নীল_আকাশের_শুকতারা (১৭তম পর্ব)

0
1003

#নীল_আকাশের_শুকতারা
(১৭তম পর্ব)

তারার মনে মনে খারাপ লাগা কাজ করছে,ওর জন্য সবার ফ্লাইটে যাওয়া হলো না, গাড়িতে করে যাবে ভালোয় ভালোয় এবার গিয়ে পৌঁছালেই হয়।

সবাই চুপচাপ গাড়িতে বসে আছে, নীল রবীন্দ্রনাথের, মাঝে মাঝে তব দেখা পাই গানটা প্লে করেছে।নীলের প্রিয় গান।
অদ্ভুতভাবে তারারও এই গানটা খুব পছন্দ।
সকালের কুয়াশার চাদর পেরিয়ে সূর্যের মিষ্টি রোদের আবরণে চারিদিকটা ঝলমল করছে সাথে করে গাড়িতে বাজছে,কী করিলে বলো পাইবো তোমারে রাখিবো আঁখিতে আঁখিতে..মাঝে মাঝে তব দেখা পাই চিরদিন কেন পাই না, কেন মেঘ আশে হৃদয় আকাশে তোমারে দেখিতে দেয় না..
অদ্ভুত এক ভালোলাগা কাজ করছে নীলের মনে।এই ভালোলাগার মানে সে জানে না তবুও এই ভালো লাগাটা মিষ্টি এক অনুভূতিতে জড়িয়ে রেখেছে তাকে।
গান শেষ হতেই সবাই নীরব হয়ে গেল।
নীরবতা ভেঙে নীরা বললো,ভাইয়া একটা জায়গায় ঘুরতে যাচ্ছি বলে মনেই হচ্ছে না সবাই এমন চুপচাপ কেন?
আকাশ বললো,তুই বকবক কর আমরা শুনি।
নীরা হাসলো,তারপর তারার দিকে তাকাতেই দেখলো,সে মন মরা হয়ে চুপচাপ বসে আছে।
নীরা তারাকে প্রশ্ন করলো,আবার কী হলো তারা ভয় পাচ্ছো?
তারা ফিসফিসিয়ে নীরার কানে কানে বললো,সবার খুব সমস্যা হচ্ছে গাড়িতে যেতে তাই চুপচাপ যাচ্ছে আর এটা আমার জন্যই হয়েছে।
নীরা মুচকি হেসে বললো,পাগলী এমন কিছু না গাড়িতে যেতে ভালোই লাগছে আমাদের কী বলো তোমরা?
আকাশ নীরার কথার উত্তরে বললো,আমি তো সারাক্ষণ জানালা দিয়ে আমাদের দেশের সৌন্দর্য উপভোগ করছি।কবি জীবনানন্দের ভাষায় বলতে হচ্ছে, বাংলার মুখ আমি দেখিয়াছি, তাই আমি পৃথিবীর রূপ খুঁজিতে যাই না আর।
তারা অবাক হয়ে বললো, বাহ! আপনি বাংলা কবিতাও জানেন?
আকাশ পেছন ফিরে তারার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বললো,বাংলার আস্ত একজন কবির পাশে বসে আছি আর এরকম কয়েকটা কবিতা না জানলে হয়।
তারা বুঝতে না পেরে প্রশ্ন করলো, কে কবি।
প্রশ্ন করে মুহুর্তেই ওর মনে পড়লো নীরা একদিন বলেছিল নীল লিখে।
আকাশ নীলের দিকে তাকিয়ে বললো,কবি নীলানন্দের কথা বলছিলাম।
নীল ভ্রু কুচকে এক পলক আকাশের দিকে তাকিয়ে চোখ ফিরিয়ে নিয়ে বললো,ড্রাইভ করছি এতো বকবক কেন করছিস তোরা?
