#নেশা
#পর্ব_০৩
#Tabassum_Kotha
ঘুমের ঘোরে মনে হচ্ছে কেউ আমাকে জরিয়ে ধরে ব্লাউজের হুক খুলছে। সারারাত চেয়ারে বাঁধা অবস্থায় কান্না করছি। একটু আগেই চোখ লেগেছে। পিঠে লোকটার স্পর্শ ক্রমাগত বাড়তে থাকলে আমার ঘুম পুরোপুরি ছুটে যায়। চোখ খুলতেই দেখি নির্ঝর আমার উপর আধ শোয়া হয়ে আছেন আর আমি বিছানায় শুয়ে আছি।
নির্ঝরকে একটা ধাক্কা দিয়ে আমার উপর থেকে সরিয়ে আমি উঠে বসলাম। নির্ঝর এমনিতেই ড্রাংক ছিল, ধাক্কা দেওয়াতে টাল সামলাতে না পেরে নিচে পরে যায়। ব্লাউজ কাঁধের উপর উঠিয়ে ব্ল্যাংকেট টা গায়ে জরিয়ে কোনোমতে শরীরটা আড়াল করলাম। নির্ঝর রক্তিম চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। চোখ দিয়ে মনে হচ্ছে আগুন ঝরছে, আর সেই আগুন আমাকে ঝলসে দেবে। ভীষণ ভয় করছে, উনার চোখ মুখ দেখে মনে হচ্ছে আবার কোনো শাস্তি দেবেন।
নির্ঝর উঠে এসে আমার চুলের মুঠি চেপে ধরে দাঁতে দাঁত চেপে বললেন,
— অনেক সাহস হয়েছে তোমার তাই না! আমাকে! নির্ঝর আহমেদ চৌধুরীকে ধাক্কা দেও!
— আই এম সরি। আমি আপনাকে ধাক্কা দিতে চাই নি কিন্তু আপনি যা করছিলেন সেটা ঠিক না। আপনাকে থামানোর জন্যই,,
— চুপ একদম চুপ! তোমাকে আমি কিনে নিয়েছি। আমার যা ইচ্ছা তোমার সাথে আমি তাই করবো।
চুল টেনে ধরায় ব্যথায় আমার চোখ দিয়ে পানি পরছে।
— আমার উপর কারো অধিকার নেই। আমাকে কেউ কিনতে বা বেঁচতে পারবে না। আমি কোনো পণ্য নই।
— তুমি কোনো পণ্য নও তবে তুমি আমার প্রোপার্টি। একটা বিষয় ভেবে দেখেছো? তুমি কতোটা ভ্যালিওলেস! তোমার দাম মাত্র পাঁচ লাখ টাকা! এতো কম দামি তুমি?
কথাটা বলেই নির্ঝর বিকট হাসলেন। নির্ঝরের কথায় আমার কান দিয়ে রক্ত বের হওয়ার উপক্রম। একটা মানুষ এতোটা নিচু কিভাবে হতে পারে।
নিজের সম্পর্কে এসব কথা শুনতে আমার ভীষণ কষ্ট হচ্ছে কিন্তু কিছুই করতে পারছি না। বড্ড অসহায় মনে হচ্ছে নিজেকে। নির্ঝর আমার চুলের মুঠি ধরা অবস্থাতেই কিছুক্ষণ আমার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন। তার দৃষ্টিতে আমার জন্য আকাশ সমান ঘৃণা জমে রয়েছে। এই ঘৃণা তার করা প্রতিটি দুর্ব্যবহারের থেকেও বেশি কষ্ট দিচ্ছে আমাকে। কিছুক্ষণ এভাবে থেকে উনি আমার চুল ছেড়ে দিয়ে ব্ল্যাংকেটে টান দিলেন।
— কি করছেন? দয়া করে আমার এতোবড় সর্বনাশ করবেন না!
— ডোন্ট বি সিলি বেবস্। তোমার মতো একটা রাস্তার মেয়েকে নির্ঝর আহমেদ চৌধুরী স্বপ্নেও তার বেড পার্টনার বানাবে না। সো নিজেকে এতোটা ইমপোর্ট্যান্স দিও না।
— তাহলে কেনো আটকে রেখেছেন আমাকে? যেতে দিন। মুক্ত করে দিলেই তো পারেন।
— হুশ! তুমি আমার ভালোবাসা নও। তুমি আমার নেশা! ভালোবাসাকে ছেড়ে মানুষ বাঁচতে পারে, কিন্তু নেশা কে ছেড়ে বাঁচা অসম্ভব। তোমার নেশা করেই আমি মরতে চাই।
— আর আমি মুক্তি চাই। যেতে দিন আমাকে। আর যদি মুক্তি দিতে না পারেন তবে মেরে ফেলুন।
— নাহ। তোমাকে আমি মরতে দেবো না কখনও। আর শান্তিতে বাঁচতেও দেবো না।
— কেনো!!
