নীল_আকাশের_শুকতারা (২য় পর্ব)

0
1108

#নীল_আকাশের_শুকতারা
(২য় পর্ব)

নীরা তারাকে একটা ঘরে নিয়ে গেল।ঘরটাতে অসংখ্য বই পত্রে ভরপুর।একাডেমিক বই বাদেও বিভিন্ন রকম গল্প,উপন্যাসের বই রাখা বুক সেল্ফে।কিন্তু প্রত্যেকটা বই অগোছালো করে রেখে দেয়া।কিছু বই আবার বিছানায়, মেঝেতে ফেলে ছড়ানো ছিটানো।
ঘরের আরও কিছু জিনিস পত্র অযত্নে রাখা।
সব মিলিয়ে পুরো ঘরটাই অগোছালো।
নীরা ঘরের অবস্থা দেখে খানিকটা লজ্জাই পেল মনে হলো।মুচকি হেসে বললো,তারা এই ঘরটা হলো ভাইয়ার স্টাডি রুম।ভাইয়া ছাড়া এ ঘরে আর কেউ আসে না, মানে আশা নিষেধ।আমি যদি ভুলেও আসি ভাইয়া রাগ করে।সে জন্য ঘরটা গোছানোর সুযোগও পাই না।
কিন্তু এখন তো তোমার থাকার জন্য আর কোনো ঘর নেই, নিচের ঘর গুলোতে তো তুমি একা থাকতে পারবে না তাই বাবা বললো এই ঘরটা তোমাকে পরিষ্কার করে দিতে।
তারা একটু ইতস্তত করে বললো,নিচের একটা ঘরে আমি থাকতে পারতাম।আপনার ভাইয়া যদি রাগ করেন?
–আরে না ভাইয়া রাগ করলেও বাবার মুখের উপর কথা বলতে পারবে না।আর আমাকে আপনি আপনি করবে না। তুমি করে বলো।
চলো আমরা একসাথে ঘরটা গোছাই।
–আমি একাই পারবো।
–তা আবার হয় নাকি দুজনেই একসাথে করবো চলো।
নীরার সাথে তারার বেশ ভাব হয়ে গেল।দুজনে ঘন্টা ঘানেকের মধ্যেই পুরো ঘর পরিষ্কার করে একদম তকতকে-ঝকঝকে করে তুললো।
আরাফাত সাহেব এসে ঘরের বাইরে থেকেই দাঁড়িয়ে দেখছেন তারা বেশ হাসিখুশি হয়েই কাজ করছে।
উনি একটা সুস্থির নিশ্বাস ছাড়লেন।তবুও মনে মনে ততটা স্বস্তি পাচ্ছেন না।হালিমা বেগম তারাকে এই বাসায় রাখতে মোটেও আগ্রহ দেখাননি।বরং উনি চান না ডিভোর্সি বাবা মায়ের সন্তান ওনার সন্তানদের আশেপাশেই থাকুক।
এটা নিয়ে আরাফাত সাহেব আর হালিমা বেগমের মনোমালিন্য হয়ে গেছে।কীভাবে হালিমা বেগমকে মানাবেন উনি সত্যিই বুঝতে পারছেন না।আর এই পরিস্থিতিতে মেয়েটাকে বাসা থেকে বের করে দেয়াও সম্ভব না ওনার পক্ষে।উনি ওনার সিদ্ধান্তে অটল।
আরাফাত সাহেবকে দেখতে পেয়ে তারা দ্রুত বললো,আংকেল ভিতরে আসুন।
আরাফাত ভিতরে ঢুকলেন।ঘরটাকে চেনাই যায় না একদম পরিপাটি।
উনি নীরাকে ডেকে বললেন,অনেক বেলা হয়ে গেছে মা আয় খেতে দে।তারা মায়েরও নিশ্চয়ই ক্ষিদে পেয়েছে।
নীরা বাবাকে প্রশ্ন করলো,মা কোথায় বাবা?অনেক্ক্ষণ সারা শব্দ পাচ্ছি না।
–তোর মা শুয়ে আছে দেখ গিয়ে ডাক ওকে।
নীরা দ্রুত পায়ে হেটে চলে গেল।
আরাফাত সাহেব এগিয়ে এসে বললেন,ফ্রেশ হয়ে নাও মা।অনেক কাজ করেছো এবার খেয়ে নিবে।
তারা মুচকি হেসে বললো, আমি এখনই ফ্রেশ হয়ে আসছি আংকেল।