আকাশ বললো,কথা না বললে তোর বোন বলে কথা বলি না, আর কথা বললে তুই বলছিস বকবক না করতে। তোরা দুইটা আসলেই আপন ভাই বোন কী না আমার মাঝে মাঝে সন্দেহ হয়।
আকাশের কথা শুনে তারা ফিক করে হেসে দিয়ে মনের অজান্তেই বলে উঠলো,নীরা আপুর মতো লক্ষ্মী একটা মেয়ের এমন রাগী দানব ভাই হতেই পারে না আমার তো মনে হয় আংকেল আন্টি ওনাকে কুড়িয়ে পেয়েছেন।
কথাটা বলে তারা নিজেই নিজের সাহস দেখে চমকে উঠলো।দ্রুত মুখ চেপে ধরলো সে।
নীরা উচ্চস্বরে হাসি শুরু করলো।আকাশ আর মেঘও সেই হাসিতে তাল মেলালো।নীল তখনও শান্ত দেখে নীরা একটু অবাক হয়ে বললো,ভাইয়া তারা তোকে এতো বড় একটা কথা বললো আর তুই কিছু বললি না। জেগে আছিস তো? দেখিস ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে গাড়ি চালিয়ে আবার অঘটন ঘটাস না।
নীরা কথাটা বলে শেষ করতে পারলো না হুট করে গাড়ি থামালো নীল।আকাশ হঠাৎ এভাবে গাড়ি থামায় প্রশ্ন করলো,গাড়ি থামালি কেন নীল?
নীল কয়েক বার গাড়ি স্টার্ট দেয়ার চেষ্টা করে বললো,আমি থামাইনি থেমে গেছে, এখন তো স্টার্টও হচ্ছে না কিছু একটা সমস্যা হয়েছে।
আকাশ চিন্তিত হয়ে বললো,এবার কী হবে?কতদূর এসেছি আমরা?
নীল গাড়ি থেকে নেমে বললো,আশেপাশে গ্যারেজ বা মেকানিক পাওয়া যায় কী না দেখতে হবে এখনও আমরা অর্ধেক রাস্তায়।
আকাশ আর নীল দুজনেই গাড়ি থেকে নামলো,নীল আকাশকে বললো তুই গাড়িতে নীরাদের সাথে থাক আমি আশেপাশে দেখি কাউকে পাওয়া যায় কী না।
আকাশ নীলের কথা অনুযায়ী আবার গাড়িতে এসে বসলো।মিনিট কুড়ি পরে নীল ফিরে এলো একজন লোককে সাথে নিয়ে।লোকটা গাড়ি দেখে বললো,ঠিক করতে বেশ কিছু সময় লাগবে।
আকাশ গাড়ি থেকে নেমে গেল।বাকিরাও একে একে নামলো।
তারা এদিক-ওদিক তাকিয়ে খেয়াল করলো পাশেই একটা সর্ষের ক্ষেত দেখা যাচ্ছে।
তারা নীরাকে হাত ইশারায় ওটা দেখিয়ে বললো,আপু ওখানে দেখো কী সুন্দর সরিষার ক্ষেত।যাবে?
নীরা সম্মতি জানালো।
আকাশ আর মেঘও ওদের সাথে গেল।শুধু নীল দাঁড়িয়ে রইলো গাড়ির কাছে।মেঘ সেখানে গিয়েই ছবি তুলতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো।
তারা মুগ্ধ চোখে সর্ষের ক্ষেতে হলুদ সবুজের মিলেমিশে একাকার যাওয়া দেখছে,
আর মনের অজান্তেই গুনগুন করছে।নীরা ব্যপারটা খেয়াল করে বললো, তারা তুমি গান গাইতে জানো তাই না?কখনও তো শুনালে না।
তারা চমকে উঠে বললো,না আপু সেরকম ভালো পারি না।
–যেমনই পারো শুনাও প্লিজ।গাড়ি ঠিক হতে কতক্ষণ লাগে কে জানে, একদম ভালো লাগছে না।
আকাশ নীরা আর তারার কথা শুনছে কাছ থেকে, কিছু বলছে না শুধু মনে মনে অপেক্ষা করছে তারা কখন গান গাইবে।
নীরার জোরাজোরিতে তারা তার মিষ্টি সুরেলা কন্ঠে গাওয়া শুরু করলো,
“ভেঙে মোর ঘরের চাবি নিয়ে যাবি কে আমারে
ও বন্ধু আমার!
