নীল_আকাশের_শুকতারা,০৯,১০

0
1179

#নীল_আকাশের_শুকতারা,০৯,১০
(৯ম পর্ব)

নীরা নীলের বিড়বিড় করে কথাগুলো পুরোপুরি বুঝতে পারলো না তবে কিছুটা আন্দাজ করলো তারাকে নিয়েই কিছু বলছে।ও তারাকে ডাকলো।তারা ইতস্তত করে ঘরে প্রবেশ করলো।
নীরা কাঁদো কাঁদো হয়ে বললো,ভাইয়ার সারা শরির পুড়ে যাচ্ছে মনে হয় জ্বর এসেছে।কী জানি বলছে তোমাকে নিয়ে একটু শুনে দেখো তো।
তারা গুটি গুটি পায়ে নীলের কাছে এগিয়ে গেল।তারপর মেঝেতে বসেই নীলের বিড়বিড় করে বলা কথাগুলো শুনার চেষ্টা করলো।নীল বলছে,তারাকে আমি বৃষ্টিতে রেখে এসে ছিলাম,তারার এই অবস্থার জন্য আমি দায়ী।ওর কাছে আমি ক্ষমা চাইতে গিয়েও পারি না, মেয়েটার সাথে আমি খারাপ ব্যবহার করতে চাই না তবুও অনেক খারাপ ব্যবহার করি।
তারা পরিষ্কার শুনতে পেলো নীলের বলা কথাগুলো।দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে নীরাকে বললো,আপু তাড়াতাড়ি আংকেলকে ফোন দাও ডাক্তার আনতে হবে।ওনার জ্বর তো মনে হচ্ছে অনেক বেশি তাই উল্টাপাল্টা বকছেন।
নীরা দ্রুত পায়ে হেটে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল আরাফাত সাহেবকে ফোন করার উদ্দেশ্যে।
নীল বিড়বিড় করেই চলেছে।তারা এবার কিছুটা আমতা আমতা করে বললো, আপনি চুপ করে থাকুন কথা বলবেন না,আমি সত্যিই কালকের ব্যপারটা ভুলে গেছি।আর আপনি যে অসুস্থ হলেন সেটা তো আমারই জন্য।
নীল চোখ বন্ধ অবস্থায়ই বললো,কে?
তারা আস্তে করে বললো,তারা।
-কোন তারা?
-আমি শুকতারা।
শুকতারা তো থাকে ভোরের নীল আকাশে,নীল আকাশের শুকতারা আজ মাটিতে নেমে এলো কেন?
নীল অগোছালো ভাবে কথাগুলো বললো।তারা বুঝতে পারছে নীল জ্বরের ঘুরে যা তা বলছে।তাই আর কিছু বললো না।
হালিমা বেগম হন্তদন্ত হয়ে ছেলের ঘরে ঢুকলেন ওনাকে বেশ অস্থির দেখাচ্ছে।তারা নীলের থেকে খানিকটা সরে এলো।
হালিমা বেগম ছেলের কাছে বসে মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন আর আঁচল দিয়ে চোখ মুছছেন।

নীলকে ডাক্তার দেখানো হলে ঔষধ খাইয়ে দেয়া হলো।জ্বর খানিকটা কমেছে কিন্তু বেঘোরে ঘুমাচ্ছে।
হালিমা বেগম রান্নাবান্না আর ছেলের যত্ন করতে গিয়ে হাপিয়ে গেছেন।আজ বাসায় মেহমান আসবেন সে কথা যেন নীলের অসুস্থতায় তিনি ভুলেই গিয়ে ছিলেন।তাড়াহুড়ো করে রান্না করছেন।আর কিছুক্ষণ পরেই দেশের মাটিতে পা রাখবেন আতিয়া এবং ওনার দুই ছেলে।নীল গিয়ে ওনাদের রিসিভ করার কথা ছিল কিন্তু এখন তো সেটা সম্ভব হচ্ছে না তাই হালিমা নীরা আর তারাকে বললেন এয়ারপোর্টে যেতে।
নীরা আর তারা দ্রুত তৈরি হয়ে বেরিয়ে পড়লো।
দশ-পনেরো মিনিটের মধ্যেই ওরা এয়ারপোর্টে পৌঁছে গেল।নীরাকে বেশ প্রফুল্ল দেখাচ্ছে।
তারার মনে নানা রকম দুশ্চিন্তা বাসা বেধেছে। অচেনা মানুষজন আরাফাত সাহেবের বাসায় আসছেন তারাকে ওনারা কীভাবে নিবেন সেটাই চিন্তার বিষয়।
তারাকে চিন্তিত দেখে নীরা বললো,কী হয়েছে তারা?