খাবার টেবিলে তারা, নীরা আর আরাফাত সাহেব বসে আছেন।হালিমা বেগমকে অনেক বার ডাকা সত্যেও উনি আসেননি।আরাফাত সাহেব বলছেন,তোমরা খাওয়া শুরু করো পরে নীলের মায়ের খাবার নীরা গিয়ে ওর মাকে দিয়ে আসবে।
নীরা আর আরাফাত সাহেব খাচ্ছেন কিন্তু তারা ভাতে হাত বুলিয়েই যাচ্ছে।
আরাফাত সাহেব লক্ষ করে তারাকে খানিকটা শাসন মেশানো কন্ঠেই বললেন,খাবার সব খেয়ে উঠতে হবে মা।তাড়াতাড়ি খাও।
তারা পরিষ্কার বুঝতে পারছে হালিমা বেগমের এরূপ আচরণের কারণ, সে জন্যই গলা দিয়ে ভাত নামতে চাইছে না।জোর করেই কয়েকটা খেলো।
আরাফাত সাহেব নীরাকে উদ্দেশ্য করে বললেন,তোর ভাইয়া কোথায় এখনও ফিরলো না?
নীরা পানির গ্লাসে চুমুক দিয়ে বললো,ভাইয়ার এক্সট্রা ক্লাস আছে আসতে আসতে বিকেল হবে।
আরাফাত সাহেব গম্ভীর ভাবে বললেন,কী এতো ক্লাস করে যে বিকেল হয়ে যায় বাসায় আসতে।
নীরা আর কথা বললো না।

