#নীল_আকাশের_শুকতারা,০৩,০৪
(৩য় পর্ব)
দশ মিনিট পর নীল নিজের ঘরে এসে দেখলো সব গোছিয়ে রাখা কিন্তু তারা ঘরে নেই।
নীল ওর অপ্রয়োজনীয় জিনিস গুলোও আনিয়েছে।মনে মনে ভাবছে,এসব উড়ে এসে জুড়ে বসা মেয়েদের এরকমই চাপে রাখতে হয় নাহলে মাথায় উঠে বসে।
তারা রান্না ঘরের দরজায় এসে দাঁড়িয়েছে।হালিমা আন্টির বলা কথাগুলো ওর কানে বাজছে এখনও।আসলেই তো কেন পায়ের উপর পা তুলে খাবে ও।যাদের সাথে থাকবে তাদের কাজকর্ম তো করাই যায়।হালিমা বেগম তারাকে দেখে চেঁচিয়ে উঠলেন,তুমি এখানে কী করছো?
তারা কেঁপে উঠে বললো,আন্টি কোনো কাজ করা লাগলে করতাম।
হালিমা রুক্ষ গলায় বললেন,এখন কোনো কাজ নেই যাও এখান থেকে। কালকে থেকে কী কী করতে হবে বুঝিয়ে দিবো।
তারা ফিরে আসার জন্য ঘুরতেই দেখলো আরাফাত সাহেব দাঁড়িয়ে আছেন।ও কিছু হয়নি এমন একটা ভান করে সরে এলো।
কিন্তু আরাফাত স্পষ্ট শুনতে পেয়েছেন সবটা।এগিয়ে গিয়ে বললেন,হালিমা এই মেয়েটাকে কী তোমার কাজের মেয়ে মনে হয়? মেয়েটার সাথে এমন ব্যবহার কেন করছো?
–কাজের মেয়ে না হলে কী কাজ করা যাবে না?পায়ের উপর পা তুলে আমার বাসায় কেউ থাকতে পারবে না।আর আমি যেমন আচরণ করি তেমনই করবো।
–হালিমা ভালো ভাবে বলছি মেয়েটার সাথে এমন আচরণ করবে না।
–যদি করি কী করবে তুমি?
আরাফাত সাহেবের প্রচন্ড মেজাজ খারাপ হলো তিনি গর্জন করে বললেন,আমি এই মেয়েটাকে নিয়ে বাসা ছেড়ে চলে যাবো।
হালিমা বেগমের চোখদুটো জলে ভরে উঠলো।
তিনি কাঁপা গলায় বললেন,তুমি আমাদের থেকে আলাদা হয়ে যাবে?
–হ্যাঁ হবো।
হালিমা বেগম এবার ইনিয়েবিনিয়ে কান্না শুরু করলেন।কাঁদতে কাঁদতেই বললেন,তুমি বাইরের একটা মেয়র জন্য আজকেই আমার সংসার ভাঙতে চলেছো।আমি এর জন্যই বলছিলাম এই মেয়েকে আমি বাসায় রাখতে চাই না।আমি জানি তো একটা ভেঙে যাওয়া পরিবারের সন্তান, সংসার ভাঙা ছাড়া আর কী বা করতে জানে।
আরাফাত সাহেব আস্তে কথা বলার জন্য বার বার অনুরোধ করলেন হালিমা বেগমকে তবুও তিনি কিছুই শুনছেন না।আরও জোরে জোরে কান্নাকাটি শুরু করেছেন।এক পর্যায়ে নীল আর নীরা এসে হাজির হলো।আরাফাত সাহেব রেগে মেগেই বাসা থেকে বেরিয়ে গেলেন।নীল বাবার এভাবে রেগে বেরিয়ে যাওয়া দেখে মায়ের কাছে এসে প্রশ্ন করলো, কী হয়েছে মা?বাবা এভাবে রেগেমেগে বেরিয়ে গেল কেন?
