নুজাইরাহ,৬ষ্ট_পর্ব (অন্তিম পাতা)

0
1205

#নুজাইরাহ,৬ষ্ট_পর্ব (অন্তিম পাতা)
#written_by_Liza

তোর বাবার জন্য তুই নস্ট হলি। যদি এখনো তোর স্মাগলারের সাথে প্রেম করার স্বাদ জাগে তবে ভুলে যাবি আমি তোর মা। আমি শুধু নুজাইরাহ’র মা।”

জুরাইনাহ পা ধরে নুজাইরাহ’র কাছ থেকে ক্ষমা চায়৷ এ দৃশ্য দেখে মেঝো ফুফুর পিত্তি জ্বলে যাচ্ছে। তিনি চাইছেন না কোনোভাবেই দু’বোনের মিল হোক। নুজাইরাহ জুরাইনাহকে ক্ষমা করে দেয়।

নুজাইরাহ বিকেলে নামাজ সেরে বারান্দায় দাড়িয়ে বই পড়ছে, বারান্দা থেকে সোজা রাস্তা দেখা যায়। এমন সময় রাস্তা পার হচ্ছিলো এক বুড়ো ভদ্রলোক। কাচা পাকা দাড়ি মুখে। সাদা পাঞ্জাবি পরনে। লাঠি ভর দিয়ে মসজিদের দিকে যাচ্ছে, নুজাইরাহকে দেখে কিছুক্ষণ দাড়িয়ে আবারো সোজা মসজিদের দিকে ছুটছে। নুজাইরাহ খেয়াল করলেও অতটা গুরুত্ব দেয় না।

নুজাইরাহ তার দাদিকে টিউব দিয়ে শরবত খাওয়াচ্ছিলো পাশে বসে,অমন সময় দরজার সামনে সেই লোকটি দাড়িয়ে হাপাচ্ছে আর বলছে “পানি, পানি”

নুজাইরাহ দাদিকে খাইয়ে উড়না দিয়ে মুখ মুছে দিয়ে তড়িঘড়ি পানি আনতে চলে গেলো। পানির গ্লাস হাতে নিয়ে এসে দেখে ঐ লোকটি নুজাইরাহ’র মায়ের সাথে সোফায় বসে কথা বলছে। নুজাইরাহ সালাম দিয়ে পানি এগিয়ে দেয়। লোকটি পানি খেয়ে নুজাইরাহ’র দিকে তাকিয়ে আছে। নুজাইরাহ’র অস্বস্তি লাগছে বেশ। নুজাইরাহ রুমে চলে যায়।

নাফিজ আলম রুম থেকে বেরিয়ে লোকটিকে দেখে ঘাবড়ে যায়। মনে মনে ভাবে “জুরাইনাহ কোনো কান্ড বাধিয়েছে নাকি। নাহলে বাসায় মানুষ কেন হঠাৎ”

লোকটি নাফিজ আলমকে বসতে বলে পাশে, নাফিজ আলম লোকটির কথায় পাশে বসে, বয়স্ক লোকটি হেসে বলে “আমি আপনার বড় মেয়ের জন্য আসছি ভাইসাব”

নাফিজ আলম কিছু বুঝতে না পেরে মেহেরীমাকে জিজ্ঞেস করে ইশারা দিয়ে। মেহেরীমা হেসে বলে “আমার নুরার জন্য বিয়ের ঘটকালি করতে এসেছে ইনি। আমার নুজাইরাহকে তার ছেলের বউ করে নিয়ে যেতে চায়। তুমি কি বলো?”