-কিছু না আপু।
-কিছু নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছো?
– তেমন কিছু না আপু।
নীরা তারাকে কিছু বলতে যাবে তখনই চিৎকার করে উঠলো,ফুপিরা এসে গেছে। এই তো আকাশ ভাই আর মেঘ।
নীরা দ্রুত এগিয়ে গেল।তারা এগিয়ে না গিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো।দূর থেকে তাকিয়ে দেখলো,নীরা যে ছেলেদের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়েছে তাদের দুজনেই সুট পরে আছে,একজন সাদা রঙের আরেকজন হালকা নীল।হালিমা বেগমের কথা অনুযায়ী দুজনেই বেশ সুদর্শন। তারা ভাবছে এই পরিবারের প্রত্যেকটা ছেলে-মেয়েই যেন প্রতিযোগিতা করে জন্মেছে কে কার থেকে বেশি মায়াবী চেহারা নিয়ে জন্মাবে।নীল আর নীরা যেমন ঠিক তেমনই এই দুই ভাই।
তারা একজন মধ্যবয়সী মহিলাকে খেয়াল করলো নীরাকে জড়িয়ে ধরেছেন।উনি সম্ভবত আতিয়া ফুপি।
ওনার চেহারায় বয়সের কোনো ছাপ নেই।বিদেশী বলে মনেই হচ্ছে না, কী সুন্দর বাদামী রঙের একটা শাড়ি পরে আছেন।
নীরা এবার ওনাদের নিয়ে তারার সামনে এসে দাঁড়ালো।তারা মাথায় হাত দিয়ে নিশ্চিত হয়ে নিলো ওর ওড়নাটা মাথায় ঘোমটা টানা আছে কী না।
নীরা মুচকি হেসে ওর ফুপিকে উদ্দেশ্য করে বললো,এটা হচ্ছে তারা।বাবার বন্ধু যে সাহেদ আংকেল ওনার মেয়ে।ও আমাদের সাথেই থাকে এখন।
আতিয়া মুখ বাকিয়ে বললেন,তোর মা সবটাই বলেছে আমাকে ওই ডিভোর্সি বাবা,মায়ের মেয়ে তো এটা?তো ওকে এখানে নিয়ে এসেছিস কেন?
আতিয়ার কথা শুনে তারার মুখটা কালো হয়ে গেল।নীরাও বেশ অপ্রস্তুত হয়ে বললো,আমি একা একা আসবো তো তাই মা বললো ওকে নিয়ে আসতে।
আতিয়া আর কিছু না বলেই সামনে এগিয়ে গেলেন।ইশারায় আকাশ আর মেঘকেও ডাকলেন।
মেঘ এগিয়ে গেল।
আকাশ এতক্ষণ খেয়াল করছিল, গোলাপি সেলোয়ার-কামিজ পরা তারা নামের মেয়েটা মাথায় ওড়না দিয়ে ঘোমটা টেনে বেশ হাসিখুশি মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে।মনে হচ্ছিলো একটা পূর্নিমার চাঁদ হাসছে।
কিন্তু ওর মায়ের কথা শুনা মাত্রই মেয়েটার মুখ যেন কালো মেঘে ঢেকে যাওয়া চাঁদের মতো হয়ে গেল।
আকাশ কিছু বলতে গিয়েও বলতে পারলো না আতিয়া এবার জোরে ডাকলেন,আকাশ এসো।
আকাশ দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে এগিয়ে গেল।