হালিমা বেগম আহাজারি করে বললেন,আমার সংসার ভাঙলো রে বাবা এবার আমার সংসার ভাঙলো।ঔ মেয়ে নিজের বাবা মায়ের কাছে থাকতে পারেনি,ভাঙা সংসারে বড় হওয়া মেয়ে এবার আমার সংসার ভাঙতে এসেছে।ঔ তারা মেয়েটার জন্যই আজকে তোর বাবা আমার সাথে রাগ করে বাসা থেকে বেরিয়ে গেলেন।
নীরা কোনমতে মাকে শান্ত করার চেষ্টা করছে।
নীল আর এক মুহুর্ত দাঁড়ালো হাটা শুরু করলো।উদ্দেশ্য বাবাকে বাসায় নিয়ে আসা।
নীলের সামনে পরলো তারা।
তারাও আরাফাত সাহেবের হন্তদন্ত হয়ে বেরিয়ে যাওয়াটা লক্ষ করেছে এদিকে রান্নাঘর থেকে হালিমা বেগমের কান্নাও শুনা যাচ্ছে।ওর সাহস হচ্ছে না যাওয়ার, তাই বিচলিত হয়েই নীলকে জিজ্ঞেস করলো,আংকেল এভাবে বেরিয়ে গেলেন কেন?আন্টি কেন কাঁদছেন?
নীল চলে যেতে গিয়েও থামলো।কয়েক সেকেন্ড নিঃশব্দে তারার দিকে তাকিয়ে চেঁচিয়ে বললো,কী শুনতে চাও তুমি? নিজের বাবা মায়ের সংসার ভেঙেছে বলে, নিজের বাবা মায়ের কাছে ঠাই হয়নি বলে আমাদেরও বাবা,মা হারা করবে? ভেঙে দিবে আমাদের সংসার?আবার নির্লজ্জের মতো জিজ্ঞেস করছো কী হয়েছে! কী হতে বাকি রেখেছো তুমি?
আসলে তোমাদের মতো মেয়েরা এসবই পারে।
তারার মুখ থেকে আর একটা কথাও বেরোলো না।
ওর চোখ ভেঙে কান্না বেরিয়ে এলো।
নীল দ্রুত পায়ে বাসা থেকে বেরিয়ে গেল।
তারা দৌড়ে চলে গেল নিজের ঘরে।তারপর চিৎকার করে কান্না শুরু করলো।সারাদিনের জমানো কান্না গুলো যেন একেবারে বেরিয়ে আসতে চাইছে এখন।
কেন ওর সাথেই সব সময় এমন হয়! নাকি আসলেই তারা কারোর জন্যই শোভনীয় না।যেখানেই যায় সেখানেই ভাঙন ধরে। ওর নিজেকে বড্ড অপরাধী মনে হচ্ছে।তারা বুকভাঙা আর্তনাদ করতে লাগলো।
এক ঘন্টা পর নীল আরাফাত সাহেবকে বুঝিয়ে বাসায় নিয়ে এলো।হালিমা বেগমের কাঁদতে কাঁদতে ব্লাড ব্রেশার বেড়ে গেছে।নীরা অনবরত মায়ের মাথায় পানি ঢালছে আর অস্বস্তি করছে।
আরাফাত এসে হালিমা বেগমের কাছে বসলেন,তারপর ওনার মাথায় হাত বুলিয়ে ডাকলেন,ও হালিমা কী হয়েছে তোমার? এই তো আমি এসেছি উঠে বসো।
হালিমা বেগম চোখ খুলে আরাফাত সাহেবকে দেখতে পেয়ে ফুপিয়ে কান্না শুরু করলেন।এতো বছরের সংসারে কখনও আরাফাত সাহেবের মতের বিরুদ্ধে কথা বলেন নি তিনি।আজ ঝগড়া করেছেন।ওনার খুব কষ্ট হচ্ছে।আরাফাত নীরাকে বললেন,মাকে তুলে বসা।
