নীরব_সূর্যাস্ত #পর্ব_৫(অন্তিম পর্ব) #সারা_মেহেক

0
1202

#নীরব_সূর্যাস্ত
#পর্ব_৫(অন্তিম পর্ব)
#সারা_মেহেক

জুনায়েদের সম্পূর্ণ কথা শুনে নিহা নির্বাক রইলো। কই, সে তো কখনও টের পায়নি জুনায়েদের মনের খবর! ভাগ্যের এ কি নির্মম পরিহাস!
জুনায়েদ ফের অসহায় কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
” তুই কি আমাকে ভালোবাসিস নিহা?”

নিহা কয়েক মুহূর্তের জন্য নিষ্পলক জুনায়েদের পানে চেয়ে রইলো। তার সম্মুখে বসে থাকা এই মানুষটি একসময় তার ভীষণ ভালো বন্ধু ছিলো। সে থেকে সময় গড়িয়ে যেতে যেতে একসময় ভালো বন্ধুটি ভালোবাসার মানুষে পরিণত হয়। উঁহু, ঠিক ভালোবাসার মানুষ বলা যায় না। এ যে একপাক্ষিক ভালোবাসা ছিলো! সে ভালোবাসা চাপা পড়লো এক অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার বেড়াজালে। বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলো দুটো মানুষের পথ।
নিহা সে সময় খুব করে চেয়েছিলো জুনায়েদ যেনো না বলতেই তার মনের কথা বুঝে ফেলে, চোখের ভাষা পড়ে ফেলে। কিন্তু আফসোস, সে ক্ষমতা কি সবার মাঝে থাকে! জুনায়েদের মাঝেও ছয় বছর আগে সে ক্ষমতা ছিলো না। অথচ এখন! কি করে যেনো সে ক্ষমতার অধিকারী হয়ে গেলো সে। যখন নিহা চাইছে না জুনায়েদ কিছু জানুক, কিছু অনুমান করুক, ঠিক তখনই জুনায়েদ তাকে জিজ্ঞেস করছে, সে তাকে ভালোবাসে কি না! এ কেমন অবিচার!

নিহা সর্বাত্মক চেষ্টা করলো যেনো জুনায়েদ কিচ্ছুটি বুঝতে না পারে। নিহা হাসলো। বললো,
” দেখ জুনায়েদ, তুই সেদিন আমার চাহনি দেখে কি বুঝেছিস জানি না। কিন্তু তুইই বল, তোর জন্য আমার মনে কোনো ফিলিংস থাকলে আমি কি বলতাম না? অবশ্যই বলতাম। কেননা তুই আমার অপরিচিত কেউ ছিলি না। আমার সবচেয়ে ভালো বন্ধু ছিলি তুই। তাহলে মোদ্দা কথা এই দাঁড়ালো যে আমি তোকে ভালোবাসি না।”

জুনায়েদ এবার উচ্চস্বরে হেসে বললো,
” তুই ভাবলি কি করে আমি এটা বিশ্বাস করবো? মিথ্যা ভালোই বলতে পারিস নিহা।”

নিহা ভীষণ বিরক্ত হয়েছে এমন ভান ধরে বললো,
” আজকে সকালে কি কিছু খেয়ে আছিসনি? সেই কখন থেকে দেখছি উল্টাপাল্টা কথা বলে যাচ্ছিস! ”

” আমি উল্টাপাল্টা কথা বলছি! নাকি তুই উল্টাপাল্টা জবাব দিচ্ছিস? সত্য কথা বলতে ইচ্ছে হচ্ছে না?”
বলেই জুনায়েদ চোখ বন্ধ করে লম্বা শ্বাস নিলো। ভীষণ অধৈর্য্য হয়ে পড়েছে সে। নিজের মনের অস্থিরতাকে কিছুতেই নিহার সামনে তুলে ধরতে পারছে না। এতোদিন সে নীরব ছিলো এই ভেবে যে নিহা তাকে ভালোবাসে না। উপরন্তু নিহার বিয়েও ঠিক হয়ে আছে। কিন্তু সেদিন বিয়ের কার্ড দিতে গিয়ে নিহার অভিব্যক্তি বেশ ভালোভাবেই পর্যবেক্ষণ করেছে সে এবং নিশ্চিত হয়েছে নিহার মনের কোথাও না কোথাও তার জন্য কিছু অনুভূতি আছে। এ অনুভূতি এখন শুধু স্বীকার করার পালা।
জুনায়েদ শান্ত স্বরে বললো,
” নিহা, এতোদিন আমি কিছুই বলিনি কারণ ভেবেছিলাম এটা শুধুমাত্র আমার একপাক্ষিক ভালোবাসা। কিন্তু….”

