নীলচন্দ্র শেষ পর্ব

0
2457

নীলচন্দ্র
শেষ পর্ব
জাহান আরা

এতো কাছাকাছি থেকেও নীল অথবা চন্দ্র কেউই কাউকে চিনতে পারলো না,ভাগ্য ওদের নিয়ে যে মজার খেলা খেলছে তা কেউই বুঝতে পারে নি।






সিমির বাবা বিদেশ থেকে দেশে ফেরার পর সেদিন সন্ধ্যায় ইমতিয়াজ সাহেব সিমির আর নীলের এনগেজমেন্টের দিন ঠিক করেন সিমির বাবা শাহজাহান উদ্দিনের সাথে আলোচনা করে,২ দিন পর বৃহস্পতিবার এনগেজমেন্টের দিন ঠিক করা হয়।

শুভকে নিয়ে ঘুরাঘুরি করে বাসায় এসে দেখি বাসায় কিসের যেনো আয়োজন চলছে,পুরো বাড়িতে সাজসাজ রব পড়ে গেছে।কিছুই বুঝতেছি না আমি।

মা কে কিচেনে দেখে এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করতেই মা জানায় ২ দিন পরে আমার এনগেজমেন্ট।বাবার কড়া আদেশ আমি যাতে আপত্তি না করি আমার ইচ্ছে বাবা পুর্ণ করতে চেয়েছে কিন্তু চন্দ্র আমার ভাগ্যে লিখা নাই,তাছাড়া এরকম চরিত্রহীনা মেয়েকে কিছুতেই মানায় না এই চৌধুরী বাড়ির বৌ হিসেবে।

আমি প্রতিবাদ করার মতো কিছুই পেলাম না,আসলেই তো আমি জানি না চন্দ্রর কারো সাথে কোনো সম্পর্ক ছিলো কিনা।
কিন্তু আমার বিশ্বাস চন্দ্র এরকম মেয়ে না,ও এরকম করে নি।মনে মনে প্রতিজ্ঞা করে নিলাম এরপর যেখানে যে অবস্থায় আমি চন্দ্রকে দেখবো তক্ষুনি চন্দ্রকে কাজী অফিসে নিয়ে যাবো আর সিমির সাথে বিয়ে!!!
দেখা যাক আমার বাবা ইমতিয়াজ চৌধুরী কিভাবে বিয়ে করায় আমাকে।
বাবার থেকে সময় নেয়ার জন্য আমি অবশ্যই নাটক করে যাবো এখন।
গ্রামে গিয়ে আমার চন্দ্রর খোঁজ নিতে হবে,জানতেই হবে আমাকে সব।






পরেরদিন শুভকে পড়িয়ে আসতে নিতেই শুভর বড়বু রুমে আসে।শুভ রুম থেকে বের হয়ে যায়।

আমি ওনাকে সালাম করি।

শায়লাঃ মা তোমার নামটা কি তা আমার এখনো জানা হলো না।

আমিঃ জ্বী চন্দ্র আন্টি

আন্টিঃ বেশ সুন্দর নাম তোমার,তা ওই মুখখানা কি চন্দ্রর ন্যায়??

আমিঃ কি যে বলেন আন্টি।

আন্টিঃ তুমি কিছু মনে না করলে কি একটু নেকাব তুলবে আমার বড় শখ তোমাকে দেখার।আমার বড় বৌ মা তো ধর্ম কর্ম করার সময় পায় না আগামীকাল আবার ছোট ছেলের এনগেজমেন্ট,সিমিও এরকম আধুনিক মেয়ে অথচ আমি চেয়েছিলাম একটা ধার্মিক মেয়ে।আধুনিকতার ছোঁয়ায় যে নিজের মূল অস্তিত্ব কে ভুলে যায় নি।
যাক সেসব কথা,আমি এসেছি তোমাকে দাওয়াত দিতে আগামীকাল তোমাকে অবশ্যই আসতে হবে মা।

আমিঃ না আন্টি,আপনাদের এতো গেস্টের মাঝে আমাকে বড্ড বেমানান লাগবে।প্লিজ আন্টি আমাকে এসবে জড়াবেন না,আমার এসব অনুষ্ঠান,উৎসবে আগ্রহ নেই।

আন্টিঃ বেশ,তোমার ইচ্ছে। তবে তুমি আসলে আমি মন থেকে খুশী হতাম।

তুমি কি মা তোমার চাঁদ মুখখানা আমাকে দেখাবে না??

