নীল_আকাশের_শুকতারা (পর্ব-২৩ অন্তিম পর্ব)

1
3091

#নীল_আকাশের_শুকতারা
(পর্ব-২৩ অন্তিম পর্ব)

নীলও খানিকটা ভয়ে আছে। তারাকে ওর ঘরে দরজা বন্ধ অবস্থায় কেউ দেখলে বাজে পরিস্থিতিতে পড়তে হবে সেটা নিশ্চিত।নীল, তারা দুজনেই ভেবে পাচ্ছে না এই মুহুর্তে ওদের কী করা উচিৎ!
এদিকে হালিমা দরজার বাইরে ডেকেই যাচ্ছেন।
নীল ফিসফিস করে বললো,তারা আমাকে তুলো তাড়াতাড়ি।
তারা ভ্রু কুচকে বললো,মানে?
–মানে আমাকে তুলে দরজার কাছে নিয়ে যাও।
–আপনার উঠা নিষেধ।
–দেরী না করে যেটা বলছি সেটা করো।
–যা হওয়ার হবে আমি দরজাটা খুলে দিচ্ছি।
–তারা একদম দরজা খুলতে যাবে না। তুমি বুঝতে পারছো না মা যদি তোমাকে আমার ঘরে দরজা বন্ধ অবস্থায় দেখে কী হবে।আমাকে তুলো নাহয় আমি যেভাবেই হোক একা উঠে যাবো।
তারা কাচুমাচু করে বললো, দরজাটা যে কোন আক্কেলে বন্ধ করলাম কে জানে।তারপর ভয়ে ভয়ে নীলকে তুলে দাঁড় করালো।ওর প্রচন্ড অস্বস্তি হচ্ছে তবুও নীলের কথা অনুযায়ী তাকে দরজার কাছে নিয়ে গেল।
নীল দরজার হাতলে হাত রেখে বললো,আমি দরজাটা খুললেই তুমি দরজার পেছনে লুকাবে।আর মা ভিতরে এলেই চুপচাপ বেরিয়ে যেও।
তারা মাথা নাড়ালো।
নীল কোনরকমে দাঁড়িয়ে দরজা খুলতেই হালিমা ঘরে ঢুকে প্রচন্ড অবাক হয়ে বললেন,তুই উঠে দরজা বন্ধ করেছিস, আবার হাটাহাটিও করছিস আরেকটা অঘটন ঘটাবি?
নীল ইশারায় তারাকে বেরিয়ে যেতে বলতেই তারা পা টিপে টিপে হালিমা বেগমের পেছনে বেড়িয়ে গেল।
নীল আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারছে না তাই মাকে ধরে বললো,আমাকে বিছানায় নিয়ে যাও মা।
হালিমা বেগম রাজ্যের বিরক্তি নিয়ে নীলকে বিছানায় নিয়ে শুইয়ে দিলেন।
তারপর বললেন,তুই আর একদম দরজা বন্ধ করবি না। একা একা উঠবিও না।
নীল বাধ্য ছেলের মতো মাথা নাড়ালো।

