নীল_আকাশের_শুকতারা,০৫,০৬

0
1189

#নীল_আকাশের_শুকতারা,০৫,০৬
৫ম পর্ব

নীল শান্ত গলায় বললো,বাবা তোমাকে ডাকছে।ওনি বসার ঘরে আছে।
কথাটা বলে নীল দ্রুত পায়ে হেটে নিজের ঘরে চলে গেল, তারা বসার ঘরের দিকে রওনা হলো।
আরাফাত সাহেব বসে খবরের কাগজ পড়ছেন।তারাকে দেখতে পেয়ে ওকে বসতে বলে বললেন,মা তুমি তো কলেজে ভর্তি হয়েছিলে তাই না?কিন্তু তোমার কলেজ তো এখান থেকে ওনেক দূর তাই আমি ভেবেছি তোমাকে নীল আর নীরার কলেজে ভর্তি করিয়ে দিবো।তোমার কলেজ থেকে যেসব লাগজ পত্র আনা দরকার আমি আজ আনিয়ে রাখবো।
আর নীলের কলেজে তো ওর চেনা জানা আছে তাই ভর্তি হতে তেমন অসুবিধা হবে না।আর এখন তো কলেজে ভর্তি চলছেই।
নীলের সাথে আমার কথা হয়েছে ও তোমাকে নিয়ে যাবে।তুমি কালকেই যাও ওর সাথে।
তারা মাথা নাড়ালো।
নীলের সাথে যাওয়ার খবরটা ওর মন খারাপ করে দিয়েছে।তবুও একটা ব্যপারে কিছুটা হলেও শান্তি লাগছে তা হলো নতুন কলেজে কেউ তারাকে ওর বাবা মায়ের আলাদা হয়ে যাওয়ার ব্যপারে জিজ্ঞেস করবে না।কেউ হা করে তারার দিকে তাকিয়ে থাকবে না যেন বাবা, মা আলাদা হয়ে যাওয়া সন্তান বিরাট বড় অপরাধী।
তারা চলে আসার জন্য ঘুরতেই আরাফাত সাহেব আবার ডাকলেন,তারা তোমার বাবা ফোন করেছিল।তুমি কেমন আছো জানতে চেয়েছে।তোমার সাথে একবার কথা বলতে চাইছে।তুমি কী কথা বলবে?
তারা কী বলবে ভেবে পাচ্ছে না,বাবার সাথে কথা বলতে ইচ্ছে হচ্ছে খুব তবুও অভিমান হচ্ছে আকাশ ছুঁয়া।
আরাফাত সাহেব নিজের ফোনটা থেকে সাহেদ সাহেবকে কল দিলেন।প্রথমবার কলটা বাজতে বাজতে কেটে এলো দ্বিতীয় বার রিসিভ হলো।ওপাশ থেকে সাহেদ বললেন,তারা আছে?
আরাফাত সাহেব তারার দিকে ফোনটা এগিয়ে দিলেন।
তারা ফোন হাতে নিতেই আরাফাত সাহেব উঠে চলে গেলেন।ওনার মনে হলো বাবার সাথে মেয়ের একা কথা বলার সুযোগ দেয়া উচিৎ।
তারা ফোনটা কানে ধরলো।
ওপাশ থেকে সাহেদ বললেন,তারা বলছিস?
– হ্যাঁ।
-কেমন আছিস?
-অনেক ভালো।
-আরাফাতের কাছে তুই ভালো থাকবি জানি, তোর মামা বাড়িতে ঔ সব অমানুষদের সাথে থাকার থেকে আরাফাতের কাছে থাকাই ভালো তাই আর আমি আপত্তি করলাম না।তুইও যেহেতু ওর কাছে থাকতে চাইছিস।