না পেয়ে তোমার দেখা, একা একা দিন যে আমার কাটে না রে।
বুঝি গো রাত পোহালো,
বুঝি ওই রবির আলো
আভাসে দেখা দিল গগন-পারে—
সমুখে ওই হেরি পথ, তোমার কি রথ পৌঁছবে না মোর দুয়ারে।
আকাশের যত তারা
চেয়ে বয় নিমেষহারা,
বসে রয় রাত-প্রভাতের পথের ধারে।
তোমারি দেখা পেলে সকল ফেলে ডুববে আলোক-পারাবারে।

প্রভাতের পথিক সবে
এল কি কলরবে—
গেল কি গান গেয়ে ওই সারে সারে!
বুঝি-বা ফুল ফুটেছে, সুর উঠেছে অরুণবীণার তারে তারে।

তারা গান শেষ করে ফিরে তাকাতেই দেখলো নীল অবাক চোখে তাকিয়ে আছে ওর দিকে।নীল কখন এসে হাজির হয়েছে ও খেয়ালই করেনি।তারা দ্রুত নীলের দিক থেকে চোখ সরিয়ে নিলো।
নীল মনে মনে ভাবছে,মেয়েটি এতো মধুর সুরে গান গায় যে সুরের টানে ঘুমন্ত হৃদয়ও হয়তো এই সুরে সাড়া দিতে জেগে উঠবে।
তারার গান শুনে নীরা, আকাশ,মেঘ এতোটাই অবাক হয়েছে যে মুগ্ধ হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে আছে।মুখে টু-শব্দটি করছে না।
আকাশের কানে যেন তারার গাওয়া সেই লাইনটা বাজছে এখনও, আকাশের যত তারা
চেয়ে বয় নিমেষহারা,
বসে রয় রাত-প্রভাতের পথের ধারে।
তোমারি দেখা পেলে সকল ফেলে ডুববে আলোক-পারাবারে।
সবাই নিশ্চুপ তখনই মেঘ সবাইকে চমকে দিয়ে বলে উঠলো, ওহ মাই গড, এতো সুন্দর কেউ গান গাইতে পারে মিউজিক ছাড়া।
খুব ভালো লেগেছে আপনার গান।
তারা এই প্রথমবার মেঘের মুখে কোনো কথা শুনলো।ছেলেটা এতো চুপচাপ যে এর আগে তারার সাথে কথা বলা দূরে থাক কথা বলতে শুনেও নি।
তারা মুচকি হেসে বললো,ধন্যবাদ।
নীরা তারাকে হাত ধরে টেনে ওর সামনে নিয়ে এসে বললো,এই মেয়ে এতো ভালো গান গাইতে পারো কিন্তু কখনও শুনালে না কেন?
তারা কিছু না বলে মাথা নিচু করে হাসলো।
আকাশ এবার বললো,শুকতারা সত্যিই এতো ভালো গান গাইলে তুমি যেটার প্রশংসা করার মতো উপযুক্ত বাক্য আমি খুঁজে পাচ্ছি না।
তারা আকাশে দিকে তাকিয়ে বললো,ধন্যবাদ।

গাড়ি ঠিক হতে প্রায় ঘন্টা দুই-এক সময় লেগে গেল।গ্যারেজে নিয়ে ঠিক করতে হয়েছে,পাশেই একটা গ্যারেজ ছিল তাই রক্ষে।
সবাই গাড়িতে উঠে বসার পর তারা ফিসফিসিয়ে নীরাকে বললো,আপু ফিরে যাওয়া যায় না বার বার একটা না তো একটা সমস্যা হচ্ছেই।
নীরা ইশারায় নীলকে দেখিয়ে আস্তে করে বললো,ভাইয়াকে এখন ফিরে যাওয়ার কথা বললে নির্ঘাত রেগে যাবে।
তারা গাড়ির জানালার কাচে মাথা রেখে চোখ বন্ধ করলো।

প্রায় দুপুর হয়ে যাওয়ায় গাড়ি থেকে নেমে সবাই মিলে একটা হোটেলে দুপুরের খাবারটা খেয়ে নিলো।তারপর আবার গাড়িতে উঠলো। কিছুদূর যেতেই জ্যামে আটকালো ওরা।সামনে লোকজনের ভিড় দেখে নীল গাড়ি থেকে নেমে দেখলো স্থানীয় লোকজনের মারামারিতে রাস্তাটা বন্ধ হয়ে আছে।আশেপাশে লোকজনদের জিজ্ঞেস করে জানা গেল অনেকেই নাকি গুরুতরভাবে আহত হয়েছে। এই মারামারি কখন শেষ হবে আর রাস্তাটা খুলবে কেউ নির্দিষ্ট করে বলতে পারছে না।
নীল বেশ চিন্তিত হয়ে ফিরে এসে ঘটনাটা বললো।
এটা শুনে নীরা বললো, তাহলে কী ফিরে যাবো ভাইয়া?
