বেশ ছোট। আমার কাছ থেকে অনেক কিছু শিখতে পারবে তুমি। রান্নাবান্না বলো বা টুকিটাকি জিনিস। তোমার সমস্যা নেই তো?”
উল্লাসীর জবাবের জন্য একদন্ড অপেক্ষা করে মুন্নি সরকার আবারও বললো,
-“তুমি দেখছি খুবই কম কথা বলো! বসো না! দাঁড়িয়ে আছো কেন?”
-“আমি ঠিকাছি।”
-“আরে বসো তো। বাড়ি কোথায় তোমার?”
পাশ থেকে মেসবাহ জবাব দিল,
-“আমাদের গ্রামেই।”
-“কেমন বোন হয় ও তোমার?”
-“আমার চাচাতো ভাইয়ের মামাতো বোনের ফুপাতো ভাইয়ের খালাতো বোনের নানার দুঃসম্পর্কের বেয়াইয়ের ছেলের মেয়ে উল্লাসী।”
ভ্রু কুঁচকে ফেললো মুন্নি সরকার। উদ্বিগ্ন গলায় বললো,
-“বেশ দূরের সম্পর্ক তো!”
-“জ্বি। বেশ দূরের..”
(চলবে)
#নীরবতা
#নাইমা_জাহান_রিতু
#পর্ব_৯
রাতে খাবার শেষে সব কিছু গোছগাছ করে উল্লাসী ড্রইংরুমে এলো। পাশেই সোফায় শরীর মেলে দিয়ে শুয়ে রয়েছে মেজবাহ। নজর তার টেলিভিশনের দিকে। ছোট্ট একটি নিঃশ্বাস ফেলে সেদিক থেকে নজর সরিয়ে সোফায় বসলো উল্লাসী। উৎফুল্ল চোখে টেলিভিশনের দিকে তাকিয়ে তা দেখায় মনোযোগ দিল।
-“পানি গরম দিয়ে এসেছো?”
পাশ থেকে মেসবাহর প্রশ্নে মাথা নেড়ে হ্যাঁ সূচক জবাব দিল উল্লাসী। তারপর মেজবাহর দিকে ফিরে বললো,
-“আপনার লাগবে এখন?”
-“না, যখন লাগবে আমি নিয়ে নেব।”
-“আচ্ছা..”
-“ছোট হিসেবে বেশ ভালো রাঁধো তুমি।”
-“আপনার ভালো লেগেছে?”
-“হ্যাঁ.. ভালো লেগেছে।”
মেজবাহর কথায় খুশির এক দোলা বয়ে গেল উল্লাসীর মনজুড়ে। সোফায় দু’পা উঠিয়ে আরাম করে বসে সে মেসবাহর দিকে সকল মনোযোগ জুড়ে দিয়ে মৃদু হেসে বললো,
-“আপনি জানেন, আমার বাবার ছোটমার চেয়ে আমার হাতের রান্না খেতে বেশি ভালোলাগে?”
-“জানা ছিল না.. তবে এখন জানলাম। রান্নাবাড়া করতে কী খুব ভালো লাগে তোমার?”
-“খুউউব ভালো লাগে…”
-“বেশ তো.. তা আর কী কী করতে ভালোলাগে তোমার?”
-“ঘুরতে, টেলিভিশন দেখতে, সুহার সঙ্গে সময় কাটাতে, বাবার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে, বৃষ্টিতে ভিজতে, আর…”
আঙুলে কড় ধরে ধরে একেএকে নিজের ভালোলাগা গুলো মেসবাহর কাছে খুলে বললো উল্লাসী। তারপর আগ্রহী গলায় জানতে চাইলো,
-“আর আপনার?”
-“আমার তো কিছুই ভালোলাগে না। তবে বয়স বলো বা পরিস্থিতি, এসব মেনে সব কিছুকেই ভালো লাগাতে হয়।”
-“তার মানে আপনার ভাল্লেগেনা অসুখ হয়েছে। ডাক্তারদেরও তাহলে অসুখবিসুখ হয়!”