তারা ভালো করেই জানে এখন বাবা ওর মামার বাড়ির বংশের প্রত্যেকটা মানুষের সম্পর্কে কথা বলে নানা রকম গালাগালি করবেন।তারার মোটেও এসব শুনতে ইচ্ছে করছে না।বরং বাবাকে বলতে ইচ্ছে করছে কেন নিজের কাছে রাখলে না আমাকে? কিন্তু এটা বলা সম্ভব না।তাই তারা নিজেকে সামলে বললো,কী বলতে আমার সাথে কথা বলতে চেয়েছিলে সেটা বলো।
-বলছিলাম তোর মায়ের জন্য তো সমন্ধ ঠিক করা হচ্ছে জানিস?
-না।
-কেন জানবি না? পুরো এলাকায় জানাজানি হয়ে গেছে তোর মামারা তোর মাকে নতুন করে বিয়ে দিবে আর তুই জানিস না।
-আমার এসব জানার প্রয়োজন নেই।অন্য কিছু বলার থাকলে বলো আর না থাকলে ফোনটা রাখো বাবা।
-তুই বিরক্ত হচ্ছিস?
-বিরক্ত কী শুধু তোমরাই হবে আমি হতে পারি না?
-ঠিক আছে যা বলতে ফোন দিলাম বলে দেই শুনে ফোনটা রেখে দিলে দিস।
-বলো।
-তোর রেহানা আন্টিকে চিনিস তো?
-যাকে নিয়ে রোজ তোমার আর মায়ের ঝামেলা হতো তাকে চিনবো না!
-রেহানাকে আমি বিয়ে করবো ঠিক করেছি।
-ভালো।
-আর বিয়ের পর আমি রেহানার সাথে কথা বলবো তোকে আমাদের কাছে নিয়ে আসার ব্যপারে।
ওর যদি আপত্তি না থাকে তবে আমি আমার কাছেই তোকে নিয়ে আসবো।
তারার আর কথা বলতে ইচ্ছে হলো না।নিজের মেয়েকে নিজের কাছে নিয়ে আসতে বাইরের একটা মহিলার অনুমতি নিতে হবে কেন?
ও কিছু না বলেই ফোনটা কেটে দিলো।এই মুহুর্তে তো ওর খুব কষ্ট হওয়ার কথা। বাবা, মা দুজনেরই নতুন বিয়ের খবর পেয়েছে।কিন্তু কষ্ট হচ্ছে না।তারার মনটা হয়তো এর থেকে বেশি কষ্ট পাওয়ার জন্য প্রস্তুত হয়ে আছে তাই এতটুকুতে এখন আর কষ্ট পায় না।
মায়ের বিয়ের খবরটা অবশ্য ৫০% মিথ্যে হওয়ার সম্ভাবনা আছে কারণ সাহেদ অথবা কলি দুজনেই একে অপরের বিরুদ্ধে বাড়িয়ে কথা বলেন।তবুও এই ব্যপারটা আর অবিশ্বাস্য কিছু না।ওনারা আলাদা হয়ে গেছেন নতুন করে জীবন শুরু করবেন বলেই তো।তারা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে আরাফাত সাহেবের ফোনটা দেয়ার জন্য ওনার ঘরের দিকে হাটা ধরলো।
ঘরে আরাফাত সাহেব নেই কিন্তু হালিমা আছেন।উনি বিছানায় আধ শোয়া অবস্থায় রয়েছেন।সমানে গোঙাচ্ছেন।
তারা এগিয়ে গেল, আন্টি আপনার কী হয়েছে?
-পায়ের ব্যথাটা বেড়েছে, কখন বললাম মেয়েটাকে পায়ে একটু মলম লাগিয়ে দিতে ওর নাকি জরুরি এসাইনমেন্ট আছে ওটা করে আসবে।
-আমি লাগিয়ে দেই?
-দাও।
তারা হালিমার দেখিয়ে দেয়া জায়গাটা থেকে ব্যথার মলমের কৌটা নিয়ে ওনার পায়ে আস্তে আস্তে লাগিয়ে দিলো।
হালিমা মনে মনে ভাবছেন যতটা খারাপ ভেবে ছিলেন মেয়েটা ততটাও খারাপ না।