নীল বিরক্ত হয়ে বললো, তোর কী মাথা খারাপ আমরা প্রায় সিলেট এসেই গেছি এখন আবার এতোটা রাস্তা ড্রাইভ করে কীভাবে ফিরে যাবো আমরা?
এখানে কোথাও থাকার মতো বা রিসোর্ট বা কটেজ খুঁজতে হবে রাস্তা খুললে তারপর আমাদের ঠিক করা হোটেলে যাওয়া যাবে।
আকাশ বললো, কিন্তু এখানে পাওয়া যাবে তো?
নীল এক মুহূর্তে চুপ করে থেকে বললো, দেখতে হবে আশেপাশে কাউকে জিজ্ঞেস করে।
কথাটা বলে নীল চলে গেল।কিছুক্ষণ পর ফিরে এসে বললো,এখানে মোটামুটি থাকার উপযোগী একটা কটেজ আছে নাকি এই বা দিকের রাস্তা ধরে দশ মিনিট গেলেই পাবো।
আকাশ নীলকে তাড়া দিয়ে বললো তাহলে আয় তাড়াতাড়ি গিয়ে দেখি কেমন কটেজ।খুব টায়ার্ড লাগছে।
নীল ক্লান্তির নিশ্বাস ছেড়ে বললো, আমারও।

কটেজটা বেশ ভালো মানের না হলেও খুবই সুন্দর।বাঁশ, বেত কাঠ দিয়ে পুরোটা তৈরি।চারিদিকে পাহাড় আর চা বাগানের অপরূপ সৌন্দর্য্যের সাথে পাহাড়ের চুড়ায় কটেজ।কটেজের আঙিনায় আবার নানা রকমের ফুলের গাছ লাগানো।
অপ্রত্যাশিতভাবে এতো সুন্দর পরিবেশ পেয়ে সবাই বেশ খুশি।কটেজে মাত্র দুইটা ঘরই পাওয়া গেল।একটাতে আকাশ,নীল আর মেঘ আর অন্যটাতে নীরা আর তারা।
সবাই ফ্রেশ হয়ে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে কাছ থেকে চা বাগান দেখতে বেরোলো।তারা আনমনে হাটছে আর মুগ্ধ হয়ে দেখছে।পাহাড়ের গায়ে চায়ের গাঢ় সবুজ চিকন চিকন পাতা আর কচি হালকা সবুজ পাতা মিলে কী সুন্দর ভরে আছে।দেখতে ভিষণ সুন্দর দেখাচ্ছে।সবাই বেশ মুগ্ধ হয়েই চারিদিকটা দেখে আবার কটেজে ফিরে এলো।
সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত নেমে এসেছে।সবাই রাতের খাবার শেষে কিছুক্ষণ আড্ডা দিয়ে আলাদা আলাদা ঘরে চলে এসেছে।তারা জানালা দিয়ে কিছুক্ষণ বাইরে তাকিয়ে নীরার পাশে এসে দাঁড়িয়ে ওকে ডাকলো।নীরা বাসায় ফোনে কথা বলছে তাই তারার ডাক খেয়াল করলো না। তারা কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে কটেজের কাঠের সিড়ি বেয়ে নিচে নেমে এসে একা একা হাঁটতে লাগলো।

বেশ কিছুক্ষণ হয়ে গেছে নীরা তারাকে দেখতে পাচ্ছে না বাথরুমে ভেবে আর খুঁজেও নি।কিন্তু যখন বেশ কিছুক্ষণ কেটে গেল তখন নীরা বাথরুমের দরজায় ধাক্কা দিতে গিয়ে খেয়াল করলো তারা নেই।নীরা কিছুটা চিন্তিত হয়ে তারাকে খুঁজতে খুঁজতে নীলদের ঘরটাতে গেল।সেখানেও তারা নেই।নীল আর আকাশ বিচলিত হয়ে কটেজের চারিদিকটা তারাকে খুঁজতে লাগলো।কিন্তু কোথাও তাকে দেখা যাচ্ছে না।নীলের প্রচন্ড অস্বস্তি হতে শুরু করেছে।অচেনা একটা জায়গায় একা একা মেয়েটি কোথায় গেল কোনো বিপদ হলো না তো তার! তারার কোনো বিপদ হয়েছে এটা ভাবতেই যেন নীলের বুকটা ছেত করে উঠলো।অস্থির হয়ে কটেজের চারিদিকটা খুঁজে আবার ফিরে এলো আকাশ তারার খুঁজ পেল কী না দেখতে। কিন্তু এসে দেখলো আকাশও তারাকে না পেয়েই ফিরে এসেছে।
নীরা অস্থির হয়ে নীলের কাছে তারার ব্যপারে জানতে চাইলে নীল নীরাকে বেশ জোরে ধমক দিয়ে বললো,একটা মেয়ে তোর সাথেই ছিল সে কোথায় চলে গেল তুই জানিসও না এতোটা কান্ডজ্ঞানহীন কেন তুই?