নীরা এবার তারার হাতটা ধরে বললো, পৃথিবীর প্রত্যেকটা মানুষ সমান হয় না তারা।সবার মন, মানসিকতা আলাদা আলাদা।কিন্তু তুমি যেমন ঠিক তেমনই, কেউ নিজের মতো করে তোমাকে ছোট ভাবলেই তুমি ছোট হয়ে যাবে না।আমি জানি তারা তার মিষ্টি স্বভাব দিয়ে সবার মন জয় করতে জানে যেমনটা আমার মায়ের করেছে।
তারা নীরার কথাগুলো শুনে ছলছল চোখ নিয়েই মুচকি হাসলো।

ঘড়িতে রাত দশটা বেজে পনেরো মিনিট।
আতিয়া এবং ওনার দুই ছেলে খাওয়া দাওয়া করে যার যার ঘরে চলে গেছেন।এতোটা জার্নি করে আসায় তিনজনেই বেশ ক্লান্ত ছিলেন।
নীলের জ্বর ছেড়েছে কিন্তু বিছানা থেকে উঠে দাঁড়াতে পারছে না।নীরা আর আরাফাত সাহেব খেয়ে নিয়েছেন বোন আর ভাগিনাদের সাথে।তারাকে ডাকলেও ও আসেনি।রান্নাঘর থেকে সবটা গুছিয়ে দিচ্ছিলো।
হালিমা বেগমও তারাকে রেখে খেতে চাই ছিলেন না তাছাড়া নীলকেও খাওয়ানো হয়নি।উনি নীলকে কোনো রকমে কয়েক চামচ সুপ খাইয়ে দিয়ে এসে খেতে বসেছেন।তারাও বসেছে।
খাওয়া শেষে আতিয়া থালা, বাটি গুলো পরিষ্কার করতে গেলে তারা ওনাকে ঘরে পাঠিয়ে দিয়ে নিজেই সবগুলো পরিষ্কার করলো।
তারপর রান্নাঘর গুছিয়ে বেরিয়ে এসে উপরে নিজের ঘরে যাবে তখনই খেয়াল করলো আকাশ ওর ঘর থেকে বেরিয়ে কিছু একটা খুঁজচ্ছে।
তারাকে দেখতে পেয়ে আকাশ ইতস্তত করে বললো,আমার রাতে পানি লাগে কিন্তু কোথা থেকে পানি নিবো বুঝতে পারছি না।
তারা খেয়াল করলো, আকাশ পরিষ্কার বাংলা বলছে।ও মুচকি হেসে বললো,আমি এনে দিচ্ছি।
তারপর রান্না ঘর থেকে এক বোতল পানি এনে দিলো আকাশকে।
আকাশ মুচকি হেসে বললো,ধন্যবাদ।
তারা বেশ অবাক হলো আকাশের মুখে ধন্যবাদ শব্দটা শুনে। সচরাচর বিদেশীরা বাংলা বললেও টুকটাক শব্দ ইংলিশেই বলে কিন্তু ছেলেটা একদম আলাদা।
আকাশ চলে যেতে গিয়েও ফিরে তাকালো,তারপর বললো,ও আচ্ছা আপনার সাথে তো আমার পরিচয়ই হয়নি, আমি আকাশ চৌধুরি।আপনি?
-শুকতারা আহমেদ, সবাই তারা বলে।
-বাহ!শুকতারা মানে মর্নিং স্টার তো?আপনার নামটা বেশ সুন্দর, সবাই তারা কেন বলে?
তারা মুচকি হেসে বললো,জানি না,সম্ভবত শুকতারা নামটা অনেক বড় তাই।
-বড় হলেই একটা নাম কেটে ছোট করে ডাকা লাগবে এটা আমার মোটেও পছন্দ না।আমি আপনাকে শুকতারাই বলবো ঠিক আছে।
তারা মাথা নাড়ালো,সে এখনও অবাক হয়ে ভাবছে আকাশ কী সুন্দর বাংলায় কথা বলে।
আকাশ যেন তারার ভাবনাটা বুঝেই বললো,কিছু ভাবছেন?
