নেশা #পর্ব_০১ Tabassum_Kotha

0
2965

একে অপরকে আষ্টেপৃষ্ঠে জরিয়ে ধরে শুয়ে আছে নির্ঝর আর তৃষ্ণা। আদরে আদরে ভরিয়ে দিচ্ছে নির্ঝর তৃষ্ণাকে। দুজনের গায়ে একটা সুঁতোও অবশিষ্ট নেই। বেশ মধুর ভালোবাসায় পরিপূর্ণ একটা অন্তরঙ্গ মুহূর্ত কাটাচ্ছে দুজন।

সেই ভিডিও ফুটেজটি সামনের টিভির পর্দায় প্লে হচ্ছে। ভিডিও ফুটেজটি ঘোলাটে করা, তবে নির্ঝর আর আমার চেহারা খানিকটা বোঝা যাচ্ছে। নির্ঝর আর আমার ঠোঁটের গভীর চুম্বনের মুহূর্তে এসে ভিডিও ফুটেজটি পজ হলো। হলে উপস্থিত সবাই বেশ উৎসুক দৃষ্টিতে এই মিলন দৃশ্যটি দেখে যাচ্ছিল। অনেকে আবার হতবাক হয়েছিল এসব অশ্লীলতা দেখে। কিন্তু ভিডিও ফুটেজ টি এভাবে প্লে হওয়াতে একজন ব্যক্তি ভীষণ খুশি হয়েছে। সে আর কেউ নয়, নির্ঝর আহমেদ চৌধুরী। তার ভিলেন হাসি দেওয়া মুখখানা প্রমাণ করে দিচ্ছে এসবে সে ভীষণ খুশি হয়েছে।

হলের এক কোনায় হলুদ শাড়ি পরে দাড়িয়ে অঝোর ধারায় কেঁদে যাচ্ছি আমি। সারা গায়ে আমার কাঁচা ফুলের সাজ কিন্তু তবুও সাজ টা বৃথা মনে হচ্ছে। বিয়ের কনের এমন অশ্লীল ভিডিও সবার সামনে চললে কনের যেই অবস্থা হওয়া উচিত ঠিক সেই অবস্থাই হয়েছে আমার।

আমার ঘামে ভেজা ব্যথিত মুখটা নির্ঝরের চোখের সামনে জ্বলজ্বল করছে। অবশ্য আমার কষ্ট দেখে একটা পৈশাচিক তৃপ্তি পাচ্ছে নির্ঝর।

— গাইজ ভিডিও কোয়ালিটি টা কেমন ছিল? ইউ নো, আই ওয়ান্ট এভরিথিং পারফেক্ট। তাই ভিডিও টা হাই কোয়ালিটির বানিয়েছি। তবে তৃষ্ণাকে দেখার অধিকার শুধু আমার। তাই ভিডিও ব্লার করা। (নির্ঝর)

কারো মুখে কোনো কথা নেই। পরিস্থিতির ভয়াবহতায় উপস্থিত সবার মুখে তালা লেগে গেছে। নীরবতা কাটিয়ে তৃষ্ণার চাচি রত্না বেগম বলতে শুরু করলেন,

— ছিঃ ছিঃ তৃষ্ণা। এই দিন দেখার জন্য এতো কষ্ট করে তোকে মানুষ করেছিলাম?

— বিশ্বাস করো চাচি এসব মিথ্যে। (তৃষ্ণা)

— চোখের সামনে দেখার পরেও তুই একথা বলবি!

— এই ভিডিও মিথ্যা! এই মেয়েটা আমি নই! বিশ্বাস করো। তন্ময়! আপনি অন্তত বিশ্বাস করুন।

তন্ময় কিছু বলতে যাবে তার আগেই নির্ঝর আমাকে হেঁচকা টান দিয়ে তার বুকের সাথে মিশিয়ে নিলো। নিজেকে ছাড়ানোর জন্য ধস্তাধস্তি করছি কিন্তু নির্ঝরের বাহুডোর থেকে নিজেকে সরাতে পারছি না।

পাশে দাড়িয়ে থাকা তন্ময় চেচিয়ে উঠে বললো,
— ছাড়ুন তৃষ্ণাকে। বলা নেই কওয়া নেই কোথা থেকে এসে অসভ্যতা করছেন! ছাড়ুন তৃষ্ণাকে।

— হু আর ইউ? নির্ঝর আহমেদ চৌধুরীকে প্রশ্ন করার সাহস কোথায় পেলে?