নির্ঝর আমার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে ব্ল্যাংকেট টা সরিয়ে আমার কাঁধটা উন্মুক্ত করলেন। আমি চোখমুখ খিচে ধরে আছি। এখনই বুঝি আমার সব শেষ হয়ে যাবে। কিন্তু তখনই বাম কাঁধে ভীষণ জ্বালা পোড়া অনুভব করলাম। চোখ খুলতেই দেখলাম নির্ঝর আমার কাঁধে এন্টিসেপটিক লাগিয়ে দিচ্ছেন। কাঁধে রক্ত শুকিয়ে আছে। হয়তো কেটেছিল। অবশ্য আমি টের পাই নি।
.
অনেকক্ষণ সময় নিয়ে খুব সাবধানতাবশত কাঁধের রক্ত পরিষ্কার করে এন্টিসেপটিক ক্রিম লাগিয়ে দিলেন উনি। এই মুহূর্তে নির্ঝরকে অনেক কেয়ারিং মনে হচ্ছে। কাল রাতের উনি আর এখনকার উনার মধ্যে কতো তফাত্!
— আঁচল টানার সময় সেফটিপিনে অসাবধানতাবশত কেটে গিয়েছিল। কিছুক্ষণ আগেই দেখেছিলাম। তাই তোমাকে বিছানায় এনে ব্লাউজটা খুলার চেষ্টা করছিলাম। আই এম সরি।
নির্ঝরের মুখ থেকে সরি শুনে কেনো যেনো নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছি না। এই দুইদিনে আমাকে এতো টর্চার করেছে এই লোক। আর আজ কি না সামান্য কাটা ঘাঁ এর জন্য সরি বলছে! আবার নিজ হাতে ড্রেসিং করিয়ে দিলো!
নির্ঝর ফার্ষ্ট এইড বক্স রেখে আলমারি খুলে একটা প্যাকেট বের করে আমার হাতে ধরিয়ে দিলেন।
— কিছুক্ষণ পর ফ্রেশ হয়ে এটা পরে নিও। এই ডাওন মার্কেট লাল শাড়ি আমার বাড়ির কাজের লোকও পরে না। এই পোশাকে যেনো তোমাকে আর না দেখি। এখন ঘুমাও। নয়তো আবার বেঁধে রাখতে বাধ্য হবো।
শরীর খুব ক্লান্ত থাকায় উনার সাথে কথা না বাড়িয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দিলাম। কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘুমপরী আমাকে নিজের মধ্যে বিলীন করে নিলেন।
.
.
.
.
.
দুপুরের দিকে ঘুম থেকে উঠতেই নিজেকে একা ঘরে আবিষ্কার করলাম। নির্ঝর আশেপাশে নেই, এটাই সুবর্ণ সুযোগ এখান থেকে পালিয়ে যাওয়ার। বিছানা ছেড়ে উঠে দৌড়ে দরজার কাছে গিয়েও আমাকে হতাশ হয়ে ফিরতে হলো। দরজা বাইরে থেকে লক করা। ব্যালকোনির কাচও লক করা। এখান থেকে পালানোর আর কোনো সুযোগ নেই। এই বন্ধ দরজার জাল থেকে কি আমি আর মুক্তি পাবো না!
কিছুক্ষণ থম মেরে দাড়িয়ে থেকে ওয়াশরুমে চলে গেলাম। শাওয়ারের নিচে দাড়িয়ে বিগত দুই দিনে আমার জীবনে যা যা হয়েছে সবকিছু একসাথে করে হিসাব মেলানোর চেষ্টা করছি। মুহূর্তেই সব লন্ডভন্ড হয়ে গেলো। আর এসব হয়েছে নির্ঝরের জন্য। কখনও ক্ষমা করবো না তাকে আমার এতোবড় ক্ষতি করার জন্য। আমার জীবনের সবচেয়ে বড় খুশি উনি ছিনিয়ে নিয়েছেন!
.