তারা সরল স্বীকারোক্তি দিলো,আসলে আপনি যেভাবে বাংলা বলছেন আমি এর আগে কোনো বিদেশীকে এভাবে কথা বলতে দেখিনি।সেটাই ভাবছিলাম।
আকাশ হাসলো,তারপর বললো,বিদেশে থাকলে কী হয়েছে আমরা তো বাঙালী।আর আমাদের বাংলা ভাষার জন্য কত শহীদ নিজের প্রাণ বিলিয়ে দিয়েছেন সেই ভাষাই যদি রপ্ত না করতে পারি এটা তো আমাদের জন্য লজ্জার।আর আমি কিন্তু বিদেশে জন্মগ্রহণ করিনি।বাবা ইংল্যান্ড ছিলেন,তারপর আমাদের নিয়ে গেলেন। আমি তখন ক্লাস নাইনে পড়ি যখন আমাদের নিয়ে যান।আমি বাবা মায়ের সাথে সব সময়ই বাংলায় কথা বলি।
মেঘের একটু সমস্যা হয় তবুও আমি চেষ্টা করি ও জাতে বাংলাটা ভুলে না যায়।কেউ যেন এটা না বলতে পারে আমরা বাঙালী না।
আকাশের কথা শুনে তারা সত্যিই মুগ্ধ হয়ে গেল।ভিনদেশে থেকেও দেশের প্রতি,দেশের ভাষার প্রতি কত টান ওর।
আকাশ এবার মুচকি হেসে বললো,খুব ঘুম পাচ্ছে সকালে কথা হবে ঠিক আছে শুকতারা।গুড নাইট।
তারা মুচকি হেসে বললো, শুভ রাত্রি।

সকাল সকাল তারা উঠে নামাজ পড়ে রান্নাঘরে এলো।আরাফাত সাহেব আর হালিমা বেগম উঠে পড়বেন।প্রতিদিন সকালে তিন কাপ চা বানানো ওর নিয়মিত কাজ হয়ে গেছে।সকাল সকাল চা বানিয়ে একসাথে বসে খেতে কী যে ভালো লাগে তারার।
রান্নাঘরে এসে নীলকে দেখে তারা অবাক হয়ে গেল।ভোরে ও কখনই জাগে না।নীল কয়েকটা পাউরুটি গরম করতে গিয়ে পুড়িয়ে ফেলেছে সেগুলো কোনো রকমে থালায় নেয়ার চেষ্টা করছে।রাতে তো ওর খাওয়া হয়নি হয়তো ভোরবেলা ক্ষিদে পেয়েছে।
তারা দ্রুত এগিয়ে গিয়ে বললো, এগুলো তো পুড়ে গেছে আপনি সরে দাঁড়ান আমি করে দিচ্ছি।
নীল পুড়া পাউরুটি গুলো তুলে বললো,থাক আমি এগুলোই খেতে পারবো।
তারা এবার নীলের হাত থেকে থালাটা নিয়ে রেখে দিয়ে একটু কঢ়া গলায় বললো,এগুলো খাওয়ার যোগ্য না, এমনিতেই অসুস্থ ছিলেন এখন এসব অখাদ্য খেয়ে অসুখ বাধাবেন।বলছি তো আমি করে দিচ্ছি বেশি সময় লাগবে না,এতো অবাধ্য কেন আপনি?