পরদিন সকাল সকাল তারা কলেজে যাওয়ার জন্য তৈরি হলো ঠিকই কিন্তু বুক ধরফর শুরু করেছে।নীলের সাথে যাবে মানেই নির্ঘাত ওর কঢ়া কঢ়া কথা শুনতে হবে।তারা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বাইরে এসে নীলের সামনে দাঁড়ালো।নীল বাইকে বসে আছে তারাকে দেখতে পেয়ে বাইকে স্টার্ট দিলো।তারা কোন রকমে বাইকে উঠে বসতেই নীল ফুল স্পিডে বাইক চালাতে শুরু করলো।এতো জোরে বাইক চালাচ্ছে যে ভয়ে তারার নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে।তারা ভয় পেয়ে নীলের শার্টটা খামচে ধরলো।নীল পেছন ফিরে তাকিয়ে বললো,সমস্যা কী?
তারা কাঁপা গলায় বললো,একটু আস্তে চালানো যায় না?
নীল কর্কশ গলায় বললো, আমি এভাবেই চালাই বেশি সমস্যা হলে নেমে যাও।
কথাটা বলে নীল বাইক থামালো।তাল সামলাতে না পেরে তারা নীলের উপর হুমরি খেয়ে পড়লো।
নীল ধাক্কা দিয়ে তারাকে সরিয়ে ধমক দিয়ে বললো, নামো।
তারা চুপচাপ নামলো।
নীল বাইকে স্টার্ট দিয়ে বললো,সামনে একটু হেটে বা দিকে গেলেই কলেজটা পেয়ে যাবে, দশ মিনিটের মধ্যে চলে এসো।আমি গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করবো।
অচেনা একটা জায়গায় তারাকে নামিয়ে নীল বাইক চালিয়ে চলে গেল।তারা অবাক হয়ে ভাবছে,এটা কোনো মানুষ নাকি দানব।এতোটা নিষ্ঠুর মানুষও হয়!অবশ্য যার বাবা মায়েরই নিজের সন্তানের প্রতি কোনো মায়া কাজ করে না তার সাথে বাইরের লোকজন এর থেকে ভালো আচরণ আর কীভাবে করবে।
তারা হাতের ঘড়িতে তাকিয়ে হাটা শুরু করলো।
ও নীলের কথা অনুযায়ী কলেজের সামনে এসে এদিক ওদিক তাকিয়ে নীলকে খুঁজতে লাগলো।
দূর থেকে কয়েকটা ছেলে তারাকে দেখতে পেয়ে এগিয়ে এসে ওর পাশে দাঁড়ালো ,কী ম্যাডাম কাকে খুঁজছেন।
তারা ছেলেদের হাবভাব ভালো না দেখে খানিকটা দূরে সরে এলো।ছেলেরা তারার পেছন পেছন এসে একেবারে ওর গাঁ ঘেসে দাঁড়ালো।
তারা আরেকটু দূরে সরে গেল।একটা ছেলে তারার কাছে গিয়ে ওকে ধাক্কা দিয়ে বললো,ভয় পাচ্ছেন নাকি ম্যাডাম?সুন্দরী বলে আমাদের থেকে দূরে সরে যাচ্ছেন একটু পাশে দাড়ালে কী রূপ কমে যাবে!
কথাটা বলার পর ছেলেগুলো একসাথে হো হো করে হাসতে শুরু করলো।
তারা ভয়ে কুঁকড়ে যাচ্ছে।মনে মনে আল্লাহকে ডাকছে।তখনই কোথা থেকে নীল এসে ছেলেদের মাঝখান থেকে তারাকে হাত ধরে টেনে সরিয়ে নিয়ে গেল।তারপর ছেলেদের উদ্দেশ্য করে বললো,এটা আমার বাসার মেয়ে তাই ওর সাথে এরপরে কথাবার্তা সাবধানে বলবে।ছেলেগুলো চুপচাপ চলে গেল।
ওরা চলে যেতেই নীল তারাকে ধমক দিয়ে বললো,চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকা ছাড়া আর কিছু করতে পারো না তুমি?ছেলেগুলো কী করছিল তোমার সাথে বোধগম্য হয়নি?
তারার সারা শরির কাঁপছে।আস্তে করে বললো,কী করা উচিৎ ছিল আমার?
নীল দাঁত কটমট করে বললো,সেটাও আমার বলে দিতে হবে!প্রতিবাদ করা উচিৎ ছিল।
অন্যায়ের প্রতিবাদ না করলে এরকমই মানুষের অত্যাচারের শিকার হবে।
তারা বিদ্রুপের হাসি হেসে বললো,প্রতিবাদ করা উচিৎ হলে প্রথমে তো আপনার আচরণের প্রতিবাদ করা উচিৎ।
–কী?
–প্রথম দিন থেকে আপনি আমার সাথে যে আচরণটা করছেন সেটা অন্যায় নয়? বীনা দোষে বার বার আমার সাথে খারাপ আচরণ করছেন।প্রতিবাদ করতে হলে তো আগে আমাকে সেটার প্রতিবাদ করতে হবে।আসলে আমার ভাগ্যে শুধু অত্যাচার, অপমান,অবহেলা ছাড়া কিছুই নেই তাই আমি আমার ভাগ্যকে মেনে নিয়েছি।আপনি আর প্রতিবাদী বানী শুনাবেন না।
নীল কয়েক সেকেন্ড তারার দিকে তাকিয়ে থেকে আর কোনো কথা বললো না কলেজের ভিতরে এগিয়ে গেল।তারাও আস্তে আস্তে হেটে ভিতরে গেল।
ভিতরে গিয়ে নীল জিজ্ঞেস করলো,কীসে পড়ো তুমি?
তারা আস্তে করে বললো,ইন্টারমিডিয়েট ফার্স্ট ইয়ারে।
নীল ভ্রু কুচকে বললো এতটুকু একটা মেয়ে এতো ফটর ফটর কথা বলো আবার।চলো ভর্তি করিয়ে দিচ্ছি।
তারা কোনো কথা বললো না।