নীরা কাঁদো কাঁদো হয়ে বললো আমি ঘর থেকে বেড়িয়ে ফোনে কথা বলছিলাম তারা একবার আমার পাশে এসে দাঁড়িয়ে ছিল কিন্তু সে আমাকে কিছু বলেনি।আমি ভাবতেও পারিনি তারাকে ফিরে এসে আর খুঁজে পাবো না।
নীল আর এক মুহুর্ত দাঁড়িয়ে না থেকে দ্রুত বেড়িয়ে এলো।পাগলের মতো চারিদিকে ছুটে ছুটে তারাকে খুঁজতে লাগলো।
বুকের ভেতরটাতে ঝড় শুরু হয়েছে।এই ঝড়ের নাম হারিয়ে ফেলার ভয়।এই ভয়টাই কী তবে ভালোবাসা।এতোটা অস্থির কেন লাগছে তার!
মনে হচ্ছে শরিরের সমস্ত শক্তি তারা ছিনিয়ে নিয়ে চলে গেছে।হৃদপিণ্ডের রক্ত চলাচল যেন বন্ধ হয়ে যাবে যদি এখনই এই মায়াময়ী মেয়েটার দেখা না পায় সে।
নীলের এই মুহুর্তের একটা কথাই বার বার মনে হচ্ছে,সব হারিয়ে ফেলেছে সে এই মেয়েটির কাছে।এই মেয়েটিকে ছাড়া তার চলবে না।কিছুতেই চলবে না।তারাকে তার লাগবেই।
নীল এলোমেলো ভাবে পা ফেলে দৌড়াচ্ছে দূরে কেউ একজনের অবয়ব দেখা যাচ্ছে।
এটাই কী তবে তারা!জীবনের শ্রেষ্ঠ দ্রুততম দৌড়টাই যেন দিচ্ছে সে।এক দৌড়ে এসে থামলো।হ্যাঁ এটাই তারা।
আনমনে একা দাঁড়িয়ে আছে অবাক হয়ে কী যেন দেখছে।নীল পেছন থেকে তারার হাত ধরে একটা হেচকা টানে ওকে ওর অনেকটা কাছে নিয়ে এসে রক্তলাল চোখে তাকালো।
নীলের এমন আচমকা কান্ডে তারা চমকে উঠে ওর দিকে তাকালো,নীলের চোখ থেকে যেন আগুন ঝড়ছে।
নীল গর্জন করে বললো, একা একা কী করছিলে এখানে?কাউকে না বলে এতো রাতে এখানে এসে দাঁড়িয়ে থাকার মানেটা কী?সাধারণ দায়িত্ব জ্ঞান বোধও নেই তোমার?কী কী বিপদ হতে পারতো কোনো আইডিয়া আছে?এতো কান্ডজ্ঞানহীন কীভাবে হতে পারলে।
তারা ভয়ে ভয়ে কাঁপা গলায় বললো, আমি তো জোনাকি দেখতে দেখতে এখানে..