সন্ধ্যা পেরোতেই কলি এসে হাজির হলেন আরাফাত সাহেবের বাসায়।তারা মাকে দেখতে পেয়ে দৌঁড়ে গিয়ে জড়িয়ে ধরলো।
কলি তারাকে আদর করে বললেন,তোর আংকেল আন্টি কোথায়?
তারা জবাব দিলো,ওনারা ওনাদের ছেলের ঘরে, তুমি বসো আমি ওনাদের নিয়ে আসি।
কলিকে বসার ঘরে বসিয়ে রেখে তারা উপরে গেল আরাফাত সাহেবকে ডাকতে।তিনি বললেন, ভাবীকে উপরে নিয়ে এসো।
তারা চলে গেল মাকে ডাকার জন্য।
তারার মা এসেছেন শুনে নীলের মনটা খারাপ হয়ে গেল।মনে মনে ভাবছে তবে কী উনি তারাকে নিয়ে যাবেন!
আরাফাত সাহেব এক দৃষ্টিতে নীলের দিকে তাকিয়ে আছেন।
কলি ঘরে প্রবেশ করলেন।নীলের ঘরে এক পাশে সোফা রাখা, আরাফাত সাহেব কলিকে বসতে বলে,নীরাকে বললেন আতিয়া আর আকাশ মেঘকে ডেকে আনতে।নীরা আতিয়াকে ডেকে বললো আকাশ আর মেঘকে নিয়ে আসতে।
সবাই যখন নীলের ঘরে এলেন তখন আরাফাত সাহেব বলা শুরু করলেন,আসলে আমি আজকে একটা জরুরি কথা বলতে চাই সবাইকে, আশা করি সবাই মন দিয়ে শুনবে।সবাইকে ডেকে আনার কারণ আমার মনে হয়েছে সবার বিষয়টা জেনে রাখা উচিৎ।
আতিয়া কথার মাঝখানেই বললেন,যদি আমাদের পারিবারিক কোনো কথা হয় তবে এভাবে অন্যদের সামনে বলা কী উচিৎ হচ্ছে ভাইজান?
আরাফাত এক পলক আতিয়ার দিকে তাকিয়ে বললেন,আমি জানি আতিয়া কোনটা উচিৎ হচ্ছে আর কোনটা না।
আতিয়া চুপ হয়ে গেলেন।
আরাফাত সাহেব আবার বলা শুরু করলেন,আমি নীল আর তারার ব্যপারে বলতে চাইছি।
নীল তারা নাম দুইটা শুনা মাত্র ওদের দুজনের বুকের ভিতরেই ধুক করে উঠলো।তারা আর নীল একে অপরের দিকে দৃষ্টি বিনিময় করলো।
হালিমা খানিকটা অবাক হয়ে বললেন,নীল তারার ব্যপারে মানে?
–মানে আমি নীল আর তারার বিয়ের ব্যপারে কলি ভাবীর সাথে কথা বলতে চাইছি।আমার ইচ্ছা আমি তারাকে আমার ছেলের বউ করে এ বাসায় রেখে দিবো।ভাবীর যদি কোনো অমত না থাকে তবে আমরা দ্রুত শুভ কাজটা সেরে ফেলবো।
উপস্থিত সবাই বেশ চমকালেন।আকাশের বুঝতে বাকি রইলো না তারা কার আকাশে আলো জ্বালানোর কথা বলেছিল তখন।এক বুক চাপা কষ্ট নিয়ে মুখে মুচকি হাসলো।
তারার লজ্জায় মাটির সাথে মিশে যেতে ইচ্ছে হচ্ছে।মনে মনে প্রচন্ড অবাকও হয়েছে আরাফাত সাহেবের হঠাৎ এমন একটা সিদ্ধান্তে।
হালিমা বললেন,তুমি এসব কী বলছো?আমি মানছি তারা ভালো মেয়ে কিন্তু এই বিয়েতে নীল আর তারার মতামত আছে তো?হঠাৎ করে এরকম সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে ছেলে-মেয়েদের জিজ্ঞেস করা উচিৎ।কয় দিন আগে কী হলো ভুলে গেছো?
কলি মুচকি হেসে বললেন,ভাই মেয়েটাকে তো আমি আপনাদের দিয়েই দিয়েছি।আপনাদের মেয়ে আপনারা ওর জন্য যেটা ভালো মনে করবেন সেটাই হবে।তবে ভাবীর কথাও ভুল না আগে ছেলে-মেয়ের মত নেয়া উচিৎ।
আরাফাত সাহেব বললেন, আমি ছেলে-মেয়ের মত জেনেই এই সিদ্ধান্ত নিয়েছি।ওরা দুজন -দুজনকে পছন্দ করে।
নীরা অবাক হয়ে বললো,তুমি এসব কীভাবে জানলে বাবা?
–যেভাবেই হোক জেনেছি তোমাদের সন্দেহ থাকলে ওদের জিজ্ঞেস করে দেখতে পারো।
নীরা নীলের দিকে তাকাতেই নীল হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ালো।
নীরা এবার প্রচন্ড অবাক হয়ে বললো,এতো কিছু কখন হলো? বাবাও জেনে গেছে আর আমি জানলাম না।ভাইয়া আর তারা তো সারাক্ষণ ঝগড়াই করতো।
নীরা থেমে তারার কাছে এসে বসে আবার বলা শুরু করলো,এই মেয়ে পেটে পেটে আর কত কথা আছে তোমার, এতসব লুকিয়ে রাখো কীভাবে?
তারা মুচকি হেসে মাথা নিচু করে রাখলো।নীরাও মুচকি হাসলো।
হালিমা বললেন, তারার মতো লক্ষ্মী মেয়ে আমার ঘরে এলে তো আমার ঘর আলোতে ভরে উঠবে। আমার ছেলেটা সঠিক মানুষটাকে বেছে নিয়েছে বলে আমারও ভালো লাগছে।
আরাফাত সাহেব গম্ভীর গলায় বললেন,এবার বিয়ের তারিখটা ঠিক করে নেই।এসব ব্যপারে দেরী করতে নেই।আমি তারার বাবার সাথেও একবার কথা বলে নিবো।
কলি বললেন,আমাকে কিছু সময় দিতেই হবে ভাই। আমার একটা মাত্র মেয়ে তার বিয়েতে যদি কিছু না করতে পারি নিজেকে কখনও ক্ষমা করতে পারবো না।
আরাফাত বললেন,আপনার যা ইচ্ছা করবেন কিন্তু আমি চাই কয়েক দিনের মধ্যেই সাধারণভাবে নীল আর তারার বিয়ে দিয়ে দিতে।অনুষ্ঠান যদি করার থাকে পরে করা যাবে।
হালিমা বললেন,এতো তাড়াহুড়ো কেন করছো তুমি?আমারও তো একটাই মাত্র ছেলে।
–আরে ছেলে-মেয়ের জন্য করা কী শেষ হয়ে যাচ্ছে না কী?আমি তো চাইছি ওদের আঁকতটা পড়িয়ে রাখতে।ভেবে দেখো তারা যতটা যত্ন করবে তুমি কী নীলের ততটা যত্ন করতে পারবে, তোমার কী সেই বয়স আছে?তাই আমি চাইছি মেয়েটাকে আমাদের কাছে যেভাবে ধরে রাখা যায় সেই ব্যবস্থা করতে।
কলি এবার মুচকি হেসে বললেন,এটা ঠিকই বলেছেন ভাই।ভাবীর পক্ষে একা ছেলেটার যত্ন করা সম্ভব না, তারা ঠিক নীলকে সুস্থ করে তুলবে।
আরাফাত সাহেব দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন,তাই যেন হয় ভাবী।তাহলে আমরা আগামী সপ্তাহে আঁকতটা করিয়ে দেই কী বলেন?আর এক সপ্তাহ তারা আপনার কাছেই গিয়ে থাকুক।
কলি আরাফাত সাহেবের কথায় সম্মতি জানালেন।
এবার নীল হালিমা বেগমকে উদ্দেশ্য করে বললো,আমার একটা শর্ত আছে মা।
-তোর আবার কী শর্ত।
–এই যে বাচ্চা একটা মেয়ের বিয়ে দিয়ে দিচ্ছো এই মেয়েটা তো পড়াশোনা ছেড়ে ছুড়ে সংসারী হয়ে উঠবে।আমি চাই তারা পড়াশোনাটা শেষ করুক।নীরার কাছে শুনেছি তারা চায় সে ডাক্তার হবে।আমিও সেটাই চাই।তারার নিজের একটা পরিচয় হোক।বাবা,মা কিংবা আমার পরিচয়ে না তারার নিজের পরিচয় হোক যে পরিচয়ে মাথা উচু করে বাঁচা যায়।সবাই তাকে যদি কোনোদিন দূরেও সরিয়ে দেয় যেন তারা ভেঙে না পড়ে।তখনও যেন সে মাথা উচু করেই বলতে পারে আমার আল্লাহ আর আমি একাই আমার জন্য যথেষ্ট।
কলি একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন,তুমি ভালো কথাই বলেছো বাবা আমার মেয়েটার একটা পরিচয় হওয়া দরকার।অবশ্যই সে পড়াশোটা চালিয়ে যাবে।
আরাফাত সাহেব এবং হালিমা দুজনেই সম্মতি জানালেন।
আতিয়া এবার দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন,সবারই কপালে সুখ আছে শুধু আমার কপালে নেই।
নীরা আতিয়ার কাছে এসে বললো,এভাবে বলতে নেই ফুপি সুখ সবার কপালেই থাকে।খারাপ সময় ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করতে হয় শুধু।
আতিয়া আকাশের হাত টেনে ধরে বললেন,বাবা আমার নীরা মেয়েটাকে বউমা বানিয়ে দে আর কিছু চাইবো না তোর কাছে।
আকাশ মাথা নিচু করে রাখলো।
নীরে হেসে বললো,ফুপি এখন যদি তোমার ছেলে চায়ও তবুও ওকে আমি বিয়ে করবো না।আমার আর আকাশ ভাইয়ের কথা হয়েছে আমরা আমাদের সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছি।
আকাশ ঢোক গিলে বললো,হ্যাঁ মা আমার নীরার সাথে কথা হয়েছে সে চায় না আমাকে বিয়ে করতে আর আমিও হয়তো জোর করে এই সম্পর্কে নিজেকে জড়িয়ে কখনই ভালো থাকতাম না। আমি আগামী কালই ইংল্যান্ড চলে যাচ্ছি ।তোমরা নীলের বিয়ে শেষ করে ফিরে এসো।
কথাটা বলে আকাশ উঠে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
তারা স্পষ্ট দেখতে পেলো আকাশের চলে যাওয়ার দিকে নীরার ছলছল চোখে তাকিয়ে থাকার দৃশ্যটা।

