নীরব_সূর্যাস্ত #পর্ব_২ #সারা_মেহেক

0
1117

#নীরব_সূর্যাস্ত
#পর্ব_২
#সারা_মেহেক

নিহা নিচে ঝুঁকে ব্যাগ হতে ‘গৃহদাহ’ উপন্যাসের বইটা বের করলো। গতকাল রাত হতে পড়া আরম্ভ করেছে সে। আজ উপন্যাসের মধ্য অংশে চলে এসেছে৷ ভ্যানিটি ব্যাগ হতে কালো ফ্রেমের একটা চশমা বের করে পরে বইয়ের মাঝ পৃষ্টা খুললো সে। পড়া আরম্ভ করলো। বাসের জানালা দিয়ে তীব্র বেগে হাওয়া চলাচল করছে। সে হাওয়ায় তার কপালের উপরে পড়ে থাকা মাঝারি আকৃতির চুলগুলো ভীষণ উড়াউড়ি করছে। বারংবার সে বিরক্ত হয়ে কানের পিছনে সেই চুলগুলো গুঁজে দিয়ে উপন্যাস পড়ছে।

জুনায়েদ থেকে থেকে আড়চোখে চাইছে নিহার পানে। মেয়েটার স্বভাব একদম সেই আগেকার মতোই আছে। সারাদিন শুধু বই পড়া। সুযোগ পেলেই বই পড়া। ভার্সিটিতে থাকতে নিহা আড্ডা দিতো কম, বই পড়তো বেশি। তবে একাডেমিক এর বই নয়, গল্প উপন্যাসের বই পড়তো সে। তার বই পড়ার সময়টুকুতে কেউ বাঁধা দিতে এলে ভীষণ বিরক্ত হতো সে। এখনও বোধহয় তেমনই আছে নিহা! জুনায়েদের মন চাইলো নিহাকে একটু জ্বালিয়ে দেখবে। যেই ভাবা সেই কাজ। সে খানিকটা নিহার দিকে ফিরে জিজ্ঞেস করলো,
” কি বই পড়ছিস?”

নিহা পড়তে পড়তে জবাব দিলো,
” তোর সামনেই নামটা আছে।”

বইয়ের নাম দেখতে পাওয়া সত্ত্বেও জুনায়েদ ভান ধরলো যে সে নাম দেখতে পাচ্ছে না৷ বললো,
” এখান থেকে দেখা যাচ্ছে না নাম।”

নিহা বিরক্তিতে ‘চ’ উচ্চারণ করে বললো,
” গৃহদাহ।”

” ও! শরৎচন্দ্রের বই না?”

” হুম। ”

” কতটুকু পড়া হলো?”

” কাহিনির মাঝ বরাবর আছি।”

” এখন কোন অংশে আছিস?”

প্রশ্নের ঝুড়ি খুলে বসায় জুনায়েদের উপর যারপরনাই বিরক্ত হলো নিহা। চশমা খুলে সশব্দে বই বন্ধ করে খটোমটো চাহনিতে চাইলো সে। কপালের অবিন্যস্ত চুলগুলো কানের পিছনে গুঁজে দিতে দিতে খেঁকানো গলায় বললো,
” তোর সেই পুরোনো স্বভাব এখনও বদলায়নি তাই না জুনায়েদ!”

জুনায়েদ এতক্ষণ যাবত ঠোঁট টিপে হাসছিলো। কিন্তু এখন নিহার সেই পুরোনো বাচনভঙ্গির ঢঙে সে ফিক করে হেসে বললো,
” তোর স্বভাবও তো এখনো বদলায়নি। সেই আগেকার মতো পড়ুয়া নিহা’ই রয়ে গিয়েছিস তুই, যে সময় পেলেই লাইব্রেরিতে ঢুকে বই পড়া শুরু করে দিতো!”
নিহা তৎক্ষনাৎ জবাব দিতে পারলো না। ফিরে গেলো পুরোনো সেই দিনগুলোর স্মৃতির পাতায়।