নীরা মাথা মুছে দিয়ে মাকে তুলে বসালো।
হালিমা সমানে কাঁদছেন।
নীল বিছানার কাছেই দাঁড়িয়ে আছে।আরাফাত সাহেব হাত ইশারায় ওকে বসতে বললেন।
নীল বিছানার এক পাশে বসলো।
আরাফাত সাহেব জোরে নিশ্বাস টেনে নিয়ে বলা শুরু করলেন,হালিমা আমরা যদি নিজেরা ঠিক থাকি তৃতীয় কেউ আমাদের মধ্যে ভাঙন তৈরি করার ক্ষমতা রাখে না।আমাদের সংসার কী এতোই ঠুনকো যে একটা অসহায় মেয়ের জন্য সেটা ভেঙে যাবে।সাহেদ আর কলির মধ্যে কীসের কমতি ছিল বলোতো? ভালোবাসার।তাই তারা আলাদা হয়েছে।
আমাদের মধ্যে তো ভালোবাসার কোনো কমতি নেই।আমরা প্রাণভরে ভালোবাসতে পারি।নির্দোষ একটা স্বজনহারা মেয়েকে আমরা একটু ভালোবাসতে পারি না? মেয়েটা তোমার সংসার ভাঙতে আসে নি।এসেছে একটু ভালোবাসার সন্ধানে, তাকে খালি হাতেই ফিরিয়ে দিবে তুমি?এতোটা নিষ্ঠুর তো তুমি নও।মেয়ে ভেবে না হোক মেয়ের মতো আরেকটা মেয়েকে পরের মেয়ে ভেবেই সামান্য একটু ভালোবেসো। আমি আর কিছুই চাই না তোমার কাছে।
হালিমা বেগম চোখ মুছে মাথা নাড়ালেন।
আরাফাত সাহেব এবার নীরাকে বললেন তারাকে ডেকে নিয়ে আসতে।
নীরা তারার ঘরে গিয়ে তারাকে পেল না।সারা বাসা খুঁজে এসে আরাফাত সাহেবকে বললো,বাবা তারা তো বাসায় নেই।সারা বাসা খুঁজে দেখলাম।কোথাও নেই।
আরাফাত সাহেব বিচলিত হয়ে বললেন,বাসায় নেই মানে? কোথায় গেল মেয়েটা।
আরও ভালো করে খুঁজে দেখ মা।নীল তুইও যা।
নীরা যেতে গিয়েও থেমে গেল।তারপর বললো,বাবা তারা যে ব্যাগটা নিয়ে এসেছিল সেটাও তো ওর ঘরে দেখলাম না।
আরাফাত সাহেব এবার উঠে দাঁড়ালেন।চিন্তিত ভাবেই বললেন,আমি বাসা থেকে বেরোনোর পর তোমরা কেউ মেয়েটাকে কিছু বলেছিলে?
নীরা না সূচক মাথা নাড়ালো।
আরাফাত সাহেব নীলের দিকে তাকালেন।নীল কাচুমাচু করে বললো,আমি বলেছি।
আরাফাত সাহেব রেগে গিয়ে বললেন,কী বলেছিস?
–বলেছি নিজের বাবা মায়ের সংসার ভেঙে এখন আমাদের সংসার ভাঙতে এসেছে।
আরাফাত সাহেব উত্তেজিত হয়ে বললেন,এর জন্যই মেয়েটা বাসা ছেড়ে চলে গেছে।এই মুহুর্তে আমার বাসা থেকে বেরো তুই।তারাকে খুঁজে না নিয়ে বাসায় ফিরবি না।
হালিমা বেগম কিছু বলতে গিয়েও বলতে পারলেন না।
নীল নিঃশব্দে বাসা থেকে বেরিয়ে এলো।
রাস্তায় দাঁড়িয়ে ভাবছে এই আপদটাকে এখন কোথায় খুঁজবে!