তারাকে কলি নিয়ে যাবেন তাই তারা ব্যাগপত্র গুছিয়ে নিলো।
নীরা ওকে সাহায্য করলো।তারপর নীলের ঘরে নিয়ে এসে বললো, তোমরা দুই মিনিট কথা বলে নাও আমি বাইরে দাঁড়িয়ে আছি।
তারা নীরাকে আটকে বললো, একা কথা বলার কিছুই নেই আপু তুমি থাকো।
তারপর নীলকে উদ্দেশ্য করে বললো,আমি চলে যাচ্ছি। নিজের খেয়াল রাখবেন।উঠে হাঁটাহাঁটি করবেন না। আন্টি আর নীরা আপুর কথা শুনবেন।
নীল তারার কথা শুনে ঠোঁট বাকিয়ে বললো,আমাকে এসব বলতে হবে না আমি তোমার মতো বাচ্চা না।চলে যাবে যখন দেখা করতে আর এসেছো কেন।নীরা ওকে নিয়ে গিয়ে তাড়াতাড়ি বিদেয় করে দে।
নীরা হেসে বললো,মান-অভিমানের পালা সব এক সপ্তাহ পরেই মিটে যাবে।এখন হাসিমুখে বিদেয় দে ভাইয়া বাইরে কলি আন্টি অপেক্ষা করছেন।
তারা ছলছল চোখে নীলের দিকে তাকিয়ে বললো,আসি।
নীলের বুকের ভেতরটাতে ছ্যাঁত করে উঠলো।কাঁপা গলায় বললো,তোমাকে খুব মনে পড়বে আমার, তাড়াতাড়ি ফিরে এসো।নিজের খেয়াল রেখো।

পরের দিন আকাশ সত্যই দেশ ছেড়ে চলে গেল।নিয়ে গেল এক বুক কষ্ট।আর প্রতিজ্ঞা করে গেল আর কোনদিন দেশে ফিরে আসবে না।
নীরা মনকে সান্ত্বনা দিয়ে দিলো এই বলে, যে মানুষটা তার ছিলই না তার জন্য কষ্ট পাওয়ার মানে হয় না।
আলাদা থাকার দিনগুলো নীল আর তারার কাছে বিষাদের মতোই ছিল।অবশেষে সেই দিন এলো যে দিন নীল তারাকে চিরদিনের জন্য এক বন্ধনে আবদ্ধ করে ফেলবে।
নীল এখন অনেকটাই সুস্থ।তারার মায়ের বাসায় নিয়ে যাওয়া হলো তাকে।
নীরা নিজ হাতে তারাকে বউ সাজালো।লাল বেনারসিতে অপূর্ব দেখাচ্ছে।মনে হচ্ছে একটা পরী আকাশ থেকে নেমে এসেছে।
নীল সাদা পাঞ্জাবী পায়জামা পরেছে।
তারাকে আর নীলকে পাশাপাশি সোফায় বসানো হলো।নীল বার বার আড়চোখে তারার দিকে তাকাচ্ছে।চোখই যেন সরানো যাচ্ছে না মেয়েটার দিক থেকে।কাজি সাহেব বিয়ে পড়ানো শুরু করলেন।
বিয়ে পড়ানো শেষ হতেই সবাই খাওয়া দাওয়া করে নিলেন তারপর বউ নিয়ে বাসায় ফিরে আসার পালা।তারা বিদেয় বেলায় কলিকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়লো।কলিও প্রচন্ড কাঁদছেন।মেয়েটার জন্য তিনি কিছুই করতে পারেননি।যখন মনস্থির করলেন যে এবার নিজের মেয়ের জন্য কিছু করা উচিৎ তখনই মেয়েটা সারা জীবনের জন্য পরের ঘরে চলে যাচ্ছে।কলি কাঁদতে কাঁদতে বললেন,সুখী হ মা।শ্বশুর বাড়ির সবার খেয়াল রাখিস।দোয়া করি তুই ওনাদের চোখের মনি হয়ে থাকবি।
তারপর চোখ মুছে নীলকে বললেন,বাবা আমার মেয়েটার জীবনে ভালোবাসার বড্ড অভাব।মেয়েটা কারোর ভালোবাসা পায়নি তোমরা ওর সেই অভাবটা পুষিয়ে দিও সারা জীবন আমি তোমাদের কাছে কৃতজ্ঞ থাকবো।
নীল কলির হাত ধরে বললো,আন্টি আপনি কোনো চিন্তা করবেন না তারার জীবনে ভালোবাসার আর অভাব হবে না।
তারা মায়ের কাছ থেকে বিদেয় নিয়ে গাড়িতে এসে বসলো।নীল ওর পাশেই বসা।তারা ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদছে।নীল তারার চোখ দুটি মুছে দিয়ে বললো,এই চোখে আর কোনোদিন জল দেখতে চাই না।
আজকের পর থেকে তোমার সব কান্নার অবসান হোক।
তারা মুচকি হেসে বললো, আপনিও তো আমাকে কম কাঁদান নি।
নীল হেসে বললো, আমি কাঁদালে সেটা অন্য ব্যপার,আমি সারাজীবন ধরেই তোমাকে কাঁদাবো কিন্তু অন্য কারোর জন্য তোমার চোখ থেকে এক ফোঁটা জলও যেন না গড়ায়।