নীল তারার কথা শেষ করতে না দিয়েই একটা ধাক্কা দিয়ে তারাকে খানিকটা দূরে সরিয়ে দিলো।তারপর ওর দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে চোখ বন্ধ করে নিজেকে সংযত করার চেষ্টা করে তারার হাত ধরে টেনে নিয়ে এলো কটেজে।
নীরা দৌড়ে গিয়ে তারাকে জড়িয়ে ধরলো।প্রচন্ড ভয় পেয়ে গিয়েছিল সে।
তারার বুক ধুকপুক করছে।জোনাকি দেখতে দেখতে কখন এতোটা দূরে চলে গেছে খেয়ালই করেনি সে।
আকাশ তারাকে দেখতে পেয়ে একটা সুস্থির নিশ্বাস ছেড়ে বললো,কোথায় ছিলে শুকতারা।
তারা কোনো জবাব দিলো না।
কিছুক্ষণ সবাই নীরব থাকার পর নীরবতা ভেঙে নীল নীরাকে উদ্দেশ্য করে বললো, নীরা এখনই এই মেয়েটিকে নিয়ে ঘুমিয়ে পড়।আমি শুধু ভোর হওয়ার অপেক্ষায় আছি কখন ভোর হবে আর ফিরে যাবো।এতোটা কান্ডজ্ঞানহীন একজনকে সাথে রাখাও বিপদ।
আকাশ নীলের পিঠে হাত রেখে বললো,শান্ত হ। তুইও ঘুমাতে চল।সকাল হয়ে যাক চলে যাবো আমরা।নীল আকাশের হাত সরিয়ে বললো, তুই যা আমি এখানেই সোফায় বসে থাকবো।এই দুইটা একই রকম কান্ডজ্ঞানহীন। একটারও মাথায় সামান্য বুদ্ধি বলতে কিছু নেই এরা আরও ভয়ংকর কান্ড ঘটাতে পারে একা থাকলে।তুই গিয়ে বিশ্রাম নে।আকাশ একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে চলে গেল।
নীল সোফায় বসে রইলো দৃষ্টি মেঝেতে রেখে।
তারা ভয়ে ভয়ে নীরার কানে কানে ফিসফিসিয়ে বললো,উনি এখানে!আমার তো ঘুম আসবে না আপু।
নীরাও ফিসফিস করে বললো, চাদর মুড়ি দিয়ে ঘুমানোর ভান করে শুয়ে থাকো।ভাইয়ার রাগ পড়লে কিছুক্ষণ পরই চলে যাবে।রাত জাগতে পারে না একদম।
তারা নীরার কথা অনুযায়ী চাদর মুড়ি দিয়ে গুটিসুটি মেরে শুয়ে পড়লো।ঘুমের ভান করতে গিয়ে সারাদিনের ক্লান্তিতে কখন চোখ লেগে এসেছে বুঝতেই পারেনি।
ঘুম ভাঙলো কারোর ফিসফিসিয়ে ডাক শুনে।চোখ মেলে নীলকে মাথার উপরে দেখতেই তারা চমকে গিয়ে দ্রুত উঠে বসলো।কিছু বলতে যাবে নীল তারার মুখ চেপে ধরে ইশারায় নীরাকে ঘুমাচ্ছে দেখিয়ে ফিসফিস করে বললো, চুপ,নীরা ঘুমাচ্ছে ।একটু বাইরে এসো।
তারার ঘুমের ঘোর এখনও কাটেনি ঘুম জড়ানো কন্ঠে বললো,কোথায় যাবো?
নীল তারাকে আর কিছু বলতে না দিয়ে টেনে নিয়ে গেল বাইরে।
তারা ঘুমের ঘোরে বুঝতেই পারছে না কী হচ্ছে।
নীল এবার তারাকে চোখ বন্ধ করতে বললো।
তারা নীলের কথা অনুযায়ী চোখ বন্ধ করলো।
-এবার চোখ খুলো,নীলের ফিসফিস করে বলা কথাটা তারার কানে আসতেই দ্রুত চোখ খুললো সে।নীলের হাতে একটা কাচের জার।যেটা তারার সামনে ধরে আছে।জারটার ভিতরে আলোতে ভরা।
তারা অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে জারটার দিকে।নীল এবার জারটার মুখ খুলে দিতেই অসংখ্য জোনাকি পোকা একটা একটা করে জার থেকে বেরিয়ে চারিদিকটা মিটিমিটি আলোতে ভরিয়ে তুললো।তারা মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে রইলো।ওর মনে হলো সে স্বপ্ন দেখছে। চোখ কচলে আবার তাকালো কিন্তু না এটা তো সত্যি ঘটছে।তারা বিড়বিড় করে বললো, এতো সুন্দর জোনাকি আমি কী স্বপ্ন দেখছি,এতো জোনাকি কোত্থেকে এলো?নীল ফিসফিসিয়ে বললো,না মহারানী এটা বাস্তব। আপনাকে স্বপ্ন ছুঁয়াতেই এই আয়োজন।
তারা অবাক চোখে নীলের দিকে তাকালো।আবছা অন্ধকারে জোনাকির আলোয় নীলের হাসিমুখটা বড্ড অচেনা লাগছে। তারা অবাক চোখে নীলের দিকে তাকিয়ে রইলো। নীল কিছুক্ষণ তারার দিকে তাকিয়ে থেকে আদর মাখা কন্ঠে বললো,এই মায়া চোখে আর কত ঘায়েল করবে আমাকে?