এদিক ওদিক তাকিয়ে এলাকার দোকানটায় জিজ্ঞেস করতেই দোকানী বললেন কিছুক্ষণ আগে একটা মেয়ে ব্যাগ হাতে যেতে দেখেছেন।
নীল দোকানীর কথা অনুযায়ী রাস্তা ধরে দৌড়াতে লাগলো।এক পর্যায়ে তারাকে পেয়েও গেল।
নীল হাপাতে হাপাতে তারার সামনে এসে পথ আগলে দাঁড়ালো।তারা নীলকে এড়িয়ে অন্য দিক দিয়ে হাটা ধরতেই নীল তারার হাতটা শক্ত করে ধরলো।
তারা অবাক হয়ে তাকালো নীলের দিকে।
নীল হাপাতে হাপাতেই বললো,চুপচাপ এখানে দাঁড়িয়ে থাকো।এক পাও সামনে বাড়াবে না।
তারা কয়েক সেকেন্ড নীলের দিকে তাকিয়ে থেকে বললো,আমার হাতটা ছাড়ুন।
নীল তারার দিকে এগিয়ে এসে বললো,আর না ছাড়লে কী করবে?
তারা ঢুক গিলে বললো,আমাকে যেতে দিন।আমি কারোর পরিবারে অশান্তি করতে চাই না।
নীল দাত কটমট করে বললো,বড় বড় কথা বলা বন্ধ করে চুপচাপ চলো আমার সাথে।
–আমি আর আপনাদের বাসায় যাবো না।
–ভালো ভাবে বলছি চলো আমার সাথে।
–বলেছি তো যাবো না।
–যাবে না তো?
–না।
–আমি কিন্তু টেনে হিচড়ে নিয়ে যাবো।
–আপনি যদি আমার উপর জোরজবরদস্তি করেন আমি কিন্তু চিৎকার করবো।লোকজন ডেকে আনবো।
নীল এবার তারার দুই হাত একসাথে চেপে ধরলো।তারা অবাক হয়ে হাত দুটি ছাড়ানোর চেষ্টা করছে।নীল তারার মাথায় জড়িয়ে রাখা উড়নাটা টেনে নিয়ে দু টুকরো করে ফেললো।
তারা একদিকে অবাক হয়েছে আরেকদিকে লজ্জায় দ্রুত ঘুরে দাড়িয়ে রইলো।
নীল হাফহাতা গেঞ্জির উপর শার্ট পরে ছিল।পরনের শার্টটা খুলে ঝুড়ে ফেললো তারার উপর।তারা কী করবে ভেবে না পেয়ে শার্টটা গায়ে জড়ালো।
নীল দ্রুত উড়নাটার ছেড়া অংশ দিয়ে তারার হাত আর মুখ বেধে নিলো।
তারপর ওকে কোলে নিয়ে হাটা শুরু করলো।
চলবে..
লিখা: উম্মেহানি মিম
★#নীল_আকাশের_শুকতারা ★
————–(৪র্থ পর্ব)
বাসার সামনে এসে তারাকে নামালো নীল, নামালো বললে ভুল হবে ছুড়ে ফেলে দিলো বলা যায়।
তারা থপাস করে মাটিতে পড়লো গিয়ে।নীল দ্রুত তারার হাত আর মুখের বাধন খুলে দিলো।
তারা কোনরকমে ছেড়া ওড়নাটা গায়ে মাথায় জড়িয়ে নীলের শার্ট হাতে নিয়ে উঠে দাড়ালো।
নীল তারার হাত থেকে শার্টটা ছু মেরে নিয়ে গায়ে দিলো।তারপর কলিংবেল চাপলো। নীরা এসে দরজা খুললো।
নীরা তারাকে থেকে বেশ উৎফুল্লভাবেই ওকে ধরে বাসার ভিতরে নিয়ে গেল।
তারা কাচুমাচু করে দাড়িয়ে আছে।ওর সারা শরির কাঁপছে।
নীরা তারার ওড়নাটা খেয়াল করে বললো,তোমার ওড়নাটা ছিড়লো কীভাবে তারা?