আমি কিছু না বলে নেকাব তুলে দিলাম,আন্টি অপলক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন।

সেই সময় শুভ ও রুমে এলো, হঠাৎ আমাকে দেখে শুভ ও ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে দাঁড়িয়ে যায়।আমি বের হয়ে আসি।






ল্যাপটপে বসে বসে অফিসের কাজ করছি এমন সময় শুভ রুমে আসে।

শুভঃ চাচ্চু আগামীকাল তো তোমার এনগেজমেন্ট তাই না??

আমিঃ হু।

শুভঃ চাচ্চু তুমি যদি সিমি আন্টিকে বিয়ে না করে আমার মিসকে বিয়ে করতে,মিসকে যদি চাচ্চু তুমি জীবনে একবার দেখতে চোখ সরাতে পারতে না,মাশাল্লাহ এতো অপরুপ উনি।

আমিঃ যা ভাগ এখান থেকে,আসছে মিসের সাফাই গাইতে,তুই ইদানীং আমার চাইতে তোর মিসের বেশী ভক্ত হয়ে যাচ্ছিস শুভ,এটা কিন্তু ঠিক না।

শুভঃ বিশ্বাস করো চাচ্চু,আমার মিসকে তুমি যদি একবার দেখতে তাহলে বিশ্বাস করতে আমাকে।

আমিঃ তোর মিসের চাইতে আমার মিসেস হাজার গুণ বেশী সুন্দরী।

শুভঃ কে সিমি আন্টি,দূর চাচ্চু,আমার মিসের ১০ ভাগের ১ ভাগ ও রূপ নাই তার,গুণের কথা বাদ দিলাম।

আমিঃ তোকে কে বলেছে তোর সিমি আন্টি আমার মিসেস??
আমার মিসেস তো আমার ভালোবাসার মানুষ হবে।

শুভঃ চাচ্চু বাজি ধরতে পারি আমি তোমার সাথে এটা নিয়ে আর আমি জানি আমি জিতবো।

আমিঃ ওকে বাজি।কিন্তু তোর মিসকে আমি কিভাবে দেখবো?

শুভঃ চাচ্চু তুমি ভুলে গেছো কেনো,আমার স্টাডি রুমে বাবা সিসি ক্যামেরা লাগিয়েছে আমি যাতে পড়ার সময় ফাঁকিবাজি করতে না পারি,আজকে মিস বড়বুর সামনে নেকাব তুলেছে,চলো আমরা ফুটেজ চেক করে দেখি।

আমিঃ বাহ গুড আইডিয়া তো শুভ,তোর মাথায় এতো বুদ্ধি কিভাবে এলো??

শুভঃ আমার মিস যে বুদ্ধিমতী তাই চাচ্চু।

আমিঃ আগে তো বলতি আমার চাচ্চু যে বুদ্ধিমান, নতুন মিস পেয়ে পল্টি মেরে দিলি তুই না??
চল এবার।

শুভ আর আমি সিসিটিভি ফুটেজ চেক করতে নিলাম,আজকের ফুটেজ প্লে করতেই আমি তীব্র এক শক খেলাম।
এ যে আর কেউ না,স্বয়ং আমার চন্দ্র!!!

আমিঃ শুভ,এই তো আর কেউ না,আমার চন্দ্র শুভ,তোর মিসের নাম চন্দ্র,রাইট???

শুভঃ হ্যাঁ চাচ্চু,চন্দ্র বিনতে হাবিব

আমিঃ শুভ,এতোদিন ধরে আমার চন্দ্র আমার চোখের সামনে আর আমি জানি না!!!

শুভঃ চাচ্চু এখন কি করা যায়,আগামীকাল তোমার এনগেজমেন্ট ।

আমিঃ তুই আমাকে এটা বল তোর মিস আসবে আগামীকাল??

শুভঃ না চাচ্চু,বড়বু বললো যে উনি মিসকে বলেছে কিন্তু মিস নাকি বলে দিয়েছে উনি এসবে এটেন্ড করতে ইউজুয়াল না,তাই আসতে পারবে না।

আমিঃ বলেছিলাম না এটা আমার চন্দ্র শুভ।

শুভঃ এখন কি করবে চাচ্চু???