তারা কথা বলতে বলতে পাউরুটি গরম হতে দিয়ে ফ্রিজ থেকে ডিম বের করে আনলো অমলেট বানাবে বলে।
নীল এর আগে কখনও তারার এমন কঢ়া আচরণ দেখেনি সব সময় নীলের সামনে ভয়ে ভয়ে কাঁপা গলায় কথা বলে।ও কিছুটা অবাক হয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো।
তারা পাউরুটি আর অমলেট নিয়ে নীলের হাতে দিয়ে বললো,আপনি গিয়ে খেয়ে নিন আমি আপনার জন্য দুধ গরম করে নিয়ে আসছি।দুধ-ডিম খেলে একটু শক্তি পাবেন।
নীল বিরক্ত গলায় বললো, না না আমি দুধ খাই না।
তারা গলা চওড়া করে বললো,ঔষধ মনে করে খেতে হবে আজ, আমি আপনার ঘরে দিয়ে আসবো এখন আপনি ঘরে গিয়ে তাড়াতাড়ি নাস্তাটা খেয়ে নিন।
নীল আর কিছু বললো না সোজা ওর ঘরে চলে গেল।
তারা দুধ গরম করলো,চা বানালো তারপর দুধের গ্লাস নীলের ঘরে দিয়ে চা নিয়ে হালিমা বেগম আর আরাফাত সাহেবের ঘরে গেল।
ততক্ষণে আতিয়া উঠে গেছেন।ওনার রাতে ঠিকঠাক ঘুম হয়নি। হালিমা বেগমের ঘরে সোফায় বসে আছেন।তারা সালাম দিয়ে ঘরে ঢুকলো।আরাফাত সাহেব তারাকে দেখতে পেয়ে বললেন,এই তো তারা মা এসে গেছে চা নিয়ে। মা তোমার ফুপির জন্য আরেক কাপ চা বানাতে পারবে কষ্ট করে?ওর ঘুম হয়নি নাকি রাতে, মাথা ধরেছে।
আতিয়া তৎক্ষণাৎ উঠে দাঁড়িয়ে বললেন,দরকার নেই ভাইজান, আমার চা আমি নিজে বানিয়ে নিতে পারবো।
হালিমা বেগম উঠে দাঁড়িয়ে বললেন,আমি করে দিচ্ছি।
তারা ইতস্তত করে বললো,আন্টি আমি বানিয়ে দিতে পারবো তো।
আতিয়া খানিকটা রেগে বললেন,তোমার হাতে চা আমি খাবো না বুঝতে পারছো না?
তারার মুখটা কালো হয়ে গেল।ও হালিমা বেগম আর আরাফাত সাহেবের চা-টা রেখে দিয়ে নিঃশব্দে ঘর থেকে বেরিয়ে এলো।
তারা বেরোতেই আরাফাত সাহেব বললেন,আতিয়া মেয়েটা আমার মেয়ের মতোই আর অনেক লক্ষ্মী।তোর ভাবীও মেয়েটাকে পছন্দ করতো না কিন্তু এখন কিছুটা হলেও করছে।মেয়েটার তো কোনো দোষ নেই বল।
আতিয়া গলা চওড়া করে বললেন,মা বাপের ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে সেই বাপ মায়ের সন্তান কেমন হতে পারে আমি বুঝি ভাইজান।যত চাই বলো না কেন আমি তো আর অবুঝ না।আর ভাবী শুনো এই মেয়েটাকে বলে দিও আমার ছেলেদের আসে -পাশে যেন না যায়।আমার ছেলেরা এতো প্যাচ -ট্যাচ বুঝে না সরল মনের ছেলে আমার।এই সমস্ত মেয়েরা নিজের জায়গা তৈরি করার জন্য মিষ্টি মিষ্টি কথায় মানুষ ভুলাতে পারে।বাবা-মা যে মেয়েকে নিজের কাছে রাখলো না আত্নীয় -স্বজন যেখানে খোঁজ নেয় না সেখানে তোমাদের কাছে থাকতে আসে কোন আক্কেলে?
আরাফাত সাহেব বললেন,আমি ওকে আমার কাছে নিয়ে এসেছি তাই এসেছে ও জোর করে তো আসেনি।

আতিয়া এতো জোরে কথাগুলো বললেন যে তারা ঘরের বাইরে থেকেও কথাগুলো পরিষ্কার শুনতে পেলো।ওর চোখদুটো ছলছল করে উঠলো, দ্রুত নিজের ঘরে চলে আসার জন্য হাটা ধরলো সে।
আরাফাত সাহেবের ঘরের পরেই নীলের ঘর ওর দরজা খোলা ছিল বিধায় তারাকে দেখতে পেয়ে ডাকলো,তারা একটু ভিতরে এসো।
তারা চোখ মুছে দরজায় গিয়ে দাঁড়ালো।
নীল ভ্রু কুচকে বললো, ভিতরে আসতে বলেছি এখানে দাঁড়িয়ে আছো কেন?
তারা মুখ ঘুরিয়ে বললো,যা বলার বলুন ভিতরে আসতে পারবো না।
নীল তারার অবাধ্যতা দেখে বেশ অবাক হয়ে গেল।তারপর চেঁচিয়ে বললো,
চলবে….