ফিরে এসে নীল বাইকে উঠে তারাকে উঠতে বললো।তারা মুখ ফিরিয়ে বললো,আমি এখান থেকে রিকশা নিয়ে চলে যেতে পারবো, বেশিদূর না।
নীল বিরক্ত হয়ে বললো,তার মানে আমার সাথে যেতে চাও না?
তারা মাথা নাড়িয়ে রিকশা ঠিক করতে এগিয়ে গেল।
নীল রাগে বাইক স্টার্ট দিয়ে একেবারে তারার গা ঘেসে বাইক চালিয়ে কাদার উপর দিয়ে গেল।
রাস্তার কাদা পানি ছিটকে এসে তারার উপর পরে ওর সারা গায়ে কাদা মাখামাখি হয়ে গেছে।
তারা হা করে তাকিয়ে দেখছে নীল আর একবার পেছন ফিরে তাকালো পর্যন্ত না, সোজা চলে গেল।
তারার খুব কান্না পেল।কোনরকমে নিজেকে সামলে নিয়ে রিকশায় উঠে বসলো।

নীল বাসায় আসতেই নীরা বার জিজ্ঞেস করলো তারা কোথায়।নীল কোনো জবাব না দিয়েই নিজের ঘরে চলে গেল।নীরা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভাবছে আরাফাত সাহেবকে ব্যপারটা জানাবে কী না।বাবাকে জানালে যদি উত্তেজিত হয়ে পড়েন সেটা ভেবেই নীরা বাসার বাইরে এসে এদিক ওদিক দেখতে লাগলো।তারার রিকশা এসে থামলো তখন।
নীরা এগিয়ে গিয়ে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো,তোমার জামা কাপড়ের এই অবস্থা কেন তারা?আর তুমি রিকশায় এলে কেন ভাইয়া কী তোমাকে ফেলে এসেছে?
তারা শান্ত গলায় বললো, না আপু আমি ওনাকে বলেছি আমি রিকশায় আসবো তাই চলে এসেছেন।
তারার বলা কথাটা নীরার বিশ্বাস হলো না। মনে হলো কিছু একটা হয়েছে যেটা তারা বলছে না।যাই হোক নীরা এখন আর কথা না বাড়িয়ে তারাকে বাসায় নিয়ে গেল।তারা ফ্রেশ হয়ে খাওয়া দাওয়া শেষে নিজের ঘরে বসে আছে তখন নীরা এসে বসলো ওর কাছে।
তারা মুচকি হেসে বললো,আপু কিছু বলবে?
নীরা ওর পাশে বসে বললো,গল্প করতে এলাম তোমার সাথে।
–ভালো করেছো আমিও একা একা বসে ছিলাম।
–তারা একটা কথা সত্যি করে বলবে?
–হ্যা আপু বলো।
–ভাইয়ার সাথে আজকে কলেজে যাওয়ার সময় যা যা হয়েছে সব বলো তো আমাকে।
তারা কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললো,কিছু হয়নি আপু।
–হয়েছে আমি জানি, তুমি আমাকে বলবে না তো?
–বলছি,আংকেল বা আন্টিকে বলবে না তো?
–বলবো না।
তারা নীরাকে সবটা খুলে বললো।
নীরা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো,আমার ভাইয়া জানো তো সব সময়ই একটু রাগী কিন্তু এতোটা নিষ্ঠুর ছিল না।ওর মনটা খুব ভালো, বাইরে শক্ত খোলসের আড়ালে ওর মনটা ঢাকা পড়ে যায়।
