#নীল_আকাশের_পরী
#এম_আর_এ_আকিব
#পর্ব_৬
শব্দসংখ্যা: ১৩৩১
সকালবেলা পাখির কিচিরমিচির ডাকে ঘুম ভাঙলো আকিবের৷ তার শরীরটা কেমন যেন অভস-অভস লাগছে৷ সারারাত আবুল-তাবুল কী যেন স্বপ্নে দেখেছে কিছুই মনে নেই। হঠাৎ গতরাতের ঘটনাটি মনে পড়লো। ওই পরীটা কী বলল! এতদিন ধরে যাদের বাবা-মা বলে জেনে এসেছে ওরা তার বাবা-মা নয়? সায়রা তার বোন নয়? সে ভাবলো এজন্যই বোধহয় তাকে এতোটা আদর করা হয় না যতোটা সায়রাকে করা হয়। এতবছর ধরে সে এ সংসারে আছে অথচ এই কথাটি তার একবারও মনে হয়নি৷ সে এতদিন ভাবতো সায়রা ছোট বলেই হয়তো তাকে বেশি আদর করা হয়৷ কিন্তু এখন ওই পরীর কথা শুনে সবকিছু যেন তার কাছে পরিষ্কার হয়ে গেছে।
মানুষের মনটা খুব-ই অদ্ভুত। এতবছর কাছে থেকেও যা বুঝা যায় না, অন্য কেউ বলে দিলে যেন খুব সহজেই তা পরিষ্কার হয়ে যায়৷ আকিবের ভাবতেও কান্না আসছে যে ওরা তার বাবা-মা নয়। তারা সায়রাকে বেশি আদর করলেও তাকে আপনের মতোই ভালোবাসেন। তাই তো এতদিনেও সে এসবেএ কিছুই বুঝতে পারেনি। কিন্তু তার আসল বাবা-মাকে?
আকিব ফ্রেশ হয়ে খাবার টেবিলে গিয়ে নাশতা করে নিলো৷ খাওয়ার সময় সে কারো সাথে কোনো কথা বলল না। আজ কেন জানি সবাইকে অনেক পর মনে হচ্ছে৷ মনে হচ্ছে আসলেই যেন আকিব ওদের আপন কেউ না। খাওয়া শেষ করে সে ব্যাগ নিয়ে কলেজে চলে গেল।
কলেজে যেতেই দেখা হলো ঐশীর সাথে। বরাবরের মতোই আজ ঐশীর মুখে হাসি৷ কিন্তু আজ আকিবের কাছে সেই হাসি ভালো লাগছে না। গতকাল রাতেও সে ঐশীর কথা ভাবতে ভাবতে লেখাপড়ায় মনোযোগ দিতে পারেনি। ভেবেছিল কখন ঐশীর সাথে দেখা হবে। অথচ আজ ঐশীকে দেখেও তার মধ্যে সে অনুভূতি কাজ করছে না৷ আসলে মন খারাপ বিষয়টা খুব-ই অদ্ভুত, মন খারাপটা যদি গুরুতর হয় তাহলে প্রিয় কোনো জিনিস পেলেও মনটা ভালো হয় না।
আকিবকে এমন মনমরা হয়ে থাকতে দেখে ঐশী বলল, “কী? মন খারাপ না-কি?”
শুকনো হাসি হেসে আকিব বলল, “কই? না তো।”
ঐশী বলল, “দেখে তো মনে হচ্ছে মন খারাপ।”
আকিব বলল, “আরে না। আমি ঠিক আছি।”
ঐশী আর কথা বাড়ালো না। একজন যদি তাকে সেচ্ছায় কোনো কিছু বলতে না চায়, তাহলে তাকে জোর করে কী লাভ!
প্রসঙ্গ পালটে ঐশী বলল, “আচ্ছা, তোমার না রাতে কোনো এক পরীর সাথে দেখা করতে যাওয়ার কথা ছিল৷ গিয়েছিলে?”
প্রশ্নটা শুনে আকিব কিছুক্ষণ চুপ হয়ে রইলো। সে কী বলবে ভেবে পাচ্ছে না৷ যদি বলে পরীকে দেখেছে, তাহলে তো তাকে সব ঘটনা খুলে বলতে হবে। আর যদি বলে দেখেনি তা-ও একটা লজ্জার ব্যাপার। প্রথম দিন-ই ঐশীকে সবকিছু খুলে বলাটা তার ভুল হয়েছে৷ এখন তো না বলে উপায় নেই। তবে একটা জিনিসে আকিব কিছুটা হলেও স্বস্তি পাচ্ছে। সেটা হলো ঐশী খুব-ই বিশ্বস্ত। ঐশী কাউকেই এ ঘটনা বলবে না। তাই আকিব সিদ্ধান্ত নিলো ঐশীকে সব বলে দিবে। কারো কাছে নিজের দুঃখের কথা শেয়ার করলে তা-ও যদি একটু দুঃখ লাঘব হয়।
আকিবকে ভাবতে দেখে ঐশী বলল, “কী হলো? চুপ করে আছ কেন? কোনো কারণে ভয় পেয়েছ?”
