দীর্ঘ ছয় বছর পর পছন্দের মানুষটিকে পাশের সিটে দেখে থমকে গেলো নিহা। মস্তিষ্কে নাড়া দিয়ে উঠলো পুরোনো কিছু তিক্ত স্মৃতি, যে স্মৃতি আজও থেকে থেকে পীড়া দিয়ে উঠে।
জানালার পাশের সিটে বসে ছিলো জুনায়েদ। দৃষ্টিজোড়া বাইরে নিবদ্ধ। মুগ্ধ দৃষ্টিতে দেখছে শুভ্র মেঘের আনাগোনা। মেঘের শুভ্র বিন্যাসে মোহিত হয়ে ব্যাগপ্যাক হতে ক্যামেরা বের করলো সে। লেন্সের ফোকাস ঠিক করে ক্লিক ক্লিক করে দুটো ছবি তুললো। হঠাৎ মেয়েলি কণ্ঠস্বরে তার ধ্যান কাটলো।
” জানালার পাশের সিটটা আমার জুনায়েদ।”
জুনায়েদ ফিরে তাকালো। অকস্মাৎ কাকতালীয়ভাবে নিহাকে এভাবে সম্মুখে দেখে চমকিত হলে সে। কয়েক সেকেন্ডের জন্য তার দৃষ্টিজোড়া নিষ্পলক নিহার উপর আবদ্ধ রইলো। তার এরূপ চাহনিই সেই পুরোনো দিনের ন্যায় নিহার মনে ঝড় তুললো। এই নিষ্পলক ঘোলাটে বর্ণের দৃষ্টিজোড়াই আজ থেকে ছয় বছর আগে তাকে অস্থির করেছিলো। মনে ফুটিয়েছিলো প্রণয় নামক এক নিস্তেজ ফুলের বাগান।
নিহা খানিক হাসার চেষ্টা করলো। দুজনের মাঝের এই বি’শ্রী নীরবতা কাটিয়ে তুলতে সে মৃদু হেসে বললো,
” ওভাবে তাকিয়ে আছিস কেনো? আমি নিহা’ই। এতো অবাক হওয়ার কিছু নেই।”
জুনায়েদের ধ্যান পুনরায় ভাঙলো। বোকাসোকা হাসার চেষ্টা করে নিজেকে ধাতস্থ করলো। সিট ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে নিহাকে বসার সুযোগ দিলো। আর তার পাশের সিটে বসলো সে।
নিহা সিটে বসে পায়ের নিচে ছোট একটা ব্যাগ রাখলো। সেখানে টুকটাক খাবারের কিছু আইটেম আর শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘গৃহদাহ’ উপন্যাস। জার্নি পথে বই পড়া তার পুরোনো একটি অভ্যাস।
দু মিনিটের মাঝেই বাস ছাড়লো। বাস ছাড়তেই নিহা ফোন বের করে কল লিস্ট থেকে মায়ের নাম্বার বের করলো। কল দিলো। দু’বার রিং হতেই ওপাশ থেকে তার মা কল রিসিভ করলো,
” বাসে উঠেছিস নিহা?”
” হ্যাঁ, মা বাসে উঠেছি। মাত্রই বাস ছাড়লো। ”
” আচ্ছা। সাবধানে যাস। আর গিয়েই আমাকে জানাবি কিন্তু! ”
” হ্যাঁ, মা জানাবো। চিন্তা করো না৷ জানাবো তোমাকে। ”
বলেই নিহা কল কেটে দিলো। ফোনটা ব্যাগে রেখে খানিক নড়েচড়ে বসলো৷ এতোক্ষণ মায়ের সাথে কথা বলছিলো দেখে জুনায়েদকে পাশ কাটাতে পেরেছে সে। কিন্তু এখন! দুজনের মাঝে ফের অদৃশ্য এক কাঁটাতারের বিষাক্ত নীরবতা বিরাজ করলো।
অপরিচিত দুজন মানুষের মাঝে এ নীরবতা কিছুই নয়। কিন্তু পরিচিত দুজন মানুষের মাঝে এমন নীরবতা অস্থিরতা, অস্বস্তিকর এক অনুভূতি বয়ে আনে৷ যা শরীরে ভীষণ পীড়া দেয়। নিহা ও জুনায়েদের মাঝে এ মুহূর্তে ঠিক এই পীড়া কষ্ট দিচ্ছে। দুজনে কথা আরম্ভ করার মতো কিছু পাচ্ছে না। আবার নিশ্চুপেও থাকতে পারছে না।
বেশ কিছুক্ষণ সময় নিয়ে মনের সাথে লড়াই করে জুনায়েদ জিজ্ঞেস করলো,
” কেমন আছিস নিহা?”