লিখা: উম্মেহানি মিম

★ #নীল_আকাশের_শুকতারা ★
——————-(১০ম পর্ব)
নীল ভ্রু কুচকে বললো, ভিতরে আসতে বলেছি এখানে দাঁড়িয়ে আছো কেন?
তারা মুখ ঘুরিয়ে বললো,যা বলার বলুন ভিতরে আসতে পারবো না।
নীল তারার অবাধ্যতা দেখে বেশ অবাক হয়ে গেল।তারপর চেঁচিয়ে বললো,ভিতরে আসতে বলেছি মানে আসবে, পারবো না মানে কী?
তারা ঠায় দাঁড়িয়ে বললো, বলছি তো কিছু বলার থাকলে বলুন আর না থাকলে আমি চলে যাবো।অহেতুক চিৎকার, চেচামেচি করবেন না আমার সাথে।
তারার কথা শুনে নীল দাঁতে দাঁত চেপে নিজের রাগ সংযত করে এগিয়ে এলো ওর কাছে,তারপর গর্জন করে বললো,আমি ডেকেছি তাও আমার মুখের উপর বলছো পারবে না, ঠিক আছে যাও এখান থেকে আর কখনও আমার চোখের সামনে তোমাকে যেন না দেখি।
নীল কথা গুলো বলে তারাকে ধাক্কা দিয়ে দরজা থেকে সরিয়ে দিয়ে দরজা বন্ধ করতে যাবে তখনই খেয়াল করলো তারা ফুপিয়ে কাঁদছে।নীলের কেমন যেন খারাপ লাগা শুরু হলো ও ঢুক গিলে তারার কাছে এগিয়ে গিয়ে বললো,কী হয়েছে তারা?আমি ধাক্কা দেয়াতে তুমি কী ব্যথা পেয়েছো?
নীল কথাগুলো বলতে বলতে তারার হাত ধরে কোথায় ব্যথা পেয়েছে দেখার চেষ্টা করতেই তারা ঝাড়ি দিয়ে নীলের হাতটা সরিয়ে ওর থেকে কয়েক হাত দূরে সরে গেল।তারপর চোখ মুছে কাঁদো কাঁদো গলায় বললো, আমার কিচ্ছু হয়নি।আমার কখনই কিছু হয় না।আপনারা যখন খুশি আমার সাথে চিৎকার চেচামেচি করবেন,যা খুশি তা বলবেন তবুও আমার কিছুই হবে না কারণ এটাই আমার নিয়তি।আমি তো আপনাদের আশ্রিতা।আপনাদের দয়ায় বেঁচে আছি আমার কিছু হওয়া সাজে না।
তারা ফুপিয়ে ফুপিয়ে কথাগুলো বলে দৌড়ে চলে গেল।
নীল স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো।

সকালের নাস্তা খেতে সবাই টেবিলে এসে বসেছেন।
আরাফাত সাহেব বেশ কয়েক বার তারাকে ডাকায় ও এসে দাঁড়িয়েছে ওনার সামনে।আরাফাত সাহেব নরম গলায় বললেন,মা কাল থেকে খেয়াল করছি তুমি আমাদের সাথে খাও না কেন বলো তো?