নিহা জুনায়েদের মুখ থেকে কথা কেড়ে নিয়ে তাচ্ছিল্যের সুরে বললো,
” কিন্তু এখন মনে হচ্ছে এটা দ্বিপাক্ষিক ভালোবাসা তাই তো?”
বলেই সে লম্বা এক নিঃশ্বাস নিলো। ঠাণ্ডা মাথায় বললো,
” তুই বা আমি, কেউই এখন আর ছোট নেই। আরা প্রায় ত্রিশের কোঠায়। এ বয়সে এতোটা ইম্যাচুরিটি দেখালে কি মানায়? তোরও বিয়ে ঠিক হয়ে আছে, আমারও বিয়ে ঠিক হয়ে আছে। এমন তো না যে আমরা সিঙ্গেল। আমাদের আগেপিছে কোনো টেনশন নেই। এটা ভুলে গেলে তো চলবে না যে আমাদের সাথে জড়িয়ে আছে আমাদের পরিবার। আমাদের একটা সিদ্ধান্ত সবকিছু শেষ করে দিতে পারে। ”

” আমি কিচ্ছু জানি না নিহা। তোকে আমি ঠিক বুঝাতে পারছি না কেমন অস্থিরতা অনুভব করছি আমি। তুই শুধু একবার ‘হ্যাঁ’ বল। বাকিটা আমি সামলে নিবো। কারোর কথা ভাবিস না নিহা। শুধু তোর মনের কথা শোন। ”

” এটা কিন্তু এখন জোরজবরদস্তির পর্যায়ে চলে যাচ্ছে জুনায়েদ। যা আমার মনে নেই তা জোর করে তুই আদায় করতে চাচ্ছিস কেনো? আর তোর বিবেক কি এটায় সায় দেয় যে দিপার মান সম্মানের কথা না ভেবে নিজের মনের কথা ভাবতে? তুই বিয়ে ভেঙে দিলে দিপার মতো মেয়ের সমাজে বেঁচে থাকা দুর্বিষহ হয়ে পড়বে। এতোটা স্বার্থপরও হোস না জুনায়েদ। শুধু ঐ মেয়েটার কথা একবার ভাব। ”

” আমি পারছি না নিহা অন্যের কথা ভাবতে। হ্যাঁ, আমি স্বার্থপর হয়েছি। শুধু তোর সাথে সারাজীবন থাকবো বলে সব ভুলে আমি স্বার্থপর হয়েছি। তুই একটু স্বার্থপর হতে পারিস না?”

” আমার বিবেক আমাকে সায় দেয় না জুনায়েদ।
আচ্ছা, এসব কথা বাদ দে। তুই সব ভুলে দিপাকে বিয়ে কর। দেখিস কয়েক মাসের মধ্যে আমাকে ভুলে যাবি।”

জুনায়েদ এবার তাচ্ছিল্যের সুরে বললো,
” ছয় বছরেও তোকে পুরোপুরি ভুলতে পারিনি। আর তুই বলছিস কয়েক মাসের মধ্যে ভুলে যাবো! তুই যদি আমার জীবনে ফের না আসতি তাহলে হয়তো তোকে ভুলে যাওয়া সম্ভব ছিলো। মনের এক কোনে দাফনকৃত অনুভূতি হয়ে পড়ে থাকতো। কিন্তু তুই আসাতে সব উল্টোপাল্টা হয়ে গিয়েছে। সবকিছু অগোছালো করে দিয়েছিস তুই।”

নিহা কিছু বলতে যাবে এর পূর্বেই তাশদীদের কল এলো তার ফোনে। ওপাশে তাশদীদ কিছু বলার পর নিহা ফোন রাখলো। বসা হতে উঠে দাঁড়ালো। বললো,
” আমাকে যেতে হবে এখন। অফিসে জরুরি মিটিং আছে। ”
বলেই সে যাবার পথে পা বাড়ালো। অমনিই জুনায়েদ পিছন থেকে তার হাত চেপে অসহায় কণ্ঠে বললো,
” আমাকে সত্য জবাবটা দিয়ে গেলি না নিহা। এখন আমার জীবনের চেয়ে তোর মিটিং বেশি জরুরি হয়ে গিয়েছে?”

