#নুজাইরাহ,২য়_পর্ব
#written_by_Liza
নাফিজ আলম নুজাইরাহ’র মুখ চেঁপে ধরে ইশারায় মাথা নাড়িয়ে এসব কথা বলতে নিষেধ করে, নাফিজের মা আড় পেতে সবটা শুনে ফেলে, নাফিজের মা নাফিজের সামনে এসে দাড়ায় আর বলে “নুরা (নুজাইরাহ) কারে মা কইলো? কোন বেডিরে মা ডাকছে?”
নাফিজ তথমত খেয়ে বলে “না মা ওসব ছাড়ো, খেতে দাও”
নাফিজ আলমের মা ছেলের উপর আর কোনো কথা বললো না,খাবার আনতে চলে গেলো। নুজাইরাহ গাল টিপে হেসে বলে “পাপা বোকা”।
রাতে নাফিজ আলম খেয়ে নুজাইরাহকে বুকে নিয়ে শুয়ে পড়ে,নুজাইরাহ ঘুমিয়ে পড়েছে, নাফিজ আলম ভাবছে কিভাবে কি করা যায় তা। ভাবতে ভাবতে ভাবনার ঘোরে হারিয়ে গেলো
“আজ যদি নুজাইরাহ’র মা বেঁচে থাকতো তাহলে এ দিন দেখতে হতো না। এভাবে নুজাইরাহকে ভাইয়ের মেয়ের পরিচয় দিয়ে চলতে হতো না আমার।সবটাই আমার দোষ।আমি যদি সেই মহল্লায় আসাযাওয়া বন্ধ করে দিতাম তবে বিয়ে নামক সুত্রে দ্বিতীয় বার জড়াতে হতো না। হয়তো আল্লাহ ভাগ্যে এটাই রেখেছিলো। মেহেরীমার মামা খুব কৌশল করে বিয়েটা দিয়েছে।”
ভাবনার ঘোর ভেঙ্গে নাফিজ আলম নুজাইরাহকে শুইয়ে দেয় পাশে। নুজাইরাহ গুটিসুটি মেরে বুকে ডুকে পড়ে নাফিজ আলমের । নাফিজ আলম ভাবতে থাকে সেই দুর্ঘটনার কথা
“নাফিজ একজন সাধারণ পলিথিনের কাজ করতো,বড় বড় পলিথিন দিয়ে বিভিন্ন প্যাকেটজাত করে সাপ্লাই দিতো। মেহেরীমাদের মহল্লাই প্রায় অনেক নারী এই কাজে যুক্ত। পলিথিনের কাজ করে নিজের জীবিকা বহন করতো। মেহেরীমার পরিবার ও একই কাজে যুক্ত। সেই সুবাধে নাফিজ প্রায় পলিথিনের সাপ্লাই দিতে যেতো মহল্লায়। মেহেরীমা ছিলো সুন্দরী মার্জিত ধরণের। মেহেরীমা পরিবারের বড় মেয়ে, মেহেরীমারা দুই বোন এক ভাই। আর্থিক অবস্তার স্বচ্ছলতা তেমন নেই বললেই চলে। তাই মেহেরীমাদের পরিবার পলিথিনের কাজ করতো টুকটাক সংসার চালানোর জন্য। মেহেরীমার মামা ছিলো সবচেয়ে চালাক ব্যক্তি। মেহেরীমার জন্য একের পর এক বিয়ের ঘর আসতো কিন্তু তা আর বিয়েতে পরিনত হতো না, মেহেরীমারা গরীব ছিলো বলে রিজেক্ট হতো। এ নিয়ে দুশ্চিন্তার শেষ নেই মেহেরীমার বাবা-মায়ের। পুরো মহল্লায় মেহেরীমার পরিবারকে কেউ দেখতে পারতো না। যে পরিবার থেকে বিয়ের প্রপোজাল আসতো, মহল্লার লোকেরা ভাঙ্গচি দিতো। মেহেরীমার মামা সেকালের মানুষ। তিনি আর ধৈর্য ধরতে পারছেনা। তিনি নাফিজ আলমকে মনে মনে ঠিক করে মেহরীমার জন্য। নাফিজ আলম দেখতে সাদামাটা। মেহেরীমার মামা মনে মনে ফন্দি আটে,নাফিজ আলমের গলায় কিভাবে মেহেরীমাকে ঝুলোনো যায়। যেই বলা সেই কাজ। তাবিজের প্রথা তখন খুব অহরহ। তাবিজ করে নাফিজ আলমকে বশ করে মেহরীমার সাথে বিয়ে দিয়ে দেয়। নাফিজ আলম নিজের বৈবাহিক জীবন সম্পর্কে তার মামাকে জানালেও,তার মামা সেই কথাগুলো কানে নেয় নি। নাফিজ আলমকে বশ করে জোর করে মেহরীমার সাথে বিয়ে দিয়ে দেয়। এভাবে দিন পার হতে থাকে। নাফিজ আলমের সবটা যেনো এলোমেলো