#নীল_আকাশের_পরী
#এম_আর_এ_আকিব
#পর্ব_৭
শব্দসংখ্যা: ১৫৮৪
আকিব ও সায়রা পড়ার টেবিলে বসে লেখাপড়া করছে। আকিব খুব মনোযোগ দিয়ে সায়রার দিকে তাকাচ্ছে আর অনেক কিছু ভাবছে। সায়রা তার আপন বোন না এটা সে এখনো মানতে পারছে না৷ সে যতদিন না স্বপ্নে দেখবে সবকিছু ততদিন সে এটি বিশ্বাস করতে পারবে না৷
সায়রা মনোযোগ দিয়ে লেখাপড়া করলেও সে বুঝতে পারছে আকিব অনেকক্ষণ থেকে তার দিকে তাকিয়ে আছে। তাই সে প্রশ্ন করলো, “কী ভাইয়া? না পড়ে এভাবে আমার দিকে তাকিয়ে আছ কেন?”
আকিব বলল, “ভাবছি তোর আর আমার মধ্যে মিল নেই কেন?”
সায়রা ভ্রু কুচকে বলল, “মানে?”
আকিব বলল, “এই যে তোর আর আমার স্বভাবের একদম-ই মিল নেই। তুই কতো বেশি কথা বলিস। মিশুক টাইপের এবং লেখাপড়ায়ও খুব ভালো। অন্যদিকে আমাকে দেখ, আমি কারো সাথে একদম কথা বলি না। কারো সাথে মিশতে পারি না। অন্তর্মুখী স্বভাবের। আবার লেখাপড়ায়ও তেমন ভালো নয়।”
সায়রা বলল, “হঠাৎ এ কথা কেন ভাইয়া? তোমার মাথায়ও না কেমন উদ্ভট প্রশ্নের উদ্ভব হয়।”
আকিব বলল, “হুম, প্রশ্নটা উদ্ভট। কিন্তু যৌক্তিকও। তাই না?”
সায়রা বলল, “হুম, কিন্তু এটা তো স্বাভাবিক-ই। দুজনের যে একই স্বভাব হতে হবে এমনও তো কথা না, তাই না?”
আকিব বলল, “হুম, তা ঠিক। আচ্ছা তুই পড়।”
সায়রা আরো কিছুক্ষণ আকিবের দিকে অদ্ভুতভাবে আকিবের দিকে চেয়ে রইলো। মনে মনে ভাবলো আজকে ভাইয়ার কী হয়েছে? এমন করছে কেন? তারপর নিজের লেখাপড়ায় মন দিলো।
আকিব যেন কিছুতেই লেখাপড়ায় মন দিতে পারলো না। বারবার পরীর বলা সেই কথাগুলো মনে করতে লাগলো। বাবা-মা, সায়রা সবাইকে কত আপন-ই না মনে হয় তার। অথচ তারা না-কি তার আপন কেউ না।
“তোমার মন খারাপ না-কি ভাইয়া?” সায়রার কথায় হঠাৎ চমকে ওঠলো আকিব। চমকে উঠার কারণ হলো সে গভীর চিন্তায় মগ্ন ছিল। কেউ যখন গভীর কোনো চিন্তায় ডুবে থাকে, তাহলে কেউ তার নাম ধরে ডাকলেও সে চমকে ওঠে। কারণ এটা অপ্রত্যাশিত ছিল। সে এই জগতে ছিল না, সে ছিল তার নিজস্ব চিন্তার জগতে।
স্বাভাবিক হয়ে আকিব বলল, “আরে না, মন খারাপ হবে কেন?”
সায়রা বলল, “আমাকে ধোকা দেওয়া এত সহজ না। বলো না মন খারাপ কেন?”
আকিব বলল, “আরে এমনি একটা কারণে মন খারাপ।”
“কী সেটা বলো না।”
“আরে কিছু না।”
“তোমার মুখ দেখে তো মনে হচ্ছে আমাদেরকে নিয়েই তোমার মন খারাপ। কী সেটা বলো না?”