নীলের কথা শুনে তারার বুক ধুক করে উঠলো।প্রচন্ড চমকে গেছে সে।আমতা আমতা করে চোখ কচলে বললো,এখন আমি নিশ্চিত আমি স্বপ্নই দেখছি।কিন্তু এতো ভয়ংকর আর বাজে স্বপ্ন কেন দেখছি আমি!
নীল তারার হাত দুটো আলতো করে ধরে বললো, লিসেন টু মি তারা, এটা তোমার কোনো ভয়ংকর বা বাজে স্বপ্ন না এটা আমার জীবনের বিশেষ একটা মুহুর্তে।আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ সুন্দর মুহুর্ত গুলোর মধ্যে একটা কারণ আমি এই প্রথমবার নিজের মনের কথাগুলো কাউকে অবলীলায় বলে দিতে পারছি এবং অনেক কিছুই বলার বাকি আছে এখনও দয়া করে চোখ থেকে ঘুম সরিয়ে মনোযোগ দিয়ে শুনো।

ঘুম ভেঙে এরকম অবাস্তব ঘটনার মুখোমুখি হয়ে তারার কিছুই যেন সত্যি বলে বিশ্বাস হতেই চাইছে না।ঢোক গিলে বললো, এটা স্বপ্নই আমি জানি।
নীল এবার ধমক দিয়ে বললো, বলছি তো স্বপ্ন না বার বার এক কথা কেন বলছো?চিমটি কেটে দেখো এটা স্বপ্ন না।
–কাকে চিমটি কাটবো?আপনাকে?
–নিজেকে কাটো।
তারা সত্যি সত্যি নিজের হাতে চিমটি কাটলো আর প্রচন্ড চমকে উঠে নীলের দিকে চোখ বড় বড় করে তাকালো।
নীল জোরে নিশ্বাস ছেড়ে বললো, বিশ্বাস হলো তো এবার?
তারা পুরোপুরি হুশে ফিরে এসেছে এতক্ষণে, কাঁপা গলায় বললো,কী বলতে চাইছেন আপনি?
–শুনলে তো বুঝবে কী বলতে চাইছি?
তারা অবাক চোখে তাকিয়ে রইলো নীলের দিকে।
নীল চোখ বন্ধ করে বললো, আমার তোমাকে চাই তারা।তোমাকে আমার লাগবেই।তোমাকে ছাড়া আমার চলবে না।তোমার সাথে পরিচয় হওয়ার আগে আমার মনে হতো আর কাউকে দরকার নেই আমার জীবনে।কিন্তু এখন মনে হচ্ছে জীবনের বাকি দিন গুলোতে তোমাকে আমার পাশে বড্ড প্রয়োজন।আজ তোমাকে যদি আমি ভালোবাসি না বলতে পারি মনে হচ্ছে দম বন্ধ হয়ে যাবে।আমি তোমাকে বড্ড বেশি ভালোবেসে ফেলেছি তারা।
নীল কথাগুলো বলে তারার সামনে হাটু গেড়ে বসে বললো,
ভোরের গাড়ো নীল রঙা আকাশের বুকে যদি এক টুকরো শুকতারার অস্তিত্ব দেখতে পাও,
তবে নীলের বুকেই শুকতারার ঠিকানা জেনে নিও।..
চলবে..
লিখা: উম্মেহানি মিম

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here