— তৃষ্ণাকে ছাড়ো বলছি। আমি এখনই পুলিশ ডাকছি।

তন্ময়কে থামিয়ে দিয়ে নিজেই বলতে শুরু করলাম,
— আমাকে ছাড়ুন। আমার হলুদের ফাংশনে এসে যা সিনক্রিয়েট করার তা তো করেছেনই। এখন এখান থেকে বিদায় হন।

— এসব কি বলছো জান? তুমি কি ওদের সবাইকে ভয় পাচ্ছো? ভয় পেয়ে আমাদের ভালোবাসার কথা স্বীকার করছো না?

— কিসব বলছেন আপনি? ভয় আপনাকে! আর আমাদের ভালোবাসা? আমাদের মধ্যে এই ধরনের কোনো সম্পর্ক নেই। ছাড়ুন আমাকে।

— তুমি একদম ভয় পেও না জান। এরা আমাদের কিছু করতে পারবে না। তোমার বয়ফ্রেন্ডের এতো টাকা আর পাওয়ার আছে যে এখানে দাড়িয়ে দাড়িয়ে উপস্থিত সবাইকে কিনে ফেলতে পারবে।

— চুপ করুন আপনি। বেরিয়ে যান এখান থেকে।

নিজেকে নির্ঝরের বাহুডোর থেকে ছাড়িয়ে সামনে যেতেই নির্ঝর আবার আমার হাত ধরে টান দিয়ে নিজের সাথে মিশিয়ে নেয়। নির্ঝরের বুকে এসে পরতেই নির্ঝর তার একহাত দিয়ে আমার কোমড় চেপে ধরে। আমি কিছু করার আগেই নির্ঝর আমার ঠোঁট দুটো তার ঠোঁটের দখলে নিয়ে নেয়।

হলে উপস্থিত সবার চোখ কোটর থেকে বেরিয়ে যাবার উপক্রম। হলুদে আসা মেহমানরা ফ্রিতে তামাশা দেখছে আর ঠাট্টা বিদ্রুপ করছে। দৃশ্যটা তাদের সর্বোচ্চ বিনোদন দিচ্ছে।

.
তন্ময়ের একটা ফোন কল আসাতে সে একটু দূরে গিয়েছিল। ফোন রেখে হলের ভিতরে আসতেই তৃষ্ণা আর নির্ঝরকে চুম্বনরত অবস্থায় দেখে তন্ময়ের মাথায় রক্ত উঠে যায়। তন্ময় এক ছুটে গিয়ে নির্ঝর কে ধাক্কা দিয়ে তৃষ্ণা আর নির্ঝরকে আলাদা করে। টাল সামলাতে না পেরে তৃষ্ণা মেঝেতে পরে যায়। তন্ময় পুনরায় নির্ঝরকে আঘাত করতে এগিয়ে গেলে নির্ঝরের বডিগার্ডরা তন্ময়কে আটকে দেয়। কিন্তু নির্ঝরের চোখের ইশারায় তারা থেমে যায়।

নির্ঝর নিজেকে সামলে তার স্যুট টা ঠিক করে একটা ভিলেন হাসি দেয় আমার দিকে তাকিয়ে। আমি এখনও মেঝেতে পরে অশ্রু বিসর্জন দিয়ে যাচ্ছি। তন্ময় রাগে ফুসছে কিন্তু কিছু করতে পারছে না। নির্ঝর রত্না চাচির হাতে একটা খাম ধরিয়ে দিয়ে সেখান থেকে চলে গেলো।