আকিব ভাবতে লাগলো, সায়রা কি আদৌও জানে যে সে তার ভাই না? যদি জেনে থাকে তাহলে নিশ্চয়ই বুঝে যাওয়ার কথা আমার কেন মন খারাপ। আর যদি না জানে তাহলে নিশ্চয়ই বুঝতে পারেনি। সায়রা মেধাবী, প্রচণ্ড মেধাবী। সামান্য কিছু বললেই সে অনেককিছু বুঝে যাবে৷ কিন্তু আকিব এই মুহূর্তে তাকে কিছু বলতে চাচ্ছে না। তাই সে বলল, “আরে এমনি। আমার তেমন মন খারাপ নয়। চুপচাপ পড়তে শুরু কর। আমিও পড়ছি।”
কথাটি বলে আকিব জোরে জোরে পড়া আওড়াতে লাগলো। তার মন খারাপ সে কি পড়ছে একটু বুঝছে না। কিন্তু জোরে জোরে পড়ছে শুধু সায়রাকে দেখানোর জন্য। সায়রাও এটা বুঝলো। কিন্তু কিছু বললো না কারণ সে বুঝে গেছে আকিব তার কাছ থেকে বিষয়টি গোপন রাখতে চাচ্ছে। সায়রার এটি নিয়ে একটু চিন্তা হলেও নিজের লেখাপড়ায় মন দিলো।
আজও খাওয়া-দাওয়ার পরে সে বাবার অনুমতি নিয়ে বাইরে বেরুলো। তার বাবা তাকে সবসময়ই অনুমতি দেন। তিনি তাকে বললেন, “তোর মতো বয়সে আমি রাত ১টা-২টা পর্যন্ত বাইরে থাকতাম। কত বন্ধুর সাথে যে আড্ডা দিতাম। এর জন্য বাবা-মায়ের কতো বকা যে শুনতাম। তাই আমি ভাবতাম আমি কখনো বাবা হলে ছেলেদের এভাবে বকবো না। কিন্তু তুই তো তেমন বাহিরে যেতেই চাস না। এখন যেহেতু এই কয়দিন থেকে যেতে চাচ্ছিস তাহলে তো ভালোই হলো। আমার স্বভাব তাহলে এই বয়সে এসে তুই একটু পেলি। আর হ্যাঁ, প্রতিদিন এভাবে অনুমতি নিয়ে যেতে হবে না৷ ইচ্ছে হলেই যাবি। সমস্যা নেই।”
আকিব কোনো উত্তর না দিয়ে চলে গেল। আকিবের মা তার বাবাকে উদ্দেশ্য করে বললেন, “কী বলো? ছেলেটা এতরাত পর্যন্ত বাইরে কী করে তা জানতে চাওয়া একবারও? কোনো কিছু জিজ্ঞেস না করেই যাওয়ার অনুমতি দিয়ে দাও৷ এটা কেমন?”
আকিবের আব্বু প্রশ্নটি শুনে কিছুক্ষণ হুহু করে হাসলেন। তারপর হাসি থামিয়ে বললেন, “এরকম বয়সে ছেলেরা এমন করে। এটা স্বাভাবিক। তুমি তো মেয়ে, তুমি কী বুঝবে!” বলে আবারো হাসতে লাগলেন।
আকিবের আম্মু বললেন, “তুমি বিষয়টা এত সহজভাবে নিচ্ছ কেন? যদি খা’রাপ ছেলেদের পাল্লায় পড়ে খা’রাপ হয়ে যায়?”
আকিবের আব্বু বললেন, “আরে খা’রাপ হবে কেন? আমি খা’রাপ হয়েছি? ও আমার মতোই হবে। চিন্তা করবে না একদম।”
আকিবের আম্মু আর কিছু না বলে সেখান থেকে উঠে চলে গেলেন।
আকিব নদীর তীরে নিশির সাথে বসে আছে৷ এভাবে গভীর রাতে নদীর তীরে বসে থাকলে এক ধরনের প্রশান্তি জন্মে। পৃথিবীর সমস্ত চিন্তা ভুলে মনে হয় এই নদীর তীরে বসে অনন্তকাল পাড়ি দেওয়া যায়। নিশির সাথে দেখা হওয়ার পর নিশিই থাকে এখানে নিয়ে এসেছে। আকিব চুপচাপ নদীর দিকে চেয়ে আছে। আকিব এবং নিশি দুজনই চুপচাপ। কিছুক্ষণ পর নিশি বলল, “চুপ করে আছ যে?”
আকিব নদীর দিকে তাকিয়ে বলল, “এভাবে থাকতেই ভালো লাগছে।”
জ্যোৎস্না রাত। চাঁদের আলোয় অনেককিছু পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। চাঁদের আলো নদীতে এসে পড়ছে। আবার নদীতেই চাঁদের প্রতিবিম্ব দেখা যাচ্ছে।
নিশি বলল, “বিষয়টি নিয়ে কি তুমি খুব বেশি চিন্তায় আছ?”
আকিব বলল, “কোন বিষয়?”