ঠোঁটে হাসি ফুটলো মেসবাহর। শোয়া থেকে উঠে বসে সে বললো,
-“তোমার কী ধারণা ছিল হয় না?”
-“হু… মানে উহু।”
-“ঠিকাছে। ডাক্তারদের নিয়ে আপাতত তোমার আর গবেষণা করতে হবে না। দ্রুত ঘরে চলো। অনেক রাত হয়েছে।”
টেলিভিশন বন্ধ করে ঘরের দিকে পা বাড়ালো মেসবাহ। তার পিছুপিছু ঘরে ঢুকে নিচে শোবার প্রস্তুতি নিচ্ছিলো উল্লাসী। তাকে মাঝপথেই থামিয়ে দিল মেসবাহ। স্বাভাবিক গলায় সে বললো,
-“বেডেই শুয়ে পড়ো।”
-“তাহলে আপনি কোথায় শোবেন?”
সে প্রশ্নের জবাব আজও উপেক্ষা করলো মেসবাহ। বেড সাইড টেবিল থেকে সিগারেটের প্যাকেট নিয়ে স্টাডি টেবিলে এসে বসলো সে।
-“আপনি আমাকে পছন্দ করেন না, তাই না?”
উল্লাসীর কথায় বুকের ভেতর হালকা কাঁপুনি অনুভব করলো মেসবাহ। তবে পরমুহূর্তেই নিজের সকল মনোযোগ ঘোরাতে গতকালের পড়া ডেভিড কপারফিল্ড বইটি বের করে অবশিষ্ট অংশতে চোখ ডোবালো সে।
-“ছোটমা খোকনকে আমাদের সঙ্গে প্রায়ই ঘুমোতে বলে। কিন্তু খোকন কখনোই আমাদের সঙ্গে ঘুমোয় না। কারণ ওর সুহাকে পছন্দ নয়। সুহার কাছে শুলে নাকি ওর গা ঘিনঘিন করে।”
বলেই থামলো উল্লাসী। আঁড়চোখে মেজবাহর দিকে ফিরে সে আবারও বললো,
-“তেমন আমাকেও আপনার পছন্দ নয় বলে আপনি আমার সঙ্গে ঘুমুতে চান না। আপনার গা ঘিনঘিন করে.. তাই না?”
-“অদ্ভুত সব কথা বলবে না। ঘুমোতে এসেছো ঘুমোও। ঘুমোনোর সময় এত কথা কিসের?”
মেসবাহর ধমকে দমিয়ে গেল উল্লাসী। ঝটপট বালিশে মাথা গুঁজে ঘুমের পায়তারা শুরু করলো সে। লোকটি বড়ই অদ্ভুত। তাকে বোঝা বড় দায়!
বই বন্ধ করে দেয়াল ঘড়ির দিকে নজর দিল মেসবাহ। রাত দু’টোর উপরে বেজে গেছে। এমনটাই হয়.. বই পড়তে ধরলেই সময়-জ্ঞান একদম ভুলতে বসে সে! হাই তুলে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো মেসবাহ। ধীর পায়ে বিছানার দিকে এগিয়ে গিয়ে কয়েকবার উল্লাসীকে ডাকলো সে। তবে অপর পাশ থেকে উল্লাসীর কোনো জবাব না পেয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ছেড়ে ঘরের আলো নিভিয়ে পাশের ঘরে চলে এল মেসবাহ। একটি সিগারেট ধরিয়ে বেতের চেয়ারে শরীর মেলে দিল। উল্লাসীকে কী আসলেই পছন্দ নয় তার? হয়তো.. কিন্তু কেনো পছন্দ করে না সে উল্লাসীকে? গ্রামের মেয়ে বলে, অবুঝ বলে নাকি ছোট বলে? জবাবে বুকচিরে একটি দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল মেসবাহর। ভুল ভাবছে সে উল্লাসীকে নিয়ে। পছন্দ না করলেও মেয়েটিকে অপছন্দ করে না সে। মেয়েটির