জুনায়েদ ও নিহার ভার্সিটির প্রথম বর্ষ থেকেই খুব ভালো বন্ধুত্ব ছিলো। ভার্সিটির চেনা পরিচিত প্রায় সবাই জানতো নিহা ও জুনায়েদ বেস্টফ্রেন্ড। তবে তাদের দুজনের চরিত্র একে অপরের থেকে সম্পূর্ণ পৃথক। যেখানে জুনায়েদ ছিলো উচ্ছ্বল, ছন্নছাড়া এক যুবক সেখানে নিহা ছিলো গোছানো ও ভাবুক এক যুবতি। কিন্তু কি করে যেনো দুটো বিপরীত স্বভাবের মানুষ দুটোর মধ্যে বন্ধুত্ব হয়ে গেলো। সে বন্ধুত্ব আবার এই সেই বন্ধুত্ব নয়। একদম কড়াকড়ি রকমের বন্ধুত্ব। ভার্সিটি থাকাকালীন দুজনে সারাটাদিন প্রায় একসাথে থাকতো।
নিহা যখন লাইব্রেরিতে বই পড়তো তখন জুনায়েদ গিয়ে শুধু ওকে বিরক্ত করতো। এ নিয়ে নিহার পক্ষ হতে বেশ ক’টা কিল ঘু’ষিও খেতো জুনায়েদ। মাঝে মাঝে নিহার পিঠেও আলতো করে দু একটা কিল বসিয়ে দিতো সে। কিন্তু শেষে এসে কি যেনো হয়ে গেলো তাদের মাঝে। চার বছরের দৃঢ় বন্ধুত্ব নিমিষেই ভেঙে গেলো। দুটো রাস্তা হয়ে গেলো চিরদিনের জন্য পৃথক।

নিহা হারিয়ে গিয়েছিলো পুরোনো ডায়েরির সেই স্মৃতির পাতায়। আহ, সময়গুলো কি রঙিন আর উপভোগ্য ছিলো। কিন্তু এখন সময়গুলো ক্রমশই বেরঙ আর বিতৃষ্ণাময় হয়ে উঠছে। কি হতো যদি সেই সময়গুলো স্মৃতিরপটে না ভেসে তাদের দুজনকেই নিয়ে যেতো সেই ছয় বছর পূর্বের মুহূর্তগুলোয়! যেখানে চাইলেই ভুলগুলো শুধরে নেওয়া যেতো, যেখানে উপভোগ করা যেতো নিজের মনমর্জির এক জীবন। কিন্তু সৃষ্টিকর্তা সে সুযোগ আর কি দিবে!
নিহা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। জুনায়েদও হারিয়ে গিয়েছিলো পুরোনো সময়ে। হঠাৎ নিহাকে জিজ্ঞেস করলো,
” এখনও সেই আগের মতে বইয়ের প্রতি টান আছে তোর?”

নিহা মৃদু হাসলো। পুনরায় দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,
” আগের মতো বইয়ের প্রতি টান থাকলেও আগের মতো ঠিক বই পড়া হয়ে উঠে না৷ আসলে কাজের চাপে হয়ে উঠে না৷ ”
নিহার কথা শেষ হতে না হতেই বাস একটি রোডসাইড রেস্তোরাঁয় থামলো। ২৫ মিনিটের বিরতি দেওয়া হলো সেখানে। জুনায়েদ ও নিহা দুজনেই নামলো বাস থেকে। জুনায়েদ দুপুরের খাবার খেয়েছিলো না বিধায় দুটো পরোটা আর ডাল ওর্ডার করলো। নিহা কিছু খেতে চায়ছিলো না। কিন্তু জুনায়েদের জোরাজোরিতে একটা পরোটা আর ডিম ভাজি ওর্ডার করলো। দুজনে খাওয়া শেষে রেস্তোরাঁর বাইরে বেরিয়ে ওয়ান টাইম কাপে দুটো চা নিলো। চা খেতে খেতে দু’জন সামনের জায়গায় পায়চারি করলো। হঠাৎ জুনায়েদ কি মনে করে নিহাকে বললো,
” অনেকদিন হয়েছে তোর গলায় গান শুনি না। একটা গান গেয়ে শোনা।”

নিহা ইতস্তত বোধ করলো। তবে প্রায় তৎক্ষনাৎ দীর্ঘশ্বাস ফেলে উদাস গলায় বললো,
” এখন আর গান গাইনা আমি।”

জুনায়েদ নিহার এ কথায় ভীষণ বিস্মিত হলো। কেননা নিহার গানের প্রতি আলাদা একটা টান ছিলো। তার শখ ছিলো এটি। বন্ধুমহলে নিহার গানের চর্চা প্রায় প্রত্যেকেই করতো। আর সেই নিহা এখন গান গায় না। এ কি বিশ্বাসযোগ্য!
জুনায়েদ আশ্চর্যান্বিত কণ্ঠে বললো,
” কি বলিস! তোর না শখ ছিলো?”

নিহা তাচ্ছিল্যপূর্ণ হাসি দিয়ে বললো,
” সব শখ সারাজীবন জিইয়ে রাখা যায় না জুনায়েদ। কিছু শখ কালক্রমে মাটা চাপা দিতে হয়। ”
বলেই নিহার মন চাইলো তার গান ছাড়ার শখের জন্য জুনায়েদের ঘাড়ে নির্দ্বিধায় দোষ চাপিয়ে দিতে। বলতে মন চাইলো, ‘তোর কারণেই আমার জীবনের এ প্রিয় শখও অপ্রিয় হয়ে উঠেছে জুনায়েদ!’। কিন্তু সে বললো না। বুকের ভেতর শত শত অভিযোগের ন্যায় এ অভিযোগও চাপা দিয়ে রাখলো।