আমার কি বলার আছে। তোমার মেয়ের বিয়ের মত আছে কি না তুমিই ভালো করে জানো (নাফিজ)

আমার মেয়ে আমার উপরে যাবে না। বাবা হিসেবে তোমার দায়িত্ব তুমি পালন করো (মেহেরীমা)

বেশ,কথা বলে দেখা যাক। ছেলে ভালো হলে পাকা কথা সেরে নেওয়া যাবে (নাফিজ)

লোকটি মুচকি হেসে বলে
“ছেলেকে নিয়ে আসবো কাল। মেয়েকে বলে দিও”

রাতে মেহেরীমা নুজাইরাহকে সবটা জানায়, নুজাইরাহ’র যেহেতু পছন্দ ছিলো না। নুজাইরাহ তার দাদির মুখের দিকে তাকিয়ে সবটা মেনে নেয়।

ছেলেপক্ষ এরপরের বিকেলে দেখতে আসে, ছেলে নুজাইরাহকে দেখেই পছন্দ করে ফেলে। সেদিন’ই শরীয়ত মতে নুজাইরাহ’র বিয়ে হয়।
নুজাইরাহ’র বিয়ে হয়েছে শুনে কান্নারত চোখ দুটো এদিক ওদিক করে তাকাচ্ছে নুজাইরাহ’র দাদির।

নুজাইরাহকে হাতড়ে ধরে বুকের সাথে জড়িয়ে রেখেছে নুজাইরাহ’র দাদি। নুজাইরাহ কাঁদছে তার দাদির এই অবস্তা দেখে। নুজাইরাহ’র স্বামী দাদির মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে কানে কানে ফিস ফিসিয়ে বলে “আমি আছি দাদিমা। আমি নুজাইরাহ’র সব দায়িত্ব নিবো। নুজাইরাহ আমার স্ত্রী। আমি থাকতে ওর গায়ে কোনো আঁচ আসতে দেবো না”

নুজাইরাহ দাদি স্বস্তির জোরে শ্বাস নিয়ে চোখ বন্ধ করে নেয়। সারা বাড়ি কান্নার রোল পরেছে। নুজাইরাহ’র দাদি ঘুমাচ্ছে। মেহেরীমা নুজাইরাহকে জড়িয়ে ধরে পাগলের মতো কাঁদছে। মেহেরীমা কাঁদছে আর বলছে “আমি একা হয়ে গেলাম রে নুরা। আমি একা। আমি কিভাবে থাকবো রে তোরে ছাড়া। আমার যে ভীষণ কষ্ট হচ্ছে”

নুজাইরাহ কান্নায় ভেঙ্গে পরে। নুজাইরাহ’র মেঝো ফুফু বলে উঠে, “মাইয়ার বিয়া হইছে জামাইর বাড়ি আসল ঘর। এভাবে কান্দনের কি আছে। (মেয়ের বিয়ে হয়েছে স্বামীর বাড়িই আসল বাড়ি।এভাবে কান্নার কি আছে)”

নুজাইরাহ কান্না থামিয়ে চোখ মুছে দাড়িয়ে আছে। নুজাইরাহ’র মনে একটাই প্রশ্ন “কখনো কি ফুফু আমি তোমার মেয়ে হতে পারিনি? কখনো কি আমায় একটু ভালোবাসতে পারো নি? আমি কি এমন করেছিলাম আজকের দিনটাতেও তুমি আমাকে তাড়ানোর জন্য এমন করছো”

জুরাইনাহ সকলের মাঝখানে বলে উঠে “ফুফু তোমার শশুড়বাড়ি কই? আপু তো চলে যাবে। তুমি কেন এখানে? ও চলে যাবে কাঁদবো না?”

জুরাইনাহ’র মুখে কথা শুনে মেঝো ফুফুর রাগ দ্বীগুন বেড়ে গেলো। জুরাইনাহকে চড় মারতে যাবে অমন সময় নুজাইরাহ, জুরাইনাহকে কাছে টেনে নেয়।

রাগে দুঃখে মেঝো ফুফু রুমে চলে গেলো। বিদায় দিলো না নুজাইরাহকে। নুজাইরাহ’র স্বামী সবটা দেখে বুঝেই গিয়েছে নুজাইরাহ কোন হালে আগে ছিলো। নুজাইরাহ’র স্বামী প্রতিজ্ঞা করে মনে মনে
“আমি নুজাইরাহকে এতটা সুখী করবো, তার যে একটা বাজে অতীত ছিলো ভুলিয়ে দেবো।ইনশাআল্লাহ আপনার মতো ফুফি নুজাইরাহ’র লাগবে না।”