নিষ্পাপ চেহারা, ডাগর ডাগর দু’চোখের চাহনিতে মায়া হয় তার। ইচ্ছে হয় সকল বন্ধন থেকে মুক্ত করে আবারও তার আগের দুনিয়ায় ফিরিয়ে দিতে। তবে পরিবারের কথা ভেবে তা শুধু ভাবনাতেই সীমাবদ্ধ থাকে। অস্থির মনে চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়লো মেসবাহ। বিছানায় শরীর মেলে দিয়ে আবারও উল্লাসীর চিন্তায় ডুব দিল সে। উল্লাসীর দেখানো যুক্তিগুলো ভুল ছিল। না সে তাকে অপছন্দ করে না তার সঙ্গে ঘুমোতে গা ঘিনঘিন করবে। তবে সব কিছুর উর্ধ্বে সে একজন পুরুষ। কিছু চাওয়া-পাওয়া রয়েছে তার। আছে শারীরিক চাহিদা। সেসব ভেবে নিজের পুরুষত্ব দেখাতে শিকার বানাতে চায় না সে বাচ্চা মেয়েটিকে। বাল্যবিবাহর মতো পাপ করার পর আবারও একই পাপের পুনরাবৃত্তি ঘটাতে চায় না সে। এ পাপ যে সকল পাপের চেয়ে জঘন্য!
সকাল সকাল মেসবাহকে বেরিয়ে যেতে দেখে খুশি হলো মুন্নি সরকার। খুব দ্রুত হাতের কাজ সেরে ফ্ল্যাট লক করে সে বেরিয়ে পড়লো পাশের ফ্ল্যাটের উদ্দেশ্যে। আজ বেশ জমিয়ে আড্ডা দেয়া যাবে মেয়েটির সাথে। ভেবে খুশিতে টগবগিয়ে কলিংবেলে দু’বার চাপ দিতেই ভেতর থেকে দরজা খুলে দিল উল্লাসী। বিস্মিত গলায় বললো,
-“আপনি!”
-“কেনো? তুমি কাকে আশা করছিলে?”
-“উনাকে.. মানে ভাইকে।”
ভ্রু কুঁচকে ফেললো মুন্নি সরকার। ভেতরে প্রবেশ করে ড্রইং রুমের দিকে এগুতে এগুতে বললো,
-“তুমি যেন মেসবাহর কেমন বোন হও?”
বুকের ভেতরটা ধুকপুক করতে শুরু করলো উল্লাসীর। উনি বারবার বলেছিলেন হাজারো কলিংবেল বাজালেও দরজা না খুলতে। অথচ তার কথার অমান্য করে বসলো সে!
-“কী হলো? দরজার কাছে দাঁড়িয়ে করছোটা কী? দরজা লাগিয়ে দিয়ে এদিকে এসো।”
মুন্নি সরকারের কথামতো দরজা বন্ধ করে ড্রইংরুমে এলো উল্লাসী। পুরো শরীর থরথরিয়ে কাঁপছে তার। ভুল করে তার মুখের ফাঁক দিয়ে উলোটপালোট কিছু বের হয়ে গেলে আবার ক্ষতি হবে না তো উনার?
-“আরে! বসো তো। বসো।”
জোর করে উল্লাসীকে নিজের পাশে বসালো মুন্নি সরকার। তারপর ঠোঁটের কোণায় হাসি ফুটিয়ে বললো,
-“তুমি যেনো কেমন বোন হও মেসবাহর?”
-“ওই যে! কাল উনি.. না মানে ভাই যা বললো।”
-“ও যে কি দিয়ে কি বললো তা বুঝিই নি আমি! তুমি বুঝেছিলে?”
মাথা নেড়ে না সূচক জবাব দিল উল্লাসী। ভালোলাগছে না তার। একদম ইচ্ছে করছে না এই মহিলার পাশে বসে গল্প করতে।
-“আচ্ছা, তুমি আমাকে শুধু এইটা বলো, মেজবাহর বাবা তোমার কী হয়?”
ঢোক গিললো উল্লাসী। ধীর গলায় বললো,
-“জানিনা..”