তারা এক পলক নীলের দিকে তাকিয়ে বললো,আসার সময় একটা জায়গায় আটকে ছিড়ে গেছে।
নীল মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে।
নীরা তারাকে বসিয়ে রেখে আরাফাত সাহেবকে ডেকে নিয়ে এলো।হালিমাও এলেন।দুজনই বেশ চিন্তিত।
আরাফাত সাহেব তারার কাছে এসে দাঁড়িয়ে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,মা তোমাকে এই বাসায় কে নিয়ে এসেছে?
তারা আস্তে করে বললো, আপনি।
–আমি যখন নিয়ে এসেছি তবে তোমার চলে যেতে হলে আমিই নিয়ে যাবো। একা একা বাসা ছেড়ে চলে যাওয়ার সাহস কোথায় পেলে তুমি?
তারা এবার ফুপিয়ে কেঁদে উঠলো।
আরাফাত সাহেব শান্ত গলায় বললেন,যাই হয়ে যাক না কেন কখনও আমার অনুমতি ছাড়া বাসা থেকে বের হবে না।তোমার সুবিধা অসুবিধা সব আংকেলকে বলবে।আমি বলছি এই বাসায় নীল আর নীরার যতটা অধিকার আছে তোমারও ঠিক ততটাই আছে।আমি দিয়েছি সেই অধিকার তোমাকে।কারোর কঢ়া কথায় বা অপমানে সেই অধিকারটা তুমি হারাবে না।তাই বলছি আর এমন কাজ করো না এটা আমার অনুরোধ না আদেশ।মনে থাকবে তো?
তারা চোখ মুছে মাথা নাড়ালো।
সকাল বেলা তারা ঘুম থেকে জেগেই ফজরের নামাজটা পড়ে নিলো।আরাফাত সাহেব আর হালিমাও নামাজ পড়তে জেগেছেন।
তারা চা বানানোর উদ্দেশ্যে রান্না ঘরে যাচ্ছিলো ওর দেখা হলো আরাফাত সাহেবের সাথে।
আরাফাত সাহেব মুচকি হেসে বললেন,অনেক সকাল সকাল জাগো তুমি তাই না?
— হ্যাঁ আংকেল আমি নামাজ পড়ে আর ঘুমাই না।ভোরের হাওয়াটা ভালো লাগে।আপনাকে চা বানিয়ে দেই খাবেন তো?
–খাবো তো অবশ্যই কিন্তু এখন একটু ছাদে যাবো।ভোরের হাওয়া উপভোগ করতে হলে খোলা আকাশের নিচে যেতে হয় তখন আরও ভালো মতো অনুভব করা যায়।
–তা ঠিক বলেছেন।
–তুমি কী আমার সাথে যাবে?
তারা আগ্রহ নিয়ে বললো,চলুন আংকেল যাই।এসে চা খাবো।
আরাফাত সাহেব আর তারা ছাদে এসে দাঁড়ালেন।ফুরফুরে হাওয়া চারিদিকটাতে ছেয়ে আছে।
আরাফাত সাহেব আকাশে একটা জ্বলজ্বলে তারা দেখিয়ে বললেন,এই যে তারাটা দেখছো এটার নাম কী জানো?
তারা এক মুহুর্ত দেরী না করে বললো, শুকতারা।
আরাফাত সাহেব খানিকটা হেসে বললেন,হ্যাঁ।আমি এই শুকতারাটাকেই আমার বাসায় নিয়ে এসেছি।যে কাল থেকে আমার ঘরে জ্বলজ্বল করে জ্বলছে।
তারা মুচকি হাসলো।
আরাফাত আবার বললেন,তোমার নামটা কে রেখেছে জানো মা?