তারা বাসার সামনে দাঁড়িয়ে আছে সদর দরজায়।হালিমা এসে নিজ হাতে বউমাকে ঘরে নিয়ে যাবেন বলেছেন।তারা মনে মনে ভাবছে এই বাসায় যখন প্রথম দিন প্রবেশ করে তখন মনে কত অজানা ভয়-আশংকা কাজ করছিল। স্বপ্নেও তো কল্পনা করেনি একদিন এই বাসায় বউ হয়ে প্রবেশ করবে।
হালিমা বেগম মিষ্টি নিয়ে এগিয়ে এলেন।ছেলে আর বউকে মিষ্টিমুখ করিয়ে ভিতরে নিয়ে গেলেন।
হালিমা তারাকে নিজের ঘরে নিয়ে গিয়ে ওনার বিয়েরকার আর শাশুড়ীর দেয়া অনেক গুলো শাড়ি গয়না দিয়ে বললেন,আজ থেকে এই সংসারের দায়িত্ব তোমার মা।
তারা মাথা নিচু করে বললো, আন্টি সংসারটা আপনার আপনি এই দায়িত্ব থেকে সরে যাবেন না দয়া করে, এতো বড় দায়িত্ব আমি একা পালন করতে পারবো না।আমরা দুজন মিলেই এই সংসারের হাল ধরবো।
হালিমা মুচকি হেসে বললেন,সব ঠিক আছে বউমা কিন্তু তুমি আমাকে এখনও আন্টি বলবে এটা আমি মেনে নিতে পারছি না।
তারা লজ্জায় মাথা নিচু করে আমতা আমতা করে বললো,আম্মু বলবো।
হালিমা এক গাল হেসে তারাকে জড়িয়ে ধরলেন।
দরজায় দাঁড়িয়ে নীরা আর নীল দেখছিল।ওরা দুজনেই এগিয়ে এলো।নীরা আহ্লাদী করে বললো,মা এবার সব ভালোবাসা তুমি তারাকে দিয়ে দিবে তাই না?
হালিমা হেসে বললেন,তুই না বলতি তারার সাথে তোর হিংসা হয় না।
–সেটা তো হয় না কিন্তু তুমি তো তারাকে পেয়ে আমাকে আর ভাইয়াকে ভুলেই গেছো।
হালিমা ভ্রু কুচকে বললেন,কী তারা তারা করছিস ভাবী হয় তোর।ভাবী বলে ডাকবি ওকে।
কথাটা শুনে তারা দাঁত দিয়ে জিভ কাটলো।
নীরা ভ্রু উচিয়ে বললো,এই বাচ্চা মেয়েটাকে আমার ভাবী বলতে হবে?
নীল নীরার চুল টেনে ধরে বললো,তারাকে বাচ্চা মেয়ে বলে আমাকে অপমান করছিস না?ফের যদি শুনি তুই ওকে নাম ধরে ডাকছিস খবর আছে।ভাবী বলবি।
নীরা নীলের হাত থেকে চুলের গোছা ছাড়িয়ে নিয়ে বললো,ভাইয়া তারা যদি তোর বউ হিসেবে আমার ভাবী হয় তো তুই তারার বর হিসেবে আমাকে আপু বলে ডাকবি।আমি কিন্তু তারার বড় আপু মনে রাখিস।
কথাটা শুনে নীল হেসে নীরার দিকে তেড়ে গেল সেটা দেখে হালিমা আর তারা দুজনেই হাসলেন।
ওদের খুনসুটির মাঝখানে আরাফাত সাহেব ঘরে প্রবেশ করলেন।আরাফাত সাহেব আগের মতো প্রাণবন্ত নেই ওনাকে ইদানীং কেমন যেন মনমরা দেখায়।
হালিমা নীরাকে বললেন,তারা আর নীলকে খাবার টেবিলে নিয়ে যা তোর বাবার সাথে আমি একটু কথা বলে আসছি।সারাক্ষণ মুখ গোমড়া করে রাখে কেন জিজ্ঞেস করি।
নীরা নীল আর তারাকে নিয়ে বেড়িয়ে গেল।
হালিমা চিন্তিত ভঙ্গিতে আরাফাত সাহেবকে উদ্দেশ্য করে বললেন,তোমার কী হয়েছে বলো তো ছেলের বিয়ে দিয়ে তুমি খুশি নও।
আরাফাত সাহেব গম্ভীর গলায় বললেন,বিয়েটা তো আমিই দিলাম তাহলে আমি খুশি হবো না কেন?
–সেটাই তো ভাবছি।আচ্ছা তুমি আমাকে বললে না তো নীল আর বউমার ব্যপারে কীভাবে জানলে তুমি?
–একদিন খেয়াল করলাম তারার ঘর থেকে নীল চোখ মুছে বেরিয়ে যাচ্ছে আর তারা ভিতরে কাঁদছে।সেদিন সন্দেহ হলো নীলের বন্ধুদের সাথে যোগাযোগ করলে ওরা বললো কলেজে সবাই জানে ওদের সম্পর্কের কথা।তারপর নিশ্চিত হয়ে দ্রুত বিয়ের ব্যবস্থা করলাম।
–কিন্তু তুমি মনমরা হয়ে থাকো কেন বলো।
–মেয়েটার একটা ব্যবস্থা করার আগ পর্যন্ত আমার মন আর ভালো হবে না হালিমা।
হালিমা ব্যপারটা বুঝতে পেরে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন।

খাবার টেবিলে সবাই মিলে খাবার খেতে বসেছে।একটা সুখী পরিবার দেখাচ্ছে এই পরিবারটাকে।সবাই কী সুন্দর হাসিখুশি।কারোর ভিতরে যেন কোনো কষ্ট নেই।
হালিমা নীরা, নীলের মাছ বেছে দিচ্ছেন সাথে করে তারারটাও।নীল যেহেতু হাতে খেতে পারছে না তাই তিনি খাইয়ে দিচ্ছেন।নীরাও বায়না ধরেছে মায়ের হাতে খাবে।হালিমা একটা থালায় ভাত নিয়ে নীল,নীরা তারা তিন জনকেই খাইয়ে দিলেন।
আরাফাত সাহেব মুগ্ধ দৃষ্টিতে এই দৃশ্য দেখলেন।আর প্রাণভরে দোয়া করলেন আমার ঘরে এই সুখটা যেন সারা জীবন থাকে।