-“এই মেয়ে বলে কী! তাইলে আবার এই বুড়া ধামড়া ছেলের সাথে তোমার বাবামা তোমাকে থাকতে পাঠিয়েছে কেন?”
-“জানিনা..”
চোখমুখ কুঁচকে ফেললো মুন্নি সরকার। চারপাশটায় চোখ বুলিয়ে বললো,
-“কোন রুমে থাকো তুমি?”
-“জানিনা..”
-“কি আশ্চর্য! এভাবে কথা বলছো কেনো?”
-“জানিনা..”
-“কী জানো তুমি?”
-“জানিনা..”
বিরক্তে সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো মুন্নি সরকার। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে উল্লাসীর দিকে তাকিয়ে বললো,
-“যাচ্ছি আমি.. দরজাটা লাগিয়ে দাও।”
হনহনে পায়ে মুন্নি সরকার ফ্ল্যাট ছেড়ে বেরিয়ে যেতেই হাঁপ ছেড়ে বাঁচলো উল্লাসী। লম্বা একটি নিঃশ্বাস ছেড়ে ঠোঁটে মিষ্টি হাসি ফুটিয়ে ধীর গলায় বললো,
-“জানিনা জানিনা জানিনা…”
(চলবে)
#নীরবতা
#নাইমা_জাহান_রিতু
#পর্ব_১০
বাড়ি ছেড়ে হলে ফেরার সময় হয়ে এসেছে মুবিনের। আবারও তার সেই একঘেয়ে জীবন শুরু। পড়া পড়া আর পড়া, যেখানে নেই একদন্ডের জন্য স্বস্তি। না জানি কবে মুক্তি মেলবে এর হাত থেকে! এদিকে চৈতালি মেয়েটাও এক দৃঢ় ভালোবাসার জালে জড়িয়ে ফেলেছে তাকে। খুব বেশি কষ্ট হয় আজকাল তাকে ছাড়া থাকতে। মন চায় সব ছেড়েছুড়ে গ্রামে এসে চৈতালির আশেপাশে পরে থাকতে। তাকে নিজের করে নিতে। তবে নানান বাঁধার কারণে তা আর হয়ে উঠে না। দীর্ঘশ্বাস ফেলে ব্যাগ গোছানোয় মন দিল মুবিন। বিকেল পাঁচটায় তার ট্রেন। এখন বাজে বেলা বারোটা। বেশি একটা সময় নেই মাঝে…
-“আমি সাহায্য করবো?”
চৈতালির প্রশ্নে চোখ তুলে তার দিকে তাকালো মুবিন। মৃদু হেসে বললো,
-“এসো…”
মুবিনের একটি শার্ট হাতে তুলে নিল চৈতালি। তা ভাজ করতে করতে অভিমানী গলায় বললো,
-“আজ না গেলে হয় না?”
-“অনেক দিন তো হলো এসেছি..”
গলা খানিকটা ধরে এল চৈতালির। ভারী স্বরে সে বললো,
-“কষ্ট হয় আমার..”
-“তোমার এইচএসসির তো আর বেশিদিন নেই। ভালো করে পরীক্ষা দিয়ে কোচিংয়ের জন্য রাজশাহী চলে আসবে৷ চাচার সঙ্গেও এই বিষয়ে আমি কথা বলে রেখেছি।”
-“কোচিং তো মাত্র কয়েকমাসের.. তারপর?”
-“তারপর তোমাকে কোনো না কোনোভাবে আমার কাছেই রেখে দেবো। তোমার এনিয়ে টেনশন করতে হবে না।”
চোখ ভর্তি জল নিয়ে বিছানায় বসে পড়লো চৈতালি। এই একটি দিন কেন আসে তার জীবনে?
-“কাঁদে না চৈতালি। দেখি উঠে দাঁড়াও।”
একরকম জোর করেই চৈতালিকে টেনে উঠালো মুবিন। তারপর নিজের বুকে চেপে বললো,
-“যাবার দিন কান্নাকাটি না করলে হয় না?”