তারা না সূচক মাথা নাড়ালো।খুব আগ্রহ করে অপেক্ষা করছে কে ওর নাম করণ করেছেন তার নাম জানতে।
আরাফাত সাহেব মুচকি হেসে বললেন,তোমার জন্মের সময় হসপিটালে সাহেদের সাথে আমি ছিলাম।তখন তোমার বাবার সাথে খুব ঘনিষ্ঠতা ছিল আমার।তোমার জন্ম হয়েছিল ভোরে।সাহেদ খুব খুশি ছিল।হসপিটাল থেকে চা খাওয়ার জন্য বেরিয়ে আমরা এরকমই ভোরবেলা খোলা আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে আছি। সাহেব হঠাৎ আমাকে বললো,মেয়ের কী নাম রাখা যায় বল তো।
আমি আকাশের দিকে তাকিয়ে এই শুকতারাটিকে দেখতে পেলাম আর বলে দিলাম শুকতারা।
সাহেদ তখন মজা করলেও এই নামটাই সাহেদ এবং কলির পছন্দ হলো।আর তোমার নাম করণ করা হলো।
তারার চোখটা জলে ভিজে গেল।কোনরকমে চোখের পানি আড়াল করে বললো,ধন্যবাদ আংকেল আমার এতো সুন্দর একটা নাম রাখার জন্য।চলুন বাসায় যাই।
আরাফাত আর তারা নিচে নেমে এলেন।তারা সোজা রান্নাঘরে চলে এলো।হালিমা খুড়াতে খুড়াতে রান্নাঘরে ঢুকছেন।
তারা এগিয়ে গিয়ে বললো,পায়ে কী হয়েছে আন্টি?
–বাতের ব্যথাটা বেড়েছে আমার সকাল বেলা পা নিয়ে দাঁড়াতেই পারি না।তুমি এখানে কী করছো?
–আমি চা বানাতে এসেছি আন্টি।
–পারবে?
–জ্বি।
–ঠিক আছে তুমি চা বানাও আমি একটু বসি গিয়ে।
–আপনি যান আন্টি আমি চা নিয়ে আপনাকে আর আংকেলকে ঘরে দিয়ে আসবো।
হালিমা বেগম রান্না ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন।
ঘড়িতে এগারোটা বাজে নীরা আর তারা একসাথে বসে গল্প করছিল নীল চোখ কচলাতে কচলাতে এসে বললো,নীরা কফি দিয়ে যা আমার ঘরে।
নীরা উঠতে যাবে তারা ওকে আটকে দিয়ে বললো,আমি কফি বানাই আপু?
–বানাবে বানাও।ব্ল্যাক কফি কিন্তু।
–ঠিক আছে।
তারা রান্নাঘরে এসে কফি বানিয়ে নীরাকে এনে দিয়ে বললো নীলকে দিয়ে আসতে।
নীরা কাচুমাচু করে বললো,তোমার হাতের কফি কোন স্বাদের হবে আমি তো জানি না তাই এই রিস্ক আমি নিচ্ছি না।তুমি বানিয়েছো তুমিই দিয়ে এসো।
তারা মুচকি হেসে বললো, খারাপ হবে না আপু।
–বুঝতে পারছি খারাপ হবে না কিন্তু ভাইয়াকে তুমি চেনো না।একশোটা ভুল ধরবে।একদিন যাও কফি নিয়ে নিজেই টের পাবে।
তারা আর কিছু না বলে কফি নিয়ে ভয়ে ভয়ে নীলের ঘরে চলে গেলো।
দরজায় নক করতেই নীল ভিতর থেকে বললো,দরজা খোলা আছে আয়।
তারা আস্তে আস্তে ঘরে ঢুকে কফিটা রেখে বেরিয়ে আসার জন্য ঘুরে দাঁড়িয়েছে মাত্র।
নীল পেছন থেকে ডাকলো,কে?
তারা আবার ঘুরে দাঁড়ালো।
নীল এক মুহুর্ত তারার দিকে তাকিয়ে বললো,তুমি কফি বানিয়েছো?