নিহা অকস্মাৎ জুনায়েদের স্পর্শে চমকে উঠেছিলো। কিন্তু দ্রুতই নিজেকে সামলে নিলো সে। বললো,
” হাজারবার দিয়েছি তোর জবাব। তুই মেনে নিতো পারছিস না এটা তোর দোষ। আর এসব ভিত্তিহীন কথার সাথে তোর জীবনের যুক্তি দেখাতে আছিস না। দোয়া করি বিয়ে করে সুখী হো। আর এ দোয়াও করি যেনো আমাকে সারাজীবনের জন্য ভুলে দিপার সাথে সুখে থাকতে পারিস। ”
নিহা আর কথা বাড়ালো না৷ জুনায়েদের হাতের বাঁধন আলগা হলো। নিহাকে আটকানোর আর চেষ্টা করলো না সে। সবই এখন বৃথা চেষ্টা মনে হলো তার নিকট।

নিহা পা বাড়ালো। একটিবারও ঘুরে চাইলো না জুনায়েদের পানে। এতক্ষণ যাবত বহু কষ্টে নিজের কান্নাকে চোখের পাতার আড়ালে অবরুদ্ধ করে ছিলো সে৷ কিন্তু এখন আর পারলো না। হাঁটতে হাঁটতে নীরবে অঝোরে কাঁদতে লাগলো সে। বিরবির করে নিজেকে বললো,
” এ দোয়াও করি যেনো, আমিও তোকে সারাজীবনের জন্য ভুলে থাকতে পারি জুনায়েদ। আমি চাই না আমাদের দুজনের জীবন ঠিক করতে গিয়ে তাশদীদ, দিপা,আমার পরিবার,তোর পরিবার, তাশদীদের পরিবার,দিপার পরিবার নষ্ট করে দিতে। ছয় বছর যেখানে তোকে না দেখে ছিলাম সেখানে বাকিটা জীবনও তোকে না দেখে কাটিয়ে দিতে পারবো। আফসোস শুধু একটা কথার, তুই শেষ পর্যন্ত সত্যটা জানতে পারলি না। ”

——-

আজ জুনায়েদ ও দিপার বিয়ে। একটা কমিউনিস্ট সেন্টারে বিয়ের আয়োজন করা হয়েছে। নিহা জ তাশদীদ কাপল হিসেবে গিয়েছে সে বিয়েতে। নিহা যখন দিপাকে প্রথম দেখলো তখন নিজেকে একবার প্রশ্ন করলো,
” তাহলে এই সেই দিপা নামের মেয়েটি,যার ভাগ্যে জুনায়েদের ভালোবাসা লিখা আছে? যার ভাগ্যে সারাজীবনের জন্য জুনায়েদের সঙ্গ লিখা আছে? ভাগ্যবতী মেয়ে। ভীষণ ভাগ্যবতী মেয়ে তুমি দিপা।”

বিয়ের পুরোটা সময় দিপার ঠোঁটের কোন হতে হাসিই সরলো না। তার চেহারাখানা আজ খুশিতে জ্বলজ্বল করছে। অথচ জুনায়েদ, তার চেহারায় আজ হাসির ছিঁটেফোঁটাও নেই৷ বরং তার দৃষ্টিজোড়া বারংবার নিহাকে দেখে অসহায়ত্ব বোধ করছে। তার মন বলছে, এক্ষুনি সবার সামনে থেকে নিহাকে নিয়ে দূরে কোথাও পালিয়ে যেতে!

কবুল বলার সময় জুনায়েদের ঠিক সামনে নিহা ও তাশদীদ পাশাপাশি দাঁড়িয়ে ছিলো। নিহা পুরোটা সময় অধর কোনে কপট হাসি এঁটে রাখলো। জুনায়েদ যখন কবুল বললো তখন তার চাহনি ছিলো নিহার দিকে। সে স্পষ্ট অনুভব করলো, নিজ হাতেই সে নিহা ও তার মাঝে অদৃশ্য সেই ভালোবাসার সুতোটা কবুল বলার মাধ্যমে ছিঁড়ে ফেলছে। আফসোস, এ সুতো জোড়া দেওয়ার আর অবকাশ রইলো না।

বিয়ের মূল কার্যক্রম শেষে জুনায়েদ ও দিপা যখন ওয়েডিং ফটোশুটের জন্য তৈরী হচ্ছিলো তখন নিহা ও তাশদীদ গিয়ে তাদের দুজনকে অভিনন্দন জানালো। নিহা অবলীলায় মিথ্যে খুশির অভিনয় করলো জুনায়েদ ও দিপার সামনে। তাশদীদ সবটা বুঝেও কিছু বললো না৷ শুধু অপেক্ষায় থাকলো কখন নিহা মুখ ফুটে তাকে কিছু বলবে। অবশ্য তার এ অপেক্ষার পালা কিছুক্ষণের মধ্যেই শেষ হলো।
জুনায়েদ ও দিপার ফটোশুট শুরু হতেই নিহা তাশদীদকে বললো,
” চলুন, একটু বাইরে গিয়ে বসি। অনেকক্ষণ এখানে থেকেছি। দমবন্ধ লাগছে।”