ফ্রেশ হয়ে নির্ঝরের দেওয়া মেরুন শাড়িটা পরে ভেজা চুলে বিছানায় বসে আছি। তখন নির্ঝর আর তার সাথে একটা মেয়ে রুমে ঢুকলো। মেয়েটার হাতে খাবার প্লেট। নির্ঝরের চোখের ইশারায় মেয়েটা খাবার প্লেট আমার সামনে রেখে চলে গেলো।
— হ্যাভ ইট। মেডিসিন নিতে হবে।
— আমার আপনার দয়া চাই না। আমাকে শুধু যেতে দিন। আর কিছু চাই না আমার।
নির্ঝর আমার দিকে ঝুঁকে দাঁতে দাঁত চেপে বললেন,
— আই ডোন্ট লাইক রিপিটিং মাই সেল্ফ। আমাকে রাগিও না। এর ফল ভালো হবে না। এখন যদি খাবার টা না খেয়েছো তাহলে শাস্তির জন্য রেডি হয়ে যাও।
পৃথিবীর সবচেয়ে শান্ত হুমকি দিয়ে উনি আমার ঠিক সামনের সোফায় বসে পরলেন। ভয়ে বড়সড় একটা ঢোক গিলে আমি খাবার প্লেট হাতে নিলাম। কাল সকাল থেকে না খাওয়া তাই ভীষণ ক্ষুধা পেয়েছিল। তাই আর ডান বাম না তাকিয়ে গপাগপ গিলতে শুরু করলাম। প্রায় অর্ধেক খাওয়া শেষ করে মাথা উচু করতেই দেখলাম নির্ঝর এক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। উনার তাকানো দেখে খাওয়ার স্পিডটা একটু কমিয়ে অন্য দিকে ঘুরে বসলাম। এভাবে তাকিয়ে থাকলে খাওয়া যায় নাকি!
.
খাওয়া শেষে উনি আমাকে কিছু মেডিসিন খাইয়ে দিলেন যাতে কাঁধে ইনফেকশন না হয়। ঔষধ খাওয়ানো শেষে আচমকা নির্ঝর আমাকে কোলে তুলে নিলেন। অবাক হয়ে চোখ বড়বড় করে তাকিয়ে আছি উনার দিকে। হঠাত এতো ভালোবাসা কিভাবে উতলে উঠলো আমার জন্য উনার মনে। আবার প্রেমে টেমে পরলো না তো আমার! কিন্তু আমাকে ভুল প্রমাণ করে দিয়ে উনি আমাকে চেয়ারে বসিয়ে দিয়ে বাঁধতে শুরু করলেন।
— আপনি আবার আমাকে বাঁধছেন কেনো? ছাড়ুন আমাকে যেতে দিন। বিয়ে ভাঙতে চেয়েছিলেন দেখেন বিয়ে হয় নি। এখন কেনো আমাকে কয়েদি বানিয়ে রেখেছেন?
— ভুলে গেছো? তোমাকে বাঁচতেও দেবো আবার মরতেও দেবো না।
— কিন্তু কেনো? কি শত্রুতা আমার সাথে আপনার?
— কে শত্রুতা জানতে চাইছো? তাও আবার তুমি? লিভ ইট। তুমি একটা খারাপ মেয়ে। তাই তোমার সাথে এতো কথা বলার ইচ্ছা আমার নেই।
— আমই যখন এতোই খারাপ তাহলে কেনো আটকে রেখেছেন? ছেড়ে দিন।
— তুমি আমার নেশা, তৃষ্ণা। আর নেশা খারাপ হলেও সেটা ছাড়া যায় না।
আমি কিছু বলতে যাবো তার আগেই বাইরে থেকে একটা মেয়েলি কন্ঠ ভেসে এলো। নিকষ কালো অন্ধকারে মনে হলো একটা আশার আলো ফুঁটে উঠেছে। আমি চিত্কার করতে যাবো তার আগেই নির্ঝর আমার মুখে স্কচটেপ লাগিয়ে দিলেন। কষ্টে আমার ভিতরটা দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে। একটা মানুষ কতোটা খারাপ হলে এমনটা করতে পারে! উনি দরজা বাইরে থেকে বন্ধ করে চলে গেলেন। এদিকে আমি চেয়ারে হাত পা বাঁধা অবস্থায় বসে আছি। ভীষণ কান্না পাচ্ছে। হঠাত করেই আমার ছোট্ট পৃথিবীতে এতো কষ্ট এসে জমা হলো!