সে কথার জবাব না দিয়ে ভেজা গলায় চৈতালি বললো,
-“আমাদের বিয়ে? তা কী শুধু আমাদের ভাবনাতেই রয়ে যাবে?”
বুকচিরে বেড়িয়ে আসা একটি দীর্ঘশ্বাস গোপন করলো মুবিন। পঁচিশ বছরের এই জীবনে তার বাবাকে চিনতে আর বাকি নেই তার। চৈতালিকে সহজভাবে মেনে নেবেন না তিনি। নানান অযুহাত দেখাবে, নানান কথা শোনাবে। তবে সেও কম যায় না! বাবা না মানলেও কি করে চৈতালিকে নিজের করে পেতে হয় তাও জানা রয়েছে তার। ম্লান হেসে চৈতালির চুলে ঠোঁট ডোবালো মুবিন। অস্পষ্ট গলায় বললো,
-“উহু.. সেটাও হবে। শুধু একটু বিশ্বাস রাখো আমার উপর।”
মুবিনের ঘরে ঢুকতেই ভূত দেখার মতো চমকে উঠলো অনা। বিস্ময়ে চোখজোড়া প্রশস্ত হয়ে এল তার। এসব কী দেখছে সে? চৈতালি আর ভাই একে অপরকে আষ্ঠেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে রেখেছে? ঠিক কী ঘটছে এখানে? তাছাড়া এমন এক পরিস্থিতিতে ঠিক কী করা উচিৎ তার? ভেবে পেল না অনা। কয়েকদন্ড চুপচাপ সেখানে দাঁড়িয়ে থাকার পর একরাশ অস্বস্তি নিয়ে নিঃশব্দে সে বেরিয়ে পড়লো সে ঘর ছেড়ে।
দুপুরে ভাত ঘুমের প্রস্তুতি নিচ্ছিলো মেসবাহ। কাল থেকে আবারও ব্যস্ত জীবন শুরু হয়ে যাবে তার। যাতে দুপুরে ঘুম তো দূরের কথা চোখ বোজার সময়টুকুও নেই! তবে সবকিছুর মাঝে উল্লাসীকে নিয়ে চিন্তা হচ্ছে তার। মেয়েটি সবটা সামলে সারাদিন একা বাসায় থাকতে পারবে তো?
-“ঘুমিয়েছেন?”
চোখ মেলে মেঝেতে গুটিসুটি মেরে বসা উল্লাসীকে একনজর দেখে আবারও চোখ বুজলো মেসবাহ। অস্পষ্ট গলায় বললো,
-“কিছু বলবে?”
-“হ্যাঁ.. কিছু না অনেক কিছু।”
-“শুরু করো।”
-“আজ আপনি বাইরে যাবার পর ওই মহিলা এসেছিল?”
-“কোন মহিলা?”
-“ওই যে কাল এসেছিল যে!”
চোখ মেলে উল্লাসীর দিকে তাকালো মেসবাহ। ভ্রু কুঁচকে বললো,
-“তুমি দরজা খুলেছিলে?”
দু’হাতে কান চেপে ধরলো উল্লাসী। নরম গলায় বললো,
-“ভুল করে ফেলেছিলাম! উনি আমাকে নানান উল্টাপাল্টা প্রশ্ন জিজ্ঞেস করছিলো। তবে সেসবের উত্তর তো আপনি আমায় শিখিয়ে দেন নি।”
-“শিখিয়ে দেইনি বলে সত্যিটাই বলে দিয়েছো?”
-“উহু.. কিচ্ছু বলিনি। উনার প্রতিটি প্রশ্নের উত্তরেই বলেছি জানিনা জানিনা জানিনা।”
উল্লাসীর কথা বোধগম্য হলো না মেসবাহর। জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তার দিকে চাইতেই ধীরেসুস্থে তাকে সবকিছু গুছিয়ে বললো উল্লাসী। সব শুনে ঠোঁটে ফুটলো মেসবাহর একরাশ হাসি। উচ্চস্বরে খানিক্ষন হেসে সে বলিলো,
-“গুড জব। এবার কান থেকে হাত নামাও।”
-“মাফ করে দিয়েছেন আমায়?”