তাশদীদ প্রত্যুত্তর করলো না। নিহার হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বেরিয়ে গেলো কমিউনিটি হল থেকে। পিছে জুনায়েদ চেয়ে রইলো তাদের পানে। তার দৃষ্টি গিয়ে ঠেকলো তাশদীদ ও নিহার হাতজুগলের উপর। হঠাৎ বুকে চিনচিনে মৃদু ব্যাথা অনুভব করলো সে। নিহার উদ্দেশ্যে আনমনে বললো,
” তোর আর আমার সফর এখান পর্যন্তই নিহা। এখন থেকে দুজনের পথ চিরদিনের জন্য আলাদা হয়ে গিয়েছে। ভালো থাকিস তুই৷ জানি, তুইও আমাকে ভালোবাসিস। কিন্তু যাবতীয় পিছুটানের কাছে তুই হেরে গিয়েছিস। হেরে গিয়েছি আমিও।”

নিহা ও তাশদীদ বেরিয়ে একটা কাঠের বেঞ্চিতে বসলো৷ দুজনে নিশ্চুপ রইলো বেশ কিছুক্ষণ। তাশদীদের বারংবার মনে হচ্ছে, এই বুঝি নিহা তাকে কিছু বলবে। এ কারণে আড়চোখে বারবার তার দিকে তাকাচ্ছে। বেশ কিছুক্ষণ অতিবাহিত হওয়ার পরেও নিহা যখন মুখ খুললো না তখন তাশদীদ নিহার হাতটা নিজের হাতের মুঠোয় পুরে বললো,
” কিছু কি বলতে চাও?”

নিহা একবার তাশদীদের পানে চাইলো। তাশদীদ দেখলো নিহার চোখজোড়া লালচে রঙ ধারণ করেছে। নাকের ডগায় গোলাপি বর্ণের দেখা মিলছে। হয়তো এক্ষুনি কান্না করে সব ভাসিয়ে দিবে সে!
তাশদীদের প্রশ্নের জবাবে নিহা নিবিড় অনুনয়ে পাল্টা প্রশ্ন করলো,
” আমি কি আপনার কাঁধে একটু মাথা রাখতে পারি?”

তাশদীদ মৃদু হাসলো। জবাব দিলো না সে। বরং নিহার পাশে খানিকটা এগিয়ে বসলো। নিহা এটাকে সম্মতি হিসেবে ধরে তার কাঁধে মাথা রাখলো। অনেক সময় ধরে বদ্ধ রাখা এক দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। মুহূর্তেই তার দু চোখ বেয়ে নোনাজল গড়িয়ে পড়লো। ফোঁপাতে লাগলো সে।
তাশদীদ বুঝতে পারছে নিহা কাঁদছে। কি কারণে কাঁদছে সেটাও তার অজানা নয়। সে নিহাকে থামালো না। বরং বললো,
” ওয়াদা করছি, আমার সর্বাত্মক দিয়ে চেষ্টা করবো, তোমাকে সারাজীবন সুখী রাখতে। হয়তো তুমি আমাকে ভালোবাসতে পারবে না। কিন্তু আমি তোমাকে সারাজীবন ভালোবেসে যাবো। সারাজীবন। ”

নিহা নীরব রইলো। প্রত্যুত্তর করার মতো পরিস্থিতিতে আসলে সে নেই। কিন্তু তাশদীদের এ কথা শোনার পর সে তাশদীদের হাতের মুঠো আরোও দৃঢ়ভাবে আগলে ধরে।

সূর্য অস্ত যাচ্ছে। সে সাথে অস্ত যাচ্ছে দিনটি। সে সাথে অস্ত যাচ্ছে নিহা জুনায়েদের অনুভূতি। যে অনুভূতিতে জুনায়েদের মনের কথা প্রকাশ্যে থাকলেও নিহার মনের কথা রয়ে গেলো আড়ালে। ডুবে গেলো নীরবে। পশ্চিমাকাশে সূর্যাস্তের সাথে নীরবেই মিটে গেলো নিহার অনুভূতি।
®সারা মেহেক
❤️সমাপ্ত❤️
গ্রুপ লিংক : https://facebook.com/groups/259972409591747/

( গল্পটিতে বাস্তব এন্ডিং দেওয়ার চেষ্টা করেছি। হয়তো অনেকের পছন্দ হবে না। কিন্তু আমার মতে পারিপার্শ্বিকতার দিক দিয়ে এটাই পারফেক্ট এন্ডিং।
আর এতদিন গল্প দিতে পারিনি রাইটিং ব্লকের কারণে।গতকাল নতুন গল্প দিয়ে সেটা কিছুটা হলেও গিয়েছে। নতুন গল্পটা সবই পড়ছেন তো?
#সে_আমার_অপরাজিতা
‘পর্ব:১’- https://www.facebook.com/100063464839918/posts/844782517647235/?app=fbl

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here