.
তৃষ্ণার হলুদের অনুষ্ঠান পুরো মাটি করে দিয়ে চোখে মুখে প্রশান্তির ছাপ নিয়ে নির্ঝর গাড়িতে গিয়ে বসলো।

গাড়ি ছুটে চলেছে আপন গতিতে। জানালার কাঁচের বাইরে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে নির্ঝর। বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে। কাঁচ নামানো থাকায় মাঝে মধ্যে দুই এক ফোঁটা বৃষ্টির পানি নির্ঝরের মুখের উপর ছিটে আসছে।
.
.
.
.
.
.
ওয়াশরুমে শাওয়ারের নিচে বসে আছি। শরীরে লেগে থাকা হলুদগুলো পানির স্রোতের সাথে ধুয়ে যাচ্ছে। একটু আগে নিচে যেই ড্রামাটা হলো সেটার কথা ভাবতেই আমার চোখ ভিজে যাচ্ছে। প্রতিটা মেয়ের জন্য তার বিয়ে জীবনের সবচেয়ে সুন্দর মুহূর্তের মধ্যে একটি। আর আমার বিয়ে! বিয়ের আগের দিন আমার আপত্তিকর ভিডিও সবার সামনে দেখানো হয়েছে। ভিডিওতে দেখানো মুখটা যে আমার নয় এটা এক মুহূর্তের জন্য প্রমাণ করতে পারলেও নির্ঝরের সবার সামনে কিস করার পর নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করার আর কোনো রাস্তা নেই।

পরনে থাকা কাঁচা ফুলের গয়না গুলো টেনে ছিড়ে ফেললাম। বড্ড জ্বালাচ্ছে এগুলো, কাটার মতো বিঁধছে। বাইরের দরজায় ধুমধাম বারি পরছে। রত্না চাচি বাজখাই গলায় চেচিয়ে যাচ্ছেন।

— তৃষ্ণা দরজা খোল! আজ তোর একদিন কি আমার একদিন। চরিত্রহীন মেয়ে কোথাকার। নাগরের সাথে কুকীর্তি করে এখন আমার মান সম্মাণ ধুলোয় মিশিয়ে দিলি!

চাচি অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করে যাচ্ছে। অবশ্য দোষটা তার নয়। আমার মতো অনাথের উপর এতো দয়া করেছেন, তার প্রতিদানে তাকে অপমান পেতে হলো! চাচির কথায় পাত্তা না দিয়ে লম্বা একটা শাওয়ার নিয়ে বেরিয়ে এলাম। দরজার বাইরের চেচামেচি কমে গেছে, মানে চাচি ক্লান্ত হয়ে চলে গেছে। ভেজা চুলগুলো বালিশে মেলে দিয়ে হাত পা ছড়িয়ে শুয়ে পরলাম। দুচোখের কার্ণিশ বেয়ে অশ্রুকণা গড়িয়ে পরছে। নির্ঝর একটা ঝড়ো হাওয়ার মতো আমার জীবনে এসে সবকিছু উলোট পালোট করে দিয়ে গেলো। আর আমি কিছু করতেও পারলাম না। কাল আমার বিয়ে ছিল, সে বিয়েটা কি আর হবে? তন্ময় কি আর আমাকে মেনে নেবে?

দরজায় আবার খটখট শব্দ করছে, কিন্তু এবার চাচি আসেন নি। কারণ চেচামেচির শব্দ নেই। দরজা খুলতেই একটা বাচ্চা মেয়ে হুরহুর করে ঘরের ঢুকে পরলো। মেয়েটা তিতলি, আমার কলিজার টুকরা। তিতলি তার ছোট ছোট হাতে করে নিয়ে আসা খাবারের প্লেটটা বিছানায় রাখতে রাখতে বললো,

— মামনি, তুমি নাকি আজকে সারাদিন কিছু খাও নি!

— তুমি কিভাবে জানলে মামনি?

— বাবাই বলেছে। কাজটা কি তুমি ঠিক করেছো বলো?