ম্লান হেসে আকিব বলল, “না, ভয় পাবো কেন? কিন্তু গতকাল যা দেখেছি বা শুনেছি তা বিশ্বাসযোগ্য না।”
আকিবের হাতের ওপর হাত রেখে ঐশী বলল, “আমি তোমাকে বিশ্বাস করি আকিব। আমি জানি, তুমি একটা কথাও বানিয়ে বলো না। যা বলো সব সত্যি বলো।”
ঐশী যখন আকিবের হাতের ওপর হাত রাখলো তখন তার শরীরে অন্যরকম এক শিহরন বয়ে গেল। তার হৃদ স্পন্দন যেন কয়েকগুণ বেড়ে গেল। একটা সুন্দরী মেয়ে তার হাতের ওপর হাত রাখছে তা ভাবতেই তার কেমন যেন লাগছে। কিন্তু পরক্ষণেই একটি কথা তার সমস্ত অনুভূতিকে মাটি করে দিলো। তার মনে পড়ে গেল নিশির বলা সেই কথাটি। “তুমি সাধারণ কোনো মানুষ নয়৷ তাই তুমি কোনো মেয়েকে নিয়ে অন্য কোনো স্বপ্ন দেখবে না।
আকিবকে এভাবে অন্যমনস্ক হয়ে থাকতে দেখে ঐশী বলল, ” কী এমন ভাবছ? বলো না আমাকে সবকিছু।”
আকিব বলল, “কথাটি একদম অদ্ভুত।”
ঐশী বলল, “আরে তুমি বলবে তো আগে, না-কি?”
আকিব বলল, “আমি সাধারণ কোনো মানুষ না।”
কথাটি শুনে ঐশী ভ্রু কুচকে বলল, “মানে?”
আকিব স্পষ্ট ভাভে বলল, “ওই পরীটা বলেছে যে আমি সাধারণ কোনো মানুষ না।”
কথাটি শুনে ঐশী অট্টহাসিতে ফেটে পড়লো। তার হাসি যেন থামছেই না। আকিব বলল, “বলেছিলাম না? তুমি বিশ্বাস করবে না কথাটা। এটা বিশ্বাস করার মতো না।”
অনেক কষ্টে ঐশী হাসি থামিয়ে বলল, “তুমিই বলো এটা কোনো কথা? এই তো তুমি আমার সামনে বসা একজন জলজ্যান্ত মানুষ। এখন যদি কেউ বলে তুমি মানুষ না, এটা কে বিশ্বাস করবে বলো? তুমি নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করো। তুমি কি এটা বিশ্বাস করেছ?”
আকিব কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল, “বিশ্বাস না করলেও করতে হতো। তুমি তো পুরো ঘটনা শুনোনি৷”
ঐশী বলল, “তুমি বললে তো শুনবো। বলো না।”
তারপর আকিব ঐশীকে রাতের সমস্ত ঘটনা খুলে বলল। সব ঘটনা বলার পর বলল, “তোমার কী মনে হয়? ওই নিশি পরীটা কি সত্যি বলছে?”
ঐশী কিছুক্ষণ ভেবে বলল, “কী আর বলবো? নিশ্চিত করে কিছুই বলা যাচ্ছে না৷ তবে ও যেহেতু বলছে যে ৩ মাস ১৮ দিন পর তুমি স্বপ্নে সব ঘটনা জানতে পারবে তাহলে এতদিন একটু অপেক্ষা করো। সমস্যা কী?”
আকিব বলল, “কিন্তু ও তো বলেছে ওর সাথে প্রতিরাতে দেখা করতে হবে।”
“তাহলে করো না। সমস্যা কী? পরীর সাথে দেখা হবে এ তো আনন্দের ব্যাপার। আমার না পরী দেখার খুব শখ। আমাকে দেখাবে?”
আকিবের মনে নিশির বলা শেষ কথাটি বারবার ঘুরপাক খাচ্ছে। সে চায় না নিশির সাথে ঐশীর পরিচয় করিয়ে দিতে। নিশির কথায় মনে হয় সে আকিবকে ভালোবাসে। এজন্যই তো মেয়েদের নিয়ে ভাবতে মানা করলো। এখন যদি নিশির সাথে ঐশীর পরিচয় করিয়ে দেয় তাহলে তো মহাবিপদ। তাই সে ঐশীকে বলল, “আরে পরী দেখে কী করবে? এত রাতে তুমি বাড়ি থেকে বের হবে কীভাবে? আর ভয়ও তো পেতে পারো। বাদ দাও।
ঐশী বলল, “আরে আমি তোমার মতো ভীতু না। তবে হ্যাঁ, রাতে বের হতে পারব না এটাও ঠিক। আমাকে তো দিনের বেলাও কলেজ ছাড়া অন্য কোথাও যাওয়ার অনুমতি দেওয়া হয় না। দেখো না, আমার কোনো বন্ধু কিংবা বান্ধবীও নেই। শুধু তুমি ছাড়া।”
আকিব বলল, “কেন? বান্ধবী থাকলেও সমস্যা না-কি?”