ঘড়িতে বাজে রাত বারোটা।তারা আর নীল বেলকনিতে পাশাপাশি দুটি চেয়ারে বসে আছে।দুজনেই চুপচাপ। নীরবতা ভেঙে নীল বললো,দেখো আজকের আকাশটা কত সুন্দর তারা ঝলমলে।
তারা মাথা নাড়ালো।
নীল এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তারার দিকে।নীল রঙা শাড়িতে তারাকে অপূর্ব দেখাচ্ছে।মাথাভর্তি ঘোমটা টেনে বসে আছে মাথা নিচু করে।লজ্জামাখা মুখটার থেকে যেন চোখই সরানো দায়।
তারা এবার নীলের দিকে এক পলক তাকিয়ে বললো,এভাবে তাকিয়ে কী দেখছেন?
–দেখছি ঐ আকাশের তারা গুলো বেশি সুন্দর নাকি আমার আকাশের শুকতারা বেশি সুন্দর।
–আপনার আকাশ কোনটা?
–যে আকাশটাতে একটামাত্র শুকতারা সারাক্ষণ মিটিমিটি জ্বলে আলো ছড়ায়।
–সেই আকাশের অবস্থান কোথায়?
–নীলের মনের গভীরে।
তারা মুচকি হেসে মাথা নিচু করে রাখলো।
নীল তারাকে এক হাতে জড়িয়ে ধরে বললো,
শুকতারা তুমি শোক না, সুখ হয়ে ধরা দিও,
ভোরের নীল রঙা আকাশে অস্তিত্ব খুঁজে নিও।
নীলের বুকে হারিয়ে যেও।
বিশ্বাস করো অতলে তলিয়ে যেতে দিবো না তোমায়,
আগলে রাখবো বুকের গভীরে,
যেমন করে ঝিনুক আগলে রাখে মুক্তারে।
শুকতারা তুমি সুখ হয়ে ধরা দিও।

তারা এবার নীলের কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বললো,
বিষাদের রঙ নীল জানিলাম,
তবু নীলের প্রেমে মন,প্রাণ দিলাম,
আমি জেনেশুনে বিষ পান করিলাম।

নীল এবার চোখ বড় বড় করে তারার দিকে তাকিয়ে বললো,আমি বিষ?
–বিষ নয় তো কী যখন থেকে আপনাকে পান করেছি মানে আপনার প্রেমে পড়েছি তখন থেকে অদ্ভুত এক যন্ত্রণা হচ্ছে মনের মধ্যে।
নীল মুচকি হেসে বললো,এটা হলো মিষ্টি যন্ত্রণা আর এই যন্ত্রণার নামই ভালোবাসা।
তারা লজ্জায় নীলের বুকে মাথা লুকালো।
নীল তারার কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বললো,ভালোবাসি বউ।