-“হ্যাঁ, তবে মুন্নি ভাবি যে মানুষ! দেখবে কালই আবার এসে হাজির হবে! তবে আজকের করা ভুল কাল রিপিট করা যাবে না। হাজার কলিংবেল বাজলেও তুমি কী করবে?”
-“দরজা খুলবো না।”
-“মনে থাকবে তো?”
-“থাকবে..”
স্বস্থির শ্বাস ছেড়ে আবারও চোখ বুজলো মেসবাহ। মেয়েটির মাঝে বেশ চঞ্চলতা রয়েছে। তবে তা প্রকাশে কিছু দ্বারা বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে সে। ভয়, সংকোচ, জড়তা তাকে আষ্ঠেপৃষ্ঠে চেপে ধরে রাখছে। তাহলে কী কেউ ভুলভাল কথা তার মাথায় ঢুকিয়ে দিয়েছে? যার দরুন প্রভাবিত হয়ে নিজেকে প্রকাশ করতে চেয়েও পারছে না সে? হতেই পারে। উল্লাসীকে সে একয়দিনে যতটুকু চিনেছে তাতে নিজস্বতা বলতে কিছু নেই তার ভেতর। এমতবস্থায় কারো কথায় প্রভাবিত হয়ে নিজেকে গুটিয়ে রাখা অসম্ভব কিছু নয়।
-“আপনি আজও আমায় একা ফেলে পাশের ঘরে গিয়ে ঘুমিয়েছিলেন.. তাই না?”
-“না, আজও ফজরের সময় উঠে তারপর ওঘরে গিয়েছি।”
-“সুহার কসম?”
আবারও চোখ মেললো মেসবাহ। হাই তুলে বললো,
-“সুহাটা যেনো কে?”
-“আমার বোন…”
-“বয়স কত ওর?”
-“পাঁচ বছর..”
-“তারপরই তোমার ভাই। তাই না?”
চোখমুখ শক্ত হয়ে এল উল্লাসীর। হালকা মাথা নেড়ে সে উঠে পড়লো মেঝে থেকে। সুহার জন্মের সময়ই মারা যায় মা। পিচ্চি সেই সুহাকে দেখাশোনার জন্যই বাবা বিয়ে করে আনেন ছোটমাকে। তার ঠিক এক পছর পরই জন্ম হয় খোকোনের। সেই সাথে সুহার সকল আদরযত্ন স্থানান্তর হয় খোকনে। মাঝেমাঝে মন হয়, ভালোবাসাও বুঝি স্থানান্তর হবার জিনিস? তবে পরমুহূর্তেই নিজের মায়ের কথা মনে পড়ে যায়। মায়ের জায়গায় তো ছোটমা এসেছে বেশ ক’বছর হলো! স্বয়ং মানুষই যেখানে স্থানান্তর হয় সেখানে ভালোবাসা আর কি জিনিস!
রাতে দ্রুত খাওয়াদাওয়ার কাজ সেরে উল্লাসীকে ঘুমের জন্য তাড়া দিতে শুরু করলো মেসবাহ। আগামীকাল যেহেতু সকাল সকাল উঠেই নিজের কর্মক্ষেত্রে ছুটতে হবে সেহেতু বেলা করে ঘুমোনোর কোনো সুযোগ নেই। আবার উল্লাসী না ঘুমোনোর আগে ওঘরে গিয়ে নিজের শরীর মেলে দেবারও কোনো উপায় নেই। তাই সব ভেবে রাত দশটার মাঝেই উল্লাসীকে ঘুমোনোর আদেশ দিয়ে শেক্সপিয়ারের দ্য টেমপেস্ট বই খুলে বসলো মেসবাহ। ঘন্টাখানেক সময় নিয়ে কিছু পাতা পড়ে উঠে পড়লো সে। ঘুমের দরুন গভীর নিঃশ্বাস ফেলছে উল্লাসী। একেকটি নিঃশ্বাস তার ঠোঁট ছুঁয়ে পুরো ঘরে মিশে যাচ্ছে। যা হয়তো একসময় তার নিঃশ্বাসের সঙ্গেও মিলিত হচ্ছে! অদ্ভুত এই ভাবনাকে আর এগুতে দিল না মেসবাহ। দ্রুত গতিতে পা বাড়ালো পাশের ঘরের দিকে।
গভীর ঘুমের তলিয়ে গিয়েছিল মেসবাহ। হঠাৎ শরীরের ঝাঁকুনিতে ঘুম ভেঙে গেল তার। চোখমুখ কুঁচকে উঠে বসতে বসতে বললো,
-“কী হয়েছে? কাঁদছো কেনো?”