নুজাইরাহকে শশুড়বাড়িতে নিয়ে আসা হলো। শশুড় শাশুড়ীর চোখের মনি নুজাইরাহ। জুরাইনাহ আস্তে আস্তে পরিবর্তন হতে লাগলো। জুরাইনাহ দাদির সকল দেখাশোনা কর‍তে লাগলো। সংসারের দায়িত্ব জুরাইনাহ একা সামলাতে শুরু করলো।

বিয়ের দু-মাস পর রাত দেড়টার দিকে নুজাইরাহ’র কাছে খবর আসে নুজাইরাহ’র দাদি আর বেঁচে নেয়। নুজাইরাহ পাগলের মতো বাড়ি ছুটে যায়। গিয়ে দেখে নুজাইরাহ’র দেওয়া সাদা শাড়ি দিয়ে তার শরীর জড়িয়ে রাখা। নিষ্পাপ মুখ খানা ভেসে উঠেছে। পরম শান্তিতে ঘুমাচ্ছে তার দাদি।

নুজাইরাহকে জুরাইনাহ বলে, “দাদি মারা যাওয়ার আগে শাড়িটা চেয়ে নিয়েছে মায়ের কাছ থেকে। নিজে নিজেই গায়ে জড়িয়ে শাড়ির ঘ্রাণ নিচ্ছিলো। তোর দেওয়া শাড়িটি তার শেষকালে কাজে লাগলো৷”

নুজাইরাহ মাটিতে বসে পড়ে। মেহেরীমার জ্ঞান নেয়, দিলজাহান বেগম নুজাইরাহ’র দাদির লাশ দেখে বলতে লাগলো “তাড়াতাড়ি দাফন করো”

দাফন করা হলো গোসল দিয়ে, মেহেরীমাকে কোনোভাবে সামলে নেয় নুজাইরাহ৷ নুজাইরাহ ভেঙ্গে পরলে মেহেরীমা ভেতরে ভেতরে দুমড়ে মুচড়ে যাবে নুজাইরাহ তা জানে। মেহেরীমার হয়ে এ বাড়িতে কেউ কথা বলবে না। যে ছিলো সে আজ ছেড়ে চলে গিয়েছে।
মাসখানেক পর…

আস্তে আস্তে শোকের মায়া কাটিয়ে সবাই পূনরায় ঠিক হতে লাগলো। মেহেরীমার মনে পরলে আজো ডুকরে কেঁদে উঠে তার শাশুড়ী মায়ের জন্য।

নুজাইরাহ অন্তঃসত্ত্বা। মেহেরীমা তা জানার পর মেয়ের কোনো ক্ষতি না হয় এইজন্য নুজাইরাহকে নিয়ে আসে বাড়িতে৷ নিজ হাতে সকল সেবা করছে নুজাইরাহ’র। নাফিজ আলম নিজেই নিজেকে তিক্ত হয়ে বলে “সারাজীবন ভুল করেই গেলি।”

অনেকবার নুজাইরাহকে মারতে চেয়েছে তার ফুফু, কিন্তু পারে নি জুরাইনাহ’র জন্য।জুরাইনাহ সব প্লান ভেস্তে দিলো। জুরাইনাহ তার ফুফুকে গিয়ে বলে,
“আমার বোনের গায়ে আঁচ আসলে তোমার মেয়ের সংসার ভেঙ্গে দেবো। আমি সব জানি তুমি বড় ফুফুকে কিভাবে মেরেছিলে। সব শুনেছি তোমার আর বড় চাচার কথা।বাবাকে বলে এ বাড়ি থেকে বিদেয় করবো বলে দিলাম”

জুরাইনাহ’র এমন ধমকে ক্ষিপ্ত হয়ে জুরাইনাহকে চড় মারতে যায় তার আগেই নাফিজ আলম এসে হাত ধরে ফেলে আর বলে
“কি হয়ছে আপা। কিছু হইলেই আমার মাইয়াগোর গায়ে আত তুলতে যাও। কোনোদিন তো দেখলাম না তুমারে আমার মাইয়াগো লাইজ্ঞা টানতে।(কি হয়েছে আপা কিছু হলেই আমার মেয়েদের গায়ে হাত তুলতে যাও।কোনোদিন তো দেখলাম না তোমাকে আমার মেয়েদের জন্য টানতে)”