ভাইয়ার এমন বদমেজাজী হয়ে যাওয়ার একটা কারণ আছে।
তারা কৌতহল নিয়ে বললো, কী কারণ আপু?
–বলবো অন্য একদিন।
তারার হঠাৎ মনে হলো বইয়ের ভিতর থেকে পাওয়া কাগজটার কথা।ও টেবিলের উপর থেকে কাগজটা নিয়ে নীরার দিকে এগিয়ে দিয়ে জানতে চাইলো,এটা কে লিখেছে আপু?
নীরা মুচকি হেসে বললো,আমার ভাইয়া।
তারা অবাক হয়ে বললো,উনি এটা লিখেছেন বিশ্বাস হচ্ছে না।
–এখনকার ভাইয়াকে দেখে বিশ্বাস না হওয়ারই কথা কিন্তু আমার ভাইয়া আরও অনেক কিছুই লিখতো।
-এখন লিখেন না?
-মনে হয় না।
-কেন আপু?
–বলেছিলাম না ভাইয়ার এমন বদমেজাজী হয়ে যাওয়ার পেছনে একটা কারণ আছে সেই কারণটা বলি তোমাকে।
তারা আগ্রহ নিয়ে বললো,বলো আপু।
নীরা বলা শুরু করলো..
চলবে..
লিখা: উম্মেহানি মিম

★#নীল_আকাশের_শুকতারা ★
————-(৬ষ্ঠ পর্ব)
ভাইয়ার একটা মেয়ের সাথে ফ্রেন্ডশিপ ছিল।ওরা শুধুমাত্র বন্ধুই ছিল কিন্তু ভাইয়া তিশা আপু মানে ঐ মেয়েটিকে ভালোবাসতো মনে মনে।তিশা আপু হয়তো ব্যপারটা বুঝতে পারে নি।ভাইয়া যে তিশা আপুকে ভালোবাসে এটা আমিও জানতাম।আমি অনেক বার ভাইয়াকে বলেছি তিশা আপুকে সবটা বলে দেই কিন্তু ভাইয়া বলতে দেয় নি, নিজেও বলেনি।
তবে ভাইয়া মাঝে মাঝেই তিশা আপুকে মজা করে বলতো ভালোবাসি।তিশা আপু সেগুলো বিশ্বাস করতো না হয়তো।হেসে উড়িয়ে দিতো।আর ভাইয়া মনে করতো তিশা আপু সবটা বুঝেই না বুঝার ভান করে।তো এভাবেই চলছিল হঠাৎ অনেক দিন হয়ে গেল তিশা আপুর ফোন বন্ধ,কলেজেও আসে না।ভাইয়ার তো পাগল পাগল অবস্থা।একদিন তিশা আপু ভাইয়াকে ফোন করে ডাকলো।ভাইয়া ঠিকানা অনুযায়ী দ্রুত চলে গেল।আর গিয়ে দেখলো তিশা আপু ওর হাসবেন্ডকে নিয়ে এসেছে।
সে দিন ভাইয়া বাসায় এসে পাগলের মতো কাঁদছিল।ও কল্পনাও করতে পারেনি এমন হবে।
আমি ভাইয়াকে অনেক বুঝালাম যে তিশা আপু হয়তো ভাইয়াকে শুধুমাত্র বন্ধুই ভেবেছিল কিন্তু ও সেটা মানতে চায় না।ভাইয়ার কথা অনুযায়ী তিশা আপু ওকে ঠকিয়েছে।সেই থেকে ভাইয়াটা অন্য রকম হয়ে গেল।মেয়েদের আর পছন্দ করে না আশেপাশে কাউকে দেখলেই খারাপ ব্যবহার করে।
বদমেজাজি, আবেগহীন হয়ে গেছে।
নীরা কথাগুলো বলে থামলো।
তারা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো।মনে মনে ভাবছে হয়তো নীলকে আজকে এতগুলো কথা শুনিয়ে ও ঠিক করেনি।