“কী জানি! আমার বাবা মনে করেন আমি যদি খা’রাপ কোনো বান্ধবীর পাল্লায় পড়ে খা’রাপ হয়ে যাই৷ এজন্য।”
“বান্ধবীও খা’রাপ হয় না-কি?
“এটা আমার আব্বুকে কে বুঝাবে? উনি বলেন, বান্ধবীও না-কি খা’রপ হয়।”
“কী জানি! তা আমার সাথে মিশো যে?”
“আসলে কী করবো বলো? এতবছর লেখাপড়া করে আমার কোনো বন্ধু কিংবা বান্ধবী নেই। খা’রাপ লাগে না? আমারও তো কারো সাথে মিশতে ইচ্ছে করে। সারাদিন শুধু লেখাপড়া আর চারদেয়ালের মধ্যে বন্ধি থাকতে কী ভালো লাগে? তাই তো তোমার সাথে কথা বলি।”
“তা এজন্য বান্ধবী বানাতে পারতে। আমাকেই কেন বেছে নিলে?”
“আসলে প্রথম দিন-ই তোমার সাথে আমার পরিচয় হয়েছে তাই। আর তুমি যে একটু বোকাসোকা না? এজন্য আমার ভালো লাগে। হিহিহি।”
ঐশী হাসছে। আকিব বোকাসোকা বলেই ঐশী হাসছে। কিন্তু এতে আকিবের একটুও খা’রাপ লাগছে না৷ বরং ভালো লাগছে। কিন্তু স্বভাবতই আকিবের এখানে ভালো লাগার কথা না! আকিব নিজেই নিজেকে অবেক সময় বুঝতে পারে না। সে কি ঐশীকে ভালোবাসে? ভালো না বাসলে ঐশীর এমন কথায় সে আনন্দ পাচ্ছে কেন? ভালোবাসার মামুষের যেকোনো কথা-ই তো ভালো লাগে। এই যেমন- যখন কেউ কাউকে পা’গল বলে তখন স্বভাবতই সে রে’গে যায়। কিন্তু ভালোবাসার মানুষটি যখন পা’গল বলে তখন কিন্তু রা’গ হয় না। বরং ভালোবাসা বৃদ্ধি পায়। আকিবেরও ঐশীর কথায় ভালোই লেগেছে। নিজে বোকাসোকা হওয়ার জন্য সে যেন নিজেকে ধন্যবাদ দিচ্ছে। আজ বোকাসোকা বলেই তো ঐশীর মতো এত মিষ্টি একটা মেয়েকে বন্ধু হিসেবে পেয়েছে। কিন্তু শুধুই কি বন্ধু? না কি আরো অনেক কিছু? এ প্রশ্নের উত্তর আকিবের কাছে নেই। আর সে এ প্রশ্নের উত্তর জানতেও চায় না। এই তো যেমন চলছে তেমন চলুক না। ক্ষতি কী?
কিন্তু তারপরেও তাকে বোকাসোকা বলার জন্য ঐশীকে জিজ্ঞেস করতেই হয়। তাই সে ঐশীকে বলল, “কী বলো? আমি বোকাসোকা?”
কথাটি শুনে ঐশী যেন আরো বেশি হাসতে লাগলো। আগের চেয়ে বেশি হাসছে এখন। এ হাসি যেন ফুরাবার নয়। চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে ঐশীর। এই অশ্রু সাধারণ কোনো অশ্রু নয়। এর নাম আনন্দ অশ্রু। আর এ আনন্দ অশ্রু খুব কম মানুষের-ই আসে।
আকিব মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে দেখছে। এত সুন্দর হাসি কোনো মেয়ের হয়?
ঐশী হাসি থামিয়ে চোখের জল মুছে বলল, “হ্যাঁ, তুমি তো বোকাসোকা-ই। বোকাসোকা না হলে কি এ প্রশ্নটা করতে যে আমি কি বোকাসোকা? পা’গল একটা।”
কথাগুলো বলে ঐশী আবার হাসতে লাগলো। এ হাসি থামার নয়। আকিব কোনো কথা না বলে চুপচাপ বসে বসে ঐশীর হাসি দেখছে। তার ভালো লাগছে। ঐশী হাসছে, হাসুক। তাকে বাঁধা দেওয়ার দরকার নেই। হাসলে মনটা হালকা হয়। আর ঐশী এখন মন থেকে হাসছে। মানুষ সবসময় মন থেকে হাসতে পারে না। অধিকাংশ সময়-ই মানুষ কৃত্রিম হাসি হাসে৷ ঐশীর এই মনখোলা হাসিতে আকিবের বাঁধা দেওয়ার অধিকার নেই।
চলবে…