খাওয়া শেষে তারা নিজের ঘরটাতে এসে আসরের নামাজ পড়লো।আল্লাহর কাছে হাত তুলে অনেক কান্নাকাটি করলো তারপর মনে হলো অনেকটাই ক্লান্ত।বিছানায় গিয়ে চাদর মুড়ি দিয়ে শুতেই ওর চোখ লেগে এলো।ঘুম ভাঙলো মুখের উপর ভারি কিছু একটা পড়ায়। ধরফরিয়ে আড়মোড়া ভাঙলো।চাদর ঘানিকটা ফাঁক করে তাকাতেই দেখলো লম্বা, ফর্সা গাল ভর্তি খোচা খোচা দাড়ি, একটা সুদর্শন ছেলে বিছানায় না তাকিয়েই বই গুলো একটা একটা করে ফেলছে বিছানায়।পরনে সাদা টিশার্ট আর কালো টাউজার।
তারা উঠে বসবে তখনই আরেকটা মোটা বই এসে পড়লো ওর উপর।
উফ বলে কুকিয়ে উঠে বসলো ও।নীল আচমকা আর্তনাদ শুনে ঘুরে তাকিয়ে তারাকে দেখে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে রইলো যেন ভিন গ্রহের প্রাণি দেখছে।
তারই পড়ার ঘরে একটা অচেনা মেয়ে শুয়ে ছিল।কেমন যেন অবিশ্বাস্য মনে হচ্ছে।নীল গলা চওড়া করে বললো,কে?
তারা দ্রুত উঠে দাড়িয়ে মাথার উড়না জড়িয়ে নিয়ে কাঁপা কাঁপা গলায় বললো,আমি শুকতারা মানে তারা।
নীল বিদ্রুপ করে বললো,কোন আকাশের শুকতারা?
তারা মাথা নিচু করে দাড়িয়ে রইলো কোনো জবাব দিলো না।
নীল আবারও বললো,জনাবা তারা আকাশ ছেড়ে মাটিতে কী করা হচ্ছে?আমার এই ঘরে সবার আসা বারণ বলেনি নীরা?
তারা নিঃশব্দে মাথা নাড়ালো।
নীল চেঁচিয়ে উঠলো,নীরা আমার ঘরটার এই অবস্থা কে করেছে?আমি আমার দরকারী বই গুলো খুঁজে পাচ্ছি না।আর এই মেয়েটা কে!
নীরা দৌড়ে এসে বললো,ভাইয়া তোকে বলা হয়নি এটা তারা।বাবার বন্ধু যে সাহেদ আংকেল ওনার মেয়ে।আজ থেকে ও আমাদের সাথেই থাকবে।
ওর থাকার জন্য তো আর ঘর ছিল না তাই বাবা বলেছে এই ঘরটা ওকে দিতে।
নীল গর্জন করে উঠলো কোথাকার কোন সাহেদ আংকেল তার মেয়ে আমাদের সাথে কেন থাকবে? তাও আবার আমার পড়ার ঘরে।তুই জানিস না আমি এই ঘরে কারোর আসা পছন্দ করি না।
নীলের চেচামেচি শুনে আরাফাত সাহেব এসে হাজির হলেন।হালিমা বেগমও এসেছেন।হালিমা মুখ বাকিয়ে বললেন,বলেছিলাম নীল পছন্দ করবে না।মেয়েটাকে এই ঘরে রাখার কী দরকার ছিল একে তো আপদ হয়ে এসেছে তার উপর আমার ছেলের পড়ার ঘরে জায়গা দিয়ে দিয়েছো।নিচের একটা ঘরে থাকলে কী এমন মহা ভারত অশুদ্ধ হতো।
তারা দূরে দাড়িয়ে থাকায় হালিমা বেগমের কথাগুলো শুনলো না।কিন্তু আরাফাত সাহেব স্পষ্ট শুনতে পেলেন।দাতে দাঁত চেপে নিজেকে সংযত করে এগিয়ে গিয়ে নীলকে উদ্দেশ্য করে বললেন,আমি বলেছি মেয়েটা এ ঘরে থাকবে তাই সে এখানে আছে।তোমার যা কিছু বলার আমাকে বলো একদম নীরাকে বা এই মেয়েটাকে বকাবকি করবে না।
নীলের গলার স্বর নরম হয়ে এলো।আস্তে আস্তে বললো,আমার অনেক দরকারী জিনিস পত্র আছে এই ঘরে।
–যা প্রয়োজনীয় নিজের ঘরে নিয়ে যাও।এ ঘরে এসে আর কখনও তারাকে বিরক্ত করবে না।
আরাফাত সাহেব কথাটা বলে হনহন করে বেরিয়ে গেলেন।
নীল কোনরকমে রাগ চেপে রয়েছে।হালিমা বেগম এগিয়ে এসে কর্কশ গলায় বললেন,নীল তোর যা প্রয়োজনীয় সব এই মেয়েকে বল তোর ঘরে নিয়ে গুছিয়ে রাখতে।
শুধু একজনের বাসায় উড়ে এসে জুড়ে বসলেই হয় না কিছু কাজ-টাজ করতে হয়।পায়ের উপর পা তুলে নিজের ঘরেই খাওয়া যায় না আর এটা তো পরের ঘর।
নীরা মায়ের কথায় আপত্তি জানিয়ে বললো,মা কী বলছো এসব?মেয়েটা মাত্র আজ এসেছে আমাদের বাসায়।ভাইয়ার যা দরকার আমি নিয়ে দিয়ে আসছি।