জুনায়েদ নিহার কথায় উদাস গলায় আনমনে বললো,
” আসলে ব্যক্তি ও সময় -এই দুটো জিনিস যেকোনো শখ, ইচ্ছা পাল্টে দিয়ে কোনো মানুষকে নিরস করে তুলতে পারে। আমাদের ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে।”

নিহা জুনায়েদের কথার পিঠে বললো,
” শুধু ব্যক্তি আর সময় না, কিছু ঘটনা, পারিপার্শ্বিকতা সবকিছু বদলে দেয়। ”

” আর সে ঘটনার মিথ্যে দোষী হিসেবে যদি খোদ এই মানুষটিকে দাঁড় করানো হয় তবে?”

নিহা এবার জুনায়েদের দৃষ্টি বরাবর চাইলো। জুনায়েদের দৃষ্টিতে এক ঝলক ক্ষোভের আভাস পেলো সে। বহুক্ষণ পর শেষমেশ করুণ গলায় সে বললো,
” সেদিনকার ঘটনার জন্য কি শুধুই আমি দায়ী?”

জুনায়েদ কঠোর ও স্পষ্ট গলায় বললো,
” অবশ্যই শুধু তুই-ই দায়ী। তোর কি উচিত ছিলো না সেদিন আমার পাশে দাঁড়ানোর? তোর কি উচিত ছিলো না সেদিন আমার ঢাল হয়ে আমাকে সকল পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে সাহায্য করানোর? কিন্তু তুই তা করিসনি নিহা। তুই আমাকে রেখে পালিয়ে গিয়েছিলি।”

” সেদিনকার ঘটনা কি তোর কাছে এতোটাই সহজ মনে হয়? আমি জানি সেদিন আমার উপর দিয়ে কি বয়ে গেছে। সেদিন আমি…..”
কথা সম্পূর্ণ শেষ করতে পারলো না নিহা। তাদের বাসের হর্ণ দিলো ড্রাইভার। নিহা আর কথা বাড়ালো না। এক পলক জুনায়েদের পানে চেয়ে চায়ের কাপ ফেলে বাসে উঠে পড়লো সে।
জুনায়েদের মস্তিষ্কে তখন পুরোনো স্মৃতি মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। হঠাৎ আক্রোশে তার পুরো শরীর গরম হয়ে এলো যেনো। এক চুমুকে কাপের বাকি চা-টুকু খেয়ে কাপটা দূরে ছুঁড়ে ফেললো। বড় বড় পা ফেলে এগিয়ে গেলো বাসের দিকে।
জুনায়েদ বাসে উঠতেই বাস ছাড়লো। সে গিয়ে বসলো তার নির্দিষ্ট সিটে। এখন আর নিহার সাথে কথা বলতে মন চাইছে না। মেজাজটা বেশ গরম হয়ে আছে। হয়তো বেশি গরম হয়ে গেলো আশেপাশের মানুষের তোয়াক্কা না করেই কিছু কথা শুনিয়ে দিবে নিহাকে! তাই তো নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে চোখ বুজে সিটে হেলান দিলো সে।

এদিকে নিহার দৃষ্টি জানালার বাইরে। দৃষ্টির সম্মুখে সবুজ স্নিগ্ধ প্রকৃতি থাকা সত্ত্বেও তার সম্মুখে ভেসে উঠলো ছয় বছরের পুরোনো সেই স্মৃতি।

ছয় বছর পূর্বে,
নিহা আজ ভীষণ খুশি। দু বছর ধরে জমিয়ে রাখা ভালোবাসার অনুভূতিগুলো আজ জুনায়েদকে বলবে সে। প্রারম্ভে সে ভীষণ ইতস্ততবোধ করছিলো। কিন্তু পরে নিজেকে এই বুঝ দিলো যে, চার বছরের বন্ধুত্ব তাদের। আর ক’দিন পর ফাইনাল পরীক্ষা। এর মাঝেই নিজের মনে চেপে রাখা অনুভূতিগুলো প্রকাশ করা উচিত। নচেৎ দেরি হয়ে যাবে।
ক্লাস শেষ করে নিহা কৃষ্ণচূড়া গাছের দিকে এগুলো। সেখানেই জুনায়েদ আছে। কিন্তু সেখানে গিয়ে সে স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। কেননা
®সারা মেহেক

#চলবে

গ্রুপ লিংক : https://facebook.com/groups/259972409591747/
পরবর্তী পর্ব যথাসময়ে পেতে পেইজ ফলো দিয়ে রাখুন: https://www.facebook.com/official.saramehek
( সকলে গল্প নিয়ে মতামত জানাবেন। আর গল্প ভালো লাগলে আমার গ্রুপে এড হয়ে নিজের পছন্দ অপছন্দ জানাতে পারেন)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here