তারা কাচুমাচু করে জবাব দিলো,আপনাদের খাওয়া হয়ে গেলেই আমি খেয়ে নেই আংকেল, সবাই একসাথে খেতে বসলে কারোর কিছু লাগলে কে এনে দিবে বলুন।
হালিমা বেগম তারার কথা শুনে বললেন,তুমি খেতে বসো চুপচাপ কারোর কিছু লাগলে আমি এনে দিবো।
তারা আর কিছু না বলে নীরার পাশের চেয়ারটা টেনে বসলো।
আকাশ খেতে খেতে নীলকে উদ্দেশ্য করে বললো,কি ব্যপার নীল সাহেব কালকে থেকে আপনার কোনো খোঁজ নেই।
নীল মুচকি হেসে বললো,কালকে জ্বরের ঘুরে ছিলাম ভাই তাই তোরা কখন এসেছিস খেয়ালই নেই।সরি।
আকাশ হেসে বললো, আর সরি বলতে হবে না তুই যে অসুস্থ ছিলিস সেটা কালকেই এসে জানলাম তাই তো আর তোকে ডিস্টার্ব করিনি।
আতিয়া আকাশকে থামিয়ে দিয়ে বললেন,তোরা থাম তো আমি একটা কাজের কথা বলবো।ভাইজান কোর্টে চলে যাওয়ার আগেই বলে ফেলি।
আরাফাত সাহেব চায়ে চুমুক দিয়ে বললেন,যা বলার তাড়াতাড়ি বল আতিয়া আমি কিছুক্ষণ পরই বেরিয়ে যাবো।
আতিয়া আরাফাত সাহেব আর হালিমা বেগমকে উদ্দেশ্য করে বললেন,ভাইজান আর ভাবী এবার আমি দেশে এসেছি কিন্তু এমনি এমনি না।আমার বড় বেটার বউ নিয়ে যাবো বলেই এসেছি।বয়স তো আর কম হলো না এখনই বিয়ে শাদি না করালে নাতি-নাতনির মুখ আমার আর দেখা হবে না।
মেঘ হেসে বললো,আমি জানতাম মায়ের ইমপোর্টেন্ট কথা মানেই ভাইয়ার বিয়ে।
আতিয়া চোখ রাঙিয়ে মেঘের দিকে তাকাতেই ও চুপ হয়ে গেল।
আকাশ বিরক্ত গলায় বললো, মা প্লিজ এখনই এসব না।আমি এবার দেশটা ঘুরে দেখতে এসেছি।আমরা সবাই মিলে ট্যুরে যাবো,ছোটবেলায় যেমন চুড়ইভাতি করতাম সেরকম করবো।তারপর তোমার যা ইচ্ছা তাই করো।
আতিয়া দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন,যখনই বিয়ের কথা বলি এই ছেলে একটা না তো একটা অজুহাত দেয়।এবার আমি তোর বিয়ে না দিয়ে ফিরে যাবো না বললাম।
আতিয়া কথাটা বলতে বলতে খাবার ছেড়ে উঠে চলে গেলেন।হালিমা ওনার পেছন পেছন গেলেন।
আরাফাত সাহেব চা শেষ করে উঠে দাঁড়িয়ে বলেন,আমার দেরী হয়ে যাচ্ছে তোরা মা বেটা মিলে ঝগড়া কর আমি আসি।
নীরা এবার শব্দকরে হাসা শুরু করলো।ওর হাসি দেখে আকাশ, মেঘ আর নীলও হাসছে।
নীরা হাসতে হাসতে বললো,আমার জ্ঞান হয়েছে থেকে দেখছি ফুপি আকাশ ভাইয়ের বিয়ের জন্য সিরিয়াস।এখনও একই রকম আছে।আকাশ ভাই তুমিও বিয়ে করে নিলেই তো পারো, ফুপির এতো শখ তোমার বিয়ে নিয়ে।
আকাশ হেসে বললো,মা এবার সত্যি সত্যি আমার বিয়ে দিবে এটাই ঠিক করেছে।আমি তো আর না করছি না, শুধু বললাম একটু নিজেরা দেশটা ঘুরে দেখি,এনজয় করি তারপর এসব কথা ভাবা যাবে।
আর এটা শুনেই মা রেগে গেল।
ওদের কথার মাঝখানেই তারা উঠে দাঁড়ালো।
নীরা তারার দিকে তাকিয়ে বললো,তারা কী খেলে তুমি এতো তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে গেল।
তারা মুচকি হেসে বললো,আমার খাওয়া হয়ে গেছে আপু।তোমাদের জন্য কফি বানিয়ে আনি?