ভোরবেলা তারা আর নীল দুজনেই একসাথে ফজরের নামাজ আদায় করলো।
তারপর তারা রান্নাঘরে যাওয়ার জন্য উঠতেই নীল ওকে আটকে বললো,কোথায় যাচ্ছো?
–চা বানাতে, এখনই আম্মু আব্বু উঠে যাবেন।
নীল মুচকি হেসে বললো,আমার বউয়ের মুখে বাবা মাকে আব্বু-আম্মু ডাক শুনতে খুব মিষ্টি লাগছে তো।
তারা মাথা নিচু করে বললো, বার বার বউ বলবেন না তো আমার লজ্জা লাগে।
–বউকে বউ না বললে আর কী বলবো?
–আমার নাম আছে, নাম ধরে ডাকবেন।
–আমার তো বউ নামে ডাকতেই বেশি ভালো লাগছে।
–আমার ভালো লাগে না।
–কেন?
— লজ্জা লাগে তাই।
–বউ হয়ে গেছো আর কীসের লজ্জা হু?
–কিছু না
কথাটা বলে তারা চলে যেতে লাগলো নীল এবার তারার শাড়ির আচল টেনে ধরে ওকে নিজের কাছে নিয়ে এলো।
তারা লজ্জামাখা কন্ঠে বললো , কী করছেন এসব?ছাড়ুন তো আমাকে এখনই যেতে হবে।
নীল আহ্লাদী কন্ঠে বললো,আরেকটু থাকলে কী হবে একটু পর যেও।
তারা একটা হেচকা টানে নীলের থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বললো,না। আর থাকা যাবে না।
কথাটা বলে তারা চলে যাচ্ছে নীল আবার পেছন থেকে ডাকলো,তারা।
তারা পেছন ফিরে তাকিয়ে বললো,আবার কী হলো।
এবার নীলের মুখটা কাঁদো কাঁদো দেখালো,মনে হচ্ছিল সব হারানো দুঃখি মানুষটা অসহায় হয়ে বলছে,যেও না।
নীলের অবস্থা দেখে তারার হাসি পেয়ে গেল।সে এক দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ নীলের দিকে তাকিয়ে থেকে হাসতে হাসতে বেরিয়ে এলো।
তারা রান্নাঘরে এসে চা বসালো।নীলের জন্য মনটা কেমন খচখচ করছে তার।এখন ভাবছে কিছুক্ষণ থেকে গেলেই পারতো কেউ তো জাগেনি এখনও।
এক কাপ চা আর এক কাপ কফি বানিয়ে উপরে নিয়ে গেল।
ঘরে ঢুকতেই দেখলো নীল ঘুমিয়ে আছে।
তারা মনে মনে হাসলো, কত তাড়াতাড়ি শান্ত হয়ে ঘুমিয়ে আছে মানুষটা।
তারা আর নীলকে ডাকলো না।
নীলের পাশে বসে চা খেতে খেতে ওর দিকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো।নীলের ঘুমন্ত চেহারা এতো সুন্দর দেখাচ্ছে কেন কে জানে।
মনে হচ্ছে ভোরের সূর্য তার সমস্ত আলো নীলকে দিয়ে দিয়েছে আর যার জন্য চেহারাটা জ্বলজ্বল করে আলো ছড়াচ্ছে।
তারার এক মুহুর্তের জন্য যেন বিশ্বাস হচ্ছিল না এতো সুন্দর মানুষটা তার স্বামী।পরমুহূর্তে মনে হলো আসলেই কী নীল এতো সুন্দর নাকি নিজের স্বামী বলেই নীলকে এতো সুন্দর দেখাচ্ছে তারার চোখে।এর আগে তো নীলকে এতো বেশি সুন্দর মনে হয়নি।তারা মনে মনে হাসলো।এক দৃষ্টিতে প্রায় মিনিট দুই-এক তাকিয়ে রইলো নীলের দিকে।যত দেখছে ততই যেন দেখার তৃষ্ণা বেড়ে যাচ্ছে।এক মুহুর্তের জন্যও চোখ ফেরাতে ইচ্ছে করছে না তারার।দেখতে দেখতে একটা সময় তারার কেন যেন কান্না পেয়ে গেল।চোখ থেকে কয়েক ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়লো নীলের উপর।
তারা দ্রুত চোখ মুছলো।হঠাৎ করে কান্না পাওয়ার কোনো মানে খুঁজে পেল না তারা।ওর কেমন যেন একা একা লাগতে শুরু করলো।তাই নীলকে ডাকবে ঠিক করলো।কয়েক বার ডাকলেও নীল সাড়া দিলো না।তারা জানে নীলের ঘুম খুব ভাড়ি নীরা বলেছিল কেউ গায়ে হাত না দিয়ে ডাকলে তার ঘুম ভাঙে না,তারা এবার নীলকে ডাকার জন্য ওর গায়ে হাত দিতেই আঁতকে উঠলো।নীলের সারা শরির বরফের মতো ঠান্ডা। তারা একটা কাঁথা এনে নীলের গা ঢেকে দিলো।ভোরের ঠান্ডা হাওয়া হিমশীতল করে দিয়েছে মানুষটার শরির।
কিন্তু নীল উঠছে না কেন তারার যে বড্ড একা একা লাগছে।
তারা নীলকে ধাক্কা দিয়ে ডাকলো,এই শুনছেন, উঠুন। আমার একা একা লাগছে।
নীলের ঘুম তবুও ভাঙলো না।তারা এবার খুব জোরে নীলকে ধাক্কা দিলো আর খেয়াল করলো নীল একটুও নড়ছে না তারা কেঁপে উঠলো।দ্রুত হাতটা নীলের নাকের কাছে নিতেই আঁতকে উঠলো, মানুষটার নিশ্বাস পড়ছে না।
তারা শরিরের সমস্ত শক্তি একসাথে করে নীলকে জড়িয়ে ধরে চিৎকার করে উঠলো,এই কী হয়েছে আপনার?উঠুন না।এভাবে নিশ্বাস আটকে মজা করছেন আমার সাথে তাই না?জাতে আমি ভয় পেয়ে যাই।কেন এমন করছেন আপনি, একবার তাকান আমার দিকে।নীল এবারও কোনো সাড়া দিলো না।তারা নীলকে ছেড়ে কয়েক হাত দূরে সরে গেল।ওর চোখ থেকে অঝোর ধারায় জল গড়িয়ে পড়ছে।চোখ মুছে বললো, এখন কিন্তু বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে।আমি কিন্তু আব্বু আম্মুকে বলে খুব শাস্তি দেয়াবো আপনাকে।এরকম মজা আমার ভালো লাগে না।বুঝেছি, বউ বলে ডাকতে নিষেধ করেছি বলে এরকম করে আমাকে শাস্তি দিচ্ছেন তো।এই কানে ধরে বলছি আর কখনও বউ ডাকতে নিষেধ করবো না আপনাকে তবুও এই অভিনয়টা বন্ধ করুন।আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে কিন্তু।
তারা আবার নীলের কাছে গিয়ে বসলো,বিরক্তি নিয়ে এদিক ওদিক তাকিয়ে নীলের দিকে তাকাতেই আঁতকে উঠলো নীলের নাক থেকে খানিকটা রক্ত গড়িয়ে পড়ছে।
নীল কী তবে চিরদিনের জন্য ঘুমিয়ে গেল!
তারা নীলকে জড়িয়ে ধরে সজোরে বুক ফাটানো আর্তনাদ করে উঠলো।