“ওই যে ওরা তোমার বাবা-মা নয়।”
মৃদু স্বরে বলল, “না।”
“আমি জানি।”
আকিব আর কোনো প্রশ্ন করলো না। নিশির সাথে কথা বলতে তার ওতোটা ভালো লাগে না, যতটা ঐশীর সাথে কথা বলতে ভালো লাগে। আকিবকে চুপ থাকতে দেখে নিশিও চুপ হয়ে বসে রইলো। কিছুক্ষণ পর বলল, “শুধু জন্ম দিলেই বাবা-মা হওয়া যায় না। যারা ছোটবেলা থেকে বাবা-মায়ের আদর-স্নেহে বড়ো করেছেন তারাও কিন্তু তোমার বাবা-মা। যে ছোট থেকে তোমাকে ভাইয়ের চোখে দেখে আসছে সে-ও কিন্তু তোমার বোন।”
কথাগুলো আকিবের ভালো লাগলো। আসলেই তো, সে যারা আপন না বলে মন খা’রাপ করেছিল তারা আপন না হলেও তো আপন৷ তারা আপন না হলে কি তাকে বাবা-মায়ের স্নেহে লালন-পালন করতেন? তার আসল বাবা-মা’কে সে এটি জানে না। কখনো তাদের দেখেছে কি-না তাও জানে না। সারাজীবন যাদের কাছে মানুষ হয়েছে তাদের আপন না ভেবে কোথায় যাবে? তাই আকিব বলল, “ঠিক বলেছ।”
নিশি বলল, “এতক্ষণ ধরে নদীর দিকে চেয়ে কী দেখো?”
আকিব বলল, “নদী-ই দেখি৷ ভালো লাগছে দেখতে।”
নিশি বলল, “একটা কথা রাখবে?”
আকিব বলল, “কী?”
“আমার দিকে একটু তাকাবে? যেভাবে নদীর দিকে গভীর মনোযোগ দিয়ে তাকাচ্ছ সেভাবে কি আমার দিকে তাকাবে?”
“কেন? তোমার দিকে তাকাতে হবে কেন?”
“আমি উত্তর দেবো না। তুমি তাকাবে কি-না বলো?”
আকিব এবার নদীর দিক থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নিশির দিকে তাকালো। আজ একবারও নিশির দিকে ভালো করে তাকায়নি। তাই যখন তাকালো তখন মনে হলো পূর্ণিমার চাঁদটা বুঝি তার খুব কাছে চলে এলো। নিশি আজ একটু সাজগোজ করেছে। চোখে গাঢ় করে কাজল দিয়েছে৷ ঠোঁটে গোলাপি রঙের লিপস্টিক৷ কয়েকটা চুল সামনে এসে খানিকটা কপাল ঢেকে দিয়েছে৷ আকিব যখন নিশির কথা রাখতে নিশির দিকে তাকাচ্ছিল তখন ভেবেছিল একবার তাকিয়ে আবার বহমান নদীর দিকে তাকাবে। কিন্তু নিশির দিকে তাকানোর পর তা সে ইচ্ছে ম’রে গেছে। এখন সে ভাবছে কেন এতক্ষণ নিশির দিকে না তাকিয়ে নদীর দিকে তাকালো৷ নদীর সৌন্দর্য থেকে কয়েকগুণ বেশি সুন্দর নিশির মুখ। এ মুখের দিকে একবার গভীরভাবে তাকালে আর চোখ ফেরানো যায় না। কী সুন্দর মায়াময় বদনখানি। চাঁদটা আজ পূর্ণ আলো ছড়াচ্ছে। চাঁদ যখন পূর্ণ আলো ছড়ায় তখন চাঁদকে দেখতে সবচেয়ে সুন্দর লাগে৷ কিন্তু আজকে যদি কাউকে বলা হয় যে, পূর্ণিমার ওই চাঁদ বেশি সুন্দর না কি নিশি বেশি সুন্দর? যে-কেউ চোখ বন্ধ করে বলে দেবে নিশি বেশি সুন্দর। নিশি কেমন সুন্দর তা লিখে কখনোই প্রকাশ করা যাবে না। নিশির রূপ থেকে যেন আলো চারদিকে ছড়িয়ে পড়ছে আর সেই আলো চাঁদের জ্যোৎস্নাকেও হার মানাবে। আকিব মুগ্ধ নয়নে নিশির মুখের দিকে তাকাচ্ছে আর ভাবছে, “এত সুন্দর কোনো মেয়ে হয়? আমি তো আগে কখনো এমন কাউকে দেখিনি।”