আকাশ বললো, মনে মনে কফিই চাইছিলাম এখন।
তারা রান্নাঘরে চলে গেল কফি বানাতে।
নীল নীরাকে ডেকে বললো,গিয়ে বলে আয় আমি কফিতে চিনি বেশি খাই।
নীরা ঠোঁট বাকিয়ে বললো, বলে ছিলাম সেদিন, আর বলতে হবে না।
আকাশ নীলকে উদ্দেশ্য করে বললো,তা বস আর কতদিন একজনের বিরহে জীবন কাটাবি এবার নতুন করে শুরু কর।
নীল মুচকি হেসে বললো,কারোর বিরহে তো দিন কাটাই না আমি, প্রেম-ভালোবাসা এসবের প্রতি মন উঠে গেছে।
-আমরা চাই এমন কেউ আসুক তোর জীবনে যে তোকে আবার প্রেমে পড়তে বাধ্য করবে,কী বলিস নীরা।
আকাশ কথাটা বলে হাসলো।নীরাও মাথা নাড়িয়ে হাসলো।
ওদের কথার মাঝখানে তারা তিন কাপ কফি নিয়ে হাজির হলো।নীরা তিন কাপ দেখে একটু অবাক হয়ে বললো,তুমি তো কফি খাও না কিন্তু আমি তো খাই, আমার জন্য বানালে না তারা?আচ্ছা ভাইয়ার কফিতে চিনি বাড়িয়ে দিয়েছো তো?
তারা মেঘ আর আকাশকে কফি দিয়ে নীরার কাছে এসে বললো ,ওনার জন্য তো বানাইনি এটা তোমার কফি।
কথাটা শুনে নীল চোখ বড় বড় করে তাকালো।
নীরা অবাক হয়ে বললো,মানে ভাইয়ার জন্য কফি কেন বানালে না তারা?
তারা নরম গলায় বললো,ভুলে গেলে আপু? উনি তো যার তার হাতে কফি খান না।সেদিন তো আমার বানানো কফি টাস্টবিনে ফেলে দিলেন।
নীরা মুখ টিপে হেসে ভয়ে ভয়ে নীলের দিকে তাকালো নীল রাগে দাঁত কটমট করছে।পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে নীরা একটু হেসে বললো,তারা তুমি বরং ভাইয়ার জন্য কফি বানিয়ে আনো, ভাইয়া আজ খাবে।
তারা এক পলক নীলের দিকে তাকিয়ে বললো,না আপু উনি যেমন যার তার হাতের কফি খান না,তেমনই আমার কফি যদি কেউ ডাস্টবিনে ফেলে দেয় আমিও তার জন্য আর কফি বানাই না।
নীল রাগী রাগী মুখ করে তারার দিকে এক দৃষ্টিতে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থেকে,শব্দ করে চেয়ার সরিয়ে উঠে চলে গেল।
নীরা ওর যাওয়া নিশ্চিত করে বললো,এটা কী করলে তারা তোমার রাগী দানব তো রেগে আগুন হয়ে গেছে আর তুমি তো শেষ বলে একেবারে ছক্কা মেরে দিলে।
কথাটা বলে নীরা হাসতে শুরু করলো।
আকাশ খানিকটা বুঝতে পেরে বললো,রাগী দানব মানে?
নীরা হাসতে হাসতে বললো,ভাইয়ার রাগ সম্পর্কে তো জানো তারার বানানো কফি না খেয়ে একদিন ডাস্টবিনে ফেলে দিয়ে ছিল।তারপর আরও অনেক ঘটনা ঘটয়েছে মেয়েটার সাথে এর জন্যই তারা ওর নাম দিয়েছে রাগী দানব।
নীরার কথা শুনে আকাশ আর মেঘ একসাথে হেসে উঠলো।তারাও হাসছে।
নীরা কথা শেষ করে তাকাতেই দেখলো নীল ওর থেকে কয়েক হাত দূরে দাঁড়িয়ে আছে।
নীরা ঢুক গিলে,ভয়ে ভয়ে ফিসফিস করে বললো,ভাইয়া আবার কখন এসেছে তোমরা আমাকে বলবে না।
তারা দ্রুত রান্নাঘরে চলে গেল। নীল এগিয়ে এসে ওর টেবিলে রাখা ঘড়িটা তুলে নিজের ঘরে চলে গেল
তারপর মনে মনে বললো,আমাকে সবার সামনে কফি না দিয়ে এভাবে অপমান করা আর আমাকে রাগী দানব বলে ডেকে সবাইকে নিয়ে হাসাহাসি করা একবার তোমাকে পাই মাটির তারা দেখাচ্ছি মজা।…
চলবে..
লিখা: উম্মে হানি মিম

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here