দেখতে দেখতে দশ বছর পেরিয়ে গেল।তারা এখন দেশের সনামধন্য ডাক্তারদের মধ্যে একজন।আজ নীলের দশম মৃত্যু বার্ষিকী।
নীলকে হারিয়ে এতো গুলো দিন পেরিয়ে গেছে তবুও তারার মনে নীলকে হারিয়ে ফেলার ব্যথা জীবন্ত রয়ে গেছে।
এতো গুলো বছরে এমন কোনো দিন নেই যেদিন নীলের জন্য এক ফোঁটা জল গড়ায়নি তারার চোখ থেকে।নীলকে হারিয়ে দশ বছর আগে সেই ভোরে তারা পাগল প্রায় হয়ে গিয়েছিল।
অজ্ঞান হয়ে পড়ে ছিল ঘন্টার পর ঘন্টা।জ্ঞান ফিরতেই নীলকে পাগলের মতো খুঁজেছে।নীলের শোকে অসুস্থ হয়ে কাটিয়েছে দিনের পর দিন ।আরাফাত সাহেবের সুখে ভরা পরীবারটা যেন ভয়ংকর কষ্টপুরী হয়ে উঠেছিল।
দিনের পর দিন এই বাসায় চুলোয় ঠিক মতো আগুন জ্বলেনি।একটা মানুষও নিয়মিত মুখে দানা পানি দেয়নি।তবুও তারা সবাই বেঁচে আছে শুধু বেঁচে রইলো না নীল।সবাইকে ফাঁকি দিয়ে চলে গেল না ফেরার দেশে।
যখন তারা বুঝতে পারলো নীলের অনাগত সন্তানের মা হতে চলেছে সে তখনই নিজেকে শক্ত করতে শুরু করলো।নীলের স্মৃতি তাকে যে বাঁচাতেই হবে।
প্রতিনিয়ত ধুকে ধুকে নীলয়কে পৃথিবীতে নিয়ে এলো তারা।কষ্টপুরীতে এক চিলতে সুখ যেন ফিরে এলো।সবাই নীলের স্মৃতি হিসেবেই নীলয়কে বুকে আকড়ে বেঁচে থাকার একটা অবলম্বন ফিরে পেল।
তারাও নীলয় আর নীলের স্বপ্নকে আঁকড়ে ধরে বাঁচা শুরু করলো।নীলের স্বপ্ন ছিল তারা ডাক্তার হবে।তার নিজের একটা পরিচয় হবে।সবাই যদি ওকে দূরে সরিয়েও দেয় তবুও যেন তারা মাথা উচু করে বলতে পারে আমি আর আমার আল্লাহ একাই আমার জন্য যথেষ্ট।আজ ঠিক সেটাই হয়েছে।
নীলের ছবি হাতে নিয়ে তারা অনেক্ক্ষণ যাবত দরজা বন্ধ করে বসে আছে।একা একা কথা বলছে নীলের সাথে যেটা বিগত দশ বছর থেকেই করে এসেছে সে।
তারা নীলের ছবির উপর হাত রেখে কাঁপা কাঁপা গলায় বলছে, আপনি তো বলে ছিলেন আমার ভালোবাসার কাছে আপনি আত্নসমর্পণ করে ফেলেছেন তো সেই ভালোবাসা ছেড়ে কেন চলে গেলেন? কেন আমাকে একা ফেলে পালিয়ে গেলেন?
বলেছিলেন তো আজীবন আমার মনের জেল খানায় অপরাধী হয়ে কাটিয়ে দিবেন। ঠিক সেটাই করলেন আমার পাশে থাকলেন না কিন্তু আমার মনের জেল খানায় সত্যিই আপনি অপরাধী হয়ে রয়ে গেলেন।হ্যাঁ আপনি অপরাধ করেছেন।আমাকে ছেড়ে যাওয়া আপনার অনেক বড় অপরাধ।
আমার মাকে তো কথা দিয়েছিলেন আমার জীবনে ভালোবাসার অভাব হবে না তবে কেন আমার জীবন থেকে সব ভালোবাসা ছিনিয়ে নিয়ে আপনি হারিয়ে গেলেন?
অবশ্য আপনি আপনার কথা রেখেছেন। বলে ছিলেন সারা জীবন আমাকে আপনার জন্য কাঁদাবেন সেটাই তো হচ্ছে।আমি কাঁদছি আপনার জন্য। এখন খুশি তো আপনি?
আচ্ছা, চলেই যদি যাবেন তবে কেন সেই এক দিনের সংসারের যন্ত্রণাময় স্মৃতি আমার উপর চাপিয়ে দিয়ে গেলেন?
এই এক দিন কী এক যুগ হতে পারতো না? তবুও তো নিজেকে সামলে নিতে পারতাম।
মা বলতো মানুষ মারা গেলে আকাশের তারা হয়ে যায়।
আপনি তো আমাকে নীল আকাশের শুকতারা বলতেন আর নিজেই কি-না ঔ নীল আকাশের শুকতারা হয়ে গেলেন।
যাবেনই যদি কেন নীলয়কে দিয়ে গেলেন আমাকে?নীলয় না থাকলে আমি কবে বেঁচে থাকার মানে ভুলে গিয়ে আপনার কাছে চলে যেতাম।কিন্তু নীলয় আর আপনার স্বপ্নের জন্য সেটা আমি পারলাম না।
মানুষ বলে মরে যাওয়া কষ্টের কিন্তু আমি তো তার উল্টোটা ভোগ করছি।
আপনি বিহীন বেঁচে থাকা এতো কষ্টের কেন বলুন তো?