কি করছে তোর মাইয়া জানোস?(কি করছে তোর মেয়ে জানিস?) (মেঝো ফুফু)

হে বলো বলো ফুফি কি করেছি আমি। একবার বলো তারপর বাকিটা আমি বলতেছি (জুরাইনাহ)

মেঝো ফুফু কথা না বাড়িয়ে চলে যায়,জুরাইনাহ তার বাবাকে নুজাইরাহ’র ক্ষতির ব্যাপারে সবটা বলে দেয়। প্রথমে বিশ্বাস না করলেও পরে বিশ্বাস করে নাফিজ আলম।নাফিজ আলম কোনো রিয়েক্ট না করে। মেঝো বোনের মেয়ের জামাইকে বলে “তোমার শাশুড়ীকে তোমাদের সাথে রাখো আজ থেকে। তার যখন ছেলে নেয় তোমরা মেয়েদের জামাই’ই ওদের ছেলে। দরকার হলে আলাদা রাখো তোমার শাশুড়ীকে”

মামা আমি আগেই বলেছি মাকে এখানে নিয়ে আসবো আপনার ভাগ্নীর সাথে থাকবে। মা কিছুতেই রাজি হয়নি। (মেঝো ফুফুর মেয়ের জামাই)

ঠিকাছে আমি বলে রাজি করাচ্ছি,তোমরা বাড়িতে এসো কাল দাওয়াত রইলো (নাফিজ আলম)

পরেরদিন ভাগ্নী জামাই ও ভাগ্নী দাওয়াত খেতে এলো। নুজাইরাহ ও জুরাইনাহ বাড়িতে। মেহেরীমা রান্না বান্না করে মেহমান দারি করছে। মেঝো ফুফু তার মেয়েকে ইশারায় বলছে “তোরা যে আইবি আমারে আগে কইলি না ক্যান (তোরা যে আসবি আমায় আগে বললি না কেন?)”

নাফিজ আলম খাওয়াদাওয়া সেরে তার বোনকে সকলের সামনে বলছে
“দেখ আপা।আমি বুড়ো হচ্ছি বয়স আমার বাড়ছে। এভাবে চাকরি করা আমার পক্ষে সম্ভব না। অবসর নিচ্ছি। তাই তুমি তোমার মেয়ের বাড়িতে থাকবা দুটো ফ্লাট আছে। একটাতে তুমি থাকবা।”

মেয়ের জামাইর সামনে মেঝো ফুফু কিছু বলতে পারলো না।সন্ধ্যায় খাওয়া দাওয়া সেরে মেঝোফুফু একেবারের জন্য অন্য ফ্লাটে শিফট করে।

সময় খুব দ্রুত চলছে। নুজাইরাহ’র সংসার নিয়ে বেশ ভালোই আছে। নুজাইরাহ’র কোল জুড়ে ছোট্ট ফুটফুটে ছেলে আসে। এদিকে জুরাইনাহ’র বিয়ে হয়। জুরাইনাহ হাসবেন্ড মেহেরীমা ও নাফিজ আলমকে নিজের মা-বাবার মতো দেখাশোনা করে। কারণ জুরাইনাহ’র হাসবেন্ডের কোনো মা-বাবা নেই৷ এতিম ছেলে।

জুরাইনাহ’র হাসবেন্ড মেহেরীমা ও নাফিজকে নিজের মা-বাবার মতো আগলে রাখে। এদিকে নুজাইরাহ’র হাসবেন্ড মাসিক খরচ ও বাজার দেয়।

সংসার চলছে ফুলের মতো। নুজাইরাহ ও জুরাইনাহ দুজন’ই স্বামী সন্তান শশুড় শাশুড়ী নিয়ে ভীষণ খুশিতে দিন কাটাচ্ছে।

সমাপ্ত।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here