নীল আঁচল,পর্ব_৩

0
2100

নীল আঁচল,পর্ব_৩
সুলতানা সিমা

নীলের বিয়ের পনেরো দিন চলছে। এতেই তাঁর জীবনটা তেনা তেনা হয়ে গেছে। হাঁটতে, বসতে, খেতে, ঘুমাতে সবখানে শুধু নীল নীল আর নীল। মাঝে মাঝে নীলের মনে হয়,নিলা তার উপর কোনোকিছুর প্রতিশোধ নিচ্ছে। আবার মাঝে মাঝে ভাবে, যে মানুষটা সম্পুর্ণ নীল ভূত, তাঁর মাথায় তো নীলের রংয়ের পাগলামো থাকবেই। নীল রংয়ের খাবার থেকে বাঁচতে নিলার সব আদেশ মানতে হয় নীলকে। আর সারাদিন নীল নীল নীলাঞ্জনা গান গাইতে হয়। আজকাল নীল আঁচলের কষ্টটা অনুভব করতে পারে। সারাদিন আঁচলের পাশে এই গান গান গেয়ে ঘ্যানঘ্যান করতো। আঁচল বিরক্ত হতো বলে কতই না ঝগড়া করতো। এখন বুঝতে পারে, সব সময় এক গান হোক বা যাই হোক শুনতে ভালো লাগেনা, বিরক্ত লাগে। তবে এই নীল ভূতের মনে হয় বিরক্ত বলে কিছু নাই। নীল তো শুধু বিরক্ত না। নীল শব্দটার প্রতি তাঁর একটা তিক্ততা জন্ম নিয়েছে। কেউ তাঁকে নীল বলে ডাকলে সে ক্ষেপে যায়। তাঁর কাছে মনে হয় নীল বলে ডাকছে মানে তাঁকে নিয়ে মজা উড়াচ্ছে। রাস্তাঘাটে যদি কারো সাথে দেখা হয় আর সে বলে, “এই নীল শুন” তখন তাঁর মেজাজ সপ্তম আকাশে চড়ে যায়। আর শুরু হিয় মারামারি। এক কথায় নীল৷ এখন নীল শব্দটাকে ঘৃণা করে।

নীল পেয়াজ কাটতাছে আর কাঁদতাছে। তাঁর নীল রংয়ের ভূত বসে বসে আপেল খাচ্ছে। নীলের ইচ্ছে করছে গলাটা মাথা থেকে আলাদা করে দিতে। নিলা নীলকে তর্জুনি আঙুলের ইশারায় ডাকলো। নীল নাইফ রেখে চোখ মুছে মুছে এসে হাত সামনে এটে মাথা নিচু করে দাঁড়ালো। মনে মনে দোয়া করতাছে, গান গাইতে যেন না বলে। নিলা একটা আঙুর নিয়ে নীলকে বলল” হাঁ করো।” নীল হাঁ করে খেয়ে নিলো। নিলা বলল” এবার এটা খেতে আমাকে কিছু একটার সাথে তুলনা করে প্রশংসা করো।” নীল বলল
_বুঝিনি।
_এই যেমন ধরো,তুমি ফুলের মতো সুন্দর। তুমি হীরার চেয়েও চকচকা। এইরকম কিছু বলো।”
নীল একটু ভাবলো তারপর বলল”
“_তুমি আকাশের থেকেও নীল। আমাদের টয়লেটের কমোডের থেকেও নীল।” নীল আঙুর মুখে ঢুকাচ্ছিলো। এটা শুনে তাঁর হাত থেমে গেলো। রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে বলল “আমারে কমোডের সাথে তুলনা করলি? আমারে দেখতে তোর কাছে কমোডের মতো লাগে? আমি কমোড?” নীল শুকনো একটা ঢোক গিলে বলল” তুমি কমোড হবা কেন। তুমি তো ইলিশ মাছ। তুমি জাতীয় মাছ। খেতে মজা, কিন্তু অনেক কাঁটা।”
_কীইইইইইইই? তুই আমারে এইটা বললি। শেষমেষ আমাকে মাছের সাথে তুলনা করলি? ওই তুই কোনোদিন আমারে খাইছিলি?
_নীল দ্রুত কয়েকবার না সূচক মাথা নেড়ে বলল” না না না মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেছে।
_মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেছে? আজ তোকে আমি নীল ভাত খাওয়াবো।
_না না না প্লিজ। তুমি যা বলবা তাই করবো। ভাত নীল না প্লিজ।
_তুই শুধু ভাত না, এখন থেকে সব নীল খাবি। “নীল কাঁদো কাঁদো গলায় বলল”
_বউউউউউউউ। বউউউউ রেএএ। প্লিজ বউ পাষাণ হইওনা।
_কেঁদে লাভ নাই। যা রুমে যা।
_বউ প্লিজ।
_তুই যাবি নাকি কুন্তি লাগাবো।” নীল আর দাঁড়ালো না। কাঁদো কাঁদো মুখ করে চলে গেলো রুমে। কিছুক্ষণ পরে তাঁর বউ তাঁকে এনে এক প্লেট ভাত দিয়ে গেলো। সাথে ডিম ভাজি। আহহহ ডিম ভাজার ঘ্রাণে ইচ্ছে করছে এখনই খেতে। কিন্তু ভাত দেখে তো ইচ্ছে গুলো অসহায় তাঁকে ফেলে উড়ে যাচ্ছে।