-“আমাকে একা ওঘরে ফেলে আপনি এঘরে এসে কেনো ঘুমিয়েছেন?”
-“তাতেই কাঁদতে হবে?”
-“জানি না। আমাকে ওরা ধরে নিয়ে যাচ্ছিল! আপনি কেনো এসে এঘরে ঘুমিয়েছিলেন?”
কিছু বুঝলো না মেসবাহ। হাই তুলে দেয়াল ঘড়ির দিকে নজর দিতেই সে দেখলো ঘড়িতে বাজছে রাত একটা। অর্থাৎ উল্লাসীকে ফেলে এঘরে আসার দু’ঘন্টাও হয়নি। অথচ এর মাঝেই উঠে পড়েছে সে! মেজাজ চরম খারাপ হয়ে এল তার। তবুও নিজেকে সে যথাসাধ্য সামলে নিয়ে বললো,
-“অবুঝের মতো করোনা উল্লাসী। ওঘরে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ো। কাল আবার আমার সকাল সকাল উঠতে হবে।”
কান্নার বেগ বাড়িয়ে দিল উল্লাসী। উনি কেনো বোঝে না একা ঘরে শুয়ে ঠিক কতটা ভয় পায় সে! নানানরকম বাজে স্বপ্নও দেখে। তখন পাশে একজনকে না পেলে আতংকে দিশেহারা হয়ে পড়ে তার অবুঝ মন। এসব কেনো বোঝেন না উনি?
-“কান্না থামাও, উল্লাসী। এত রাতে এভাবে কাঁদলে আশেপাশের মানুষেরা কি ভাববে! কান্না থামাও বলছি।”
মেসবাহর ধমকে কান্নার বেগ খানিকটা কমালো উল্লাসী। মেসবাহর দু’হাত ধরে সে আকুল গলায় বললো,
-“আমি একা ওঘরে থাকবো না।”
-“তোমার থাকতে হবে। এখন কী আমার ঘুম বাদ দিয়ে তোমাকে পাহারা দিতে জেগে বসে থাকবো আমি? এসবের চাকরি নিয়েছি আমি? আমার নিজের জীবন নেই? কাজকর্ম নেই? সব ফেলে কী এখন তোমায় নিয়ে পরে থাকতে হবে আমার?”
ফোঁপাতে ফোপাঁতে উল্লাসী জবাব দিল,
-“আমি যাবো না।”
-“তুমি যাবে। এবং এক্ষুনি যাবে।”
বলেই উল্লাসীর হাত ধরে বিছানা ছেড়ে নামলো মেসবাহ। তারপর দ্রুত পায়ে তাকে টানতে টানতে নিয়ে এলো পাশের ঘরে। এক ধাক্কায় বিছানার মাঝ বরাবর উল্লাসীকে ফেলে ক্রোধে বিস্ফোরিত গলায় বললো,
-“একটা শব্দ যেনো না শুনি। চুপচাপ ঘুমোও। নয়তো আমার চেয়ে খারাপ কেউ হবে না।”
এরপর আর অপেক্ষা না করে উল্লাসীকে একা ঘরে রেখে বাইরে থেকে দরজা বন্ধ করে নিজের ঘরের দিকে পা বাড়ালো মেসবাহ। রাগ হচ্ছে তার। রাগের চোটে পুরো শরীর, কপালের রগ কেঁপে কেঁপে উঠছে।
(চলবে)