নিহা মুচকি হাসলো। জবাব দিলো,
” এই তো ভালোই আছি। তুই কেমন আছিস?”
” আমিও ভালো আছি। ”
এরপর মিনিট দুয়েক সময় নিয়ে জুনায়েদ ফের জিজ্ঞেস করলো,
” এভাবে কখনো দেখা হবে ভাবিনি আমি।”
নিহা জোরপূর্বক হাসার চেষ্টা করলো৷ বললো,
” আসলেই। আমিও কখনো এক্সপেক্ট করিনি এভাবে আমাদের দেখা হবে। ”
” হুম। কোথায় যাচ্ছিস তুই?”
” কোথায় আর যাবো! গন্তব্য আমার সেই ঢাকাতেই আছে।”
” ওহ। বাড়িতে এসেছিলি? ”
” হ্যাঁ। মা একটু অসুস্থ হয়ে পড়েছিলো। তাই দেখতে এসেছিলাম। ”
” কি হয়েছিলো আন্টির?”
” ঐ প্রেশার লো হয়ে গিয়েছিলো। পুরোনো প্রবলেম। তোর তো জানা আছে।”
জুনায়েদ দূর্বলভাবে মাথা নাড়ালো। নিহাকে ঘিরে প্রতিটি তথ্য, প্রতিটি স্মৃতি তার এখনও মনে আছে। কি করবে, ভুলতে পারিনি সে। কেননা এক সময় এই মেয়েটিই তার ভীষণ আপন ছিলো। কিন্তু কি থেকে কি হয়ে গেলো, ভাগ্য আর পরিস্থিতি বদলে সব বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলো।
জুনায়েদ জবাব দিলো,
” হ্যাঁ মনে আছে।
তো কি করছিস এখন?”
” একটা ব্যাংকে জব নিয়েছি আমি। তোর কি অবস্থা? এখনও বুঝি সেই ছন্নছাড়া ভাব যায়নি তোর? হাতে ক্যামেরা দেখলাম যে! এখনও ছবি তুলিস?”
জুনায়েদ নত মস্তকে ঈষৎ হাসলো। ছোট্ট করে নিঃশ্বাস ফেলে বললো,
” এই ছয় বছরে অনেক কিছু বদলে গিয়েছে নিহা। তুই আমাকে যেমনটা ফেলে এসেছিলি তেমনটা আমি নেই। ”
জুনায়েদের এহেন কথা নিহার হৃদয়ে আ’ঘা’ত হা’ন’লো। দৃষ্টির সম্মুখে ভেসে উঠলো আজ হতে ছয় বছর পূর্বের সেই ঘটনা, যার স্মৃতি আজও তাকে সুক্ষ্মভাবে আঘাত করে।
জুনায়েদ পুনরায় বললো,
” এখন একটা কর্পোরেট কোম্পানিতে জব করি। আর শখের বসে সময় পেলে ক্যামেরা নিয়ে বেড়িয়ে পড়ি। ”
” ভালো। নিজের শখটাকে যে এখনও জীবিত রেখেছিস তুই তা শুনে ভালো লাগলো। ক’জনই বা পারে সারাজীবন নিজের শখকে বাঁচিয়ে রাখতে!”
বলেই দীর্ঘশ্বাস ফেললো নিহা। জুনায়েদ তার এ দীর্ঘশ্বাসের পিছনের কারণ জানতে জিজ্ঞেস করলো,
” কেনো? তোর শখ বুঝি এখন মৃ’ত?”
নিহা জবাব দিতে যাবে এর পূর্বেই তার ফোনে একটা কল এলো। ব্যাগ হতে ফোন বের করে দেখলো তাশদীদ কল করেছে। তাশদীদের নামটা তার ফোনে ভেসে উঠতেই জুনায়েদের নজর গিয়ে ঠেকলো তাতে।
নিহা কল রিসিভ করলো। ওপাশ হতে তাশদীদ জিজ্ঞেস করলো,
” বাসে উঠেছো নিহা?”
নিহা অধর কোনে সৌজন্যমূলক হাসি এঁটে বললো,
” জি উঠেছি। ”
” তাহলে উঠে একটু কল করে জানাবে না আমাকে? আমি ভাবলাম বাস বোধহয় মিস করে ফেললে।”
” না, মিস করিনি। বাসে উঠে মা’কে কল করেছিলাম। ভেবেছিলাম কিছুদূর যাওয়ার পর আপনাকে কল করবো।”
” আচ্ছা বাদ দাও এসব। লাঞ্চ করে বেরিয়েছো তো?”