পর দিন সকাল সকাল উঠে নীরা আর তারা কলেজে যাওয়ার জন্য তৈরি হয়ে নিলো।
নীরা প্রতিদিন নীলের সাথে বাইকে কলেজ যায় কিন্তু আজকে তারা থাকায় ওরা আলাদা রিকশা নিলো।নীল আস্তে আস্তে বাইক চালিয়ে নীরাদের রিকশার পাশে পাশেই যাচ্ছে।

ক্লাস শেষে তারা একা একা দাঁড়িয়ে আছে আর নীরার জন্য অপেক্ষা করছে।নীরার ক্লাস শেষ হতে একটু সময় লাগবে।কিছুক্ষণ পর পরই দলে দলে মেয়েরা এসে তারার দিকে হা করে তাকিয়ে আবার চলে যাচ্ছে।
তারার খুব অস্বস্তি হচ্ছে, হয়তো কলেজে ও নতুন তাই সবাই এমন হা করে দেখছে।
কিন্তু এতো বড় কলেজে প্রতিদিন নিশ্চয়ই অনেক নতুন স্টুডেন্ট আসে সবাইকে কী এরা এমন করে দেখে! তারা নিজের মনে কথাগুলো ভাবছিলো
হঠাৎ অচেনা একটা মেয়ে এসে তারার পাশে দাঁড়ালো।ও খেয়াল করলো মেয়েটা ডেবডেব করে তাকিয়ে আছে ওর দিকে।তারার খুব অস্বস্তি হচ্ছিল।মেয়েটি এবার ফিসফিস করে বললো,তোমার নাম তারা?

তারা অচেনা একটা মেয়ের মুখে ওর নাম শুনে অবাক হয়ে বললো, জ্বি।

–ইন্টার মিডিয়েট ফার্স্ট ইয়ারে পড়ো?

–হুম।

–এতোটুকু একটা বাচ্চা মেয়ের জন্য নীল পাগল!তুমি তো আহামরি সুন্দরীও না।তোমার থেকে অনেক বেশি সুন্দরীরাও নীলের কাছে পাত্তা পায় না।

মেয়েটার কথা শুনে তারা চমকে উঠে বললো,কী বলছেন এসব আপনি?

মেয়েটি মুখ বাকিয়ে বললো,যেন বুঝতে পারছো না।তুমি নীলদের বাসায় থাকো না?নীলের বাবার বন্ধুর মেয়ে না তুমি?

–হ্যাঁ।

–তাহলে আর লুকাচ্ছো কেন ভাই? এখন তো নীল তোমারই, আমরা তো চাইলেই নিয়ে যেতে পারবো না।কীভাবে ওকে বশে আনলে বলো তো একবার।

তারা বিরক্ত হয়ে বললো,কী সব বলছেন আপনি।এমন কিছুই না।

–না মানে বশ না করলে নীল এমনি এমনি তোমার জন্য পাগল হয়ে যাবে? আমরা কত চেষ্টা করেও ওর সাথে বন্ধুত্ব পর্যন্ত করতে পারলাম না আর তুমি ওকে বয়ফ্রেন্ড বানিয়ে ফেললে।