হয়ে গিয়েছে। নাফিজ আলম নিজের কর্মের প্রতি অনুতপ্ত হয়ে সবকিছু মেনে নেয়,যেহেতু বিয়ে হয়ে গেছে। মেহেরীমার জীবনটা নস্ট করতে চাইছিলো না আর। মেহেরীমার চাল চলনের উপর নাফিজ আলম মুগ্ধ হতে থাকে। মেহেরীমার মা ও মামা মিলেই নাফিজ আলমকে বশ করে। মেহেরীমার মামা নিজের কার্যসিদ্ধির জন্য নাফিজ আলমের আগের এক সংসার আছে সেই কথাটি মেহেরীমার মায়ের কাছ থেকে লুকিয়ে যায়। দেখতে দেখতে এ বিয়ের আজ ন’মাস। নাফিজ আলমের সাহস হয়ে উঠে না মেহেরীমাকে সত্যটা বলার। তবুও কি আর করার সত্য আজ হোক কাল প্রকাশ পাবেই”
নাফিজ আলম ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়ে, ভোর ফুটেছে। নুজাইরাহ’র ডাকে নাফিজ আলমের ঘুম ভাঙ্গে। আজ নাফিজ আলম জলদি তৈরি হয়ে মেহেরীমার বাড়িতে চলে যায়। আজ মেহেরীমাকে সে বাসায় নিয়ে আসবে। সব সত্য বলবে।
মেহেরীমা নাফিজ আলমকে সকাল সকাল ঘরে দেখে খুব অবাক। নাফিজ আলম অস্ফুট স্বরে বলে মেহেরীমাকে “জলদি তৈরি হও। বাড়ি যাবো।”
মেহেরীমা যেনো স্বপ্ন দেখছে,কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছে না। মেহেরীমা তৈরি হয়ে খাওয়াদাওয়া করে পুরো মহল্লাকে বিদায় দিয়ে নাফিজের সাথে বেরিয়ে পড়ে। মেহেরীমার মুখে স্নিগ্ধ হাসি বিদ্যমান, নাফিজের মুখে চিন্তার ছাপ। মেহেরীমা কিছু জিজ্ঞেস করলেই নাফিজ আলম মৃদু হেসে এড়িয়ে যায়।
বাড়িতে যাওয়ার পর দরজায় দাড়িয়ে আছে মেহেরীমা ও নাফিজ আলম। নুজাইরাহ দৌড়ে এসে মেহেরীমার কোলে ঝাপ দেয়। মেহেরীমা নুজাইরাহকে কোলে নিয়ে দু গালে চুমু খায়। সবাই মেহেরীমা ও নাফিজকে এভাবে দেখে অবাক পর্যায়ে। নাফিজ আলমের মায়ের মুখে কালো আধার যেনো ছেয়ে গেছে তাদের দেখে। পরক্ষণে নাতনীর খুশি দেখে ফিক করে হেসে দেয় নাফিজের মা।নাফিজের মা বলে উঠে “আও গো মা আও, বও ইগানো। (আসো মা আসো,বসো এখানে)”
মেহেরীমা মুচকি হেসে শাশুড়ী মায়ের কথা মতো পাশে বসে, নাফিজের মায়ের কোনো দুঃখ নেয়,কারণ ছোট্ট নুজাইরাহ তার নতুন মাকে দেখে খুশি। নুজাইরাহ’র জন্য সবটা মেনে নেয় নাফিজের মা।
নাফিজের দুই নিজের বড় বোন আছে,আর এক সৎ বড় ভাই আছে। সৎ বড় ভাই গ্রামে থাকে, বড় একবোন সেই গ্রামেই থাকে। নাফিজের মেঝো বোন নাফিজের সাথে থাকে। যদিও বিবাহিত তার বোন। স্বামী পরকিয়ায় লিপ্ত ছিলো বলে ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে। নাফিজের মেঝো বোনের দুই মেয়ে আছে। নাফিজ তাদের লালন পালন করেন। যৌথ পরিবার।
নাফিজের মেঝো বোন ভেঙ্গচি কেটে মেহেরীমাকে দেখছে, মেহেরীমার চোখ এড়ায় না। মেহেরীমা চুপচাপ বসে আছে আর ভাবছে
“শাশুড়ী তো মেনে নিয়েছে।তাহলে অন্য কে কি আমায় ভাবছে এটা আমার ভাবার বিষয় না।”
নাফিজের মেঝো বোন নাফিজকে বলে “কইত্তে এই বেডিরে উডাইয়া আনছোস?(কোত্থেকে এই মেয়েকে উঠিয়ে আনলি)”