” হ্যাঁ করেছি। আপনি লাঞ্চ করেছেন?”
” মাত্রই বসলাম লাঞ্চ করতে। তোমার কথা ভীষণ মনে পড়ছে বুঝলে। মিস করছি তোমাকে।
নিহা মৃদু হাসলো। বললো,
” এখন খেয়ে নিন জনাব। আমি আজই আসছি। আর মিস করার সুযোগ নেই বুঝলেন।”
ওপাশে তাশদীদ হাসলো। আরো দু চারটা কথা বলে ফোন রাখলো সে।
নিহা ফোন রাখতেই জুনায়েদ নড়েচড়ে বসলো। এতক্ষণ যাবত সে সতর্কতার সহিত নিহা আর তাশদীদের কথোপকথন শুনছিলো। নিহা যেনো এ ব্যাপারে টের না পায় তাই নিজের ফোন বের করে সে-ও কাউকে কল করার ভান করলো।
ফোন ব্যাগে রাখতে না রাখতেই জুনায়েদ উৎসুক কণ্ঠে শুধালো,
” বিয়ে করলি কবে? দাওয়াত দিলি না যে?”
জুনায়েদের এহেন প্রশ্নে নিহা খানিকটা সশব্দে হাসলো। বললো,
” বিয়ে নামক প্যারা এখনও ঘাড়ে নেইনি রে জুনায়েদ। ”
জুনায়েদ তখন আন্দাজে ঢিল ছুড়ে জিজ্ঞেস করলো,
” তাহলে বয়ফ্রেন্ড নিশ্চয়ই? ”
” উঁহু। বয়ফ্রেন্ড না সে। ”
এবার জুনায়েদ খানিকটা ভাবলো। পুনরায় জিজ্ঞেস করলো,
” ফিয়ন্সে?”
নিহা হ্যাঁ সূচক মাথা দোলালো। সাথে সাথে জুনায়েদের আগ্রহ কমে গেলো। হৃদয় মাঝে এক অদ্ভুত পীড়া আরম্ভ হলো। আশ্চর্য, দীর্ঘ ছয় বছর পর এই পীড়া আরম্ভ হওয়ার মানে কি! আর নিহার প্রতি এখনও এ অনুভূতি কেনো! ছয় বছর পূর্বে সে যা করে গিয়েছে তাতে এমন অনুভূতি ফের জেগে উঠার মানে হয় না। জুনায়েদ নিজেকে শক্ত করলো। নাহ, তার দূর্বল হলে চলবে না। নিহার যে ফিয়ন্সে আছে! সুতরাং এ অনুভূতির কোনো ভবিষ্যত নেই।
জুনায়েদের বর্তমান পরিস্থিতি জানতে নিহাও আগ্রহ বোধ করলো। জিজ্ঞেস করলো,
” তোর কি অবস্থা জুনায়েদ? কয় বাচ্চার বাপ হলি?”
জুনায়েদ তাচ্ছিল্যের হাসি হাসলো। বললো,
” কয় বাচ্চার বাপ! এখনও বিয়ে করিনি বুঝলি। আসলে কিছু কিছু স্মৃতি এখনও মনের বাক্স থেকে মুছতে পারিনি আমি৷ ”
নিহা ভীষণ অপরাধবোধে জর্জরিত হলো। সে বারংবার চাইছে পুরোনো স্মৃতিগুলো যেনো এ মুহূর্তে দুজনের কথোপকথনের মাঝে জাগ্রত হয়ে না আসে। কিন্তু ঘুরেফিরে জুনায়েদ সে কাজটিই করছে। কথার মাধ্যমে টেনেহিঁচড়ে বের করছে তিক্ত সেই স্মৃতিগুলো।
#নীরব_সূর্যাস্ত
#পর্ব_১
#সারা_মেহেক
#চলবে কি?
(৩/৪ পর্বের অতি ছোট একটা গল্প হবে এটা। প্রথম পর্ব পড়ার পর কি আপনাদের রেসপন্স পাবো?🙂)
গ্রুপ লিংক : https://facebook.com/groups/259972409591747/
পরবর্তী পর্ব যথাসময়ে পেতে পেইজ ফলো দিয়ে রাখুন: https://www.facebook.com/official.saramehek
পরবর্তী পর্বঃ https://m.facebook.com/story.php?story_fbid=829362669189220&id=100063464839918&mibextid=Nif5oz