দরজায় বাইরে আরাফাত সাহেবের গলার সুর শুনতে পেয়ে তারা চোখ মুছে সাদা চাদরটা গায়ে মাথায় জড়িয়ে নিয়ে দরজা খুলে দিলো।
আরাফাত সাহেব বাইরে থেকে বললেন,ভিতরে আসবো মা?
তারা বললো,আসুন।
আরাফাত সাহেব ঘরে প্রবেশ করে বললেন,তোমার সাথে আমার কিছু কথা ছিল।
–বলুন।
আরাফাত সাহেব হাত জোর করে তারার সামনে বসে পড়লেন।তারা দ্রুত সরে গিয়ে বললো,আব্বু কী করছেন, উঠুন।
আরাফাত সাহেব মাটিতে বসেই বললেন, বড় অন্যায় করে ফেলেছি মা,পাপ করে ফেলেছি। আমার এই অন্যায় অপরাধ তুমি যদি ক্ষমা না করো তবে দোজখেও আমার জায়গা হবে না।
তারা আরাফাত সাহেবকে তুলে দাঁড় করিয়ে বললো,আব্বু কী হয়েছে বলুন আমাকে।আমি বিশ্বাস করি না কোনো বাবা তার মেয়ের কাছে অপরাধ করতে পারে।
আরাফাত সাহেব এবার বাচ্চাদের মতো হাউমাউ করে কান্না শুরু করলেন।কিছুক্ষণ কাঁদার পর চোখ মুছে বলা শুরু করলেন, দশ বছর আগে করা অপরাধের কথা যেটা বিগত বছর গুলোতে আরাফাত সাহেবকে কুড়ে কুড়ে খেয়েছে, মা দশ বছর আগে যেদিন নীল এক্সিডেন্ট করে সেদিন মাথায় প্রচন্ড আঘাত পায়।ডাক্তার বলে ছিলেন ওর জ্ঞান ফেরার সম্ভাবনা খুবই কম।কিন্তু যখন জ্ঞান ফিরে এলো আমরা যতটা খুশি হয়েছি ডাক্তাররা ততটাই অবাক হয়েছিলেন।আমি এসব ওতটা ভালো বুঝিও না তুমি নিশ্চয়ই ওর রিপোর্ট দেখলে বুঝবে।ডাক্তার বলেছিলেন নীলের মাথার ভিতরে একটা জায়গায় ডেমেজ হয়ে রক্ত জমাট বেধে আছে।যে কোনো মুহুর্তে ওর ব্রেইন স্টোক হওয়ার সম্ভাবনা ছিল।এটা অপারেশন করেও নীলকে ঠিক করা সম্ভব ছিল না কারণ এমনিতেই নীলের ডেমেজ ছিল অপারেশন করে আর কাটাছেঁড়া করলে সে মারা যেতো।
যখন সে কিছুটা সুস্থ হয়ে গেল।ডাক্তার আমাকে বললেন নীল যেকোনো মুহুর্তে স্টোক করতে পারে আবার এমনও হতে পারে এভাবেই সারা জীবন বেঁচে থাকতে পারে যেভাবে অকল্পনীয়ভাবে এক সপ্তাহ বেঁচে আছে।
তখন আমি জানতে পারি নীল তোমাকে কতটা পছন্দ করে।আমার মনে হয়েছিল তুমি আমার ছেলের জীবনে এলে যদি আমার ছেলেটা সুস্থ হয়ে যায়।যদি তোমাকে না পেয়ে কষ্ট পায় তাহলে তো সে মরে যাবে।আর যদি মরেই যায় তবে যে কয়টা দিন বেঁচে আছে সে কয়টা দিন একটু খুশি থাকুক।এই ভেবে আমি তাড়াহুড়ো করে তোমাদের বিয়ে দিয়ে দেই।আমি ছাড়া আর কেউ নীলের ব্যপারে কিছু জানতো না।আমি তোমাকে তখন এসব জানাইনি মা এটা আমার অনেক বড় অপরাধ।আমি অন্যায় করেছি।আমার ছেলের জীবনের সাথে তোমার জীবন জড়িয়ে তোমার জীবনটাও শেষ করে দিয়েছি।তুমি এক অসহায় বাবাকে ক্ষমা করবে তো মা?
তারার গাল বেয়ে অঝোর ধারায় জল গড়িয়ে পড়ছে।চোখ মুছে বললো, আব্বু আপনি কোনো ভুল করেননি বরং ঠিক কাজটাই করে ছিলেন।আপনার ছেলের সাথে আমার জীবন আপনি জড়াবেন কেন সেটা তো জড়ানোরই ছিল।আমি তো আপনার কাছে কৃতজ্ঞ সেই এক দিনের সংসারের জন্য।আপনি আমাকে সেই সুযোগটা না দিলে আমার জীবনে যে আর কিছুই থাকতো না।আমি নিঃশেষ হয়ে যেতাম।
আপনার ঋণ আমি কোনদিনও শোধ করতে পারবো না আব্বু।এবার আম্মুর কাছে যান।কখন থেকে দরজা বন্ধ করে কাঁদছেন।
একটু পরে নীরা আপু ওর বরকে নিয়ে আসবে আমি ওদের জন্য রান্নাবান্নাটা সেরে রাখছি।
আরাফাত সাহেব চোখ মুছে বললেন,আজকে আর আগুনের তাপে যেতে হবে না মা আমি বাইরে থেকে খাবার আনিয়ে নিচ্ছি।
–কী যে বলেন না আপনি এতোদিন পর বাড়ির মেয়ে বাড়ি ফিরে আসছে আর তাকে নাকি আমি বাইরের খাবার খাওয়াবো।তা আবার হয় নাকি?
আমার রান্না করতে কোনো সমস্যা হবে না আব্বু।বরং কাজ না করে বসে থাকলেই কষ্ট বেশি হবে।
আরাফাত সাহেব একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন।
তারা আস্তেধীরে হেঁটে রান্নাঘরে চলে এলো।আজ ওর নীরা আপু আসবে।নীল চলে যাওয়ার পর তারার মতো এই বাসার প্রত্যেকটা মানুষই দিশেহারা হয়ে গিয়েছিল তার মধ্যে নীরা অন্যতম।কিন্তু নীলয়ের জন্মের সময় সেই নীরাই তারার অনেক যত্ন করেছে।তারাকে মুখে তুলে খাইয়ে পর্যন্ত দিয়েছে।এই বাসার মানুষ গুলো না থাকলে নীলয়কে পৃথিবীতে নিয়ে আসা তারার পক্ষে সম্ভব ছিল না।নীলয়ের জন্মের পর তাকেও অনেক যত্ন করেছে নীরা।ঠিক করে নিয়েছিল বাবা-মা আর নীলয়কে ছেড়ে কোথাও যাবে না।আরাফাত সাহেব আর হালিমা বেগম ছেলেকে হারিয়েছেন একদিকে আরেক দিকে মেয়ের কোনো উপায় করতে পারছেন না ভিতরে ভিতরে ভিতরে শেষ হয়ে যাচ্ছিলেন।
ওনাদের মুখের দিকে তাকানো যেতো না।
তখন ফেরেস্তার মতো আগমন ঘটে অলিকের।অলিক নীরার সাথে পড়াশোনা করতো এক কলেজে।নীরাকে পছন্দ করতো কিন্তু কখনও বলেনি। সে হঠাৎ বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে এলো।তারপর তারা যে কীভাবে নীরাকে রাজি করিয়েছে একমাত্র আল্লাহ আর সে-ই জানে।
নীরার বিয়ের দিন নীলয়ের সেকি কান্না।ফুপিকে প্রচন্ড ভালোবাসতো যে।নীরাও খুব কাঁদছিল।আজ দু-বছর পর নীরা আর অলিক আমেরিকা থেকে দেশে ফিরছে।নীলয় যেদিন শুনেছে নীরা আসবে সেদিন থেকেই ওর খুশি আর কে দেখে।
তারা মনে মনে নীলয়কে খুঁজচ্ছিল তখনই কেউ পেছন থেকে জড়িয়ে ধরলো তাকে।বুঝতে বাকি রইলো না এটা তারার নয়নের মনি নীলয়ই হবে।তারা পেছন ফিরে না তাকিয়েও বললো,এতক্ষণ কোথায় ছিলে?সকালের নাস্তাটাও করা হয়নি তোমার।কতবার বলেছি অনিয়ম করবে না।অনিয়ম আমার একদম পছন্দ না।
নীলয় কোনো জবাব দিলো না।তারা পেছন ফিরে তাকিয়ে দেখলো নীলয় সাদা পাঞ্জাবী পরে আছে।মাথায় টুপি।একদম নীলের মতোই দেখাচ্ছে ছেলেটাকে।
নীলয়ের চোখ ভেজা, ভাঙা গলায় বললো, মা আমি বাবার কবর জেয়ারত করতে গিয়ে ছিলাম।আজকের দিনেই তো বাবা চলে গিয়ে ছিল না ফেরার দেশে।আমি কোরআন তেলাওয়াত করে বাবার জন্য দোয়া করে এসেছি মা।
তারার বুকের ভেতরটা হাহাকার করে উঠলো, নীলয়কে ঝাপটে জড়িয়ে ধরে নিয়ে গেল বুকের কাছে।দু-ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়লো তার চোখ থেকে।
কাঁপা গলায় বিড়বিড় করে বললো,আল্লাহ নীলয়ের বাবাকে তুমি ভালো রেখো।
(সমাপ্ত)

#নীল_আকাশের_শুকতারা- (অন্তিম পর্ব)
লিখা: উম্মেহানি মিম

1 COMMENT

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here