হালিমা এবার নীরাকে ধমক দিয়ে বললেন,তুই চুপ থাক।আয় আমার সাথে।
হালিমা নীরাকে টেনে নিয়ে চলে গেলেন।
তারা মাথা নিচু করে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে।
নীলের গলা শুনে কেঁপে উঠলো।
নীল কর্কশ গলায় বলছে, এই মেয়ে যা যা বইয়ের নাম বলি সব নিয়ে আমার ঘরে এসো।
তারা ভয়ে ভয়ে মাথা নাড়ালো।
নীল পড়ার টেবিলের উপর থেকে কাগজ কলম নিয়ে তারার হাতে গুজে দিয়ে বললো,যা যা বলি লিখো।
তারা কলম হাতে নিয়ে লেখা শুরু করলো।নীল দ্রুত একের পর এক বইয়ের নাম বলে চলেছে।
তারা দ্রুত লিখেও যেন ওর বলার মতো দ্রুত লিখতে পারছে না।তবুও হাল না ছেড়ে লিখছে।ত্রিশটার মতো বইয়ের নাম বলে এবার এই ঘরের কিছু জিনিস পত্রের নাম বলা শুরু করলো নীল।তারা একটা একটা করে সব গুলো লিখে নিলো।
এতো দ্রুত লিখতে গিয়ে তারার হাত যেন আর মানছে না। নীল জিনিস পত্রের নাম বলা শেষ করে বললো,দশ মিনিটের মধ্যে সবকিছু আমার ঘরে নিয়ে এসো।আমি ঘড়ি ধরে অপেক্ষা করছি।
কথাটা বলে ও দ্রুত পায়ে হেটে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
তারা কাগজের দিকে একবার তাকায় তো ঘড়ির দিকে আরেকবার তাকায়।ইতিমধ্যে এক মিনিট চলে গেছে।ও দ্রুত কাগজে লিখে রাখা বই গুলো সেল্ফ থেকে বের করে হাতে নিলো।অনেক ভাড়ি ভাড়ি বই। সবগুলো একসাথে নিয়ে যাওয়া সম্ভব না, দুই-তিন বারে নিয়ে যেতে হবে।কিন্তু নীলের ঘর কোনটা সেটাও তো জানে না।তারা অর্ধেক বই নিয়ে কোনমতে নীলের ঘর খুঁজতে লাগলো।নীরাকেও দেখা যাচ্ছে না।তারার মাথায় এলো নীরার ঘরটার কাছাকাছি নীলের ঘর হতে পারে তাই সেদিকে হাটা ধরলো।আর পেয়েও গেল দরজায় নীল দাঁড়িয়ে আছে।তারা দ্রুত ভিতরে গিয়ে বইগুলো রাখলো।নীল খানিকটা জোরেই বললো,আর মাত্র চার মিনিট বাকি আছে বাকি বইগুলো নিয়ে এসো এরপর আরও দশ মিনিটের মধ্যে জিনিস পত্র নিয়ে আসবে।
তারা এক প্রকার দৌড়েই আবার নিজের ঘরে গিয়ে বাকি বইগুলো নিয়ে এসে রাখলো।
তারা হাপাচ্ছে।নীলের মনে সামান্য সহানুভূতি পর্যন্ত নেই।চেঁচিয়ে বললো,সময় অপচয় করা আমি পছন্দ করি না বাকি জিনিস পত্র নিয়ে এসো তোমার পরের দশ মিনিট শুরু হয়ে গেছে।
তারা হাপাতে হাপাতেই দৌড়ে গিয়ে একটা একটা করে জিনিস পত্র এনে রাখলো নীলের ঘরে।
নীল কর্কশ গলায় বললো,হয়েছে দুই মিনিট জিরিয়ে নিয়ে আবার কাজ শুরু করবে।সব জিনিস পত্র আর বই গুছিয়ে রাখো।আরও দশ মিনিট দিয়ে গেলাম দশ মিনিট পর এসে যেন দেখি সব গোছানো হয়ে গেছে।
নীল হনহন করে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
তারা স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভাবছে একটা মানুষ কতটা নিষ্ঠুর হলে অচেনা একটা মানুষের সাথে এমন আচরণ করতে পারে।
আরাফাত আংকেলের মতো মানুষের ছেলে নীরার মতো মেয়ের ভাই এমন বদরাগী বিশ্বাস হতে চায় না।
তারার চোখদুটো ছলছল করে উঠলো।
অন্যের বাসায় থাকতে হলে এতটুকু কষ্ট তো সহ্য করতেই হবে।এরপর আর কী কী আছে কপালে কে জানে!
ঘড়িতে তাকিয়ে দেখলো দু মিনিট পেরিয়ে গেছে।তারা দ্রুত জিনিস পত্র গোছানো শুরু করলো।
চলবে…

লিখা: উম্মেহানি মিম

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here