তারা মাথা নাড়ালো।
নীল কফির মগ হাতে নিয়ে ডাস্টবিনে ফেলে দিয়ে বললো,যার তার হাতের কফি আমি খাই না।
সোজা আমার ঘর থেকে বেরিয়ে যাও আর নীরাকে বলো পাঁচ মিনিটের মধ্যে কফি নিয়ে আসতে।
তারার চোখদুটো ছলছল করছে।আস্তে আস্তে ঘর থেকে বেরিয়ে এলো।
নীরা তারাকে পাঠিয়ে নিজেও স্বস্তি পাচ্ছিল না তাই উঠে যেতে গিয়ে দেখলো তারা কফির মগ হাতে নিয়ে অন্যমনস্ক ভাবে হেটে হাসছে।নীরা এগিয়ে গিয়ে বললো,কী হয়েছে তারা ভাইয়া কিছু বলেছে? এতো তাড়াতাড়ি কফি খেল কীভাবে?
তারা এদিক ওদিক তাকিয়ে বললো,কফিটা উনি খাননি।বলেছেন তোমার হাতের কফি ছাড়া খাবেন না।
নীরা ব্যপারটা বুঝতে পেরে বললো,সরি তারা।আমি বুঝতে পারিনি ভাইয়া কফিটা খাবে না।আমি ভাবছিলাম তুমি কফি নিয়ে গেলে ভাইয়া তোমার উপর খুশি হবে।আর কিছু বলেছে তোমাকে?
–না।
–ঠিক আছে আমি কফি বানিয়ে নিয়ে যাচ্ছি তুমি বসো।
তারা মাথা নাড়ালো। নীরা চলে গেল।
তারাও উঠে নিজের ঘরে চলে গেল।মনে মনে ভাবছে,এই বাসায় প্রত্যেকটা মানুষ আলাদা আলাদা।কারোর সাথে কারোর মিল নেই।
তারা মনে মনে ঠিক করলো আর নীলের আশেপাশে যাবে না।ওকে দেখলেই নীল রাগারাগি করে, খারাপ আচরণ করে।এতে করে ওর মনও খারাপ হয়ে যায়।
ও দরজা বন্ধ করে বুক সেল্ফ থেকে একটা উপন্যাসের বই হাতে নিলো। বইটা খুলতেই ভিতর থেকে একটা চিরকুটের মতো কিছু নিচে পড়লো।
তারা কাগজটা তুলে নিয়ে ভাজ খুলে পড়া শুরু করলো,
” কথাগুলো মরতে চায় তারই শ্রবণে,
যে রয়েছে কথা বলার বারণে”
চমৎকার হাতের লেখায়,দু-লাইন লেখা।কিন্তু কথাটা যেন অনেক গভীর।একেবারে বুকে গিয়ে লাগে।
তারার খুব ইচ্ছে করে ওর বাবা মায়ের সাথে কথা বলতে কিন্তু ওনারা দিনে একবার ফোন পর্যন্ত করে না। তারার খোঁজ নেয়ার প্রয়োজনটুকু নেই তাদের।ও ইচ্ছে থাকা সত্যেও কথা বলতে পারছে না বাবা মায়ের সাথে।
সব কিছুতেই যেন বাধা,বারণ।
তারার চোখ থেকে দু ফোটা জল গড়িয়ে পড়লো। ও ভাবছে,এতো সুন্দর,এতো গভীর কথাটা কে এমন অল্প কথায় লিখেছে?
যে লিখেছে ভালোই লিখেছে, নিশ্চয়ই সে অনেক আবেগ দিয়ে গভীরে চিন্তা করেই লিখেছে।
তারার দরজায় কেউ একজন নক করছে।সে দ্রুত
গিয়ে দরজা খুলে নীলকে দেখে অবাক হয়ে গেল।
নীল শান্ত গলায় বললো…
চলবে
লিখা: উম্মেহানি মিম