পরক্ষণেই আকিব ভাবলো নিশি তো সাধারণ কোনো মেয়ে নয়। নিশি হলো একজন পরী। আর পরীরা যে খুব বেশি সুন্দর হয় তা তো সে ছোটবেলা থেকেই জানে। ছোটবেলা কতো যে পরীর ছবি কল্পনা করেছিল তার হিসাব নেই। কিন্তু আজ নিশির রূপের কাছে তার ছোটবেলার কল্পনায় আসা সকল পরীর রূপ যেন কিছুই না৷ নিশির এই সৌন্দর্য কেউ কখনো কল্পনা করতে পারবে না। আকিব যেন অজানা এক জগতে হারিয়ে গেছে। যে জগতে শুধু নিশির বসবাস। নিশি যে এত সুন্দর তা এতদিন কেন সে বুঝতে পারলো না? হয়তো এতদিন সে ওতোটা গভীরভাবে নিশির দিকে তাকায়নি। কোনো এক গাড়ির পেছনে সে লেখা দেখেছিল, “সুন্দর চোখে চেয়ে দেখো, পৃথিবী কত সুন্দর।” কথাটি কোনো মনিষী বলেছেন কি-না সে জানে না। কিন্তু কথাটি আজ সে উপলব্ধি করতে পারছে। নিশির সৌন্দর্যে আজ যেন সে বিমুগ্ধ। এ রূপের প্রেমে শতশত মুনি-ঋষিও তাঁদের তপস্যা ভাঙতে রাজি হবেন। এভারেস্টের চূড়ায় উঠে যাচ্ছে এমন বালক-ও এমন রূপ দেখলে এভারেস্টের চূড়ায় না উঠে নিচে নেমে আসবে এরকম মায়াবী রূপের প্রেমে। এই রূপের দিকে একবার কেউ তাকালে সে তার প্রেমে পড়তে বাধ্য। এমন রূপের কোনো পরীকে যদি কোনো কবি দেখতো তাহলে শতশত মহাকাব্য উৎসর্গ করতো তার নামে। যদি নিশির রূপ কোনো রাজ্যের রাজা দেখতো তাহলে সে এই রূপের প্রেমে পড়ে রাজ্য ছেড়ে ভিখারি হতেও রাজি হতো। নিশির এই রূপ যদি যু’দ্ধে অবস্থানরত কোনো বীর সৈ’ন্য দেখতো তাহলে হয়তো সে-ও যু’দ্ধ ছেড়ে ওই রূপের প্রেমে নির্দ্বিধায় আত্মসমর্পণ করতো। নিশির এই রূপ দেখে আকাশের চাঁদটাও হয়তো আফসোস করছে কেন সে চাঁদ হয়ে জন্মালো। চাঁদ হয়ে না জন্মে যদি মানুষ কিংবা জ্বিন হয়ে একটি বার নিশির কাছে বসতে পারতো এতেই হয়তো সে তার জীবনকে সার্থক মনে করতো। এই রূপের বর্ণনা খাতা-কলম, কিংবা কী-বোর্ডে লিখে প্রকাশ করা সম্ভব না। আকিব তাকিয়ে আছে তো তাকিয়ে আছেই। কতক্ষণ পার হলো সে যাবে না। শুধু এতটুকু ভাবলো, যে স্রষ্টা এত সুন্দর করে সৃষ্টি করেছেন, যে স্রষ্টার সৃষ্টির দিকে তাকালে চোখ ফেরানো যায় না, সেই স্রষ্টা না জানি কত সুন্দর হবেন। সেই স্রষ্টার দিকে তাকানোর পর বান্দার যে হুশ থাকবে না তা আর বলতে হয় না৷
আকিবকে এখনো মনোযোগ দিয়ে নিশিকে দেখছে। এদিকে সময় যে বেশ কিছুক্ষণ অতিবাহিত হয়েছে তাতে তার ভ্রুক্ষেপ নেই৷ সে ভাবছে এই তো মাত্র কয়েক সেকেন্ড হলো। সময়টা আসলেই আপেক্ষিক। প্রচণ্ড গরমে যখন মরুভূমির রোদে দশ মিনিট হাঁটা হয় তখন মনে হয় যেন কয়েক ঘণ্টা যাবত হাঁটছি, আবার যখন নিশির মতো সুন্দরী পরীর দিকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা তাকিয়ে থাকা হয় তখন মনে হয় এই তো মাত্র কয়েক সেকেন্ড হলো।
চলবে…
[প্রিয় পাঠক, গল্পটি আপনাদের কেমন লাগছে মতামত জানান। ভালো লাগলে আপনার বন্ধুদেরকে গল্পটি পড়ার জন্য সাজেস্ট করুন। ন্যূনতম ১০০জন পাঠক না হলে গল্প লিখতে উৎসাহ পাই না।]