–দেখুন আপনি যা বলছেন সব ভুল ওনার সাথে আমার সেরকম কোনো সম্পর্ক নেই।

মেয়েটা এবার কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললো,তুমি বলতে চাও না বুঝতে পারলাম, মেয়েরা অবশ্য এসব লুকিয়েই রাখতে পছন্দ করে কিন্তু একটা কথা শুনে রাখো কলেজের অর্ধেকের বেশি স্টুডেন্ট তোমাদের সম্পর্কের ব্যপারে জানে তাই বেশি দিন এটা লুকিয়ে রাখতে পারবে না।

তারা এবার অসহ্য হয়ে কিছু বলতে যাবে খেয়াল করলো নীরা এদিকে আসছে।
মেয়েটা নীরাকে দেখতে পেয়ে আসছি বলে দ্রুত পায়ে হেটে চলে গেল।
নীরা এসে তারাকে এভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বললো,কতক্ষণ থেকে দাঁড়িয়ে আছো তুমি?
–এই তো আপু কিছুক্ষণ হবে।
তারা মেয়েটার বলা কথাগুলো নীরাকে বলতে যাবে খেয়াল করলো নীল এসে দাঁড়িয়েছে।ও চুপ হয়ে গেল।
নীরা বললো,তারা তুমি প্লিজ ভাইয়ার সাথে চলে যাও আমার আরেকটা ক্লাস আছে একটু সময় লাগবে।ভাইয়া তোমাকে ঠিকঠাক নিয়ে যাবে আমি বলে দিয়েছি উল্টাপাল্টা কিছু করলে আমি নিজে বাবাকে বলবো।তুমি নিশ্চিন্তে যাও বনু।

–আপু আমি অপেক্ষা করবো তোমার জন্য।আমার কোনো সমস্যা নেই।

–না আমার অনেক দেরী হবে তুমি এখানে একা একা দাঁড়িয়ে থাকবে এটা হয় না তারা।ভাইয়ার সাথে যাও আমি বলছি তো সেদিনের মতো কিছুই হবে না।

নীলের সাথে যেতে তারার প্রচন্ড অস্বস্তি হচ্ছে নীরাকে কিছুতেই বুঝাতে পারলো না তাই বাধ্য হয়েই রাজি হলো।

নীল সামনে হাটছে তারা পেছন পেছন।
চারিদিক থেকে বেশ কয়েকটা মেয়ে আবার ওদের দিকে ডেবডেব করে তাকিয়ে আছে।তারার প্রচন্ড অস্বস্তি হচ্ছে।বার বার মনে পড়ছে একটু আগে অচেনা মেয়েটার বলা কথাগুলো।
নীল ওর বাইকের কাছে এসে বললো,উঠে বসো আজকে আস্তে চালাবো।
তারা আনমনেই ভাবছিল।নীল একটু জোরে ডাক দিলো, তারা!
তারা চমকে উঠে বললো, হুম?
–আজকে কলেজে কেউ আগের দিনের মতো বিরক্ত করেছে?
–না।
নীল মুচকি হেসে বললো আর কেউ বিরক্ত করবেও না।নিশ্চিন্তে পড়াশোনা করো তুমি।
নীল বাইকে উঠে স্টার্ট দিতে যাবে তখনই তারা দ্রুত বললো,কলেজে সবাইকে কিছু বলেছেন আপনি?
নীল মুখ ঘুরিয়ে বললো,যা বলার বলেছি তোমার এসব নিয়ে ভাবতে হবে না।
তারপর ধমক দিয়ে বললো, উঠে বসো নাহলে ফেলে রেখে চলে যাবো।
তারা আর কিছু না বলে বাইকে উঠে বসলো।