আমিঃ শুন,আমি প্ল্যান করতেছি এনগেজমেন্ট ক্যান্সাল করার তুই আমাকে হেল্প করবি।

শুভ আর আমি মিলে কঠিন এক প্ল্যান করে নিলাম।
ড্রাইভারের থেকে চন্দ্রর এড্রেস জেনে নিলাম।

পরদিন আমার এনগেজমেন্ট।

সকালে ঘুম থেকে উঠেই শুভ গলা ফাটিয়ে চিৎকার করতে শুরু করলো,ওর নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে বলে।

শুভ আমাদের সবার নয়নের মণি।

সবাই তক্ষুনি শুভকে নিয়ে হাসপাতালে ছুটে গেলো।
শুভকে ইমিডিয়েটলি অক্সিজেন দেওয়া হলো কিন্তু আমি জানি আজকে সারাদিনে শুভকে বাসায় আনতে পারবে না আর।
ড্রাইভার সবাইকে নিয়ে গেলো,আমি ড্রাইভারের বদলে চন্দ্রকে অফিসে নিতে গেলাম।

শুভর অসুস্থতা দেখে বাবা সিমির বাবাকে কল দিয়ে এনগেজমেন্ট ক্যান্সেল করে দিলেন।

হর্ণ বাজাতেই চন্দ্র নেমে এলো,অনেকদিন পর আমি আমার চন্দ্রকে দেখতেছি আজকে।

চন্দ্রকে নিয়ে সোজা ভাইয়ার অফিসে গেলাম।

চন্দ্র খেয়াল ও করলো না আজকে যে ড্রাইভার চেঞ্জ।

চন্দ্র গিয়ে ওর ডেস্কে বসলো আমি ভাইয়ার কেবিনে বসে চন্দ্রকে টেলিফোনে ডাকলাম।

কেবিনে ঢুকে চন্দ্র আমাকে দেখে থতমত খেয়ে গেলো।

চন্দ্রঃ স্যার,আপনি??
আজকে না আপনার এনগেজমেন্ট??

আমিঃ হওয়ার কথা ছিলো কিন্তু হবে না এখন।

চন্দ্রঃ কেনো স্যার??

আমিঃ আমি আমার ভালোবাসার মানুষকে খুঁজে পেয়েছি।

চন্দ্রঃ কিভাবে স্যার??

আমি কিছু না বলে গিটার বাজাতে শুরু করলাম।
সেই পুরনো সুর।

চন্দ্র বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে গেলো।

আমিঃ চিনতে পেরেছো চন্দ্র???

চন্দ্রঃ কতো খুঁজেছি আপনাকে মনে মনে শুধু আল্লাহ জানে।

আমিঃ আমি যে কতো কষ্ট পেয়েছি তা তোমাকে কিভাবে বুঝাবো চন্দ্র??
চন্দ্র তোমাকে আমার একটা কথা বলার আছে তার আগে।

চন্দ্রঃ বলুন

আমি চন্দ্রর বাবার সাথে ঘটে যাওয়া আমার কাজটি চন্দ্রকে ব্যাখ্যা করে বললাম।
তারপর ওর চাচীর বলা সব কিছু বললাম

চন্দ্র সব বুঝতে পারলো।

তারপর চন্দ্র আমাকে সব কিছু বললো।

চন্দ্রঃ অনেক দেরি হয়ে গেছে এখন তাই না।

আমিঃ না চন্দ্র,সব ঠিক আছে আমাদের।

চন্দ্রঃ কিন্তু আপনার বাবা মা???

আমিঃ তুমি ভয় পেও না,সব ঠিক হয়ে যাবে।

হাসপাতালে ফোন দিয়ে মা কে বললাম শুভকে দিতে ফোন
শুভকে বললাম,শুভ সব মিটে গেছে সবাইকে নিয়ে বাসায় আয় ফিরে।

আমি ও চন্দ্র কে নিয়ে বাসায় গেলাম।

বাবা সব শুনে চুপ করে রইলো

ভাবীঃ আমি অথচ ভেবেছিলাম চন্দ্র কে আমার ছোট ভাই তিশানের বৌ বানাতাম,যাই হোক,জা তো হচ্ছে এবার।

মাঃ আমার কিন্তু বৌ মা পছন্দ হয়েছে।

ভাইয়াঃ না সবই ঠিক আছে,কিন্তু সমস্যা একটাই আমার অফিসের ডায়মন্ড এখন নীলের অফিসে ট্রান্সফার হয়ে যাবে,নীলের বিজনেস বড় হবে আমার চাইতে।

আমিঃ চন্দ্র যদি চায় ও ওর আগের কোম্পানিতে থাকতে পারে, তবে আমি অবশ্যই ওকে তোমার চাইতে হাই স্যালারি অফার করছি আমার কোম্পানিতে জয়েন করার জন্য।