নীল প্লেট হাতে নিয়ে কাঁদো কাঁদো মুখ করে বসে আছে। নীলের বাবা মা আসলেন। নীলের মা বললেন “বাবা নীল” নীল ক্ষেপে গেলো। হুংকার দিয়ে বলল “ওই নীল ডাকো কেন?” নীলের বাবা সহজ ভঙ্গিতেই বললেন” তোকে নীল ডাকবে না তো কাকে ডাকবে”
_আমি কী জানি কাকে ডাকবা? আমাকে নীল ডাকবা না। “প্লেট হাত থেকে রেখে বাবা মায়ের সামনে দাঁড়িয়ে বলল”আমার নাম নীল কে রাখছে? ” নীলের মা বললেন”
_আমি না তো বাবা রাখছে। “নীল রাগি লুকে তাঁর বাবার দিকে তাকালো। নীলের বাবা ভয়ার্ত চোখে তাকিয়ে বললেন” কিছু কী হইছে বাবা নীল?”
_উফফফফফফ। আমাকে কিছু বলতে হলে একদম এই নাম ব্যবহার করবা না। আর নীল কী নাম রাখছো হ্যাঁ? আর নাম নাই? লাল, হলুদ,বেগুনি,সবুজ,টিয়া কত রং তো আছে। নীল রাখলা কেন? আরে কালা তো রাখতে পারতা। লোকে সুন্দর করে ডাক দিতো কালা ভাই।
_কিন্তু তুই তো সাদা হইছিলি বাবা তাই কালা রাখি নাই।
_তো নীল রাখলা কেন? নীল হইছিলাম? সাদা রাখলে কী হইতো। আমি কালা হইয়া যাইতাম? যাও বের হও আমার ঘর থেকে।

“নীলের বাবা মা আর দাঁড়ালেন না। নীলের রাগ উঠে গেছে মানে এখন সে যা মুখে আসবে তাই বলবে। এখন যাওয়াই ভালো। পড়ে আবার আসবেন। বাসায় একটা নীল রংয়ের ভূত দেখতে দেখতে ভয়ে মরে যাচ্ছেন কিছুদিনের জন্য বাইরে কোথাও যেতে চান।

নীলের বোন (নীরা) ছাদে দোলনায় বসে বসে বই পড়ছে। তাঁর পোষা বেড়াল একটু পর পর এসে তাঁর কোলে উঠছে তো এদিকে দৌঁড়াচ্ছে ওইদিকে দৌঁড়াচ্ছে। বেড়ালটা সাদা রংয়ের। নীরার সব থেকে প্রিয় বন্ধু হচ্ছে এই বেড়াল। বেড়ালটার নাম রেখেছে ক্যাটবেরী। নীরা যখন কোলে নিবেন না তাঁর পিছু পিছু হাঁটবে। শুধু নীরা নয় তাঁর ঘরের সব মানুষের কোলে উঠতে পছন্দ করে ক্যাটবেরী। নীরার মনোযোগ বইয়ের দিকে, বেড়ালটা নেমে চলে গেলো তাঁর খেয়াল নেই।