বাসায় ফিরেছে থেকে তারা স্বস্তি পাচ্ছে না।বার বার ভাবছে ঐ মেয়েটির বলা কথাগুলো। নীরা তারাকে এতো চিন্তিত দেখে অনেক বার জিজ্ঞেস করলো কী হয়েছে।তারা সবটা বলে দিলো।
নীরা সবটা শুনে অবাক হয়ে বললো,এসব তুমি কী বলছো?চলো তো ভাইয়াকে গিয়ে জিজ্ঞেস করি ঘটনা আসলে কী!
তারা ভয়ে ভয়ে বললো,আমি যাবো না আপু তুমি গিয়ে জিজ্ঞেস করো।
নীরা জোর করে তারাকে টেনে নিয়ে গেল।
নীলের দরজায় নক করতেই নীল ভিতর থেকে বললো,দরজা খোলা আছে।
নীরা তারাকে নিয়ে ঘরে ঢুকে নীলের বিছানার পাশে গিয়ে দাঁড়ালো। তারপর নীলের হাত থেকে ওর ফোনটা ছিনিয়ে নিয়ে বললো,ভাইয়া কলেজে তুই তারার সম্পর্কে কিছু বলেছিস?আর যদি কিছু বলে থাকিস এখন বল আমাদের।
নীল নীরার হাত থেকে ফোনটা টেনে নিয়ে বললো,যা এখান থেকে।
নীরা চেঁচিয়ে বললো, ভাইয়া সবকিছুতেই তোর ধমক ভালো লাগে না আমার।তারাকে অপ্রস্তুত করার জন্যই এসব করেছিস তাই না?
নীল এবার বিরক্ত হয়ে বললো,অপ্রস্তুত করার জন্য করিনি, যাতে কেউ ওকে অপ্রস্তুত না করতে পারে সে জন্য করেছি।সেদিন নিজের চোখে দেখেছি ছেলেরা ওর সাথে কীভাবে খারাপ আচরণ করছিল। আমার বাসার মেয়ে বাইরে লোকজন এমন করবে আমি সেটা সেটা সহ্য করবো না।আমার বাসার বাইরে গিয়ে বল যেখানে সেখানে যা খুশি তা করতে আমার কোনো মাথা ব্যথা নেই।কলেজে আমার একটা সম্মান আছে সেই সম্মানটা বাঁচাতেই বলেছি তারা আমার বাবার বন্ধুর মেয়ে,আমার অনেক ঘনিষ্ঠ আত্মীয় ,আমাদের বাসায় থাকে।সবাই ভেবে নিয়েছে ও আমার গার্লফ্রেন্ড। সবাই যদি বেশি ভাবে এতে আমার কী করার আছে? তাছাড়া আমি আর বেশি কিছু বলতে চাইনি কারণ এটা শুনার পর আর কেউ ওকে বিরক্ত করার সাহস পাবে না।ছোট্ট একটা কথা সবাই ভেবে নিয়েছে আর দেখ পরিবেশটাই বদলে গেছে।
তারা প্রচন্ড অবাক হয়ে নীলের কথা শুনছে আর মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে।
নীরা চোখ বড় বড় করে বললো,এটা ছোট্ট কথা?আচ্ছা ঠিক আছে বুঝলাম কলেজের সবাই এটা বুঝে নেয়ায় তারার ভালোই হবে ওকে ছেলেরা বিরক্ত করবে না।কিন্তু তুই যে কলেজের রোমিও তোর জুলিয়েটরা যে এবার তারার মাথাটা খাবে সে বেলায়?
নীল ফোন ঘাটতে ঘাটতে বললো,আমি ওদেরও বলে দিবো যাতে কেউ তারাকে বিরক্ত না করে তুই এখন আমার ঘর থেকে বের হ নাহলে ঘাড় ধরে বের করে দিবো।
আর শুন যখন তখন আমার ঘরে আসবি না আর তুই এসেছিস ভালো কথা যাকে তাকে নিয়ে আসার কী দরকার?
নীরা হা করে তাকিয়ে রইলো নীলের দিকে।তারা দ্রুত পায়ে হেটে নীলের ঘর থেকে বেরিয়ে এলো।

পরদিন তারা তৈরি হচ্ছে কলেজ যাওয়ার জন্য।মনে মনে প্রচন্ড ভয় হচ্ছে।নীল কলেজে সবাইকে যা বলেছে এরপর কলেজ জীবন যে তারার জন্য শোভনীয় হবে না সেটা পরিষ্কার বুঝতে পারছে।
আজকে কলেজে গিয়ে নতুন কোনো ঝামেলায় না পড়লেই হয়।
নীরা এসে তারাকে ডাকতেই দুজনেই কলেজের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লো..
চলবে…

লিখা: উম্মেহানি মিম

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here