চন্দ্রঃ সরি স্যার,আমি আমার আগের কোম্পানিতে যেসব ফ্যাসিলিটি পাচ্ছি আপনার কোম্পানি তে সেসব আপনি দিতে পারবেন না তাই আমি আমার জবটা ছাড়ছি না।আপনার হাই স্যালারি আমি রিফিউজ করছি

আমিঃ মিস চন্দ্র,আমি আপনাকে পার্সোনাল কার দিবো।

চন্দ্রঃ দরকার নাই স্যার।

বাবাঃ আমাকে ছাড়াই তো দেখছি সবাই সব পরিকল্পনা করে ফেলেছো।
তো মিস চন্দ্র,আমার এখনো ফ্যামিলি নামের একটা বিজনেস কোম্পানি আছে আর আমি চাই আপনি সেই কোম্পানির চেয়ারম্যানের চেয়ারে বসে আপনার শাশুড়ী আম্মাকে রেস্ট দিন,তার পাশাপাশি আপনি চাইলে আপনার জবটা কন্টিনিউ করতে পারেন।

চন্দ্রঃ আমি আপনার অফার গ্রহণ করছি স্যার।

আমিঃ আমার অফার কেউ একসেপ্ট করে না কেনো ভাইয়া??

ভাবীঃ তোমার সাথে আজীবন একসাথে থাকার অফার যেখানে গ্রহণ করে নিয়েছে,তো আর কি বাকী থাকে ছোট সাহেব?

বাবাঃ কাজী আসতে এতো দেরী হচ্ছে কেনো শুভ্রা দেখো তো একটু।

পারিবারিকভাবে ছোট আয়োজনে আমাদের বিয়ে হয়ে গেলো। আজ আমাদের বাসর রাত।
আমি চন্দ্রর কাছে যেতে পারছি না,এতো সাধনার,অপেক্ষার রাত আমার অথচ চন্দ্র এখনো আর কাছে আসছে না।

কি আর বলবো দুঃখের কথা,আমার বৌ এখন বসে বসে তার অফিসের ফাইল দেখছে।
আর আমি বসে বসে আকাশ থেকে নেমে আসা একটা চন্দ্রকে দেখেছি।
এই মুখ দেখেই আমি ৭ জনম অনায়াসে কাটিয়ে দিতে পারি।

পরিশিষ্টঃ আমার বৌ আমার অফিসে যায় না,তার আগের অফিস মানে ভাইয়ার অফিসে যায়,আমি বেচারা একা একা অফিস করি,আর মনে মনে ভাইয়াকে অসংখ্য বকাবকি করি,ভাইয়াকে চন্দ্র বড় ভাই ডাকে যেহেতু ওর ভাইবোন নেই,আর আমাদের ও বোন নেই,তাই ভাইয়া চন্দ্রকে ছোট বোন বলে,ওনারা ভাইবোন সব কিছুতে এক জোট থাকে,অফিস থেকে এসেও সে আমার কাছে আসে না,সে তার ডিউটি পালন করে,শুভকে পড়ায়।
তারপর তার মেইন অফিসে যায় রান্নাঘরে,রান্নাবান্না করে।
তারপর অফিসের কাজ করে বসে বসে রাতে,আর আমি বসে বসে চন্দ্র দেখি।

আমি কিছু একটা বললেই সোজা বাবার কাছে নালিশ জানায়।
বাবা তখন হুকুম দেয় ওনার সংসার কোম্পানির চেয়ারম্যানকে বকা দেওয়ার অপরাধে আমার আজকে এক বেলা খাবার বন্ধ,এবং সেই সাথে বাসার সবাইকে আমার বাহিরে ডিনার করাতে নিয়ে যেতে হবে।

বাবা,মায়ের মেয়ের অভাব চন্দ্র কি নিখুঁতভাবে পূরণ করে দিয়েছে ভাইয়া ভাবীর বোনের অভাব,শুভর টিচার+বেস্ট ফ্রেন্ড।

আর আমার???

থাক সেটা আমার কাছেই।

ও হ্যাঁ,আমাদের চৌধুরী পরিবারে এখন আরেকটা খুশীর জোয়ার বইছে।

বুঝতে পারছেন নিশ্চয় আপনারা??
থাক,এসব সবাইকে বলে বেড়ালে চন্দ্র আবার বাবার কাছে নালিশ দিবে।

আলহামদুলিল্লাহ,আল্লাহ বান্দার সব ইচ্ছে পূর্ণ করার মালিক।জীবন আসলেই সুন্দর!!!

(সমাপ্ত)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here