আঁচল রান্না শেষ করে এসে বসেছে মাত্র। নীল এখনো প্লেট সামনে রেখে বসে আছে। ডিম খেয়ে ফেলছে ভাত ছাড়াই। নিলার মনে মনে হাসি পাচ্ছে। আসলে সে নীলকে কিচেন থেকে তাড়ানোর জন্য এই ব্যবস্থা করেছে। আর পাঁচদিন পরে নীলের বার্থডে। তখন সে নীলকে অনেক বড় সারপ্রাইজ দেবে। ভেবেই আনন্দ লাগে আঁচলের, যখন নীল জানবে সে আঁচল তখন কেমন রিয়েক্ট করবে। একটা সাদা বেড়াল এসে দৌঁড়ে ঘরে ঢুকলো। আঁচল প্রথমে কিঞ্চিৎ ভয় পেয়ে যায়। লাফ দিয়ে খাটে পা তুলে। বিড়াল এসে নীলের কোলে উঠে। আঁচল বলল” এটা কার বিড়াল?” নীলের মনে হলো আঁচল ভয় পেয়েছে। তারমানে বেড়াল দেখিয়ে এখন থেকে আঁচলের থেকে বাঁচা যাবে। নীলের মাথায় শয়তানি বুদ্ধি আসতেই বলল “এটা আমার বিড়াল। জানো,এটা আমার খুব প্রিয় বিড়াল।
_কই আগে তো কখনো দেখিনি।
_কেমনে দেখবে, ওঁর তো আলাদা একটা ঘর আছে।
_অহ আচ্ছা।
বেড়ালটা নীলের কোল থেকে নেমে বেরিয়ে গেলো। একটুপর আঁচলও বেরিয়ে গেলো। নীলের বউ বেড়াল ভয় পায় ভাবতেই তাঁর লুঙ্গিডান্স দিতে ইচ্ছে করছে। আহ এখন থেকে সে বেড়াল দেখিয়ে ভয় দেখাবে। খুশিতে নীল কলার নাড়াতে নাড়াতে বলল ” নীলকে ভয় দেখানো,নীলকে ধমক দেওয়া। নীল একাই একশো হতে পারলো না তো কি হইছে। নীলের একটা বেড়াল আছে।

নীরা বই বন্ধ করে পায়ে জুতা পড়তে যাবে তখন দেখলো নীল রংয়ের একটা বেড়াল তাঁর দিকে দৌঁড়ে আসছে। নীরা আহহহহহ বলে চিৎকার দিয়ে জুতা বই সব ফেলে দৌঁড় দিলো। নীরা ছাদের চারদিকে দৌঁড়াচ্ছে বেড়াল তাঁর পিছু পিছু দৌঁড়াচ্ছে। নীরার চিৎকার শুনে তাঁর বাবা মা সবাই আসলেন ছাদে। নীরা সিঁড়ির দিকে দৌঁড় দিলো। বিড়ালও সেদিকে দৌঁড় দিলো। সিঁড়ির ওখানে নীলের বাবা মা ছিলেন তাঁরাও দৌঁড় দিলেন। উনারা আগে আগে বেড়াল পিছে পিছে দৌঁড়াচ্ছে। নীলের বাবার লুঙ্গি পায়ের সাথে আটকে গিট খুলে গেলো। গেঞ্জি দাঁতে কামড়ে লুঙ্গি পেছাতে পেছাতে দৌঁড়াচ্ছেন। মোটা পেটটা নড়ে নড়ে উঠছে। নীলের মা দৌঁড়াচ্ছেন আর বলছেন ” লা হাওলা লাকুয়াতা ইল্লা বিল্লাহিল আলিউল আজিম।” দৌঁড়াতে দৌঁড়াতে উপর থেকে নিচে চলে আসলেন। বেড়াল নীরার দিকে দোঁড়াচ্ছে। সে তাঁর বেড়ালটা চিনতে না পেরে বার বার ক্যাটবেরী ক্যাটবেরী বলে ডাকছে। যতই ক্যাটবেরী ডাকছে বেড়াল ততই তাঁর দিকে যাচ্ছে। মা মেয়ে বাপ মিলে ঘরের একোণা থেকে ওকোণায় দৌঁড়ে যাচ্ছেন। নীল ঘর থেকে বের হয়ে দেখলো এই কান্ড । কিসের জন্য দৌড়াচ্ছেন জিজ্ঞেস করার আগেই নীলের চোখে পড়লো বেড়ালটা। নীল নিচে আসলো। সে নিচে আসতেই তাঁর দিকে এগিয়ে এলেন তাঁর বাবা মা বোন। পিছু পিছু দৌঁড়ে আসলো বেড়ালও। রাগান্বিত বেড়াল রাগে শরীরের পশম দাঁড়িয়ে আছে। নীল বেড়াল দেখতে কত ভয়ানক লাগছে। বিড়ালটা ভয়ানক এক অদ্ভুত স্বরে বললো “মিউউউউউ” সাথে সাথে নীল লাফ দিয়ে উঠে “ভূউউউউউউত” বলে দৌঁড় দিলো।

চলবে…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here