নাফিজ কিছু না বলে এড়িয়ে যায়, নাফিজের মা মেহেরীমাকে বলে “মা কাফড়ডি ফাল্টাইয়া অন্য কাফড় পড়ো,যাও ঘরো যাও (মা কাপড় পাল্টে অন্য কাপড় পড়ো,যাও ঘরে যাও)”
নুজাইরাহ মেহেরীমাকে নিয়ে গেলো টানতে টানতে তার বাবার রুমে। মেহেরীমার সাথে নুজাইরাহ’র বেশ ভাব জমে গেছে।
অন্যদিকে নাফিজের মেঝো বোন বড় বোনকে ফোন দিয়ে সবটা জানায়, বড় বোন খুশিতে আটকানা, তার নুরা(নুজাইরাহ) মা পাবে। বড় বোনের এই খুশি যেনো নাফিজের মেঝো বোনের আর সইছিলো না। ফোন রেগে রেখে দেয়।
নাফিজের মেঝো বোন এবার বড় সৎভাইকে ফোন দিয়ে সব বলে “নাফিজ আরেকডা বেডি লইয়া আইছে ভাই, এই বেডি বাক্কা চালু বুঝা যায়। কেমনে তাড়ামু কও ছাইন। একটারে মাইরা রাস্তা কিলিয়ার করছিলাম।এহন আরেকটা হাজির। এডারে মারোন যাইবো না। তুমি একটা কিছু করো৷ এডা যেন আপনা আপনি যায় গা ভাইগা (নাফিজ আরেকটা মেয়ে নিয়ে এসেছে ভাইয়া,এই মেয়ে দেখতে বড্ড চালাক বুঝা যায়। কেমনে তাড়াবো বলো তো।একটাকে মেরে রাস্তা ক্লিয়ার করেছিলাম,এখন আরেকটা হাজির। এটাকে মারা যাবেনা।তুমি কিছু একটা করো। এটা যেনো নিজে নিজেই চলে যায় ভেগে)”
নাফিজের মেঝো বোনের কথা শুনে বড় ভাই বেশ চিন্তিত,কিভাবে বের করা যায় ফন্দি আটছে ভাইবোন মিলে।
মেহেরীমার সাথে সবার মোটামুটি ভাব জমেছে। নাফিজ মেহেরীমাকে সব সত্য জানিয়ে দেয়। মেহেরীমায় মাথায় যেনো বাজ ভেঙ্গে পরেছে।মেহেরীমা নিজেকে কোনোভাবে সামলে নেয়।মন থেকে সবটা মেনে নিতে না পারলেও নুজাইরাহ’র মুখের দিকে তাকিয়ে সবটা নিমিষেই হজম করে মেহেরীমা। মেহেরীমা নুজাইরাহ’কে নিজের মেয়ের মতো লালন পালন করতে শুরু করে। নুজাইরাহ’র সাথে মেহেরীমার সম্পর্ক হয় শক্তিশালী,এক কথায়
লোকে ভেবে নেয় তারা রক্তের সম্পর্কে আবদ্ধ। কেউ বুঝতেই পারে না নুজাইরাহ মেহেরীমার সতীনের মেয়ে।
এই সম্পর্ক যেনো নাফিজের মায়ের মনে জায়গা করে নিয়েছে। মেহেরীমাকে নিজের মেয়ের মতো আগলে রাখে নাফিজের মা। সুখের সংসার মেহেরীমার।
মেহেরীমার কোল জুড়ে আসে বছর খানেকের মধ্যে ছোট্ট পরী। যার নাম জুরাইনাহ,নুজাইরাহ’র ছোট বোন। নুজাইরাহ সকলের চোখের মনি,তেমন’ই জুরাইনাহ ও। কিন্তু বঞ্চিত হয় মেঝো ফুফুর আদর থেকে। মেঝো ফুফু নুরাইজাহ ও জুরাইনাহকে দেখতে পারতো না।
ঠিক তেমন’ই নুজাইরাহকে দিলজাহান বেগম মন থেকে মেনে নিতে পারে নি। সবার দৃষ্টি অগোচরে নুজাইরাহকে মারতো,এমন জায়গায় মারতো যেটা দেখানোর মতো নয়। নুজাইরাহ ভয়ে কখনো কেউকে কিছু বলতো না৷ নুজাইরাহ বড় হয়েছে। নুজাইরাহ’র ছ’বছর, জুরাইনাহ’র তিন বছর। দু’জনেই একে অপরের ঢাল। নুজাইরাহ বড় বোনের মতো জুরাইনাহ’কে আগলে রাখতো।
দিলজাহান বেগম নুজাইরাহ’কে দু চোখে সহ্য করতে পারতো না। নুজাইরাহ কে নাফিজের পাশে দেখলেই সবার আড়ালে মারতো,অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করতো। দিলজাহান বেগম চাইতো শুধু জুরাইনাহ’ই নাফিজের মেয়ে হিসেবে থাকুক৷ জুরাইনাহ যেনো নাফিজের চোখের মনি হয়।
চলবে…