.
” স্নিগ্ধা তুমি এখানে?” — নির্ঝর ঘর থেকে বেরিয়ে সিড়ি দিয়ে নামতে নামতে নিচে দাড়ানো স্নিগ্ধাকে বললো।
— তুমি দিন দিন বড্ড পচা হয়ে যাচ্ছো। ভুলে গেছো আজকে আমাদের ঘুরতে যাওয়ার কথা ছিল!
— ওহ। আই এম সো সরি স্নিগ্ধা। আসলে কাজের চাপে একদমই ভুলে গিয়েছিলাম।
— তুমি সব ভুলে যাও। তোমাকে মজাটা বোঝাবো তবে বিয়ের পর। আঁচলের সাথে বেধে রাখবো।
— ওকে রেখো। এখন চলো যাই।
নির্ঝর স্নিগ্ধাকে সাথে নিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলো। তারা স্নিগ্ধার পছন্দের রেষ্টুরেন্টে যায়। পুরো সন্ধ্যা একসাথে কাটানোর পর রাত ৮ টার দিকে স্নিগ্ধা কে বাড়িতে ড্রপ করে নির্ঝর তার বাড়িতে চলে আসে।
নির্ঝর ঘরে ঢুকতেই দেখে তৃষ্ণা চেয়ারেই ঘুমিয়ে আছে। তৃষ্ণার কাছে গিয়ে হাটু ভেঙে বসে পরে সে। তৃষ্ণার মুখ থেকে স্কচটেপ টা আলতো করে খুলে দিলো নির্ঝর। তৃষ্ণার চোখে মুখে এসে পরা চুলগুলোকে আঙুল দিয়ে সরিয়ে তৃষ্ণার মুখটা উন্মুক্ত করলো।
তৃষ্ণার মুখে স্থির দৃষ্টি রেখে তৃষ্ণাকে নিখুঁত ভাবে পর্যবেক্ষণ করছে নির্ঝর। কাল রাতে ঠোঁটে ক্লিপ চেপে কেটে দেওয়া জায়গা কালচে হয়ে আছে। তৃষ্ণার চুলগুলো কানের পিঠে গুজে দিয়ে ঠোঁটে হালকা করে ছুঁয়ে দিলো নির্ঝর। কাটা জায়গায় ঠান্ডা হাতের স্পর্শ পেয়ে ঘুমের মাঝে কেপে উঠে তৃষ্ণা। ততক্ষণাৎ হাত সরিয়ে উঠে দাড়ায় নির্ঝর। আলমিরা থেকে টাওয়াল বের করে ওয়াশ রুমে চলে যায় সে।
.
লম্বা একটা শাওয়ার নিয়ে বেশকিছুক্ষণ পর বের হয় নির্ঝর। তৃষ্ণা আগের ভঙ্গিতেই ঘুমিয়ে আছে। নির্ঝর একটু এগিয়ে গিয়ে তৃষ্ণার বাঁধন খুলে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে সিগারেটের প্যাকেট আর মদের বোতল নিয়ে ব্যালকোনিতে চলে যায়।
রাতের গভীরতার সাথে সাথে অন্ধকার পাল্লা দিয়ে বাড়ছে। নির্ঝর তার চিরচেনা ভঙ্গিতে হাতে মদের গ্লাস আর আঙুলের ভাঁজে সিগারেট নিয়ে রকিং চেয়ারে বসে আছে। মদের গ্লাসে চুমুক দিয়ে আর মাঝে মধ্যে সিগারেটে টান দিচ্ছে। সিগারেটের ধোয়া গুলো রাতের আঁধার তার মধ্যে মিশিয়ে নিচ্ছে। বেশকিছুক্ষণ সময় ব্যালকোনিতে কাটিয়ে দিয়ে মদের বোতল প্রায় অর্ধেক শেষ করে উঠে পরলো নির্ঝর। ঢুলু শরীরে ঘরে গিয়ে বিছানায় ঘুমন্ত তৃষ্ণাকে দুচোখ ভরে কিছুক্ষণ দেখলো। তৃষ্ণার দিকে ঝুঁকে তৃষ্ণার কপালে একটা চুমু খেয়ে তৃষ্ণাকে আষ্টেপৃষ্ঠে জরিয়ে ধরে ঘুমিয়ে পরলো নির্ঝর।
চলবে..
[ভুল-ত্রুটি ক্ষমার চোখে দেখবেন। ধন্যবাদ।]