— না মামনি। ভুল হয়ে গেছে। এত্তোগুলা সরি!

— হুহ এখন ঠিক আছে। জলদি জলদি খেয়ে নাও তো।

তিতলি নিজের হাতে আমাকে খাইয়ে দিচ্ছে। আমার মতো একটা মেয়েকে যে কেউ এতোটা ভালোবাসতে পারে সেটা তিতলিকে না দেখলে বিশ্বাস করতে পারতাম না। পুরো পৃথিবীর চোখে আমি খারাপ কিন্তু একমাত্র তিতলির চোখে আমি তার আদর্শ মা।

” মা মেয়ে এক হয়ে গেলে আর আমি একা পরে গেলাম! That’s not fair!”– দরজায় হেলান দিয়ে তন্ময় কথাটা বললো।

— তিতলি মামনি তুমি ঘুমিয়ে পরো অনেক রাত হয়েছে।

— ওকে মামনি।

তিতলি চলে গেলে তন্ময় আমার কাছে এসে বসলেন।

— আই এম সরি। নিচে যা কিছু হলো। কিন্তু বিশ্বাস করুন ভিডিও তে মেয়েটা আমি নই। আমি এতোটা খারাপ নই।

— রিলাক্স তৃষ্ণা। আই ট্রাষ্ট ইউ। আর কালকে যথা সময়েই আমাদের বিয়েটা হবে। যে যতো প্ল্যানিং ই করুক আমাদের বিয়েটা হবেই।







বিছানায় শরীর এলিয়ে দিয়ে সিলিং এর দিকে তাকিয়ে আছে নির্ঝর। মুখে তৃপ্তির হাসি তার। তবুও বুকের বা পাশটায় ঝড় বয়ে যাচ্ছে। এই ঝড়ের কোনো কারণ সে খুঁজে পাচ্ছে না। এসি করা রুম, পর্যাপ্ত পরিমাণ ঠান্ডা আবহাওয়া। তবুও ঘেমে নেয়ে একাকার হয়ে গেছে সে। অকারণেই সব হচ্ছে তার সাথে আজকাল।

” নির! কোথায় ছিলে সারাদিন?” — দরজার সামনে দাড়িয়ে অত্যন্ত সুন্দরী একটা মেয়ে নির্ঝরের উদ্দশ্যে প্রশ্নটা ছুড়লো।

মেয়েটার আগমনের আভাস পেয়ে নির্ঝর উঠে বসলো।

— স্নিগ্ধা! তুমি এখানে?

— কেনো আসতে পারি না বুঝি?

— সেটা তো বলি নি! কখন এলে?

— এইমাত্র। জানো কতোবার ফোন করেছি তোমাকে! আম্মু তোমাকে অনেকবার ফোন করেছিল তুমি ফোন ধরো নি। তাই আমাকে ফোন দিয়েছে যে বিয়ের তারিখ কবে ঠিক করবে?

স্নিগ্ধার কথা শুনে নির্ঝরের চোখে মুখে চিন্তা এসে ভর করলো। কিছুক্ষণ চিন্তিত হয়ে বসে থেকে নির্ঝর উত্তর দিলো,
— লুক স্নিগ্ধা! কিছুদিন আমি খুব বিজি থাকবো। তাই এখন বিয়েটা করা সম্ভব হচ্ছে না। দুই মাস সময় পেলে খুব ভালো হতো।

নির্ঝরের মুখে দুই মাস ওয়েট করার কথা শুনে স্নিগ্ধার মন খারাপ হলেও কিছু না বলে হাসি মুখে মেনে নিলো। শত হলেও ভালোবাসার মানুষটার আবদার বলে কথা!

চলবে..

#নেশা
#পর্ব_০১
Tabassum_Kotha

[নতুন গল্প কেমন লাগছে জানাবেন। আপনাদের ভালো লাগলে সামনে কন্টিনিউ করবো🤗। ভুল-ত্রুটি ক্ষমার চোখে দেখবেন। ধন্যবাদ]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here